অহৈতুকী ভক্তি


ন ধনং ন জনং ন সুন্দরীং
কবিতাং বা জগদীশঃ কাময়ে ।
মম জন্মনি জন্মনীশ্বরে
ভবতাদ্ ভক্তিরহৈতুকী ত্বয়ি ॥ ৪ ॥

অনুবাদঃ হে প্রভো! আমি ধন চাই না, অনুগামী লোকজন চাই না, সুন্দরী নারী, মুক্তি এ সব কিছুই চাই না । আমার একমাত্র প্রার্থনা, যেন জন্মে জন্মে তোমার অহৈতুকী প্রেম-সেবা করতে পারি ।

অমৃত-প্রভা ভাষ্যঃ

শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু আমাদিগকে এই পথে এগিয়ে যেতে বলেন, “আমি টাকা-কড়ি, সোনা, মণিমাণিক্য কোন ধনই চাই না, জগতে যশ প্রতিষ্ঠা বা অনুগত লোকজনও চাই না; সুন্দরী নারীর সঙ্গ কামনাও আমার নাই । সুনাম বা কবি খ্যাতিও আমার দরকার নাই ।” এ হল উক্ত শ্লোকের সাধারণ অর্থ । কিন্তু শ্রীল ভক্তিবিনোদ ঠাকুর ও শ্রীল ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী ঠাকুর এই শ্লোকের টীকায় আরও গভীর রহস্য উদ্ ঘাটন করেছেন ।
আমাদের গুরু মহারাজ এই শ্লোকের টীকায় লিখেছেন যে, ধন, জন, নারী এবং কবি যশ এর অন্তরালে duty, wealth, sense pleasure and salvation অর্থাৎ ধর্ম, অর্থ, কাম ও মোক্ষাভিলাষ নিহিত । শ্রীল ভক্তিবিনোদ ঠাকুর এই শ্লোকের টীকায় ব্যক্ত করেছেন; ধন বলতে নিজের বর্ণাশ্রম ধর্ম অনুযায়ী কর্ত্তব্য পালনের মাধ্যমে অর্থাৎ সদ্বৃত্তি দ্বারা-লব্ধ অর্থ বা আর্থিক সচ্ছলতা । ‘জন’ বল্তে নিজের comfort বা সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য স্ত্রী-পুত্রাদি আত্মীয়-স্বজন এবং পরিচারকবর্গ । ‘সুন্দরীং’ অর্থ কাম-তৃপ্তি বা সুন্দরী নারী-সঙ্গ । ‘কবিতাং’ অর্থ কাব্য বা মোক্ষ । মোক্ষ শব্দের অর্থ আপাততঃ খুব উচ্চস্তরের কথা মনে হয় । কিন্তু আসলে কাব্য-কবিতার মত এও flowery words, স্তোকবাক্য মাত্র ।মোক্ষ এক প্রকার কল্পনা মাত্র কারণ প্রকৃতপক্ষে মোক্ষের শেষ পর্য্যায় ত’ নির্বাণ, আত্মসত্তার বিলুপ্তি!

