ড.মহানামব্রত ব্রহ্মচারী মহারাজের সংক্ষীপ্ত জীবন-বৃত্তান্ত।


ড.মহানামব্রত ব্রহ্মচারী মহারাজের সংক্ষীপ্ত জীবন-বৃত্তান্ত।
Image result for mahanambrata brahmachari
জন্মঃ ৯ পৌষ,১৩১১/২৫ ডিসেম্বর,১৯০৪ তারিখে বরিশাল জেলার বানরীপাড়ু উপজেলার অন্তর্গত খালিশাকোটা গ্রামে। মহাপ্রয়াণঃ ৩১ আশ্বিন,১৪০৬/১৮ অক্টোবর,১৯৯৯। বাল্যনাম: বঙ্কিম চন্দ্র দাশগুপাত। পিতা: কালিদাস দাস গুপ্তমাতা: কামিনী সুন্দরী।
শিক্ষা: এম.এ.(ডাবল),পি.এইচ.ডি (শিকাগো).ডি.লিট.(ভারত)।
অধ্যাত্ম কর্ম প্রবাহ: শৈশবেই প্রভু জগদ্বন্ধু সুন্দরের লীলাভুমি ফরিদপুর শ্রীধাম শ্রীঅঙ্গনে আগমন। সেখান থেকেই তার গুরুদেব শ্রীপাদ মহেন্দ্রজীর তত্ত্বাবধানে লেখাপড়া।কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শন ও সংস্কৃত মাষ্টার্স ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি সংস্কৃতিতে ১ম শ্রেনীতে ১ম স্থান অর্জন ও স্বর্ণপদক লাভ করেন । ১৯৩৩ সালে তিনি মার্কিন যুক্টরাষ্ট্রের শিকাগো শহরে অনুষ্ঠিত ২য় বিশ্বধর্ম সম্মেলনে যোগদান করেন।“World Fellowship of Faiths”আয়োজিত উক্ত সম্মেলনে প্রথম ভাষণ দেয়ার পরেই মার্কিন যুক্টরাষ্ট্রের জনপ্রিয় পত্রিকা গুলোর শিরোভাগে তার সে ভাষণ সম্পর্কে এবং তৎপরবর্তি সময়ে তার প্রদেয় ভাষণ সংক্রান্ত খবর ফলাও করে প্রচারিত হয় এবং ফরিদপুর শ্রীপাদ মহেন্দ্রজীর কাছে তার জন্য “Appreciation letter” পাঠানো হয়। উক্ত সংস্থার পক্ষ থেকে। তিনি সম্মিলনে চারটি ভাষণ দেন। এবং তার মাধ্যমেই মুলত তার অধ্যাত্ম জীবন প্রবাহের বহিরঙ্গ প্রকাশ শুরু হয় ক্ষরতার বেগে। তার ভিষার মেয়াদ সংস্থার কর্মকর্তাদের পক্ষ থেকে বাড়িয়ে নিয়ে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে বৈষ্ণব বেদান্তের উপর তাকে পি.এইচ.ডি করার ব্যবস্থা করে দেয়া হয়। তার অভিসর্ন্ধভ যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথিত যশা অধ্যাপকদের কাছে প্রেরণ করা হয়। এবং অভুতপূর্ব আনুষ্ঠানিকতায় তাকে পি.এইচ.ডি প্রদান করা হয় “World Fellowship oF Faiths” এর প্রধান Charles frederick সাহেব ড.ব্রহ্মচারীজীকে উক্ত সংস্থার আন্তজার্তিক সম্পাদক হিসাবে আমেরিকার বিভিন্ন স্থানে তার অমিত প্রভাবি ভাষণদানে আন্তধর্মীয় সৌহার্দ্য ও সম্পৃতির সেতু বন্ধন রচনার সুকল্যাণ। অভীস্পসায় প্রেরণ করেন।তিনি অনেক সময় উপমহাদেশের তিনটি ধর্মেরই সনাতন ধর্ম ছাড়া ইসলাম ও বৌদ্ধ ধর্ম সম্পর্কেও প্রশ্নের পেক্ষিতে ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন।তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ৬৩ টি শহর ২৯ টি বিশ্ববিদ্যালয় ,কলেজ এবং বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও সমিতিতে ৪৭৬ টি ভাষণ প্রদান করেন। সংস্থার আন্তজার্তিক সম্পাদক হিসাবে। এছাড়া ইউরোপ ও কানাডায় বেশ কিছু শহরেও তিনি সংস্থার পক্ষ থেকে শহরে যান। পাচ বছর আট মাস পরে তিনি যুক্তরাষ্ট থেকে দেশে ফিরে আসেন শ্রীঅঙ্গনে।
তার পর শুরু হয় মাতৃভুমিতে তার অধ্যাত্ম কর্মপ্রবাহ। মানুষের মধ্যে অধ্যাত্ম ও মনুষ্যত্ববোধ জাগরিত করে শান্তিময় সমাজ গড়ার সুমহান উদ্দেশ্যে তিনি ছুটে চলেন তৎকালিন পূর্ব পাকিস্থান ও ভারতের বিভিন্ন স্থানে। গ্রাম নগরের যেখানেই তিনি গিয়েছেন এবং তত্তালোচনা করেছেন জাতি,ধর্ম,বর্ণ নির্বিশেষে সর্ব স্তরের মানুষ মন্ত্র মুগ্ধের মত তার গভীর প্রজ্ঞা ও পান্ডিত্যপূর্ণ ভাষণ শুনেছে। এরই মাঝে তিনি অজস্র ছোট বড় গ্রন্থ রচনা করেছেন। যার প্রতিখানা গ্রন্থই তার সান্দ্র সাধনা । হৃদ্য মহাজীবনী উৎসারিত অধ্যাত্ম রত্নসম্ভার স্বীয় সুগভীর পান্ডিত্য প্রভায় অতুলনীয় উজ্জল্য নিয়ত দিপ্যমান থাকবে।
 
গ্রন্থ সম্ভার: তিনি রচনা করেছেন ৬৩ খানা গ্রন্থ (২)সম্পাদনা করেছেন ১০ খানা গ্রন্থ (৩) তার উপর লিখিত হয়েছে ২০ খানা গ্রন্থ এবং তার রচনা ও ভাষণ সম্পর্কে রয়েছে তিন খানা গ্রন্থ। দেশপ্রেমিক স্বাধিনতাকামী মহানামব্রতজী স্বাধীনতা চলাকালীন দেশমাত্রকের মুক্তি কামনায় প্রায় ৯ মাস অন্ন গ্রহন থেকে বিরত থেকে সত্যাগ্রহ পালন করেছেন।তিনি মঠ মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছেন কিন্তু কখন মঠাধিন হন নি। তিনি ছিলেন একাধারে ধ্যানমগ্ন দ্রষ্টা , বিজ্ঞান মনস্ক লেখব্যাখ্যাতা ও মানব কল্যাণ ব্রতি পরিব্রাজক ।মানবপন্থি মহানাম তিমির বিনাশী এক অমৃত সূর্যের নাম।
(সংগ্রহীত)

শ্রীশ্রীলক্ষ্মী-ড. মহানামব্রত ব্রহ্মচারী



লক্ষ্মী সমুদ্রসম্ভবা। সমুদ্র মন’নে লক্ষ্মীর উৎপত্তি। সমুদ্র রত্নাকর। সমুদ্র মন’নে রত্ন মিলিবেই। বিশ্ব-প্রকৃতিও একটি সমুদ্র। যাঁহারা বিচক্ষণ তাঁহারা ভূমি-প্রকৃতি কর্ষণ করিয়া শস্য-ধন আহরণ করেন। বন প্রকৃতি অনুসন্ধান করিয়া ধন আহরণ করেন। খনি-প্রকৃতি খনন করিয়া স্বর্ণ ধন সংগ্রহ করেন। এই সকলই সাগর-মন’ন। বাণিজ্যও একপ্রকার সাগর-মন’ন। এই সকল সাগর-মন’নে ধনাধিষ্ঠাত্রী লক্ষ্মীর আবির্ভাব।
