৯। শ্ৰীকৃষ্ণ-সনাতন ধর্মের উদ্ধার কর্তা


শ্ৰীকৃষ্ণ-সনাতন ধর্মের উদ্ধার কর্তা; কেন-না, ধর্ম সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার আদর্শ তিনিই দেখিয়ে গেছেন।
[ধর্ম ও সনাতন ধর্ম; শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাব-কারণ, ধর্ম ও সনাতন ধর্মের পরিচয়-লাভ; কোন্‌ ধর্মের গ্লানি দূরীকরণে শ্রীকৃষ্ণ আবির্ভূত হন, সে ধর্ম বর্ণাশ্রম ধর্ম; অধর্ম-বারণ ও ধর্ম-প্রতিষ্ঠা, শ্রীকৃষ্ণ কর্তৃক কিভাবে তা সংশোধিত হয়েছিল, তার নিদর্শন।]

ধর্ম ও সনাতন ধর্ম
ধর্ম শব্দের ব্যাখ্যায় আমরা প্রতিপন্ন করেছি যে, যা দ্বারা লোক-রক্ষা, সংসার-রক্ষা, সৃষ্টি-রক্ষা, আত্ম-রক্ষা হয়, তাহাই ধর্ম।ভ‘সনাতন ধর্ম’ শব্দের অর্থ নিত্য। সুতরাং ‘সনাতন ধর্ম’ শব্দে যে ধর্ম দ্বারা নিত্যকাল লোক, সৃষ্টি ও আত্ম-রক্ষা হয়ে আসছে, তাহাই বুঝা যায়। এই অর্থের অনুসরণে, কেউ বা সদ্‌গুণ সমূহকে সনাতন ধর্ম বলে কীর্তন করেছেন; কেউ বা, যে কর্ম সৎ ফলপ্রসূ, তাকেই ধর্ম বলে ঘোষণা করে থাকেন। প্রথমোক্ত মতে- অদ্রোহ, অস্ত্যেয়, দম, ব্রহ্মচর্য্য, সত্য, ক্ষমা, ধৃতি, অহিংসা প্রভৃতি ধর্ম মধ্যে পরিগণিত; কিন্তু শেষোক্ত মতে, কর্ম ও অকর্ম, হিংসা ও অহিংসা, উভয়ই ধর্ম মধ্যে পরিগণিত হতে পারে। শ্ৰীকৃষ্ণ নিজ উপদেশ ও কাজে ঐ দুই মতের সামঞ্জস্য সাধন করেছেন। তিনি দেখিয়েছেন, -সনাতন-ধর্মে সকলেরই স্থান আছে, অতিঘৃণ্য নরকের কীট হতে পরম পুরুষ পরাৎপর পর্য্যন্ত সকলেই সনাতন ধর্মের প্রভাব অন্তর্ভুক্ত। ফলতঃ, যে কিছুর সাহায্যে লোক-রক্ষা সৃষ্টি-রক্ষা হতে আত্মরক্ষা অর্থাৎ আত্ম-উৎকর্ষ বা আত্মায় আত্ম-সম্মিলনের পথ প্রশস্ত হয়, তাহাই সনাতন ধর্মের অন্তর্গত। তাই সনাতন ধর্ম রূপ কল্পবৃক্ষে ধর্ম অর্থ কাম মোক্ষ সকল ফলই স্তরে স্তরে সজ্জিত আছে।

শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাবের কারণে-
পৃথিবীতে নানা ধর্ম-মত ও নানা ধর্ম-সম্প্রদায় প্রচলিত অাছে। তার মধ্যে শ্ৰীকৃষ্ণ কোন ধর্ম-মতের অনুসরণ করেছিলেন ও কোন ধর্ম-মত প্রতিষ্ঠায় সমর্থ হয়েছিলেন, আর কেনই বা সে ধর্ম-মত কে সনাতন ধর্ম বলি; তার কয়েকটি তথ্য অনুসন্ধানের চেষ্টা করেছি। তা থেকে বুঝা যাবে, ধর্ম-সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার আদর্শ-প্রদর্শনে শ্ৰীকৃষ্ণ সনাতন ধর্মের উদ্ধার কর্তা বলে প্রখ্যাত আছেন। তিনি বলেছেন,- ধর্ম্ম সংস্থাপনার্থায় সম্ভবামি যুগে যুগে।” যখন ধর্মের গ্লানি উপস্থিত হয়, অধর্মের অভ্যুদয় ঘটে, সাধুদের পরিত্রাণের জন্য এবং দুষ্কৃত জনের দমনের জন্য তাঁর (ভগবানের) আবির্ভাব হয়। এই কারণেই অর্থাৎ সাধুদের পরিত্রাণ ও দুষ্কৃত জনের দমনের জন্যই ভগবানের মর্ত্যে অবতরণ; আর তাতেই অধর্মের অভ্যুত্থান রোধ এবং ধর্মের প্রতিষ্ঠা হয়ে থাকে। অতএব, ভগবদ উক্তিতে তাঁর দেহ-ধারণের চারটি কারণ দেখতে পাই , (ক) ধর্মের গ্লানি, (খ) অধর্মের অভ্যুত্থান, (গ) সাধুদের পবিত্ৰাণ, এবং (ঘ) দুষ্কৃত জনের দমন। এই কারণ-চতুষ্টয়ের প্রত্যেকটির সাথে প্রত্যেকটি সম্বন্ধযুক্ত। অধর্মের অভ্যুদয় নিবারণ হলেই ধর্মের গ্লানি দূর হতে পারে, আবার তাতেই দুষ্কৃতের বিনাশ এবং সাধুদের পরিত্রাণ আপনা-আপনিই সূচিত হয়ে থাকে। অধর্মের অভ্যুত্থান-নিবারণেই দুষ্কৃতের দমন, আর ধর্মের গ্লানি নিবারণে অর্থাৎ ধর্মের সু প্রতিষ্ঠায় সাধুদের পরিত্রাণ। এখন দেখা যাক, গ্লানি হয়েছিল-সে কোন ধর্মের ? যার অভ্যুত্থান হচ্ছিল- তাহাঁই বা কোন অধর্ম ? আরও দেখা যাক, যে দুষ্কৃতের তিনি দমন করেছেন -সেই বা কেমন দুষ্কৃত ? অারও, যে সাধুদের তিনি পরিত্রাণ করেছেন- তাঁরাই বা কি প্রকার সাধু ছিলেন ? এই সকল তথ্য নিষ্কাষণ করতে পারলে, সনাতন ধর্ম-প্রতিষ্ঠায় শ্রীকৃষ্ণের প্রভাব সম্যক ভাবে উপলব্ধি হবে। আমরা এখন একে একে ঐ চারটি বিষয়ের অনুসন্ধান করে দেখছি। তাতে বক্তব্য বিষয় বেশ বোধগম্য হওয়ার সম্ভাবনা।

কোন ধর্মের গ্লানি দূর করার জন্য আবির্ভূত হন ?
প্রথম দেখা যাক, শ্ৰীকৃষ্ণ কোন ধর্মের গ্লানি দূর করবার জন্য, কোন ধর্মের প্রতিষ্ঠা রক্ষা-কল্পে, অবতীর্ণ হন ? শ্ৰীমদ্ভগবদগীতার অস্থি-মজ্জায় দেখতে পাই, সে কোন ধর্মের ধর্ম -বর্ণাশ্রম ধর্ম। তিনি বলেছেন,- “চাতুৰ্ব্বণ্যং ময়া সৃষ্টং গুণকর্ম্মবিভাগশঃ।” চার বর্ণ তারই সৃষ্টি, অর্থাৎ বর্ণাশ্রম ধর্মের তিনিই প্রবর্তক। শারীরিক তপস্যার সংজ্ঞায়ও তিনি বলেছেন, ‘দেবতা, ব্রাহ্মণ, গুরু ও তত্ত্বজ্ঞ সাধুদের পূজা, শৌচ, সরলতা, ব্রহ্মচর্য ও অহিংসা, প্রভৃতি শারীরিক তপস্যা বলে উক্ত হয়।’ (দেবদ্বিজগুরুপ্রাজ্ঞপূজনং শৌচমার্জবম্‌। ব্রহ্মচর্য্যমহিংসা চ শারীরং তপ উচ্যতে।)। এখানেও বুঝা গেল, ব্রাহ্মণ আদির পুজায় বর্ণাশ্রম ধর্মেরই প্রাধান্য কীর্তন করলেন। তারপর ব্রাহ্মণ আদি বর্ণের কর্ম-বিভাগে এবং সে কর্ম অনুসারেই তারা যে সিদ্ধিলাভ করতে পারেন, তা বলেও বর্ণাশ্রম ধর্মেরই মাহাত্ম্য দেখালেন। যথা,-

“ব্রাহ্মণক্ষত্রিয়বিশাং শূদ্রাণাং চ পরন্তপ। কর্মাণি প্রবিভক্তানি স্বভাবপ্রভবৈর্গুণৈঃ॥
শমো দমস্তপঃ শৌচং ক্ষান্তিরার্জবমেব চ। জ্ঞানং বিজ্ঞানমাস্তিক্যং ব্রহ্মকর্ম স্বভাবজম্॥
শৌর্যং তেজো ধৃতির্দাক্ষ্যং যুদ্ধে চাপ্যপলায়নম্। দানমীশ্বরভাবশ্চ ক্ষাত্রং কর্ম স্বভাবজম্॥
কৃষিগোরক্ষ্যবাণিজ্যং বৈশ্যকর্ম স্বভাবজম্। পরিচর্যাত্মকং কর্ম শূদ্রস্যাপি স্বভাবজম্॥
স্বে স্বে কর্মণ্যভিরতঃ সংসিদ্ধিং লভতে নরঃ। স্বকর্মনিরতঃ সিদ্ধিং যথা বিন্দতি তচ্ছৃণু॥
যতঃ প্রবৃত্তির্ভূতানাং যেন সর্বমিদং ততম্। স্বকর্মণা তমভ্যর্চ্য সিদ্ধিং বিন্দতি মানবঃ॥
গীতা ১৮/ ৪১-৪৬।

পূর্বে শ্ৰীভগবান বলেছিলেন,-তিনি গুণকর্মানুসারে চতুর্বণের সৃষ্টি করেছেন। এখন আবার তিনি সেই চতুর্বর্ণের গুণকর্ম নির্দেশ করছেন। সঙ্গে সঙ্গে এটাও বলছেন, এই গুণকর্ম তাদের স্বভাবজঃ অর্থাৎ জন্ম অনুসারেই এই গুণকর্ম তার প্রাপ্ত হয়ে থাকেন। চতুর্বর্ণের সেই গুণকর্ম কি, শ্লোক-কয়েকটিতে তারই পরিচয় আছে। যথা,- ব্রাহ্মণের স্বভাব বিহিত কর্ম-শম অর্থাৎ মনঃসংযম, দম অর্থাৎ বাহ্যেন্দ্রিয় সংযম, তপস্যা, (১) শৌচ অর্থাৎ বাহির অন্তর শুদ্ধি, ক্ষান্তি অর্থাৎ ক্ষমা, আৰ্জব অর্থাৎ সরলতা, জ্ঞান অর্থাৎ বেদ-বেদাঙ্গ আদি শাস্ত্রার্থবোধ, বিজ্ঞান অর্থাৎ মানসিক প্রত্যক্ষ, আস্তিক্য অর্থাৎ ভগবদ্বিশ্বাস। এই সকল হল-ব্রাহ্মণের স্বভাবজঃ গুণ বা কর্ম বা পরিচয়-চিহ্ন। তার পর ক্ষত্রিয়ের কর্ম; যথা-শৌর্য্য, তেজ, ধৃতি, দক্ষতা, যুদ্ধে পলায়ন না করা, ঔদার্য, শাসন ক্ষমতা প্রভৃতি ক্ষত্রিয়ের স্বভাবজ কর্ম। বৈশ্যের কর্ম; যথা-কৃষি, পশুপালন, বাণিজ্য প্রভৃতি বৈশ্যদের স্বাভাবিক কর্ম। আর শূদ্রদের স্বাভাবিক কর্ম; পরিচর্য্যাত্মক। ‘নিজ নিজ কর্মে নিষ্ঠার দ্বারাই মানুষ সিদ্ধি লাভ করে। অন্তর্য্যামী পরমেশ্বর সর্বপ্রাণীর উৎপত্তির মূল এবং সর্বত্র পরিব্যাপ্ত আছেন; সুতরাং নিজ নিজ কর্ম দ্বারাই মানবগণ তাঁকে অর্চনা করে সিদ্ধিলাভ করেন।’ এইখানে নানা আপত্তির কথা উঠে থাকে। যারা বর্ণাশ্রম-ধর্মের বিরোধী, তারা বলেন,- ‘ঐ সকল গুণকর্মের বিচার করে দেখলে ব্রাহ্মণ আদি কোনও বর্ণেরই অস্তিত্ব থাকে না; কারণ, ঐ সকল গুণ এখন কোনও বর্ণেই নেই।’ এই সন্দেহ নিরসনের জন্য শ্রীকৃষ্ণ কি বলে গেছেন, স্মরণ করে দেখুন দেখি! তিনি বলেছেন,- “যার যা ধর্ম, তাই যদি তিনি সম্যকরূপে পালন করতে না পারেন, তাতেও দোষ নেই; বিকৃত অবস্থায় প্রাপ্ত অর্থাৎ বিকৃতভাবে অনুষ্ঠিত স্বধর্মে নিষ্ঠাযুক্ত থেকে মরণ শ্ৰেয়ঃ; তথাপি ধর্মান্তর গ্রহণ করতে নেই। স্বভাববশে অথাৎ জন্ম অনুসারে মানুষ যে ধর্ম প্রাপ্ত হয়, তা দোষযুক্ত হলেও তাই কখনই পরিত্যাজ্য নয়। কর্ম মাত্রই দোষযুক্ত; অগ্নিমাত্রেই ধুম আছে -এই মনে করে, দোষভাগ পরিত্যাগে সার-ভাগ-গ্রহণে (ধূমত্যাগে অগ্নি-গ্রহণের ন্যায়) মানুষ স্বধর্ম-নিষ্ঠ থেকে সিদ্ধির পথে অগ্রসর হোক।’ (২) এই সকল বিবেচনা করলে, শ্ৰীকৃষ্ণ যে বর্ণাশ্রম ধর্ম রক্ষার পক্ষে প্রয়াস পেয়েছিলেন, তা সর্বতোভাবে প্রতিপন্ন হয়। তার পর, তিনি যখন অৰ্জুনকে যুদ্ধার্থ উৎসাহিত করে বলছেন, “তুমি ক্ষত্রিয়; তোমার অন্য ধর্ম নেই, যুদ্ধই তোমার শ্ৰেয়ঃ ধর্ম”; তখন, বর্ণাশ্রম ধর্ম রক্ষার ও তার উপযোগিতার বিষয়ই দৃঢ়তার সাথে উপদেশ দেওয়া হচ্ছে -বুঝা যায় না কি ? এ সম্বন্ধে শ্ৰীকৃষ্ণের উক্তি সর্বথা স্মরণীয়।

“স্বধর্মমপি চাবেক্ষ্য ন বিকম্পিতুমর্হসি। ধর্ম্যাদ্ধি যুদ্ধাচ্ছ্রেয়োহন্যৎ ক্ষত্রিয়স্য ন বিদ্যতে॥৩১
যদৃচ্ছয়া চোপপন্নং স্বর্গদ্বারমপাবৃতম্। সুখিনঃ ক্ষত্রিয়াঃ পার্থ লভন্তে যুদ্ধমীদৃশম্॥৩২
অথ চেত্বমিমং ধর্ম্যং সংগ্রামং ন করিষ্যসি। ততঃ স্বধর্মং কীর্তিং চ হিত্বা পাপমবাপ্স্যসি॥৩৩
অকীর্তিং চাপি ভূতানি কথয়িষ্যন্তি তেহব্যয়ম্। সম্ভাবিতস্য চাকীর্তির্মরণাদতিরিচ্যতে॥৩৪
ভয়াদ্ রণাদুপরতং মংস্যন্তে ত্বাং মহারথাঃ। যেষাং চ ত্বং বহুমতো ভূত্বা যাস্যসি লাঘবম্ ॥৩৫
অবাচ্যবাদাংশ্চ বহূন্ বদিষ্যন্তি তবাহিতাঃ। নিন্দন্তস্তব সামর্থ্যং ততো দুঃখতরং নু কিম্ ॥৩৬
হতো বা প্রাপ্স্যসি স্বর্গং জিত্বা বা ভোক্ষ্যসে মহীম্। তস্মাদুত্তিষ্ঠ কৌন্তেয় যুদ্ধায় কৃতনিশ্চয়ঃ॥৩৭
সুখদুঃখে সমে কৃত্বা লাভালাভৌ জয়াজয়ৌ। ততো যুদ্ধায় যুজ্যস্ব নৈবং পাপমবাপ্স্যসি॥৩৮
গীতা ২/৩১-৩৮।

ক্ষত্রিয়ের এই যে ধর্ম-যুদ্ধ, লাভালাভ জয়-পরাজয় জ্ঞান না করে ক্ষত্রিয় এই যুদ্ধে প্রবৃত্ত হোক; তাতে মরণ হলেও তার মোক্ষ আছে। পূর্ব্বোক্ত বাক্যে শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে তাহাই বুঝিয়ে তাঁকে যুদ্ধার্থ উৎসাহ দিলেন। তবে এখানে একটি কথা বুঝবার আবশ্যক আছে যে, ক্ষত্রিয়ের ধর্ম যে যুদ্ধ, সে যুদ্ধ ধর্মযুদ্ধ; সে যুদ্ধ- রাজদ্রোহ বা উচ্ছৃঙ্খলা নয়। (৩) ফলতঃ, বৰ্ণাশ্রম ধর্ম যে কি, সে ধর্ম কাৰ্য্যতঃ কেমন করে পালন করতে হয়, শ্রীকৃষ্ণ তা তন্ন তন্ন করে প্রকাশ করে গেছেন। বর্ণাশ্রম ধর্ম রক্ষার বিষয়ে তাঁর উপদেশ-পরম্পরা যার বোধগম্য হবে, তিনি নিশ্চয়ই বুঝতে পারবেন,-বর্ণাশ্রম ধর্ম রক্ষার উদ্দেশে যেন তাঁর আবির্ভাব হয়েছিল। বর্ণাশ্রম ধর্ম রক্ষণ হলেই সৃষ্টি-রক্ষা সমাজ-রক্ষণ আত্ম-রক্ষা সব দিক রক্ষণ হবে,-এই উপদেশই যেন তাঁর বাক্যের ও কাজের মধ্যে জীবন্ত পরিদৃশ্যমান রয়েছে। তাঁর ধর্ম-সংস্থাপন উদ্দেশ্যে যে আবির্ভাব, তা সেই বর্ণাশ্রম-ধর্মের সংস্থাপন বলেই প্রধানতঃ মনে হয়। শান্তি সংস্থাপিত হলে, বর্ণাশ্রম ধর্ম রক্ষা পেলে, আত্মরক্ষা বা আত্মোৎকর্ষের পথ আপনিই সুগম হয়ে আসে। বর্ণাশ্রম ধর্মই সনাতন ধর্ম। বেশ বুঝা যায়, সেই ধর্ম রক্ষা করতেই তিনি আবির্ভূত হন।

(১) তপস্যা-কায়িক বাচিক ও মানসিক ভেদে ত্রিবিধ; সাত্ত্বিক রাজসিক ও তামসিক ভেদেও ত্রিবিধ। শারীরিক তপস্যার পরিচয় পূর্বে দেওয়া হয়েছে; ঐ শারীরিক তপস্যা ও অন্যান্য তপস্যার বিষয় গীতার ১৭শ অধ্যায়ে ১৩শ হতে ১৯শ শ্লোকে দেখুন।
(২) এ সম্বন্ধে শ্রীকৃষ্ণের উক্তি; শ্রেয়ান্ স্বধর্মো বিগুণঃ পরধর্মাৎ স্বনুষ্ঠিতাৎ। স্বভাবনিয়তং কর্ম কুর্বন্নাপ্নোতি কিল্বিষম্॥ সহজং কর্ম কৌন্তেয় সদোষমপি ন ত্যজেৎ। সর্বারম্ভা হি দোষেণ ধুমেনাগ্নিরিবাবৃতাঃ॥ এই সকল উক্তি পুনঃ পুনঃ উদ্ধৃত হলেও পুনরুক্তি দোষ ঘটে না। কেন না, এ সকল উক্তি সৎ সংশ্রব যুক্ত।
(৩) অর্জুনকে শ্রীকৃষ্ণ যে যুদ্ধে উৎসাহিত করেছিলেন, সে যুদ্ধ-ধর্মযুদ্ধ। এই খণ্ড পৃথিবীর ইতিহাসে ২১১-২১২ পৃষ্ঠায় শান্তি লাভে রাজভক্তি প্রসঙ্গে তার বিবরণ অনুধাবন করে দেখুন।

