ভগবান, ইষ্ট ও গুরুতত্ত্ব


ভগবান, ইষ্ট ও গুরুতত্ত্ব
ভগবান, ইষ্ট ও গুরু এই তিন তত্ত্ব মিলে অনেক সম্প্রদায় অনেক সাধনের ব্যবস্থা দেখা যায়। সুতরাং এই তিন তত্ত্ব সম্বন্ধে একটু আলোচনা অত্যাবশ্যক। ভগবান্‌ সর্ব্বব্যাপী সচ্চিদানন্দ স্বরূপ। যাঁর থেকে বা যাতে জগৎ সৃষ্ট, পরিণত বা বিবর্ত্তিত, যিনি আমাদের সমস্ত সত্তার, শক্তির, জ্ঞানের আনন্দের মূল প্রশ্রবন, সেই ভগবান্‌ যেন একটি বিস্তৃত গালিচা, মায়ার চাদর গায়ে দিয়ে জগৎ-জীব রূপে প্রতীয়মান হয়েছেন। আমরা মায়ার আবরণের ভিতর দিয়ে তাকে দেখতে পাই না। এখন যদি কোনো জায়গায় চাদরটা একটু ছিঁড়ে যায়, তবে সেই ছেঁড়া স্থান দিয়ে আমরা গালিচার কতটুকু অংশমাত্র দেখতে পাব! সেই দেখতে পাওয়া অংশটুকু সর্ব্বতোভাবে গালিচার অনুরূপ-যদিও সীমাবদ্ধ; আর সেই সীমা গালিচার নয়, চাদরের গায়ে ছেঁড়া অংশ। এই যে সাধক ভক্তের নিকট ভগবানের সীমাবদ্ধ সচ্চিদানন্দ ভাবে পূর্ণ প্রকাশ, তাই ঈষ্টতত্ত্ব। যাঁর ভিতরে ভগবানের সব লক্ষণ বর্ত্তমান তিনি সীমাবদ্ধ রূপে প্রতীয়মান হন আমাদেরই পূর্ণ দর্শনের অভাবে। যিনি ইষ্ট, অভিলষিত, প্রার্থিত, যাঁকে দেখলে আর দেখার কিছু বাকী থাকে না, যাঁকে পেলে আর পাওয়ার কিছু বাকী থাকে না, যিনি আমার সমস্ত অভাব পূরণ করে আমাকে তৃপ্ত, শান্ত, পূর্ণ করতে পারেন তিনি আমার ইষ্ট। যেমন চাদরখানা যত ছেঁড়া যাবে গালিচা ততই অধিকতর ব্যাপকরূপে দেখা দিবে, তেমনি ইষ্টের ধ্যানে আমরা যতই সমাহিত হব, ততই তাঁর ব্যাপকতা ফুটে বের হবে। এজন্য সাধনরাজ্যে সীমাবদ্ধ ইষ্টতত্ত্বের লক্ষণে “নমস্তে জগদ্ব্যাপিকে বিশ্বমূর্ত্তে” আদি ভাবের সমাবেশ দেখতে পাওয়া যায়। যেমন ভূগোলে সমস্ত পৃথিবীর ধারনা করার জন্য সীমাবদ্ধ মানচিত্রে দূরত্বের পরিমাণ লিখে দেওয়ায় জ্ঞানলাভের সাহায্য হয়, অথচ পৃথিবীকে সীমাবদ্ধ করা হয় না, তেমনই ইষ্টকে ধারণার সুবিধার জন্য সীমাবদ্ধ রূপে চিত্রিত ও কল্পিত করলেও তাঁর সর্ব্বব্যাপিত্বে বাধা হয় না।
যিনি সর্ব্বশক্তিমান্‌, তিনিই জীবের উপলব্ধির সুবিধার জন্য সীমাবদ্ধ ভাবে সীমাবদ্ধ চিত্তে প্রতীয়মান হতে পারেন না বলিয়া আমরা যে সর্ব্বশক্তিমান্‌কে কতটা সীমাবদ্ধ করে ফেলি তাহাও চিন্তনীয়। ঈষ্টতত্ত্ব আদর্শপ্রাপ্ত নরনারী রূপে বা তত্ত্বরুপে আগত ও শ্রীভগবানের সীমাবদ্ধ ভাবরূপে অনুভূত। ইষ্টতত্ত্ব ভগবৎ-তত্ত্বেরই আংশিক ভাবের অনুভূতি। প্রত্যেক ইষ্টতত্ত্ব অনন্ত সৌন্দর্য্য-মাধুর্য্য দ্বারা চিত্তাকর্ষক। অনন্ত শক্তিগুণ-প্রেম-জ্ঞানাদি দ্বারা জীবের চালক। যিনি পরম করুণাময় বলে জীবের দুঃখে বিগলিত-হৃদয়, -যাঁর শারীরিক, মানসিক, আধ্যাত্মিক বৃত্তিগুলি পূর্ণরূপে পরিণত ও অপূর্ব্ব সামঞ্জস্যযুক্ত। যিনি সমস্ত জীবের সমস্ত অভাব দূর করে পূর্ণতা লাভের অনন্ত আনন্দ লাভের সহায়ক। এক কথায় জীবের পূর্ণ আদর্শ। এই ইষ্টতত্ত্ব অবতার ভাবে বর্ণিত। অবতার বহু প্রকার- পূর্ণ অবতার, অংশ অবতার, গুণাবতার, শক্তি অবতার ইত্যাদি। এর মধ্যে কালী তারা আদি শক্তিরুপে এবং রাম কৃষ্ণ আদি জীবভাবে অবতাররূপে প্রসিদ্ধ। যে অবতার যাঁর নিকট অনুকূল, চিত্তাকর্ষক ও পূর্ণতাপ্রাপ্ত মনে হবে তিনিই হবেন তাহার ইষ্ট।
 
