শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা: চতুর্থ অধ্যায় – জ্ঞানযোগ(গীতাশাস্ত্রী জগদীশচন্দ্র ঘোষ)


শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা : চতুর্থ অধ্যায় – জ্ঞানযোগ

(গীতাশাস্ত্রী জগদীশচন্দ্র ঘোষ)

Image result for bhagavad gita chapter 4

শ্রীভগবানুবাচ –

ইমং বিবস্বতে যোগং প্রোক্তবানহমব্যয়ম্।
বিবস্বান্ মনবে প্রাহ মনুরিক্ষ্বাকবেহব্রবীৎ।।১

অর্থঃ-(১) শ্রীভগবান্‌ বলিলেন – এই অব্যয় যোগ আমি সূর্য্যকে বলিয়াছিলাম। সূর্য্য (স্বপুত্র) মনুকে এবং মন্য (স্বপুত্র) ইক্ষ্বাকুকে ইহা বলিয়াছিলেন।

এবং পরম্পরাপ্রাপ্তমিমং রাজর্ষয়ো বিদুঃ।
স কালেনেহ মহতা যোগো নষ্টঃ পরন্তপ।।২

অর্থঃ-(২) এইরূপে পুরুষপরম্পরা প্রাপ্ত এই যোগ রাজর্ষিগণ বিদিত ছিলেন। হে পরন্তপ, ইহলোকে সেই যোগ দীর্ঘকালবশে নষ্ট হইয়াছে।

রাজর্ষি – রাজর্ষি হইয়াও যিনি ঋষি, যেমন জনকাদি। সুতরাং যাঁহারা জ্ঞানী ও কর্ম্মী, ইহা তাঁহাদেরই অধিগম্য।

স এবায়ং ময়া তেহদ্য যোগঃ প্রোক্তঃ পুরাতনঃ।
ভক্তোহসি মে সখা চেতি রহস্যং হ্যেতদুত্তমম্।।৩

অর্থঃ-(৩) তুমি আমার ভক্ত ও সখা, এই জন্য এই সেই পুরাতন যোগ অদ্য তোমাকে বলিলাম; কারণ, ইহা উত্তম গুহ্য তত্ত্ব।

অর্জ্জুন উবাচ –

অপরং ভবতো জন্ম পরং জন্ম বিবস্বতঃ।
কথমেতদ্বিজানীয়াং ত্বমাদৌ প্রোক্তবানিতি।।৪

অর্থঃ-(৪) অর্জ্জুন বলিলেন – আপনার জন্ম পরে, বিবস্বানের জন্ম পূর্ব্বে; সুতরাং আপনি যে পূর্ব্বে ইহা বলিয়াছিলেন, তাহা কিরূপে বুঝিব?

শ্রীভগবানুবাচ –

বহূনি মে ব্যতীতানি জন্মানি তব চার্জ্জুন।
তান্যহং বেদ সর্ব্বাণি ন ত্বং বেত্থ পরন্তপ।।৫

অর্থঃ-(৫) শ্রীভগবান্‌ বলিলেন – হে অর্জ্জুন! আমার এবং তোমার বহু জন্ম অতীত হইয়াছে। আমি সে সকল জানি; হে পরন্তপ! তুমি জান না।

অজোহপি সন্নব্যয়াত্মা ভূতানামীশ্বরোহপি সন্।
প্রকৃতিং স্যামধিষ্ঠায় সম্ভবাম্যাত্মমায়য়া।।৬

অর্থঃ-(৬) আমি জন্মরহিত, অবিনশ্বর এবং সর্ব্বভূতের ঈশ্বর হইয়াও স্বীয় প্রকৃতিতে অনুষ্ঠান করিয়া আত্মমায়ায় আবির্ভূত হই।

যদা যদাহি ধর্ম্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারত।
অভ্যুত্থানমধর্ম্মস্য তদাত্মানং সৃজাম্যহম্।।৭

অর্থঃ-(৭) হে ভারত! যখনই যখনই ধর্ম্মের গ্লানি এবং অধর্ম্মের অভ্যুত্থান হয়, আমি সেই সেই সময়ে নিজেকে সৃষ্টি করি (দেহ ধারণপূর্ব্বক অবতীর্ণ হই)।

পরিত্রাণায় সাধূনাং বিনাশায় চ দুস্কৃতাম্।
ধর্ম্মসংস্থাপনার্থায় সম্ভবামি যুগে যুগে।।৮

অর্থঃ-(৮) সাধুগণের পরিত্রাণ, দুষ্টদিগের বিনাশ এবং ধর্ম্মসংস্থাপনের জন্য আমি যুগে যুগে অবতীর্ণ হই।

যুগে যুগে – তত্ত্বদবসরে, তত্তৎ সময়ে (শ্রীধর, বলরাম) যখনি ধর্ম্মের গ্লানি হয়, তখনই অবতার; এক যুগে একাধিক অবতারও হয়।

জন্মকর্ম্ম চ মে দিব্যমেবং যো বেত্তি তত্ত্বতঃ।
ত্যক্ত্বা দেহং পুনর্জ্জন্ম নৈতি মামেতি সোহর্জ্জুন।।৯

অর্থঃ-(৯) হে অর্জ্জুন, আমার এই দিব্য জন্ম ও কর্ম্ম যিনি তত্ত্বতঃ জানেন, তিনি দেহত্যাগ করিয়া পুনর্ব্বার আর জন্মপ্রাপ্ত হন না – তিনি আমাকেই প্রাপ্ত হন।

বীতরাগভয়ক্রোধা মন্ময়া মামুপাশ্রিতাঃ।
বহবো জ্ঞানতপসা পূতা মদ্ভাবমাগতাঃ।।১০

অর্থঃ-(১০) বিষয়ানুরাগ, ভয় ও ক্রোধ বর্জ্জন করিয়া, আমাতে একাগ্রচিত্ত ও আমার শরণাপন্ন হইয়া, আমার জন্মকর্ম্মের তত্ত্বালোচনা রূপ জ্ঞানময় তপস্যাদ্বারা পবিত্র হইয়া অনেকে আমার পরমানন্দভাবে চিরস্থিতি লাভ করিয়াছেন।

যে যথা মাং প্রপদ্যন্তে তাংস্তথৈব ভজাম্যহম্।
মম বর্ত্মানুবর্ত্তন্তে মনুষ্যাঃ পার্থ সর্ব্বশঃ।।১১

অর্থঃ-(১১) হে পার্থ! যে আমাকে যে-ভাবে উপাসনা করে, আমি তাহাকে সেই ভাবেই তুষ্ট করি। মনুষ্যগণ সর্ব্বপ্রকারে আমার পথেরই অনুসরণ করে অর্থাৎ মনুষ্যগণ যে পথই অনুসরণ করুক না কেন, সকল পথেই আমাতে পৌঁছিতে পারে।

কাঙ্ক্ষন্তঃ কর্ম্মণাং সিদ্ধিং যজন্ত ইহ দেবতাঃ।
ক্ষিপ্রং হি মানুষে লোকে সিদ্ধর্ভবতি কর্ম্মজা।।১২

অর্থঃ-(১২) ইহলোকে যাহারা কর্ম্মসিদ্ধি কামনা করে তাহারা দেবতা পূজা করে, কেননা মনুষ্যলোকে কর্ম্মজনিত ফললাভ শীঘ্রই পাওয়া যায়।

চাতুর্ব্বণ্যং ময়া সৃষ্টং গুণকর্ম্মবিভাগশঃ।
তস্য কর্ত্তারমপি মাং বিদ্ধ্যকর্ত্তারমব্যয়ম্।।১৩

অর্থঃ-(১৩) বর্ণচতুষ্টয় গুণ ও কর্ম্মের বিভাগ অনুসারে আমি করিয়াছি বটে, কিন্তু আমি উহার সৃষ্টিকর্ত্তা হইলেও আমাকে অকর্ত্তা ও বিকাররহিত বলিয়াই জানিও।

অব্যয় – অবিকারী (নীলকন্ঠ)। তিনি নির্গুণ হইয়াও সগুণ, ‘নির্গুণো-গুণী’। নির্গুণ বিভাবে তিনি নির্ব্বিশেষ নিষ্ক্রিয়; সগুণবিভাবে তিনি সৃষ্টিস্থিতিপ্রলয়কর্ত্তা। তাই তিনি কর্ত্তা হইয়াও অকর্ত্তা, ক্রিয়াশীল হইয়াও অবিকারী।