অধর্ম বারণ ও ধর্মপ্রতিষ্ঠা
এইবার দেখা প্রয়োজন, শ্রীকৃষ্ণ কোন অধর্মের অভ্যুত্থান নিবারণ করতে আবির্ভূত হয়েছিলেন ? সেই সঙ্গে বুঝা যাবে, দুষ্কৃত জনই বা কেমন বৃদ্ধি প্রাপ্ত হয়েছিল, আর কেমন করেই বা তারা বিধ্বস্ত হয়েছিল? সঙ্গে সঙ্গে আপনা-আপনিই পরিস্ফুট হয়ে আসবে, সাধু-গণই বা পরিত্রাণ পেয়েছিলেন কি প্রকারে ? শ্ৰীকৃষ্ণ প্রসঙ্গে পুর্বে যে সকল বিষয় আলোচিত হয়েছে, প্রকারান্তরে তারই মধ্যে এ সকল প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায়। কংস, জরাসন্ধ, দুর্যোধন, কালযবন, শিশুপাল প্রভৃতি অত্যাচারী নৃপতিবর্গের ক্রিয়াকলাপেই অধর্মের অভ্যুত্থান দেখতে পাই। তারা এবং তাদের পার্শ্বচর গণ দুষ্কৃত জন ভিন্ন আর কোন সংজ্ঞায় অভিহিত হতে পারেন ? সেই দুষ্কৃতজনের দমনে অধর্মের অভ্যুত্থান নিবারিত হয়েছিল; আর যুধিষ্ঠিরের ন্যায় ধর্মপর নৃপতির প্রতিষ্ঠায় সাধু সজ্জন সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন। কুরুক্ষেত্র মহাসমরের কারণ পরম্পরা স্মরণ করলে, আর কি কারণে কুরুপক্ষে পরাজয় অবশ্যম্ভাবী হয়েছিল, তা অনুধাবন করলে, সকল কথারই সদুত্তর পাওয়া যায়। অধিক উদাহরণের আবশ্যক নেই । যে কারণে দূরদর্শী ধৃতরাষ্ট্র কুরুপক্ষের পরাজয় প্রজ্ঞা চোখে প্রত্যক্ষ করেছিলেন, সেই কারণ গুলির বিষয় চিন্তা করলেই মূলতত্ত্ব বোধগম্য হতে পারে। (১) যদি সেই দুষ্কৃত জন তখন ধরণীর অঙ্ক হতে অপসৃত ন হত, তাহলে ধর্ম লোপ পেত; আর যদি যুধিষ্ঠির আদি সাধু সজ্জন সুপ্রতিষ্ঠিত না হতেন, তাহলেও সর্বনাশ ঘটত। পরীক্ষিতের কলি-নিগ্রহ অছিলাতে এই বিষয়টি বেশ বুঝতে পারা যায়। কলির আগমনের পূর্বে বৃষ রূপী ধর্মের সাথে গাভী রূপ ধারিণী ধরিত্রীর যে কথোপকথন হয়, তাতেই ঐ তত্ত্ব বিশদীকৃত। শ্রীকৃষ্ণের বিরহে যখন কলির কুটিল-দৃষ্টি সংসারের প্রতি নিপতিত হয়েছিল, সেই সময় দুঃখ প্রকাশ করে পৃথিবী কয়েকটি বিষয় ধর্মকে জ্ঞাপন করেছিলেন। শ্ৰীকৃষ্ণের আবির্ভাবে সমাজের কি শৃঙ্খলা, সাধিত হয়েছিল, ধর্মের অঙ্গ সকল কেমন পরিপুষ্ট হয়েছিল, গাভী-রূপিণী পৃথিবীর সেই উক্তিতে তা! জানতে পারি। পৃথিবী বলেছিলেন- “সে সময়ে (শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাব হওয়ায়) ধর্ম চারপদ হয়ে লোকের সুখ-ঐশ্বৰ্য্য বৃদ্ধি করেছিল। সত্য, শৌচ, দয়া, দান, ক্ষমা, সন্তোষ, সরলতা, শম, ইন্দ্ৰিয় দমন, স্বধর্ম-প্রতিপালন, তপস্যা, সমদৃষ্টিতা, তিতিক্ষা, লাভে উপেক্ষা, শাস্ত্রচর্চা, আত্মজ্ঞান, বৈরাগ্য, আত্মদমন, ধীরতা, ইন্দ্রিয়-বল, কর্তব্য বিবেচনা, স্বাধীনতা, কাজে নৈপুণ্য, সৌন্দর্য, ধৈর্য, মৃদু-চিত্ততা, বুদ্ধি, প্রতিভা, বিনয়, সৎ স্বভাব, মনে পটুতা, জ্ঞানেন্দ্রিয়ের ক্ষিপ্রকারিতা, গাম্ভীর্য, স্থৈর্য্য, শ্রদ্ধা, কীর্ত্তি, পূজ্যতা, নিরহঙ্কারতা, ব্রাহ্মণদের হিতৈষিতা, শরণত্ব প্রভৃতি মহত্ত্ব অভিলাষী সাধুদের বাঞ্ছিত গুণ সমূহ জগতে ব্যাপ্ত হয়েছিল। শ্ৰীকৃষ্ণ ঐ সকল গুণে গুণবান ছিলেন; সুতরাং সংসারে ও ঐ সকল গুণ ব্যাপ্ত হয়ে পড়েছিল।” তারপর প্রকাশ,- পাপভারে যখন ধরণী ভারাক্রান্ত হন, শ্রীকৃষ্ণ সে ভার লাঘব করেছিলেন।(২) শ্রীকৃষ্ণের সেই প্রভাবের ফলেই পরীক্ষিৎ যে কলি নিগ্রহে সমর্থ হয়েছিলেন, তাহাই বুঝতে পারা যায়। কলি আশ্রয় প্রার্থী হলে, পরীক্ষিৎ কলির জন্য কয়েকটি স্থান নির্দেশ করে দেন। তিনি কলিকে সম্বোধন করে বলেন,- যেখানে দ্যূতক্রীড়া, মদ্যপান,স্ত্রী ও প্রাণী হত্যা হয়, সেস্থান তোমার বসতি যোগ্য নির্দিষ্ট রইল।” কলি তখন আরও কয়েকটি স্থান প্রার্থনা করেন। তাতে রাজা পরীক্ষিৎ কলির বাসের অন্য আরও পাঁচটি স্থান নির্দেশ করে দেন। সে পাঁচটি স্থান- মিথ্যা, গর্ব, কাম, হিংসা ও বৈর। শ্রীকৃষ্ণের ইহলোক পরিত্যাগের পরও পাপের পথ রুদ্ধ রাখার জন্য সনাতন ধর্মের সাধন পথ সুগম করার পক্ষে কঠোর কঠিন বিধি ব্যবস্থা প্রবর্তিত ছিল; এই সকল উক্তিতে তাহাই প্রতিপন্ন হয়। মনে হয়, সেই অনুশাসনেরই ফলে আজও হিন্দুজাতি জীবিত রয়েছে, আজও তার বর্ণাশ্রম ধর্ম একেবারে লোপ পায়নি। উপদেশ প্রদানের সঙ্গে সঙ্গে আপন কার্য দ্বারা শ্ৰীকৃষ্ণ যে বর্ণাশ্রম ধর্ম-রক্ষার চেষ্টা পেয়েছিলেন, শাস্ত্রে তার ভূরি ভূরি প্রমাণ বিদ্যমান আছে। গোপ গণের মধ্যে যখন ইন্দ্র-পূজার প্রবর্তনার পক্ষে চেষ্টা করা হচ্ছিল, সেই সময় শ্রীকৃষ্ণ ব্রহবাসিদের তাঁদের স্বাভাবিক অর্থাৎ পিতৃপিতামহ প্রবর্তিত ধর্ম পরিত্যাগ করতে নিষেধ করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন,- “স্বভাবস্থ স্বকর্মকারী জীব কর্মেরই পূজা করবে। যথার্থ যার দ্বারা জীবিত থাকা যায়, সেই ইহার দেবতা। ব্রাহ্মণ- বেদ অধ্যাপন, ক্ষত্রিয়- পৃথিবী শাসন, বৈশ্য- বার্ত্তা এবং শূদ্র- ব্রাহ্মণের সেবা করে জীবিকা নির্বাহ করবে। বার্ত্তা চার প্রকার, কৃষি, বাণিজ্য, গোপালন ও কুসীদ। তারমধ্যে আমরা গোপালন করে থাকি; আমরা বনবাসী, অতএব গোগণ, ব্রাহ্মণ গণ এবং পর্বত এই সকলের উদ্দেশ্যেই আমাদের যজ্ঞ করা উচিত।” এইভাবে যে প্রকার যজ্ঞ ক্রিয়া গোপ জাতির অবলম্বনীয়, শ্রীকৃষ্ণ তাঁদেরকে তারই অনুসরণ করতে উপদেশ দেন। অন্যদিকে আবার শ্রীকৃষ্ণের নিজের এবং যুধিষ্ঠির আদির যজ্ঞ কর্ম কিভাবে সম্পন্ন হয়েছিল, তাও স্মরণ করে দেখুন। তার দ্বারা, বিভিন্ন স্তরের জন্য কি কর্ম বিহিত ছিল, তা বুঝা যেতে পারে। তাঁর বর্ণাশ্রম ধর্ম রক্ষার এক প্রধান নিদর্শন- তার ব্রহ্মণ ভক্তি। তিনি যুধিষ্ঠিরকে বলছেন,- এই ভূমণ্ডল মধ্যে ব্রাহ্মণ গণই আমার সর্বতোভাবে অর্চনীয়, ব্রাহ্মণদের নিকট সর্বদা প্রণতভাবে থাকলে, তাঁরা অনায়াসে প্রসন্ন হয়ে সেই প্রণত ভক্তদের মঙ্গল সাধন করবেন, (৩) কেবল মুখের উপদেশে নয়, শ্রীকৃষ্ণ কাজে ও ব্রাহ্মণদের প্রীত ভক্তির পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছিলেন। রাজসূয় প্রকরণে তিনি কোন কাজের ভার গ্রহণ করেছিলেন! মহাভারতে চির-বিঘোষিত রয়েছে, ‘চরণক্ষালনে কৃষ্ণো ব্রাহ্মণানাং স্বয়ং অভূৎ। সর্ব্বলোক সমাবৃত্তঃ পিপ্রীষুঃ ফলমুত্তমম্‌।’ অর্থাৎ, কৃষ্ণ সর্বলোকে বর্তনাধার হয়েও উৎকৃষ্ট ফল প্রাপ্তি বাসনায় ব্রহ্মণ গণের পদ প্রক্ষালনে স্বয়ং নিযুক্ত রইলেন। ভৃগুপদ চিহ্ন বুকে ধারণ করে বিষ্ণু যেভাবে ব্রাহ্মণের মাহাত্ম্য রক্ষা করে আসছেন, শ্রীকৃষ্ণের জীবনে ও কাজে তারই প্রতিচিত্র দেখতে পাই। (৪) তিনি ব্রাহ্মণ গণকে ভূদেব(ভূমিচরা দেবাঃ) বলে ঘোষণা করে গেছেন। ব্রাহ্মণ গণ তখনও ভূদেবোচিত গুণসম্পন্ন। সুতরাং সকলেরই পূজার্হ ছিলেন বলে বুঝতে পারা যায়। ব্রাহ্মণ গণই বর্ণাশ্রম-ধর্মের ভিত্তি-ভূমি। ভিত্তি-ভূমি দৃঢ় থাকলে সৌধ অচঞ্চল থাকবে, তাতে আর আশ্চর্য কি ? শ্রীকৃষ্ণ তাই সকল কাজেই ব্রাহ্মণের প্রাধান্য রক্ষা করে, বর্ণাশ্ৰম-ধর্ম-সৌধের ভিত্তি দৃঢ় করে গেলেন। বৰ্ণাশ্রম ধর্ম রক্ষার দ্বারাই তাঁর ধর্ম-সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা সার্থক হয়েছিল।

(১) ধৃতরাষ্ট্রের নৈরাশ্য ব্যঞ্জক উক্তি ‘পৃথিবীর ইতিহাস’ প্রথম খণ্ডে মহাভ্রত প্রসঙ্গে ২৪৮-২৫৫ পৃষ্ঠায় দেখুন।
(২) শ্রীমদ্ভাগবত, প্রথম স্কন্দ, ১৭ অধ্যায়; পরীক্ষিৎ ও ধর্মের কথোপকথন দেখুন।
(৩) মহাভারত, শান্তি পর্বে, ৩৯ অধ্যায়ে; যথা, বাসুদেব উবাচ। ব্রাহ্মণাস্তাত লোকেহস্মিন্ন্ররচ্চনীয়াঃ সদা মম। এতে ভূমিচরা দেবা বাগ্বিষাঃ সুপ্রসাদকাঃ।
(৪) ব্রহ্মাবিষ্ণুমহেশ্বর- তিনের মধ্যে কে শ্রেষ্ঠ ? ঋষিদের প্রশ্ন-মীমাংসার জন্য মহর্ষি ভৃগু ঐ তিন দেবতার নিকট গমন করেন। কিন্তু তিনি অভিবাদন না করায় ব্রহ্মা ও মহেশ্বর কুপিত হন। ক্ষমা প্রার্থনায় তাদেরকে তুষ্ট করে, তিনি বিষ্ণুর নিকট গমন করেন। বিষ্ণু তখন নিদ্রিত ছিলেন। ঋষি তাঁকে নিদ্রিত দেখে, তাঁর বুকে পদাঘাত করলেন। পদাঘাতে জগরিত হয়ে, রোষ প্রকাশ দূরে থাকুক, বিষ্ণু ঋষির নিকট কতই অপরাধী হয়েছেন, এই ভাব প্রকাশ করলেন। তাঁকে পদাঘাত করায় ঋষির চরণে আঘাত লেগেছে মনে করে তিনি ক্ষুব্ধ হলেন। মহেশ্বর ও ব্রহ্মাকে অভিবাদন না করায় তারা রুষ্ট হয়েছিলেন; আর বুকে পদাঘাত সত্ত্বেও ঋষির নিকট বিষ্ণু অবনত হলেন। এতে ঋষি বিষ্ণুকেই প্রধান বলে স্থির করলেন। বিষ্ণু ও গৌরব জনক চিহ্ন মনে করে ভৃগুপদচিহ্ন বুকে ধারণ করে রাখলেন।

(৮) শ্রীকৃষ্ণ- পরম নীতিবৎ


শ্রীকৃষ্ণ- পরম নীতিবৎ; কেন-না, রাষ্ট্রনীতি, সমাজনীতি, ধর্মনীতি-সকল নীতি শিক্ষা দানে তাঁর মহিমা বিকশিত।

[নীতির মূল তত্ত্ব- সর্বনীতিজ্ঞতার লক্ষণ; শ্রীকৃষ্ণ সমাজনীতিজ্ঞ, তাঁর জীবনে সমাজনীতিজ্ঞতার দৃষ্টান্ত; শ্রীকৃষ্ণের নীতি সচ্চরিত্রতা-বিধায়ক; রাজনীতি-ক্ষেত্রে শ্রীকৃষ্ণ, শ্রীকৃষ্ণের রাজনীতির গূঢ় লক্ষণ, সত্য-মিথ্যার প্রসঙ্গ; ধর্মনীতি-ক্ষেত্রে শ্রীকৃষ্ণ, কৃষ্ণের ধর্মনীতির মূল লক্ষ্য।]

  • (১) নীতির মূল তত্ত্ব- শ্রীকৃষ্ণে সর্বনীতিজ্ঞতার লক্ষণ;
  • (২) শ্রীকৃষ্ণ সামজনীতিজ্ঞ (বিশ্ব-প্রেমাঙ্কুর),
  • (৩) শ্রীকৃষ্ণের জীবনে সমাজনীতিজ্ঞতার দৃষ্টান্ত;
  • (৪) শ্রীকৃষ্ণের নীতি সচ্চরিত্রতা বিধায়ক;
  • (৫) রাজনীতি-ক্ষেত্রে শ্রীকৃষ্ণ,
  • (৬) শ্রীকৃষ্ণের রাজনীতির গূঢ় লক্ষণ,
  • (৭) সত্য-মিথ্যার প্রসঙ্গ;
  • (৮) ধর্মনীতি-ক্ষেত্রে শ্রীকৃষ্ণ,
  • (৯) শ্রীকৃষ্ণের ধর্মনীতির মূল লক্ষ্য।

নীতির মূল তত্ত্ব- সর্বনীতিজ্ঞতার লক্ষণ;
নীতি কথায় যা থেকে কিছু (উপদেশ) পাওয়া যায়, তাই নীতি নামে অভিহিত হয়ে থাকে। মানুষের বিভিন্ন অবস্থায় বিভিন্ন প্রয়োজন সাধনের জন্য নীতি তাই বিভিন্ন বিভাগে বিভক্ত হয়ে থাকে। সেই অনুসারে রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি, ধর্মনীতির নানা প্রকার ভেদ দেখতে পাই। সর্ববিধ নীতির সমবায় শিক্ষানীতি বা কেবলমাত্র নীতি নামে অভিহিত হতে পারে। যিনি একাধিক নীতি আয়ত্ত করতে পারেন, সংসারে তার যশের অবধি থাকে না।

যিনি রাজনীতিজ্ঞ অথবা যিনি অর্থনীতিজ্ঞ, যিনি সমাজনীতিজ্ঞ অথবা যিনি ধর্মনীতিজ্ঞ, তাদের কেউই অল্প পূজনীয় নন। প্রাচ্যের ও পাশ্চাত্যের পুরাবৃত্তে এক এক বিভাগে একেক জন নীতিজ্ঞের প্রতিষ্ঠা দেখতে পাই। ইউরোপের আধুনিক ইতিহাসে বিসমার্ক ও গ্লাড্‌ষ্টোন প্রমুখ রাজনীতিজ্ঞ গণের প্রতিষ্ঠার বিষয় কে না অবগত আছেন? আবার অন্য দিকে, অর্থনীতি-ক্ষেত্রে, আডাম স্মিথ, রিকার্ডো, ম্যলথাস, অ্যালেকজান্ডার বেন, জন ষ্টুয়ার্ট মিল প্রভৃতির নাম সর্বজন বিদিত। ধর্মনীতিক সমাজনীতিকদের মধ্যে ইউরোপে খৃষ্ট সম্প্রদায়ের নেতৃবর্গের নাম স্মরণীয় হয়ে আছে। কিন্তু যে দেশের যে সময়ের ইতিবৃত্তই আলোচনা করি না কেন, একাধারে কোথাও সর্বনীতিজ্ঞ ভাব সমাবেশ দেখি না। ভারতের ইতিহাসে শ্রীকৃষ্ণে সেই প্রভাব দেখতে পাই। মৌর্য-সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার দিনে মহামতি চাণক্য অশেষ নীতি-শাস্ত্র বেত্তা বলে প্রতিষ্ঠান্বিত হয়েছিলেন। কিন্তু তিনি রাজনীতি বা তার অঙ্গীভূত অর্থনীতি সম্বন্ধেই অধিক মস্তিষ্ক চালনা করতে সমর্থ হয়েছিলেন; নীতি-শাস্ত্রের অন্যান্য বিভাগে তিনি তেমন যশঃসম্পন্ন হতে পারেন নি। ঐকান্তিক রাজনীতিক (অর্থনীতিক) ছিলেন বলেই, তাঁর সাথে ইউরোপের কূটনীতিক ম্যাকিয়াভেলীর তুলনা দেখতে পাই। তারপর চাণক্য তাঁর অর্থশাস্ত্র প্রণয়ণে তাঁর পূর্ববর্তী মনীষিদের পদাঙ্ক অনুসরণ করেছিলেন বলে প্রমাণ পাওয়া যায়। শুক্রাচার্য, বৃহস্পতি, চার্ব্বাক প্রভৃতির অনুসরণকারী বলে তাঁকে বুঝতে পারি। তাঁর পূর্বে সংহিতাকার গণ নীতি-শাস্ত্রের সার সমুদ্র মন্থন করে যান, পুরাণকার গণ সর্বনীতি-তত্ত্বের অনন্ত ভাণ্ডার উন্মুক্ত করে রাখেন। সুতরাং প্রকৃত নীতি শাস্ত্রবিদ বলতে, সর্বনীতি-তত্ত্বজ্ঞ বলতে, শ্রীকৃষ্ণকে যেমন নির্দেশ করতে পারি, অধুনা তেমন আর অন্য কারও প্রতি লক্ষ্য পরে না। শ্রীকৃষ্ণের নীতি-সর্বতোমুখী। যেমন রাজনীতি ক্ষেত্রে, তেমনই অর্থনীতি ক্ষেত্রে, তেমনই সমাজনীতি ক্ষেত্রে, আবার তেমনই ধর্মনীতি ক্ষেত্রে, তাঁর নৈতিক অভিজ্ঞতার অন্ত নেই। কেবল কথায় নয়; কথায় ও কাজে উভয়ত্র তিনি নিজেকে সর্বনীতি-তত্ত্বজ্ঞ রূপে প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন।

