স্বরূপ-জ্ঞান


অয়ি নন্দতনুজ! কিঙ্করং
পতিতং মাং বিষমে ভবাম্বুধৌ ।
কৃপয়া তব পাদপঙ্কজ-
স্থিতধূলীসদৃশং বিচিন্তয় ॥ ৫ ॥
অনুবাদঃ
হে নন্দতনুজ! আমি তোমার নিত্যদাস । তথাপি আমি নিজ কর্মদোষে এই জন্ম-মৃত্যুর সংসার-সাগরে নিমজ্জিত হয়েছি । এই পতিতাধমকে তুমি দাস বলে গ্রহণ কর এবং তোমার শ্রীচরণের একটি ধূলিকণারূপে মনে কর ।

অমৃত-প্রভা ভাষ্যঃ

এই শ্লোকে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু প্রার্থনা করেছেন, হে নাথ! আমার প্রতি কৃপা কর। আমি তোমার কৃপাকটাক্ষের পিয়াসী! আমি নিজের কি করে ভাল করতে হয় তাও জানি না। তাই তোমার করুণা চাই। কৃপা করে আশ্রয় দাও, তোমার প্রেমের রাজ্যে প্রবেশ করতে দাও। তুমিই ত আমার রক্ষাকর্ত্তা সর্বস্ব। আমি তোমার আশ্রয় চাই।
তিনি কে ? আমরা ত ভগবানের কত প্রকার স্বরূপের কথা শাস্ত্রে শুনে থাকি। কিন্তু আমরা ভগবানের সেই মধুর, সুন্দর স্বরূপের কাছে এসেছি—কৃষ্ণের কাছে এসে গিয়েছি। সে কৃষ্ণ নন্দমহারাজের আদরের দুলাল। তিনি কেবল বৃন্দাবনেই থাকেন আর কোথাও ঐ মধুর হতে সুমধুর নন্দদুলালকে পাওয়া যায় না। এককালে মহান্ পণ্ডিত এবং শ্রেষ্ঠ ভক্তশিরোমণি শ্রীল রঘুপতি উপাধ্যায় মথুরাতে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর দর্শনের জন্য এসেছিলেন। সেখানে উভয়ের মধ্যে ইষ্টগোষ্ঠীতে শ্রীকৃষ্ণের মাহাত্ম্য ও মাধুর্য্যের আলোচনা হয়েছিল।
শ্রীমন্ মহাপ্রভু জিজ্ঞাসা করলেন, “আমরা কাকে আমাদের ইষ্টদেব বলে আরাধনা করব ? জীবনের চরম লক্ষ্য কি ? ইত্যাদি।
শ্রীরঘুপতি উপাধ্যায় উত্তরে বললেন,—
শ্রুতিমপরে স্মৃতিমিতরে ভারতমন্যে ভজন্তু ভবভীতাঃ ।
অহমিহ নন্দং বন্দে যস্যালিন্দে পরং ব্রহ্ম॥
জগতে যারা জন্ম-মৃত্যুভয়ে ভীত, তারা শ্রুতি বা বেদের নির্দেশে চলুক, অপরে মহাভারতাদি স্মৃতিশাস্ত্র অনুসরণ করুক, কিন্তু আমি সেই নন্দরাজার বন্দনা করি, যাঁর আঙ্গিনায় পরংব্রহ্ম ছোট শিশুটি হয়ে খেলা করেন ।
বর্ণাশ্রমধর্ম পালনকারীরা বৈদিক উপদেশ পালন করে সামাজিক জীবনযাপন করে। সাধারণ জনতা স্মৃতির অনুসরণ করে। এই ভাবে সকলেই ঈশ্বর সম্পর্ক রেখে দৈহিক কর্ত্তব্য পালন করে। আর যাঁরা জাগতিক কামনা-বাসনাকে জয় করে আধ্যাত্মিক জীবনযাপন করতে চায়, তারা উপনিষদের অনুসরণ করে। কিন্তু রঘুপতি উপাধ্যায় বলেন, আমি ঐ সবকে তোয়াক্কা করি না। আমি আমার হৃদয়ের প্রেমবৃত্তির অনুসরণ করব। মস্তিষ্ক-কসরতের কোন প্রয়োজন আমার নাই। আমার বিচারে বাস্তব শান্তি হৃদয়ের ব্যাপার, মস্তিষ্কের নয়। আর আমার হৃদয় কেবল নন্দমহারাজকেই চায়। শাস্ত্রে বলেন, “কৃষ্ণই পরাৎপর পরতত্ত্ব পরংব্রহ্ম, এবং সেই পরম্বহ্ম নন্দমহারাজের আঙ্গিনায় হামাগুড়ি দিয়ে খেলা করেন। আমি ত’ বাস্তব পরম সত্যস্বরূপকে সশরীরেই দেখতে পাই ।”
নন্দ কি করে পরতত্ত্ব পরংব্রহ্মকে এইভাবে বশ করলেন ? শ্রীমদ্ভাগবতের ১০।৮।৪৬ শ্লোকে ভক্তরাজ পরীক্ষিত মহারাজ অপূর্ব্ব বালক সাধু ব্রহ্মবিৎ শুকদেব গোস্বামীকে এই প্রশ্নই করেছিলেন,—
নন্দঃ কিমকরোদ্ ব্রহ্মন্ শ্রেয় এব মহোদয়ম্ ।
যশোদা বা মহাভাগা পপৌ যস্যাঃ স্তনং হরিঃ॥
