শ্রীকৃষ্ণ- পরম নীতিবৎ; কেন-না, রাষ্ট্রনীতি, সমাজনীতি, ধর্মনীতি-সকল নীতি শিক্ষা দানে তাঁর মহিমা বিকশিত।
[নীতির মূল তত্ত্ব- সর্বনীতিজ্ঞতার লক্ষণ; শ্রীকৃষ্ণ সমাজনীতিজ্ঞ, তাঁর জীবনে সমাজনীতিজ্ঞতার দৃষ্টান্ত; শ্রীকৃষ্ণের নীতি সচ্চরিত্রতা-বিধায়ক; রাজনীতি-ক্ষেত্রে শ্রীকৃষ্ণ, শ্রীকৃষ্ণের রাজনীতির গূঢ় লক্ষণ, সত্য-মিথ্যার প্রসঙ্গ; ধর্মনীতি-ক্ষেত্রে শ্রীকৃষ্ণ, কৃষ্ণের ধর্মনীতির মূল লক্ষ্য।]
- (১) নীতির মূল তত্ত্ব- শ্রীকৃষ্ণে সর্বনীতিজ্ঞতার লক্ষণ;
- (২) শ্রীকৃষ্ণ সামজনীতিজ্ঞ (বিশ্ব-প্রেমাঙ্কুর),
- (৩) শ্রীকৃষ্ণের জীবনে সমাজনীতিজ্ঞতার দৃষ্টান্ত;
- (৪) শ্রীকৃষ্ণের নীতি সচ্চরিত্রতা বিধায়ক;
- (৫) রাজনীতি-ক্ষেত্রে শ্রীকৃষ্ণ,
- (৬) শ্রীকৃষ্ণের রাজনীতির গূঢ় লক্ষণ,
- (৭) সত্য-মিথ্যার প্রসঙ্গ;
- (৮) ধর্মনীতি-ক্ষেত্রে শ্রীকৃষ্ণ,
- (৯) শ্রীকৃষ্ণের ধর্মনীতির মূল লক্ষ্য।
নীতির মূল তত্ত্ব- সর্বনীতিজ্ঞতার লক্ষণ;
নীতি কথায় যা থেকে কিছু (উপদেশ) পাওয়া যায়, তাই নীতি নামে অভিহিত হয়ে থাকে। মানুষের বিভিন্ন অবস্থায় বিভিন্ন প্রয়োজন সাধনের জন্য নীতি তাই বিভিন্ন বিভাগে বিভক্ত হয়ে থাকে। সেই অনুসারে রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি, ধর্মনীতির নানা প্রকার ভেদ দেখতে পাই। সর্ববিধ নীতির সমবায় শিক্ষানীতি বা কেবলমাত্র নীতি নামে অভিহিত হতে পারে। যিনি একাধিক নীতি আয়ত্ত করতে পারেন, সংসারে তার যশের অবধি থাকে না।
যিনি রাজনীতিজ্ঞ অথবা যিনি অর্থনীতিজ্ঞ, যিনি সমাজনীতিজ্ঞ অথবা যিনি ধর্মনীতিজ্ঞ, তাদের কেউই অল্প পূজনীয় নন। প্রাচ্যের ও পাশ্চাত্যের পুরাবৃত্তে এক এক বিভাগে একেক জন নীতিজ্ঞের প্রতিষ্ঠা দেখতে পাই। ইউরোপের আধুনিক ইতিহাসে বিসমার্ক ও গ্লাড্ষ্টোন প্রমুখ রাজনীতিজ্ঞ গণের প্রতিষ্ঠার বিষয় কে না অবগত আছেন? আবার অন্য দিকে, অর্থনীতি-ক্ষেত্রে, আডাম স্মিথ, রিকার্ডো, ম্যলথাস, অ্যালেকজান্ডার বেন, জন ষ্টুয়ার্ট মিল প্রভৃতির নাম সর্বজন বিদিত। ধর্মনীতিক সমাজনীতিকদের মধ্যে ইউরোপে খৃষ্ট সম্প্রদায়ের নেতৃবর্গের নাম স্মরণীয় হয়ে আছে। কিন্তু যে দেশের যে সময়ের ইতিবৃত্তই আলোচনা করি না কেন, একাধারে কোথাও সর্বনীতিজ্ঞ ভাব সমাবেশ দেখি না। ভারতের ইতিহাসে শ্রীকৃষ্ণে সেই প্রভাব দেখতে পাই। মৌর্য-সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার দিনে মহামতি চাণক্য অশেষ নীতি-শাস্ত্র বেত্তা বলে প্রতিষ্ঠান্বিত হয়েছিলেন। কিন্তু তিনি রাজনীতি বা তার অঙ্গীভূত অর্থনীতি সম্বন্ধেই অধিক মস্তিষ্ক চালনা করতে সমর্থ হয়েছিলেন; নীতি-শাস্ত্রের অন্যান্য বিভাগে তিনি তেমন যশঃসম্পন্ন হতে পারেন নি। ঐকান্তিক রাজনীতিক (অর্থনীতিক) ছিলেন বলেই, তাঁর সাথে ইউরোপের কূটনীতিক ম্যাকিয়াভেলীর তুলনা দেখতে পাই। তারপর চাণক্য তাঁর অর্থশাস্ত্র প্রণয়ণে তাঁর পূর্ববর্তী মনীষিদের পদাঙ্ক অনুসরণ করেছিলেন বলে প্রমাণ পাওয়া যায়। শুক্রাচার্য, বৃহস্পতি, চার্ব্বাক প্রভৃতির অনুসরণকারী বলে তাঁকে বুঝতে পারি। তাঁর পূর্বে সংহিতাকার গণ নীতি-শাস্ত্রের সার সমুদ্র মন্থন করে যান, পুরাণকার গণ সর্বনীতি-তত্ত্বের অনন্ত ভাণ্ডার উন্মুক্ত করে রাখেন। সুতরাং প্রকৃত নীতি শাস্ত্রবিদ বলতে, সর্বনীতি-তত্ত্বজ্ঞ বলতে, শ্রীকৃষ্ণকে যেমন নির্দেশ করতে পারি, অধুনা তেমন আর অন্য কারও প্রতি লক্ষ্য পরে না। শ্রীকৃষ্ণের নীতি-সর্বতোমুখী। যেমন রাজনীতি ক্ষেত্রে, তেমনই অর্থনীতি ক্ষেত্রে, তেমনই সমাজনীতি ক্ষেত্রে, আবার তেমনই ধর্মনীতি ক্ষেত্রে, তাঁর নৈতিক অভিজ্ঞতার অন্ত নেই। কেবল কথায় নয়; কথায় ও কাজে উভয়ত্র তিনি নিজেকে সর্বনীতি-তত্ত্বজ্ঞ রূপে প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন।
শ্রীকৃষ্ণের সমাজনীতি (বিশ্ব-প্রেমাঙ্কুর)
সমাজনীতি, রাজনীতি, ধর্মনীতি প্রভৃতি বিষয়ে শ্রীকৃষ্ণের যে সকল উক্তি দেখতে পাই, তার সমস্তই বিশেষভাবে লোকশিক্ষাপ্রদ ও জনহিত সাধক। সংসারে সুশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য, সংসারকে শান্তিময় করার জন্য, তিনি যে সকল উপদেশ প্রদান করে গেছেন, মানুষের মনে যদি তা জাগরিত থাকে, মানুষ যদি সে সকল উপদেশ কখনও বিস্মৃত না হয়, তাহলে এই অধিব্যাধি শোক-তাপ পূর্ণ সংসারেই স্বর্গের সুখ-স্বর্গের শান্তি-প্রত্যক্ষীভূত হতে পারে।
সংসারে অশান্তির এক প্রধান কারণ,- বর্তমান অবস্থায় অসন্তুষ্টি, সুতরাং সে অবস্থার পরিবর্তন প্রয়াস। এই অসন্তুষ্টি অবস্থার পরিবর্তন চেষ্টাই সকল অনর্থের মূল। সমাজবিপ্লব, রাষ্ট্রবিপ্লব, ধর্মবিপ্লব, -সংসারে যে কোনও বিপ্লবের সূচনা হয়েছে, সকলই আত্ম-অবস্থায় অসন্তুষ্টি জনিত। উৎক্ষেপ বা উচ্ছৃঙ্খলতা তার প্রধান কারণ বলে বুঝতে পারি। মানুষ যখন আপন সমাজ-বন্ধনে সন্তুষ্ট নয়, মানুষ যখন আপনার আচার-ধর্ম-নিষ্ঠায় উদ্বেগ সম্পন্ন হয়ে উঠে; তখনই তার শান্তি দূরে যায়, উদ্বেগ-উচ্ছৃঙ্খলার আবর্ত্তে পড়ে তাকে বিপর্যস্ত হতে হয়। বিপ্লবের ও অশান্তির এ মূল তত্ত্ব কি, তা অনুসন্ধান করেছিলেন বলেই শ্রীকৃষ্ণ তারস্বরে ঘোষণা করে বললেন,-
