প্রশ্নঃ- অজ্ঞানী ব্যক্তিরা যেমন আপন কর্ম অনুয়ায়ি ভূব লোকের বিভিন্ন স্তরে যাতনার কমবেশি ভোগ করে, জ্ঞানীদের কি সেরকম ফলভেদ হয় না?


উত্তরঃ– অবশ্যই হয়, জ্ঞানীগণ আপন জ্ঞানের পরমান অনুসারে জন ও মহ লোকের বিভিন্ন স্তরে সুখ শান্তির কমবেশি ভোগ করেন, আবার যাঁদের চৈতন্য অনুভূতি হয়েছে, তাঁরা সেই অনুভূতির পরিমান অনুসারে চৈতন্যভূমির বিভিন্ন স্তরে আনন্দের কমবেশি সম্ভোগ করেন, তবে চৈতন্যভূমির প্রথম স্তরে উন্নীত হলে বাধা বিঘ্নের সম্ভাবনা না থাকায় তাঁরা দ্রুতবেগে চরম লক্ষ্যে উপনীত হন।

ক্রমশঃ

সৎ প্রসঙ্গ-সকল আত্মাই কি উর্দ্ধলোকে গমন করে ? শুনেছি গয়ায় পিণ্ড দিলে প্রেতাত্মা উদ্ধার হয়, এটা গৌণ বা মূখ্য কোন শ্রাদ্ধের অন্তঃর্গত?


উত্তরঃ– যার স্বলোকের উপযোগী কর্মফল সঞ্চিত থাকে, সে স্বলোকে গমন করে, নতুবা ভূলোকে ভূমিষ্ট হয়।

গয়ায় পিণ্ড দান- এটা মুখ্য শ্রাদ্ধের অন্তঃর্গত, অপরোক্ষ জ্ঞান শক্তির অভাবে যারা এই শ্রাদ্ধের প্রয়োগ তত্ত্ব জানেনা তারা স্থির বিশ্বাস পূর্বক প্রেতাত্মার যাতনা দেহ বিনাসের জন্য শ্রীভগবানের উপর নির্ভর করে। শ্রীভগবানকে আমৃমোক্তার নামা দেওয়ায় তাঁর কৃপায় ঐ কার্য সাধিত হয়, তাঁর শ্রীচরণ সংস্পর্শে পিণ্ড সকল চৈতন্যময় হয়ে প্রেতাত্মার যাতনা দেহ বিনষ্ট করে দেয়, তবে স্থল বিশেষে গয়ায় পিণ্ড দান সত্ত্বেও যে প্রেতাত্মার উদ্ধার হয় না, পিণ্ডদাতার নির্ভরহীন সংযমই তার কারণ মাত্র জেনো।

সৎ প্রসঙ্গ- মুখ্য শ্রাদ্ধের দ্বারা যাতনা দেহটি বিনষ্ট না হলে কতদিন দুঃখ ভোগ করতে হয় ?


উত্তরঃ– দমের পরিমান অনুসারে যেমন ঘড়ি অল্প বা অধিক সময় চলে দম শেষ হলে বন্ধ হয়ে যায়, তেমনি দুষ্কৃতির দম যার যত অধিক, দেহের স্থায়িত্বের জন্য দুঃখের বেগ তাকে তত অধিক কাল ভোগ করতে হয়।সুবিধার মধ্যে এই যে কর্ম ইন্দ্রিয় না থাকায় ঐ সময় নূতন কর্মের সঞ্চার হয় না এজন্য সঞ্চিত কর্রমের ফল ভোগ শেষ হলেই ঐ দেহটি বিনষ্ট হয়ে যায়।

