উত্তরঃ– দমের পরিমান অনুসারে যেমন ঘড়ি অল্প বা অধিক সময় চলে দম শেষ হলে বন্ধ হয়ে যায়, তেমনি দুষ্কৃতির দম যার যত অধিক, দেহের স্থায়িত্বের জন্য দুঃখের বেগ তাকে তত অধিক কাল ভোগ করতে হয়।সুবিধার মধ্যে এই যে কর্ম ইন্দ্রিয় না থাকায় ঐ সময় নূতন কর্মের সঞ্চার হয় না এজন্য সঞ্চিত কর্রমের ফল ভোগ শেষ হলেই ঐ দেহটি বিনষ্ট হয়ে যায়।
শ্রাদ্ধ, প্রেতাত্মার তৃপ্তির জন্য পিতৃগণ বা সপ্তর্ষি মণ্ডলীর উদ্দেশ্যে করা হয়।
এখন গৌণ বা সাধারণ শ্রাদ্ধের দ্বারা কিভাবে দেহীর তৃপ্তি লাভ হয় তা শ্রবণ কর। শ্রাদ্ধ কর্তার দ্বারা এই শ্রাদ্ধ, প্রেতাত্মার তৃপ্তির জন্য পিতৃগণ বা সপ্তর্ষি মণ্ডলীর উদ্দেশ্যে করা হয়। কেননা এই সপ্তর্ষিগণ(সপ্তর্ষি মণ্ডলীকেই পিতৃগণ, শ্রাদ্ধ এনাদের উদ্দেশ্যই করতে হয়,(হরিবংস) সপ্তমস্তর বিশিষ্ট ভূব লোকের নিয়ামক বা অধিষ্ঠাতৃ দেবতা। ডাক বাক্সে পত্র ফেললে যেমন পোষ্টমাষ্টার তা ঠিকানায় পৌছে দেন, তেমনি শ্রদ্ধা পূর্বক ভোজনাদির দ্বারা ব্রাহ্মণগণকে তৃপ্ত করলে পিতৃগণ সন্তুষ্ট হয়ে সেই তৃপ্তি প্রেতাত্মার উদ্দেশ্যে চালনা করেন; ব্রাহ্মণগণের তৃপ্তির সাথে সপ্তর্ষিগণের তুষ্টির সম্বন্ধ এই যে, ঋষিগণ জ্ঞান শক্তির ঘণীভূত প্রকাশ স্বরূপ, ব্রাহ্মণগণ জ্ঞানী এবং জ্ঞান অখণ্ড; সুতরাং ব্রাহ্মণগণের অভ্যন্তরস্থ জ্ঞান শক্তির তৃপ্তির সপ্তর্ষিগণও তুষ্ট হন, এবং এই জন্যই এত লোক থাকতে শ্রাদ্ধে ব্রাহ্মণ ভোজন করানোর নিয়ম। জ্ঞানী সত্ত্বগুণান্বিত ব্যক্তি ভিন্ন ভোজনাদির দ্বারা তৃপ্তিলাভ করতে পারে না (শ্রাদ্ধ মন্ত্রে ব্রাহ্মণদের মধ্যে যে দেবতাগণকে আহবান করা হয় তা এই সত্ত্বগুণের উদ্রেক করার জন্য।), কেননা যাদের লালসা অত্যন্ত প্রবল, তারা জড় বুদ্ধিতে ভোজন করে ফলে প্রকৃত তৃপ্তির আস্বাদ লাভে বঞ্চিত হয় আকন্ঠ ভোজন করেও মনে করে উদর গহ্বর আর একটু বড় হলে ভাল হত, সুতরাং গুরু ভোজনের জন্য আহারান্তে শারিরীক যাতনার ছট্ফট্ করে; তৃপ্তি তাদের কাছেও আসিতে পারে না। অতএব হাজার ব্যক্তির মধ্যে যদি একজনও প্রকৃত ব্রাহ্মণকে ভোজন করানো যায় তাহলে প্রেতাত্মার তৃপ্তি লাভ সম্বন্ধে সন্দেহ থাকে না, কিন্তু প্রেতাত্মাকে তৃপ্ত করবার লক্ষ্য স্থির রেখে এই ভোজন আন্তরিক শ্রদ্ধা পূর্বক করাতে হয়, কারণ পত্র পাঠাতে যেমন তাতে টিকিট যুক্ত করতে হয়; তেমনি শ্রদ্ধাযুক্ত কর্মের দ্বারা এই তৃপ্তি চালিত হয়। কেননা সে দেশে বেয়ারিং তৃপ্তির চলন নাই।
বর্তমান সময়ে দেখতে পাই যে অধিকাংশ শ্রাদ্ধই ফাঁকা আওয়াজের মতো নিস্ফল হয়। শ্রদ্ধা ও তৃপ্তির দিকে কারও লক্ষ্য থাকে না, পুরোহিতের লক্ষ্য অর্থের দিকে ও শ্রাদ্ধ কর্তার লক্ষ্য বৃথা আড়ম্বরের দ্বারা যাতে লোকের কাছে মান বজায় থাকে। সুতরাং পুরোহিত ও যজমান উভয়েরই অজ্ঞানরূপ আলেয়ার অনুসরণ করে বিপথগামী হয়, অতএব এমন অবস্থায় যখন গৌণ বা সাধারণ শ্রাদ্ধই হয়ে উঠে না, তখন মুখ্য বা অসাধারণ শ্রাদ্ধ সম্বন্ধে আলোচনা করাই বিড়ম্বনা, কিন্তু সুকৃতির আকর্ষণে যখন তুমি জিজ্ঞাসু হয়েছ তখন শ্রবণ কর।