“শ্রেয়ান স্বধর্ম্মো বিগুণঃ পরধর্ম্মাৎ স্বনুষ্ঠিতাৎ।
স্বভাবনিয়তং কর্ম্ম কুর্ব্বান্নাপ্নোতি কিল্বিষম॥”
সমাজের শান্তি-রক্ষার পক্ষে এ উপদেশ অমূল্য। আপন ধর্ম, আপন সমাজ, আপন পিতৃ-পিতামহ অনুষ্ঠিত কর্ম যদি দোষ-দুষ্ট ও হয়, তারই অনুসরণ করবে; কদাচ অন্যের সমাজ, অন্যের ধর্ম বা অন্যের অনুষ্ঠিত কর্মের জন্য লালায়িত হবে না। শান্তিলাভের জন্য এ উপদেশের কি আর তুলনা আছে ? এ উপদেশ-জ্ঞানের সার, নীতির সার। ‘স্বধর্ম্মো নিধনং শ্রেয়ঃ পরধর্ম্মোভয়াবহঃ” এর অপেক্ষা নীতি-শিক্ষা আর কি হতে পারে ? সমাজে শৃঙ্খলা-রক্ষা,-সংসারে শান্তি-রক্ষা যে নীতির মুখ্য উদ্দেশ্য, সেই নীতিই প্রকৃষ্ট নীতি। এই নীতিশিক্ষারই এক অঙ্গ, পিতৃ মাতৃ-গুরুজনে ভক্তি শিক্ষা। দেখুন সে বিষয়ে শ্রীকৃষ্ণের কি উপদেশ বা উক্তি (শ্রীমদ্ভাগবত, ১০ম স্কন্ধ, ৪৫শ অধ্যায়),-
“সর্ব্বার্থ-সম্ভবো দেহো জনিতঃ পোষিতো যতঃ।
ন তয়োর্ষাতি নির্ব্বেশং পিত্রোর্ম্ররত্ত্যঃ শয়ায়ুষা॥
যস্তয়োরাত্মজঃ কল্য আত্মনা চ ধনেন চ।
বৃত্তিং ন দদ্যাৎ তং প্রেত্য স্বষাংসং খাদয়ন্তি হি॥”
অর্থাৎ -‘ধর্ম-অর্থ-কাম-মোক্ষ সর্বার্থ সম্ভব এই দেহ, যাঁদের দ্বারা উৎপন্ন ও পরিপুষ্ট হয়েছে, শত বৎসর জীবিত থেকেও মানুষ সেই পিতামাতার ঋণ পরিশোধ করতে সমর্থ হয় না। যে পুত্র আপনার দেহ দ্বারা এবং ধনসম্পত্তির দ্বারা পিতামাতার তুষ্টি সাধনে সমর্থ না হয়, লোকান্তরে যমদূত তাদের মাংস ছিন্ন করে আহার করে।’
তাই শাস্ত্র বলছে-
“পিতা স্বর্গ পিতা ধর্ম্মঃ পিতাহি পরমন্তপঃ।
পিতরি প্রীতিমাপন্নে প্রিয়ন্তে সর্ব্বদেবতা॥”
কেবল পিতামাতা বলেই নয়, যাঁরা অসহায় অবস্থায় প্রতিপালন করে থাকেন, তাঁরা ও পিতৃমাতৃতুল্য চিরসেব্য। এ বিষয়ে শ্রীকৃষ্ণের উক্তি,-
“স পিতা স চ জননী যৌ পুষ্ণীতাং স্বপুত্রবৎ।
শিশূন বন্ধুভিরুৎসৃষ্টান্ কলৈাঃ পোষরক্ষণে॥”
অর্থাৎ, ‘আত্মীয় স্বজন কর্তৃক পরিত্যক্ত আত্ম-রক্ষণে অসমর্থ শিশুকে যাঁরা পুত্রবৎ লালন-পালন করেন, তাঁহারা ও পিতামাতার তুল্য ভক্তিভাজন অর্থাৎ তাঁদের প্রতিও পিতামাতার ন্যায় ব্যবহার করা কর্ত্তব্য।’
তারপর মানুষের আরও কর্তব্য আরও প্রতিপাল্য কাজ কি আছে দেখুন। শ্রীকৃষ্ণ (শ্রীমদ্ভাগবত, ১০ম স্কন্ধ, ৪৫শ অধ্যায়) বলছেন,-
“মাতরং পিতরং বৃদ্ধং ভার্য্যাং সাধ্বীং সুতং শিশুম্।
গুরুং বিপ্রং প্রপন্নঞ্চ ফল্যোহবিভ্রচ্ছ্বসন্ মৃত॥”
অর্থাৎ,-‘মানুষের কর্তব্য এই যে, পিতা মাতা সাধ্বী ভার্য্যা ও শিশুসন্তানদেরকে প্রতিপালন করবে; ব্রাহ্মণ গণ এবং প্রপন্ন ব্যক্তি-গণ ও তাঁদের প্রতিপাল্য। সামর্থ্য সত্ত্বেও যারা আত্মীয়-স্বজনের ও আশ্রিত জনের ভরণপোষণ সঙ্কুলান না করে, তারা জীবম্মৃত অর্থাৎ জীবিত থেকেও মৃতের মধ্যে পরিগণিত।’
বিভিন্ন সংসারের সমষ্টিই সমাজ। সুতরাং ব্যষ্টিভাবে এক একটি সংসার যদি সুগঠিত হয়, তাহলে সমাজ আপনই সুগঠিত ও শৃঙ্খলাবদ্ধ হয়ে আসে।
জীব-জন্মের সার্থকতা সম্পর্কে-
শ্রীকৃষ্ণের শিক্ষা জীবে দয়া। সে দয়া কেমন দয়া- প্রখর রোদে পাদপকুলকে ছায়াদান করতে দেখে, তাদের উপমায় ব্রজবাসিদেরকে শ্রীকৃষ্ণ (শ্রীমদ্ভাগবত, দশম স্কন্ধ, দ্বাবিংশ অধ্যায়, ৩২–৩৫ শ্লোঃ) বুঝাচ্ছেন; যথা-
“পশ্যত্যৈতান্ মহাভাগান্ পরার্থৈকান্তজীবিতান্।
বার্তাবর্ষাতপহিমান সহন্তো বারয়ন্তি নঃ॥
অহো এষাং বরং জন্ম সর্ব্বপ্রাণ্যুপজীবনম্।
সুজনস্যেব যেসাং বৈ বিমুখা যান্তি নার্থিনঃ
পত্রপুষ্পফলচ্ছায়া মূলবল্কলদারুভিঃ
গন্ধনির্যাসভস্মাস্থি তোক্মৈঃ কামান্বিতন্বতে॥
এতাবজ্জন্মসাফল্যং দেহিনামিহ দেহিষু।
প্রাণৈরর্থৈর্ধিয়া বাচা শ্রেয়আচরণং সদা॥”
অথাৎ, “এই মহাভাগ বৃক্ষ কে দেখো; এরা পরের প্রয়োজন সাধনের নিমিত্ত নির্জনে জীবিত রয়েছে। দেখ-স্বয়ং বাতাস, বর্ষা, রোদ, হিম সহ্য করে আমাদেরকে ঐ সকল থেকে রক্ষা করছে। অহো! এঁদের জন্ম অতি উৎকৃষ্ট। এরা সকল প্রাণীর উপজীব্য। দয়ালু ব্যক্তির কাছ থেকে যাচকের ন্যায় এঁদের কাছ থেকে কখনই বিমুখ হয় না। এরা পত্র, পুষ্প, ফল, ছায়া, মূল, বাঁকল, গন্ধ, নির্যাস, ভস্ম, অস্থি ও পাতা আদির অঙ্কুর দ্বারা নিরন্তর বাসনা পূরণ করে। প্রাণীদের মধ্যে প্রাণ, সম্পত্তি ও বাক্য দ্বারা সর্বদা মঙ্গল আচরণ করাই জীবগণের জন্মের ফল।’ এ উপদেশের তুলনা নেই। দেহ, প্রাণ, বাক্য, মন, সম্পত্তি প্রভৃতির দ্বারা সর্বদা জীবের মঙ্গল আচরণ করবে; তবেই জীবন সফল-জন্ম সফল।
আদর্শ অমূল্য সমাজনীতি!- ‘প্রাণৈরর্বৈধিয়াঃ বাঁচা শ্রেয় এবাচরেৎ সদা।’ বিশ্বপ্রেম-বিধায়ক এমন নীতি আর কোথায় আছে কে দিয়েছেন কবে ?