গুরুতত্ত্ব ঈষ্টতত্ত্বের প্রতিমূর্ত্তি বা প্রতীক; সংযত শুদ্ধ শান্ত হওয়ার ফলে যাঁর ভিতরে নিত্যসিদ্ধ ইষ্টতত্ত্ব প্রায় পূর্ণভাবে প্রকটিত, যাঁর কথা ভাব এবং কাজের মধ্যে দিয়ে ইষ্টতত্ত্বের প্রায় পূর্ণভাবে স্ফুরণ উপলব্ধ হয় তিনিই আমার গুরু। ভগবানের অসীম ভাবের ধারনা করা কঠিন বলে ইষ্টতত্ত্বের ব্যবস্থা হয়েছে, আবার ইষ্টতত্ত্বও সুলভ নয় বলে গুরুতত্ত্বের প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করা হয়েছে। যাতে সাধন-রাজ্যে বিকৃতি না ঘটে এজন্য এই তিন তত্ত্ব মিলিয়ে দেখার ব্যবস্থা আছে। উপনিষদ্‌ বেদান্ত আদি গ্রন্থে উল্লেখিত ভগবৎ-তত্ত্বের সব লক্ষণগুলি ইষ্টতত্ত্বের সাথে মিলিয়ে দেখতে হবে। যে পর্য্যন্ত ভগবৎ-তত্ত্বের সঙ্গে ইষ্টতত্ত্বের লক্ষণগুলি সুন্দরভাবে মিলে না যাবে, সে পর্য্যন্ত মনে করতে হবে, আমি আমার ইষ্ট হবার যোগ্য নন। যাঁর ভিতর দিয়ে ইষ্ঠতত্ত্বের অবাধিত স্ফুরণের সম্ভাবনা নেই- মনে রাখতে হবে, তিনি আমার গুরু হবার উপযুক্ত নন। গুরুই ইষ্টের প্রতীক, ইষ্ট ভগবানের প্রতীক; গুরু পৌছিয়ে দিবেন ইষ্টের কাছে, ইষ্টের ভিতর দিয়ে আমরা পৌঁছাব ভগবানের কাছে । যাঁরা গুরু ও ইষ্টের সাহায্য ব্যতীত ভগবানকে উপলব্ধি করতে চেষ্টা করেন, দেহধারীর পক্ষে তাঁদের পন্থাটা অনেকটা কঠিন বলেই ভক্তিমার্গ ঈষ্ট ও গুরুতত্ত্বের দিকে এতটা দৃষ্টি রেখেছে।
তথ্যসূত্র- পূজা-শ্রীচুনীলাল সান্যাল।
সংকলনে- কৃষ্ণকমল।

শ্রীশ্রী গুরু প্রণাম মন্ত্র (অর্থ সহ)