শ্রাদ্ধ, প্রেতাত্মার তৃপ্তির জন্য পিতৃগণ বা সপ্তর্ষি মণ্ডলীর উদ্দেশ্যে করা হয়।

এখন গৌণ বা সাধারণ শ্রাদ্ধের দ্বারা কিভাবে দেহীর তৃপ্তি লাভ হয় তা শ্রবণ কর। শ্রাদ্ধ কর্তার দ্বারা এই শ্রাদ্ধ, প্রেতাত্মার তৃপ্তির জন্য পিতৃগণ বা সপ্তর্ষি মণ্ডলীর উদ্দেশ্যে করা হয়। কেননা এই সপ্তর্ষিগণ(সপ্তর্ষি মণ্ডলীকেই পিতৃগণ, শ্রাদ্ধ এনাদের উদ্দেশ্যই করতে হয়,(হরিবংস) সপ্তমস্তর বিশিষ্ট ভূব লোকের নিয়ামক বা অধিষ্ঠাতৃ দেবতা। ডাক বাক্সে পত্র ফেললে যেমন পোষ্টমাষ্টার তা ঠিকানায় পৌছে দেন, তেমনি শ্রদ্ধা পূর্বক ভোজনাদির দ্বারা ব্রাহ্মণগণকে তৃপ্ত করলে পিতৃগণ সন্তুষ্ট হয়ে সেই তৃপ্তি প্রেতাত্মার উদ্দেশ্যে চালনা করেন; ব্রাহ্মণগণের তৃপ্তির সাথে সপ্তর্ষিগণের তুষ্টির সম্বন্ধ এই যে, ঋষিগণ জ্ঞান শক্তির ঘণীভূত প্রকাশ স্বরূপ, ব্রাহ্মণগণ জ্ঞানী এবং জ্ঞান অখণ্ড; সুতরাং ব্রাহ্মণগণের অভ্যন্তরস্থ জ্ঞান শক্তির তৃপ্তির সপ্তর্ষিগণও তুষ্ট হন, এবং এই জন্যই এত লোক থাকতে শ্রাদ্ধে ব্রাহ্মণ ভোজন করানোর নিয়ম। জ্ঞানী সত্ত্বগুণান্বিত ব্যক্তি ভিন্ন ভোজনাদির দ্বারা তৃপ্তিলাভ করতে পারে না (শ্রাদ্ধ মন্ত্রে ব্রাহ্মণদের মধ্যে যে দেবতাগণকে আহবান করা হয় তা এই সত্ত্বগুণের উদ্রেক করার জন্য।), কেননা যাদের লালসা অত্যন্ত প্রবল, তারা জড় বুদ্ধিতে ভোজন করে ফলে প্রকৃত তৃপ্তির আস্বাদ লাভে বঞ্চিত হয় আকন্ঠ ভোজন করেও মনে করে উদর গহ্বর আর একটু বড় হলে ভাল হত, সুতরাং গুরু ভোজনের জন্য আহারান্তে শারিরীক যাতনার ছট্‌ফট্‌ করে; তৃপ্তি তাদের কাছেও আসিতে পারে না। অতএব হাজার ব্যক্তির মধ্যে যদি একজনও প্রকৃত ব্রাহ্মণকে ভোজন করানো যায় তাহলে প্রেতাত্মার তৃপ্তি লাভ সম্বন্ধে সন্দেহ থাকে না, কিন্তু প্রেতাত্মাকে তৃপ্ত করবার লক্ষ্য স্থির রেখে এই ভোজন আন্তরিক শ্রদ্ধা পূর্বক করাতে হয়, কারণ পত্র পাঠাতে যেমন তাতে টিকিট যুক্ত করতে হয়; তেমনি শ্রদ্ধাযুক্ত কর্মের দ্বারা এই তৃপ্তি চালিত হয়। কেননা সে দেশে বেয়ারিং তৃপ্তির চলন নাই।

বর্তমান সময়ে দেখতে পাই যে অধিকাংশ শ্রাদ্ধই ফাঁকা আওয়াজের মতো নিস্ফল হয়। শ্রদ্ধা ও তৃপ্তির দিকে কারও লক্ষ্য থাকে না, পুরোহিতের লক্ষ্য অর্থের দিকে ও শ্রাদ্ধ কর্তার লক্ষ্য বৃথা আড়ম্বরের দ্বারা যাতে লোকের কাছে মান বজায় থাকে। সুতরাং পুরোহিত ও যজমান উভয়েরই অজ্ঞানরূপ আলেয়ার অনুসরণ করে বিপথগামী হয়, অতএব এমন অবস্থায় যখন গৌণ বা সাধারণ শ্রাদ্ধই হয়ে উঠে না, তখন মুখ্য বা অসাধারণ শ্রাদ্ধ সম্বন্ধে আলোচনা করাই বিড়ম্বনা, কিন্তু সুকৃতির আকর্ষণে যখন তুমি জিজ্ঞাসু হয়েছ তখন শ্রবণ কর।