শ্রীকৃষ্ণের নীতি সদাচার বিধায়ক।
শ্রীকৃষ্ণের নীতির মধ্যে যেমন সর্বত্র করুণা প্রকাশের উপদেশ পেয়ে থাকি, তেমনি সচ্চরিত্রতার ও লোকানুবর্ত্তিতার প্রভাব দেখতে পাই। দ্যুতক্রিয়া সম্বন্ধে তাঁর উক্তি অনুধাবন করলে! তাঁর নীতি কত দূর উন্নত ছিল, বুঝতে পারি। শ্রীকৃষ্ণ বলছেন- অক্ষক্রীড়ায় সাধু মানবদের মতিভ্রংশ হয় এবং অসৎ লোকদের সুহৃদ্ভেদ ও নানা প্রকার বিপদের উৎপত্তি হয়ে থাকে। যথা, মহাভারতে উদ্যোগ পর্বে দুর্য্যোধনের প্রতি শ্রীকৃষ্ণের উক্তি-
“অক্ষদ্যুতং মহাপ্রজ্ঞ সতাং মতিবিনাশনম্।
অসতাং তত্র জায়ন্তে ভেদাশ্চ ব্যসনানি চ॥”
কৃষ্ণ বিদ্বেষীদের রটনা এই যে, শ্রীকৃষ্ণ লাম্পট্য দোষে দুষ্ট ছিলেন, পরবর্তী কালে কোনও কোনও বৈষ্ণব কবি কতকটা সেরকম চিত্রে শ্রীকৃষ্ণকে চিত্রিত করে গেছেন। কৃষ্ণ কোন্ প্রেমের প্রেমিক ছিলেন, আর কেমন প্রেমের শিক্ষা জগৎকে তিনি শিখিছেন, তা বুঝতে না পেরেই, তা ধারণা করতে না পেরেই, অজ্ঞজন ভ্রমে পতিত হন। কিন্তু শ্রীকৃষ্ণের চরিত্র, শ্রীকৃষ্ণের নীতি, শ্রীকৃষ্ণের উক্তি লক্ষ্য করলে সে ভ্রম একেবারে দূর হতে পারে।
কৃষ্ণগতপ্রাণা রমণীদেরকে সম্বোধন করে শ্রীকৃষ্ণ কি উপদেশ দিয়েছেন, দেখুন;-
“পতয়ো নাভ্যসূইয়েরন পিতৃভ্রাতৃসুতাদয়ঃ।
লোকশ্চ বো ময়োপেতা দেবা অপ্যমুমন্বতে॥
ন প্রীতয়হনুরাগায় হ্যঙ্গসঙ্গো নৃর্ণামিহ।
তন্মনো ময়ি যুঞ্জনা অচিরাম্মামবাপ্স্যথ॥”
(শ্রীমদ্ভাগবত ১০ম স্কন্ধ অধ্যায় ২৩)
অর্থাৎ, ‘অঙ্গে অঙ্গে মিলন মিলন নয়; চিত্ত-সমর্পণই প্রকৃত মিলন।’ পতি, পিতা, ভ্রাতা ও পুত্র আদি তাতে দোষ দিতে পারে না, অথচ, সেই মিলনই প্রকৃষ্ট মিলন। শ্রবণ, কীর্তন, স্মরণ, মনন প্রভৃতির দ্বারাই যে শ্রী ভগবানকে প্রাপ্ত হওয়া যায়, আর সে সঙ্গ লাভে যে সকল বন্ধনের অবসান হয়ে যায়, এখানে ভগবদ্ উক্তিতে সেই ভাবই পরিব্যক্ত,- শ্রীকৃষ্ণের এটাই সার উপদেশ।
শ্রীকৃষ্ণ সমাজের শৃঙ্খলা ভঙ্গ করার জন্য আদৌ চেষ্টা করেন নি; পরন্তু যাতে সমাজের শৃঙ্খলা রক্ষা হয়, তার প্রতি তাঁর একমাত্র লক্ষ্য ছিল। পতি, পিতা, পুত্র প্রভৃতি দোষ দেখতে না পান-এতদুক্তিতে তাঁর লোকানুবর্ত্তিতারই প্রকৃষ্ট পরিচয় পাওয়া যায় না কি ?
কামজয়ই শ্রীকৃষ্ণের প্রধান শিক্ষা তিনি তাই পুনঃ পুনঃ বলিয়াছেন,
দৃষ্ট্বা স্ত্রিয়ং দেবমায়াং তদ্ভাবৈরজিতেন্দ্রিয়ঃ।
প্রলোভিতঃ পতত্যন্ধে তমস্যগ্নৌ পতঙ্গবৎ॥
যোষিদ্ধিরণ্যাভরণাম্বরাদি দ্রব্যেষু মায়ারচিতেষু মূঢঃ।
প্রলোভিতাত্মা হ্যুপভোগবুদ্ধ্যা পতঙ্গবন্নশ্যতি নষ্টদৃষ্টিঃ॥
পতঙ্গদের কাছ থেকেও শিক্ষা গ্রহণ করা যায়- পতঙ্গ রূপে মুগ্ধ হয়ে অগ্নিতে ঝাঁপ দেয় এবং পুড়ে ছারখার হয়ে যায়। তেমনি ভাবে ইন্দ্রিয়গণকে বশীভূত রাখতে অসমর্থ ব্যক্তি নারী-দেহ দর্শনেই তাতে আসক্ত হয়ে পড়ে এবং ঘোর অন্ধকারে, নরকে অধঃপতিত হয়ে নিজের সর্বনাশ ডেকে আনে। সত্যই নারী দেবতাদের সেই মায়া-যার জন্য জীব ভগবান বা মোক্ষ প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হয়ে যায়।৭
যে মূঢ় ব্যক্তি কামিনী-কাঞ্চন পোষাক-অলংকার আদি বিনাশশীল ভ্রামাত্মক পদার্থে আসক্ত এবং সেগুলির উপভোগের জন্য লালায়িত সে ক্রমে নিজ বিবেকবুদ্ধি হারিয়ে পতঙ্গবৎ ধ্বংস হয়ে যায়।
এ বিষয়ে আর অধিক আলোচনার আবশ্যক অনুভব করি না। ফলতঃ শ্রীকৃষ্ণ যে ব্যাভিচার স্রোত প্রবাহিত করেন নি, বরং সে স্রোত রুদ্ধ করবার পক্ষেই চেষ্টা করেছিলেন, তা বলাই বাহুল্য।
রাজনীতি-ক্ষেত্রে শ্রীকৃষ্ণ।
শ্রীকৃষ্ণ যে একজন পরম রাজনীতি বিশারদ ছিলেন, কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে জরাসন্ধ, কাল-যবন, শিশুপাল প্রভৃতির সংহার সাধনে তা বেশ প্রতিপন্ন হয়। জরাসন্ধের কাছ থেকে বন্দী রাজাদের উদ্ধার এবং যুধিষ্ঠিরের সাম্রাজ্য স্থাপনে একে একে পথের কাঁটা দূর করা, তাঁর রাজনীতিজ্ঞতার প্রকৃষ্ট পরিচয়। তাঁর উক্তির মধ্যে এই রাজনীতিজ্ঞতার নিদর্শন নানা স্থানে দেখতে পাই। সৌভাগ্য মাদকতা উন্মত্ততাই যে পতনের লক্ষণ, বন্ধন উন্মুক্ত রাজাদেরকে শ্রীকৃষ্ণ (শ্রীমদ্ভাগবত, দশম স্কন্দ, ৩৭ অধ্যায়ে, ১৯শ-২০শ শ্লোঃ) তা বুঝিয়ে বলছেন-
“দিষ্ট্যা ব্যবসিতং ভূপা ভবন্ত ঋতভাষিণঃ। শ্রীয়ৈশ্বর্যমদোন্নাহং পশ্য উন্মাদকং নৃণাম্।।
হৈহয়ো নহুষো বেণো রাবণো নরক্যোপরে। শ্রীমদাদ্ভ্রংশিতাঃ স্থানাদ্দেবদৈত্যনরেশ্বরাঃ।।”
অর্থাৎ, আমি দেখেছি, সৌভাগ্য মাদকতা উন্নতিই মানবের উন্মত্ততার কারণ। কার্ত্তবীর্য, নহুষ, বেণ, রাবণ, নরক এবং অন্যান্য দেব দৈত্য রাজারা ঐশ্বর্য ও গর্বে অন্ধ হয়ে নিজ নিজ স্থান থেকে পতিত হয়েছেন।’
এরপর, সেই বন্ধন উন্মুক্ত রাজারা নিজ রাজ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়ে কিভাবে রাজকার্য পরিচালনা করবেন, শ্রীকৃষ্ণ সে সম্বন্ধে উপদেশ দান করেন। সে উপদেশে বলেন যে, ভগবানে চিত্ত স্থির রেখে সাবধানে ধর্ম অনুসারে প্রজাপালন করতে হবে, সন্তান-সন্ততি সুখ-দুঃখ অথবা মঙ্গল অমঙ্গল যেমন ঘটবে, তাতেই সন্তুষ্ট থাকতে হবে এবং ভগবানে চিত্ত স্থির রেখে সকল কাজ সম্পন্ন করে যাবে। এইরকম উপদেশ দিয়ে বন্ধন-মুক্ত রাজাদের প্রতি যথোপযুক্ত সদয় ব্যবহার করে, শ্রীকৃষ্ণ তাঁদের সকলেরই চিত্ত আকর্ষণ করেন। এখানে শ্রীকৃষ্ণের কথায় ও কাজে তাঁর রাজনীতিজ্ঞতার বিশিষ্ট পরিচয় পেয়ে থাকি। অযথা-রূপে অত্যাচার গ্রস্ত রাজাদের মুক্তিদানে তিনি তাঁদের হৃদয় যেমন ভাবে আকর্ষণ করতে সমর্থ হয়েছিলেন, তাতে যুধিষ্ঠিরের সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা কল্পে তাঁদের দ্বারা বিশেষ সহায়তা হয়েছিল। শরণাগত রক্ষার সঙ্গে সঙ্গে রাজসূয় যজ্ঞ অনুষ্ঠানে সহায়তা লাভ,-এই ব্যাপারে দুই কাজ পূর্ণ করা হয়। এ কথা, এ ভাব তাঁর বাক্যেই প্রকাশ,-