হে ব্রহ্মজ্ঞ! আপনি ত’ সর্বদা ব্রহ্মানন্দে লীন। জগতের কোন জড় সত্তার বোধ আপনার নাই । কারণ আপনি সর্বদা ব্রহ্মানন্দে মগ্ন। জড় জগতের প্রতি আপনার চেতনা কখনও দৃক্পাতও করে না। আর আপনিই বলেন, কৃষ্ণই চরম পরম সত্যস্বরূপ। আমি একটা কথাই জিজ্ঞাসা করি প্রভো! নন্দ কি এমন সাধনা করেছিলেন, তিনি পরম সত্য স্বরূপের এমনকি পরিচয় পেয়েছিলেন যাতে সেই পরমপুরুষ তাঁর এতই আপন হয়ে গেলেন যে, তিনি তাঁর পুত্রত্ব স্বীকার করলেন, তাঁর আঙ্গিনায় হামাগুড়ি দিয়ে খেলা করলেন। মনে হয় তিনি নন্দমহারাজের একেবারে বশীভূত হয়ে গেলেন ?এ কি রকম ? এটা ত’ অত্যন্ত আশ্চর্য্যের বিষয়! এও কি সম্ভব ?
পরাৎপর পরমতত্ত্ব মা যশোদার স্তন্যপান করেন ?
যোগী, ঋষি, তপস্বী জ্ঞানীগণ বলেন যে, এক এক সময় তাঁরা উপাস্য তত্ত্বের ক্বচিৎ সাক্ষাৎ পেয়ে থাকেন সমাধি অবস্থায়। তারপরে হঠাৎ তাঁরা ফিরে আসেন। অধিক সময় ধরে তাঁরা সেই স্তরে থাকতে পারেন না। তাহলে সেই পরতত্ত্ব মা যশোদার কোলে বসে তাঁর স্তন্যপান করেন ? যদি এটা সত্য, আর এও যদি সম্ভব, তা হলে আমরা সেই সহজ পথটি বেছে নেবো না কেন—যাতে সেই পরংব্রহ্মের সঙ্গে আমাদের এতটা আত্মীয় সম্পর্ক হয়ে যেতে পারে।
তাই রঘুপতি উপাধ্যায় তাঁর প্রার্থনায় দম্ভের সঙ্গে বলেন, আমি শাস্ত্রের এত শত সূক্ষ্ম চুলচেরা বিচারের গোলকধাঁধায় ঢুকতে চাই না। আমি মাত্র সেই নন্দ ও তাঁর পরিজনের কাছে শরণাগত হয়ে যাই—নন্দ যেখানে বড় কর্ত্তা গৃহের মধ্যে, তাঁদের পরিবারের একজন হয়ে যেতে চাই ।
শ্রুতি-স্মৃতি নির্দিষ্ট কর্ত্তব্য-কর্ম করলে উত্তম লোকে যাওয়া যায় । আর কর্ম যোগে ছেড়ে দিয়ে জ্ঞানমার্গে মুক্তির জন্য সাধনা করা যেতে পারে। কিন্তু যদি আরও উন্নততর স্তরের সাধু-গুরু—যেমন নন্দ মহারাজ ও তাঁর পরিবার—এঁদের একজন হয়ে গেলেই আমরা শরণাগতিদ্বারা সেই প্রেমের রাজ্যে পৌঁছে যেতে পারি।
আমার সাধারণ জ্ঞান আমার পরমার্থ সম্পর্কে বিশ্বাস এই কথাই বলে, যদি সেই পরতত্ত্ব এতই দুর্লভ হয়েও তাঁকে বাস্তব, একেবারে ধরাছোঁয়ার মধ্যে আপনজনরূপে—হৃদয় নিয়ে পেতে পারি, তবে মিছিমিছি এই ঝামেলার মধ্যে যাওয়ার দরকারটাই কি ? যদি কেউ বলে যে, চিলে কানটা নিয়ে গেছে, তবে কানে হাত দিয়ে না দেখে চিলের পেছনে দৌড়াবার দরকার কি ? তাই যদি পরতত্ত্বকে এতই সহজে এতই আপন করে পাই তবে এখানে সেখানে দৌড়াবার দরকার কি ? যদি এটা জানতে পারি যে, ঐ দুর্লভ পরতত্ত্ব কৃপাকরে তাঁর যাবতীয় মাধুর্য্য ও চমৎকারিতা নিয়ে আমার এত নিকটতর হয়ে নেমে আসেন—যা সিদ্ধ মহাপুরুষগণ প্রত্যক্ষ অনুভব করেছেন, পেয়েছেন, তাহলে আমি আর সেই তপস্বী, নির্বিশেষবাদী জ্ঞানী ও ত্যাগী বৈরাগ্যবাদীদের মত মরীচিকার পেছনে শুধু দৌড়াদৌড়ি করি কি জন্যে ?
এটা ত’ সাধারণ জ্ঞান। ক্রান্তদর্শী মহাপুরুষগণ ও শাস্ত্র বলেন যে, নন্দনন্দন কৃষ্ণই পরংব্রহ্ম—এটি ত’ খুব সোজা কথা। আর আমরা যখন সেই সোজা কথাটা বুঝবার স্তরে পৌঁছে গেছি, তখন আমরা ত’ সোজাই কৃষ্ণকে বলতে পারি—হে নন্দ-নন্দন কৃষ্ণ! প্রেম রাজ্যের রাজা! আমি তোমারই প্রেম ও করুণা চাই। আমি তোমারই দাস। আমি ত বুঝেই রেখেছি—অনুভব করেছি, তোমার সাথে আমার স্নেহ-সম্বন্ধ আছেই। আমি তোমারই আশ্রয়ে আছি। কিন্তু অবস্থাগতিকে আমি এখন অসুবিধায় পড়ে গেছি । আমায় এমন কতকগুলি শত্রু ঘিরে রয়েছে, যারা কিছুতেই ছাড়ে না, তোমার কাছ থেকে দূরে সরিয়ে নিতে চায়, সবসময় তোমার সেবা করি—এটা তারা চায় না—তোমার সেবায় নানপ্রকার বিঘ্ন ঘটায়। তবুও ত’ আমি জানি আমার অন্তরে তুমিই আমার প্রভু—তুমিই আমার সর্বস্ব। তোমার সঙ্গ না হলে আমার হৃদয় কিছুতেই শান্তি পাবে না। তাই তোমার কাছে আর্তি জানাই—তোমার কৃপা না হলে আমি এ দুর্দ্দৈব থেকে নিষ্কৃতি পেতে পারব না—এ বন্ধন আমার কাটবে না।