শ্রীকৃষ্ণের সমাজনীতি (বিশ্ব-প্রেমাঙ্কুর)
সমাজনীতি, রাজনীতি, ধর্মনীতি প্রভৃতি বিষয়ে শ্রীকৃষ্ণের যে সকল উক্তি দেখতে পাই, তার সমস্তই বিশেষভাবে লোকশিক্ষাপ্রদ ও জনহিত সাধক। সংসারে সুশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য, সংসারকে শান্তিময় করার জন্য, তিনি যে সকল উপদেশ প্রদান করে গেছেন, মানুষের মনে যদি তা জাগরিত থাকে, মানুষ যদি সে সকল উপদেশ কখনও বিস্মৃত না হয়, তাহলে এই অধিব্যাধি শোক-তাপ পূর্ণ সংসারেই স্বর্গের সুখ-স্বর্গের শান্তি-প্রত্যক্ষীভূত হতে পারে।
সংসারে অশান্তির এক প্রধান কারণ,- বর্তমান অবস্থায় অসন্তুষ্টি, সুতরাং সে অবস্থার পরিবর্তন প্রয়াস। এই অসন্তুষ্টি অবস্থার পরিবর্তন চেষ্টাই সকল অনর্থের মূল। সমাজবিপ্লব, রাষ্ট্রবিপ্লব, ধর্মবিপ্লব, -সংসারে যে কোনও বিপ্লবের সূচনা হয়েছে, সকলই আত্ম-অবস্থায় অসন্তুষ্টি জনিত। উৎক্ষেপ বা উচ্ছৃঙ্খলতা তার প্রধান কারণ বলে বুঝতে পারি। মানুষ যখন আপন সমাজ-বন্ধনে সন্তুষ্ট নয়, মানুষ যখন আপনার আচার-ধর্ম-নিষ্ঠায় উদ্বেগ সম্পন্ন হয়ে উঠে; তখনই তার শান্তি দূরে যায়, উদ্বেগ-উচ্ছৃঙ্খলার আবর্ত্তে পড়ে তাকে বিপর্যস্ত হতে হয়। বিপ্লবের ও অশান্তির এ মূল তত্ত্ব কি, তা অনুসন্ধান করেছিলেন বলেই শ্রীকৃষ্ণ তারস্বরে ঘোষণা করে বললেন,-
“শ্রেয়ান স্বধর্ম্মো বিগুণঃ পরধর্ম্মাৎ স্বনুষ্ঠিতাৎ।
স্বভাবনিয়তং কর্ম্ম কুর্ব্বান্নাপ্নোতি কিল্বিষম॥”
সমাজের শান্তি-রক্ষার পক্ষে এ উপদেশ অমূল্য। আপন ধর্ম, আপন সমাজ, আপন পিতৃ-পিতামহ অনুষ্ঠিত কর্ম যদি দোষ-দুষ্ট ও হয়, তারই অনুসরণ করবে; কদাচ অন্যের সমাজ, অন্যের ধর্ম বা অন্যের অনুষ্ঠিত কর্মের জন্য লালায়িত হবে না। শান্তিলাভের জন্য এ উপদেশের কি আর তুলনা আছে ? এ উপদেশ-জ্ঞানের সার, নীতির সার। ‘স্বধর্ম্মো নিধনং শ্রেয়ঃ পরধর্ম্মোভয়াবহঃ” এর অপেক্ষা নীতি-শিক্ষা আর কি হতে পারে ? সমাজে শৃঙ্খলা-রক্ষা,-সংসারে শান্তি-রক্ষা যে নীতির মুখ্য উদ্দেশ্য, সেই নীতিই প্রকৃষ্ট নীতি। এই নীতিশিক্ষারই এক অঙ্গ, পিতৃ মাতৃ-গুরুজনে ভক্তি শিক্ষা। দেখুন সে বিষয়ে শ্রীকৃষ্ণের কি উপদেশ বা উক্তি (শ্রীমদ্ভাগবত, ১০ম স্কন্ধ, ৪৫শ অধ্যায়),-

“সর্ব্বার্থ-সম্ভবো দেহো জনিতঃ পোষিতো যতঃ।
ন তয়োর্ষাতি নির্ব্বেশং পিত্রোর্ম্ররত্ত্যঃ শয়ায়ুষা॥
যস্তয়োরাত্মজঃ কল্য আত্মনা চ ধনেন চ।
বৃত্তিং ন দদ্যাৎ তং প্রেত্য স্বষাংসং খাদয়ন্তি হি॥”

অর্থাৎ -‘ধর্ম-অর্থ-কাম-মোক্ষ সর্বার্থ সম্ভব এই দেহ, যাঁদের দ্বারা উৎপন্ন ও পরিপুষ্ট হয়েছে, শত বৎসর জীবিত থেকেও মানুষ সেই পিতামাতার ঋণ পরিশোধ করতে সমর্থ হয় না। যে পুত্র আপনার দেহ দ্বারা এবং ধনসম্পত্তির দ্বারা পিতামাতার তুষ্টি সাধনে সমর্থ না হয়, লোকান্তরে যমদূত তাদের মাংস ছিন্ন করে আহার করে।’

তাই শাস্ত্র বলছে-

“পিতা স্বর্গ পিতা ধর্ম্মঃ পিতাহি পরমন্তপঃ।
পিতরি প্রীতিমাপন্নে প্রিয়ন্তে সর্ব্বদেবতা॥”
কেবল পিতামাতা বলেই নয়, যাঁরা অসহায় অবস্থায় প্রতিপালন করে থাকেন, তাঁরা ও পিতৃমাতৃতুল্য চিরসেব্য। এ বিষয়ে শ্রীকৃষ্ণের উক্তি,-
“স পিতা স চ জননী যৌ পুষ্ণীতাং স্বপুত্রবৎ।
শিশূন বন্ধুভিরুৎসৃষ্টান্‌ কলৈাঃ পোষরক্ষণে॥”
অর্থাৎ, ‘আত্মীয় স্বজন কর্তৃক পরিত্যক্ত আত্ম-রক্ষণে অসমর্থ শিশুকে যাঁরা পুত্রবৎ লালন-পালন করেন, তাঁহারা ও পিতামাতার তুল্য ভক্তিভাজন অর্থাৎ তাঁদের প্রতিও পিতামাতার ন্যায় ব্যবহার করা কর্ত্তব্য।’

তারপর মানুষের আরও কর্তব্য আরও প্রতিপাল্য কাজ কি আছে দেখুন। শ্রীকৃষ্ণ (শ্রীমদ্ভাগবত, ১০ম স্কন্ধ, ৪৫শ অধ্যায়) বলছেন,-
“মাতরং পিতরং বৃদ্ধং ভার্য্যাং সাধ্বীং সুতং শিশুম্‌।
গুরুং বিপ্রং প্রপন্নঞ্চ ফল্যোহবিভ্রচ্ছ্বসন্‌ মৃত॥”
অর্থাৎ,-‘মানুষের কর্তব্য এই যে, পিতা মাতা সাধ্বী ভার্য্যা ও শিশুসন্তানদেরকে প্রতিপালন করবে; ব্রাহ্মণ গণ এবং প্রপন্ন ব্যক্তি-গণ ও তাঁদের প্রতিপাল্য। সামর্থ্য সত্ত্বেও যারা আত্মীয়-স্বজনের ও আশ্রিত জনের ভরণপোষণ সঙ্কুলান না করে, তারা জীবম্মৃত অর্থাৎ জীবিত থেকেও মৃতের মধ্যে পরিগণিত।’

বিভিন্ন সংসারের সমষ্টিই সমাজ। সুতরাং ব্যষ্টিভাবে এক একটি সংসার যদি সুগঠিত হয়, তাহলে সমাজ আপনই সুগঠিত ও শৃঙ্খলাবদ্ধ হয়ে আসে।

জীব-জন্মের সার্থকতা সম্পর্কে-
শ্রীকৃষ্ণের শিক্ষা জীবে দয়া। সে দয়া কেমন দয়া- প্রখর রোদে পাদপকুলকে ছায়াদান করতে দেখে, তাদের উপমায় ব্রজবাসিদেরকে শ্রীকৃষ্ণ (শ্রীমদ্ভাগবত, দশম স্কন্ধ, দ্বাবিংশ অধ্যায়, ৩২–৩৫ শ্লোঃ) বুঝাচ্ছেন; যথা-

“পশ্যত্যৈতান্‌ মহাভাগান্‌ পরার্থৈকান্তজীবিতান্‌।
বার্তাবর্ষাতপহিমান সহন্তো বারয়ন্তি নঃ॥
অহো এষাং বরং জন্ম সর্ব্বপ্রাণ্যুপজীবনম্‌।
সুজনস্যেব যেসাং বৈ বিমুখা যান্তি নার্থিনঃ
পত্রপুষ্পফলচ্ছায়া মূলবল্কলদারুভিঃ
গন্ধনির্যাসভস্মাস্থি তোক্মৈঃ কামান্বিতন্বতে॥
এতাবজ্জন্মসাফল্যং দেহিনামিহ দেহিষু।
প্রাণৈরর্থৈর্ধিয়া বাচা শ্রেয়আচরণং সদা॥”

অথাৎ, “এই মহাভাগ বৃক্ষ কে দেখো; এরা পরের প্রয়োজন সাধনের নিমিত্ত নির্জনে জীবিত রয়েছে। দেখ-স্বয়ং বাতাস, বর্ষা, রোদ, হিম সহ্য করে আমাদেরকে ঐ সকল থেকে রক্ষা করছে। অহো! এঁদের জন্ম অতি উৎকৃষ্ট। এরা সকল প্রাণীর উপজীব্য। দয়ালু ব্যক্তির কাছ থেকে যাচকের ন্যায় এঁদের কাছ থেকে কখনই বিমুখ হয় না। এরা পত্র, পুষ্প, ফল, ছায়া, মূল, বাঁকল, গন্ধ, নির্যাস, ভস্ম, অস্থি ও পাতা আদির অঙ্কুর দ্বারা নিরন্তর বাসনা পূরণ করে। প্রাণীদের মধ্যে প্রাণ, সম্পত্তি ও বাক্য দ্বারা সর্বদা মঙ্গল আচরণ করাই জীবগণের জন্মের ফল।’ এ উপদেশের তুলনা নেই। দেহ, প্রাণ, বাক্য, মন, সম্পত্তি প্রভৃতির দ্বারা সর্বদা জীবের মঙ্গল আচরণ করবে; তবেই জীবন সফল-জন্ম সফল।
আদর্শ অমূল্য সমাজনীতি!- ‘প্রাণৈরর্বৈধিয়াঃ বাঁচা শ্রেয় এবাচরেৎ সদা।’ বিশ্বপ্রেম-বিধায়ক এমন নীতি আর কোথায় আছে কে দিয়েছেন কবে ?

শ্রীকৃষ্ণের নীতি সদাচার বিধায়ক।
শ্রীকৃষ্ণের নীতির মধ্যে যেমন সর্বত্র করুণা প্রকাশের উপদেশ পেয়ে থাকি, তেমনি সচ্চরিত্রতার ও লোকানুবর্ত্তিতার প্রভাব দেখতে পাই। দ্যুতক্রিয়া সম্বন্ধে তাঁর উক্তি অনুধাবন করলে! তাঁর নীতি কত দূর উন্নত ছিল, বুঝতে পারি। শ্রীকৃষ্ণ বলছেন- অক্ষক্রীড়ায় সাধু মানবদের মতিভ্রংশ হয় এবং অসৎ লোকদের সুহৃদ্ভেদ ও নানা প্রকার বিপদের উৎপত্তি হয়ে থাকে। যথা, মহাভারতে উদ্যোগ পর্বে দুর্য্যোধনের প্রতি শ্রীকৃষ্ণের উক্তি-

“অক্ষদ্যুতং মহাপ্রজ্ঞ সতাং মতিবিনাশনম্।
অসতাং তত্র জায়ন্তে ভেদাশ্চ ব্যসনানি চ॥”

কৃষ্ণ বিদ্বেষীদের রটনা এই যে, শ্রীকৃষ্ণ লাম্পট্য দোষে দুষ্ট ছিলেন, পরবর্তী কালে কোনও কোনও বৈষ্ণব কবি কতকটা সেরকম চিত্রে শ্রীকৃষ্ণকে চিত্রিত করে গেছেন। কৃষ্ণ কোন্‌ প্রেমের প্রেমিক ছিলেন, আর কেমন প্রেমের শিক্ষা জগৎকে তিনি শিখিছেন, তা বুঝতে না পেরেই, তা ধারণা করতে না পেরেই, অজ্ঞজন ভ্রমে পতিত হন। কিন্তু শ্রীকৃষ্ণের চরিত্র, শ্রীকৃষ্ণের নীতি, শ্রীকৃষ্ণের উক্তি লক্ষ্য করলে সে ভ্রম একেবারে দূর হতে পারে।
কৃষ্ণগতপ্রাণা রমণীদেরকে সম্বোধন করে শ্রীকৃষ্ণ কি উপদেশ দিয়েছেন, দেখুন;-

“পতয়ো নাভ্যসূইয়েরন পিতৃভ্রাতৃসুতাদয়ঃ।
লোকশ্চ বো ময়োপেতা দেবা অপ্যমুমন্বতে॥
ন প্রীতয়হনুরাগায় হ্যঙ্গসঙ্গো নৃর্ণামিহ।
তন্মনো ময়ি যুঞ্জনা অচিরাম্মামবাপ্স্যথ॥”
(শ্রীমদ্ভাগবত ১০ম স্কন্ধ অধ্যায় ২৩)

অর্থাৎ, ‘অঙ্গে অঙ্গে মিলন মিলন নয়; চিত্ত-সমর্পণই প্রকৃত মিলন।’ পতি, পিতা, ভ্রাতা ও পুত্র আদি তাতে দোষ দিতে পারে না, অথচ, সেই মিলনই প্রকৃষ্ট মিলন। শ্রবণ, কীর্তন, স্মরণ, মনন প্রভৃতির দ্বারাই যে শ্রী ভগবানকে প্রাপ্ত হওয়া যায়, আর সে সঙ্গ লাভে যে সকল বন্ধনের অবসান হয়ে যায়, এখানে ভগবদ্‌ উক্তিতে সেই ভাবই পরিব্যক্ত,- শ্রীকৃষ্ণের এটাই সার উপদেশ।
শ্রীকৃষ্ণ সমাজের শৃঙ্খলা ভঙ্গ করার জন্য আদৌ চেষ্টা করেন নি; পরন্তু যাতে সমাজের শৃঙ্খলা রক্ষা হয়, তার প্রতি তাঁর একমাত্র লক্ষ্য ছিল। পতি, পিতা, পুত্র প্রভৃতি দোষ দেখতে না পান-এতদুক্তিতে তাঁর লোকানুবর্ত্তিতারই প্রকৃষ্ট পরিচয় পাওয়া যায় না কি ?
কামজয়ই শ্রীকৃষ্ণের প্রধান শিক্ষা তিনি তাই পুনঃ পুনঃ বলিয়াছেন,

দৃষ্ট্বা স্ত্রিয়ং দেবমায়াং তদ্ভাবৈরজিতেন্দ্রিয়ঃ।
প্রলোভিতঃ পতত্যন্ধে তমস্যগ্নৌ পতঙ্গবৎ॥
যোষিদ্ধিরণ্যাভরণাম্বরাদি দ্রব্যেষু মায়ারচিতেষু মূঢঃ।
প্রলোভিতাত্মা হ্যুপভোগবুদ্ধ্যা পতঙ্গবন্নশ্যতি নষ্টদৃষ্টিঃ॥

পতঙ্গদের কাছ থেকেও শিক্ষা গ্রহণ করা যায়- পতঙ্গ রূপে মুগ্ধ হয়ে অগ্নিতে ঝাঁপ দেয় এবং পুড়ে ছারখার হয়ে যায়। তেমনি ভাবে ইন্দ্রিয়গণকে বশীভূত রাখতে অসমর্থ ব্যক্তি নারী-দেহ দর্শনেই তাতে আসক্ত হয়ে পড়ে এবং ঘোর অন্ধকারে, নরকে অধঃপতিত হয়ে নিজের সর্বনাশ ডেকে আনে। সত্যই নারী দেবতাদের সেই মায়া-যার জন্য জীব ভগবান বা মোক্ষ প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হয়ে যায়।৭
যে মূঢ় ব্যক্তি কামিনী-কাঞ্চন পোষাক-অলংকার আদি বিনাশশীল ভ্রামাত্মক পদার্থে আসক্ত এবং সেগুলির উপভোগের জন্য লালায়িত সে ক্রমে নিজ বিবেকবুদ্ধি হারিয়ে পতঙ্গবৎ ধ্বংস হয়ে যায়।
এ বিষয়ে আর অধিক আলোচনার আবশ্যক অনুভব করি না। ফলতঃ শ্রীকৃষ্ণ যে ব্যাভিচার স্রোত প্রবাহিত করেন নি, বরং সে স্রোত রুদ্ধ করবার পক্ষেই চেষ্টা করেছিলেন, তা বলাই বাহুল্য।

রাজনীতি-ক্ষেত্রে শ্রীকৃষ্ণ।
শ্রীকৃষ্ণ যে একজন পরম রাজনীতি বিশারদ ছিলেন, কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে জরাসন্ধ, কাল-যবন, শিশুপাল প্রভৃতির সংহার সাধনে তা বেশ প্রতিপন্ন হয়। জরাসন্ধের কাছ থেকে বন্দী রাজাদের উদ্ধার এবং যুধিষ্ঠিরের সাম্রাজ্য স্থাপনে একে একে পথের কাঁটা দূর করা, তাঁর রাজনীতিজ্ঞতার প্রকৃষ্ট পরিচয়। তাঁর উক্তির মধ্যে এই রাজনীতিজ্ঞতার নিদর্শন নানা স্থানে দেখতে পাই। সৌভাগ্য মাদকতা উন্মত্ততাই যে পতনের লক্ষণ, বন্ধন উন্মুক্ত রাজাদেরকে শ্রীকৃষ্ণ (শ্রীমদ্ভাগবত, দশম স্কন্দ, ৩৭ অধ্যায়ে, ১৯শ-২০শ শ্লোঃ) তা বুঝিয়ে বলছেন-

“দিষ্ট্যা ব্যবসিতং ভূপা ভবন্ত ঋতভাষিণঃ। শ্রীয়ৈশ্বর্যমদোন্নাহং পশ্য উন্মাদকং নৃণাম্।।
হৈহয়ো নহুষো বেণো রাবণো নরক্যোপরে। শ্রীমদাদ্ভ্রংশিতাঃ স্থানাদ্দেবদৈত্যনরেশ্বরাঃ।।”

অর্থাৎ, আমি দেখেছি, সৌভাগ্য মাদকতা উন্নতিই মানবের উন্মত্ততার কারণ। কার্ত্তবীর্য, নহুষ, বেণ, রাবণ, নরক এবং অন্যান্য দেব দৈত্য রাজারা ঐশ্বর্য ও গর্বে অন্ধ হয়ে নিজ নিজ স্থান থেকে পতিত হয়েছেন।’

এরপর, সেই বন্ধন উন্মুক্ত রাজারা নিজ রাজ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়ে কিভাবে রাজকার্য পরিচালনা করবেন, শ্রীকৃষ্ণ সে সম্বন্ধে উপদেশ দান করেন। সে উপদেশে বলেন যে, ভগবানে চিত্ত স্থির রেখে সাবধানে ধর্ম অনুসারে প্রজাপালন করতে হবে, সন্তান-সন্ততি সুখ-দুঃখ অথবা মঙ্গল অমঙ্গল যেমন ঘটবে, তাতেই সন্তুষ্ট থাকতে হবে এবং ভগবানে চিত্ত স্থির রেখে সকল কাজ সম্পন্ন করে যাবে। এইরকম উপদেশ দিয়ে বন্ধন-মুক্ত রাজাদের প্রতি যথোপযুক্ত সদয় ব্যবহার করে, শ্রীকৃষ্ণ তাঁদের সকলেরই চিত্ত আকর্ষণ করেন। এখানে শ্রীকৃষ্ণের কথায় ও কাজে তাঁর রাজনীতিজ্ঞতার বিশিষ্ট পরিচয় পেয়ে থাকি। অযথা-রূপে অত্যাচার গ্রস্ত রাজাদের মুক্তিদানে তিনি তাঁদের হৃদয় যেমন ভাবে আকর্ষণ করতে সমর্থ হয়েছিলেন, তাতে যুধিষ্ঠিরের সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা কল্পে তাঁদের দ্বারা বিশেষ সহায়তা হয়েছিল। শরণাগত রক্ষার সঙ্গে সঙ্গে রাজসূয় যজ্ঞ অনুষ্ঠানে সহায়তা লাভ,-এই ব্যাপারে দুই কাজ পূর্ণ করা হয়। এ কথা, এ ভাব তাঁর বাক্যেই প্রকাশ,-
“কার্যং পৈতৃষ্বস্রেয়স্য রক্ষা চ শরণৈষিণাম্।” শরণাগত রক্ষা যে শ্রীকৃষ্ণের নীতির অন্তর্ভুক্ত ছিল, এই উক্তির অভ্যন্তরে তাহা দেদীপ্যমান রয়েছে। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে পাণ্ডবদের পক্ষ অবলম্বনে যুগপৎ ন্যায়ের মর্যাদা ও শরণাগত-রক্ষা প্রকাশ পেয়েছে। অথচ কুরুপাণ্ডবের যুদ্ধে আত্মীয়-সুহৃদের যা কর্তব্য, সে কর্তব্য-পালনে শ্রীকৃষ্ণের একটুও ক্রুটি দেখা যায়নি। যুদ্ধের পূর্বে সন্ধি-স্থাপনের জন্য তিনি যে যথোচিত চেষ্টা করেছিলেন, তাঁর প্রমাণ পদে পদে প্রত্যক্ষ হয়। মহামতি বিদুর যখন দুর্যোধনের অন্যায় আচরণের বিষয় তুলে ধরে শ্রীকৃষ্ণকে বললেন,- “বল-গর্বিত বিমূঢ় দুর্যোধন কখনই আপনার বাক্য রক্ষা করবে না”; মনে করে দেখুন দেখি, তখন শ্রীকৃষ্ণ কি উত্তর দিয়েছিলেন? শ্রীকৃষ্ণ বলেছিলেন,- “আমি দুর্যোধনের দৌরাত্ম্য এবং ক্ষত্রিয়দের শত্রু-ভাব সকলই অবগত আছি, এবং অবগত থেকেও আজ কুরু-মণ্ডল মধ্যে সমাগত হয়েছি। যে যে ব্যক্তি এই অশ্ব-রথ-মাতঙ্গ সমাকীর্ণ বিপর্যস্ত মেদিনী-মণ্ডলকে মৃত্যু-পাপ হতে বিমুক্ত করতে সমর্থ হয়, সে অবশ্যই অত্যুত্তম ধর্ম লাভ করতে পারে। আমি নিঃসংশয়ে বলতে পারি, মনুষ্য নিজ শক্তি অনুসারে কোনও ধর্ম-কাজ নিষ্পাদনে যত্ন করে যদিও কৃতকার্য হতে না পারে, তথাপি তার পুণ্যফল প্রাপ্ত হয়; আবার মনে মনে কোনও পাপ কর্মের চিন্তা করে তার অনুষ্ঠান না করলেও তারজন্য ফলভোগের অধিকারী হয় না।