কেহ সকামভাবে রাজসিক বা তামসিক পূজার্চ্চনা করে, কেহ নিষ্কাম ভাবে উপাসনা করে। এরূপ কর্ম্ম-বৈচিত্র্য কেন? তুমিই ত এসব ঘটাও? – না, প্রকৃতিভেদবশতঃ এইরূপ হয়। প্রকৃতিভেদ অনুসারে বর্ণভেদ বা কর্ম্মভেদ আমি করিয়াছি – কিন্তু আমি উহার কর্ত্তা হইলেও উহাতে লিপ্ত হই না বলিয়া আমি অকর্ত্তা। জীবেরও এই তত্ত্ব জানিয়া নিষ্কামভাবে স্বধর্ম্ম পালন করা উচিত। মুমুক্ষু ব্যক্তিগণ পূর্ব্বে এই ভাবেই কর্ম করিযাছেন।

ন মাং কর্মাণি লিস্পন্তি ন মে কর্ম্মফলে স্পৃহা।
ইতি মাং যোহভিজানাতি কর্ম্মভির্ন স বধ্যতে।।১৪

অর্থঃ-(১৪) কর্ম্মসকল আমাকে লিপ্ত করিতে পারে না, কর্মফলে আমার স্পৃহাও নাই, এইরূপে যিনি আমাকে জানেন, তিনি কর্ম্মদ্বারা আবদ্ধ হন না।

শ্রীভগবান্‌ আদর্শ কর্মযোগী, তাঁহার নির্লিপ্ততা ও নিস্পৃহতা বুঝিতে পারিলে মনুষ্য নিষ্কাম কর্ম্মের মর্ম্ম বুঝিতে পারে, তাহার কর্ম নিষ্কাম হয়। সুতরাং কর্ম্ম করিয়াও সে কর্ম্মবন্ধন হইতে মুক্ত হয়।

এবং জ্ঞাত্বা কৃতং কর্ম্ম পূর্ব্বৈরপি মুমুক্ষুভিঃ।
কুরু কর্ম্মৈব তস্মাৎ ত্বং পূর্ব্বৈঃ পুর্ব্বতরং কৃতম্।।১৫

অর্থঃ-(১৫) এইরূপ জানিয়া (অর্থাৎ আত্মাকে অকর্ত্তা, অভোক্তা মনে করিয়া) পূর্ব্ববর্ত্তী মোক্ষাভিলাষিগণ অর্থাৎ পূর্ব্ববর্ত্তী জনকাদি রাজর্ষিগণ কর্ত্তৃত্বাভিমান বর্জ্জনপূর্ব্বক নির্লিপ্তভাবে স্বীয় কর্ত্তব্য কর্ম্ম সম্পাদন করিয়া গিয়াছেন, তুমিও সেইরূপ নিষ্কামভাবে স্বীয় কর্ত্তব্য পালন কর।

কিং কর্ম্ম কিমকর্ম্মেতি কবোয়হপ্যত্র মোহিতাঃ।
তত্তে কর্ম্ম প্রবক্ষ্যামি যজ্ জ্ঞাত্বা মোক্ষ্যসেহশুভাৎ।।১৬

অর্থঃ-(১৬) কর্ম্ম কি, কর্ম্মশূন্যতাই বা কি, এ বিষয়ে পণ্ডিতেরাও মোহ প্রাপ্ত হন অর্থাৎ ইহার প্রকৃত তত্ত্ব বুঝিতে পারেন না, অতএব কর্ম্ম কি, (এবং অকর্ম্ম কি) তাহা তোমাকে বলিতেছি, তাহা জানিলে অশুভ হইতে (সংসারবন্ধন হইতে) মুক্ত হইবে।

কর্ম্ম – বিহিত কর্ম্ম; বিকর্ম্ম – অবিহিত কর্ম্ম; অকর্ম্ম – কর্ম্মশূন্যতা; কর্ম্মত্যাগ, কিছু না করিয়া তুষ্ণীম্ভাব অবলম্বন।

কর্ম্মণো হ্যপি বোদ্ধব্যং বোদ্ধব্যঞ্চ বিকর্ম্মণঃ।
অকর্ম্মণশ্চ বোদ্ধব্যং গহনা কর্ম্মণো গতিঃ।।১৭

অর্থঃ-(১৭) বিহিত কর্ম্মের বুঝিবার বিষয় আছে, বিকর্ম্ম বা অবিহিত কর্ম্মের বুঝিবার বিষয় আছে, অকর্ম্ম বা কর্ম্মত্যাগ সন্বন্ধেও বুঝিবার বিষয় আছে; কেননা কর্ম্মের গতি (তত্ত্ব) দুর্জ্ঞেয়।

কর্ম্মণ্যকর্ম্ম যঃ পশ্যেদকর্ম্মণি চ কর্ম্ম যঃ।
স বুদ্ধিমান্ মনুষ্যেষু স যুক্তঃ কৃতস্নকর্ম্মকৃৎ।।১৮

অর্থঃ-(১৮) যিনিকর্ম্মে অকর্ম্ম এবং অকর্ম্মে কর্ম্ম দেখেন মনুষ্যের মধ্যে তিনিই বুদ্ধিমান্‌; তিনি যোগী, তিনি সর্ব্বকর্ম্মকারী।

কর্ম্মতত্ত্বঃ যিনিকর্ম্মে অকর্ম্ম দর্শন করেন অর্থাৎ যিনি কর্ম্ম করিয়াও মনে করেন যে দেহেন্দ্রিয়াদি কর্ম্ম করিতেছে, আমি কিছুই করি না, তিনিই বুদ্ধিমান্‌, কেন না কর্ম্ম করিয়াও তিনি কর্ম্মের ফলভোগীহয়েন না। অর্থাৎ যিনি কর্ত্তৃত্বাভিমান ত্যাগ করিয়া কর্ম্ম করেন, তাঁহার কর্ম্মও অকর্ম্মস্বরূপ। – ইহাই কর্ম্মতত্ত্ব।

বিকর্ম্মতত্ত্বঃ কর্ম্ম করিয়াও তাহার ফলভোগী হয়েন না সুতরাং নির্লিপ্ত অনহঙ্কারী কর্ম্মযোগীর পক্ষে বিকর্ম্মও অকর্ম্মস্বরূপ – ইহাই বিকর্ম্মতত্ত্ব।

অকর্ম্মতত্ত্বঃ আর যিনি অকর্ম্মে কর্ম্ম দর্শন করেন, তিনিই বুদ্ধিমান্‌। অনেকে আলস্যহেতু, দুঃখবুদ্ধিতে কর্ত্তব্যকর্ম্ম ত্যাগ করেন, কিন্তু তাহারা জানেন না এ অবস্থায় প্রকৃতির ক্রিয়া চলিতে থাকে, কর্ম্মবন্ধ হয় না। এই যে কর্ম্মত্যাগ বা অকর্ম্ম ইহা প্রকৃতপক্ষে কর্ম্ম, কেননা ইহা বন্ধনের কারণ। আবার ইহারা কর্ম্ম ত্যাগ করিয়া মনে করেন, আমি কর্ম্ম করি না, আমি বন্ধনমুক্ত। কিন্তু “আমি কর্ম্ম করি” ইহা যেমন অভিমান, “আমি কর্ম্ম করি না” ইহাও সেইরূপ অভিমান, সুতরাং বন্ধনের কারণ। ইহারা বুঝেন না যে কর্ম্ম করে প্রকৃত, ‘আমি’ নহে। বস্তুতঃ ‘আমি’ ত্যাগ না হইলে কেবল কর্ম্মত্যাগে বন্ধন-মুক্ত হওয়া যায় না। সুতরাং এইরূপ অকর্ম্ম বা কর্ম্মত্যাগও বন্ধনহেতু বলিয়া প্রকৃতপক্ষে কর্ম্মই – ইহাই অকর্ম্মতত্ত্ব।

যস্য সর্ব্বে সমারম্ভাঃ কামসংকল্পবর্জ্জিতাঃ।
জ্ঞানাগ্নিদগ্ধকর্ম্মাণং তমাহিঃ পণ্ডিতং বুধাঃ।।১৯

অর্থঃ-(১৯) যাঁহার সমস্ত কর্মচেষ্টা, ফলতৃষ্ণা ও কর্ত্তৃত্বাভিমানবর্জ্জিত, সুতরাং যাঁহার কর্ম্ম জ্ঞানরূপ অগ্নিদ্বারা দগ্ধ হইয়াছে, সেইরূপ ব্যক্তিকেই জ্ঞানিগণ পণ্ডিত বলিয়া থাকেন।