আত্মার স্বরূপ—সূর্য্যের কিরণকণাসদৃশঃ

এখানে বলা হয়েছে “আমার মনে হয় আমি তোমার সঙ্গে নিত্যযুক্ত নই যদি তা হত, তা হলে, আমার এ বিচ্ছেদ অসম্ভব। আমি ত’ তোমার স্বাংশ অবতারও নই। অন্যান্য অবতারবর্গ কৃষ্ণের স্বাংশ, কিন্তু জীবাত্মা ত বিভিন্নাংশ। শ্রীমদ্ ভগবদ্ গীতায় শ্রীকৃষ্ণ বলেন যে, জীব তাঁর নিত্য অংশ। কৃষ্ণের তটস্থা শক্তি থেকে জীবের উৎপত্তি।
“কৃষ্ণের তটস্থা শক্তি ভেদাভেদ-প্রকাশ”
এবং জীব সূর্য্যের কিরণকণের মত, অতি সূক্ষ্ম পরমাণু সদৃশ কৃষ্ণ শক্তির অংশবিশেষ। কিন্তু এখানে ভক্ত বলেন, ‘আমি ত কিরণকণ সদৃশও নই, আমি তোমার পদধূলির একটি কণা, তোমার শ্রীঅঙ্গ-জ্যোতির একটি কণাসদৃশও আমি নই।’ এইভাবে শ্রীমন্মহাপ্রভু আমাদের হয়ে বলতে চাইছেন যে, আমাদের প্রার্থনা এইরূপই হওয়া উচিত। আমি তোমার অচ্ছেদ্য অংশাংশ—এত বড় কথা বলার সাহস আমার নাই। আমি সত্যিই তোমা থেকে বিচ্যুত একটি ক্ষুদ্র ধূলিকণা, কিন্তু তবুও তোমার করুণাই আমি চাই । তাই আমার প্রতি দয়া কর। তোমার কাছে আমার এ দাবীকে একটা বিশেষ কৃপা বলেই স্বীকার কর। তোমার সাথে যে কোনও একটা সম্বন্ধ জুড়ে দিও, তা যতই ছোট হোক না কেন। কিছুই যদি না পার, তবে এইটুকু দয়াই কর! তোমার শ্রীচরণের একটা ধূলিকণাও করে নিও—এই আমার নিবেদন!

Leave a comment

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.