(দ্বি-প্রহর ও সন্ধ্যাবেলায়)
ওঁ অজ্ঞান-তিমিরান্ধস্য জ্ঞানাঞ্জন-শলাকয়া।
চক্ষুরুন্মীলিতং যেন তস্মৈ শ্রীগুরবে নমঃ।। ১
মন্ত্রঃ সত্যং পূজা সত্যং সত্যং দেবো নিরঞ্জনঃ।
গুরোর্বাক্যং সদা সত্যং সত্যমেব পরং পদম্।।২
অখন্ড-মন্ডলাকারং ব্যাপ্তং যেন চরাচরম্।
তত্পদং দর্শিতং যেন তস্মৈ শ্রীগুরবে নমঃ।।৩
পিতৃমাতৃ-সুহৃদ্বন্ধু-বিদ্যা-তীর্থানি দেবতা।
ন তুল্যং গুরুণা শীঘ্রং স্পর্শয়েৎ পরমং পদম্।।৪
গুরুর্ব্রহ্মা গুরুর্বিষ্ণুঃ গুরুর্দেবো মহেশ্বরঃ।
গুরুরেব পরং ব্রহ্ম তস্মৈ শ্রীগুরবে নমঃ।।৫
ধ্যানমূলং গুরোমূর্ত্তিঃ পূজামূলং গুরোঃ পদম্।
মন্ত্রমূলং গুরোর্বাক্যং মোক্ষমূলং গুরোঃ কৃপা।।৬
ব্রহ্মানন্দং পরম-সুখদং কেবলং জ্ঞানমূর্ত্তিম্।
দ্বন্দ্বাতীতং গগন-সদৃশং তত্ত্বমস্যাদি-লক্ষ্যম্।।
একং নিত্যং বিমলমচলং সর্ব্বদা সাক্ষিভূতম্।
ভাবাতীতং ত্রিগুণ-রহিতং সদ্গুরুং তং নমামি।।৭
ত্বমেব মাতা চ পিতা ত্বমেব।
ত্বমেব বন্ধুশ্চ সখা ত্বমেব।
ত্বমেব বিদ্যা দ্রবিণং ত্বমেব।
ত্বমেব সর্ব্বং মম দেবদেব।।৮
অর্থঃ
যিনি অজ্ঞান-অন্ধকারাচ্ছন্ন শিষ্যের চক্ষু জ্ঞানাঞ্জন-শলাকা দিয়া খুলিয়া দেন, সেই শ্রীগুরুদেবকে ভক্তিভরে প্রণাম করি।১
মন্ত্র সত্য, পূজা সত্য, দেব নিরঞ্জনও সত্য; শ্রীগুরুদেবের বাক্যও সর্ব্বদা সত্য বলিয়া জানিবে এবং সেই পরমপদও সত্য।২
যাঁহার দ্বারা অখন্ড-মন্ডলাকার এই চরাচর বিশ্ব পরিব্যাপ্ত রহিয়াছে, তাঁহার শ্রীপাদপদ্ম যিনি দর্শন করাইয়া দেন, সেই শ্রীগুরুদেবকে পুনঃ পুনঃ প্রণাম করি।৩
এই জগতে পিতামাতা, সুহৃৎ-বন্ধু, বিদ্যাবুদ্ধি, তীর্থসমূহ এবং দেবদেবী কেহই শ্রীগুরুদেবের সমতুল্য হইতে পারে না; যেহেতু শ্রীগুরুদেবই একমাত্র সেই পরম ব্রহ্মপদ শীঘ্র লাভ করাইয়া দিতে পারেন।৪
শ্রীগুরুদেবই ব্রহ্মা, গুরুই বিষ্ণু, গুরুই দেব মহেশ্বর, শ্রীগুরুই পরব্রহ্ম স্বরূপ; সেই শ্রীগুরুদেবকে পুনঃ পুনঃ ভক্তিভরে প্রণাম করি।৫
শ্রীগুরুমূর্ত্তিই সর্ব্বদা ধ্যান করা কর্ত্তব্য, শ্রীগুরুদেবের শ্রীপাদপদ্মই সর্ব্বদা পূজা করা উচিত, শ্রীগুরুদেবের বাক্যই মন্ত্র-স্বরূপ এবং শ্রীগুরুকৃপাই মুক্তি বা মোক্ষ লাভের একমাত্র উপায়।৬
যিনি ব্রহ্মানন্দ-স্বরূপ, পরম সুখদানকারী, নিলির্প্ত, জ্ঞান-মূর্ত্তি-স্বরূপ, যিনি সুখদুঃখাদি দ্বন্দ্বের অতীত, গগনসদৃশ উদার, ‘তত্ত্বমসি’ প্রভৃতি মহাবাক্যের লক্ষ্য-স্বরূপ, যিনি এক, নিত্য, বিমল, অচল, সর্ব্বদা সমস্ত কিছুর সাক্ষীস্বরূপ, ভাবাতীত ও ত্রিগুণাতীত, সেই পরব্রহ্মরূপী শ্রীশ্রীসদ্গুরুকে ঐকান্তিক ভক্তিভরে প্রণাম করি।৭
হে গুরুদেব, তুমিই আমার মাতা, তুমিই আমার পিতা, তুমিই বন্ধু, তুমিই সখা। তুমিই আমার বিদ্যাবুদ্ধি, তুমিই আমার ধনৈশ্বর্য্য সবই; শুধু তাহাই নয়, হে আমার প্রাণদেবতা, তুমিই আমার জীবনের যথাসর্বস্ব।৮
(এইভাবে শ্রীশ্রীসদ্গুরুর শ্রীচরণে সম্পূর্ণরূপে আত্মসমর্পণই প্রণাম মন্ত্রের যথার্থ অর্থ)
সংগৃহীত- নিবেদনে শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা স্কুল