নিষ্কাম কর্ম্ম দিব্য কর্ম্ম, ভাগবৎ কর্ম্ম! ‘আমি করিতেছি’ এইরূপ কর্ত্তৃত্বাভিমান যাঁহার নাই, তিনি কর্ম্ম করিয়াও তাহার ফলভাগী হন না। অহং-বুদ্ধিত্যাগই প্রকৃত জ্ঞান। এই জ্ঞানরূপ অগ্নিদ্বারা তাঁহার কর্ম্মের ফল দগ্ধ হইয়াছে, তাঁহার কর্ম্মের ফলভাগিত্ব বিনষ্ট হইয়াছে। এইরূপ ব্যক্তিই কর্ম্মে অকর্ম্ম অর্থাৎ কর্ম্মশূন্যতা দেখেন।

ত্যক্ত্বা কর্ম্মফলাসঙ্গং নিত্যতৃপ্তো নিরাশ্রয়ঃ।
কর্ম্মণ্যভিপ্রবৃত্তোহপি নৈব কিঞ্চিৎ করোতি সঃ।।২০

অর্থঃ-(২০) যিনি কর্ম্মে ও কর্ম্মভলে আসক্তি পরিত্যাগ করিয়াছেন, যিনি সদা আপনাতেই পরিতৃপ্ত, যিনি কোন প্রয়োজনে কাহারও আশ্রয় গ্রহণ করেন না, তিনি কর্ম্মে প্রবৃত্ত হইলেও কিছুই করেন না (অর্থাৎ তাঁহার কর্ম্ম অকর্ম্মে পরিণত হয়)।

নিরাশীর্যতচিত্তাত্মা ত্যক্তসর্ব্বপরিগ্রহঃ।
শারীরং কেবলং কর্ম্ম কুর্ব্বন্নাপ্নোতি কিল্বিষম্।।২১

অর্থঃ-(২১) যিনি কামনা ত্যাগ করিয়াছে, যাঁহার চিত্ত ও ইন্দ্রিয় সংযত, যিনি সর্ব্বপ্রকার দান-উপহারাদি গ্রহণ বর্জ্জন করিয়াছেন, তাদৃশ ব্যক্তি কেবল শরীরদ্বারা কর্ম্মানুষ্ঠান করিয়াও পাপভাগী হন না (কর্ম্মবন্ধনে আবদ্ধ হন না)।

যদৃচ্ছালাভসন্তুষ্টো দ্বন্দ্বাতীতো বিমৎসরঃ।
সমঃ সিদ্ধাবসিদ্ধৌচ কৃত্বাহপি ন নিবধ্যতে।।২২

অর্থঃ-(২২) যিনি প্রার্থনা ও বিশেষ চেষ্টা না করিয়া যাহা প্রাপ্ত হওয়া যায় তাহাতেই সন্তুষ্ট থাকেন, যিনি দ্বন্দ্বসহিষ্ণু, মাৎসর্য্যশূন্য সুতরাং বৈরবিহীন, যিনি সিদ্ধি ও অসিদ্ধি তুল্য জ্ঞান করেন, তিনি কর্ম্ম করিয়াও কর্ম্মফলে আবদ্ধ হয়েন না।

গতসঙ্গস্য মুক্তস্য জ্ঞানাবস্থিতচেতসঃ।
যজ্ঞায়াচরতঃ কর্ম্ম সমগ্রং প্রবিলীয়তে।।২৩

অর্থঃ-(২৩) যিনি ফলাকাঙ্খাবর্জ্জিত, রাগদ্বেষাদিমুক্ত, যাঁহার চিত্ত আত্মবিষয়ক জ্ঞানে নিবিষ্ট বা জ্ঞানস্বরূপ ব্রহ্মে অবস্থিতি, যিনি যজ্ঞার্থ (অর্থাৎ ঈশ্বর-প্রীত্যর্থ যজ্ঞস্বরূপ) কর্ম করেন, তাঁহার কর্ম্মসকল ফলসহ বিনষ্ট হইয়া যায়, ঐ কর্ম্মের কোন সংস্কার থাকে না (অর্থাৎ তাহার কর্ম্ম বন্ধনের কারণ হয় না)।

ব্রহ্মার্পণং ব্রহ্ম হবির্ব্রহ্মাগ্নৌ বরহ্মণা হুতম্।
ব্রহ্মৈব তেন গন্তব্যং ব্রহ্মকর্ম্মসমাধিনা।।২৪

অর্থঃ-(২৪) যিনিকর্ম্মে ও কর্মের অঙ্গসকলে ব্রহ্মই দেখেন, তিনি ব্রহ্মত্বই প্রাপ্ত হন – ‘ব্রহ্মবিদ ব্রহ্মৈব ভবতি’।

অর্পণ (স্রুবাদি যজ্ঞপত্রে) ব্রহ্ম, ঘৃতাদি ব্রহ্ম, অগ্নি ব্রহ্ম, যিনি হোম করেন তিনিও ব্রহ্ম, এইরূপ জ্ঞানে ব্রহ্মরূপ কর্ম্মে একাগ্রচিত্ত পুরুষ ব্রহ্মই প্রাপ্ত হন।

দৈবমেবাপরে যজ্ঞং যোগিনঃ পর্য্যুপাসতে
ব্রহ্মাগ্নাবপরে যজ্ঞং যজ্ঞেনৈবোপজুহ্বতি।।২৫

অর্থঃ-(২৫) অন্য কোন কোন যোগিগণ দৈবযজ্ঞের অনুষ্টান করেন, অপর কেহ কেহ ব্রহ্মরূপ অগ্নিতে (পূর্ব্বোক্ত ব্রহ্মার্পণ রূপ) যজ্ঞদ্বারাই যজ্ঞার্পণ করেন (অর্থাৎ সর্ব্বকর্ম্ম ব্রহ্মে অর্পণ করেন।

শ্রোত্রাদীনীন্দ্রিয়াণ্যন্যে সংযমাগ্নিষু জুহ্বতি।
শব্দাদীন্ বিষয়ানন্য ইন্দ্রিয়াগ্নিষু জুহ্বতি।।২৬

অর্থঃ-(২৬) অন্যে সংযমরূপ অগ্নিতে চক্ষুকর্ণাদি ইন্দ্রিয়সমূহকে হোম করেন অর্থাৎ ইন্দ্রিয়গুলিকে রূপরসাদি বিষয় হইতে প্রত্যাহার করিয়া সংযতেন্দ্রিয় হইয়া অবস্থান করেন, ইহার নাম সংযম-যজ্ঞ বা ব্রহ্মচর্য্য; অন্যে ইন্দ্রিয়রূপ অগ্নিতে শব্দাদি বিষয়সমূহকে আহুতি দেন – অর্থাৎ ইন্দ্রিয়সমূহ শব্দাদি বিষয় গ্রহণ করিতেছে, কিন্তু তিনি রাগদ্বেষশূন্যচিত্তে অনাসক্তভাবে থাকেন। মুমুক্ষু নির্লিপ্ত সংসারীরা এই যজ্ঞ করেন; ইহাকে বলা যায় ইন্দ্রিয়-যজ্ঞ।

সর্ব্বাণীন্দ্রিয়কর্মাণি প্রাণকর্ম্মাণি চাপরে।
আত্মসংযমযোগাগ্নৌ জুহ্বতি জ্ঞানদীপিতে।।২৭

অর্থঃ-(২৭) অন্য কেহ (ধ্যানযোগিগণ) সমস্ত ইন্দ্রিয়-কর্ম্ম ও সমস্ত প্রাণকর্ম্মকে ব্রহ্মজ্ঞানে প্রদ্দীপিত আত্মসংযম বা সমাধিরূপ যোগাগ্নিতে হোম করেন অর্থাৎ পঞ্চজ্ঞানেদ্রিয়, পঞ্চ কর্ম্মেন্দ্রিয় ও পঞ্চপ্রাণ ইহাদের সমস্তকর্ম্ম নিরোধ করিয়া আত্মানন্দসুখে মগ্ন থাকেন। ইহার নাম আত্মসংযম বা সমাধি যজ্ঞ।

দ্রব্যযজ্ঞাস্তপোযজ্ঞা যোগযজ্ঞাস্তথাপরে।
স্বাধ্যায়জ্ঞানযজ্ঞাশ্চ যতয়ঃ সংশিতব্রতাঃ।।২৮

