“প্রসঙ্গ- মায়াবাদ”
অধ্যাত্মবিজ্ঞানের এই শ্রেষ্ঠ মতটি হিন্দু, বৌদ্ধ ও জৈনধৰ্ম কর্তৃক জগতে প্রচারিত। সেদিনকার খ্ৰীষ্ট ও মুসলমানধৰ্ম এ মতটা হৃদয়ঙ্গম করতে অক্ষম। গ্ৰীসদেশে মহাত্মা প্লেটো ও নিজপুস্তকে এই শ্রেষ্ঠ মত প্রচার করেন। আধুনিক জড়বাদী, স্থুলদর্শী বিজ্ঞান এই মত আদৌ গ্রহন করে না; কারণ ইহার মতে তোমার অস্তিত্বের ন্যায় এই প্রত্যক্ষ পরিদৃশ্যমান জগতের অস্তিত্ব সকলের নিকট সত্য, মহাসত্য এবং কদাচ মিথ্যাজ্ঞানসম্ভুত হইতে পারে না।
বেদান্তের মায়াবাদের প্রকৃত তাৎপৰ্য্য অতীব দুরূহ। অনেক পণ্ডিত মায়াবাদ ব্যাখ্যা করার সময় দৃষ্টান্ত দেন, যেমন অন্ধকারে রজুদর্শনে সর্পভ্রম হয়, তারপরে রজ্জুজ্ঞান হইলে অলীক সর্পজ্ঞান মন হতে দূরীভূত হয়, সেইরূপ সংসারে পরমার্থ জ্ঞান হইলে সংসারের যাবতীয় মায়াজ্ঞান মন হতে দূরীভূত হয়; তখন সংসারের কোন ভেদাভেদজ্ঞান থাকে না এবং সকলই ব্ৰহ্মময় বলে বোধ হয়। তাঁহাদের মতে, ইহাই মায়াবাদের প্রকৃত তাৎপর্য্য। কিন্তু জৈন ও বৌদ্ধপণ্ডিতগণ এর ব্যাখ্যা করেন নিজের ধর্ম মত অনুসারে। যাহা হউক, এস্থলে মায়াবাদের প্রকৃত তত্ত্ব উদঘাটন করা কর্তব্য।
শাস্ত্রে মায়াশব্দ দুই প্রকার অর্থে ব্যবহৃত। ইহার প্রথম অর্থে অতিরিক্ত মোহ বুঝায়; যেমন দেহ, পুত্র, কলাত্রাদি সংসারের ক্ষণভঙ্গুর বিষয়ে মানব-মন স্বভাবতঃ মায়ায় মুগ্ধ। এ মায়াবন্ধন ছেদন করা ইহার পক্ষে অনেক সময় দুঃসাধ্য বটে, কিন্তু সংসারে বৈরাগ্য উপস্থিত হলে, ইহা অপেক্ষাকৃত সহজ সেইরূপ সংসারের যাবতীয় অনিত্য মিথ্যাজ্ঞান লাভ করতঃ পরব্রহ্মকে ভুলে গিয়ে সকল বিষয়ে আমার আমার যে মিথ্যাজ্ঞান মনে উদয় হয়, তাহাও এর মায়াজ্ঞান। শাস্ত্রোক্ত পরমহংসমার্গ অবলম্বন করিলে এ মায়াজ্ঞান দূরীভূত হইতে পারে।
মায়াশব্দের দ্বিতীয় অর্থে মহামোহ বুঝায়, যা ছেদন করা মনের পক্ষে একেবারে সম্পূর্ণরূপ অসাধ্য। পরমহংস হউন, যোগী হউন, গৃহস্থ হউন, এ মহামায়ার মহা বন্ধন মানব কোনকালে এ জগতে ছেদন করতে পারে না। যতদিন তিনি স্থুলদেহ ধারণ করিয়া ইহলোকে বা জীবনের এই সমতল ক্ষেত্রে (this plane of existence ) বাহ্যজগতের সহিত বিবিধ সম্বন্ধে সম্বদ্ধ হয়ে বিচরণ করেন, ততদিন যে মহামায়ার মহাবরণে তিনি মুগ্ধ, সে