হরিবংসের অষ্টাদশ অধ্যায়ে উল্লেখ আছে যে, সপ্তম স্তর বিশিষ্ট ভূব লোকের নিয়ামক স্বরূপ যে সপ্তজন ঋষি আছেন তাঁদের মধ্যে চারজন শরীরী ও তিন জন অশরীরী। সাধারণ শ্রাদ্ধে শরীরী ঋষিদের ও অসাধারণ শ্রাদ্ধে অশরীরী ঋষিদের সাহায্য আবশ্যক হয়। ঋষি ধাতুর অর্থ গতি-শক্তি বা পরোক্ষ জ্ঞান-শক্তি প্রসূত তৃপ্তির চালক বা গতি শক্তি স্বরূপ, এবং তারহীন অথবা মানসিক টেলিগ্রামের মতো সুক্ষ্মের সাহায্যে যে চৈতন্যগর্ভ শব্দ বা ভাব শক্তির চালনা হয় অশরীরী ঋষি শক্তি বা অপরোক্ষ জ্ঞান তার গতি শক্তি স্বরূপ, এই ঋষি শক্তি জ্ঞান উপহিত চৈতন্যের স্তর-ভেদে প্রকাশ ভেদ মাত্র, এবং এই জন্যই সাধকদের হৃদয়ে এই শক্তির প্রকাশ হলে তাঁরা জ্ঞান ভূমির উর্দ্ধস্তরে আরোহণ করে ক্রমে চৈতন্য ভূমিতে উপনীত হন।
শ্রাদ্ধের মন্ত্র শব্দ হতে, শব্দ কম্পন হতে ও কম্পন বা ভাব শক্তি হতে উৎপন্ন, সুতরাং শক্তিই মন্ত্রের মূল, কেবল ছন্দ অনুসারে শুদ্ধ উচ্চারণ করলে যখন এর শক্তির ক্রিয়া দেখা যায়, তখন মন্ত্রের স্বরূপ জেনে তাতে ভাব যুক্ত করলে যে তা অমোঘ হবে সে বিষয়ে কি সন্দেহ হতে পারে?
বেদ, বাইবেল প্রভৃতি সকল শাস্ত্রই শব্দকে ব্রহ্মশক্তির আধার স্বীকার করেন এবং আধুনিক জড় বিজ্ঞানও শব্দ-শক্তি প্রমাণিত হয়েছে, সুতরাং শব্দ শক্তিগর্ভ এবং চৈতন্যের অধ্যাস ভিন্ন সমষ্টিতে এই শক্তির বেগবৃদ্ধি অর্থাৎ প্রকাশাধিক্য হয় ও তার সাথে ভাব যুক্ত হলে পূর্ণ প্রকাশ হয়। অল্পসংখ্যক শৃঙ্খলাযুক্ত সৈন্য জাতিয়ভাবে অনুপ্রাণিত হয়ে যুদ্ধ করলে যেমন বহুসংখ্যক বিশৃঙ্খল সৈন্যকে পরাজয় করতে পারে তেমনি শঙ্খলাযুক্ত শব্দ সমষ্টির ভাবযুক্ত বিন্যাস মহান শক্তির জনক স্বরূপ এবং তারই নাম মন্ত্র, অতএব এই মন্ত্রের স্বরূপ ও ক্রিয়া অবগত হয়ে লক্ষ্যে প্রয়োগ করলে সফলতা অবশ্যম্ভাবী জানিও।
শক্তির দ্বারাই শক্তির প্রয়োগ হয়, ধনু শক্তির সাহায্যে হস্তশক্তি যেমন বাণশক্তিকে লক্ষ্য স্থানে নিয়ে যায় তেমনি শ্রদ্ধাশক্তির সাহায্যে ঋষি বা জ্ঞান-শক্তি শব্দ ও ভাবময় চৈতন্য শক্তিকে লক্ষ্যস্থলে নিয়ে যায়।
পূর্বে বলেছি যে মনোময় কোষস্থ মলিনতার উপাদানে আতিবাহিক বা যাতনা দেহ গঠিত হয়, ধুয়ায় মলিন চিম্নি মধ্যে স্তিমিত আলোর মতো অপ্রকাশ ভাবে এই দেহের মধ্যে চৈতন্যাংশ বিদ্যমান থাকে, অতএব চিম্নি মধ্যস্থ আলোক অধিক উদ্দীপিত হলে যেমন ঐ চিম্নিটি ফেটে যায় তেমনি শ্রাদ্ধ কর্তা জ্ঞানশক্তির দ্বারা শ্রদ্ধার পথে চৈতন্য শক্তিকে প্রয়োগ করে প্রেতাত্মার আতিবাহিক দেহস্থ চৈতন্যাংশের উদ্দীপনা করে দেন ও তার ফলে দেহটি নষ্ট হওয়ায় দেহী ঐ ভাঙা পিঞ্জর হতে উদ্ধার পেয়ে উর্দ্ধলোকে গমন করে। জ্ঞানী সাধক ভিন্ন এই মুখ্য বা অসাধারণ শ্রাদ্ধ অপরে করতে পারেনা, এবং এই জন্যই শাস্ত্র বলেন যে বংসে একজন সুপুত্র জন্মালে- মোদন্তি পিতরো, নৃত্যন্তি দেবতা, সনাথা চেয়ং ভূর্ভবতি।
পিতৃগণ আনন্দ করেন, দেবতা গণ নৃত্য করেন, বন্ধুরা মনে করেন
'আামি এতদিন অনাথ ছিলাম, আজ আমি সন্যাথা হইয়াছি'
শেয়ার করে অন্যদের জানতে সহায়তা করুন-
You must be logged in to post a comment.