অর্থঃ-(২৮) কেহ কেহ দ্রব্যদানরূপ যজ্ঞ করেন, কেহ কেহ তপোরূপ যজ্ঞ করেন, কেহ কেহ যোগরূপ যজ্ঞ করেন, কোন কোন দৃঢ়ব্রত যতিগণ বেদাভ্যাসরূপ যজ্ঞ করেন, কেহ কেহ বেদার্থপরিজ্ঞানরূপ যজ্ঞ সম্পাদন করেন।

অপানে জুহ্বতি প্রাণং প্রাণেহপানং তথাপরে।
প্রাণাপানগতী রুদ্ধা প্রাণায়ামপরায়ণাঃ।
অপরে নিয়তাহারাঃ প্রাণান্ প্রাণেষু জুহ্বতি।।২৯

অর্থঃ-(২৯) আবার অন্য যোগিগণ অপান বায়ুতে প্রাণবায়ু আহুতি প্রদান করেন, (কেহ কেহ) প্রাণে অপানের আহুতি দেন, অপর কেহ পরিমিতাহারী হইয়া প্রাণ ও অপানের গতিরোধ পূর্ব্বক প্রাণায়াম পরায়ণ হইয়া ইন্দ্রিয়গণকে প্রাণে আহুতি দেন।

সর্ব্বেহপ্যেতে যজ্ঞবিদো যজ্ঞক্ষয়িতকল্মষাঃ।
যজ্ঞশিষ্টামৃতভুজো যান্তি ব্রহ্ম সনাতনম্।।৩০
নায়ং লোকোহস্ত্যযজ্ঞস্য কুতোহন্যঃ কুরুসত্তম।।৩১

অর্থঃ-(৩০-৩১) এই যজ্ঞবিদ্‌গণ সকলেই যজ্ঞদ্বারা নিস্পাপ হইয়া থাকেন; যাঁহারা অমৃত-স্বরূপ যজ্ঞাবশিষ্ট অন্ন ভোজন করেন, তাঁহারা সনাতন ব্রহ্মপদ লাভ করেন। হে কুরুশ্রেষ্ঠ! যে কোনরূপ যজ্ঞই করে না, তাহার ইহলোকই নাই, পরলোক ত দূরের কথা (অর্থাৎ ইহলোকেই তাহার কোন সুখ হয় না, পরলোকে আর কি হইবে?)।

একথার তাৎপর্য এই যে, যজ্ঞই সংসারের নিয়ম। প্রত্যেকের কর্ত্তব্য সম্পাদন দ্বারা, পরস্পরের ত্যাগ স্বীকার দ্বারা, আদান-প্রদান দ্বারাই জগৎ চলিতেছে এবং উহাতেই প্রত্যেকের সুখ-স্বাতন্ত্র্য অব্যাহত আছে। যে এই বিশ্ব-যজ্ঞ ব্যাপারে যোগদান করে না, যজ্ঞস্বরূপে স্বীয় কর্ত্তব্য সম্পাদন করে না, তাহার ইহকাল ও পরকাল উভয়ই বিনষ্ট হয়, তাহার জীবন ব্যর্থ হয়।

এবং বহুবিধা যজ্ঞা বিততা ব্রহ্মণো মুখে।
কর্ম্মজান্ বিদ্ধি তান্ সর্ব্বানেবং জ্ঞাত্বা বিমোক্ষ্যসে।।৩২

অর্থঃ-(৩২) এইরূপ বহুবিধ যজ্ঞ ব্রহ্মের মুখে বিস্তৃত (বিহিত) আছে, এ সকলই কর্ম্মজ অর্থাৎ কায়িক, বাচিক বা মানসিক এই ত্রিবিধ কর্ম্ম হইতে সমুদ্ভূত বলিয়া জানিও; এইরূপ জানিলে মুক্তিলাভ করিবে।

শ্রেয়ান্ দ্রব্যময়াদ্ যজ্ঞাজ্ জ্ঞানযজ্ঞঃ পরন্তপ।
সর্ব্বং কর্ম্মাখিলং পার্থ জ্ঞানে পরিসমাপ্যতে।।৩৩

অর্থঃ-(৩৩) হে পরস্তপ, দ্রব্যসাধ্য দৈব্যযজ্ঞাদি হইতে জ্ঞানযজ্ঞ শ্রেষ্ঠ; কেননা, ফল-সহিত সমস্ত কর্ম্ম নিঃশেষে জ্ঞানে পরিসমাপ্ত হয়।

তদ্ বিদ্ধি প্রণিপাতেন পরিপ্রশ্নেন সেবয়া।
উপদেক্ষ্যন্তি তে জ্ঞানং জ্ঞানিনস্তত্ত্বদর্শিনঃ।৩৪

অর্থঃ-(৩৪) গুরুচরণে দণ্ডবৎ প্রণামদ্বারা, নানা বিষয় প্রশ্নদ্বারা এবং গুরুসেবা দ্বারা সেই জ্ঞান লাভ কর। জ্ঞানী, তত্ত্বদর্শী গুরু তোমাকে সেই জ্ঞান উপদেশ করিবেন।

যজ্ জ্ঞাত্বা ন পুনর্ম্মোহমেবং যাস্যসি পাণ্ডব।
যেন ভূতান্যশেষাণি দ্রক্ষ্যস্যাত্মন্যথো ময়ি।।৩৫

অর্থঃ-(৩৫) হে পাণ্ডব, যাহা জানিলে পুনরায় এরূপ (শোকাদি জনিত) মোহ প্রাপ্ত হইবে না, যে জ্ঞানদ্বারা সমস্ত ভূতগ্রাম স্বীয় আত্মাতে এবং অনন্তর আমাতে দেখিতে পাইবে।

অপি চেদসি পাপেভ্যঃ সর্ব্বেভ্যঃ পাপকৃত্তমঃ।
সর্ব্বং জ্ঞানপ্লবেনৈব বৃজিনং সন্তরিষ্যসি।।৩৬

অর্থঃ-(৩৬) যদি তুমি সমুদয় পাপী হইতেও অধিক পাপাচারী হও, তথাপি জ্ঞানরূপ তরণী দ্বারা সমুদয় পাপসমুদ্র ঊত্তীর্ণ হইতে পারিবে।

যথৈধাংসি সমিদ্ধোহগ্নির্ভস্মসাৎ কুরুতেহর্জ্জুন।
জ্ঞানাগ্নি সর্ব্বকর্ম্মাণি ভস্মসাৎ কুরুতে তথা।।৩৭

অর্থঃ-(৩৭) হে অর্জ্জুন, যেমন প্রজ্জ্বলিত অগ্নি কাষ্ঠরাশিকে ভস্মীভূত করে, তেমন জ্ঞানরূপ অগ্নি কর্ম্মরাশিকে ভস্মসাৎ করে।

নহি জ্ঞানেন সদৃশং পবিত্রমিহ বিদ্যতে
তৎ স্বয়ং যোগসংসিদ্ধঃ কালেনাত্মনি বিন্দতি।।৩৮

অর্থঃ-(৩৮) ইহলোকে জ্ঞানের ন্যায় পবিত্র আর কিছু নাই। কর্ম্ম-যোগে সিদ্ধ-পুরুষ সেই জ্ঞান কালসহকারে আপনিই অন্তরে লাভ করে।

শ্রদ্ধাবান্ লভতে জ্ঞানং তৎপরঃ সংযতেন্দ্রিয়ঃ।
জ্ঞানং লব্ধ্বা পরং শান্তিমচিরেণাধিগচ্ছতি।।৩৯

অর্থঃ-(৩৯) যিনি শ্রদ্ধাবান্‌, একনিষ্ঠ সাধন-তৎপর এবং জিতেন্দ্রিয়, তিনিই জ্ঞানলাভ করেন। আত্মজ্ঞান লাভ করিয়া অচিরাৎ পরম শান্তি লাভ করেন।

অজ্ঞশ্চাশ্রদ্দধানশ্চ সংশয়াত্মা বিনশ্যতি।
নায়ং লোকোহস্তি ন পরো ন সুখং সংশয়াত্মনঃ।।৪০

অর্থঃ-(৪০) অজ্ঞ, শ্রদ্ধাহীন, সংশয়াকুল, ব্যক্তি বিনষ্ট হয়, সংশয়াত্মার ইহলোকও নাই, পরলোকই নাই, সুখও নাই।