মহাবরণ তিনি কদাচ ভেদ করিতে পারেন না। এ মহামায় তাহার অস্তিত্বের মূলে সংলগ্ন। এ স্থুলদেহ সৰ্ব্বজ্ঞ মায়াতীত আত্মার মায়াদেহ মাত্র। এ মায়াদেহে নিবদ্ধ(বদ্ধ, আটকানো) হইলেই আত্মা মায়ামুগ্ধ হয় এবং বাস্তব পদার্থ বুঝতে পারে না। এ মায়াদেহ ত্যাগ করলে, ইহসংসারের যাবতীয় মায়াজ্ঞান হতে আত্মা ও নর্মুক্ত হয়। এজন্য বিশ্বব্যাপারের ঘাহা কিছু আমাদের নয়নগোচর হয়, তার সমস্তই মিথ্যাজ্ঞানসম্ভুত, তাহ সংবৃতি(লুকায়িত বা আচ্ছাদিত)মূলক (relative); কিন্তু বস্তুত: উহারা কি, উহাদের বাস্তবরূপ কি, তা আমরা অবগত নই: এবং কোনকালে অবগত হইব না।
এই যে অন্ধকারে পথে যেতে যেতে তুমি একখণ্ড রজ্জ্ব অবলোকন করতে করতে সর্পভ্রমে ভয়বিহবল হয়ে পিছনে ফিরে আস, পরে উহাকে ভালরূপ নিরীক্ষণ করাতে তোমার সর্পভ্রম দূর হয় এবং সেইসঙ্গে তোমার মনও সুস্থির হয়; এই যে রেলগাড়িতে যাইতে যাইতে তুমি চতুর্দিকস্থ বৃক্ষসমূহকে চলায়মান দেখ,পরে সামান্য পর্যালোচনা করে বুঝতে পার, যে গাড়ির গতিবশতঃ বৃক্ষ গুলি বিপরীতদিকে চলায়মান; আবার যখন তুমি ভাবতে থাক, ধরিত্রী স্বয়ং উহার পৃষ্ঠস্থ যাবতীয় পদার্থ ও চতুদিকস্থ বায়ুরাশি লয়ে আকাশপথে অসীমবেগে ভ্ৰাম্যমান, তারজন্য প্রতিদিন সূৰ্য্যকে প্রাতঃকালে, পূৰ্ব্বদিকে উদয় হতে ও পশ্চিম দিকে অস্ত যাইতে দেখ এবং রাত্রিকালে আকাশস্থ যাবতীয় নক্ষত্রমণ্ডল ধ্রুবতারার চতুর্দিকে পরিভ্রমণ করতে দেখ; এই যে একজন পথিক মরুভূমিতে যাইতে যাইতে পিপাসায় আতুর হয়ে পুরোভাগে জলাশয় দেখে এবং জলপানার্থ যেমন উহার দিকে ধাবমান হয়, অমনি জলাশয়টি আরও দূরে পলায়ন করে; এখন জিজ্ঞাসা এ সকল দৃশ্যপটল তোমার মনে কিরূপ বোধ হয় ? এরা কি তোমার মায়ামুগ্ধ মনের মায়াজ্ঞান, না এরা তোমার চোখের ভ্রান্তিদর্শন ? এরা তোমার ভ্রান্তিদর্শন মাত্র এবং কখনোই মায়াজ্ঞাম নয়। এরূপ ভ্রান্তিদর্শন উৎপাদনে যে মহামায়ার কথা উপরে লিখিত, উহার কিছুমাত্র অনুশাসন নাই। এ সকল কেবল আমাদের দর্শনশক্তির ভ্রান্তিমাত্র। অল্পমাত্র জ্ঞান লাভেই এরূপ ভ্রাস্তির দূরকরণ হয়।