হরিবংসের অষ্টাদশ অধ্যায়ে উল্লেখ আছে যে, সপ্তম স্তর বিশিষ্ট ভূব লোকের নিয়ামক স্বরূপ যে সপ্তজন ঋষি আছেন তাঁদের মধ্যে চারজন শরীরী ও তিন জন অশরীরী। সাধারণ শ্রাদ্ধে শরীরী ঋষিদের ও অসাধারণ শ্রাদ্ধে অশরীরী ঋষিদের সাহায্য আবশ্যক হয়। ঋষি ধাতুর অর্থ গতি-শক্তি বা পরোক্ষ জ্ঞান-শক্তি প্রসূত তৃপ্তির চালক বা গতি শক্তি স্বরূপ, এবং তারহীন অথবা মানসিক টেলিগ্রামের মতো সুক্ষ্মের সাহায্যে যে চৈতন্যগর্ভ শব্দ বা ভাব শক্তির চালনা হয় অশরীরী ঋষি শক্তি বা অপরোক্ষ জ্ঞান তার গতি শক্তি স্বরূপ, এই ঋষি শক্তি জ্ঞান উপহিত চৈতন্যের স্তর-ভেদে প্রকাশ ভেদ মাত্র, এবং এই জন্যই সাধকদের হৃদয়ে এই শক্তির প্রকাশ হলে তাঁরা জ্ঞান ভূমির উর্দ্ধস্তরে আরোহণ করে ক্রমে চৈতন্য ভূমিতে উপনীত হন।

শ্রাদ্ধের মন্ত্র শব্দ হতে, শব্দ কম্পন হতে ও কম্পন বা ভাব শক্তি হতে উৎপন্ন, সুতরাং শক্তিই মন্ত্রের মূল, কেবল ছন্দ অনুসারে শুদ্ধ উচ্চারণ করলে যখন এর শক্তির ক্রিয়া দেখা যায়, তখন মন্ত্রের স্বরূপ জেনে তাতে ভাব যুক্ত করলে যে তা অমোঘ হবে সে বিষয়ে কি সন্দেহ হতে পারে?

বেদ, বাইবেল প্রভৃতি সকল শাস্ত্রই শব্দকে ব্রহ্মশক্তির আধার স্বীকার করেন এবং আধুনিক জড় বিজ্ঞানও শব্দ-শক্তি প্রমাণিত হয়েছে, সুতরাং শব্দ শক্তিগর্ভ এবং চৈতন্যের অধ্যাস ভিন্ন সমষ্টিতে এই শক্তির বেগবৃদ্ধি অর্থাৎ প্রকাশাধিক্য হয় ও তার সাথে ভাব যুক্ত হলে পূর্ণ প্রকাশ হয়। অল্পসংখ্যক শৃঙ্খলাযুক্ত সৈন্য জাতিয়ভাবে অনুপ্রাণিত হয়ে যুদ্ধ করলে যেমন বহুসংখ্যক বিশৃঙ্খল সৈন্যকে পরাজয় করতে পারে তেমনি শঙ্খলাযুক্ত শব্দ সমষ্টির ভাবযুক্ত বিন্যাস মহান শক্তির জনক স্বরূপ এবং তারই নাম মন্ত্র, অতএব এই মন্ত্রের স্বরূপ ও ক্রিয়া অবগত হয়ে লক্ষ্যে প্রয়োগ করলে সফলতা অবশ্যম্ভাবী জানিও।

শক্তির দ্বারাই শক্তির প্রয়োগ হয়, ধনু শক্তির সাহায্যে হস্তশক্তি যেমন বাণশক্তিকে লক্ষ্য স্থানে নিয়ে যায় তেমনি শ্রদ্ধাশক্তির সাহায্যে ঋষি বা জ্ঞান-শক্তি শব্দ ও ভাবময় চৈতন্য শক্তিকে লক্ষ্যস্থলে নিয়ে যায়।