যে অজ্ঞ, অর্থাৎ যাহার শাস্ত্রাদির জ্ঞান নাই, এবং যে সদুপদেশ লাভ করে নাই এবং যে শ্রদ্ধাহীন অর্থাৎ সদুপদেশ পাইয়াও যে তাহা বিশ্বাস করে না এবং তদনুসারে কার্য্য করে না, সুতরাং যে সংশয়াত্মা – অর্থাৎ যাহার সকল বিষয়েই সংশয় – এইটি কি ঠিক, না ঐটি ঠিক, – এইরূপ চিন্তায় যে সন্দেহাকুল তাহার অত্মোন্নতির কোন উপায় নাই।

যোগসংন্যস্তকর্ম্মাণং জ্ঞানসংচ্ছিন্নসংশয়ম্।
আত্মবন্তং ন কর্ম্মাণি নিবধ্নন্তি ধনঞ্জয়।।৪১

অর্থঃ-(৪১) নিষ্কাম কর্ম্মযোগের দ্বারা যাঁহার কর্ম্ম ঈশ্বরে সমর্পিত হইয়াছে, আত্মদর্শনরূপ জ্ঞানের দ্বারা যাঁহার সকল সংশয় ছিন্ন হইয়াছে, এইরূপ অপ্রমাদী আত্মবিদ্‌ পুরুষকে কর্ম্মসকল আবদ্ধ করিতে পারে না অর্থাৎ তিনি কর্ম্ম করিলেও কর্ম্মফলে আবদ্ধ হন না।
অর্থাৎ – জ্ঞানী কর্ম্ম করিয়াও কর্ম্মে আবদ্ধ হন না, সুতরাং জ্ঞানীরও কর্ম্ম আছে, একথা স্পষ্টই বলা হইল, তবে সে কর্ম্ম অকর্ম্মস্বরূপ।

তস্মাদজ্ঞানসম্ভূতং হৃৎস্থং জ্ঞানাসিনাত্মনঃ।
ছিত্ত্বৈনং সংশয়ং যোগমাতিষ্ঠোত্তিষ্ঠ ভারত।।৪২
অর্থঃ-(৪২) অতএব হে, ভারত, অজ্ঞাতজাত হৃদয়স্থ এই তোমার সংশয়রাশিকে আত্মজ্ঞানরূপ খড়্গদ্বারা ছেদন করিয়া নিস্কাম কর্ম্মযোগ অবলম্বন কর, উঠ, যুদ্ধকর।
তুমি যুদ্ধে অনিচ্ছুক, কারণ তোমার হৃদয়ে নানারূপ সংশয় উপস্থিত হইয়াছে। গুরুজনাদি বধ করিয়া কি পাপভাগী হইব? আত্মীয়-স্বজনাদির বিনাশে শোক-সন্তপ্ত হইয়া রাজ্যলাভেই বা কি সুখ হইবে? এইরূপ শোক, মোহ ও সংশয়ে অভিভূত হইয়া তুমি স্বীয় কর্ত্তব্য বিস্মৃত হইয়াছ। তোমার এই সংশয় অজ্ঞান-সম্ভূত। যাঁহার দেহাত্মবোধ বিদূরিত হইয়াছে, সর্ব্বভূতে একাত্মবোধ জন্মিয়াছে – তাঁহার চিত্তে এ সকল সংশয় উদিত হয় না; তিনি শোক-দুঃখে অভিভূত হন না (‘তত্র কো মোহঃ কঃ শোক একত্বমনুশ্যতঃ’ – ঈশ) ইহাই প্রকৃত জ্ঞান, তাহা পূর্ব্বে বলিয়াছি। শ্রদ্ধা, আত্মসংযম একনিষ্ঠা – সেই জ্ঞান লাভের যে উপায় তাহাও বলিয়াছি। আমার বাক্যে তোমার শ্রদ্ধা আছে, তোমার আত্মসংযম ও একনিষ্ঠা আছে, সুতরাং তোমাকে আমি জ্ঞানোপদেশ দিতেছি। তুমি আত্মজ্ঞান লাভপূর্ব্বক নিঃসন্দেহ হইয়া নিস্কাম কর্ম্মযোগ অবলম্বন কর, স্বীয় কর্ত্তব্য পালন কর, যুদ্ধ কর।
ইতি শ্রীমদ্‌ভগবদ্‌গীতাসূপনিষৎসু ব্রহ্মবিদ্যায়াং যোগশাস্ত্রে।


১) বিবস্বান (সূর্য) হইতেই সূর্যবংশের উৎপত্তি । বিবস্বানের পুত্র মনু, মনুর পুত্র ইক্ষ্বাকু । এই বৈবস্বত মনু হইতে ৫৮তম অধস্তন পুরুষ শ্রীরামচন্দ্র ।

এই শ্লোকে যে যোগধর্মের কথা উল্লেখ করা হইল, ইহাই মহাভারতের শান্তিপর্বে কথিত নারায়ণীয় ধর্ম বা সাত্বত ধর্ম । কল্পে কল্পে এই ধর্ম কিরূপে আবির্ভূত হইয়া প্রচারিত হইয়াছে তথাত তাহার বিস্তারিত পরম্পরা দেওয়া হইয়াছে । এ-স্থলে মাত্র ব্রহ্মার সপ্তম জন্মে অর্থাৎ বর্তমান কল্পে ত্রেতাযুগের প্রথমে এই ধর্ম কিরূপে প্রচারিত হইয়াছিল, সেই পরম্পরা দেওয়া হইয়াছে ।

২) রাজর্ষি = রাজা হইয়াও যিনি ঋষি, যেমন জনকাদি । সুতরাং যাঁহারা জ্ঞানী ও কর্মী, ইহা তাঁহাদেরই অধিগম্য ।

৬) মায়া = পরমেশ্বরের অপূর্ব সৃষ্টি-কৌশল, যোগমায়া, যোগ । শঙ্কর মতে অবস্তু বা ভ্রমাত্মক কোনো কিছু (illusion) ।
পরমেশ্বরের নিজের অব্যক্ত স্বরূপ হইতে সমস্ত জগৎ নির্মাণ করিবার অচিন্ত্য শক্তিকেই গীতাতে ‘মায়া’ বলা হইয়াছে [তিলক] ।

অবতারতত্ত্ব :
সর্বভূতেশ্বর জন্মমৃত্যু-রহিত, প্রাণিগণের যেরূপ জন্মমৃত্যু হয়, তাঁহার সেরূপে আবির্ভাব হয় না । তিনি তাঁহার ত্রিগুণাত্মিকা প্রকৃতিকে বশীভূত করিয়া মায়াবলে আবির্ভূত হন অর্থাৎ মায়া-শরীর ধারণ করেন [শ্রীমৎ শঙ্করাচার্য] । কিন্তু ভক্তিপন্থী শ্রীধরস্বামী প্রভৃতি বলেন – উহাই তাঁহার নিত্যসিদ্ধ-চিদ্রূপ, উহা জড়রূপ নহে ।

মহাভারতে নারায়ণীয়-পর্বাধ্যায়ে যে দশ অবতারের উল্লেখ আছে তাহাতে বুদ্ধ অবতার নাই, প্রথমে হংস (swan) অবতার । পরবর্তী পুরাণসমূহে বুদ্ধ-অবতার লইয়াই দশ অবতারের গণনা হইয়াছে । ভাগবতে দ্বাবিংশ অবতারের উল্লেখ আছে, এবং এই প্রসিদ্ধ শ্লোকাংশ আছে – ‘শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং ভগবান পরব্রহ্ম; সমস্ত অবতার তাঁহারই অংশ ও কলা’ । বিশদ

বেদান্তমতে ঈশ্বর কেবল এক নন, তিনি অদ্বিতীয়, একমেবদ্বিতীয়ম্‌, তিনিই সমস্ত, তিনি ছাড়া আর-কিছু নাই, সকলই তাঁহার সত্তায় সত্তাবান, সকলই তাঁহার মধ্যেই আছে, তিনি সকলের মধ্যেই আছেন । সুতরাং অজ আত্মার দেহ-সম্পর্ক গ্রহণ করা অসম্ভব তো নহেই, বরং সেই সম্পর্কেই জগতের অস্তিত্ব । কাজেই হিন্দুর পক্ষে অবতার-বাদ কেবল ভক্তি-বিশ্বাসের বিষয়মাত্র নহে, উহা বেদান্তের দৃঢ় ভিত্তির উপরেই প্রতিষ্ঠিত ।

৮) যুগে যুগে – তত্ত্বদবসরে, তত্তৎ সময়ে (শ্রীধর, বলদেব) যখনই ধর্মের গ্লানি হয়, তখনই অবতার; এক যুগে একাধিক অবতারও হয় ।