সেবার পুঁজিপতি (Service Capitalist)ঃ

শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু বলেন, হে প্রভো! আমি কেবল তোমার প্রতি সহজাত অহৈতুকী ভক্তি চাই, তার কোনও প্রতিদান চাই না । আমি সহজাত সেবাপ্রবৃত্তির প্রয়াসী । প্রেম অর্থে ভালবাসা, affection, love, আমি তোমার সেবাই করবো, আর তুমি তার পারিতোষিকরূপে আরও সেবা করবার প্রবৃত্তি, সামর্থ্য ও লালসাই দান করবে—এরই নাম প্রেম । আমার সেবাপ্রবৃত্তি আরও বাড়বে আর তার interest—সুদই হবে আরও সেবা করবার মূলধন, Capital—ঠিক যেমন হয় money lending business এ—টাকা সুদে খাটাবার ব্যবসায়ে । এইভাবে ভক্ত ভগবানের কাছে প্রার্থনা জানায়—“প্রভো!আমি ত’ তোমার সেবা করছি, আর যদি তুমি তার বদলে আমাকে কিছু দিতে চাও, তাহলে দাও—আরও মূলধন দাও, যাতে করে আমার সেবাবৃত্তি উত্তরোত্তর বাড়তে থাকে ।”
আমি নিজের কর্মফলে যেখানেই জন্মাই না কেন, হে প্রভো! আমি কেবল তোমার সেবাই চাই, তার প্রতিদিনে অন্য কিছুই চাই না । সাধারণতঃ আমাদের চারিদিকে যে সব প্রলোভন ঘিরে ধরেছে সেগুলো হল—ধন, জন, নারী আর মোক্ষকামনা অর্থাৎ ধর্ম, অর্থ, কাম ও মোক্ষ—এইভাবে জীবনের চার পুরুষার্থের বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ করা হয়েছে ।
কিন্তু শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু বলেন ঐসব পুরুষার্থের প্রতি আমার কোনও আকর্ষণ নাই । কিন্তু কেবল তোমাকেই চাই প্রভো! আমি মুক্তি পেতে চাই না । আমি কখনও তা চাইব না—হে প্রভো! আমাকে এই সংসার থেকে মুক্তি দাও । মুক্তি পেলে আমি তোমার সেবা ভালভাবে করতে পারব—এ প্রকার condition বা চুক্তি ভগবানের সঙ্গে করা চলে না । এইটাই হল সবচেয়ে নিষ্কাম প্রার্থনা—নিজের কর্ম-দোষে আমি পশু, পক্ষী যে জন্মই পাই বা স্বর্গে, নরকে যেখানেই যাই, তাতে কোন ক্ষতি নাই । আমার সমগ্র আশা-আকাা কেবল একটিতেই কেন্দ্রিত—তোমার প্রতি আমার আকর্ষণ যাতে হারিয়ে না যায়, আমি চাই তা আমার যেন প্রতিদিনই বাড়তে থাকে ।
Devotion—ভক্তি হচ্ছে অহৈতুকী, তার কোন হেতু নাই । এইটিই জীবের সহজাত প্রবৃত্তি অন্য কোন কামনা-বাসনা তাতে নাই । কেউ হয়ত’ বলতে পারে, যদি সুদই সবসময় মূলধন— capital রূপে খাটান যায়, তবে ত’ আমি কোন লাভই লাভ পাব না! কিন্তু আমাদের বিচার ত’ আলাদা । আমাদের enjoyment-ই হল self-giving—নিজেকে দিয়ে দেওয়া—অপরে আমায় নিয়ে enjoy করুক এইটাই হল highest enjoyment এর basis—মূলভিত্তি । ভক্ত ভাবে— Let Krishna enjoy with others—I will be the scape-goat, যত সম্ভোগ কৃষ্ণেরই তাঁর নিত্য পরিচরগণের সঙ্গে; আমি ত’ কেবলমাত্র সেবাদাস ।
শ্রীল ভক্তিবিনোদ ঠাকুর বলেন, “শিশুর যখন কোন জ্ঞানই থাকে না, তাকে রোগে বা শত্রুতে আক্রমণ করলে সে নিজেকে রক্ষা করতে পারে না । ঠিক তাই, যখন কোন সাধকের নামপ্রভুর সম্পর্কে কোন জ্ঞানই হয় নাই, তখন তার সেটা শৈশবাবস্থা, সেই অবস্থায় তার নামাপরাধ ইত্যাদি হওয়া স্বাভাবিক । যখন তার জ্ঞান বৃদ্ধি পায় তখন কোন অপরাধ তাকে স্পর্শ করতে পারে না । কিন্তু প্রথমাবস্থায় নানাপ্রকার অপরাধের আশঙ্কা আছেই ।