—- সংগ্রামে আসন্ন-বিনাশে উন্মুখ কুরু ও পাণ্ডবদের মধ্যে শাস্তি স্থাপন করতে আমি অকপটে যত্ন করব।
—-আপদ-গ্রস্ত কৃশ্যমান মিত্রকে যে ব্যক্তি যথাশক্তি অনুনয় দ্বারা তা থেকে বিমুক্ত করার চেষ্টা না করে, পণ্ডিতেরা তাকে নৃশংস বলে উল্লেখ করেন। মিত্র ক্ষমতানুসারে যত্ন কড়ে যে কোনও উপায় দ্বারা, এমন কি কেশগ্রহ পর্য্যন্ত করেও, মিত্রকে অকাজ হতে নিবর্তিত করতঃ কারও নিন্দনীয় হন না।
—আমি হিত-অনুষ্ঠানে যত্ন-পরায়ণ হলেও যদি দুর্যোধন আমার প্রতি কোনও শঙ্কা করে, তথাপি মিত্রের কর্তব্য কর্ম সম্পন্ন করলাম বলে আমার হৃদয়ের প্রীতি হবে। জ্ঞাতি গণ মধ্যে পরস্পর ভেদ হবার সূত্র হলে যে মিত্র সর্ব-প্রযত্নে মধ্যস্থ অবলম্বন না করে, পণ্ডিতেরা তাকে মিত্র বলে গণনা করেন না। সন্ধি বিষয়ে আমার যত্ন করবার হেতু এই যে, অধর্মনিষ্ঠ সৌহৃদ্য-শূন্য মুঢ় লোকেরা যেন বলতে না পারে, কৃষ্ণ সমর্থ হয়েও কোপযুক্ত কুরু-পাণ্ডবগণকে যুদ্ধ হতে নিবারণ করল না।
—অবোধ দুর্যোধন যদি আমার ধর্মার্থ যুক্ত মঙ্গলময় বাক্য শ্রবণ করেও অগ্রাহ্য করে, তবে নিতান্তই কালের বশবর্তী হবে। অথবা যদি পাণ্ডবদের অর্থহানি না করিয়ে আমি কুরু গণ মধ্যে শাস্তি-সংস্থাপন করতে সমর্থ হই, তাহলে আমারও মহাফল উপধায়ক পুণ্য কর্ম করা হয় এবং কৌরবেরাও মৃত্যুপাশ হতে নিষ্কৃতি পেতে পারে।”
শ্রীকৃষ্ণের এই উক্তির মধ্যে সর্ব্ববিধ শিক্ষাই পাওয়া যায়। এর মধ্যে সমাজনীতি, রাজনীতি, অর্থনীতি সকল নীতিরই সমাবেশ আছে। কি নিগুঢ় শিক্ষাপ্রদ ধর্মনীতি-যখন তিনি বললেন,-

“ধর্মকার্যং যতঞ্শক্ত্যা নো চেৎপ্রাপ্নোতি মানবঃ।
প্রাপ্তো ভবতি তৎপুণ্যমত্র মে নাস্তি সংশয়ঃ॥ ৫-৯৩-৭
মনসা চিন্তয়ন্পাপং কর্মণা নাতিরোচয়ন্।
ন প্রাপ্নোতি ফলং তস্যেত্যেবং ধর্মবিদো বিদুঃ॥” ৫-৯৩-৮

এই সকল উক্তির মধ্যে প্রকৃষ্ট রাজনীতির লক্ষণ এই যে, শ্রীকৃষ্ণ মনে মনে অধর্মের উচ্ছেদ-সাধনে সঙ্কল্পবদ্ধ আছেন; অথচ, সন্ধির জন্য চেষ্টা করছেন। মিত্র হিসাবে, আত্মীয় হিসাবে, যে চেষ্টা করা আবশ্যক, তাতে ত্রুটি হচ্ছে না; অথচ, দুষ্টের দমনরূপ কর্ত্তব্য পালন-স্পৃহাও জাগরিত রয়েছে। মিত্রতাও দেখানো হচ্ছে, আবার ভয় প্রদর্শনেরও ত্রুটি হচ্ছে না। রাজনীতিজ্ঞের যে লক্ষণ, এই এক সন্ধি-প্রস্তাবেই তা বিশিষ্ট ভাবে দেখতে পাই। সন্ধি-সংস্থাপনের জন্য কুরু-সভায় গিয়ে, শ্রীকৃষ্ণ দুর্য্যোধনের ক্রটির কোনও কথাই ব্যক্ত করতে সঙ্কোচ বোধ করলেন না; অধিকন্তু জানালেন, সুহৃদগণের বাক্য উল্লঙ্ঘন করলে তুমি কোনও কালে কল্যাণ-লাভে সমর্থ হবে না; –‘ন শর্ম্ম প্রাপ্স্যাসে রাজন্নুৎক্রম্য সুহৃদান্‌ বচঃ।’ পিতা মাতা গুরুজনের বাক্য লঙ্ঘন করে যে জন কোনও কাজ করে, তার শ্রেয়ঃ নেই,-শ্রীকৃষ্ণের উক্তিতে এই সকল কথা প্রকাশ পায়। সুতরাং তিনি একদিকে দুর্য্যোধনের শ্রেয়-সাধনের জন্য আন্তরিক চেষ্টা করেছিলেন বুঝা যায়; আবার অন্যদিকে তাঁর শ্লেষ-বাক্য দুর্য্যোধনকে যুদ্ধার্থ উত্তেজিত করেছিল বলেই বুঝতে পারি। বলা হয়, দ্বিভাবার্থজ্ঞাপক বাক্য প্রয়োগই বিশিষ্ট রাজনীতিজ্ঞের লক্ষণ। শ্রীকৃষ্ণ-চরিত্রের সমালোচনা প্রসঙ্গে কেউ কেউ তাই তাঁর ঐরুপ দ্ব্যর্থ-ভাবাত্মক বাক্যের সমালোচনায় তাঁকে পরম কুটরাজনীতিজ্ঞ বলে নির্দেশ করে থাকেন। অশ্বখামার মৃত্যু সংবাদ – রটনায়, সত্যাসত্যের অনুবর্ত্তিতা প্রসঙ্গে, কেঊ তাঁকে প্রকৃষ্ট রাজনীতিক বলে ঘোষণা করেন, কেউ বা তাঁকে অসত্যের-পাপের প্রশ্রয়দাতা বলে অনুযোগ করে থাকেন। এখানে আমরা কিন্তু তার দিব্য-সুন্দর মুর্ত্তি দেখতে পাই। রাজনীতিকের দৃষ্টিতে, বিপক্ষ পক্ষের সঙ্ঘাত-সাধনের জন্য তিনি যে পন্থা অবলম্বন করেছিলেন, তাহাই শ্লাঘনীয়(প্রশংসা; আত্মপ্রশংসা)। কেন-না, বিজয়-লক্ষ্মী সেই পথেই তাঁকে জয়মাল্য প্রদান করেছিলেন। সাম-দান-ভেদ প্রভৃতি রাজনীতির অঙ্গ। রাজনীতি-ক্ষেত্রে জয়ী হতে হলে সে সকল কুটনীতির সাহায্য অপরিহার্য। কিন্তু সমালোচকের তীব্র-দৃষ্টিতে ঐ সকল কাজে তিনি ভয়ানক অপরাধী বলে প্রতিপন্ন হয়েছেন; কেন-না,-তিনি ‘সত্যই ধর্ম’;অহিংসাই ধর্ম’ প্রভৃতি শিক্ষা দান করে আপন কাজে অসত্যের হিংসার প্রশ্রয় দিয়া গেছেন। এ সকল বিষয় বুঝতে হলে ধর্মতত্ত্ব বিশেষভাবে বুঝবার প্রয়োজন হয়। কেননা, রাজধর্ম এক রকম, গার্হস্থ্য ধর্ম একরকম, আর মোক্ষধর্ম একরকম; সুতরাং সর্বত্র একবিধ নীতি কখনও প্রয়োজন-সাধক হয় না। কর্মে অকর্মে এবং অকর্মে কর্ম প্রভৃতির বিষয় আলোচনা করে আমরা যা বুঝেছি, + সে অনুসারে বিচার করতে গেলে সত্যে অসত্য, অসত্যে সত্য প্রতিপাদিত হতে পারে। আমরা যাকে সত্য বলে মনে করি, অনেক সময় তা ভ্রান্তিমূলক প্রতিপন্ন হয়। আবার আমরা যাকে মিথ্যা বলে মনে করি, অনেক সময় তা সত্য বলে প্রতিপন্ন হতে পারে। যদি বুঝা যায়, দুর্য্যোধনের পক্ষ অধর্মের-অসত্যের পরিপোষক, আর তাদের ধ্বংস-সাধনে ধর্মের-সত্যের প্রতিষ্ঠা অবশ্যম্ভাবী, তাহলে বুঝতে হয়, যুধিষ্টিরের সেই উক্তি অসত্য হয়েও সত্য-ফলপ্রসু। কিন্তু সে বিতর্কে-সে দার্শনিক গবেষণায় প্রবৃত্ত না হয়ে যদি মানুষিক সহজ দৃষ্টিতে সন্ধান করে দেখি, তাহলেই বা কি তথ্য অবগত হই? অবগত হই না কি, শ্রীকৃষ্ণ কি লৌকিক ভাবে কি অলৌকিক ভাবে অসত্যের প্রশ্রয় কখনও দেন নাই! যুধিষ্টির সত্যবাদী; তিনি জীবনে কখনও মিথ্যা কথা বলননি; জ্ঞানে হোক আর অজ্ঞানে হোক, অশ্বত্থামার সংহার-সাধনে তাঁকে মিথ্যার প্রশ্রয় দিতে হল। জীবনে একবার একটা মাত্র ঘটনায় যুধিষ্ঠির মিথ্যা বাক্য উচ্চারণ করলেন। কিন্তু তার ফল হল কি? ফল হল-তাঁর নরক-দর্শন। শ্রীকৃষ্ণ দেখালেন,-মিথ্যা কখনই শ্রেয়ঃসাধক নয়; সত্যের জন্য-ধর্মরাজ্য সত্যরাজ্য প্রতিষ্ঠার জন্য যে মিথ্যা, সে মিথ্যাও দোষাবহ। শাস্ত্রে আছে বটে, প্রাণ-রক্ষা-কল্পে ও বিবাহ প্রভৃতি বিষয়-বিশেষে মিথ্যাও পাতক শূন্য হয়ে থাকে;++ কিন্তু সত্য-মিথ্যার সে মীমাংসায় উপনীত হওয়া সাধারণ মানুষের সাধ্যায়ত্ত নয়। যেখানে উপদেশ আছে-প্রাণীর প্রাণ রক্ষার জন্য মিথ্যা দোষাবহ নয়, সেখানে বিচার করা প্রয়োজন-কোন অবস্থায় দোষাবহ নয়! শ্রীকৃষ্ণ পরম জ্ঞানী-পরম নীতিতত্ত্বজ্ঞ ছিলেন; সুতরাং তিনি দোষাদোষ বিচার করেই সত্য-মিথ্যার উপযোগিতা নির্ধারণ করতেন। কিন্তু তাহলেও কর্মফল অনিবার্য। মিথ্যা হিংসা যখন কর্মরূপে পরিণত হইবে; তাহার ফলোৎপত্তি কেহই রোধ করিতে পরিবে না। যুধিষ্ঠিরের মিথ্যা-বাক্য এক দিকে সত্যের প্রতিষ্ঠায়—ধর্ম-রাজ্যের প্রতিষ্ঠায় সহায় হইল বটে; কিন্তু অন্য দিকে এক জন ধার্মিকের সংহার-সাধন করিল। সুতরাং ঐ এক মিথ্যায় দুই ফল অনিবার্য্য হইল। যে শুভ-সঙ্কল্প-সাধনের দূর লক্ষ্য রাখিয়া সেই মিথ্যা-বাক্য প্রযুক্ত হইয়াছিল, সে শুভ সঙ্কল্প সাধিত হইয়া আসিল; অপিচ, সে যে মিথ্যা-আশীবিষ( দন্তে বিষ আছে যাহার-সর্প), তাহার ক্রিয়াও করিয়া গেল,—সেই মিথ্যার জন্য যুধিষ্ঠিরকে নরক-দর্শন করিতে হইল। এখানে একটা প্রশ্ন উঠতে পারে। সে মিথ্যার পাপ কৃষ্ণে না বর্ত্তিয়া যুধিষ্টিরে বর্ত্তিল কেন? তাহারও কারণ আছে। শ্রীকৃষ্ণ নিষ্কাম, যুধিষ্ঠির সকাম। যুধিষ্ঠির রাজ্যলাভেচ্ছু, সুতরাং সকাম ছিলেন। সেই জন্য নিষ্কাম কর্মী শ্ৰীকৃষ্ণে পাপফল স্পর্শ করিল না; সকামকর্মী যুধিষ্ঠির পাপফলভাগী হইলেন। অধিকন্তু শ্রীকৃষ্ণ এখানে দেখাইলেন, অজ্ঞাতসারে মিথ্যা কহিলেও পাপভাগী হইতে হইবে। ফলতঃ, সূক্ষ্ম-ভাবে বিচার করিয়া দেখিলে, শ্রীকৃষ্ণ যে মিথ্যার প্রশ্রয়দাতা ছিলেন, তাহা কখনই বলা যাইতে পারে না। তিনি একজন প্রকৃষ্ট রাজনীতিক ছিলেন, এ সকল আলোচনায় তাহাই প্রতিপন্ন হয়।

শ্রীকৃষ্ণের ধর্ম্মনীতি
শ্রীকৃষ্ণের সকল নীতির শ্রেষ্ঠ নীতি-ধর্ম্মনীতি। সমাজনীতি রাজনীতি প্রভৃতি এক হিসাবে তাঁহার ধর্ম্মনীতিরই অন্তর্ভুক্ত। যাহা কিছু তিনি উপদেশ দিয়াছেন বা যে কিছু কার্য্যের তিনি অনুষ্ঠান করিয়া গিয়াছেন, সকলেরই মূল লক্ষ্য এক- ধর্ম্ম-প্রতিষ্ঠা। সুতরাং তাঁহার নীতিমাত্রেরই মূল-ভিত্তি—ধর্মের উপর। অর্থাৎ,—তাঁহার প্রবর্ত্তিত কি সমাজনীতি কি রাজনীতি সকলই ধর্ম্মশিক্ষামূলক। তথাপি আমরা তাঁহার নৈতিক মত-সমূহকে বিভিন্ন বিভাগে বিভক্ত করিলাম; তাঁহার কারণ এই যে, কার্য্যক্ষেত্রে সংসারীর পক্ষে বিভিন্ন অবস্থাতে তাঁহার মত বিভিন্ন প্রকারে কার্য্যকরী হইতে পারে। তদনুসারে শ্রীকৃষ্ণের ধর্ম্মনীতি-প্রসঙ্গে মানুষের উচ্চ-পরিণতির বিষয়ই বিবৃত করা হইতেছে।
যে অবস্থা সকল অবস্থার সার অবস্থা, সে অবস্থার লক্ষণ কি-আর কেমন করিয়াই বা সে অবস্থায় উপস্থিত হওয়া যায়, শ্রীকৃষ্ণের ধর্ম্মনীতির আলোচনায় কেবল তাহারই কয়েকটি দৃষ্টান্ত প্রদর্শন করিব মাত্র। প্রথম, মানুষের কি রূপ পরার্থপর নিঃসঙ্গ ও নির্লিপ্ত হওয়া প্রয়োজন, তৎসম্বন্ধে তিনি বলিতেছেন,—

“শশ্বৎপরার্থসর্বেহঃ পরার্থৈকান্তসম্ভবঃ। সাধুঃ শিক্ষেত ভূভৃত্তো নগশিষ্যঃ পরাত্মতাম্॥
প্রাণবৃত্ত্যৈব সন্তুষ্যেন্মুনির্নৈবেন্দ্রিয়প্রিয়ৈঃ। জ্ঞানং যথা ন নশ্যেত নাবকীর্যেত বাঙ্মনঃ।।
বিষয়েষ্বাবিশন্যোগী নানাধর্মেষু সর্বতঃ। গুণদোষব্যপেতাত্মা ন বিষজ্জেত বায়ুবৎ।।
পার্থিবেষ্বিহ দেহেষু প্রবিষ্টস্তদ্গুণাশ্রয়ঃ। গুণৈর্ন যুজ্যতে যোগী গন্ধৈর্বায়ুরিবাত্মদৃক্।।
অন্তর্হিতশ্চ স্থিরজঙ্গমেষু ব্রহ্মাত্মভাবেন সমন্বয়েন।
ব্যাপ্ত্যাব্যবচ্ছেদমসঙ্গমাত্মনো মুনির্নভস্ত্বং বিততস্য ভাবয়েৎ॥
তেজোঽবন্নময়ৈর্ভাবৈর্মেঘাদ্যৈর্বায়ুনেরিতৈঃ। ন স্পৃশ্যতে নভস্তদ্বৎকালসৃষ্টৈর্গুণৈঃ পুমান্।।
স্বচ্ছঃ প্রকৃতিতঃ স্নিগ্ধো মাধুর্যস্তীর্থভূর্নৃণাম্। মুনিঃ পুনাত্যপাং মিত্রমীক্ষোপস্পর্শকীর্তনৈঃ।।

অর্থাৎ- ‘পর্ব্বত যেমন পরার্থ-ব্রতধারী, তদ্‌গাত্রোৎপর বৃক্ষতৃণ-নির্ঝর যেমন পরের প্রয়োজন-সাধক হয়; সাধুগণের কার্য্যও সেইরূপ হওয়া কর্ত্তব্য; তাঁহারা পর্ব্বতগাত্রোৎপন্ন বৃক্ষাদির নিকট হইতে পরার্থতা(পরের জন্যই তাঁহাদের কার্য্য) শিক্ষা করিবেন। সাধুজন প্রাণধারণ করিবেন-কেবল জ্ঞানান্বেষণের জন্য; রূপ-রসাদি ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বিষয় উপভোগের জন্য সাধুগণ কখনই জীবনধারণ করেন না। গুণলিপ্সা বামনের বিক্ষেপ জ্ঞান-নাশক। শীতোষ্ণসুখদুঃখাদি নানাধর্ম্মশীল থাকিয়াও সাধুপুরুষ গুণদোষে অনাসক্ত থাকিবেন; বায়ু যেমন সর্ব্বত্র সঞ্চালিত থাকিয়াও নির্লিপ্ত আছেন; যোগী পুরুষের সেইরূপ নির্লিপ্ততা প্রয়োজন। আত্মদর্শী যোগী বাল্যযৌবনাদি দেহধর্ম্ম আশ্রয় করিয়াও এবং সেই সেই আবস্থার গুণাশ্রয়ী হইয়াও, অসংশ্লিষ্ট থাকেন; বায়ু যেমন গন্ধাদি ধর্ম-যোগে গন্ধবহু বলিয়া অভিহিত হইলেও গদ্ধাদির সহিত অসংসৃষ্ট, যোগিপুরুষও সেইরূপ নির্লিপ্ত-ভাবাপন্ন। আকাশ যেমন সর্ব্বগত, ঘটাদির সহিতও তাহার যেমন অসঙ্গ নাই, অথচ আকাশ যেমন নিঃসঙ্গ নির্লিপ্ত; আত্মা সেইরূপ সর্ব্বভূতে বিরাজমান আছেন; যোগী পুরুষ দেহাদির সহিত সম্বন্ধযুক্ত আত্মার স্থাবর-জঙ্গমাদি সর্ব্বত্র নিঃসঙ্গ নির্লিপ্ত ভাবে অবস্থিতির বিষয় অনুভব করিবেন। তেজ, জল, অন্ন, পৃথিবী, প্রভৃতি কালসৃষ্টগুণে পুরুষ আবদ্ধ নহেন; বায়ু-চালিত মেঘাদির সচিত আকাশের যেমন সংশ্রব অভাব, যোগী পুরুষের ও সেইরূপ নির্লিপ্ত ভাব। স্বভাবজ নির্মল স্নিগ্ধ মধুর জল যেমন জীবের স্নিগ্ধতা সম্পাদন করে, নির্মল স্নিগ্ধ মধুর স্বভাব সাধুপুরুষও সেইরূপ দর্শন স্পর্শন কীর্ত্তন প্রভৃতির দ্বারা দ্রষ্টা-মাত্রকে পরিতৃপ্ত করেন।’ অন্য আর এক স্থলে ভগবান সাধুজনের উপমায় কহিতেছেন-“সিদ্ধু যেমন বর্ষাকালীন নদী-সকলের জল প্রাপ্ত হইয়াও বেলা অতিক্রম করেন না এবং গ্রীষ্মকালে নদীসকল শুষ্ক হইলেও বিশুষ্ক হন না; তদ্রুপ নারায়ণ পরায়ণ যোগী কামসকল যথেষ্টরূপে লাভ করিয়া বা ঐ সকল বর্জ্জিত হইয়া, আনন্দে মত্ত ও দুঃখে ম্লান হইবে না।” শ্রীমদ্ভাগবতে (একাদশ স্কন্ধ, অষ্টম অধ্যায়, ৬ষ্ঠ শ্লোকে)যথ,-

