সংক্ষেপে শিবলিঙ্গ পূজা বিধি


লিঙ্গপুরাণ সপ্তবিংশ অধ্যায় এ শিব লিঙ্গপূজার বিধি উল্লেখ পাওয়া যায়-
শৈলাদি বললেন, আমি সংক্ষেপে লিঙ্গপূজা বিধি বলছি শ্রবণ কর। বিস্তারপূর্বক বললে শতবর্ষেও সমাপ্তি হয় না। এই প্রকার যথাবিধি স্নানান্তে পূজা স্থানে প্রবেশপূর্বক প্রাণায়ামত্রয় করে দেবত্র্যম্বকের ধ্যান করবে, পঞ্চবক্ত্র দশভুজ, শুদ্ধস্ফটিক সদৃশ শুক্লবর্ণ সকল প্রকার অলঙ্কারে ভূষিত বিচিত্র বসন পরিধান মহাদেবের এইরূপ রূপ চিন্তা করে দহনাদি (বহ্নিবীজাদি) দ্বারা শৈবীতনু (শিবশরীর) স্বয়ংও অবলম্বন পূর্বক মহেশ্বরকে পূজা করবে। এইরূপে দেহ শুদ্ধ করে মূলমন্ত্র ক্রমে ন্যাস করবে। সর্বত্র প্রণবযোগে ব্ৰহ্মমন্ত্র ন্যাস করা বিধেয়। পুজাবিষয়ে নমঃশিবায় এই পরম শুভ। ঐ সূত্রে ছন্দ (বেদ) আর মন্ত্রগণ সূক্ষ্মরূপে স্থিতি করেন। সূক্ষ্ম বটবীজে শাখাপ্রশাখাশালী বটবৃক্ষের সূক্ষ্মরূপে অবস্থিতির ন্যায় অতি শোভন মহৎ ও কারণ স্বরূপ পঞ্চাক্ষর ক্ষুদ্রমন্ত্রে ব্রহ্ম স্বয়ং সূক্ষ্মবৎ অবস্থিত আছেন।১-৭।
গন্ধচন্দনজল দ্বারা পুজাস্থান মার্জন প্রক্ষালন, প্রোক্ষণাদি দ্বারা পূজা পাত্ৰ শুদ্ধি করবে। ক্ষালন ও প্রোক্ষণকর্মে প্রণব পাঠ বিহিত আছে। ধীমান্‌ বিপ্ৰ, প্রোক্ষণীপাত্র, অর্ঘ্যপাত্র, পাদ্যপাত্র ও আচমনীয়াৰ্থ কল্পিত পাত্র অবগুণ্ঠন (নির্জল) করে যথাবিধি রাখবে। পরে সে সকল পাত্র কুশ দ্বারা আচ্ছাদন ও জল দ্বারা প্রোক্ষণ করতে হয়। অনন্তর সকল পাত্রে সুশীতল জল দিবে। বুদ্ধিমান ব্যক্তি, প্রণব উচ্চারণপূর্বক বক্ষ্যমাণ দ্রব্য সকল রাখবে। উশীর (বেণার মূল) চন্দন পাদ্যপাত্রে, জায়ফল কক্কোল কর্পূর অনন্তমূল ও মানচূর্ণ করে আচমনীয় পাত্রে স্থাপন করবে, এইরূপ সকল পাত্ৰেতে দিয়ে লেপনার্থ চন্দন কর্পূর ও বিবিধ পুষ্প পাত্রান্তরে স্থাপন করবে।৮–১৪।