Suicide Squad—আত্মঘাতী সেনাঃ

শ্রীল ভক্তিবিনোদ ঠাকুর বলেন, “কৃষ্ণনাম এতই সুন্দর, মধুর, উদার, চমৎকার! আমি বরং সকল নামাপরাধ নিজের মাথায় নিয়ে মরি, অন্য সকলে সেই নামামৃত আস্বাদন করুক ।” তিনি নিজেকেও বলি দিতে চান, ঠিক যেমন যুদ্ধ সময়ে হয়ে থাকে । যুদ্ধের সময় সৈন্যেরা নিজের বগলে বম্ বেঁধে শত্রু জাহাজের চিম্ নির ভিতর লাফ দেয় । ব্রিটিশের সঙ্গে যুদ্ধের সময় জাপানী Suicide Squad এর সৈন্যরা এই রকম দুঃসাহসিক কাজ করেছিল । সেই সাহসের কথা শুনে হিটলার বলেছিলেন, “এখনও আমাদের জাপানীদের কাছ থেকে কিছু শিক্ষা করার আছে । তাই শ্রীল ভক্তিবিনোদ ঠাকুর প্রার্থনা করেন—
“নাম প্রভুর চরণে যতরকম অপরাধ আছে, সে সব নিয়ে আমি শেষ হয়ে যাই, অন্য সাধকেরা নামরসামৃত আস্বাদন করুক ।”
শ্রীল বাসুদেব দত্ত ঠাকুরও বলেছিলেন, “প্রভো! পৃথিবীর জীবের যত পাপ আছে, তা আমাকে দিয়ে নরকে ফেলে দাও, তাদের উদ্ধার কর—তাদের কৃষ্ণপ্রেম দাও ।” কিন্তু ভক্তদের এই মহান্ উদারতার জন্য তারা কখনও বিনাশ পান না । বলা হয় die to live, বাঁচার জন্যেই মরা । প্রভুর চরণে যাঁদের এই প্রকার প্রেমভক্তি রয়েছে, তাঁরা ত’ অনন্ত শাশ্বত জীবনই লাভ করে । এইটীই প্রকৃত সুখ—যা আমরা পাই ।
শ্রীমন্মহাপ্রভুর শিক্ষাষ্টকের শেষ শ্লোকে এই প্রকার sentiment প্রেমসেবার কথা বুঝিয়ে বলা হয়েছে । এই প্রেমের উদাহরণ আর একটি শাস্ত্রে পাওয়া যায় । এক সময় কৃষ্ণের মাথাধরার জন্য ভক্তের পদধূলির প্রয়োজন হল । শ্রীনারদ তা সংগ্রহের জন্য প্রথমে দ্বারকার মহিষীদের কাছে গেলেন । কিন্তু স্বামী হলেও কৃষ্ণত’ স্বয়ং ভগবান এই জন্য তারা অপরাধের ভয়ে পদধূলো দিতে চাইলেন না । শেষে নারদ বৃন্দাবনে গিয়ে কৃষ্ণপ্রেয়সী গোপীদের কাছে কৃষ্ণের আরোগ্য লাভের জন্য তাঁদের পদধূলো চাইলেন এবং তাঁরা সাগ্রহে তাড়াতাড়ি তা দিয়েছিল । এইটাই হল কৃষ্ণের সুখের জন্য আত্মত্যাগের চরম সীমা এবং এইটাই হল পরিপূর্ণ ভক্তি । ভক্তের জীবনই কেবল কৃষ্ণসুখের জন্য ।যেখানে যত ত্যাগ, সেখানে ভক্তির গাঢ়তাও তত বেশী । আর ঐ ত্যাগই হল Die to Live বাঁচার জন্য মরা । কৃষ্ণই হচ্ছেন বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ ভোক্তা তাই তাঁর জন্য আমরা নিজেকে সম্পূর্ণ দিয়ে দিতে কুণ্ঠিত হব না ।