“সমৃদ্ধকামো হীনো বা নারায়ণপরো মুনিঃ। নোৎসর্পেত ৎ শুষ্যেত সরিদ্ভিরিব সাগরঃ।।”
সাধুর স্বরূপ ও সাধুসঙ্গের ফল শ্রীমদ্ভাগবতে শ্রীভগবান এইরূপ বর্ণন করিয়া গিয়াছেন,—
“সন্তঃ অনপেক্ষাঃ মচ্চিত্তাঃ প্রশান্তাঃ সমদর্শিনঃ। নির্মমাঃ নিরহঙ্কারাঃ নির্দ্বন্দ্বাঃ নিষ্পরিগ্রহাঃ।।
যথা উপশ্রয়মাণস্য ভগবন্তং বিভাবসুম্। শীতং ভয়ং তমঃ অপি এতি সাধূন্ সংসেবতঃ তথা।।
নিমজ্জ্য উন্মজ্জ্যতাং ঘোরে ভবাব্ধৌ পরম অয়নম্। সন্তঃ ব্রহ্মবিদঃ শান্তাঃ নৌঃ দৃঢ ইব অপ্সু মজ্জতাম্ ।।
অন্নং হি প্রাণিনাং প্রাণঃ আর্তানাং শরণং তু অহম্। ধর্মঃ বিত্তং নৃণাং প্রেত্য সন্তঃ অর্বাক্ বিভ্যতঃ অরণম্।।
সন্তঃ দিশন্তি চক্ষূংষি বহিঃ অর্কঃ সমুত্থিতঃ। দেবতাঃ বান্ধবাঃ সন্তঃ সন্তঃ আত্মা অহম্ এব চ।।

অর্থাৎ,- “যাঁহারা নিরপেক্ষ, মচ্চিত্ত, প্রশান্ত, সমদর্শী, মমতাশূন্য, অহঙ্কারবর্জ্জিত, দ্বন্দ্বরহিত এবং পরিগ্রহশূন্য, তাঁহারাই সাধু।…যেমন ভগবান অগ্নিকে আশ্রয় করিলে লোকের শীত, অন্ধকার ও ভয় থাকে না; তেমনি সাধুগণের সেবা করিলে সমস্ত পাপ নষ্ট হইয়া যায়। যেমন, যাঁহারা জলে নিমগ্ন হইয়া যাইতেছেন, তাঁহাদিগের নৌকা পরম আশ্রয়; সেইরূপ ঘোর ভগবসাগরে নিমর্জ্জন ও উন্মজ্জনশীল জীবগণের ব্রহ্মজ্ঞ সাধু-সকল পরম অবলম্বন। যেমন অন্ন প্রাণীগণের প্রাণ; যেমন আমি কাতর জনগণের প্রাণ, যেমন আমি কাতর জনগণের শরণ; যেমন ধর্ম্ম পরকালে মানবগণের ধন; সেইরূপ সাধুগণ সংসারপতনভীত পুরুষের পরিত্রাতা। সাধুসকল অশেষ চক্ষু প্রদান করেন, সূর্য্য উদিত হইয়া বাহ্য-চক্ষু প্রদান করেন; সাধুগণ অন্তশ্চক্ষু, বহিশ্চক্ষু উভয়বিধ দৃষ্টিশক্তি প্রদান করিয়া থাকেন সাধুগণই দেবতা ও বান্ধব; সাধুগণই আমি আত্মারূপে অবস্থিত।” সাধুমহিমা সাধুসঙ্গ কীর্ত্তন করিয়া শ্রীকৃষ্ণ মানুষকে সাধুসঙ্গে সচ্চিন্তায় সম্ভাবনায় অনুপ্রাণিত করিয়াছেন। সাধুসঙ্গে সৎপ্রসঙ্গে সচ্চিন্তায় যে সৎস্বরুপত্ব প্রাপ্ত হওয়া যায়; আর অসচ্চিন্তায় অসৎসঙ্গে অসৎভাবে যে বিপরীত অবস্থা প্রাপ্তি ঘটে; একটা দৃষ্টান্তে তাহা বিশদীকৃত দেখি। শ্রীমদ্ভাগবতে (একাদশ স্কন্ধ, নবম অধ্যায়) যথা,—

“যত্র যত্র মনঃ দেহী ধারয়েৎ সকলং ধিয়া। স্নেহাৎ দ্বেষাৎ ভয়াৎ বা অপি যাতি তৎ তৎ সরূপতাম্।।”
কীটঃ পেশস্কৃতং ধ্যায়ন্ কুড্যাং তেন প্রবেশিতঃ। যাতি তৎ স্সত্মতাং রাজন্ পূর্বরূপম্ অসন্ত্যজন্।।”

অর্থাৎ—“মনের সহিতই মুক্তির বা দেহীর অবস্থান্তর প্রাপ্তির সম্বন্ধ। স্নেহ, দ্বেষ, ভয় প্রভৃতি যে সকল বিষয়ে তাহার অনুধ্যান থাকে, দেহান্তেও সে তত্তৎসরূপতা প্রাপ্ত হয়। কীট যেমন পেশস্কারকে (ভ্রমর-বিশেষকে) ধ্যান করিতে করিতে তৎকর্তৃক কুড্যার (ভিত্তির) মধ্যে প্রবিষ্ট হইয়া নিরুদ্ধ অবস্থায় তাহার স্বরূপ্য প্রাপ্ত হয়; মানুষেরও সেই দশা হয়।” * সকল উপদেশের সার উপদেশ এই উপমায় নিবদ্ধ দেখি। মনই সকল অবস্থার বিধায়ক; সুতরাং চিত্তকে স্থির করিয়া যিনি আত্মার প্রতি ন্যস্ত করিতে পারেন, অর্থাৎ মন যাঁহার ভগবন্ন্যস্ত হইতে পারিয়াছে, তাঁহারই জন্ম সার্থক, জীবন সার্থক, শিক্ষা সার্থক।

ভক্তমুখে ধর্ম্মনীতি-প্রচার
বলিয়াছি তো, শ্রীকৃষ্ণের ধর্ম্মনীতি তাঁহার শিক্ষার প্রাণভূত। সুতরাং যেখানে তিনি আবির্ভূত হইয়াছেন, যেখানে তাঁহার অমৃতবাণী বিঘোষিত হইয়াছে, সেইখানেই তাঁহার ধর্ম্মনীতির আলোক-রশ্মি হৃদয়ে হৃদয়ে বিচ্ছুরিত দেখি। শ্রীমদ্ভগবদগীতার সকল অংশই ধর্ম্মনীতি-মূলক। শ্রীকৃষ্ণের দার্শনিক মত-পরম্পরা আলোচনা উপলক্ষে যে সকল অংশ উদ্ধৃত করা হইয়াছে, তাহাতেই এ বিষয় বিশদরূপে অবগত হওয়া যাইবে। ভাগবত, মহাভারত, ব্রহ্মবৈবর্ত্তপুরাণ এবং হরিবংশ প্রভৃতিতে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের যে সকল উক্তি দৃষ্ট হয়, তাহার মধ্যেও ধর্ম্মনীতি ওতঃপ্রোতঃ বিদ্যমান রহিয়াছে। মহাভারতের অনুগীতা–তদুক্ত ধর্ম্মোপদেশ-মুলক। শান্তিপর্বে যুধিষ্টিরের প্রশ্নের উত্তরে ভীষ্ম সর্ব্ববিধ ধর্ম্ম-বিষয়ে যুধিষ্ঠিরকে যে উপদেশ প্রদান করেন, সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে দর্শন করিলে, সে ও শ্রীকৃষ্ণ-কথিত ধর্ম-তত্ত্ব বলিয়া মনে করিতে পারি। কেন-না, মহাভারতে লিখিত আছে- শ্রীকৃষ্ণ ভীষ্মের শরীরে প্রবেশ করিয়া, তাঁহাকে ভক্তি ও ত্রিকাল-দর্শন-জ্ঞান দান করিয়াছিলেন। শরশয্যাশায়ী ভীষ্ম যুধিষ্ঠিরকে উপদেশচ্ছলে সকল শাস্ত্রের সার তথ্য অবগত করান। এমন কোনও উপদেশ বা এমন কোন ও শিক্ষা বোধ হয় নাই,—শরশয্যাশায়ী ভীষ্মের উক্তিতে যাহা ব্যক্ত হয় নাই। ভীষ্ম যে পরম জ্ঞানী পরম পণ্ডিত ছিলেন, তদ্বিষয়ে আদৌ সন্দেহ নাই। তথাপি মুমুর্ষু ভীষ্ম কোন শক্তি প্রভাবে জীবনের শেষ মুহূর্ত্তে তাদৃশ তত্ত্ব-কথা ব্যক্ত করিতে সমর্থ হইয়াছিলেন, তাহা ও বিবেচনার বিষয়। সে শক্তিকে শ্রীকৃষ্ণের শক্তি ভিন্ন কি বলিব ? যোগ-প্রভাবে পরদেহে প্রবেশের সামর্থ্য জন্মে। শ্রীকৃষ্ণ যোগপ্রভাবে ভীষ্মের দেহে প্রবেশ করিয়া তাঁহার মুখে ধর্ম্ম-তত্ত্ব ব্যক্ত করেন। ইহা অলৌকিক অত্যাশ্চর্য্য ব্যাপার নহে! আজকাল যোগাঙ্গের অংশ মাত্র অবলম্বন করিয়াই কত অলৌকিক ব্যাপার সম্পন্ন হইতেছে। মেসমেরিজম, হিপ্‌নটিজম, স্পিরিচুয়ালিজম প্রভৃতি তত্ত্বে অভিজ্ঞ ব্যক্তিগণের বিষয়ই এখানে উল্লেখ করিতেছি। মেসমেরিজম (Mesmerism ) শক্তি প্রভাবে মানুষ দেহ বিশেষে শক্তিবিশেষের সঞ্চালন করিতে সমর্থ হয় । *মৈন্মর-তত্ত্ব-বিশারদগণ (Mesmeriser) অধিবিষ্টের ( Mediumএর ) সাহায্যে অলৌকিক অমানুষিক ক্রিয়া সম্পন্ন করিয়া থাকেন। ইউরোপে, আমেরিকায়, অষ্ট্রেলিয়ায় এবং ভারতবর্ষের বিভিন্ন কেন্দ্রে তত্ত্ববিদ্যার আলোচনা হওয়ায়, অধিবিষ্ট (মিডিয়াম্) সাহায্যে পরলোকগত আত্মার আবির্ভাব অনেকে প্রত্যক্ষ করিয়াছেন; অপিচ, সেই অধিবিষ্ট ( মিডিয়াম্) অশিক্ষিত অজ্ঞজন হইলেও গভীর জ্ঞানগবেষণার পরিচয় দিতে সমর্থ হয়। তত্ত্বাধিবেশনে (seance) অধিবিষ্টের (মিডিয়ামের) সাহায্যে পরলোকগত ব্যক্তির ছায়ামূৰ্ত্তি দর্শন এবং ক্রিয়া-কলাপ দৰ্শন অধুনা একরূপ অবিসস্বাদিত। একটী প্রামাণিক ঘটনার উল্লেখ করিতেছি। + এগুরু গ্লেণ্ডিনিং বিষয়-বাণিজ্য উপলক্ষে লণ্ডনের উত্তর পশ্চিম ভাগে ডালষ্টন নামক উপকণ্ঠে বাস করিতেন। ১৯১০ খৃষ্টাব্দের ১৩ই জানুয়ারী “তাঁহার শাস্তিনিকেতন রূপ সুরম্য নিবাসে একটি তত্ত্বাধিবেশন (seance) হইয়াছিল। অনেক ভদ্রলোক ও ভদ্রমহিলা সেখানে উপবিষ্ট ছিলেন। তাঁহারা সকলেই দেখিলেন,—গ্লেণ্ডিনিঙের স্বর্গগত সহধৰ্ম্মিণী, সেখানে জড় পরমাণুতে আবৃত স্পর্শযোগ্য প্রত্যক্ষ মূৰ্ত্তিতে উপস্থিত হইয়া। একটা পার্শ্বস্থ টেবিলের পুষ্পাধান হইতে কয়েকট পুষ্প হস্ত প্রসারণ করিয়া তুলিয়া লইলেন, এবং তাহা হইতে পাঁচটি পুষ্প দ্বারা গ্লেণ্ডিনিঙকে অলঙ্কৃত করিয়া, অন্যান্য ভদ্রলোক ও ভদ্রমহিলাদিগকে একটা কিংবা দুইটা করিয়া পুষ্প উপহার দিলেন।…(গ্লেণ্ডিনিং) প্রতি মাসে দুই তিন দিন, মিডিয়ামের সাহায্যে—প্রখর আলোকে—সিয়ান্স (seance) অর্থাৎ তত্ত্বাধিবেশন করিয়া, তাঁহার স্বর্গগত পত্নী ও পুত্ৰকন্যার ছায়ামূৰ্ত্তি দর্শন করিয়া থাকেন, এবং তাঁহাদিগের হস্তস্পর্শ ও ললাট-চুম্বন-লাভে, এবং তাহাঁদিগের সহিত কথোপকথনে অন্তরে অমৃতশীতল সুখশান্তি প্রাপ্ত হন।” তত্ত্ববিদ্যা-সংক্রান্ত গ্রন্থে এ সকল বিষয়ের ভুরি ভুরি প্রমাণ পাওয়া যেতে পারে। ভারতবর্ষে এই তত্ত্ববিদ্যা- যে চরমোৎকৰ্ষ লাভ করিয়াছিল, তাহা বুঝাইবার প্রয়োজন হয় না। যে সময়ের প্রসঙ্গ উত্থাপিত হইয়াছে, তখন তত্ত্ববিদ্যার উৎকর্ষেরই দিন। যোগ-তত্ত্ববিদ্যার পূর্ণ স্ফূর্ত্তি। যোগ-প্রভাবে সকলই সম্ভব ছিল। শ্রীকৃষ্ণ পরম যোগী ছিলেন। মুমুর্ষু ভীষ্ম যে একাধারে সকল তত্ত্ব-কথার উপদেশ প্রদানে সমর্থ হইয়াছিলেন, তাহার একমাত্র কারণ,- শ্রীকৃষ্ণের প্রভাব। ভীষ্ম মৃত্যুর পূর্ব্বে শ্রীকৃষ্ণের স্মরণ অর্চ্চন বন্দন দ্বারা তদগতচিত্ত হইয়াছিলেন। তখন, যোগপ্রভাবে শ্ৰীকৃষ্ণ ভীষ্মের দেহাভ্যস্তরে প্রবেশ করিয়া তাঁহাকে ত্রিকাল-দর্শনের দিব্য-জ্ঞান প্রদান করেন। মহাভারতে(শান্তি-পর্ব) যথা,- “অধিগম্য তু যোগেন ভক্তিং ভীষ্মস্য মাধবঃ। ত্রৈলোক্যদর্শনং জ্ঞানং দিব্যং দত্ৎবা যয়ৌ হরিঃ॥ 12-46-136”
যোগ প্রভাবে ভক্তের শরীরে প্রবেশ করিয়া ভক্তবৎসল ভগবান যে আপন বিভূতি প্রকাশ করেন, ইতিহাসে এ দৃষ্টান্তের অসদ্ভাব নাই। সেদিনও মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যদেব ভক্ত রায় রামানন্দের দেহে অভির্ভূত হইয়া প্রশ্নোত্তরচ্ছলে রামানন্দের মুখে পরম তত্ত্ব বিবৃত করিয়াছিলেন। এইরূপে দেখা যায়, শ্ৰীকৃষ্ণ নিজের মুখে এবং অন্তরঙ্গগণের মুখে সকল নীতির সার নীতি-সমূহ প্রকাশ করিয়া গিয়াছেন। সুতরাং শ্ৰীকৃষ্ণ যে পরম নীতিবিৎ ছিলেন, তদ্বিষয়ে কোনই মতান্তর নাই।

শ্রীকৃষ্ণের নীতি জনহিতসাধক।
সকল প্রকার নীতির, উপদেশের বা শিক্ষার একট লক্ষ্য আছে। সে লক্ষ্য— সংসারের বা জগতের হিতসাধন। সুতরাং যে নীতির, উপদেশের বা শিক্ষার দ্বারা জগতের হিতসাধন হয়, তাহাই প্রকৃষ্ট। শ্রীকৃষ্ণের নীতির এই প্রকৃষ্টতা সৰ্ব্বতোভাবে পরিদৃষ্ট হয়। তাহাঁর নিজের জীবনেই তিনি আপন কাৰ্য্য দ্বারা আপনার প্রচারিত নীতির সার্থকতা দেখাইয়া গিয়াছেন। শ্রীকৃষ্ণের জীবন-বৃত্তান্ত আলোচনায় আমরা বুঝিতে পারি, জনহিতসাধনই তাহাঁর জীবনের প্রধান ব্রত ছিল। ধৰ্ম্ম সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার ও মূল লক্ষ্য-দুষ্কৃতের বিনাশে সজ্জনের রক্ষায় সেই জনহিতসাধন-ব্রত পালন। এখানে প্রশ্ন উঠিতে পারে, জনহিতসাধনই যদি তাঁহার লক্ষ্য ছিল, তাহা হইলে লোকক্ষয়কর যুদ্ধে প্রবৃত্ত না হইয়া অন্য প্রকারে তিনি শাস্তি-স্থাপনের চেষ্টা পাইলেন না কেন ? জনহিতসাধন উদ্দেশ্যেই প্রণোদিত জন, লোকহনন করিবেন কেন ? এ প্রশ্নের উত্তর এই যে, জনহিতসাধন উদ্দেশ্যেই লোক হনন আবশ্যক হইয়াছিল; নহিলে, অকারণ তিনি লোকক্ষয় করিবার চেষ্টা কখনও পান নাই। জরাসদ্ধ, শিশুপাল প্রভৃতি বধের দৃষ্টাস্তে এ প্রশ্নের সমাধান হইতে পারে। জরাসন্ধের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করিয়া জয়লাভ করা তৎকালে পাওবগণের পক্ষে অসাধ্য ছিল বলিলেও অত্যুক্তি হয় না। পরন্তু সে পথে অগ্রসর হইতে হইলে, বহু লোকক্ষয় সম্ভাবনা ছিল। সুতরাং শ্রীকৃষ্ণ সেখানে এক কৌশল অবলম্বন করিলেন; তাঁহার একটি উক্তিতে বা নীতিবাক্যে, তাঁহার সে কৌশলের আভাষ পাওয়া যায়। সে উক্তিটি এই, “অদ্বারেণ রিপোর্গেহং দ্বারেণ সুহৃদো গৃহান। প্রবিশন্তি নরাধীরা দ্বারাণ্যেতানি ধর্ম্মতঃ।।”
অর্থাৎ,- ‘বুদ্ধিমান্‌ ব্যক্তিরা শত্রুর গৃহে অদ্বার দিয়া এবং বন্ধুর গৃহে দ্বার দিয়া প্রবিষ্ট হন।’ এই উক্তির নিগূঢ় তাৎপর্য্য এই যে, শত্রুকে যুদ্ধার্থ প্রস্তুত হইবার সুবিধা না দিয়া, সহসা আক্রমণ ও বিশ্বস্ত করাই বিধেয়।
জরাসন্ধ বধ সম্বন্ধে শ্ৰীকৃষ্ণ এই নীতিরই অনুসরণ করেন। তাঁহার কৌশলক্রমেই ভীমের সহিত জরাসন্ধের মল্লযুদ্ধ আরম্ভ হয়। ভীম ও জরাসন্ধ তুল্য বীর ছিলেন। তাঁহাদের মল্লযুদ্ধ কার্ত্তিক মাসের প্রথম তিথিতে আরম্ভ হয়। ত্রয়োদশী পৰ্য্যন্ত উভয়ে দিবারাত্রি অনাহারে অবিশ্রান্ত যুদ্ধে ব্ৰতী ছিলেন। চতুর্দ্দশীর রাত্রিতে জরাসন্ধ ক্লান্ত হইয়া সংগ্রামে নিরস্ত হন। সেই সময় শ্রীকৃষ্ণের ইঙ্গিতে ভীমসেন জরাসন্ধের সংহারসাধন করেন । শ্ৰীকৃষ্ণের কৌশলে লোকক্ষয় নিবারিত হয় ; অথচ জরাসন্ধও পঞ্চত্ব প্রাপ্ত হন। শক্রনাশের সঙ্গে সঙ্গে নিরীহ সৈনিকগণ বা জনসাধারণ নিহত না হন,—এই উদ্দেশ্যে জরাসন্ধের বধে শ্ৰীকৃষ্ণের কৌশলাবলম্বন বলিয়া মনে করিতে পারি। শিশুপাল-বধে ও শ্ৰীকৃষ্ণ লোকক্ষয় বিষয়ে সাবধান ছিলেন। কালযবনের সহিত তাঁহার যে যুদ্ধ হয়, তাহাতেও তাঁহার অপূৰ্ব্ব কৌশল দেখিতে পাই। জরাসন্ধের সহিত কালযবন পুনঃপুনঃ মথুরা আক্রমণ করিয়াছিলেন। কালযবনের আক্রমণ প্রতিরোধ করিতে মথুরাবাসিগণ অসমর্থ হইয়াছিলেন। কালযবনের ভয়ে শেষে শ্রীকৃষ্ণকে আত্মীয়-স্বজন সহ দ্বারকায় আশ্রয় লইতে হয়। অথচ, বিনা লোকক্ষয়ে কেমন কৌশলে শ্রীকৃষ্ণ সেই কালযবনকে ৰধ করিয়াছিলেন! কৌশলের চরম চিত্র সেখানে প্রতিফলিত; আবার রাজনীতিজ্ঞতারও প্রকৃষ্ট দৃষ্টাস্ত সেই ঘটনায় প্রত্যক্ষীভূত। বলা বাহুল্য, শ্ৰীকৃষ্ণের সংহার-সাধন জন্য কালযবের বিশেষ চেষ্টা ছিল। শ্রীকৃষ্ণ তাহা বেশ জানিতেন। এই অবস্থায় শ্রীকৃষ্ণ একদিন কালযবনের সম্মুখ দিয়া একটা পৰ্ব্বত-গুহার দিকে একাকী পলায়ন করিলেন। একা শ্ৰীকৃষ্ণকে পৰ্ব্বত-গুহার দিকে পলাইতে দেখিয়া, কালযবন শ্রীকৃষ্ণের অনুসরণ করেন । শ্ৰীকৃষ্ণ একাকী পলায়ন করিয়াছিলেন ; সুতরাং তঁtহার অনুসরণে কালযবনের মনে কোনই দ্বিধা উপস্থিত হইল না। কালযবন একাই শ্ৰীকৃষ্ণের অনুসরণে গুহ মধ্যে প্রবেশ করিলেন। সেই গুহায় সূৰ্য্যবংশীয় রাজা মুচুকুন্দ যোগস্থ ছিলেন। গুহায় প্রবেশ করিয়াই কালযবন শ্ৰীকৃষ্ণ-ভ্রমে রাজা মুচুকুন্দকে পদাঘাত করেন। ফলে, মুচুকুন্দের কোপানলে কালঘবনকে ভস্মীভূত হইতে হয়। হরিবংশে এই ঘটনা বিশেষভাবে বিবৃত আছে । কালযবন যাহারই হস্তে মৃত্যুমুখে পতিত হউন;- শ্ৰীকৃষ্ণই তাহার সংহার সাধন করুন, অথবা মুচুকুন্দই তাহাকে ভস্মসাৎ করিয়া ফেলুন –কালযবন-বধে লোকক্ষয় নিবারণে, প্রকারান্তরে লোক রক্ষা কল্পে, শ্রীকৃষ্ণের চেষ্টা দেখা যায়। কুরুপাণ্ডবের মধ্যে সন্ধিস্থাপন-চেষ্টায় লোকক্ষয় নিবারণ পক্ষে তাহার যে একান্ত যত্ব ছিল, তাহা পূৰ্ব্বেই দেখাইয়াছি। সুতরাং তাহার মূল লক্ষ্য যে লোক রক্ষা, সমাজরক্ষা, জনহিতসাধন, তদ্বিষয়ে কোনই মতান্তর থাকিতে পারে না। তবে এ কথাও এখানে বিচাৰ্য্য যে, পুৰ্ব্বোক্ত দৃষ্টান্তে যেমন তাঁহার লোক রক্ষাকর নীতির প্রাধান্য দেখিতে পাই, অন্যত্র আবার তাহার বিপরীত দৃষ্টান্তের অসদ্ভাব নাই। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে লোকক্ষয় এবং যদুবংশের ধ্বংস-সাধন তিনি নিবারণ পক্ষে চেষ্টা করিলেন না কেন ? এ প্রশ্নের উত্তর এই যে, সজ্জনের প্রতিষ্ঠা করিতে হইলে দুৰ্জ্জনের উচ্ছেদসাধন অবশ্যম্ভাবী। ক্ষেত্ৰজাত ধান্যাদি শস্য রক্ষা করিতে হইলে, তদন্তরায়ভূত তৃণগুল্মাদি উৎপাটন একান্ত আবশ্যক। অল্পের অনিষ্টে যদি অধিকের ইষ্ট সাধিত হয়, নীতিবিদ্‌গণ তাহাই শ্রেয়ঃ বলিয়া মনে করেন। এইরূপে বুঝা যায় যে, শ্ৰীকৃষ্ণ পরম নীতিবিৎ ছিলেন; আর জনহিতসাধন উদ্দেশ্যেই তাঁহার নীতি বিহিত হইয়াছিল।