কেবল টাকা কড়িই ধন নহে। চরিত্রধনও মহাধন। যার টাকা নাই সে লক্ষ্মীহীন। যার চরিত্রধন নাই সে লক্ষ্মীছাড়া। যাঁহারা সাধক তাঁহাদের শ্রেষ্ঠ সম্পদ মুক্তিধন। তাঁহারা লক্ষ্মী-নারায়ণ ভজনা করেন মুক্তি সম্পত্তি পাইবার আশায়। লক্ষ্মী জীবনোপায়রূপিণী। সর্বজীবের জীবিকার উৎস। ইনি স্বর্গে স্বর্গলক্ষ্মী, রাজগৃহে রাজলক্ষ্মী, যাঁহাদের জীবন পবিত্র তাঁহাদের সংসারে গৃহলক্ষ্মী।
লক্ষ্মীর আর একটি রূপ আছে নদীরূপা। লক্ষ্মী শাপভ্রষ্টা হইয়া পদ্মানদীরূপে প্রকাশিতা। আমরা ভাগ্যবান। বাংলাদেশে ইনি পদ্মানদীরূপে প্রবাহিত হইয়া এই পবিত্র ভূমিকে সুজলা-সুফলা শস্যশ্যামলা করিয়া রাখিয়াছেন।
লক্ষ্মীদেবীর বাহনটি পেঁচা। লক্ষ্মী এমন সুন্দরী, আর বাহনটি এমন কদাকার। পেঁচা দিবান্ধ। ধনশালী হইলেই লোক প্রায়শঃ অন্ধ হইয়া যায়। ধনী হইবার পূর্বে ভাবে- ধন হইলে সকলেই উপকার করিব। আত্মীয়-স্বজনদের আর দুঃখকষ্টে থাকিতে দিব না। কিন’ ধন পাওয়া মাত্র সে পেঁচক হইয়া যায়।
লক্ষ্মীমান হইয়াও চক্ষুষ্মান এমন মানুষ কি নাই? আছে। লক্ষ্মীর বাহন পেঁচক তাহাদের প্রতি ভালকথা বলে- “ভাই অন্ধ হও। মিথ্যার পথে ধন আসিবে, চুরির পথে ধন আসিবে, ঘুষের পথে ধন আসিবে, এই সব বিষয়ে অন্ধ হইয়া যাও, যাহারা এই সব কুৎসিৎ পথে ধনশালী হইয়াছে তাহাদের দিকে তাকাইও না।”
পেঁচক বলে, “আমি যমের দূত। কুপথে যদি ধন অন্বেষণ কর তবে যমের দণ্ড মাথায় পড়িবে। আমার প্রভু যমের চিন-া কর। মৃত্যুর কথা ভাব। কিছুই সঙ্গে যাইবে না। সুতরাং হীন পথে ধন আনিও না, পবিত্র পথে ধন আয় কর। পবিত্র কার্যে ব্যয় কর।” যাহারা মুক্তি পথের সাধক, পেঁচক তাহাদিগকে গীতার বাণী স্মরণ করাইয়া দেয়।
শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বলিয়াছেন-
“যা নিশা সর্ব্বভূতানাং তস্যাং জাগত্তি সংযমী।
যস্যাং জাগ্রতি ভূতানি সা নিশা পশ্যতো মুনেঃ॥
যোগী আর ভোগী জীবের কথা বলিতেছেন। ভোগীর পক্ষে যা রাত্রি, যোগীর পক্ষে তা দিন। ভোগী যা দিন, যোগীর তা রাত্রি। ভোগী আধ্যাত্মিক বহুবিষয়ে ঘুমন-, বিষয়সম্ভোগে সজাগ। কিন’ সংযতেন্দ্রিয় যোগী আত্মিক বিষয়ে সজাগ, বিষয় ভোগে উদাসীন অচেতনতুল্য।
পেঁচক মুক্তিকামী সাধককে বলে, “সকলে যখন ঘুমায় তুমি আমার মত জাগিয়া থাক। আর সকলে যখন জাগ্রত তখন তুমি আমার মত ঘুমাইতে শিখ, তবেই সাধনে সিদ্ধি। কৈবল্যধন লাভ।”
পরমার্থধনাভিলাষী সাধক পেঁচার মত রাত্রি জাগিয়া সাধন করে। লোকচক্ষুর অন-রালে নির্জনে থাকে। লক্ষ্মীমার বাহনরূপে আসন লইয়া পেঁচকের যে ভাষণ তাহা বিভিন্ন স-রের বিভিন্ন প্রকার সাধকের উপাদেয় সম্পদ।