শ্রীগুরুপরম্পরা


Image result for vaishnava guru parampara

কৃষ্ণ হৈতে চতুর্ম্মুখ, হন কৃষ্ণসেবোন্মুখ,
ব্রহ্মা হৈতে নারদের মতি ।
নারদ হৈতে ব্যাস, মধ্ব কহে ব্যাস-দাস,
পূর্ণপ্রজ্ঞ পদ্মনাভ গতি ॥

নৃহরি মাধব-বংশে, অক্ষোভ্য পরমহংসে,
শিষ্য বলি অঙ্গিকার করে ।
অক্ষোভ্যের শিষ্য জয়- তীর্থ নামে পরিচয়,
তাঁর দাস্যে জ্ঞানসিন্ধু তরে ॥

তাঁহা হৈতে দয়ানিধি, তাঁর দাস বিদ্যানিধি,
রাজেন্দ্র হইল তাঁহা হৈতে ।
তাঁহার কিঙ্কর জয়- ধর্ম্ম নামে পরিচয়,
পরম্পরা জান ভালমতে ॥

জয়ধর্ম্ম-দাস্যে খ্যাতি, শ্রীপুরুষোত্তম-যতি,
তাঁ’হ’তে ব্রহ্মণ্যতীর্থ সূরি ।
ব্যাসতীর্থ তাঁর দাস, লক্ষ্মীপতি ব্যাসদাস,
তাঁহা হইতে মাধবেন্দ্র পুরী ॥

মাধবেন্দ্র পুরীবর, শিষ্যবর শ্রীঈশ্বর,
নিত্যানন্দ, শ্রীঅদ্বৈত বিভু ।
ঈশ্বরপুরীকে ধন্য, করিলেন শ্রীচৈতন্য,
জগদ্গুরু গৌর মহাপ্রভু ॥

মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্য, রাধাকৃষ্ণ নহে অন্য,
রূপানুগ জনের জীবন ।
বিশ্বম্ভর প্রিয়ঙ্কর, শ্রীস্বরূপ-দামোদর,
শ্রীগোস্বামী রূপ-সনাতন ॥

রূপপ্রিয় মহাজন, জিব-রঘুনাথ হন,
তাঁর প্রিয় কবি কৃষ্ণদাস ।
কৃষ্ণদাস-প্রিয়বর, নরোত্তম সেবাপর,
যাঁর পদ বিশ্বনাথ-আশ ॥

বিশ্বনাথ ভক্তসাথ, বলদেব জগন্নাথ,
তাঁর প্রিয় শ্রীভক্তিবিনোদ ।
মহাভাগবতবর, শ্রীগৌরকিশোরবর,
হরিভজনেতে যাঁর মোদ ॥

তদনুগ-মহাজন শ্রীকৃষ্ণ-কীর্ত্তন-ধন
যেবা দিল পুরি জগকাম ।
শ্রীবার্ষভানবীবরা, সদা সেব্য সেবাপরা,
তাঁহার দয়িতদাস নাম ॥

তদভিন্ন দেহদিব্য স্বরূপ-রূপ-রঘু-জিব্য
সদা সেব্য যাঁর পাদপদ্ম ।
সুসিদ্ধান্ত মূর্ত্তিধর শ্রীশ্রীধর গুরুবর
রূপানুগ-সাধুশ্রেয় সদ্ম ॥