“কার্যং পৈতৃষ্বস্রেয়স্য রক্ষা চ শরণৈষিণাম্।” শরণাগত রক্ষা যে শ্রীকৃষ্ণের নীতির অন্তর্ভুক্ত ছিল, এই উক্তির অভ্যন্তরে তাহা দেদীপ্যমান রয়েছে। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে পাণ্ডবদের পক্ষ অবলম্বনে যুগপৎ ন্যায়ের মর্যাদা ও শরণাগত-রক্ষা প্রকাশ পেয়েছে। অথচ কুরুপাণ্ডবের যুদ্ধে আত্মীয়-সুহৃদের যা কর্তব্য, সে কর্তব্য-পালনে শ্রীকৃষ্ণের একটুও ক্রুটি দেখা যায়নি। যুদ্ধের পূর্বে সন্ধি-স্থাপনের জন্য তিনি যে যথোচিত চেষ্টা করেছিলেন, তাঁর প্রমাণ পদে পদে প্রত্যক্ষ হয়। মহামতি বিদুর যখন দুর্যোধনের অন্যায় আচরণের বিষয় তুলে ধরে শ্রীকৃষ্ণকে বললেন,- “বল-গর্বিত বিমূঢ় দুর্যোধন কখনই আপনার বাক্য রক্ষা করবে না”; মনে করে দেখুন দেখি, তখন শ্রীকৃষ্ণ কি উত্তর দিয়েছিলেন? শ্রীকৃষ্ণ বলেছিলেন,- “আমি দুর্যোধনের দৌরাত্ম্য এবং ক্ষত্রিয়দের শত্রু-ভাব সকলই অবগত আছি, এবং অবগত থেকেও আজ কুরু-মণ্ডল মধ্যে সমাগত হয়েছি। যে যে ব্যক্তি এই অশ্ব-রথ-মাতঙ্গ সমাকীর্ণ বিপর্যস্ত মেদিনী-মণ্ডলকে মৃত্যু-পাপ হতে বিমুক্ত করতে সমর্থ হয়, সে অবশ্যই অত্যুত্তম ধর্ম লাভ করতে পারে। আমি নিঃসংশয়ে বলতে পারি, মনুষ্য নিজ শক্তি অনুসারে কোনও ধর্ম-কাজ নিষ্পাদনে যত্ন করে যদিও কৃতকার্য হতে না পারে, তথাপি তার পুণ্যফল প্রাপ্ত হয়; আবার মনে মনে কোনও পাপ কর্মের চিন্তা করে তার অনুষ্ঠান না করলেও তারজন্য ফলভোগের অধিকারী হয় না।
—- সংগ্রামে আসন্ন-বিনাশে উন্মুখ কুরু ও পাণ্ডবদের মধ্যে শাস্তি স্থাপন করতে আমি অকপটে যত্ন করব।
—-আপদ-গ্রস্ত কৃশ্যমান মিত্রকে যে ব্যক্তি যথাশক্তি অনুনয় দ্বারা তা থেকে বিমুক্ত করার চেষ্টা না করে, পণ্ডিতেরা তাকে নৃশংস বলে উল্লেখ করেন। মিত্র ক্ষমতানুসারে যত্ন কড়ে যে কোনও উপায় দ্বারা, এমন কি কেশগ্রহ পর্য্যন্ত করেও, মিত্রকে অকাজ হতে নিবর্তিত করতঃ কারও নিন্দনীয় হন না।
—আমি হিত-অনুষ্ঠানে যত্ন-পরায়ণ হলেও যদি দুর্যোধন আমার প্রতি কোনও শঙ্কা করে, তথাপি মিত্রের কর্তব্য কর্ম সম্পন্ন করলাম বলে আমার হৃদয়ের প্রীতি হবে। জ্ঞাতি গণ মধ্যে পরস্পর ভেদ হবার সূত্র হলে যে মিত্র সর্ব-প্রযত্নে মধ্যস্থ অবলম্বন না করে, পণ্ডিতেরা তাকে মিত্র বলে গণনা করেন না। সন্ধি বিষয়ে আমার যত্ন করবার হেতু এই যে, অধর্মনিষ্ঠ সৌহৃদ্য-শূন্য মুঢ় লোকেরা যেন বলতে না পারে, কৃষ্ণ সমর্থ হয়েও কোপযুক্ত কুরু-পাণ্ডবগণকে যুদ্ধ হতে নিবারণ করল না।
—অবোধ দুর্যোধন যদি আমার ধর্মার্থ যুক্ত মঙ্গলময় বাক্য শ্রবণ করেও অগ্রাহ্য করে, তবে নিতান্তই কালের বশবর্তী হবে। অথবা যদি পাণ্ডবদের অর্থহানি না করিয়ে আমি কুরু গণ মধ্যে শাস্তি-সংস্থাপন করতে সমর্থ হই, তাহলে আমারও মহাফল উপধায়ক পুণ্য কর্ম করা হয় এবং কৌরবেরাও মৃত্যুপাশ হতে নিষ্কৃতি পেতে পারে।”
শ্রীকৃষ্ণের এই উক্তির মধ্যে সর্ব্ববিধ শিক্ষাই পাওয়া যায়। এর মধ্যে সমাজনীতি, রাজনীতি, অর্থনীতি সকল নীতিরই সমাবেশ আছে। কি নিগুঢ় শিক্ষাপ্রদ ধর্মনীতি-যখন তিনি বললেন,-
“ধর্মকার্যং যতঞ্শক্ত্যা নো চেৎপ্রাপ্নোতি মানবঃ।
প্রাপ্তো ভবতি তৎপুণ্যমত্র মে নাস্তি সংশয়ঃ॥ ৫-৯৩-৭
মনসা চিন্তয়ন্পাপং কর্মণা নাতিরোচয়ন্।
ন প্রাপ্নোতি ফলং তস্যেত্যেবং ধর্মবিদো বিদুঃ॥” ৫-৯৩-৮
এই সকল উক্তির মধ্যে প্রকৃষ্ট রাজনীতির লক্ষণ এই যে, শ্রীকৃষ্ণ মনে মনে অধর্মের উচ্ছেদ-সাধনে সঙ্কল্পবদ্ধ আছেন; অথচ, সন্ধির জন্য চেষ্টা করছেন। মিত্র হিসাবে, আত্মীয় হিসাবে, যে চেষ্টা করা আবশ্যক, তাতে ত্রুটি হচ্ছে না; অথচ, দুষ্টের দমনরূপ কর্ত্তব্য পালন-স্পৃহাও জাগরিত রয়েছে। মিত্রতাও দেখানো হচ্ছে, আবার ভয় প্রদর্শনেরও ত্রুটি হচ্ছে না। রাজনীতিজ্ঞের যে লক্ষণ, এই এক সন্ধি-প্রস্তাবেই তা বিশিষ্ট ভাবে দেখতে পাই। সন্ধি-সংস্থাপনের জন্য কুরু-সভায় গিয়ে, শ্রীকৃষ্ণ দুর্য্যোধনের ক্রটির কোনও কথাই ব্যক্ত করতে সঙ্কোচ বোধ করলেন না; অধিকন্তু জানালেন, সুহৃদগণের বাক্য উল্লঙ্ঘন করলে তুমি কোনও কালে কল্যাণ-লাভে সমর্থ হবে না; –‘ন শর্ম্ম প্রাপ্স্যাসে রাজন্নুৎক্রম্য সুহৃদান্ বচঃ।’ পিতা মাতা গুরুজনের বাক্য লঙ্ঘন করে যে জন কোনও কাজ করে, তার শ্রেয়ঃ নেই,-শ্রীকৃষ্ণের উক্তিতে এই সকল কথা প্রকাশ পায়। সুতরাং তিনি একদিকে দুর্য্যোধনের শ্রেয়-সাধনের জন্য আন্তরিক চেষ্টা করেছিলেন বুঝা যায়; আবার অন্যদিকে তাঁর শ্লেষ-বাক্য দুর্য্যোধনকে যুদ্ধার্থ উত্তেজিত করেছিল বলেই বুঝতে পারি। বলা হয়, দ্বিভাবার্থজ্ঞাপক বাক্য প্রয়োগই বিশিষ্ট রাজনীতিজ্ঞের লক্ষণ। শ্রীকৃষ্ণ-চরিত্রের সমালোচনা প্রসঙ্গে কেউ কেউ তাই তাঁর ঐরুপ দ্ব্যর্থ-ভাবাত্মক বাক্যের সমালোচনায় তাঁকে পরম কুটরাজনীতিজ্ঞ বলে নির্দেশ করে থাকেন। অশ্বখামার মৃত্যু সংবাদ – রটনায়, সত্যাসত্যের অনুবর্ত্তিতা প্রসঙ্গে, কেঊ তাঁকে প্রকৃষ্ট রাজনীতিক বলে ঘোষণা করেন, কেউ বা তাঁকে অসত্যের-পাপের প্রশ্রয়দাতা বলে অনুযোগ করে থাকেন। এখানে আমরা কিন্তু তার দিব্য-সুন্দর মুর্ত্তি দেখতে পাই। রাজনীতিকের দৃষ্টিতে, বিপক্ষ পক্ষের সঙ্ঘাত-সাধনের জন্য তিনি যে পন্থা অবলম্বন করেছিলেন, তাহাই শ্লাঘনীয়(প্রশংসা; আত্মপ্রশংসা)। কেন-না, বিজয়-লক্ষ্মী সেই পথেই তাঁকে জয়মাল্য প্রদান করেছিলেন। সাম-দান-ভেদ প্রভৃতি রাজনীতির অঙ্গ। রাজনীতি-ক্ষেত্রে জয়ী হতে হলে সে সকল কুটনীতির সাহায্য