একাদশী তিথি



একাদশী তিথির আর এক নাম হরিবাসর। বাসর শব্দের দুইটা অর্থ। বাসর বলিতে ঘর বোঝায়। যেখানে বাস করা হয়। বাসর শব্দের অপর অর্থ দিন,দিবস।
হিন্দু শাস্ত্রে দুর্গার জন্য দিন আছে আশ্বিনী সপ্তমী অষ্টমী নবমী।মাকালীর জন্য দিন আছে অমাবস্যা,শিবের জন্য চতুর্দশী ,লক্ষীর জন্য পূর্ণিমা ইত্যাদি। জামাইয়ের জন্য দিন আছে ষষ্ঠী,ভাইর জন্য দিন আছে ভ্রাতৃদ্বিতীয়া। শ্রীহরির জন্য একটি বিশেষ দিন,তার নাম হরি বাসর-একাদশী। ঐদিন আমরা শ্রীহরির সঙ্গে এক ঘরে বাস করিব। মনটা হরির পাদপদ্মে হইতে কোথাও যেন না সরিয়া যায়-এইভাবে চলিব।
আমাদের নানা স্থানে চলিতে হয় প্রধানতঃ আহারের চিন্তায়। ঐদিন আহার বাদ দিলে অনেক চলাফিরা কমিয়া যায়,আমাদের ছুটাছুটি বাড়ে ইন্দ্রিয়ের চঞ্চলতা হেতু। ইন্দ্রিয় সংযত হলে চিত্ত স্থির হয় ছুটাছুটি কমিয়া যায়।
আমাদের ১১টা ইন্দ্রিয়।চক্ষু,কর্ণ,নাসিকা,জিহ্বা ও ত্বক-৫ টি জ্ঞানেন্দ্রিয়। বাক্,পাণি,পাদ,পায়ু ও উপস্থ-৫টি কর্মেন্দ্রিয়। আর অন্তরিন্দ্রিয় একটি মন। এই এগারটি ইন্দ্রিয়কে সংযত রাখিয়া শ্রীহরির গৃহে তার সঙ্গে বাস করার জন্য একদিশী দিবস নির্দিষ্ট। হরি গৃহ কোথায় যেখানে হরিনাম ও হরিকথা কীর্তন পাঠ হয় সেই স্থানই হরির ঘর।
সুতরাং ঐদিন সর্বদা হরিনাম কীর্তন ও হরিকথা আলাপনে কাটিলে হরিসঙ্গে একঘরে বাস করা হয়,সুতরাং একদশী দিনে কর্তব্য আহার ত্যাগ করিয়া বা আহার সাধ্যমত কমাইয়া সারা-দিন-রাত ভগবান্ শ্রীহরির নামকীর্তন,গুণকীর্তন,লীলাকীর্তন ও শাস্ত্রগ্রন্থ পাঠ লইয়া অতিবাহিত করা।
এই অনুষ্ঠান সত্য ত্রেতা যুগ হইতে প্রবর্তিত আছে। কলিযুগে মহাপ্রভু গৌরাঙ্গদেব আসিয়া অদ্বৈত আচার্যের বাড়ি বিশেষভাবে একদশীর অনুষ্ঠান প্রবর্তণ করেন। সকল বৈষ্ণবগণ হরিবাসর কীর্তণ করেন।
শ্রীশ্রী প্রভু জগদ্বন্ধু শ্রীগৌরাঙ্গসুন্দরের অবতার। তিনিও একদশীর অনুষ্ঠান করিয়াছেন।ও ভক্তদের করিতে আদেশ করিয়াছেন।

সুতরাং এই দিনে আমরা কৃষ্ণকথা,গৌরকথা,জগদ্বন্ধুসুন্দরের লীলা গাথা-কথা স্মরণে চিন্তনে আলোচনায় কাটাইব। ইহাতে আমারা আধ্যাত্মিক পথে শ্রীহরির দিকে অগ্রসর হইব। শুধু আমাদের কল্যাণ নহে গ্রামের কল্যাণরাজ্যের কল্যাণ,পুথিবীর সকল নরনারীর মহাকল্যাণ সাধিত হইবে। একাদশী তিথির জয় হউক্। জয় জগদ্বন্ধসুন্দরের জয় হউক।

শ্রীবিষ্ণূপ্রিয়া-ভাগবত গঙ্গোত্তরী ড,মহানামব্রত ব্রহ্মচারী।


Ram Bandhu Das Sreeangon's photo.