৭। শ্রীকৃষ্ণ-পরম প্রেমিক


শ্রীকৃষ্ণ-পরম প্রেমিক; কেন না তিনি বিশ্ব প্রেমের মূলাধার রূপে বিদ্যমান আছেন।

[প্রেম-স্বরূপ, প্রেম আত্মনিবেদন; প্রেমিকের লক্ষণ, প্রেমিকের সমদর্শন; কৃষ্ণ প্রেমে পরম প্রেমিক, শ্রীরাধার ও ব্রজগোপীর প্রেম-প্রসঙ্গ; বৈষ্ণবের প্রেম তত্ত্ব, ব্রজগোপীর ও শ্রীরাধার প্রেমের নিগূঢ় রহস্য।]

ভক্তের যে সিদ্ধি লাভ, তাই প্রেম। প্রেম ভক্তি তরুর অমৃত ফল। স্নেহ, মমতা, করুণা প্রভৃতি মুকুল মুঞ্জরী পুষ্প যখন প্রেম ফলে পরিণত হয়, তখনই ভক্তি তরু ফলপ্রসূ বুঝা যায়। সেই প্রেম ফল পরিণত হয়, তার টক-স্বাদ কষা-স্বাদ দূর হয়ে যায়, প্রেম যখন পূর্ণরূপে ভগবানের প্রতি ন্যস্ত হয়। বৈষ্ণব শাস্ত্র বড় যথার্থ কথাই বলেছেন, প্রেমই ভক্তের পরম মাহাত্ম্য, ভক্তের যে সিদ্ধিলাভ, নিশ্চয়ই তা প্রেমফল। ‘প্রেমভক্তেশ্চ মাহাত্ম্যঃ ভক্তোর্ম্মাহাত্ম্যতঃ পরম্‌! সিদ্ধমেব যতো ভক্তেঃ ফলং প্রেমৈব নিশ্চিতম্‌।’ ভক্তির যে নয় লক্ষণ (শ্রবণং কীর্তন বিষ্ণোঃ স্মরণং পাদসেবনম্। অর্চ্চনং বন্দনং দাস্যং সখ্যমাত্মনিবেদনম্।), শ্রবণ মনন কীর্তন আদি ভেদে নববিধা যে ভক্তির প্রাধান্য শাস্ত্রে কীর্তিত হয়েছে, আত্মনিবেদন তারই পরিণতি। আত্মনিবেদনই প্রেম। শ্রবণ, কীর্তন, স্মরণ, পাদসেবন, অর্চন, বন্দন, দাস্য, সখ্য সকলের পরিণতি আত্মনিবেদনে বা প্রেমে। পরম-প্রেমিক শ্রীকৃষ্ণ স্তরে স্তরে ভক্তির লক্ষণ সমূহ প্রদর্শন করে, সকলের পরিণতি দেখিয়েছেন- আত্মনিবেদনে বা প্রেমে। শ্রীকৃষ্ণের নিজ জীবনে এই নববিধা ভক্তির লক্ষণ পূর্ণ প্রকটিত দেখতে পাই। কেমন স্তরে স্তরে পরিপুষ্ট লাভ করে স্নেহ মমতা সখ্যতা প্রভৃতি প্রেমে পরিণত হয়, তার জীবনে কত ঘটনায় কত ভাবে তা প্রকাশিত। শ্রবণ, কীর্তন, স্মরণ, পাদসেবন, অর্চন, বন্দন প্রভৃতির ফলে দাস্য সখ্য ভাব সঞ্জাত হয়। সেই দাস্য সখ্য ভাবের স্ফূর্তি আত্মনিবেদনে বা প্রেমে। তিনি নিজেই দাস্যভাব দেখিয়েছেন, নন্দ আদিকে পিতা সম্বোধনে; তার প্রতি দাস্যভাব দেখিয়েছেন – ব্রহ্ম আদি দেব গণ শ্রীকৃষ্ণের নন্দ আলয়ে অবস্থান কালে নন্দের বাধা বহন, আর বিপদে ব্রহ্ম আদি দেবতাদের শ্রীকৃষ্ণ অর্চন, উভয়ে স্থানেই দাস্য ভাবের দৃষ্টান্ত। স্নেহ বাৎসল্যের উদাহরণে নন্দ যশোদার বিষয় স্বতঃই মনে উদয় হয়। ব্রজবালক গণের সখ্যতা, সখ্য ভাবের চূড়ান্ত দৃষ্টান্ত।

এই দাস্য,স্নেহ, বাৎসল্য প্রভৃতি স্তর অতিক্রমের পর আত্মনিবেদন বা প্রেম ভাব। অমর বিদ্যাপতি এই আত্মনিবেদনের অবস্থা সমূহের বিষয় এভাবে বর্ণনা করে গেছেন,-

ধানশী।
তাতল সৈকতে বারি-বিন্দু-সম সুত-মিত-রমণী-সমাজে
তোহে বিসরি মন, তাহে সমপিনু অব মঝু হব কন কাজে॥
মাধব! হাম পরিণাম নিরাশা।
তুহুঁ জগ-তারণ দীন দয়া ময়, অতয়ে তোহারি বিশোয়াসা॥
আধ জনম হাম নিদে গোঙায়নু জরা শিশু কত-দিন গেলা।
নিধুবনে রমণী রস রঙ্গে মাতনু তোহে ভজব কন বেলা॥
কত চতুরানন মরি মরি যাওত ন তুয়া আদি অবসান।
তোহে জনমি পুন, তোহে সমাওত, সাগরী লহরী সমানা॥
ভণয়ে বিদ্যাপতি, শেষ শমন ভয়ে তুয়া বিনু গতি নাহি আরা।
আদি অনাদিক, নাথ কহায়সি, অর তারণ ভার তোহারা॥

ব্রজগোপী গণে এই আত্মনিবেদনের পরাকাষ্ঠা দেখতে পাই। তাঁরাই প্রেমিকা। আত্মনিবেদনে একাগ্রতার ফলে, তারা যখন দেখলেন, জলে কৃষ্ণ স্থলে কৃষ্ণ, কৃষ্ণ ভিন্ন আর অন্য কিছুই নেই, তখনই তাঁদের আত্মনিবেদন সার্থক হল, তখনই তাঁদের প্রেমের পূর্ণ পরিণতি সাধিত হল। সেই প্রেমই তো প্রেম। যে প্রেমে সর্বত্র ভগবৎ দর্শন হয়। কে বলে- ব্রজাঙ্গনার প্রেম কামরাগ কলুষিত ? কে বলে- ব্ৰজগোপীদের প্রেম আসক্তির আবল্য ছিল। রাসমণ্ডলে অসংখ্য গোপী-পরিবেষ্টিত শ্রীকৃষ্ণ। কিন্তু গোপীদের সকলেই মনে করছে- ‘শ্রীকৃষ্ণ আমারই নিকট রয়েছেন।’ কৃষ্ণের কথা স্মরণ করতে করতে, কৃষ্ণের ভাব অনুধ্যান করতে করতে, কৃষ্ণ প্রেম বিধূরা ব্রজাঙ্গনাগণ ‘আমিই কৃষ্ণ’ এই ভাবাপন্ন হয়ে পড়েছিল। যথা, শ্রীমদাভগবতে,-

“গতিস্মিতপ্রেক্ষণভাষণাদিষু প্রিয়াং প্রিয়স্য প্রতিরূঢ়মূৰ্ত্তয়ঃ।
অমাবহস্ত্বিত্যবলাস্তদাত্মিকা ন্যাবেদিষুঃ কৃষ্ণবিহারবিভ্ৰমা॥”

সে কি অনির্বচনীয় ব্যাপার, যারা জ্ঞান রাজ্যের অভ্যন্তরে প্রবেশ করেনি, তারা তা অনুধাবন করতেই পারবেন না। ব্রহ্মবৈবর্ত্ত পুরাণে শ্রীকৃষ্ণ জন্ম খণ্ডে এই রাসলীলার যে বর্ণনা আছে, তা স্মরণ করলে স্তম্ভিত ও বিস্মিত-বিমুগ্ধ হতে হয়। সে বর্ণনায় দেখতে পাই, রাসমণ্ডলে নয় লক্ষ গোপীর সমাগম হয়েছিল; আর শ্ৰীহরি নয় লক্ষ গোপ-রূপ ধারণ করে তাদের সাথে ক্রীড়া করেছিলেন। তবেই বুঝে দেখুন রাসলীলা কি, আর ব্ৰজগোপী গণ কেমন ভাবে কিরূপ প্রেমে আত্মনিবেদনে সমর্থ হয়েছিল। সর্বত্র কৃষ্ণদৰ্শন, সর্বত্র ভগবদর্শন এ প্রেমের কি অন্ত আছে ? শ্রীকৃষ্ণ বাক্যে ও কাজে সেই পরম প্রেমেরই শিক্ষাদান করে গেছেন। ব্ৰজগোপীদের বস্ত্রহরণ-সেও এই প্রেম শিক্ষারই নিদর্শন। যখন ভগবদ্ভক্তি পূর্ণতা লাভ করবে, তখন সকল ভেদ ভাব দূরীভূত হবে। যার ভেদ ভাব দূরীভূত হয়েছে, যে জলে স্থলে সর্বত্র ভগবানকে দেখতে পাচ্ছে, তার আবার লজ্জা কি ? কতটা আত্মজ্ঞান জন্মিলে কতদূর ত্যাগ স্বীকার শিক্ষা করলে মানুষ মোক্ষের পথে অগ্রসর হতে পারে, বস্ত্রহরণ-ব্যাপারে শ্রীকৃষ্ণ সেটাই শিক্ষা দিলেন। তিনি শিক্ষা দিলেন- যদি ভক্ত হতে চাও, ভক্তির মাহাত্ম্য বুঝে থাক, তাহলে তার চরম পন্থা ‘আত্ম-নিবেদন’ অবলম্বন কর। উহাই ভক্তির পরিণতি। সে অবস্থায় অদেয় আর কিছুই নেই, নিজের বলতে আর কিছুই নেই, রমণীর যে শ্রেষ্ঠ সম্পদ লজ্জা, সেখানে সে লজ্জার মূলে পর্যন্ত কুঠারাঘাত করতে হবে। এই হল চরম শিক্ষা। যার এই ভাব-এই ত্যাগের ভাব এসেছে, প্রেম যে কি পরম বস্তু, সেই তাকে জেনেছে; সেই বিশ্ব প্রেমে প্রাণ-মন সমর্পণ করে প্রেমিক হতে পেরেছে।

(১) শ্রীমদ্ভাগবত ১০ম স্কন্ধ, ৩৩শ অধ্যায়ে, ৩য় শ্লোকে এই বর্ণনা দ্রষ্টব্য। ব্রহ্মবৈবর্ত্ত পুরাণে, শ্রীকৃষ্ণ জন্ম খণ্ড, ২৮শ অধ্যায়ে এ বিষয় লক্ষ্য করুন।

প্রেম’ই সমদর্শন-

এই প্রেমের মাহাত্ম্য শ্রী কৃষ্ণ যেমন বুঝিয়েছেন, তেমন আর দ্বিতীয় দেখি না। ত্যাগী না হলে প্রেমিক হতে পারে না, জীবনের প্রতি কাজে, কর্তব্য সাধনের প্রতি উপদেশে, সেই ত্যাগ তত্ত্বই তিনি প্রকাশ করে গেছেন। যেমন ব্ৰজগোপী গণকে দেখিয়েছেন- কত ত্যাগের ফলে প্রেমিক হওয়া যায়; তেমনই ত্যাগের আদর্শ-রূপে আপনাকে প্রতিফলিত করে বিশ্ববাসীকে বিশ্ব প্রেমের মুখ্য মন্ত্র শিখিয়ে গেছেন। শ্রীকৃষ্ণের জীবনে ত্যাগের দৃষ্টান্তের অবধি নেই। কতবার কত অবসর এসেছিল, তিনি কত বিশাল রাজ্য সাম্রাজ্যের অধীশ্বর হতে পারতেন; কিন্তু ত্যাগী পুরুষ, ত্যাগ- শিক্ষাদান রূপ মহামন্ত্রের উপদেষ্টা মহাপুরুষ, তার প্রতি ভ্রূক্ষেপ করেন নি। ত্যাগের আদর্শ অনুসরণ করে কেমনভাবে সংসার বিশ্বপ্রেমে মাতোয়ারা হতে পারবে, এটাই তার ধ্রুব লক্ষ্য ছিল। প্রকৃত প্রেমিক কোন জন ? বিশ্ব প্রেমে যাঁর প্রাণ মাতোয়ারা হয়েছে, তিনি ভিন্ন প্রেমিক আর কোন জন ? সর্বজীবে সমদর্শন কর। সর্বত্র ভগবদধিষ্ঠান দেখ; এটাই হল- প্রেমিকের লক্ষণ; এটাই হল আত্ম-সমর্পণ; এটাই হল মোক্ষমুক্তি নির্বাণ কৈবল্য পন্থা অনুসরণ। শ্রীকৃষ্ণ তাই পুনঃ পুনঃ’ই বলেছেন, সেই পরাগতি প্রাপ্ত হয়, যে জন সর্বভূতে পরমেশ্বরের বিদ্যমানতা উপলব্ধি করতে পারে। শ্ৰীমদ্ভগবদগীতায় ১৩ অধ্যায়ে, যথা,-

“সমং সর্ব্বেষু ভূতেষু তিষ্ঠন্তং পরমেশ্বরম্। বিনশ্যৎস্ববিনশ্যন্তং যঃ পশ্যতি স পশ্যতি॥
সমং পশ্যন্ হি সর্ব্বত্র সমবস্থিতমীশ্বরম্। ন হিনস্ত্যাত্মনাত্মানং ততো যাতি পরাং গতিম্॥”

সর্বজীবে সমদর্শন, সর্বত্র ঈশ্বর অনুভূতি, এটাই প্রকৃত প্রেম, এটাই পরম প্রেমিকের লক্ষণ। শ্রীকৃষ্ণ পুনঃ পুনঃই এই উপদেশ প্রদান করে গেছেন। তিনি যখন বলেছেন, “আমি অনলে আছি, অনিলে আছি, সলিলে আছি”, তখন তাঁর সর্বত্র বিদ্যমানতা উপলব্ধি হয়। তারপর তিনি আরও যখন বলেছেন, ‘অগ্নিতে, গুরুতে, আত্মাতে, সকল প্রাণীতে আমার উপাসনা করবে’, তখনই মনে হয় না কি- তিনি কি বিশ্ব-প্রেমের কি মহান শিক্ষাই প্রদান করছেন! সর্বভূতে সমদর্শন-বিশ্বপ্রেমে প্রাণ-সমর্পণ-এর অপেক্ষা প্রেমিকের আদর্শ আর কি হতে পারে ?