অপরিহার্য। কিন্তু সমালোচকের তীব্র-দৃষ্টিতে ঐ সকল কাজে তিনি ভয়ানক অপরাধী বলে প্রতিপন্ন হয়েছেন; কেন-না,-তিনি ‘সত্যই ধর্ম’;অহিংসাই ধর্ম’ প্রভৃতি শিক্ষা দান করে আপন কাজে অসত্যের হিংসার প্রশ্রয় দিয়া গেছেন। এ সকল বিষয় বুঝতে হলে ধর্মতত্ত্ব বিশেষভাবে বুঝবার প্রয়োজন হয়। কেননা, রাজধর্ম এক রকম, গার্হস্থ্য ধর্ম একরকম, আর মোক্ষধর্ম একরকম; সুতরাং সর্বত্র একবিধ নীতি কখনও প্রয়োজন-সাধক হয় না। কর্মে অকর্মে এবং অকর্মে কর্ম প্রভৃতির বিষয় আলোচনা করে আমরা যা বুঝেছি, + সে অনুসারে বিচার করতে গেলে সত্যে অসত্য, অসত্যে সত্য প্রতিপাদিত হতে পারে। আমরা যাকে সত্য বলে মনে করি, অনেক সময় তা ভ্রান্তিমূলক প্রতিপন্ন হয়। আবার আমরা যাকে মিথ্যা বলে মনে করি, অনেক সময় তা সত্য বলে প্রতিপন্ন হতে পারে। যদি বুঝা যায়, দুর্য্যোধনের পক্ষ অধর্মের-অসত্যের পরিপোষক, আর তাদের ধ্বংস-সাধনে ধর্মের-সত্যের প্রতিষ্ঠা অবশ্যম্ভাবী, তাহলে বুঝতে হয়, যুধিষ্টিরের সেই উক্তি অসত্য হয়েও সত্য-ফলপ্রসু। কিন্তু সে বিতর্কে-সে দার্শনিক গবেষণায় প্রবৃত্ত না হয়ে যদি মানুষিক সহজ দৃষ্টিতে সন্ধান করে দেখি, তাহলেই বা কি তথ্য অবগত হই? অবগত হই না কি, শ্রীকৃষ্ণ কি লৌকিক ভাবে কি অলৌকিক ভাবে অসত্যের প্রশ্রয় কখনও দেন নাই! যুধিষ্টির সত্যবাদী; তিনি জীবনে কখনও মিথ্যা কথা বলননি; জ্ঞানে হোক আর অজ্ঞানে হোক, অশ্বত্থামার সংহার-সাধনে তাঁকে মিথ্যার প্রশ্রয় দিতে হল। জীবনে একবার একটা মাত্র ঘটনায় যুধিষ্ঠির মিথ্যা বাক্য উচ্চারণ করলেন। কিন্তু তার ফল হল কি? ফল হল-তাঁর নরক-দর্শন। শ্রীকৃষ্ণ দেখালেন,-মিথ্যা কখনই শ্রেয়ঃসাধক নয়; সত্যের জন্য-ধর্মরাজ্য সত্যরাজ্য প্রতিষ্ঠার জন্য যে মিথ্যা, সে মিথ্যাও দোষাবহ। শাস্ত্রে আছে বটে, প্রাণ-রক্ষা-কল্পে ও বিবাহ প্রভৃতি বিষয়-বিশেষে মিথ্যাও পাতক শূন্য হয়ে থাকে;++ কিন্তু সত্য-মিথ্যার সে মীমাংসায় উপনীত হওয়া সাধারণ মানুষের সাধ্যায়ত্ত নয়। যেখানে উপদেশ আছে-প্রাণীর প্রাণ রক্ষার জন্য মিথ্যা দোষাবহ নয়, সেখানে বিচার করা প্রয়োজন-কোন অবস্থায় দোষাবহ নয়! শ্রীকৃষ্ণ পরম জ্ঞানী-পরম নীতিতত্ত্বজ্ঞ ছিলেন; সুতরাং তিনি দোষাদোষ বিচার করেই সত্য-মিথ্যার উপযোগিতা নির্ধারণ করতেন। কিন্তু তাহলেও কর্মফল অনিবার্য। মিথ্যা হিংসা যখন কর্মরূপে পরিণত হইবে; তাহার ফলোৎপত্তি কেহই রোধ করিতে পরিবে না। যুধিষ্ঠিরের মিথ্যা-বাক্য এক দিকে সত্যের প্রতিষ্ঠায়—ধর্ম-রাজ্যের প্রতিষ্ঠায় সহায় হইল বটে; কিন্তু অন্য দিকে এক জন ধার্মিকের সংহার-সাধন করিল। সুতরাং ঐ এক মিথ্যায় দুই ফল অনিবার্য্য হইল। যে শুভ-সঙ্কল্প-সাধনের দূর লক্ষ্য রাখিয়া সেই মিথ্যা-বাক্য প্রযুক্ত হইয়াছিল, সে শুভ সঙ্কল্প সাধিত হইয়া আসিল; অপিচ, সে যে মিথ্যা-আশীবিষ( দন্তে বিষ আছে যাহার-সর্প), তাহার ক্রিয়াও করিয়া গেল,—সেই মিথ্যার জন্য যুধিষ্ঠিরকে নরক-দর্শন করিতে হইল। এখানে একটা প্রশ্ন উঠতে পারে। সে মিথ্যার পাপ কৃষ্ণে না বর্ত্তিয়া যুধিষ্টিরে বর্ত্তিল কেন? তাহারও কারণ আছে। শ্রীকৃষ্ণ নিষ্কাম, যুধিষ্ঠির সকাম। যুধিষ্ঠির রাজ্যলাভেচ্ছু, সুতরাং সকাম ছিলেন। সেই জন্য নিষ্কাম কর্মী শ্ৰীকৃষ্ণে পাপফল স্পর্শ করিল না; সকামকর্মী যুধিষ্ঠির পাপফলভাগী হইলেন। অধিকন্তু শ্রীকৃষ্ণ এখানে দেখাইলেন, অজ্ঞাতসারে মিথ্যা কহিলেও পাপভাগী হইতে হইবে। ফলতঃ, সূক্ষ্ম-ভাবে বিচার করিয়া দেখিলে, শ্রীকৃষ্ণ যে মিথ্যার প্রশ্রয়দাতা ছিলেন, তাহা কখনই বলা যাইতে পারে না। তিনি একজন প্রকৃষ্ট রাজনীতিক ছিলেন, এ সকল আলোচনায় তাহাই প্রতিপন্ন হয়।
শ্রীকৃষ্ণের ধর্ম্মনীতি
শ্রীকৃষ্ণের সকল নীতির শ্রেষ্ঠ নীতি-ধর্ম্মনীতি। সমাজনীতি রাজনীতি প্রভৃতি এক হিসাবে তাঁহার ধর্ম্মনীতিরই অন্তর্ভুক্ত। যাহা কিছু তিনি উপদেশ দিয়াছেন বা যে কিছু কার্য্যের তিনি অনুষ্ঠান করিয়া গিয়াছেন, সকলেরই মূল লক্ষ্য এক- ধর্ম্ম-প্রতিষ্ঠা। সুতরাং তাঁহার নীতিমাত্রেরই মূল-ভিত্তি—ধর্মের উপর। অর্থাৎ,—তাঁহার প্রবর্ত্তিত কি সমাজনীতি কি রাজনীতি সকলই ধর্ম্মশিক্ষামূলক। তথাপি আমরা তাঁহার নৈতিক মত-সমূহকে বিভিন্ন বিভাগে বিভক্ত করিলাম; তাঁহার কারণ এই যে, কার্য্যক্ষেত্রে সংসারীর পক্ষে বিভিন্ন অবস্থাতে তাঁহার মত বিভিন্ন প্রকারে কার্য্যকরী হইতে পারে। তদনুসারে শ্রীকৃষ্ণের ধর্ম্মনীতি-প্রসঙ্গে মানুষের উচ্চ-পরিণতির বিষয়ই বিবৃত করা হইতেছে।
যে অবস্থা সকল অবস্থার সার অবস্থা, সে অবস্থার লক্ষণ কি-আর কেমন করিয়াই বা সে অবস্থায় উপস্থিত হওয়া যায়, শ্রীকৃষ্ণের ধর্ম্মনীতির আলোচনায় কেবল তাহারই কয়েকটি দৃষ্টান্ত প্রদর্শন করিব মাত্র। প্রথম, মানুষের কি রূপ পরার্থপর নিঃসঙ্গ ও নির্লিপ্ত হওয়া প্রয়োজন, তৎসম্বন্ধে তিনি বলিতেছেন,—
“শশ্বৎপরার্থসর্বেহঃ পরার্থৈকান্তসম্ভবঃ। সাধুঃ শিক্ষেত ভূভৃত্তো নগশিষ্যঃ পরাত্মতাম্॥
প্রাণবৃত্ত্যৈব সন্তুষ্যেন্মুনির্নৈবেন্দ্রিয়প্রিয়ৈঃ। জ্ঞানং যথা ন নশ্যেত নাবকীর্যেত বাঙ্মনঃ।।
বিষয়েষ্বাবিশন্যোগী নানাধর্মেষু সর্বতঃ। গুণদোষব্যপেতাত্মা ন বিষজ্জেত বায়ুবৎ।।
পার্থিবেষ্বিহ দেহেষু প্রবিষ্টস্তদ্গুণাশ্রয়ঃ। গুণৈর্ন যুজ্যতে যোগী গন্ধৈর্বায়ুরিবাত্মদৃক্।।
অন্তর্হিতশ্চ স্থিরজঙ্গমেষু ব্রহ্মাত্মভাবেন সমন্বয়েন।
ব্যাপ্ত্যাব্যবচ্ছেদমসঙ্গমাত্মনো মুনির্নভস্ত্বং বিততস্য ভাবয়েৎ॥
তেজোঽবন্নময়ৈর্ভাবৈর্মেঘাদ্যৈর্বায়ুনেরিতৈঃ। ন স্পৃশ্যতে নভস্তদ্বৎকালসৃষ্টৈর্গুণৈঃ পুমান্।।
স্বচ্ছঃ প্রকৃতিতঃ স্নিগ্ধো মাধুর্যস্তীর্থভূর্নৃণাম্। মুনিঃ পুনাত্যপাং মিত্রমীক্ষোপস্পর্শকীর্তনৈঃ।।