শ্রীবিষ্ণূপ্রিয়া
শ্রীশ্রীগৌরাঙ্গসুন্দরের সহধর্মিণী শ্রীবিষ্ণুপ্রিয়াদেবী। গৌরীয় বৈষ্ণব সাহিত্যে উপেক্ষিতা তিনি। শ্রীকৃষ্ণদাস কবিরাজ গোস্বামীর শ্রীশ্রীচৈতন্যচরিতামৃত ও শ্রীল বৃন্দাবনদাস ঠাকুরের শ্রীশ্রী চৈতন্যভাগবত বৈষ্ণব সমাজে দুইখানি মহাগ্রন্থ।উভয় গ্রন্থেই দেখি শ্রীবিষ্ণুপ্রিয়া দেবী উপেক্ষিতা।কবিরাজ গোস্বামী তাঁহার বিরাট গ্রন্থে একটিবার মাত্র বিষ্ণূপ্রিয়া নামটি উচ্চারণ করিয়াছেন।আর বৃন্দাবন দাস ঠাকুর কিছু বলিয়াছেন-কিন্তু তাহা তেমন বিশেষ কিছু নয়।
ইহা এক আশ্চার্য্য ঘটনা।এই মহামহীয়সী দেবীর কোন মুল্য দেন নাই দু’জন শ্রেষ্ঠ গৌরলীলার আস্বাদক ও প্রচারক।এইরুপ কেন হইয়াছে তা জানিনা।গৌরসুন্দর বিষ্ণূপ্রিয়াকে উপেক্ষা করিয়া সংসার ছাড়িয়া চলিয়া গিয়াছেন।এই জন্যইকি গ্রন্থকারগণ তাঁহাকে একটু ক্ষুদ্র স্থানও দেন নাই। শ্রীগৌরসুন্দর কি বিষ্ণুপ্রিয়াকে একবারে ছাড়িয়া গিয়াছেন?না,তা তো যান নাই,যাইতে পারেন নাই।শ্রীভগবানের শ্রীমুখের বানী আছে।আমার ভক্ত আমার হৃদয়ে থাকে আমি আমার ভক্তের হৃদয়ে থাকি।
শ্রীবিষ্ণূপ্রিয়াদেবীর হৃদয়ে ভরা ,কানায় কানায় ভরা ছিলেন গৌরহরি।সুতরাং শ্রীগৌরসুন্দরের হৃদয় ভরাও শ্রীবিষ্ণুপ্রিয়া ছিলেন-ইহা সতঃসিদ্ধের মত সত্য।প্রত্যেক বৎসর গৌরহরি জগদানন্দকে দিয়া যে বস্ত্র পাঠাইতেন মাতার জন্য,তাহার সঙ্গে যে লাল পেড়ে শাড়ি আসিত,তাহাতো বিধবা জননীর জন্য নহে।দামোদর পন্ডিত খুব সাবধানি লোক বলিয়া তাহাকে যে নবদ্বীপের বাড়িতে পাঠাই ছিলেন তাহাকি শুধু বৃদ্ধা গর্ভধারিনীর জন্য,নাকি তার মধ্যে ষোড়শী সহধর্মীণির ভাবনাও আছে?
শ্রীগৌরসুন্দরে বলা হয় বিপ্রলম্ভ রসাবতার। বিপ্রলম্ভ অর্থ বিরহ।শ্রীরাধাগোবিন্দ একীভূততনু যার,তার এত বিরহ বেদনা হাহাকার কেন?
সবই কি শ্রীরাধার জন্য?শ্রীরাধাতো্ তার অঙ্গে একান্তভাবে অঙ্গীভূত। শ্রীরাধারবিরহ আর শ্রীবিষ্ণুপ্রিয়ার বিরহে তফাৎ কি? সাগরের জল সাগরের জলই,তা প্রশস্ত মহাসাগরের হউক আর আটলান্টিক মহাসাগরের হউক। দুই সাগরের সংযোগ ভুমিতে স্নান করিয়া দেখিয়াছি সর্বতোভাবেই এক। বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণে একই উপাদান।শ্রীসীতাদেবীর লঙ্কায় আশোক বনে কান্না আর শ্রীরাধারানীর বৃন্দাবনে নিকুঞ্জবনে কান্নার কি কোন প্রভেদ আছে? গৌড়ীয় বৈষ্ণব শাস্ত্রবেত্তারা বলেন-“হাঁ আছে” শ্রীসীতা ও রামের প্রেম স্বকীয়া,শ্রীরাধা-কৃষ্ণের প্রেম পরকীয়া। পরকীয়া রসের গভীরতা বেশী। তাই বিরহের ও চমৎকারিতা অধিক।
স্বকীয়া ও পরকীয়া নায়িকার ভেদ গৌরীয় আচার্যরাই করেন,অন্যান্য সম্প্রদায়ের আচার্যগণ উহা ভাবনা করিতেও সঙ্কুচিত হন। তাহারা সীতা রাম আর রাধাশ্যামে বিন্দুমাত্র ভেদ দর্শন করে না। গৌড়ীয়েরা করেন। কেন করেন তাহার কারন বলিতেছি-