কৃষ্ণ প্রেমে পরম প্রেমিক-
শ্রীকৃষ্ণের প্রেম তত্ত্ব বুঝতে হলে, শ্রীরাধাকে বুঝা আবশ্যক হয়; নইলে, শ্রীকৃষ্ণের প্রেম-প্রসঙ্গ অসম্পূর্ণ রয়ে যায়। ভক্তির যে চরম পরিণতি প্রেম, ব্রজাঙ্গনায় আর শ্রীমতী শ্রীরাধিকায় তাই পরিস্ফুট দেখি। প্রেমে ভেদাভেদ ভাব দূর হয়; প্রেমে আত্মা পরমাত্মায় মিশে যায়। সাধন কতদূর উচ্চতা প্রাপ্ত হলে সে ভেদভাব দূর হয়, ভক্ত ও ভগবান এক হয়ে যান, বুদ্বুদ প্রশান্তভাবে বারিধি অঙ্গে অঙ্গ মিশিয়ে দেয়, রাধা-কৃষ্ণের প্রেমে সেই তত্ত্বই বিশদীকৃত। কল্পনা কুশল কবিদের কলুষ-তুলিতে রাধাকৃষ্ণের প্রেম এক বীভৎস মূর্তি ধারণ করে আছে। কিন্তু যাঁরা সে প্রেম-তত্ত্ব অন্তরে অন্তরে অনুভব করতে পেরেছেন, তারাই বুঝেছেন- সে প্রেম কি অনুপম অপার্থিব সামগ্রী! যেখানে রাধা কৃষ্ণের প্রেম পরিবর্ণিত আছে, সেখানে শ্রীকৃষ্ণই বা কে- আর শ্রীরাধাই বা কে? শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, ‘আমি সেই আমি – যে আমি সকলের অন্তরাত্মা সর্বকর্মে নির্লিপ্ত সর্বজীবে অবস্থিত হয়েও সর্বত্র অদৃশ্যভাবে বিরাজ করছি। বায়ু-দেব যে প্রকার সর্বত্র সর্ব জন্তুতে বিচরণ করে ও লিপ্ত নন, সেইরূপ আমি নির্লিপ্ত অথচ সর্ব-কর্মের সাক্ষী নিরন্তর কর্মের অনুষ্ঠান ও শুভাশুভ কর্মের ফল ভোগ করে থাকে। যে প্রকার জলপূর্ণ ঘটে চন্দ্র, সূর্য মণ্ডল প্রতিবিম্ব রূপে বিরাজ করে, আবার সেই ঘট ভেঙ্গে গেলে সেই প্রতিবিম্ব চন্দ্র সূর্যে সংশ্লিষ্ট হয়, সেই রকম দেহীর বিনষ্ট হলে আমার প্রতিবিম্ব জীব ও আমাতে বিলীন হয়ে থাকে। আমি সমুদায় প্রাণিদের জীবরূপে দৃষ্ট ও আত্মরূপে অদৃষ্ট হয়ে আছি। আমি সর্বত্র সর্বদা সর্ব দ্রব্যে অধিষ্ঠিত আাছি; আমি শরীর ধারণ করলে সগুণ হই, নতুবা নিরাকার নির্গুণ” বুঝে দেখুন- স্বরূপ তত্ত্ব! আরও বুঝে দেখুন- শ্ৰীমতী কার প্রেমে আত্ম বিসর্জিতা! সাঙ্খ্যে যে পুরুষ, উপমার অলঙ্কারে রূপকের অভ্যন্তরে; এখানে তিনিই প্রকাশমান নন কি ? তার পর তাদের সে মিলনই বা কেমন ? শ্ৰীকৃষ্ণ বলছেন- “তুমি আমি একই পদার্থ! যেমন দুগ্ধ ও দুগ্ধধাবল্যের কখনই পার্থক্য হয় না, সেই রকম আমাদের ও নিশ্চয়ই ভেদ নেই। বিশ্বের সমুদায় যোষিদগণই তোমার কলাংশের অংশ-কলায় সমুৎপন্ন; সুতরাং যে রমণী, সেই তুমি; যে পুরুষ, আর সেই আমি; আমি অংশ বিশেষে বহ্নিরূপী হলে তুমি ও স্বীয় অংশে স্বাহা নামে দাহিকা শক্তি রূপিণী আমার প্রিয়া হয়েছ। আমি তোমার সাথে একত্রিত থাকলে সমুদায় বস্তু দগ্ধ করতে সমর্থ। আর তোমার বিচ্ছেদে তাতে সম্পূর্ণ অক্ষম। আমি কলা দ্বারা দীপ্তিমান দিনের মধ্যে সূৰ্য্যরূপে প্রকাশ পেলে তুমি ও প্রভারূপে আমার সাথে মিলিত হয়েছ। তোমার মিলন ব্যতীত আমি দীপ্তিমান হতে পারি না।” নির্বাণে মোক্ষে যে মিলন, এ মিলন সেই মিলন। ব্রহ্মবৈবর্ত্তপুরাণে এবং হরিবংশে শ্রীরাধার যে পরিচয় পাই, তার সারতত্ত্ব নিষ্কাষণ করলে তিনিই সাক্ষাৎ প্রকৃতি রূপিণী বলে বুঝতে পারি। যিনি রাধা, তিনি সাযুজ্য প্রাপ্তা। যিনি রাধা, তাঁর প্রেম পূর্ণতা প্রাপ্ত; সুতরাং শ্রীকৃষ্ণ প্রেমে শ্রীরাধা, আর শ্রীরাধার প্রেমে শ্রীকৃষ্ণ, ভক্তে ও ভগবানে অভিন্ন ভাব। শ্রীমদ্ভাগবতে (৯ম স্কঃ ৪র্থ অঃ ৩৪শ ও ৩৯শ শ্লোঃ) ভগবান তাই বলেছেন,-

অহং ভক্তপরাধীনো হ্যস্বতন্ত্ৰ ইব দ্বিজ, সাধুভিগ্ৰস্তহাদয়ো ভক্তৈৰ্ভক্তজনপ্রিয়ঃ॥
সাধ‌বো হৃদয়ং মহ্যং সাধূনাং হৃদয়ং ত্বহম্। মদন্যৎ তে ন জান‌ন্তি নাহং তে‌ভ্যো মনাগ‌পি॥

অর্থাৎ, ভক্তের সাথে আমার স্বাতন্ত্র্য নেই, আমি ভক্তের অধীন, সাধু ভক্তগণ আমার হৃদয় অধিকার করে আছেন। সাধু ভক্তগণই আমার হৃদয়, আমিই ভক্তদের হৃদয়। তারাও যেমন আমা ভিন্ন অন্য জানে না, আমিও তেমনই তাদের ভিন্ন অন্য জানি না।

ভক্ত ও ভগবান যেখানে এমনই এক-এমনই অভিন্ন, সেখানেই তো প্রেমের ও প্রেমিকের সার্থকতা। কৃষ্ণ প্রেমে রাধা-প্রেমে-পরম প্রেমের পূর্ণ স্ফুর্তি- আরাধ্য ও আরাধ্যে, ভক্তে ও ভগবানে অপূর্ব মিলন। এই প্রেমের পরম গুরু-শ্রীকৃষ্ণ। তাই শ্রীকৃষ্ণ পরম প্রেমিক।

পরম বৈষ্ণবের প্রেমতত্ত্ব-
পরম ভাগবত বৈষ্ণব গণ রাধা কৃষ্ণের প্রেম কেমন ভাবে উপলব্ধি করে গেছেন, তার একটু পরিচয় এখানে তুলে ধরা একান্ত আবশ্যক বলে মনে করি প্রমের স্বরূপ তত্ত্ব তাঁরা কেমন নির্ণয় করেছেন, রাধাকৃষ্ণের প্রেম যে কত উচ্চ স্তরের সামগ্ৰী, তাঁরা কেমন বুঝিয়ে গেছেন, তাঁদের পদাবলী থেকে তার আস্বাদ গ্রহণ করুন। প্রেম কি, কিভাবে তা উৎপন্ন হয়, শ্রীচৈতন্যদেব ভক্ত শ্রীরূপকে তা বুঝাচ্ছেন, শ্রীচৈতন্য চরিতামৃতে যথা-

শুদ্ধভক্তি হৈতে হয় প্রেমের উৎপন্ন।
অতএব শুদ্ধ ভক্তির কহিয়ে লক্ষণ
অন্য বাঞ্ছা অন্য পূজা ছাড়ি জ্ঞান কর্ম।
আনুকূল্যে সর্ব্বেন্দ্রিয়ে কৃষ্ণানুশীলন।
এই শুদ্ধ ভক্তি ইহা হৈতে প্রেম হয়।
পঞ্চরাত্রে ভাগবতে এই লক্ষণ কয়॥
তথাহি ভক্তিরসামৃত সিন্ধৌ-
সর্ব্বোপাধিবিনির্মুক্তং তৎপরত্বেন নির্ম্মলং।
হৃষীকেশ হৃষীকেশ সেবনং ভক্তিরুচ্যতে॥
(নারদপঞ্চরাত্র)
লক্ষণং ভক্তিযোগস্য নির্গুণস্য হ্যুদাহৃতং।
অহৈতুক্যব্যবহিতা যা ভক্তিঃ পুরুষোত্তমে॥
সালোক্য-সার্ষ্টি-সামীপ্য-সারূপ্যৈকত্বমপ্যুত।
দীয়মানং ন গৃহ্ণন্তি বিনা মৎসেবনং জনাঃ॥
স এব ভক্তিযোগগাখ্য আত্যন্তিক উদাহৃতঃ।
যেনাতিব্রজ্য ত্রিগুণান্মদ্ভাবায়োপপদ্যতে॥
ভুক্তি-মুক্তি আদি বাঞ্ছা যদি মনে হয়।
সাধন করিলেও প্রেম উৎপন্ন না হয়॥
তথাহি ভক্তিরসামৃতসিন্ধৌ-
ভুক্তি মুক্তি স্পৃহা যাবৎ পিশাচী হৃদি বর্ত্ততে।
তাবদ্‌ভক্তি সুখস্যাত্র কথমভ্যুদয়ো ভবেৎ॥
সাধন ভক্তি হৈতে হয় রতির উদয়।
রতি গাঢ় হৈলে তার ‘প্রেম’ নাম কয়॥

প্রেম কি পরম পদার্থ, উপরে উদ্ধৃত বর্ণনায় তা কতকটা অনুভব করা যায়। প্রেমিক যিনি, তাঁর প্রার্থনা কিছুই নেই। সাগরে যেমন গঙ্গার জল গিয়ে মিশে যায়, সে যেমন নিজের কোনও আকাঙ্ক্ষা কোনও কামনাই রাখে না, প্রেমিকের সেই লক্ষণ। প্রেমিকের নিষ্কাম সাত্ত্বিক ভক্তি, সালোক্য (সমান লোকে বাস) চায় না, সার্ষ্টি (সমান ঐশ্বর্য্য) চায় না, সামীপ্য (নিকটবর্ত্তিত্ব) চায় না, সারূপ্য (সমান রূপতা) চায় না, সাযুজ্য বা একত্ব তা ও চায় না, এমন কি, প্রেমিক ভক্তকে ভগবান যদি সালোক্য আদি মুক্তি প্রদান করতেও চান, তিনি তা গ্রহণ করেন না। কত স্তরে সেই প্রেমের স্ফুর্ত্তি হয়, শ্রীচৈতন্যদেব দৃষ্টান্ত দিয়ে তা শ্রীরূপকে এভাবে বুঝিয়ে বলছেন, যথা-

প্রেম বৃদ্ধি ক্রমে নাম-স্নেহ, মান, প্রণয়।
রাগ, অনুরাগ, ভাব, মহাভাব হয়
যৈছে বীজ ইক্ষু, রস, গুড়, খণ্ড, সার।
শর্করা, সিতা, মিশ্রি, উত্তমমিশ্রি অার।
এই সব কৃষ্ণভক্তিরসের স্থায়িভাব।
স্থায়িভাবে মিলে যদি বিভাব অনুভব।
স্বাত্ত্বিক-ব্যভিচারি-ভাবের মিলনে।
কৃষ্ণভক্তিরস হয় অমৃত-আস্বাদনে॥
যৈছে যদি সিতা ঘৃত মরীচ কর্পূর।
মিলনে ‘রসালা’ হয় অমৃত মধুর।
ভক্তভেদে রতিভেদ – পঞ্চ পরকার।
শান্তরতি, দাস্য রতি, সখ্যরতি আর।
বাৎসল্যরতি, মধুররতি—এ পঞ্চ বিভেদ।
রতিভেদে কৃষ্ণভক্তিরস পঞ্চভেদ॥
শান্ত-দাস্য সখ্য-বাৎসল্য মধুর রস নাম।
কৃষ্ণভক্তিরস মধ্যে এ পঞ্চ প্রধান॥
হাস্যাদ্ভুত বীর করুণ রৌদ্র বীভৎস ভয়।
পঞ্চবিধ-ভক্তে গৌণ সপ্ত রস হয়॥
পঞ্চ রস স্থায়ী ব্যাপী রহে ভক্তমনে।
সপ্ত গৌণ আগন্তুক পাইয়ে কারণে॥
শান্তভক্ত-নব যোগেন্দ্র, সনকাদি আর।
দাস্য ভাবভক্ত -সৰ্ব্বত্র সেবক অপার।
সখ্যভক্ত-শ্ৰীদামাদি, পুরে ভীমাৰ্জ্জুন।
বাৎসল্যভক্ত- মাতা, পিতা, যত গুরুজন॥
মধুররসভক্ত মুখ্য-ব্রজে গোপীগণ।
মহিষীগণ, লক্ষ্মীগণ,-অসঙ্খ্য গণন॥
পুনঃ কৃষ্ণরতি হয় দুই ত প্রকার।
ঐশ্বৰ্য্য-জ্ঞানমিশ্রী, কেবলা ভেদ আর॥
গোকুলে কেবলা-রতি ঐশ্বৰ্য্যজ্ঞানহীন।
পুরীদ্বয়ে বৈকুণ্ঠাদ্যে ঐশ্বৰ্য্য প্রবীণ॥
ঐশ্বৰ্য্যজ্ঞান-প্রাধান্যে সঙ্কোচিত প্রীতি।
দেখিলে না মানে ঐশ্বৰ্য্য-কেবলার রীতি॥
শান্তদাস্যরসে ঐশ্বর্য্য কঁহি উদ্দীপন।
বাৎসল্য-সখ্য-মধুরে ত করে সঙ্কোচন॥
বসুদেব-দেবকীর কৃষ্ণ চরণ বন্দিল।
ঐশ্বর্য্যজ্ঞানে দোহার মনে ভয় হৈল॥
তথাহি ভাগবতে,-
দেবকী বসুদেবশ্চ বিজ্ঞায় জগদীশ্বরৌ।
কৃতসংবন্দনৌ পুত্রৌ সস্বজাতে ন শঙ্কিতৌ॥
কৃষ্ণের বিশ্বরূপ দেখি অৰ্জুনের হইল ভয়।
সখ্যভাবে ধার্ষ্ট্য ক্ষমায় করিয়া বিনয়।
কৃষ্ণ যদি রুক্মিণীকে কৈল পরিহাস।
‘কৃষ্ণ ছাড়িবেন’ জানি রুক্মিণীর হৈল ত্ৰাস॥
কেবলার শুদ্ধ প্রেম-ঐশ্বৰ্য্য না জানে।
ঐশ্বৰ্য্য দেখিলে নিজ সম্বন্ধ সে মানে॥

শ্রীচৈতন্যদেবের এই সকল উক্তি প্রাণে প্রাণে যিনি অনুভব করতে পারেন, তিনিই বুঝতে সমর্থ হল,- ব্ৰজগোপীদের প্রেম শ্রীরাধার প্রেম কি অপার্থিব স্বৰ্গীয় সামগ্ৰী! মধুররসে যে সকল রসের সার সন্মিলন, শান্ত-দাস্য আদি রস পর পর পুষ্ট হয়ে যে পরমরস মাধুৰ্য্যে পরিণত হয়, এ উপমার মধ্যে এক নিগূঢ় সত্যের আভাষ দেখতে পাই। সেই নিত্য-পদার্থ তন্মাত্র-সংযোগে যে বিশ্বসৃষ্টির বিষয় অবগত হই, এখানেও তাঁরই অধ্যাস নয় কি ? সাংখ্যের যে পুরুষ-নির্গুণ নির্লিপ্ত নিরুপাধিক; সাংখ্যের যে প্রকৃতি- নির্গুণা নির্লিপ্তা নিরুপাধিকা; শ্রীকৃষ্ণ ও শ্রীরাধা- সেই পুরুষ ও প্রকৃতি রূপে পরিকীর্তিত। সেখানে সাংখ্যমতে পঞ্চতন্মাত্ৰক যে সৃষ্টি-ক্রিয়া, সেখানে আকাশ আদি পঞ্চমহাভূতের সৃষ্টি-মূলে যে পঞ্চতন্মাত্রের স্ফূর্তি-লীলা; এখানেও শান্ত-দাস্য আদির পরিস্ফুরণে কেমন ভাবে মাধুৰ্য্য রসের (প্রেমের) উৎপত্তি হয়, তাহাই বুঝান হয়েছে। সাংখ্যের পঞ্চতন্মাত্রের সাথে আকাশ আদি ভূত গণের সম্বন্ধ এবং ভগবানে একনিষ্ঠ (স্বরূপ জ্ঞান আদি) মূল-তত্ত্বের সাথে শান্ত দাস্য আদি রস পঞ্চকের সম্বন্ধ -উপমা-বিশ্লেষণে এইরূপ উপলব্ধি হতে পারে। যথা,

পঞ্চভূত উৎপত্তি মূলরসপঞ্চকউৎপত্তি মূল
আকাশশব্দতন্মাত্রশান্তএকনিষ্ঠা(তৃষ্ণাত্যাগ)
বায়ুশব্দ ও স্পর্শ তন্মাত্রদাস্যনিষ্ঠা ও সেবা
তেজশব্দ, স্পর্শ, রূপ তন্মাত্রসখ্যনিষ্ঠা, সেবা ও বিশ্বাস
জল শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস তন্মাত্রবাৎসল্য নিষ্ঠা, সেবা, বিশ্বাস, পালন
ক্ষিতিশব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস, গন্ধ তন্মাত্রমধুরনিষ্ঠাসেবা, বিশ্বাস পালন, আত্মসমর্পণ
ভগবানে একনিষ্ঠ (স্বরূপ জ্ঞান আদি) মূল-তত্ত্বের সাথে শান্ত দাস্য আদি রস পঞ্চকের সম্বন্ধ


যেমন আকাশ আদি পঞ্চভূতে পূর্ব পূর্ব তন্মাত্রের ও যোগ আছে, অধিকন্তু নুতন তন্মাত্রের আধিক্য ঘটেছে, এখানেও সেইরকম মধুর রসে অপর রস-চতুষ্টয়ের সমাবেশের সঙ্গে সঙ্গে নুতন তত্তত্বের আধিক্য ঘটেছে। ক্রমান্বয়ে এই গুণ-সমৃদ্ধির পরিচয় শ্ৰীচৈতন্যদেবের উক্তিতে পাওয়া যাচ্ছে। স্বরূপ সম্বোধনে (শ্রীচৈতন্যচরিতামৃতে) শ্রীচৈতন্যের উক্তি, যথা,-

কৃষ্ণবিনা তৃষ্ণা ত্যাগ তার কার্য্য মানি।
অতএব শান্ত কৃষ্ণ ভক্ত এক জানি॥
স্বৰ্গ মোক্ষ কৃষ্ণভক্ত নরক করি মানে।
কৃষ্ণনিষ্ঠা তৃষ্ণা ত্যাগে শান্তের দুই গুণে॥
এই দুই গুণে ব্যাপে সব ভক্তগণে।
আকাশের শব্দ গুণ যেন ভূতগণে॥
কেবল স্বরূপ জ্ঞান হয় শান্তরসে।
পুণেশ্বৰ্য্য প্রভুজ্ঞান অধিক হয় দাস্যে॥
ঈশ্বরজ্ঞান সম্ভ্রম, গৌরব প্রচুর।
সেবা করি কৃষ্ণে মুখ দেন নিরস্তর॥
শান্তের গুণ দাস্যে আছে, অধিক সেবন।
অতএব দাস্য রসের হয় দুই গুণ॥
শান্তের গুণ দাস্যের সেবন সখ্যে দুই হয়।
দাস্যে সম্ভ্রম গৌরব সেবা সখ্যে বিশ্বাসময়॥
কান্ধে চঢ়ে কান্ধে চড়ায় করে ক্রীড়া-রণ।
কৃষ্ণ সেবে কৃষ্ণে করায় আপন সেবন॥
বিশ্রম্ভ প্রধান সখ্য-গৌরব-সম্ভ্রমহীন।
অতএব সখ্যরসের তিন গুণ চিন॥
মমতা অধিক কৃষ্ণে-আত্মসম জ্ঞান।
অতএব সখ্য রসে বশ ভগবান॥
বাৎসল্যে-শান্তের গুণ দাস্যের সেবন।
সেই সেই সেবনের ইহা নাম পালন।
সখ্যের গুণ-অসঙ্কোচ আগৌরব সার।
মমতা-আধিক্যে তাড়ন ভর্ৎসন-ব্যবহার॥
আপনাকে পালক জ্ঞান, কৃষ্ণে পাল্য জ্ঞান।
চারি রসের গুণে বাৎসল্য অমৃত সমান॥
সে অমৃতানন্দে ভক্তসহ ডুবেন আপনে।
কৃষ্ণ ভক্তবশ গুণ কহে ঐশ্বৰ্য্যজ্ঞানিগণে।
তথাহি পদ্ম পুরাণে-
ইতিদৃক্‌ স্বলীলাভিরানন্দকুণ্ডে, স্বঘোষং নিমজ্জন্তমাখ্যাপন্তম্।
তদীয়েশিতজ্ঞেষু ভক্তৈর্জিতত্ত্বং, পুনঃ প্রেমতস্তং শতাবৃত্তি বন্দে॥
মধুর রসে-কৃষ্ণ-নিষ্ঠা সেবা অতিশয়।
সথ্যের অসঙ্কোচ লালন মমতাধিক হয়॥
কান্তভাবে নিজাঙ্গ দিয়া করেন সেবন।
অতএব মধুর রসে হয় পঞ্চ গুণ॥
আকাশাদির গুণ যেন পর পর ভূতে।
এক দুই তিন ক্রমে পঞ্চ পৃথিবীতে॥
এইমত মধুরে সবভাব-সমাহার।
অতএব স্বাদাবিকো করে চমৎকার।
এই ভক্তি রসের কৈল দিগ দরশন।
ইহার বিস্তার মনে করিত ভাবন॥
ভাবিতে ভাবিতে কৃষ্ণ স্ফুরয়ে অস্তরে।
কৃষ্ণ কৃপায় অজ্ঞ পায় রসসিন্ধু পারে॥
যারা জ্ঞানী, যারা সদ-বুদ্ধি সম্পন্ন তারা কৃষ্ণ প্রেমের মাহাত্ম্য যথার্থ উপলব্ধি করেছেন; আর যারা কলুষ-চিত্ত, তারাই সেই নির্মল অনাবিল প্রেমে কামগন্ধ দেখতে পায়। নইলে,-
“গোপীগণের প্রেমে রূঢ় ভাব নাম।
শুদ্ধ নিৰ্ম্মল প্রেম কভু নহে কাম॥
কামগন্ধহীন স্বাভাবিক গোপী প্রেম।
নির্ম্মল উজ্জল শুদ্ধ যেন দগ্ধ হেম॥
কৃষ্ণের সহায় গুরু বান্ধব প্রেয়সী।
গোপীকা হয়েন প্রিয়া শিষ্যা সখী দাসী॥
গোপীকা জানেন কৃষ্ণ মনের বাঞ্ছিত।
প্রেমসেবা পরিপাটি ইষ্টসমীচিত॥
সেই গোপীগণ মধ্যে উত্তম রাধিকা।
রূপে গুণে সৌভাগ্যে প্রেমে সর্ব্বাধিকা॥”
তারপর, কামে ও প্রেমে কি পার্থক্য, তাও বুঝে দেখুন। শ্রীচৈতন্যচরিতামৃতে শাস্ত্র লক্ষণ অনুসারে শ্রীকৃষ্ণ দাস গোস্বামী কামের ও প্রেমের পার্থক্য বিচার করে বলছেন,-
কাম প্রেম দোহাকার বিভিন্ন লক্ষণ।
লৌহ আর হেম জৈছে স্বরূপে বিলক্ষণ॥
আত্মেন্দ্রিয় প্রীতি ইচ্ছা-তারে বলি ‘কাম’।
কৃষ্ণেন্দ্রিয়-প্রীতি ইচ্ছা-ধরে ‘প্রেম’ নাম॥
নামের তাৎপৰ্য্য-নিজ সম্ভোগ কেবল।
কৃষ্ণ সুখতাৎপর্য্য-হয় প্রেম ত কেবল॥
লোকধর্ম্ম বেদধর্ম্ম দেহধর্ম্ম কর্ম্ম।
লজ্জা ধৈর্য্য দেহ সুখ আত্মসুখ মর্ম্ম॥
সর্ব্বত্যাগ করি করে কৃষ্ণের ভজন।
কৃষ্ণ সুখ হেতু করে প্রেমের সেবন॥
ইহাকে কহিয়ে কৃষ্ণে দৃঢ় অনুরাগ।
স্বচ্ছ ধৌত বস্ত্রে যেন নাহি কোন দাগ॥
অতএব কাম-প্রেম বহুত অন্তর।
কাম অন্ধতম, প্রেম নিৰ্ম্মল ভাস্কর॥
অতএব গোপীগণে নাহি কাম গন্ধ।
কৃষ্ণ সুখ লাগি মাত্র কৃষ্ণে সে সম্বন্ধ॥
আর অধিক আলোচনার আবশ্যক দেখি না। যে প্রেমে আত্মায় আত্ম সম্মিলন, রাধাকৃষ্ণের প্রেম-সেই প্রেম। সে মিলন সে প্রেম মহাযোগীর যোগসাধন। সে প্রেমে আরাধ্য-আরাধিকা এক হয়ে গেছে। নদীর জলে আর সাগরের জলে এক হয়ে আছে।