কিন্তু এই যে অশ্বখ বৃক্ষটি যা বিশাল ও বহুবিস্তৃত শাখা প্রশাখা লইয়া তোমার সামনে দাড়িয়ে আছে, যার প্রতিকৃতি তোমার নয়ন অভ্যন্তরে বিপরীতভাবে প্রতিবিম্বিত এবং যার রূপ তুমি যাবজ্জীবন একরূপ দেখে থাক, ইহা তোমার মায়ামুগ্ধ মনের মায়াজ্ঞান। প্রকৃতি ঐ বৃক্ষের সাথে তোমার চক্ষু ও মনের যেরূপ সম্বন্ধ স্থিরীকৃত করিয়া দেয়, তাহাতে তুমি উহাকে চিরদিন একরূপ দেখ। আলোক যোগে বৃক্ষটির যেরূপ প্রতিবিম্ব তোমার নয়নদ্বয়ে পতিত হয়, অধ্যাসবশতঃ তুমি উহার চিরপরিচিত রূপটা নয়নগোচর কর এবং বাহ্যজগতে উহার অবস্থিতি অনুভব কর। তুমি কখনো বলতে পার না, যে উহার বাস্তবরূপ ঠিক ঐ প্রকার। আবার তুমি ঐ বৃক্ষটি যেমন দেখ, একটা পিপীলিকাও যে উহাকে ঐরূপ দেখে, তা ও তুমি বলতে পার না। এতেই কি বোধ হয় না, যে অশ্বথবৃক্ষটির জ্ঞান তোমার মায়াজ্ঞান মাত্র ? সেইরূপ এ জগতের যাবতীয় পদার্থের জ্ঞান আমাদের মায়াজ্ঞান মাত্র। এখন যে মায়ার আবরণে আবৃত হয়ে আমাদের জীবাত্মা এ সংসারে মায়াজ্ঞানলাভ করে, তাহাই মহামায়া।
মায়া দ্বারা চালিত হয়ে আমরা বিশ্ব প্রপঞ্চের যে জ্ঞানলাভ করি, তা আমাদের মায়াজনিত মিথ্যাজ্ঞান, অথচ ইহাই আবার আমাদের মায়াজনিত সত্যজ্ঞান। যতদিন আমরা মায়ায় মুগ্ধ হয়ে এই মায়াময় জগতে অবস্থান করি, ততদিন ঐ মায়াজনিত মিথ্যাজ্ঞানই আমাদের নিকট মহাসত্য জ্ঞানে পূজিত হয়। এতদ্ব্যতীত আমাদের অন্য গতি নেই। এ স্থানে জগৎ মায়াময় এবং আমরাও সকলে সমভাবে মায়ামুগ্ধ; তারজন্য আমরা কখনো ময়াজনিত জ্ঞানকে মিথ্যাজ্ঞান বলে জানতে পারি না। কিন্তু যাহারা মহামায়া হতে মুক্ত, তাঁদের নিকট আমাদের মায়াজনিতজ্ঞান মিথ্যাজ্ঞান বলিয়া বিবেচিত হয়। এখন এ সংসারে এমন লোক অতীব বিরল। পরমহংস হউন, যোগী হউন, মহামায়ার মহামোহ ভেদ করা সকলের পক্ষে সমান অসাধ্য। একমাত্র পরব্রহ্মই মায়াতীত। সেজন্য তাঁহারই নিকট আমাদের যাবতীয় জ্ঞান মিথ্যাজ্ঞান; অথবা যে সকল দেবতা অল্পাধিক মায়ামুক্ত, তাহাদের নিকটও আমাদের এ মায়াজ্ঞান মিথ্যাজ্ঞান মাত্র। দেখ, এই বিশ্বকে তুমি ও আমি যেরূপ দেখি, সকলেই ঠিক সেইরূপ দেখেন; কিন্তু ইহার বাস্তবরূপ কি, তাহা তুমিও জান না, আমিও জানি না এবং বোধ হয় দেবতারাও জানেন না।
