শঙ্করাচার্য্যের পিতার নাম শিবগুরু, মাতার নাম সতীদেবী (মতান্তরে ভদ্র)। তাঁহার জন্মস্থান-দক্ষিণাত্যের কেরল-প্রদেশের কালাদি (কাল্টি) গ্রামে। ঐ গ্রাম পূর্ণা-নদীর তীরে অবস্থিত। এই মতই প্রসিদ্ধ; কিন্তু ‘শঙ্করবিজয়’ অন্য মত প্রকাশ করেন যে, শঙ্করের মাতার নাম বিশিষ্টা, পিতা বিশ্বজিৎ। বিশিষ্টা-মহাদেবের আরাধনায় সৰ্ব্বদা নিযুক্ত থাকতেন। তার পতি বিশ্বজিৎ তাতে তাকে পরিত্যাগ করে, সন্ন্যাস-ধৰ্ম অবলম্বন করেন। এই সময় দেবাদিদেব মহাদেব জ্যোতিঃরূপে মুখবিবর দিয়ে বিশিষ্টার উদরে প্রবিষ্ট হন। তাতেই গর্ভ-সঞ্চার হয়; আর সেই গর্ভে স্বয়ং শঙ্কর শঙ্করাচার্য রূপে জন্মগ্রহণ করেন। মহাপুরুষদের আবির্ভাব সম্বন্ধে অনেক স্থানেই এরকম অলৌকিক কাহিনী প্রচলিত আছে। জন্মকাল সম্বন্ধেও এমন বিভিন্ন মতান্তরের শেষ নেই। এক গণনায় শঙ্করাচাৰ্য্য খৃষ্ট জন্মের ৪৬৯ বৎসর পূর্বে আবির্ভূত হয়েছিলেন বলে প্রতিপন্ন হয়; আবার অন্য প্রকার গণনায় খৃষ্টীয় নবম শতাব্দীতে তার আবির্ভাব-কাল নিৰ্দ্ধারিত হয়ে থাকে। সূক্ষ্ম-গণনায় পণ্ডিতেরা কেউ বা ৭৮৮ খৃষ্টাব্দে, কেউ বা ৬৬৮ খৃষ্টাব্দে শঙ্করাচার্যের জন্মকাল নির্দেশ করেন। শঙ্করাচার্য্যের আবির্ভাব কাল সম্বন্ধে এরকম মতান্নতর ঘটার প্রধান কারণ,-শক, সন প্রভৃতির গণনায় গণ্ডগোল। ‘শঙ্করবিজয়’ গ্রন্থে তার জন্ম সন লেখা নেই; লেখা আছে, তাঁর জন্ম-সময়ে বৃহস্পতি কেন্দ্রে, রবি মেষ রাশিতে, শনি তুলা রাশিতে এবং মঙ্গল মকর রাশিতে সংস্থিত ছিলেন। “এ মন্তব্যে নানারকম গণন হতে পারে। মতান্তরের এই এক প্রধান কারণ। অন্য কারণ,-বিভিন্ন স্থানে প্রাপ্ত উদ্ভট-শ্লোকে শঙ্করের আবির্ভাব-কাল-নির্ণয়ের প্রয়াস। একটি উদ্ভট শ্লোক পাওয়া যায়,
“দুষ্টাচারবিনাশায় প্রাদুর্ভুতো মহীতলে। স এব শঙ্কারাচাৰ্য্যঃ সাক্ষাৎ কৈবল্যদায়কঃ॥ নিধিনাগেভবহ্ন্যব্দে বিভবে শঙ্করোদয়ঃ। অষ্টবর্ষে চতুৰ্ব্বেদান্ দ্বাদশে সৰ্ব্বশাস্ত্রকৃৎ॥
ষোড়শে কৃতবান ভাষ্যং দ্বাত্রিংশে মুনিবভ্যগাৎ॥
কল্যব্দে চন্দ্ৰনেত্রাঙ্কবহ্ন্যাব্দে গুহাপ্রবেশঃ। বৈশাথে পূর্ণিমায়ান্ত শঙ্করঃ শিবতামগাৎ॥