তাঁর প্রেয় মহোঽভীষ্ট স্থাপনে সদাসচেষ্ট
ভক্তিসুন্দর শ্রীগোবিন্দ নাম ।
তাঁর প্রিয় মনোনীত আচার-প্রচারে রত
ভক্তিনিরমল শ্রীআচার্য্য নাম ।
এই পরম্পরা ধন সবে গৌর-নিজজন
তাঁদের উচ্ছিষ্টে মোর কাম ॥

গুরু: বহু জন্মের সম্বন্ধ


Image result for guru

বহু বুদ্ধিমানের মধ্যে দেখেছি যা তা বিশ্বাস করার দুর্দমনীয় প্রবৃত্তি – তা আবার বড় বড় শ্লোকের খাঁড়া উচিয়ে৷ এঁরা ভাবেন এরই নাম যথার্থ গুরুভক্তি, আনুগত্য – লয়ালটি৷ শুনতে শুনতে প্রায়ই আমার মনে হত- আমার মতন ডিস্লয়াল শিষ্য বুঝি ভূ-ভারতে দুটি নেই৷ বহু ভুগে ও পোড় খেয়ে ক্রমশ বুঝেছিলাম যে উদ্ভটবিলাসী ও অধ্যাত্মবাদী সমার্থক নয়৷

বুদ্ধির অভিমানে আঘাত লাগলে যখনই মনে হ’ত যে, বুদ্ধির খাসতালুকে বাস ক’রে এতদিন যে মুক্তির খাজনা দিয়ে এলাম- ফসল ফলল কতটুকু? কিছুই পাই নি – বলি না৷ কিন্ত্ত যা পেয়েছিলাম তাতো অসাঙ্গ নয়, ফুরিয়া যায় সে পথ চলতে চলতে৷ তখন ফিরি আপ্তবাক্যের দিকে – কিন্ত্ত আপ্তবাক্য তো জীবন্ত হ’য়ে ওঠে না জীবনের তাপ বিনা৷ এই জন্যেই বুঝি শাস্ত্রে বলেছে গুরু বিনা গতি নেই? তন্ত্রে পড়েছিলাম: ”গুরুমুখ্যাঃ ক্রিয়াঃ সর্বা ভক্তিমুক্তি ফলপ্রদাঃ’- অর্থাত্‍ কোনো জপতপই গুরুর প্রত্যক্ষ আদেশ বিনা সক্রিয় হ’য়ে ওঠে না৷ গুরু খুঁজেছিলামও তো সেই জন্যেই৷ কোথায় না গিয়েছি- কত নাগা সন্ন্যাসী, গ্রামবাসী, গৃহী, যোগী, কত মঠ, মণ্ডলেশ্বর- কিন্ত্ত কাউকে দেখেই তো মনে হয় নি ইনিই আমার গুরু! মনে হ’ল প্রথম যখন দেখলাম শ্রীঅরবিন্দের দিব্যকান্তি ১৯২৪ সালে৷ মন মুহূর্তেই মেনে নিল তাঁকেই আমার গুরু ব’লে৷ তিনিও আমাকে গ্রহণ করেছিলেন সঙ্গে সঙ্গেই – সেকথা তিনি লিখেছিলেন প্রায় বার বত্‍সর পরে- ১৯৩৫ সালে; ”দিলীপ, তোমার সঙ্গে দেখা হওয়ার আগেই আমি অনুভব করেছিলাম তোমার সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত সম্বন্ধ – যেজন্যে আমি বরাবর তোমাকে ছিলাম ধারণ ক’রে৷ আমি যে তোমার সংস্পর্শে আসতে না আসতে টের পেয়েছিলাম যে, তোমার সঙ্গে আমার সম্বন্ধ বহু জন্মের… যে, তুমি আমার জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ… তাই তো তোমার আমার ফের দেখা হয়েছিল৷ এ ভবিতব্য৷ তুমিও আমাকে এইভাবে গুরু ব’লে চিনেছিলে ব’লেই এসেছিলে আমার কাছে৷ তোমার বাইরের মন এখনো এ-সম্বন্ধে পূর্ণ সচেতন হয় নি নবজন্মের সময় একটা নতুন আড়াল আসে ব’লেই৷ নইলে একথা তুমিও জানো অন্তরে৷”