এখন দেখা যাউক, আমরা কি প্রকারে সংসারের মায়াজ্ঞানলাভ করি। এ মন্বন্তরে (পুরাণমতে এক এক মনুর অধিকার কাল) পঞ্চেন্দ্রিয়ই মনের দ্বারস্বরূপ এবং পঞ্চেন্দ্রিয়যোগেই মন জগতের যাবতীয় জ্ঞানলাভ করে। পঞ্চেন্দ্রিয়ের মধ্যে চক্ষু আবার সর্বশ্রেষ্ঠ। পদার্থের জ্ঞানলাভে চক্ষুই সৰ্ব্বাপেক্ষ আমাদের অধিক সাহায্য করে। পঞ্চেন্দ্রিয়ের মধ্যে যদি কোন ইন্দ্রিয়ের অভাব হয়, অপরগুলি উহার অভাব পুরণ করতে চেষ্ট পায় ; যেমন অন্ধ ব্যক্তির লাঠি স্পর্শযোগে অনেকস্থানে চোখের কাজ করতে দেথা যায়।
এ সংসারে মানবমন ও চক্ষুর যেরূপ সম্বন্ধ এবং উহাদের যেরূপ প্রকৃতি, তাহাতে তুমি দর্শনশক্তি দ্বারা যাবতীয় পদার্থের একপ্রকার জ্ঞানলাভ কর। যদি কোন কারণে তোমার চক্ষুদ্বয় বিকৃত হয়, পদার্থবিশেষের জ্ঞানও তখন অন্যরূপ হয়। দেখ, গোলাপ ফুলটা তোমার চক্ষে কেমন সুন্দর ও রমণীয়! যদি তোমার চক্ষু বিকৃত হয়ে যায়, তুমি তাকে অন্যরূপ দেখ, অথবা যদি তোমার মন বিকৃত হয়ে যায়, উত্তম চক্ষু সত্ত্বেও তুমি উহাকে অন্যরূপ দেখে থাক। যখন তোমার চক্ষুদ্বয় এই সুবিস্তৃত, পরিদৃশ্যমান জগৎসমক্ষে উল্মীলিত হয় এবং তোমার মনও ঐদিকে ধাবিত হয়, তখন তুমি এর বিচিত্ররূপদৰ্শনে বিমুগ্ধ হও। চক্ষুদ্বয় নিমীলিত করে দেখ, সেই অপরূপ দৃশ্যটা তৎক্ষণাৎ তোমার মানসপট হইতে অন্তহৃত হয়ে যায় এবং জগৎও ঘোরান্ধকারে আবৃত হয়। তখনই তুমি স্পষ্টই বুঝতে পার, এ বিশ্বপ্রপঞ্চ কেবল মায়াময়।
একজন জন্মান্ধকে জিজ্ঞাসা কর, তোমার সন্মুখস্থ বৃক্ষবিশেষের বা জন্তু-বিশেষের স্বরূপ কি প্রকার ? দর্শন ব্যতীত অন্য ইন্দ্রিয়যোগে তাহার মনে ঐ পদার্থ বা জন্তুর যেরূপ জ্ঞান ও স্বরূপ হৃদয়ঙ্গম হয়, তাহাই সেই হতভাগ্য ব্যক্তি উল্লেখ করে। তুমি দণ্ডায়মান হয়ে তাহাকে জিজ্ঞাসা কর, তুমি দণ্ডায়মান আছ, কি উপবিষ্ট আছ ? তোমার বাক্য উচ্চদেশ হতে নিঃসৃত হইতেছে শ্রবণ করিয়া সে ব্যক্তি বলিয়া থাকে, তুমি দণ্ডায়মান আছ। তোমার মায়াজ্ঞান তোমার নিকট যেরূপ সত্য, তাহার মায়াজ্ঞান তাহার নিকটও সেইরূপ সত্য।
জীবজগৎ পৰ্য্যালোচনা করলে দেখতে পাওয়া যায়, অনেক নিকৃষ্টজীবে ইন্দ্রিয়গণ অতি অস্ফুটভাবে বর্তমান; এমন কি, অনেক জীবে এক বা ততোধিক ইন্দ্রিয়ের অভাব দেখা যায়; অথচ সকলেই দেহযাত্রা নিৰ্ব্বাহ উপযোগী যাবতীয় কৰ্ম সুচারুরূপে সম্পাদন করে। প্রকৃতি যাবতীয় জীবজন্তুকে স্ব স্ব অবস্থার উপযোগী করিয়া দেয়। এতে বোধ হয়, সকল জীবের মায়াজ্ঞান বিভিন্ন। যে জীব যে অবস্থায় পতিত, উহার মায়াজ্ঞান সেই অবস্থার উপযোগী। পিপীলিকা একখণ্ড মিষ্টান্ন দেখে অপর পিপীলিকাগণকে কিরূপে আহবান করে, তা আমরা অবগত নই; কেবল পিপীলিকারাই তা বুঝিতে পারে।