এই শ্লোকটি ‘নাস্তিকত্রাস’ গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত। দাক্ষিণাত্যে বেলগ্রামে হাতে লেখা পুঁথি মধ্যে এই শ্লোকটি পাওয়া যায়, পণ্ডিতেরা শঙ্করাচার্য্যের আবির্ভাবের ও তিরোভাবের কাল স্থির করে থাকান। ৩৮৮৯ কল্যব্দে(নিধিনাগেভবহ্ন্যব্দে) তাঁহার জন্ম এবং ৩৯২১ কল্যব্দে (চন্দ্রনেত্রাঙ্কবহ্ন্যব্দে) তার শিবত্ব-প্রাপ্তি নির্দিষ্ট হয়। এই মতের উপরই অধিকাংশ বিদেশি পণ্ডিত আস্থা স্থাপন করে গেছেন। কিন্তু এই অপেক্ষা প্রবল যুক্তিপূর্ণ যে মত, সে মতের ভিত্তিস্থান দ্বারাবতী মঠের পিণাকী-চিহ্নিত লিপি। সে লিপির কিছু অংশ এই-
“যুধিষ্ঠিরশকে ২৬৩১ বৈশাখ শুক্লপঞ্চম্যাং শ্রীমচ্ছঙ্করাবতারঃ।
যুধিষ্ঠিরশকে ২৬৩৬ চৈত্রগুক্লনবম্যাং তিথাবুপনয়নম্।
যুধিষ্ঠিরশকে ২৬৩৯ কাৰ্ত্তিকশুক্লৈকাদশ্যাং চতুর্থাশ্রমস্বীকারঃ।
যুধিষ্ঠিরশকে ২৬৪০ ফাল্গুনগুক্লদ্বিতীয়ায়াং গোবিন্দপাদাদুপদেশঃ।
তত আরভ্য ২৬৪৬ জ্যৈষ্ঠ কৃষ্ণ ৩০ পৰ্য্যন্তং বদর্য্যাশ্রমে ষোড়শভাষ্যপ্রণয়নম।
যুধিষ্ঠিরশকে ২৬৪৭ মার্গকৃষ্ণদ্বিতীয়ায়াং মণ্ডনেন সহ বাদারম্ভঃ।
যুধিষ্ঠিরশকে ২৬৪৮ চৈ, শু, ৪ মণ্ডনপরাজয়ঃ।
যুধিষ্ঠিরশকে ২৬৪৯ চৈ, শু, ৯ মণ্ডনমিশ্রস্যোত্তমাশ্রমগ্রহণম্।
যুধিষ্ঠিরশকে ২৬৫০ চৈ, শু, ৩ দিগ্বিজয়মহোৎসবারম্ভঃ।
যুধিষ্ঠিরশকে ২৬৫৪ পৌ, শু, ১৫ হস্তামলকাচাৰ্য্যস্য শৃঙ্গপুর পীঠেহভিষেচনম্।
যুধিষ্ঠিরশকে ২৬৬৩ কা, শু, ২৫ নিখিলজগদ্ধারকো ভগবান্ শঙ্করো ব্ৰহ্মাদ্য তীর্থে নিজ শরীরেণৈব বিমানমাস্থায় কৈলাসং জগাম।”
এ হিসাবে, ২৬৩১ যুধিষ্ঠিরাব্দে আবির্ভাব এবং ২৬৬৩ যুধিষ্ঠিরাব্দে তিরোভাব। এই অনুসারে শঙ্করাচাৰ্য্য খৃষ্ট-পূর্ব পঞ্চম শতাব্দীতে আবির্ভুত হয়েছিলেন।জন্ম-গ্ৰহণের পর জাতকর্ম সমাপন মাত্র শিশু শঙ্করাচার্য্য চারটি মহাবাক্য উচ্চারণ করেন। সেই মহাকাব্য-চতুষ্টয়,- “অহং ব্ৰহ্মাস্মি’, ‘তত্ত্বমসি’, ‘প্রজ্ঞানং ব্রহ্ম,’ ‘আয়মাত্মা ব্ৰহ্ম’। পিতা শিবগুরু এই শ্রুতিসার মহাকাব্য-চতুষ্টয় সদ্যোজাত শিশুর মুখে উচ্চারিত হতে শুনে বিস্ময়-সাগরে নিমগ্ন হলেন। শিশুর অপূর্ব কান্তি-মনোহর রূপ! দেশ-দেশান্তর হতে সাধুসন্ন্যাসী ও ব্ৰাহ্মণরা দলে দলে শিশুকে দেখতে আসলেন। একাদশ দিনে শুভলগ্নে শিশুর নামকরণ হল। দশ দিনের শিশু শঙ্করাচাৰ্য্য, দুই বৎসরের বালক অপেক্ষাও হৃষ্টপুষ্ট ও শক্তিমান হয়ে উঠলেন। প্রথম বর্ষে শঙ্করের ভাষা-শিক্ষা সমাপন হল। পঞ্চম বর্ষের মধ্যেই শঙ্করাচাৰ্য্য, ব্যাকরণ, পুরাণ, অলঙ্কার