কুশাগ্ৰ, অক্ষত, যব, ব্রীহি, তিল, গব্যঘৃত সিদ্ধার্থ (শ্বেতসর্ষপ) ভস্ম এই সকল দ্রব্য অর্ঘ্যপাত্রে রাখবে। কুশ পুষ্প যব ব্রীহি বহুমূল (অনন্তমূল) অমাল ও ভষ্ম প্রণব দ্বারা প্রেক্ষিণী পাত্রে রাখবে। পঞ্চাক্ষর রুদ্রগায়ত্রী বা বেদসার কেবল প্রণব ন্যাস করবে। অনন্তর প্রোক্ষণীপাত্রস্থ জলদ্বারা প্রণব ও ঈশানাদি পঞ্চমন্ত্র পাঠ করে সমুদায় পূজোপকরণ প্রোক্ষণ করতে হয়। দেবদেবের দক্ষিণ পার্শ্ব দীপ্ত অগ্নির সদৃশ ত্রিনেত্র ত্ৰিদশেশ্বর কালচক্র-মুকুট হরি চক্ৰ চতুর্ভূজ পুষ্পমাল্যধর, সর্বাভরণ ভূষিত এইরূপ নন্দী আদিষ্ট আমাকে অর্চনা করবে।১৫-২০।
উত্তর পার্শ্বে আমার পবিত্র সুযশানাম্নী ভাৰ্য্যা ও মরুতের শুভা সব্রতানাম্নী পত্নী অম্বার (দুর্গার) পাদমণ্ডনতৎপরা এই উভয়কে পূজা করে পরমেষ্ঠী মহাদেবের গৃহমধ্যে প্রবেশানন্তর দেবদেবের পঞ্চ মস্তকে ঈশানাদি পঞ্চমন্ত্র দ্বারা ভক্তিভাবে পঞ্চ পুষ্পাঞ্জলি প্রদান করে, গন্ধপুষ্প ধুপ আর দ্বিবিধ উপচার দ্বারা শঙ্করকে পূজা করে কাৰ্ত্তিক, গণেশ ও দেবীপূজনন্তর লিঙ্গশুদ্ধি মস্তক হতে নির্মাল্য অপসারণ করবে। প্রণবাদি নমোহস্তক সকল মন্ত্ৰ জপান্তে প্রণবপাঠপূর্বক পদ্মাসন কল্পনা করবে। ২১—২৪।
সেই পদ্মের পুর্বদিকস্থ পত্র অক্ষর (অবিনাশী) সাক্ষাৎ অনিমাময় দক্ষিণ পত্র, লঘিমাময় পশ্চিম পত্র, মহিমাময় উত্তর পত্র, প্রাপ্তিময় বহ্নি কোন প্রাকাম্য নৈঋত পত্র, ঈশিত্ব বায়ুকোণে বশিত্ত্ব, ঈশান পুত্ৰ সর্বজ্ঞত্ব, পদ্মকর্ণিকা চন্দ্রমণ্ডল, চন্দ্রের অধোদেশে সূর্যমণ্ডল, সূর্যের অধঃ সাক্ষাৎ অগ্নি। ধর্মাদি (ধর্ম, জ্ঞান, বৈরাগ্য, ঐশ্বর্য) বিদিকে (অগ্ন্যাদি চার কোণে) ক্রমে অনন্তাদি কল্পনা। পুর্বাদি দিক্‌ চতুষ্টয়ে) অব্যক্তাদি (অব্যক্ত, মহত্তত্ত্ব, অহঙ্কার ও চিত্তরূপ) সোমের অন্তে গুণত্রয় (সত্ত্বঃ রজঃ তমঃ) তার উর্দ্ধে তিন সূক্ষ্মতত্ত্ব (বিশ্ব, তৈজস, প্রাজ্ঞ,) তার অন্তে (উপরি) শিবপীঠ (শিবাসন) ঐ পীঠে সদ্যোজাতং প্রপদ্যামি, এই মন্ত্র দ্বারা পীঠোপরি স্থাপন, রুদ্রগায়ত্রী দ্বারা সান্নিধ্যকরণ, অঘোর মন্ত্রপাঠে নিরোধ করে, ঈশান মন্ত্র দ্বারা পূজা করবে। পাদ্য, আচমনীয় ও অর্ঘ্য বিভুকে প্রদান করবে, গন্ধ ও চন্দনযুক্ত জল দ্বারা যথাবিধি রুদ্রকে স্নান করাবে। যথাবিধানে পাত্রে পঞ্চগব্য রেখে মন্ত্রপূর্বক শোধনান্তে তা দ্বারা প্রণব পাঠপূর্বক যথাবিধি স্নান করাবে। আজ্য মধু তথা ইক্ষুরস আর পবিত্র অন্যান্য দ্রব্য দ্বারা প্রণব পাঠপুর্বক মহাদেবকে অভিষেক করবে, পবিত্র জলপুর্ণ ভাণ্ড দ্বারা মন্ত্রোচারণ পূর্বক জল মহেশ্বরমস্তকোপরি ক্ষেপণ করবে। ২৫–৩৪।