১) শ্রীকৃষ্ণ-ভারতের ইতিহাসে প্রাণ স্থানীয়;


(১) শ্রীকৃষ্ণ-ভারতের ইতিহাসে প্রাণ স্থানীয়; কেন-না, বিপ্লবের বিষম আবর্তে পতিত ভারত তরণী কে তিনিই রক্ষা করেছিলেন।
[শ্রীকৃষ্ণ-বিপ্লব হিন্দু-সমাজের রক্ষাকর্তা, -লোপপ্রাপ্ত প্রাচীন জাতি সমূহের সাথে হিন্দু-জাতির তুলনায়;- শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাব-কালে ভারতের রাজনৈতিক, সামাজনৈতিক ও ধর্মনৈতিক অবস্থার চিত্র,-কংস, জরাসন্ধ, দুর্যোধন প্রভৃতির প্রসঙ্গে এবং তৎকালীন সমাজের ব্যভিচার আদির বিষয় উল্লেখ্য]

শ্রীকৃষ্ণ-ভারতের ইতিহাসে প্রাণ স্থানীয়-

পৃথিবীর উপর দিয়ে বিবর্তনের কি প্রবল প্রবাহই চলেছে! কতই ভাঙ্গছে-কতই গড়ছে। কত জাতির অভ্যুত্থান ও অধঃপতন ঘটল,- কত নব নব সাম্রাজ্য, কত নব নব ধর্ম-সম্প্রদায়, কত ভাবে কালের কোলে ক্রীড়া করে গেল! কিন্তু সেই বিশ্ব-বিপ্লবকারী বিবর্তন-প্রবাহের মধ্যেও ভারতবর্ষ নিজের স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করতে সমর্থ হল। সে দেখল-তার চোখের উপর কত জাতি কত ভাবে ভেসে গেল! সে দেখল- কালের তাণ্ডব লীলা কত সম্প্রদায়কে কেমন ভেঙ্গে গড়ে নিলো! কিন্তু, কি আশ্চর্য, তার উপর বিবর্তনের সে প্রভাব কার্যকরী হল না! কি জানি, কোন্ মহীয়সী মহিমা সে বিপ্লবে তাকে রক্ষা করল! জল-বুদবুদের ন্যায় কত জাতি উঠল ও মিশে গেল; কিন্তু ভারতবর্ষের হিন্দু-জাতি অক্ষুণ্ণ রইল! কত সমাজ কত ধর্ম-সম্প্রদায় কত চাকচিক্যই দেখানোর প্রয়াস পেল, কিন্তু জলদ-কোলে ইন্দ্রধনুর ন্যায় তাদের অস্তিত্ব কোথায় লুকিয়ে গেল! অথচ, সূর্য্যসম প্রভাববান্‌ হয়ে রইল-ভারতবর্ষের সনাতন ধর্ম, আর সেই সনাতন ধর্মের অনুসারী এই হিন্দু-জাতি। যখন দেখতে পাই বিবর্তনই বিশ্বজনীন নিয়ম; তখন সেই নিয়মের ব্যতিক্রমকারী এ অভাবনীয় অচিন্ত্য-পূর্ব ঘটনার কারণ কি? এক কারণ-ভগবান শ্রীকৃষ্ণ। শুভক্ষণে ভারতভূমিতে কৃষ্ণচদ্রের আবির্ভাব হয়েছিল; – তাই সেই বিবর্তনের বিষম সঙ্কটের দিনেও হিন্দুজাতি রক্ষা পেয়ে গেল! শ্রীকৃষ্ণ যদি ভারতবর্ষে আবির্ভূত না হতেন তাহলে বোধ হয়, ‘ভারতবর্ষ’ নাম পর্যন্ত লোপ পেত; তাহলে বোধ হয়, ‘হিন্দুস্থান’ সংজ্ঞা ইতিহাসের অঙ্গ হতে মুছে যেত; তাহলে বোধ হয় পৃথিবীর অন্যান্য লোপ-প্রাপ্ত প্রাচীন জাতি-সমূহের নামের সঙ্গে, ‘হিন্দুর’ নামটি মাত্র ক্বচিৎ গ্রথিত থাকত! কোথায় সে প্রাচীন মিশর-কাল প্রভাবে ভাসতে ভাসতে গিয়ে কার অঙ্গে অঙ্গ মিশিয়ে দিল! সে জাতির কীর্তি-স্তম্ভ পিরামিড-স্তূপ!- তুমি কি সাক্ষাৎ দিতে পার- তোমার সেই লোক প্রসিদ্ধ নির্মাতারা এখন কি ভাবে কোথায় অবস্থান করছেন! প্রাচীন রোম! -প্রাচীন গ্রীস! -তোমরা তো জগতের বুকে সে দিন মাত্র ক্রিয়াশীল ছিলে! -টমরাই বা এখন কোথায় কি ভাবে অবস্থান করছে? কাল-প্রবাহে বিচরণশীল অ্যাসিরিয়া, বাবিলন, ফিনিসীয়া-বুদ্‌বুদের প্রায় কোথায় মিশে গেল? প্রাচীন কারও কোনও পরিচয়-চিহ্ন-ক্রম-পর্যায়-কোথাও অনুসন্ধান করে মিলবে না। কিন্তু সে পরিচয় অক্ষুণ্ণ আছে-ভারতবর্ষে। ভারতবর্ষ আজও তারস্বরে ঘোষণা করতে সমর্থ-তার পিতৃ-পরিচয়ের এখনও ক্রমভঙ্গ হয়নি। সেই হিন্দু, আজও নিজেকে হিন্দু বলে পরিচয় দিতে স্পর্ধা অনুভব করতে পারেন; সেই ব্রাহ্মণ-আজও নিজেকে বরেণ্য আসনে অধিষ্ঠিত রাখতে সমর্থ আছেন। এ ক্রম-পর্যায় রক্ষার মূলাধার-ভগবান শ্রীকৃষ্ণ। শ্রীকৃষ্ণ-ভারতের ইতিহাসে তাই প্রাণ স্বরূপ।
বিপ্লব-বিভীষিকার চিত্র।

শ্রীকৃষ্ণ-বিপ্লব হিন্দু-সমাজের রক্ষাকর্তা-

(লোপ পাওয়া প্রাচীন জাতি সমূহের সাথে হিন্দু-জাতির তুলনায়;- শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাব-কালে ভারতের রাজনৈতিক, সামাজনৈতিক ও ধর্মনৈতিক অবস্থার চিত্র,-কংস, জরাসন্ধ, দুর্যোধন প্রভৃতির প্রসঙ্গে এবং তৎকালীন সমাজের ব্যভিচারের বিষয় উল্লেখ্য।)

কি বিপ্লব-বিপদ থেকে শ্ৰীকৃষ্ণ ভারতবর্ষকে রক্ষা করেছিলেন? রাষ্ট্র-বিপ্লব, ধর্ম-বিপ্লব, সমাজ-বিপ্লব, নীতি-বিপ্লব-যত প্রকার বিপ্লব সম্ভবপর, ভারতবর্ষে সেই সকল বিপ্লব সঙ্ঘটিত হতে আরম্ভ হয়েছিল। তখন রাজন্যবর্গ কি দুর্বৃত্ত-দুশ্চরিত্র হয়ে উঠেছিল! যে জাতির মূল-মন্ত্র-“”পিতা স্বর্গ, পিতা ধর্ম, পিতাহি পরমং তপ,’; সে জাতির অধিপতি হয়ে, রাজচক্রবর্তী কংস নিজের পিতা উগ্রসেনকে কারাগারে বন্দী করে রাখতে প্রবৃত্ত হয়েছিল! রাজার রাজধর্ম-পালনে ব্যভিচার, এর অধিক আর কি হতে পারে? সৌভ্রাতৃত্ব যে জাতির শ্রেষ্ঠ শিক্ষা, সে জাতির নৃপতি দুর্যোধন বঞ্চনায় ভ্রাতাদের হৃতসর্বস্ব করতে উদ্বুদ্ধ হয়েছিল। তারপর, কি ভীষণ!-কি লোমহর্ষণ!-জরাসন্ধের অত্যাচার! জরাসন্ধ শঙ্কর-পূজার উছিলায় নরবলি প্রদান করতেন; আর তাঁর সেই অত্যাচারে কত গৃহস্থকে প্রাণভয়ে দেশান্তরে পালাতে হয়েছিল! (জরাসন্ধের নরবলির বিষয়-মহাভারত, সভা-পর্ব, বাইশ অধ্যায় প্রভৃতি দ্রষ্টব্য) সমাজের এ অধঃপতনের কি তুলনা আছে ? রাজার এইপ্রকার অত্যাচারের কি পার আছে ? কেবল কি প্রজার প্রতি এই অত্যাচার ? স্বসভ্য রাজনীতির নিয়ম অনুসারে অধীন করদাতা-মিত্র রাজন্যবর্গ প্রধান রাজার আশ্রয়-লাভে শান্তিসুখে সুখী থাকেন। কিন্তু জরাসন্ধের আধিপত্যের অন্তর্ভুক্ত হওয়ায়, তাঁদের কি দুর্দশাই উপস্থিত হয়েছিল! তারা জরাসন্ধের অত্যাচারে দিনরাত পরিত্রাহি ডাক ডাকছিলেন। ইতিহাসে প্রকাশ, পারিপার্শ্বিক এক শত ক্ষুদ্র রাজ্য, জরাসন্ধের বশ্যতা স্বীকারে বাধ্য হয়েছিল; কিন্তু জরাসন্ধ সুযোগক্রমে সেই সকল নৃপতিকে নরবলি প্রদান করবেন। অধিকন্তু, তখন ভারত এমন কেউই সামর্থ্যবান ছিলেন না যে, জরাসন্ধের! সে অত্যাচারের বাধা দিতে পারেন। রাজসূয়-যজ্ঞ সম্পাদনে মহামতি যুধিষ্ঠির যখন রাজচক্রবর্তী বলে পরিচিত হবেন স্থির হয়, তখন সে অত্যাচার-নিবারণে তাঁরও বিক্রম, বিভীষিকা দেখেছিল। জরাসন্ধের অত্যাচারের বিষয় জ্ঞাপন করে শ্রীকৃষ্ণ যখন বললেন,- ‘সেই এক শত অধীন নৃপতির মধ্যে ছিয়াশি সংখ্যক ভূপতি জরাসন্ধ কর্তৃক সম্মানিত হয়ে বলিদানের জন্য নিরূপিত রয়েছেন। কেবল চৌদ্দ-জন মাত্র অবশিষ্ট আছেন, তারা হস্তগত হলে, ঐ ঘোরতর ক্রূর কর্ম অচিরে সম্পাদিত হবে। অতএব ঐ ব্যাপারে যিনি বাঁধা প্রদান করতে সমর্থ হবেন, তিনিই প্রদীপ্ত যশোরাশি লাভ করতে পারবেন, এবং যিনি তাকে জয় করতে পারবেন, তিনি নিশ্চয়ই সাম্রাজ্য ভোগ করবেন।’ কিন্তু স্মরণ করে দেখুন, যুধিষ্ঠির তাতে কি উত্তর দেন! জরাসন্ধের ন্যায় পরাক্রমশালী নৃপতি বিদ্যমান থাকতে, তাঁর রাজসূয়-যজ্ঞ সম্পন্ন হওয়া এক রকম অসম্ভব বলেই তিনি ব্যক্ত করেন। অধিকন্তু শ্ৰীকৃষ্ণ যখন উৎসাহ-সহকারে জরাসন্ধ-বধের প্রস্তাব করেন, যুধিষ্ঠির হতাশ-ভাব-প্রকাশ করে বলেছিলেন,- ‘আমি মনে করি, ভীম-অর্জুন আমার নেত্র-যুগল, আর তুমি আমার মন। অতএব নয়ন-মন বিহীন হয়ে আমি কিভাবে জীবিত থাকব? ফলতঃ, অত্যাচারীর অত্যাচার দমনের সামর্থ্য ও তখন লোপ পেয়েছিল। রাজশক্তি বিচ্ছিন্ন হওয়ায়, যথেচ্ছাচারিতা যেন রাজ্য বিস্তার করে বসেছিল। যেমন জরাসন্ধ, তেমনই শিশুপাল। শিশুপাল চেদীদেশের অধিপতি ছিলেন। তিনি ভগদ্‌ বিদ্বেষী ঘোর অত্যাচারী হয়ে উঠেছিলেন। ভেদবুদ্ধি শিক্ষা দেওয়াই যেন তাঁর রীতি-নীতি হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ভগবদ্ভক্তি, ভগবৎ-প্রীতি মানুষ যাতে বিস্মৃত হয়ে যায়, চেদীপতি শিশুপালের কাজে ও বাক্যে সেই শিক্ষাই বিকাশমান। পৌণ্ড্র দেশের অধিপতি বাসুদেব কর্তৃক ভগবানের প্রতি বিদ্রূপ প্রকাশই বা কি শিক্ষা দিয়েছিল? মানুষ ভগবানের প্রতি বিদ্রূপ পরায়ণ হোক-এ কি নীচ শিক্ষা! এমন কত দিকে কত ভাবে উচ্ছৃঙ্খল রাজত্ব করে বেড়াচ্ছিল, তার ইয়ত্তা হয় না। তখন রাজশক্তি কি ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়েই পড়েছিল!

উত্তর-দক্ষিণ পূর্ব-পশ্চিম-ভারতের যে প্রান্তে দৃষ্টিপাত করবেন, সে দিকেই দেখতে পাবেন, রাজলক্ষ্মী কেঁদে কেঁদে আশ্রয় অনুসন্ধান করে বেড়াতে ছিলেন। উত্তরে দেখুন- কত রাজ্য কত জনপদ আপনাপন ক্ষুদ্র-শক্তির গরবে অধীর হয়ে যথেচ্ছাচার আরম্ভ করেছে, আর সেই সুযোগে কত বৈদেশিক আচারভ্রষ্ট জাতি ভারতের দ্বারে প্রবেশোন্মুখ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পূর্বে পশ্চিমে দক্ষিণে সকল দিকেই সমান বিশৃঙ্খলা-সমান বিভীষিকা! বর্তমান ইতিহাস বলে থাকে,- ‘অ্যালেকজান্ডারের ভারত আক্রমণই বিধর্মী বৈদেশিক জাতিদের ভারতের সাথে প্রথম সম্বন্ধ স্থাপন।’ (১) সার্ধ দুই হাজার বৎসর পূর্বের ইতিহাস হিসাবে সেই আক্রমণই প্রথম আক্রমণ বলে মনে করা যেতে পারে বটে, কিন্তু যে সময়ের প্রসঙ্গ উত্থাপন করেছি, তখনও একবার ভারতের সেই অবস্থার উপক্রম হয়েছিল। ভারত হতে বিতাড়িত আচার ভ্রষ্ট পারদ-পহ্নব-চীন-যবন আদি জাতিরা তখনও পূর্ব-অপমান পূর্ব-শত্রুতা বিস্মৃত হতে পারেনি। পরন্তু, তখনও তারা ভারতবর্ষকে গ্রাস করবার জন্য জিহ্বা-লেহন করছিল, আর ধীরে ধীরে আহারের অন্বেষণে অগ্রসর হচ্ছিল। যেমন রাষ্ট্র বিপ্লব, তেমনই সমাজ-বিপ্লব ও নীতি বিপ্লব সঙ্ঘটিত হয়েছিল। যারা আদর্শ-স্থানীয় হবেন, তাঁরাই তখন কি কলুষ-চরিত্রের পরিচয় দিতে প্রবৃত্ত হয়েছিলেন। যখন দেখতে পাই-যুধিষ্ঠিরের ন্যায় আদর্শ পুরুষ বিভ্রান্ত দ্যূতক্রীড়াসক্ত, আর তাতে রাজ্য-সাম্রাজ্য-এমন কি, সহধর্মিণীকে পর্যন্ত পণ করতে অকুণ্ঠিত-চিত্ত, তখন সমাজ যে কি অধঃপাতে যেতে বসেছিল, তা সহজেই উপলব্ধি হয় না কি? কলির আগমনের সূচনা, তাৎকালিক বহু নর-চরিত্রেই যেন প্রকাশ পেয়েছিল। নীতি কি বিকৃতি-প্রাপ্তই হয়েছিল। রাজদণ্ডধর রাজার সভায় রজঃস্বলা রমণীকে কেশাকর্ষণে নিয়ে গিয়ে বিবস্ত্র-করার চেষ্টা-এর অধিক নীতি বিগর্হিত কাজ আর কি হতে পারে? সমাজ-বন্ধন কি শিথিল হয়ে পড়েছিল! সম্ভ্রান্ত পরিবারের মধ্যে বর্ণসংকর সৃষ্টি, আর গান্ধর্ব্ব-রাক্ষস আদি বিবাহের প্রবর্তনা-সমাজের অধঃপতনের কি ভীষণ চিত্রপট নয়ন-পথে প্রতিফলিত করে! তখন সচ্চরিত্র সাধু-সজ্জন যে একেবারে অন্তর্হিত হয়েছিলেন, তা বলছি না, তবে কুচরিত্র কদাচারের প্রশ্রয় যে দিন-দিনই বৃদ্ধি পেয়েছিল, আর প্রসিদ্ধ প্রধান সংসার বিশেষের মধ্যে যে ব্যভিচার স্রোত প্রকাশ পেয়েছিল, তাতে কোন সংশয় নেই। সেই অবস্থাই অধর্মের অভ্যুদয়ের অবস্থা। গীতায় যে শ্রীভগবান বলছেন,-

“যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারত।
অভ্যুত্থানমধর্মস্য তদাত্মানং সৃজাম্যহম্।।”

‘হে ভারত! যখনই যখনই ধর্মের হানী ও অধর্মের আধিক্য হয়, তখনই তখনই আমি নরদেহ ধারণ করে ভূভার-হরণে অবতীর্ণ হই’ পারিপার্শ্বিক অবস্থার আলোচনার সেই সময়ই উপস্থিত হয়েছিল বলে মনে হয় না কি? ফলতঃ, সে বিশৃঙ্খলা ভাব যদি বর্দ্ধমান থাকত, সে বিলাস-ব্যসনের স্রোতে সমাজ যদি ভাসমান হত, তাহলে ভারতের হিন্দুজাতির অস্তিত্ব কোন দিন কোথায় লুকিয়ে যেত। পাপের এই প্রবল বন্যার মাঝে, সমাজ-বিপ্লবের এই খর-স্রোত-সম্মুখে, গিরিবরের ন্যায় বিশাল বৃক্ষ বিস্তার করে যিনি দণ্ডায়মান হয়েছিলেন, আর যার প্রভাবে সেই প্রচণ্ড গতি পরিবর্তন হয়েছিল; তাঁর মহিমার কি পরিসীমা আছে? শ্রীকৃষ্ণ অপরিসীম প্রভাবান হয়েছিল; বিপ্লবের বিষম ঘুর্নিঝড়ে নিপতিত ভেঙে যাওয়া ভারত-তরণিকে তিনিই তখন রক্ষা করেছিলেন।

(১) আধুনিক ইতিহাস হিসাবে অ্যালেকজান্ডারের আক্রমণই প্রথম আক্রমণ বটে, কিন্তু অন্য দেশে অন্য জাতির স্বতন্ত্র ভাবে প্রতিষ্ঠার পূর্বে ভারত হইতে বিতাড়িত জাতিরা যে মধ্যে মধ্যে ভারত আক্রমণের চেষ্টা পাইয়াছিল, মহাভারতে তাহার আভাষ পাওয়া যায়।

তথ্যসূত্র-
ভারতবর্ষের ইতিহাস, বিশ্বকোষ, পৃথিবীর ইতিহাস(দুর্গাদাস লাহিড়ী)

সংকলনে- শ্রীকৃষ্ণকমল মিন্টু।