প্রভৃতিতে পারদর্শিতা লাভ করলেন। উপনয়নের আগেই শঙ্করের পিতৃবিয়োগ ঘটে। জননী ভদ্রাদেবী পতির পারলৌকিক কাজ সমাপন করে, কিছুদিন পরে পুত্রের উপনয়নের ব্যবস্থা করলেন। পঞ্চম বর্ষে উপনয়ন শেষে ব্রহ্মচৰ্য্য অবলম্বনে শঙ্কর গুরুগৃহে শাস্ত্র অনুশীলনে প্রবৃত্ত হলেন। অল্পদিনেই বেদ, বেদাঙ্গ, দর্শন, শ্রুতি, স্মৃতি প্রভৃতিতে অসাধারণ ব্যুৎপত্তি প্রকাশ পেল। গুরুগৃহ হতে প্রত্যাবর্তন করে শঙ্কর কিছুদিন জননীর সেবা-পরিচর্য্যায় এবং ব্রাহ্মণের নিত্যকর্ম অনুষ্ঠান যাগযজ্ঞ কাজে ব্ৰতী হন। সেই সময় বহু বিদ্যার্থী শঙ্করের নিকট শিক্ষালাভের জন্য আগমন করেন। উপনয়নের পর হতেই সন্ন্যাসাশ্রম গ্রহণের জন্য শঙ্করের মন একাত্ত উৎসুক হয়; কিন্তু জননীর আপত্তির কারণে কিছু দিন তার সে সঙ্কল্প কাজে পরিণত হয় না। এই সময়ে এক দিন নদীতে স্নান করতে গেলে, এক বৃহৎ আকার কুমীর শঙ্করকে আক্রমণ করে। শঙ্কর জননী কোনরকমে কুমীরের গ্রাস থেকে সন্তানকে মুক্ত করতে পারছেন না।
শঙ্কর তখন জননীকে বলেন,-“আমায় সন্ন্যাস-গ্রহণের অনুমতি প্রদান করলে কুম্ভীর আমায় পরিত্যাগ করতে পারে। কুম্ভীররূপী মহেশ্বর যেন শঙ্করকে বিশ্ব-সংসারের কাজে নিযুক্ত হওয়ার জন্য আহবান করছেন,-শঙ্করের উক্তিতে এই ভাব প্রকাশ পায়। পুত্রের প্রাণের মায়ায় জননী শঙ্করের সন্ন্যাস-গ্রহণে সন্মতি জ্ঞাপন করেন। এর পর একজন আত্মীয়ের পরিচর্য্যাধীনে জননীর সেবার ব্যবস্থা করে শঙ্কর সংসারত্যাগী হন। তখন ভারতবর্ষে বিভিন্ন ধর্ম-সম্প্রদায়ের অভ্যুদয়ে নাস্তিকতার বিজয়-দুন্দুভি নিনাদিত হতেছিল। চাৰ্ব্বাক, শূন্যবাদী, নাস্তিক, বৌদ্ধ প্রভৃতি বিবিধ ধর্ম-সম্প্রদায়ের অভ্যুদয়ে তখন বেদ-বিহিত ধর্ম-কর্ম লোপ পেতে বসেছিল। শঙ্করাচাৰ্য্য সেই সকল ধর্ম-মতের কুজ্ঝটিকা-জাল অপসরণ করে সনাতন ধর্মের দিব্য জ্যোতিঃ প্রকাশ করলেন। ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে পুনরায় মঠমন্দির-সমূহ প্রতিষ্ঠিত হল। নিৰ্বাপিত-প্রায় অগ্নি-কণা পুনরায় লকলক শিখা বিস্তার করল; সনাতন হিন্দুধর্মের জয়নিনাদে দিগ মগুল পরিপূর্ণ হয়ে উঠল। শঙ্করাচাৰ্য্য ধর্ম জগতে এক যুগান্তর উপস্থিত করলেন।
তথ্য সূত্র- পৃথিবীর ইতিহাস চতুর্থ খণ্ড।
সংকলনে- শ্রীমান কৃষ্ণকমল (মিন্টু)
সনাতন সংগঠন।