ভালবাসার পাত্র দুইটি যদি পরস্পরের সুলব ও সহজলভ্য হয় তাহা হইলে প্রিতি রসটি পুষ্ট হয় না।দুর্লভ হইলেই সুন্দর রুপে পরিস্ফুট হয়।সীতা শ্রীরামচন্দ্রের স্বকীয়া অর্থাৎ বিবাহীতা পত্নি। সর্বদাই তাহাকে সন্নিধানে পাওয়া যায়। সেই জন্যই তাহাদের মধ্যে যে প্রিতি রস তাহাতে গাঢ়তা কম। তাহদের প্রিতী গাঢ় হইল তখন যখন রাবণ কর্তৃক সীতা দেবী অপহৃতা হইলেন। শ্রীরামচন্দ্রের আর্তনাদ তখন বুকফাটা,শ্রীসীতাদেবীর রোদন ও তদ্রুপ মর্মান্তিক। যখন দশানন কর্তৃক সীতারামের প্রণয়ে বিরহ সৃষ্টি হইল,তখন প্রণয় রস সম্ভোগ হইল সীতা রামেও,আমাদেরও। আবার সীতার উদ্ধারের পর আর সেই মধুরীমা রইল না। রসের আস্বাদন যেন সংকুচীত হইয়া গেল।
শ্রীরাধাকৃষ্ণের মিলন অতী অল্প,বিরহই অধিক। বিরহ সর্বদাই লাগিয়া আছে। বিরহই স্বাভাবিক। মিলনটাই সাময়িক । অনেক উৎকন্ঠা অনেক তপস্যার পর ক্ষীণক মিলন-তার মধ্যেও সর্বদা বিচ্ছেদের প্রবল ভীতি।পূর্বরাগ বিরহ,মান,বিরহ প্রভৃতিতে কিছু সময়ের পর আবার মিলন ঘটিত।কিন্তু মাথুর বিরহের পরে আর মিলন হয় নাই,দিবস রজনী সর্বদাই বিরহে ক্রন্দন।
“নয়নক নিদ গেয় বয়নক ভাষ
সুখ গেয় প্রিয়া সনে দুখ হাম পাশ।”
নয়নে নিদ্রা নাই,মুখে ভাষা নাই। সকল সুখ প্রিয় কৃষ্ণের সঙ্গে চলিয়া গিয়াছে-শুধু দুঃখই আছে আমার কাছে এই কথা শ্রীরাধারানী বলিতেছেন সখিদের নিকট।কৃষ্ণ বিরহে অবিশ্রাম অশ্রুধারা ঢালিতে ঢালিতে বিরহে তীব্রতা ক্রমে ক্রমে গাঢ় তমতায় পৌছিয়াছিল। এই জন্যই শ্রীরাধার বিরহের মত আর বিরহ নাই।বিরহের তাপে-

“দশেন্দ্রিয় ছেড়ে গেল নবদ্বার বন্ধ হল
শবপ্রায় পড়ে কলেবর।”
বিরহের এই মৃত্যুতুল্য অব্স্থা আর কোথাও হয় দৃষ্ট নাই।শ্রীরাধা পরকীয়া বলিয়াইতো এমনটি হইয়াছে,হইতে পারিয়াছে।সীতা দেবীর বেদনা দশ মাসের জন্য লঙ্কায় অশোক বনে।শ্রীরাধার বেদনা সীমাহীন কালের জন্য ব্রজের নিকুঞ্জ কাননে।সীতাদেবী প্রতি মুহুর্তে,জানেন,নিশ্চিতভাবে জানেন শ্রীরামচন্দ্র তাহাকে উদ্ধার করিবেনই। শর্মার কাছে যুদ্ধের খবর পান।তিনি সৈন্য সহ কতদুর অগ্রসর হইয়াছেন। শ্রীরাধার অন্তরে শ্রীকৃষ্ণের প্রাপ্তির ক্ষীণআশার রেখাটাও নাই। এই জন্য রাধা-কৃষ্ণের প্রিতি রসে এক গভীরতা ও এত চমৎকারিতা।এই হইল গৌরীয় আচার্য্যপাদ গণের কথা।ঐ কথা অতি সুন্দর প্রাণস্পর্শী সত্য। শ্রী রাধার বিরহই প্রকৃত বিরহ পদবাচ্য।জীবন ভীরিয়া হাহাকার। হা-কৃষ্ণ হা-কৃষ্ণ বলিয়া অসহনীয় তীব্রতম বেদনার প্রগাঢ়তম অনুভূতি । এখানে বিরহ কথাটি মুর্তি ধরয়াছে।সাহিত্য যত বিরহ সকলই ইহার তুলনায় হিমালয়ের কাছে অন্যান্য পাহাড় – পর্বতের মতই নগন্য।