পূর্বে বলেছি যে মনোময় কোষস্থ মলিনতার উপাদানে আতিবাহিক বা যাতনা দেহ গঠিত হয়, ধুয়ায় মলিন চিম্‌নি মধ্যে স্তিমিত আলোর মতো অপ্রকাশ ভাবে এই দেহের মধ্যে চৈতন্যাংশ বিদ্যমান থাকে, অতএব চিম্‌নি মধ্যস্থ আলোক অধিক উদ্দীপিত হলে যেমন ঐ চিম্‌নিটি ফেটে যায় তেমনি শ্রাদ্ধ কর্তা জ্ঞানশক্তির দ্বারা শ্রদ্ধার পথে চৈতন্য শক্তিকে প্রয়োগ করে প্রেতাত্মার আতিবাহিক দেহস্থ চৈতন্যাংশের উদ্দীপনা করে দেন ও তার ফলে দেহটি নষ্ট হওয়ায় দেহী ঐ ভাঙা পিঞ্জর হতে উদ্ধার পেয়ে উর্দ্ধলোকে গমন করে। জ্ঞানী সাধক ভিন্ন এই মুখ্য বা অসাধারণ শ্রাদ্ধ অপরে করতে পারেনা, এবং এই জন্যই শাস্ত্র বলেন যে বংসে একজন সুপুত্র জন্মালে- মোদন্তি পিতরো, নৃত্যন্তি দেবতা, সনাথা চেয়ং ভূর্ভবতি।

পিতৃগণ আনন্দ করেন, দেবতা গণ নৃত্য করেন, বন্ধুরা মনে করেন 
'আামি এতদিন অনাথ ছিলাম, আজ আমি সন্যাথা হইয়াছি'

সৎ প্রসঙ্গ-কর্মভোগ যদি শেষ হয়ে যায়, তবে আবার কোন কর্মের জন্য ভূলোকে জন্ম গ্রহণ করি?


উত্তরঃ- নদীর অগনিত তরঙ্গের মধ্যে একটি তরঙ্গ বিলীন হলে যেমন আর একটি তার স্থান দখল করে, তেমনি জীবের হৃদয় আধারে কর্ম সংস্কারের বহুস্তর আছে। একটি স্তরের কর্ম ভোগ শেষ হলে তার স্থান পরবর্তি স্তরের দ্বারা পূর্ণ হয় এবং এই কর্ম সংস্কারই জীবকে জন্মমৃত্যুর শৃঙ্খলে আবদ্ধ করে ভূভূর্বস্বয়ের ঘুর্ণিপাকে ঘুরিয়ে বেড়ায়। ফল নষ্ট হলেও যেমন তার বীজের মধ্যে অগনিত বীজ সূক্ষ্মভাবে থাকে। আবার সেই সকল বীজ অপর বীজ সকলের জনক হয়। তেমনি একটি স্তরের কর্মফল জীর্ণ হওয়া মাত্র তার মধ্যস্থ কর্ম বীজ অঙ্কুরিত হয়ে পুনরায় ফল প্রসব করে। সাধনের দ্বারা হৃদয়ে জ্ঞান অগ্নি প্রজ্জ্বলিত করাই এই সকল বীজ নষ্ট করার এক মাত্র উপায়। অতিরিক্ত তাপে যেমন বীজের উৎপাদিকা শক্তি নষ্ট হয়ে যায়, তেমনি জ্ঞান অগ্নির প্রখর তাপে কর্ম সংস্কারের বীজ গুলি ঝলসে যায়। আর তাদের জনন শক্তি থাকে না এবং এই জন্মই গীতায় ভগবান বলছেনঃ-

যথৈধাংসি সমিদ্ধোহগ্নির্ভস্মসাৎ কুরুতেহর্জ্জুন।
জ্ঞানাগ্নি সর্ব্বকর্ম্মাণি ভস্মসাৎ কুরুতে তথা।।৪/৩৭