অর্থাৎ- ‘পর্ব্বত যেমন পরার্থ-ব্রতধারী, তদ্গাত্রোৎপর বৃক্ষতৃণ-নির্ঝর যেমন পরের প্রয়োজন-সাধক হয়; সাধুগণের কার্য্যও সেইরূপ হওয়া কর্ত্তব্য; তাঁহারা পর্ব্বতগাত্রোৎপন্ন বৃক্ষাদির নিকট হইতে পরার্থতা(পরের জন্যই তাঁহাদের কার্য্য) শিক্ষা করিবেন। সাধুজন প্রাণধারণ করিবেন-কেবল জ্ঞানান্বেষণের জন্য; রূপ-রসাদি ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বিষয় উপভোগের জন্য সাধুগণ কখনই জীবনধারণ করেন না। গুণলিপ্সা বামনের বিক্ষেপ জ্ঞান-নাশক। শীতোষ্ণসুখদুঃখাদি নানাধর্ম্মশীল থাকিয়াও সাধুপুরুষ গুণদোষে অনাসক্ত থাকিবেন; বায়ু যেমন সর্ব্বত্র সঞ্চালিত থাকিয়াও নির্লিপ্ত আছেন; যোগী পুরুষের সেইরূপ নির্লিপ্ততা প্রয়োজন। আত্মদর্শী যোগী বাল্যযৌবনাদি দেহধর্ম্ম আশ্রয় করিয়াও এবং সেই সেই আবস্থার গুণাশ্রয়ী হইয়াও, অসংশ্লিষ্ট থাকেন; বায়ু যেমন গন্ধাদি ধর্ম-যোগে গন্ধবহু বলিয়া অভিহিত হইলেও গদ্ধাদির সহিত অসংসৃষ্ট, যোগিপুরুষও সেইরূপ নির্লিপ্ত-ভাবাপন্ন। আকাশ যেমন সর্ব্বগত, ঘটাদির সহিতও তাহার যেমন অসঙ্গ নাই, অথচ আকাশ যেমন নিঃসঙ্গ নির্লিপ্ত; আত্মা সেইরূপ সর্ব্বভূতে বিরাজমান আছেন; যোগী পুরুষ দেহাদির সহিত সম্বন্ধযুক্ত আত্মার স্থাবর-জঙ্গমাদি সর্ব্বত্র নিঃসঙ্গ নির্লিপ্ত ভাবে অবস্থিতির বিষয় অনুভব করিবেন। তেজ, জল, অন্ন, পৃথিবী, প্রভৃতি কালসৃষ্টগুণে পুরুষ আবদ্ধ নহেন; বায়ু-চালিত মেঘাদির সচিত আকাশের যেমন সংশ্রব অভাব, যোগী পুরুষের ও সেইরূপ নির্লিপ্ত ভাব। স্বভাবজ নির্মল স্নিগ্ধ মধুর জল যেমন জীবের স্নিগ্ধতা সম্পাদন করে, নির্মল স্নিগ্ধ মধুর স্বভাব সাধুপুরুষও সেইরূপ দর্শন স্পর্শন কীর্ত্তন প্রভৃতির দ্বারা দ্রষ্টা-মাত্রকে পরিতৃপ্ত করেন।’ অন্য আর এক স্থলে ভগবান সাধুজনের উপমায় কহিতেছেন-“সিদ্ধু যেমন বর্ষাকালীন নদী-সকলের জল প্রাপ্ত হইয়াও বেলা অতিক্রম করেন না এবং গ্রীষ্মকালে নদীসকল শুষ্ক হইলেও বিশুষ্ক হন না; তদ্রুপ নারায়ণ পরায়ণ যোগী কামসকল যথেষ্টরূপে লাভ করিয়া বা ঐ সকল বর্জ্জিত হইয়া, আনন্দে মত্ত ও দুঃখে ম্লান হইবে না।” শ্রীমদ্ভাগবতে (একাদশ স্কন্ধ, অষ্টম অধ্যায়, ৬ষ্ঠ শ্লোকে)যথ,-
“সমৃদ্ধকামো হীনো বা নারায়ণপরো মুনিঃ। নোৎসর্পেত ৎ শুষ্যেত সরিদ্ভিরিব সাগরঃ।।”
সাধুর স্বরূপ ও সাধুসঙ্গের ফল শ্রীমদ্ভাগবতে শ্রীভগবান এইরূপ বর্ণন করিয়া গিয়াছেন,—
“সন্তঃ অনপেক্ষাঃ মচ্চিত্তাঃ প্রশান্তাঃ সমদর্শিনঃ। নির্মমাঃ নিরহঙ্কারাঃ নির্দ্বন্দ্বাঃ নিষ্পরিগ্রহাঃ।।
যথা উপশ্রয়মাণস্য ভগবন্তং বিভাবসুম্। শীতং ভয়ং তমঃ অপি এতি সাধূন্ সংসেবতঃ তথা।।
নিমজ্জ্য উন্মজ্জ্যতাং ঘোরে ভবাব্ধৌ পরম অয়নম্। সন্তঃ ব্রহ্মবিদঃ শান্তাঃ নৌঃ দৃঢ ইব অপ্সু মজ্জতাম্ ।।
অন্নং হি প্রাণিনাং প্রাণঃ আর্তানাং শরণং তু অহম্। ধর্মঃ বিত্তং নৃণাং প্রেত্য সন্তঃ অর্বাক্ বিভ্যতঃ অরণম্।।
সন্তঃ দিশন্তি চক্ষূংষি বহিঃ অর্কঃ সমুত্থিতঃ। দেবতাঃ বান্ধবাঃ সন্তঃ সন্তঃ আত্মা অহম্ এব চ।।
অর্থাৎ,- “যাঁহারা নিরপেক্ষ, মচ্চিত্ত, প্রশান্ত, সমদর্শী, মমতাশূন্য, অহঙ্কারবর্জ্জিত, দ্বন্দ্বরহিত এবং পরিগ্রহশূন্য, তাঁহারাই সাধু।…যেমন ভগবান অগ্নিকে আশ্রয় করিলে লোকের শীত, অন্ধকার ও ভয় থাকে না; তেমনি সাধুগণের সেবা করিলে সমস্ত পাপ নষ্ট হইয়া যায়। যেমন, যাঁহারা জলে নিমগ্ন হইয়া যাইতেছেন, তাঁহাদিগের নৌকা পরম আশ্রয়; সেইরূপ ঘোর ভগবসাগরে নিমর্জ্জন ও উন্মজ্জনশীল জীবগণের ব্রহ্মজ্ঞ সাধু-সকল পরম অবলম্বন। যেমন অন্ন প্রাণীগণের প্রাণ; যেমন আমি কাতর জনগণের প্রাণ, যেমন আমি কাতর জনগণের শরণ; যেমন ধর্ম্ম পরকালে মানবগণের ধন; সেইরূপ সাধুগণ সংসারপতনভীত পুরুষের পরিত্রাতা। সাধুসকল অশেষ চক্ষু প্রদান করেন, সূর্য্য উদিত হইয়া বাহ্য-চক্ষু প্রদান করেন; সাধুগণ অন্তশ্চক্ষু, বহিশ্চক্ষু উভয়বিধ দৃষ্টিশক্তি প্রদান করিয়া থাকেন সাধুগণই দেবতা ও বান্ধব; সাধুগণই আমি আত্মারূপে অবস্থিত।” সাধুমহিমা সাধুসঙ্গ কীর্ত্তন করিয়া শ্রীকৃষ্ণ মানুষকে সাধুসঙ্গে সচ্চিন্তায় সম্ভাবনায় অনুপ্রাণিত করিয়াছেন। সাধুসঙ্গে সৎপ্রসঙ্গে সচ্চিন্তায় যে সৎস্বরুপত্ব প্রাপ্ত হওয়া যায়; আর অসচ্চিন্তায় অসৎসঙ্গে অসৎভাবে যে বিপরীত অবস্থা প্রাপ্তি ঘটে; একটা দৃষ্টান্তে তাহা বিশদীকৃত দেখি। শ্রীমদ্ভাগবতে (একাদশ স্কন্ধ, নবম অধ্যায়) যথা,—
“যত্র যত্র মনঃ দেহী ধারয়েৎ সকলং ধিয়া। স্নেহাৎ দ্বেষাৎ ভয়াৎ বা অপি যাতি তৎ তৎ সরূপতাম্।।”
কীটঃ পেশস্কৃতং ধ্যায়ন্ কুড্যাং তেন প্রবেশিতঃ। যাতি তৎ স্সত্মতাং রাজন্ পূর্বরূপম্ অসন্ত্যজন্।।”
অর্থাৎ—“মনের সহিতই মুক্তির বা দেহীর অবস্থান্তর প্রাপ্তির সম্বন্ধ। স্নেহ, দ্বেষ, ভয় প্রভৃতি যে সকল বিষয়ে তাহার অনুধ্যান থাকে, দেহান্তেও সে তত্তৎসরূপতা প্রাপ্ত হয়। কীট যেমন পেশস্কারকে (ভ্রমর-বিশেষকে) ধ্যান করিতে করিতে তৎকর্তৃক কুড্যার (ভিত্তির) মধ্যে প্রবিষ্ট হইয়া নিরুদ্ধ অবস্থায় তাহার স্বরূপ্য প্রাপ্ত হয়; মানুষেরও সেই দশা হয়।” * সকল উপদেশের সার উপদেশ এই উপমায় নিবদ্ধ দেখি। মনই সকল অবস্থার বিধায়ক; সুতরাং চিত্তকে স্থির করিয়া যিনি আত্মার প্রতি ন্যস্ত করিতে পারেন, অর্থাৎ মন যাঁহার ভগবন্ন্যস্ত হইতে পারিয়াছে, তাঁহারই জন্ম সার্থক, জীবন সার্থক, শিক্ষা সার্থক।
ভক্তমুখে ধর্ম্মনীতি-প্রচার