তত্ত্ববিদ্যা উপদেশ দেয়, এক এক মন্বস্তরে মানবের এক একটা ইন্দ্রিয় স্ফুরিত; সেজন্য প্রত্যেক মন্বন্তরে তাহার মায়াজ্ঞানও বিভিন্ন। এখন আমরা এই কাৰ্য্যকারণাত্মক বিশ্বের যেরূপ জ্ঞানলাভ করি, পূৰ্ব্ব পূৰ্ব্ব মম্বন্তরে মনুপুত্ৰগণ বোধ হয় অন্তপ্রকার জ্ঞানলাভ করিয়া যান। স্বায়ম্ভব মন্বন্তরে যে মায়াজ্ঞান প্রচলিত, চাক্ষুস মন্বন্তরে তা বিভিন্ন এবং বৈবস্বত মন্বন্তরে তা আরও বিভিন্ন। এস্থলে জড়বিজ্ঞান সাহঙ্কারে যে উপদেশ দেয়, চিরদিন ভৌতিক শক্তি একরূপ, তা আমরা কখনো গ্রহন করিতে পারি না।
অদ্বৈতবাদী বৈদাস্তিক পণ্ডিতদিগের মতে যা সৎ, তা মায়াতীত এবং যা অসৎ, তা মায়াবিশিষ্ট। একমাত্র পরব্রহ্মই সৎ বা সত্যস্বরূপ, এজন্য তিনি বেদে ওঁ তৎসৎ ও সচ্চিদানন্দ বলিয়া কথিত। এই বিশ্ব প্রপঞ্চ মায়াময়, এজন্য ইহা অসৎ, ক্ষণে ক্ষণে ইহা পরিবৰ্ত্তিত এবং ইহাতে ত্রিগুণের অনন্তলীলা প্রকাশিত।
বিশিষ্টাদ্বৈতবাদীদিগের মতে এই কাৰ্য্যকারণত্মক বিশ্বপ্রপঞ্চ, যা আমাদের চৰ্ম্মচক্ষের সমক্ষে প্রত্যক্ষীভূত, তাহাই সৎ বা সত্যস্বরূপ; আর যে সকল বিষয় প্রত্যক্ষ হয় না, তাহাই অসৎ বা মিথ্যা। সৎ ও অসৎ এই দুইটা শব্দের তাৎপর্য্যে এত পার্থক্য থাকায়, সমগ্র হিন্দু শাস্ত্রে যে কত গোলযোগ উপস্থিত, তা এস্থলে বর্ণন করবার “আবশ্যকতা নাই। পরব্রহ্মের মহামায়া দুরত্যয়া। ইহার অনুশাসন পরিহার করা জীবের অসাধ্য।
ত্রিভির্গুণময়ৈর্ভাবৈরেভিঃ সর্ব্বমিদং জগৎ ।
মোহিতং নাভিজানাতি মামেভ্যঃ পরমব্যয়ম্ ॥১৩॥
দৈবী হ্যেষা গুণময়ী মম মায়া দুরত্যয়া ।
মামেব যে প্রপদ্যন্তে মায়ামেতাং তরন্তি তে ॥১৪॥ (শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা সপ্তম অধ্যায়)
“মায়ার ত্রিগুণে সমস্ত জগৎ বিমুগ্ধ, তজ্জন্ত গুণাতীত, মায়াতীত অবিনশ্বর পরমাত্মা যে আমি, অমাকে কেহ জানিতে পারে না। আমার এই গুণময়ী দৈবী মায়া লোকে অতিকষ্টে পরিহার করে। কেবল যাঁহারা আমাকে প্রাপ্ত হন, তাহারাই আমার এই মায়া হইতে উত্তীর্ণ হন।”