অর্থাৎ আগুন দ্বারা যেমন কাষ্ঠ ভস্ম হয় তেমনি জ্ঞানাগ্নির দ্বারা কর্ম সংস্কারের বীজ গুলি দগ্ধ হয়ে যায়।
এখানে তোমার মূল প্রশ্নের বিষয় শ্রবণ কর, অজ্ঞানে দেহত্যাগ করলে ভূ ভূর্ব স্বয়ের মধ্যে আবদ্ধ থেকে ক্রমাগত জন্ম মৃত্যুর জরা ব্যাধির তাড়না সহ্য করতে হয়; সুকৃতি ও দুষ্কৃতি জনিত ক্ষণস্থায়ী সুখ দুঃখের ঘাত প্রতিঘাতে নিষ্পেষিত হওয়ায় জীব প্রকৃত শান্তি ও নির্মল আনন্দ সম্ভোগ করতে পায় না, কিন্তু সাধন বলে যাঁর অজ্ঞান অন্ধকার বিদূরিত হয়েছে, যিনি দেবযান অবলম্বন পূর্বক ভূ ভূর্ব স্বয়ের ঘুর্ণিপাক অতিক্রম করে জ্ঞান ভূমিস্থ ক্রমমুক্তির সোপানে আরোহণ করেছেন, নিত্য ও অবিছিন্ন চিন্দানন্দময় চৈতন্য ভূমিতে উন্নীত হয়ে চিদঘন শ্রীভগবানকে লাভ করার আকুল আকঙ্খায় যাঁর হৃদয় পূর্ণ, কেবল সেই মহাত্মাই শ্রীভগবানের কৃপায় দ্রুত অগ্রসর হন ও জ্ঞানের স্তরদ্বয় অতিক্রম পূর্বক মহামুক্তি লাভ করে মায়াতীত শিবত্বে অধিষ্ঠিত হন। নচেৎ কেবল জ্ঞানই যাঁর লক্ষ্য, তিনি চতুর্থ বা পঞ্চম স্তরে আবদ্ধ হয়ে পড়েন। মায়ার নির্মল অংশের অন্তর্গত হওয়ায় যদিও এই দুই স্তরে দুঃখের হৃদয় শোষক তাপ নেই কিন্তু সুখের জোয়ার ভাটা আছে এবং দ্রুত ও শোচনীয় অধঃপতনের সম্ভাবনা না থাকলেও কালগর্ভে পতন ভয় নিহিত থাকে। কেননা চরম লক্ষ্যে সৃষ্টি সংযুক্ত না থাকায় কালে জ্ঞান অভিমানের আকর্ষণে দৃষ্টি নিম্ন অভিমুখীন হয় ও পুনরায় স্বয়ের স্তরে আবনীত হয়ে ঘুর্ণিপাকের অন্তর্গত হয়ে পড়ে।

এখন বোধ হয় স্তর সম্বন্ধে কতকটা বুঝেছে, সাধন বলে দেহ ভাণ্ডের যে স্তর পর্যন্ত মনকে উন্নত করা যায়, দেহান্তে সাধক ব্রহ্মাণ্ডের সেই স্তরে উপনীত হয়ে তার উপযোগি দেহ ধারণ করেন, জীবের শরীর পঞ্চকোষময়; অন্নময়, প্রাণময়, মনোময়, বিজ্ঞানময় ও আনন্দময়। মনোময় কোষটি মধ্যস্থলে অবস্থিত, মন নিন্মমুখী হয়ে অন্নময় ও প্রাণময় কোষে সংযুক্ত থাকলে অজ্ঞান এবং উর্দ্ধমুখী হয়ে বিজ্ঞানময় কোষে সংযুক্ত হলে জ্ঞান ও আনন্দময় কোষে সংযুক্ত হলে চৈতন্যময় হয়ে যায়।