১১) গীতার এই শ্লোকটির তাৎপর্য বুঝিলে প্রকৃতপক্ষে ধর্মগত-পার্থক্য থাকে না, হিন্দুর হৃদয়ে ধর্মবিদ্বেষ থাকিতে পারে না । হিন্দুর নিকট কৃষ্ণ, খ্রীষ্ট, বুদ্ধ সকলেই এক ।

‘ইহাই প্রকৃত হিন্দুধর্ম । হিন্দুধর্মের তুল্য উদার ধর্ম আর নাই – আর এই শ্লোকের তুল্য উদার মহাবাক্য আর নাই ।’ [বঙ্কিমচন্দ্র]

১৩) অব্যয় – অবিকারী (নীলকন্ঠ) । তিনি নির্গুণ হইয়াও সগুণ, ‘নির্গুণো-গুণী’ । নির্গুণ বিভাবে তিনি নির্বিশেষ নিষ্ক্রিয়; সগুণবিভাবে তিনি সৃষ্টিস্থিতিপ্রলয়কর্তা । তাই তিনি কর্তা হইয়াও অকর্তা, ক্রিয়াশীল হইয়াও অবিকারী । কেহ সকামভাবে রাজসিক বা তামসিক পূজার্চনা করে, কেহ নিষ্কাম ভাবে উপাসনা করে । এরূপ কর্ম-বৈচিত্র্য কেন? তুমিই ত এসব ঘটাও ? – না, প্রকৃতিভেদবশতঃ এইরূপ হয় । প্রকৃতিভেদ অনুসারে বর্ণভেদ বা কর্মভেদ আমি করিয়াছি – কিন্তু আমি উহার কর্তা হইলেও উহাতে লিপ্ত হই না বলিয়া আমি অকর্তা । জীবেরও এই তত্ত্ব জানিয়া নিষ্কামভাবে স্বধর্ম পালন করা উচিত । মুমুক্ষু ব্যক্তিগণ পূর্বে এই ভাবেই কর্ম করিযাছেন ।

চাতুর্বর্ণের উৎপত্তি

১৪) শ্রীভগবান্‌ আদর্শ কর্মযোগী, তাঁহার নির্লিপ্ততা ও নিস্পৃহতা বুঝিতে পারিলে মনুষ্য নিষ্কাম কর্মের মর্ম বুঝিতে পারে, তাহার কর্ম নিষ্কাম হয় । সুতরাং কর্ম করিয়াও সে কর্মবন্ধন হইতে মুক্ত হয় ।

১৬) কর্ম – বিহিত কর্ম; বিকর্ম – অবিহিত কর্ম; অকর্ম – কর্মশূন্যতা; কর্মত্যাগ, কিছু না করিয়া তুষ্ণীম্ভাব অবলম্বন ।

১৮) কর্মতত্ত্বঃ, বিকর্মতত্ত্ব, অকর্মতত্ত্ব :
কর্মতত্ত্বঃ : যিনি কর্মে অকর্ম দর্শন করেন অর্থাৎ যিনি কর্ম করিয়াও মনে করেন যে দেহেন্দ্রিয়াদি কর্ম করিতেছে, আমি কিছুই করি না, তিনিই বুদ্ধিমান্‌, কেন না কর্ম করিয়াও তিনি কর্মের ফলভোগী হন না । অর্থাৎ যিনি কর্তৃত্বাভিমান ত্যাগ করিয়া কর্ম করেন, তাঁহার কর্মও অকর্মস্বরূপ ।

বিকর্মতত্ত্বঃ : কর্ম করিয়াও তাহার ফলভোগী হন না সুতরাং নির্লিপ্ত অনহঙ্কারী কর্মযোগীর পক্ষে বিকর্মও অকর্মস্বরূপ ।

অকর্মতত্ত্বঃ : আর যিনি অকর্মে কর্ম দর্শন করেন, তিনিই বুদ্ধিমান্‌ । অনেকে আলস্যহেতু, দুঃখবুদ্ধিতে কর্তব্যকর্ম ত্যাগ করেন, কিন্তু তাহারা জানেন না এ অবস্থায় প্রকৃতির ক্রিয়া চলিতে থাকে, কর্মবন্ধ হয় না । এই যে কর্মত্যাগ বা অকর্ম ইহা প্রকৃতপক্ষে কর্ম, কেননা ইহা বন্ধনের কারণ । আবার ইহারা কর্ম ত্যাগ করিয়া মনে করেন, আমি কর্ম করি না, আমি বন্ধনমুক্ত । কিন্তু “আমি কর্ম করি” ইহা যেমন অভিমান, “আমি কর্ম করি না” ইহাও সেইরূপ অভিমান, সুতরাং বন্ধনের কারণ । ইহারা বুঝেন না যে কর্ম করে প্রকৃত, ‘আমি’ নহে । বস্তুতঃ ‘আমি’ ত্যাগ না হইলে কেবল কর্মত্যাগে বন্ধন-মুক্ত হওয়া যায় না । সুতরাং এইরূপ অকর্ম বা কর্মত্যাগও বন্ধনহেতু বলিয়া প্রকৃতপক্ষে কর্মই ।

১৯) নিষ্কাম কর্ম দিব্য কর্ম, ভাগবৎ কর্ম ! ‘আমি করিতেছি’ এইরূপ কর্তৃত্বাভিমান যাঁহার নাই, তিনি কর্ম করিয়াও তাহার ফলভাগী হন না । অহং-বুদ্ধিত্যাগই প্রকৃত জ্ঞান । এই জ্ঞানরূপ অগ্নিদ্বারা তাঁহার কর্মের ফল দগ্ধ হইয়াছে, তাঁহার কর্মের ফলভাগিত্ব বিনষ্ট হইয়াছে । এইরূপ ব্যক্তিই কর্মে অকর্ম অর্থাৎ কর্মশূন্যতা দেখেন ।

২৩) যজ্ঞতত্ত্ব :
বৈদিক যজ্ঞাদি লইয়াই হিন্দুধর্মের আরম্ভ । যজ্ঞমাত্রেরই মূল তাৎপর্য হইতেছে ত্যাগ এবং ত্যাগের ফলস্বরূপ ভোগ – দিব্যভোগ (‘অমৃতমশ্নুতে’) । নৃযজ্ঞ, ভূতযজ্ঞ প্রভৃতি স্মার্ত-যজ্ঞগুলি সকলই ত্যাগমূলক । প্রাচীনকালে যজ্ঞই ঈশ্বর-আরাধনার প্রধান অঙ্গ ছিল । কালক্রমে এই সকল যজ্ঞবিধি অতি জটিল ও বিস্তৃত হইয়া পড়ে ।

বেদের ব্রাহ্মণভাগে বিবিধ যাগযজ্ঞাদির বিস্তৃত বিবরণ আছে । বৈদিক ক্রিয়াকর্ম ও বৈদিক মন্ত্রের দুইটি অঙ্গ ছিল – (i)বাহ্য, আনুষ্ঠানিক; (ii)আভ্যন্তরীণ, আধ্যাত্মিক । বাহ্য অনুষ্ঠানটি প্রকৃতপক্ষে কোনো আধ্যাত্মিক গূঢ়-তত্ত্বেরই রূপক বা প্রতীকরূপে ব্যবহৃত হইত । যেমন সোমরস = অমৃত/অমরত্ব/ভূমানন্দের প্রতীক; ধান = ধনের প্রতীক; দূর্বা = দীর্ঘায়ুর প্রতীক । দূর্বার মৃত্যু নাই, রৌদ্রে পুড়িয়া, বর্ষায় পচিয়া গেলেও আবার গজাইয়া উঠে । উহার আর এক নাম ‘অমর’ । সুতরাং ধান-দূর্বা মস্তকে দেওয়ার অর্থ – ধনেশ্বর হও, চিরায়ু লাভ কর । বস্তুত, হিন্দুদিগের পূজার্চনা, আচার-অনুষ্ঠান সমস্তই রূপক বা প্রতীক-তান্ত্রিক (symbolic) ।