বলিয়াছি তো, শ্রীকৃষ্ণের ধর্ম্মনীতি তাঁহার শিক্ষার প্রাণভূত। সুতরাং যেখানে তিনি আবির্ভূত হইয়াছেন, যেখানে তাঁহার অমৃতবাণী বিঘোষিত হইয়াছে, সেইখানেই তাঁহার ধর্ম্মনীতির আলোক-রশ্মি হৃদয়ে হৃদয়ে বিচ্ছুরিত দেখি। শ্রীমদ্ভগবদগীতার সকল অংশই ধর্ম্মনীতি-মূলক। শ্রীকৃষ্ণের দার্শনিক মত-পরম্পরা আলোচনা উপলক্ষে যে সকল অংশ উদ্ধৃত করা হইয়াছে, তাহাতেই এ বিষয় বিশদরূপে অবগত হওয়া যাইবে। ভাগবত, মহাভারত, ব্রহ্মবৈবর্ত্তপুরাণ এবং হরিবংশ প্রভৃতিতে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের যে সকল উক্তি দৃষ্ট হয়, তাহার মধ্যেও ধর্ম্মনীতি ওতঃপ্রোতঃ বিদ্যমান রহিয়াছে। মহাভারতের অনুগীতা–তদুক্ত ধর্ম্মোপদেশ-মুলক। শান্তিপর্বে যুধিষ্টিরের প্রশ্নের উত্তরে ভীষ্ম সর্ব্ববিধ ধর্ম্ম-বিষয়ে যুধিষ্ঠিরকে যে উপদেশ প্রদান করেন, সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে দর্শন করিলে, সে ও শ্রীকৃষ্ণ-কথিত ধর্ম-তত্ত্ব বলিয়া মনে করিতে পারি। কেন-না, মহাভারতে লিখিত আছে- শ্রীকৃষ্ণ ভীষ্মের শরীরে প্রবেশ করিয়া, তাঁহাকে ভক্তি ও ত্রিকাল-দর্শন-জ্ঞান দান করিয়াছিলেন। শরশয্যাশায়ী ভীষ্ম যুধিষ্ঠিরকে উপদেশচ্ছলে সকল শাস্ত্রের সার তথ্য অবগত করান। এমন কোনও উপদেশ বা এমন কোন ও শিক্ষা বোধ হয় নাই,—শরশয্যাশায়ী ভীষ্মের উক্তিতে যাহা ব্যক্ত হয় নাই। ভীষ্ম যে পরম জ্ঞানী পরম পণ্ডিত ছিলেন, তদ্বিষয়ে আদৌ সন্দেহ নাই। তথাপি মুমুর্ষু ভীষ্ম কোন শক্তি প্রভাবে জীবনের শেষ মুহূর্ত্তে তাদৃশ তত্ত্ব-কথা ব্যক্ত করিতে সমর্থ হইয়াছিলেন, তাহা ও বিবেচনার বিষয়। সে শক্তিকে শ্রীকৃষ্ণের শক্তি ভিন্ন কি বলিব ? যোগ-প্রভাবে পরদেহে প্রবেশের সামর্থ্য জন্মে। শ্রীকৃষ্ণ যোগপ্রভাবে ভীষ্মের দেহে প্রবেশ করিয়া তাঁহার মুখে ধর্ম্ম-তত্ত্ব ব্যক্ত করেন। ইহা অলৌকিক অত্যাশ্চর্য্য ব্যাপার নহে! আজকাল যোগাঙ্গের অংশ মাত্র অবলম্বন করিয়াই কত অলৌকিক ব্যাপার সম্পন্ন হইতেছে। মেসমেরিজম, হিপ্নটিজম, স্পিরিচুয়ালিজম প্রভৃতি তত্ত্বে অভিজ্ঞ ব্যক্তিগণের বিষয়ই এখানে উল্লেখ করিতেছি। মেসমেরিজম (Mesmerism ) শক্তি প্রভাবে মানুষ দেহ বিশেষে শক্তিবিশেষের সঞ্চালন করিতে সমর্থ হয় । *মৈন্মর-তত্ত্ব-বিশারদগণ (Mesmeriser) অধিবিষ্টের ( Mediumএর ) সাহায্যে অলৌকিক অমানুষিক ক্রিয়া সম্পন্ন করিয়া থাকেন। ইউরোপে, আমেরিকায়, অষ্ট্রেলিয়ায় এবং ভারতবর্ষের বিভিন্ন কেন্দ্রে তত্ত্ববিদ্যার আলোচনা হওয়ায়, অধিবিষ্ট (মিডিয়াম্) সাহায্যে পরলোকগত আত্মার আবির্ভাব অনেকে প্রত্যক্ষ করিয়াছেন; অপিচ, সেই অধিবিষ্ট ( মিডিয়াম্) অশিক্ষিত অজ্ঞজন হইলেও গভীর জ্ঞানগবেষণার পরিচয় দিতে সমর্থ হয়। তত্ত্বাধিবেশনে (seance) অধিবিষ্টের (মিডিয়ামের) সাহায্যে পরলোকগত ব্যক্তির ছায়ামূৰ্ত্তি দর্শন এবং ক্রিয়া-কলাপ দৰ্শন অধুনা একরূপ অবিসস্বাদিত। একটী প্রামাণিক ঘটনার উল্লেখ করিতেছি। + এগুরু গ্লেণ্ডিনিং বিষয়-বাণিজ্য উপলক্ষে লণ্ডনের উত্তর পশ্চিম ভাগে ডালষ্টন নামক উপকণ্ঠে বাস করিতেন। ১৯১০ খৃষ্টাব্দের ১৩ই জানুয়ারী “তাঁহার শাস্তিনিকেতন রূপ সুরম্য নিবাসে একটি তত্ত্বাধিবেশন (seance) হইয়াছিল। অনেক ভদ্রলোক ও ভদ্রমহিলা সেখানে উপবিষ্ট ছিলেন। তাঁহারা সকলেই দেখিলেন,—গ্লেণ্ডিনিঙের স্বর্গগত সহধৰ্ম্মিণী, সেখানে জড় পরমাণুতে আবৃত স্পর্শযোগ্য প্রত্যক্ষ মূৰ্ত্তিতে উপস্থিত হইয়া। একটা পার্শ্বস্থ টেবিলের পুষ্পাধান হইতে কয়েকট পুষ্প হস্ত প্রসারণ করিয়া তুলিয়া লইলেন, এবং তাহা হইতে পাঁচটি পুষ্প দ্বারা গ্লেণ্ডিনিঙকে অলঙ্কৃত করিয়া, অন্যান্য ভদ্রলোক ও ভদ্রমহিলাদিগকে একটা কিংবা দুইটা করিয়া পুষ্প উপহার দিলেন।…(গ্লেণ্ডিনিং) প্রতি মাসে দুই তিন দিন, মিডিয়ামের সাহায্যে—প্রখর আলোকে—সিয়ান্স (seance) অর্থাৎ তত্ত্বাধিবেশন করিয়া, তাঁহার স্বর্গগত পত্নী ও পুত্ৰকন্যার ছায়ামূৰ্ত্তি দর্শন করিয়া থাকেন, এবং তাঁহাদিগের হস্তস্পর্শ ও ললাট-চুম্বন-লাভে, এবং তাহাঁদিগের সহিত কথোপকথনে অন্তরে অমৃতশীতল সুখশান্তি প্রাপ্ত হন।” তত্ত্ববিদ্যা-সংক্রান্ত গ্রন্থে এ সকল বিষয়ের ভুরি ভুরি প্রমাণ পাওয়া যেতে পারে। ভারতবর্ষে এই তত্ত্ববিদ্যা- যে চরমোৎকৰ্ষ লাভ করিয়াছিল, তাহা বুঝাইবার প্রয়োজন হয় না। যে সময়ের প্রসঙ্গ উত্থাপিত হইয়াছে, তখন তত্ত্ববিদ্যার উৎকর্ষেরই দিন। যোগ-তত্ত্ববিদ্যার পূর্ণ স্ফূর্ত্তি। যোগ-প্রভাবে সকলই সম্ভব ছিল। শ্রীকৃষ্ণ পরম যোগী ছিলেন। মুমুর্ষু ভীষ্ম যে একাধারে সকল তত্ত্ব-কথার উপদেশ প্রদানে সমর্থ হইয়াছিলেন, তাহার একমাত্র কারণ,- শ্রীকৃষ্ণের প্রভাব। ভীষ্ম মৃত্যুর পূর্ব্বে শ্রীকৃষ্ণের স্মরণ অর্চ্চন বন্দন দ্বারা তদগতচিত্ত হইয়াছিলেন। তখন, যোগপ্রভাবে শ্ৰীকৃষ্ণ ভীষ্মের দেহাভ্যস্তরে প্রবেশ করিয়া তাঁহাকে ত্রিকাল-দর্শনের দিব্য-জ্ঞান প্রদান করেন। মহাভারতে(শান্তি-পর্ব) যথা,- “অধিগম্য তু যোগেন ভক্তিং ভীষ্মস্য মাধবঃ। ত্রৈলোক্যদর্শনং জ্ঞানং দিব্যং দত্ৎবা যয়ৌ হরিঃ॥ 12-46-136”
যোগ প্রভাবে ভক্তের শরীরে প্রবেশ করিয়া ভক্তবৎসল ভগবান যে আপন বিভূতি প্রকাশ করেন, ইতিহাসে এ দৃষ্টান্তের অসদ্ভাব নাই। সেদিনও মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যদেব ভক্ত রায় রামানন্দের দেহে অভির্ভূত হইয়া প্রশ্নোত্তরচ্ছলে রামানন্দের মুখে পরম তত্ত্ব বিবৃত করিয়াছিলেন। এইরূপে দেখা যায়, শ্ৰীকৃষ্ণ নিজের মুখে এবং অন্তরঙ্গগণের মুখে সকল নীতির সার নীতি-সমূহ প্রকাশ করিয়া গিয়াছেন। সুতরাং শ্ৰীকৃষ্ণ যে পরম নীতিবিৎ ছিলেন, তদ্বিষয়ে কোনই মতান্তর নাই।
শ্রীকৃষ্ণের নীতি জনহিতসাধক।