এখন আমরা অবার বক্তব্য বিষয়ে আসিতেছে।শ্রীবিষ্ণূপ্রিয়ার কথা বলিব।শ্রীসীতার প্রেম স্বকীয়া। শ্রীবিষ্ণূপ্রিয়ার প্রেম ও স্বকীয়া। সুতরাং পরকীয়া শুনিয়াই অন্য সম্প্রদায়ের আশ্চার্য্য গণের নাসিকাকুঞ্চন তাহা শ্রীসীতার সম্ধন্ধেও যেমন নাই,শ্রীবিষ্ণুপ্রিয়ার সম্বন্ধেও তেমনি নাই।শ্রী সীতাদেবীর প্রেম স্বকীয়া বলিয়া তাহার রামপ্রেম শ্রীরাধার কৃষ্ণপ্রেম অপেক্ষা গভীরতায় উন,গাঢ়তায় ন্যুন। শ্রীবিষ্ণুপ্রিযারওকি তাই?না তাহা নহে।কেন,বিচার করিব।
শ্রীরাধার অনুরাগে পরকীয়া হেতু যে প্রিয়তমের দুর্লবতা তাহা সীতাদেবীতে নাই,কিন্তু বিষ্ণূ প্রিয়াতেও নাই এমন কথা বলিবে কোন শাস্ত্রজ্ঞান ব্যক্তি?আমরা বলিব বিষ্ণুপ্রিয়ার অনুরাগে যে দুর্লবত্ত্ব তাহা শ্রীরাধার অনুরাগ অপেক্ষা অধিক।পূর্ণচন্দ্র অতি সমুজ্জল-যতক্ষণ সূর্যের কিরণ রেখা পৃথিবীকে স্পর্শ না করে।
শ্রীকৃষ্ণ মথুরায় আছেন। শ্রীরাধার তাহার কাছে ছূটিয়া যাইবার অধিকার নাই,যে অধিকার আছে শ্রীসীতার। শ্রীবিষ্ণুপ্রিয়ারও শ্রীগৌরাঙ্গের কাছে যাইবার অধিকার নাই।শ্রীরাধার নাই কারন তিনি বিবাহিতা পত্নি নহেন।শ্রীবিষ্ণু প্রিয়ার নাই কারন তাহার পতিসন্ন্যাসি। কঠোর সন্ন্যাসি।তিনি পত্নিমুখ দেখাতো দুরের কথা কোন নারী মুখ দর্শনই তাহার পক্ষে শাস্ত্র বিগর্হিত। শ্রীরাধার কৃষ্ণের কাছে মথুরায় ছূটিয়া গেলে সমাজ । বিষ্ণুপ্রিয়া গৌরের কাছে ছূটিয়া গেলে সমাজ হাসিবে না।প্রাণের দেবতা নিতান্তই বিদনাতুর হইবেন।সমাজকে হাসানো যায় কিন্তু প্রিয়তমের অসহনীর দুঃখ সহ্য করা যায় না।শ্রীরাধার প্রবল দুঃখের মধ্যে একবিন্দু শান্তনা শ্রীকৃষ্ণ বলিয়া গিয়াছেন-“আবার আসিব”। উদ্ধবকে শ্রীকৃষ্ণ বলিয়াছেন-“আমি আবার আসি”। এই বাক্য গভীর বিশ্বাসই শ্রীরাধাকে প্রাণে বাচাইয়া রাখিয়াছে।আর বিষ্ণুপ্রিয়া?
বিষ্ণূপ্রিয়া জানেন,সুদৃঢ়ভবেই জানেন প্রাণের গৌরহরি আর আসিবেন না তাহাকে দেখা দিতে।প্রাণেতে ধরিয়া রাখিবার মত একটি তৃণও নাই। বিরহ দুঃখ সমুদ্রের মধ্য।সমুদ্রে কেবল হাবু-ডুবুই খাইতে হইবে-কোন কিছুই ধরিবার মতো সম্বল নাই।শ্রীরাধা জানেন শ্রীকুষ্ণ মথুরা বা দ্বারকায় আছেন,রাজৈশ্বর্যেই আছেন।সে দিকে কোন দুঃখ কষ্ট নাই। শ্রীবিষ্ণুপ্রিযা জানেন না গৌরহরি কোথায় আছেন।দক্ষিণ দেশে গিয়াছেন-অচেনা ,অজানা দেশ,সঙ্গে সাথি সঙ্গী,দরদী কেহই নাই।শ্রীবিষ্ণু প্রিয়া শূনিয়াছেন হৃষিখন্ডের গভীর অরণ্যের মধ্য চলিয়াছেন বৃন্দাবনের দিকে।কোথায় কিভাবে পথ চলিতেছেন-তাহার নিদ্রা হয়তেছে কিনা কিছু্ই জানেন না।