ক্রমে ব্রহ্মবিদ্যা বা জ্ঞানমার্গের প্রভাবে বৈদিক যাগযজ্ঞাদি গৌণ বলিয়া বিবেচিত হইতে লাগিল এবং জ্ঞানযজ্ঞ/ব্রহ্মযজ্ঞই শ্রেষ্ঠ যজ্ঞ বলে নির্ধারিত হইল । তাহার পর ভাগবত-ধর্ম ও ভক্রিমার্গের প্রচার হইলে পুরাণাদি-শাস্ত্রে জপযজ্ঞ/নামযজ্ঞেরই প্রাধান্য দেওয়া হইয়াছে । শ্রীগীতায়ও ভগবান দ্রব্যযজ্ঞ হইতে জ্ঞানযজ্ঞেরই শ্রেষ্ঠতা দিয়াছেন । বস্তুত ভারতীয় ধর্মচিন্তার ক্রমবিকাশ ও সম্প্রসারণের সঙ্গে-সঙ্গে যজ্ঞশব্দের অর্থ ও তাৎপর্য সম্প্রসারিত হইয়াছে । গীতায় এই সম্প্রসারণের সকল স্তরই স্বীকার করা হইয়াছে এবং যজ্ঞের যে মূলতত্ত্ব ত্যাগ, ঈশ্বরার্পণ, নিষ্কামতা তাহা যুক্ত করিয়া সবগুলিই মোক্ষপ্রদ করিয়া দেওয়া হইয়াছে ।

২৪) যিনি কর্মে ও কর্মের অঙ্গসকলে ব্রহ্মই দেখেন, তিনি ব্রহ্মত্বই প্রাপ্ত হন – ‘ব্রহ্মবিদ ব্রহ্মৈব ভবতি’ ।

জ্ঞানীর কর্ম ব্রহ্মকর্ম :
যিনি যজ্ঞ করিতে বসিয়া স্রুবাদি (হবিঃ-অর্পণ করিবার জন্য হাতা) কিছু দেখিতে পান না, সর্বত্রই ব্রহ্ম দর্শন করেন, ব্রহ্ম ব্যতীত আর-কিছু ভাবনা করিতে পারেন না, ব্রহ্মে একাগ্রচিত্ত সেই যোগী পুরুষ ব্রহ্মই প্রাপ্ত হন । এই স্থলে ‘যজ্ঞ’-শব্দ রূপার্থক; বস্তুত জ্ঞানীর কর্মকেই এখানে যজ্ঞরূপে কল্পনা করা হইয়াছে । ইহাই কর্মযোগের শেষ কথা, এই অবস্থায় কর্ম জ্ঞানে পরিসমাপ্ত হয় । এই জন্যই বলা হইয়াছে, ‘সাংখ্যগণ যে স্থান লাভ করেন, কর্মযোগীও তাহাই প্রাপ্ত হন’ [৫|৫] । যাঁহারা ‘সাংখ্যযোগ ও কর্মযোগকে পৃথক বলেন তাঁহারা অজ্ঞ’ [৫|৪] । ‘সর্বং খল্বিদং ব্রহ্ম’ (এ-সমস্তই ব্রহ্ম), ‘অহং ব্রহ্মাস্মি’ (আমি ব্রহ্ম), ইত্যাদি শ্রুতিবাক্য এই জ্ঞানই প্রচার করিয়াছেন । জীবের অহংবুদ্ধি যখন সম্পূর্ণ বিদূরিত হয়, তখনই এই পূর্ণ একত্বের জ্ঞান আবির্ভূত হয় । তখন জ্ঞাতা-জ্ঞেয়, উপাস্য-উপাসক, কর্তা-কর্ম-করণ এইসকল ভেদবুদ্ধি থাকে না; সর্বত্রই এক তত্ত্ব, এক শক্তিই আবির্ভূত হয় । এইরূপ জ্ঞানে যিনি কর্ম করিতে পারেন, জীবনযাপন করিতে পারেন, তাঁহার কর্ম-বন্ধন কি ? তিনি তো মুক্ত পুরুষ ।

কর্ম, ভক্তি, জ্ঞান – এই তিন মার্গেরই শেষ ফল অদ্বয় তত্ত্বোপলব্ধি, পার্থক্য প্রারম্ভে ও সাধনাবস্থায় ।
কর্মীর আরম্ভ লোকরক্ষার্থ বা ঈশ্বরপ্রীত্যর্থ নিষ্কাম কর্মে;
ভক্তের আরম্ভ নিষ্কাম উপাসনায়;
জ্ঞানমার্গী সাধকগণ প্রারম্ভ হইতেই অদ্বৈতভাবে চিন্তা করেন ।
বিশিষ্ট চিন্তা :
প্রকৃত পক্ষে জ্ঞানমার্গী সাধকগণদের কোনো উপাসনা নাই, কেননা সকলই যখন ব্রহ্ম, তখন কে কাহার উপাসনা করিবে ? কেবল ব্রহ্মচিন্তাই তাঁহাদের উপাসনা, তাই এই উপাসনার নাম ‘বিশিষ্ট চিন্তা’ । ইহা ত্রিবিধ –
অঙ্গাববিদ্ধ উপাসনা = যজ্ঞের অঙ্গবিশেষকে ব্রহ্ম ভাবনা করা ।
প্রতীক উপাসনা = যাহা ব্রহ্ম নয়, তাহাকে ব্রহ্ম-ভাবনা, যেমন মনকে ব্রহ্ম ভাবিয়া উপাসনা করা ।
অহংগ্রহ = আত্মা ব্রহ্ম হইতে অভিন্ন, আমিই ব্রহ্ম (‘অহং ব্রহ্মাস্মি’) – এইরূপ ভাব-সাধনা ।
২৫-২৭) ‘যজ্ঞ’ শব্দ রূপকার্থে ব্যবহৃত হইয়াছে । যজ্ঞের লাক্ষণিক অর্থ গ্রহণ করিয়া বিভিন্ন সাধন-প্রণালী বর্ণিত হইয়াছে :-
দৈবযজ্ঞ : ইন্দ্র-বরুণাদি দেবতার উদ্দেশে
ব্রহ্মার্পণ যজ্ঞ বা জ্ঞানযজ্ঞ : ব্রহ্মাগ্নিতে জীবাত্মার আহুতি
সংযমযজ্ঞ : ব্রহ্মচর্য অর্থাৎ ইন্দ্রিয়গুলিকে রূপরসাদি-বিষয় হইতে প্রত্যাহার
ইন্দ্রিয়যজ্ঞ : ইন্দ্রিয়রূপ অগ্নিতে শব্দাদি-বিষয়সমূহের আহূতি (নির্লিপ্ত সংসারী)
আত্মসংযম বা সমাধি-যজ্ঞ : আত্মাতে চিত্তকে একাগ্র করা (ধ্যানযোগিগণ)
প্রাণকর্মাণি – প্রাণ, অপান, ব্যান, উদান, সমান – মনুষ্য শরীরে এই পঞ্চপ্রাণ আছে :-
প্রাণবায়ুর কর্ম : বহির্নয়ন
অপান বায়ু্র কর্ম : অধোনয়ন
ব্যান বায়ু্র কর্ম : আকুঞ্চন ও প্রসারণ
উদান বায়ু্র কর্ম : ঊর্দ্ধনয়ন
সমান বায়ুর কর্ম : ভুক্তপদার্থের পরিপাক-করণ
২৮) এই শ্লোকে পাঁচ প্রকার যজ্ঞের কথা বলা হইল :-
দ্রব্যযজ্ঞ : দ্রব্যত্যাগরূপ যজ্ঞ । পূর্বের দৈবযজ্ঞ ও ব্রহ্মার্পণ যজ্ঞও দ্রব্যযজ্ঞ । উহা শ্রৌত কর্ম, আর বাপী-কূপাদি খনন, দেবমন্দির প্রতিষ্ঠা, অন্নসত্র দান ইত্যাদি স্মার্ত-কর্ম । এ-সকল এবং পুষ্পপত্র-নৈবেদ্যাদি দ্বারা পূজার্চনা সমস্তই দ্রব্যযজ্ঞ ।
তপোযজ্ঞ : কৃচ্ছ্র-চান্দ্রায়ণাদি উপবাস ব্রত
যোগযজ্ঞ : অষ্টাঙ্গ যোগ বা রাজযোগ – যম, নিয়ম, আসন, প্রাণায়াম, প্রত্যাহার, ধারণা, ধ্যান ও সমাধি ।
স্বাধ্যায়-যজ্ঞ : ব্রহ্মচর্য অবলম্বন করিয়া শ্রদ্ধাপূর্বক যথাবিধি বেদাভ্যাস
বেদজ্ঞান-যজ্ঞ : যুক্তিদ্বারা বেদার্থ নিশ্চয় করা
২৯) প্রাণবায়ু = হৃদয় হইতে যে বায়ু বাহিরে আসে; অপান বায়ু = বাহির হইতে যে বায়ু হৃদয়ে প্রবেশ করে ।
প্রাণায়াম : প্রাণ = প্রাণবায়ু, আয়াম = নিরোধ; অর্থাৎ প্রাণবায়ুর নিরোধ । ইহা তিন প্রকার – (i)পূরক, (ii)রেচক, (iii)কুম্ভক ।