ঐ জল অগ্রে শুক্ল বস্ত্র দ্বারা সাধকগণ শোধন করে নিবে। ঐ জল কুশ, অপমাৰ্গ, কর্পূর জাতি, কবরীর ও শুক্ল পুষ্প মল্লিক, কমল, উৎপল, ও চন্দনাদি সুগন্ধি দ্রব্য দ্বারা পূর্ণ করবে, জলোপরি সদ্যোজাতাদ মন্ত্র পাঠ করা বিধিসিদ্ধ। তাম্ৰপাত্র পদ্মপত্র ও পলাশপত্র রচিত পাত্র, শঙ্খ, মৃন্ময় ও শুভপাত্র সকূর্চ্চৎ ও সপুষ্প ঐ সকল পাত্রদ্বারা মন্ত্ৰপুর্বক স্বানে বিহিত। তোমাকে স্নানমন্ত্ৰ বলছি, ঐ সকল মন্ত্ৰ সর্বার্থসিদ্ধিহেতু হয়, শ্রবণ কর।৩৫- ৩৯।
যে সকল মন্ত্র দ্বারা স্নান করালে মনুষ্য মুক্ত হয়, হে মন্ত্রজ্ঞ মানবগণ! পবমানমন্ত্র, তথা সমীয়কমন্ত্র, রুদ্রমন্ত্র, নীলরুদ্র, শুভশ্রী সূক্ত, রজনীসূক্ত, শুভ ভারুগু, চমক মন্ত্র; শিব শুভ আথর্ব, শাস্তি, পুনঃ শাস্তি, আরণ্য, বারুশ, জ্যেষ্ঠ বেদব্রত, পুণ্য পুরুষসূক্ত, ত্বরিত রুদ্র, বাপি,
শতঋক, শিব পঞ্চব্রহ্ম, সূত্র ও কেবল প্রণব এই সকল মন্ত্র দ্বারা সকলপাপনাশ জন্ত দেবদেব শিবকে স্নান কুরাবে; পরে বস্ত্র, যজ্ঞোপবীত তথা আচমনীয়, গন্ধ, পুষ্প, ধূপ, দীপ, ও অন্ন ক্রমে দিবে এবং সুগন্ধি জল ও পুর্ন আচমনীয় দান করবে। ৪০-৪৭।
মুকুট, শুভচ্ছন্ন (রত্নালঙ্কার) ও অন্যান্য ভূষণ প্রণব পাঠে দিবে, মুখবাসাদি তাম্বূলও দান করবে। অনন্তর স্ফটিক সদৃশ শুক্লবৰ্ণ, নিষ্কল, অবিনাশী দেবগণের কারণস্বরূপ শিব সর্বলোকময় ব্ৰহ্মা, বিষ্ণু, রুদ্রাদি, ঋষিগণ অন্যান্য দেবগণ বেদবিদগণ ও বেদান্তের অগোচর শ্রুতি এই কথা কহে। এবং আদি, মধ্য, অন্ত-রহিত ভবরোগীর ভেষজ স্বরূপ শিবলিঙ্গস্থিত শিব বলে কথিত হয়, উহাকে প্রণব দ্বারা শিবলিঙ্গের মস্তকে পূজা করবে। স্তব, যথাবিধি জপ, নমস্কার ও প্রদক্ষিণ করবে। অনন্তর বিশেষার্ঘ্য দান করে চরণদ্বয়ে পুষ্পাঞ্জলি দানানন্তর প্রণিপাতান্তে স্বহৃদয়ে শিবকে আনয়ন করবে, এইরূপ উত্তম সংক্ষেপে শিবলিঙ্গার্চনবিধি কথিত হল। অদ্য আমি তোমার নিকট আভ্যন্তরপূজাবিধি বলছি।৪৮-৫৪।