যে মহাত্মা অসাধারণ যোগবলে সমাধিস্থ হইয়া মায়ামুগ্ধ দেহের চব্বিশ তত্ত্বের ক্রমশঃ লয় সাধন করতঃ পরব্রহ্মের সহিত নিজ আত্মার মিলন করতে পারেন, তিনিই সমাধির অবস্থার মায়া হতে বিচ্যুত হন। সমাধি ভঙ্গ হলেই তিনি ও পূৰ্ব্বের ন্যায় মায়াবিশিষ্ট অবস্থা প্রাপ্ত হন। কলিযুগের কয়জন লোক সেরূপ যোগাভ্যাস করতে পারেন, বল ? অৰ্দ্ধঘণ্টার জন্য নিমীলিতাক্ষ হইয়া এক প্রাণে, একধ্যানে ঈশ্বরে চিত্ত সমাহিত করতে পারলে, যে তুমি সমাধিস্থ হয়ে মায়ামুক্ত হও, তা কখনো মনে করিও না। চব্বিশতত্ত্বের লয়সাধন করে প্রকৃত সমাধিস্থ হওয়া কত সাধনাসাপেক্ষ, তা মহাত্মাগণই জানেন।
জীবাত্মা মহামায়া দ্বারা অনস্ত কাল চালিত। কেবল যে ইহসংসারে জীবাত্মা ইহাদ্বারা চালিত, এমন নহে; অন্যান্য লোকে ও জীবাত্মা ইহাদ্বারা সম্যক পরিচালিত। যখন নিজ কৰ্ম্মফল কর্তৃক চালিত হয়ে জীব জীবনের বিবিধাবস্থাপন্ন ভিন্ন ভিন্ন সমতলক্ষেত্রে বা ভিন্ন ভিন্ন লোকে পরিভ্রমণ করে, তখনও ইহা এই মহামায়া দ্বারা চালিত হইয়া ভিন্ন ভিন্ন জ্ঞানলাভ করতে থাকে ও ভিন্ন ভিন্ন সুখ ও দুঃখ ভোগ করতে থাকে। যুগযুগান্তরে, কল্পকল্লান্তরে কোটি কোটি বৎসরের পর শিক্ষা ও সংযম দ্বারা ক্রমোন্নত হয়ে যখন জীবাত্মা পরব্রহ্মে মিলিত হয়ে নিৰ্ব্বাণপদ প্রাপ্ত হয়, তখনই ইহা মহামায়া হইতে একেবারে বিমুক্ত হয়। তদ্ভিন্ন সকল লোকে ও সকল অবস্থায় জীবাত্মা মায়া হইতে অব্যাহতি প্রাপ্ত হয় না এবং সুখদুঃখরূপ মহাবৰ্ত্তে পতিত হইয়া ঘুর্ণায়মান হয়।
[ভগবৎতত্ত্ব কি, কিরূপে তদ্গত-চিত্ত হওয়া যায় – শ্রীভগবান্ স্বয়ং এই অধ্যায়ে তাহা বলিতেছেন ।]
শ্রীভগবান্ বলিলেন – হে পার্থ, ভক্ত সর্বতোভাবে আমার শরণাগত হইয়া (অগ্নিহোত্রাদি যজ্ঞ, দান বা তপস্যাদি কর্মের ফলাশ্রয় না করিয়া) আমাতে মনোনিবেশ-পূর্বক যোগাভ্যাস করিলে বিভূতি, বল, শক্তি ও ঐশ্বর্যাদিসম্পন্ন পুর্ণস্বরূপে (সগুণ ও নির্গুণরূপে) আমাকে নিঃসংশয়ে যেরূপে জানিতে পারিবে, তাহা শ্রবণ কর । ১
অপরোক্ষ অনুভূতির সহিত মদ্বিশয়ক এই জ্ঞান নিঃশেষে তোমাকে উপদেশ দিব । স্বানুভূতির সহিত তাহা লাভ করিলে সংসারে আর অন্য কিছু জ্ঞাতব্য অবশিষ্ট থাকে না । ২
You must be logged in to post a comment.