পূরক প্রাণায়াম : প্রশ্বাস দ্বারা অপান বায়ুকে শরীর-ভিতরে প্রবেশ করাইলে প্রাণবায়ুর গতি রোধ হয়, ইহাই অপানে প্রাণের আহুতি; ইহাতে অন্তর বায়ুতে পূর্ণ হয় ।

রেচক প্রাণায়াম : নিঃশ্বাস দ্বারা প্রাণবায়ুকে শরীর থেকে নিঃসারণ করিলে অপান বায়ুর অন্তঃপ্রবেশরূপ গতিরোধ হয়, অর্থাৎ বাহিরের বায়ু ভিতরে প্রবেশ করিতে পারে না, ইহাই প্রাণে অপানের আহুতি; ইহাতে অন্তর বায়ুশূন্য হয় ।

কুম্ভক প্রাণায়াম : প্রাণ ও অপানের গতি রোধ করিয়া অর্থাৎ রেচন-পূরণ পরিত্যাগ-পূর্বক বায়ুকে শরীরের মধ্যে নিরুদ্ধ করিয়া অবস্থিতি করেন । এইরূপ কুম্ভকে শরীর স্থির হইলে ইন্দ্রিয়সমূহ প্রাণবায়ুতে লয় হইয়া যায়, ইহাই প্রাণে ইন্দ্রিয়সমূহের আহুতি ।

৩০) একথার তাৎপর্য এই যে, যজ্ঞই সংসারের নিয়ম । প্রত্যেকের কর্তব্য সম্পাদন দ্বারা, পরস্পরের ত্যাগ স্বীকার দ্বারা, আদান-প্রদান দ্বারাই জগৎ চলিতেছে এবং উহাতেই প্রত্যেকের সুখ-স্বাতন্ত্র্য অব্যাহত আছে । যে এই বিশ্ব-যজ্ঞ ব্যাপারে যোগদান করে না, যজ্ঞস্বরূপে স্বীয় কর্তব্য সম্পাদন করে না, তাহার ইহকাল ও পরকাল উভয়ই বিনষ্ট হয়, তাহার জীবন ব্যর্থ হয় ।

৩১) যজ্ঞাবশিষ্ট দ্রব্যকে অমৃত বলে । এ-স্থলে ইহা রূপকার্থক । যজ্ঞস্বরূপ কৃত নিষ্কাম কর্মদ্বারাই মোক্ষ লাভ হয় ।

৩৪) পরিপ্রশ্নেন – আমি কে ? আমার সংসার-বন্ধন কেন ? কিরূপে বন্ধনমুক্ত হইব ? ইত্যাদি প্রশ্ন দ্বারা ।

৩৭) ‘ইহা দ্বারা মোটেই বুঝায় না যে, যখন জ্ঞান সম্পূর্ণ হয় তখন কর্ম বন্ধ হইয়া যায়’ – [শ্রী অরবিন্দ]

পারমার্থিক জ্ঞান কি ? যাহা দ্বারা সর্বভূত এবং স্বীয় আত্মা অভিন্ন বোধ হয় এবং তারপর বোধ হয় সেই আত্মা শ্রীভগবানেরই সত্ত্বা, – আমি, সর্বভূত, যাহা কিছু তাঁহার সত্তায়ই সত্তাবান, তাঁহারই আত্ম-অভিব্যক্তি, তিনিই সকলের মূল [গী|৪|৩৫] ।

প্রাকৃত/লৌকিক জ্ঞান কি ? চক্ষু-কর্ণাদি ইন্দ্রিয় দ্বারা, বুদ্ধিবিচার দ্বারা নানা বিষয়ে আমরা যে জ্ঞানলাভ করি । ইহাতে শ্রদ্ধার প্রয়োজন হয় না । এই সকল নিম্নস্তরের সত্যের সহিত মিথ্যা মিশ্রিত থাকে, সংশয়বুদ্ধিতে পরীক্ষা করিয়া (scientific method) মিথ্যা হইতে সত্যকে পৃথক করিয়া লইতে হয় ।

৪০) যে অজ্ঞ, অর্থাৎ যাহার শাস্ত্রাদির জ্ঞান নাই, এবং যে সদুপদেশ লাভ করে নাই এবং যে শ্রদ্ধাহীন অর্থাৎ সদুপদেশ পাইয়াও যে তাহা বিশ্বাস করে না এবং তদনুসারে কার্য্য করে না, সুতরাং যে সংশয়াত্মা – অর্থাৎ যাহার সকল বিষয়েই সংশয় – এইটি কি ঠিক, না ঐটি ঠিক, – এইরূপ চিন্তায় যে সন্দেহাকুল তাহার অত্মোন্নতির কোন উপায় নাই ।

৪১) অর্থাৎ – জ্ঞানী কর্ম করিয়াও কর্মে আবদ্ধ হন না, সুতরাং জ্ঞানীরও কর্ম আছে, একথা স্পষ্টই বলা হইল, তবে সে কর্ম অকর্মস্বরূপ ।

রহস্য : কর্ম ও জ্ঞানে সংযোগ কিরূপে সম্ভব ?
গতি ও স্থিতি, আলোক ও অন্ধকার যেমন একত্র থাকিতে পারে না, তদ্রূপ কর্ম ও জ্ঞানের সমুচ্চয় অসম্ভব বলিয়াই বোধ হয় । সন্ন্যাসবাদিগণ এইরূপ যুক্তিবলেই জ্ঞান-কর্মের অস্বীকার করেন । ‘আমিত্ব’ বর্জন করিয়াও ‘আমি’ রাখা, জ্ঞানলাভ করিয়াও কর্ম করা – এটা অসম্ভব নহে । বস্তুত যোগিগণ সর্বদাই আবশ্যক কর্ম করেন যেমন রাজর্ষি জনকাদি, দেবর্ষি নারদাদি, ব্রহ্মর্ষি বশিষ্ঠাদি, মহর্ষি বিশ্বমিত্রাদি, পরমহংস রামকৃষ্ণাদি । সর্বোপরি শ্রীভগবান স্বয়ং নিজ কর্মের আদর্শ দেখাইয়া, জ্ঞানিগণকে বিশ্বকর্মে আহ্বান করিয়া বলিতেছেন – ‘লোকরক্ষার্থ জ্ঞানিগণও অনাসক্তচিত্তে কর্ম করিবে’ । ইহার উপর আর টীকা-টীপ্পনী চলে না, দার্শনিক মতবাদ যাহাই হউক ।

৪২) তুমি যুদ্ধে অনিচ্ছুক, কারণ তোমার হৃদয়ে নানারূপ সংশয় উপস্থিত হইয়াছে । গুরুজনাদি বধ করিয়া কি পাপভাগী হইব ? আত্মীয়-স্বজনাদির বিনাশে শোক-সন্তপ্ত হইয়া রাজ্যলাভেই বা কি সুখ হইবে ? এইরূপ শোক, মোহ ও সংশয়ে অভিভূত হইয়া তুমি স্বীয় কর্তব্য বিস্মৃত হইয়াছ । তোমার এই সংশয় অজ্ঞান-সম্ভূত । যাঁহার দেহাত্মবোধ বিদূরিত হইয়াছে, সর্বভূতে একাত্মবোধ জন্মিয়াছে – তাঁহার চিত্তে এ সকল সংশয় উদিত হয় না; তিনি শোক-দুঃখে অভিভূত হন না [ঈশোপনিষৎ|৭]; ইহাই প্রকৃত জ্ঞান, তাহা পূর্বে বলিয়াছি । শ্রদ্ধা, আত্মসংযম একনিষ্ঠা – সেই জ্ঞান লাভের যে উপায় তাহাও বলিয়াছি । আমার বাক্যে তোমার শ্রদ্ধা আছে, তোমার আত্মসংযম ও একনিষ্ঠা আছে, সুতরাং তোমাকে আমি জ্ঞানোপদেশ দিতেছি । তুমি আত্মজ্ঞান লাভপূর্বক নিঃসন্দেহ হইয়া নিষ্কাম কর্মযোগ অবলম্বন কর, স্বীয় কর্তব্য পালন কর, যুদ্ধ কর ।

One thought on “শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা: চতুর্থ অধ্যায় – জ্ঞানযোগ(গীতাশাস্ত্রী জগদীশচন্দ্র ঘোষ)

Leave a comment

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.