সকল প্রকার নীতির, উপদেশের বা শিক্ষার একট লক্ষ্য আছে। সে লক্ষ্য— সংসারের বা জগতের হিতসাধন। সুতরাং যে নীতির, উপদেশের বা শিক্ষার দ্বারা জগতের হিতসাধন হয়, তাহাই প্রকৃষ্ট। শ্রীকৃষ্ণের নীতির এই প্রকৃষ্টতা সৰ্ব্বতোভাবে পরিদৃষ্ট হয়। তাহাঁর নিজের জীবনেই তিনি আপন কাৰ্য্য দ্বারা আপনার প্রচারিত নীতির সার্থকতা দেখাইয়া গিয়াছেন। শ্রীকৃষ্ণের জীবন-বৃত্তান্ত আলোচনায় আমরা বুঝিতে পারি, জনহিতসাধনই তাহাঁর জীবনের প্রধান ব্রত ছিল। ধৰ্ম্ম সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার ও মূল লক্ষ্য-দুষ্কৃতের বিনাশে সজ্জনের রক্ষায় সেই জনহিতসাধন-ব্রত পালন। এখানে প্রশ্ন উঠিতে পারে, জনহিতসাধনই যদি তাঁহার লক্ষ্য ছিল, তাহা হইলে লোকক্ষয়কর যুদ্ধে প্রবৃত্ত না হইয়া অন্য প্রকারে তিনি শাস্তি-স্থাপনের চেষ্টা পাইলেন না কেন ? জনহিতসাধন উদ্দেশ্যেই প্রণোদিত জন, লোকহনন করিবেন কেন ? এ প্রশ্নের উত্তর এই যে, জনহিতসাধন উদ্দেশ্যেই লোক হনন আবশ্যক হইয়াছিল; নহিলে, অকারণ তিনি লোকক্ষয় করিবার চেষ্টা কখনও পান নাই। জরাসদ্ধ, শিশুপাল প্রভৃতি বধের দৃষ্টাস্তে এ প্রশ্নের সমাধান হইতে পারে। জরাসন্ধের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করিয়া জয়লাভ করা তৎকালে পাওবগণের পক্ষে অসাধ্য ছিল বলিলেও অত্যুক্তি হয় না। পরন্তু সে পথে অগ্রসর হইতে হইলে, বহু লোকক্ষয় সম্ভাবনা ছিল। সুতরাং শ্রীকৃষ্ণ সেখানে এক কৌশল অবলম্বন করিলেন; তাঁহার একটি উক্তিতে বা নীতিবাক্যে, তাঁহার সে কৌশলের আভাষ পাওয়া যায়। সে উক্তিটি এই, “অদ্বারেণ রিপোর্গেহং দ্বারেণ সুহৃদো গৃহান। প্রবিশন্তি নরাধীরা দ্বারাণ্যেতানি ধর্ম্মতঃ।।”
অর্থাৎ,- ‘বুদ্ধিমান্ ব্যক্তিরা শত্রুর গৃহে অদ্বার দিয়া এবং বন্ধুর গৃহে দ্বার দিয়া প্রবিষ্ট হন।’ এই উক্তির নিগূঢ় তাৎপর্য্য এই যে, শত্রুকে যুদ্ধার্থ প্রস্তুত হইবার সুবিধা না দিয়া, সহসা আক্রমণ ও বিশ্বস্ত করাই বিধেয়।
জরাসন্ধ বধ সম্বন্ধে শ্ৰীকৃষ্ণ এই নীতিরই অনুসরণ করেন। তাঁহার কৌশলক্রমেই ভীমের সহিত জরাসন্ধের মল্লযুদ্ধ আরম্ভ হয়। ভীম ও জরাসন্ধ তুল্য বীর ছিলেন। তাঁহাদের মল্লযুদ্ধ কার্ত্তিক মাসের প্রথম তিথিতে আরম্ভ হয়। ত্রয়োদশী পৰ্য্যন্ত উভয়ে দিবারাত্রি অনাহারে অবিশ্রান্ত যুদ্ধে ব্ৰতী ছিলেন। চতুর্দ্দশীর রাত্রিতে জরাসন্ধ ক্লান্ত হইয়া সংগ্রামে নিরস্ত হন। সেই সময় শ্রীকৃষ্ণের ইঙ্গিতে ভীমসেন জরাসন্ধের সংহারসাধন করেন । শ্ৰীকৃষ্ণের কৌশলে লোকক্ষয় নিবারিত হয় ; অথচ জরাসন্ধও পঞ্চত্ব প্রাপ্ত হন। শক্রনাশের সঙ্গে সঙ্গে নিরীহ সৈনিকগণ বা জনসাধারণ নিহত না হন,—এই উদ্দেশ্যে জরাসন্ধের বধে শ্ৰীকৃষ্ণের কৌশলাবলম্বন বলিয়া মনে করিতে পারি। শিশুপাল-বধে ও শ্ৰীকৃষ্ণ লোকক্ষয় বিষয়ে সাবধান ছিলেন। কালযবনের সহিত তাঁহার যে যুদ্ধ হয়, তাহাতেও তাঁহার অপূৰ্ব্ব কৌশল দেখিতে পাই। জরাসন্ধের সহিত কালযবন পুনঃপুনঃ মথুরা আক্রমণ করিয়াছিলেন। কালযবনের আক্রমণ প্রতিরোধ করিতে মথুরাবাসিগণ অসমর্থ হইয়াছিলেন। কালযবনের ভয়ে শেষে শ্রীকৃষ্ণকে আত্মীয়-স্বজন সহ দ্বারকায় আশ্রয় লইতে হয়। অথচ, বিনা লোকক্ষয়ে কেমন কৌশলে শ্রীকৃষ্ণ সেই কালযবনকে ৰধ করিয়াছিলেন! কৌশলের চরম চিত্র সেখানে প্রতিফলিত; আবার রাজনীতিজ্ঞতারও প্রকৃষ্ট দৃষ্টাস্ত সেই ঘটনায় প্রত্যক্ষীভূত। বলা বাহুল্য, শ্ৰীকৃষ্ণের সংহার-সাধন জন্য কালযবের বিশেষ চেষ্টা ছিল। শ্রীকৃষ্ণ তাহা বেশ জানিতেন। এই অবস্থায় শ্রীকৃষ্ণ একদিন কালযবনের সম্মুখ দিয়া একটা পৰ্ব্বত-গুহার দিকে একাকী পলায়ন করিলেন। একা শ্ৰীকৃষ্ণকে পৰ্ব্বত-গুহার দিকে পলাইতে দেখিয়া, কালযবন শ্রীকৃষ্ণের অনুসরণ করেন । শ্ৰীকৃষ্ণ একাকী পলায়ন করিয়াছিলেন ; সুতরাং তঁtহার অনুসরণে কালযবনের মনে কোনই দ্বিধা উপস্থিত হইল না। কালযবন একাই শ্ৰীকৃষ্ণের অনুসরণে গুহ মধ্যে প্রবেশ করিলেন। সেই গুহায় সূৰ্য্যবংশীয় রাজা মুচুকুন্দ যোগস্থ ছিলেন। গুহায় প্রবেশ করিয়াই কালযবন শ্ৰীকৃষ্ণ-ভ্রমে রাজা মুচুকুন্দকে পদাঘাত করেন। ফলে, মুচুকুন্দের কোপানলে কালঘবনকে ভস্মীভূত হইতে হয়। হরিবংশে এই ঘটনা বিশেষভাবে বিবৃত আছে । কালযবন যাহারই হস্তে মৃত্যুমুখে পতিত হউন;- শ্ৰীকৃষ্ণই তাহার সংহার সাধন করুন, অথবা মুচুকুন্দই তাহাকে ভস্মসাৎ করিয়া ফেলুন –কালযবন-বধে লোকক্ষয় নিবারণে, প্রকারান্তরে লোক রক্ষা কল্পে, শ্রীকৃষ্ণের চেষ্টা দেখা যায়। কুরুপাণ্ডবের মধ্যে সন্ধিস্থাপন-চেষ্টায় লোকক্ষয় নিবারণ পক্ষে তাহার যে একান্ত যত্ব ছিল, তাহা পূৰ্ব্বেই দেখাইয়াছি। সুতরাং তাহার মূল লক্ষ্য যে লোক রক্ষা, সমাজরক্ষা, জনহিতসাধন, তদ্বিষয়ে কোনই মতান্তর থাকিতে পারে না। তবে এ কথাও এখানে বিচাৰ্য্য যে, পুৰ্ব্বোক্ত দৃষ্টান্তে যেমন তাঁহার লোক রক্ষাকর নীতির প্রাধান্য দেখিতে পাই, অন্যত্র আবার তাহার বিপরীত দৃষ্টান্তের অসদ্ভাব নাই। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে লোকক্ষয় এবং যদুবংশের ধ্বংস-সাধন তিনি নিবারণ পক্ষে চেষ্টা করিলেন না কেন ? এ প্রশ্নের উত্তর এই যে, সজ্জনের প্রতিষ্ঠা করিতে হইলে দুৰ্জ্জনের উচ্ছেদসাধন অবশ্যম্ভাবী। ক্ষেত্ৰজাত ধান্যাদি শস্য রক্ষা করিতে হইলে, তদন্তরায়ভূত তৃণগুল্মাদি উৎপাটন একান্ত আবশ্যক। অল্পের অনিষ্টে যদি অধিকের ইষ্ট সাধিত হয়, নীতিবিদ্গণ তাহাই শ্রেয়ঃ বলিয়া মনে করেন। এইরূপে বুঝা যায় যে, শ্ৰীকৃষ্ণ পরম নীতিবিৎ ছিলেন; আর জনহিতসাধন উদ্দেশ্যেই তাঁহার নীতি বিহিত হইয়াছিল।
শেয়ার করে অন্যদের জানতে সহায়তা করুন-
You must be logged in to post a comment.