আগেই বলেছি যে শ্রাদ্ধ অজ্ঞানীদের জন্য, এবং সংসারে অধিকাংশ ব্যক্তিই অজ্ঞানের অন্তঃর্গত, কেননা লক্ষ্যের মধ্যে একজন প্রকৃত জ্ঞানী পাওয়া যায় কিনা সন্দেহ, অজ্ঞানীরা নিজ নিজ দূষ্কৃতির পরিমান অনুসারে অল্প বা অধিক কাল যাতনাময় আতিবাহিক দেহের মধ্যে আবদ্ধ থেকে ভুব লোকের নিম্ন বা উর্দ্ধস্তরে পরিভ্রমণ করে; অতএব এই দেহটি নাশ করে তা হতে তাদেরকে উদ্ধার করাই শ্রাদ্ধের মূল উদ্দেশ্য; মূখ্য শ্রাদ্ধে এই উদ্দেশ্য আশু ফলবতী হয় এবং গৌণ শ্রাদ্ধে সাময়িক তৃপ্তির দ্বারা সামান্য উন্নতি হয় মাত্র। এক্ষণে এই দেহটি কিভাবে প্রস্তুত হয় ও শ্রাদ্ধের দ্বারা কেন তার তৃপ্তি বা নাশ হয় তা শ্রবণ কর।

পিতৃযানগামিদের দেহত্যাগ হলে তার কোষ পঞ্চভূতে ও প্রাণময় কোষ মহাপ্রাণে বিলীন হয়ে যায়। দেহী তখন মনোময় কোষে আবদ্ধ হয়ে সুক্ষ্ম শরীর ধারণ করে, এই শরীরের নাম আতিবাহিক দেহ, কর্ম ভেদে এই দেহের গঠন ভেদ ও গঠন ভেদে যাতনা ভেদ হয়; যাঁর মনের মধ্যে সাংসার আশক্তি প্রবল, কামাদি রিপু ও কুবৃত্তি জনিত লালসার মালিন্য অধিক পরিমাণে বিদ্যমান থাকে, দেহান্তে তার মনোময় কোষস্থিত ঐসকল মলিনতা উপাদান স্বরূপ হয়ে একটি যাতনাময় দেহ পিঞ্জর গঠনের কারণ হয়। দেহী তখন ঐ পিঞ্জরে আবদ্ধ হয়ে প্রতিপলে নরক যন্ত্রনা উপভোগ করে। জীবদ্দশায় জ্ঞান লাভের চেষ্টা না করায় সুক্ষ্ম দেহ ধারণ করেও তার সুক্ষ্মতত্ত্বের ধারণা করার শক্তি থাকে না, অথচ স্থুল জড়ীয় ভোগ বাসনার তীব্র আকর্ষণ বশতঃ ঐ সকল কাম্যবস্তু ইচ্ছা মাত্রই সামনে পেয়েও কর্ম ইন্দ্রিয় না থাকায় ভোগ করতে পারে না। দুর্জয় পিপাশা! কিন্তু সামনে শীতল জল থাকতেও পান করতে পারে না, ক্ষুধার জ্বালায় অস্থির! অথচ ইচ্ছা মাত্র নানাবিধ সুখাদ্য সামনে পেয়েও খেতে পারে না; কামদেবের শরে জর্জরিত! অথচ সামনে পরমা সুন্দরী রমণিদের আকুল আহবান সত্ত্বেও তাদেরকে স্পর্শ করতে পারে না, সুতরাং অতৃপ্ত লালসার তীব্র কষাঘাতে জর্জরিত হতে থাকে; ফলে দেহী আপন দুষ্কৃতি ভেদে নানা প্রকার যাতনার আক্রমণে উদ্‌ভ্রান্ত হয়ে আশান্ত প্রাণে ক্রমাগত ছুটাছুটি করে। ভূলোকের সাতটি স্তরে যেমন মানুষ, পশু, পাখি প্রভৃতি ভিন্ন ভিন্ন প্রাণীর সুখ দুঃখের অনুভুতি বিভিন্ন প্রকার, সূক্ষ্ম দেহীদের নিজ নিজ দুষ্কৃতি জনিত মালিন্যের পরিমান অনুসারে তেমনি ভূব লোকের ভিন্ন ভিন্ন স্তরে বিভিন্ন প্রকার দুঃখ ভোগ করে। গৌণ শ্রাদ্ধ চালিত তৃপ্তির দ্বারা এই দুঃখের অপেক্ষাকৃত শান্তি ও মূখ্য শ্রাদ্ধ চালিত চৈতন্য শক্তির দ্বারা দুঃখের আধার স্বরূপ দেহটি বিনষ্ট হওয়ায় দুঃখেরও নিবৃত্তি হয়।

শ্রীহরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়।