প্রিয় সুখে আছে এই চিন্তা বিরহ দুঃখকে অনকটা লাঘব করে।শ্রীরাধার সেই লাঘবতা টুকু আছে।শ্রীবিষ্ণুপ্রিয়ার তাহার বিণ্দুমাত্রও নাই। প্রিয়েও অজ্ঞাত অবস্থা বিরহ বেদনাকে তীব্র কতর করে। শ্রীবিষ্ণূপ্রিয়াই তাহাই আছে।যখন তিনি জানেন পুরিতেই আছেন-তখনও শূনেন,সুখে-স্বাচ্ছনেন্দ আহার নিদ্রা করেন না।জগদানন্দ শ্রীঅঙ্গে মাখাইতে কিছুসুগন্ধি তৈল নিয়া গিয়াছিলেন মাথায় বহিয়া বাংলাদেশ হইতে পুরীধামে। তাহা তিনি এক ফোটাও গ্রহন করতেন নাই। দুঃখে জগদানন্দ তৈলের হাড়িটা আছাড় দয়া ভাঙ্গিয়া ফেলিয়াছেন।প্রভুর জন্য তুলার লেপ ও বালিশ করা হইয়াছিল-তাহা গ্রহন করেন নাই।ভিতরে তুলা ফেলিয়া কলাগাছের শুকনা পাতাদিয়া লেপ বালিশ তৈয়ারী হইয়াছে,তাহা হয়তো নিবেন। প্রভু রাত্রে বিন্দু মাত্র নিদ্রা যান না।বিরহ বেদনায় দেয়ালে মুখ ঘষিয়া ঘষিয়া ক্ষত বিক্ষত করিয়া ফেলেন।এইসব নিদারুন সংবাদ শ্রীবিষ্ণুপ্রিয়ার কানে পৌছেইতে বিষ্ণূপ্রিয়ার বিরহাগ্নিতে ঘৃতাহুতি হয়। এইরুপ জ্বালা শ্রীরাধার নাই।
শ্রীগৌরহরির আহার প্রায় নাই। অতি অল্প। আর বিষ্ণূ প্রিয়া আহার করেন কি?কয়েকটি আতপ তন্ডুল তন্তু নিয়া বসেন।একবার করিয়া ১৬ নাম ৩২ অক্ষর উচ্চারণ করেন আর একটি চাউল এধার হতে ওধারে রাখেন।বৈষ্ণব যেমন একটি নাম পূর্ণ করিয়া একটি মালা টানেন । বৈষ্ণব জপান্তে মালা রাখিয়া দেন।শ্রীবিষ্ণুপ্রিয়া জপান্তে তন্তুল কটি দিনান্তে গভীর রাতে সিদ্ধ করিয়া , গৌর সুন্দরকে মানসে অর্পন করিয়া তৎপর নিজে প্রসাদ গ্রহন করেন। গৌর হরি থাকেন গম্ভীরায়-তার তিন দিকে তিনটি কপাট তাহা প্রায় রুদ্ধ থাকে। গভীর রাত্রে প্রেমের আবেগে কোনদিন ছুটিয়া বাহিরে যান । শ্রীবিষ্ণূপ্রিয়াও থাকেন সর্বদাই রুদ্ধ গৃহে। কখনও বাহির হন না। কোন পুরুষের মুখ দেখেন না। একাকি গৃহ মধ্যে বিরহতাপে গুমরিয়া মরেন।
শ্রীগৌরসুন্দর দিনে একবার ছূটিয়া গিয়া দারুব্রহ্ম শ্রীজগন্নাথের মুখারবিন্দ দর্শন করেন।শ্রীগৌরহরির একটি দারুবিগ্রহ তৈয়ারী করাইয়া লইয়াছেন। গৃহ মধ্যে থাকিয়া তাহার শ্রীমুখদর্শন করেন আর প্রাণ উগরিয়া অন্তরের কথা বলেন। শ্রীগৌরহরির কথা বলার জন্য আছেন দুটি মরমী লোক,স্বরুপ আর রাম রায়,শ্রীবিষ্ণূপ্রিয়ার কেহ নাই কথা বলার মত। যদি লোচন দাসের মতন কোন গৌরভক্ত শ্রীগৌর সম্বন্ধে কিছূ পদ পদাবলী লিখিয়া আনিয়া পাঠ করেন। তাহা নিরবে শূনেন,কিছু বলেন না।আনন্দ বা দুঃখ বিরহকাতর বদনে ফূটিয়া উঠে শ্রীগৌর হরি সেবা করেন গোবিন্দ,তাহার সঙ্গে প্রভু দুই একটি কথা বলেন। শ্রীবিষ্ণূ প্রিয়ার সেবা করেন ঈষাণ,তার সঙ্গে কোন কথা হয় না। সে দুই কলসী জল দিয়া যায়।
শ্রীগৌর সুন্দর ছিলেন কাশীমিশ্রাবাসে গম্বীরায়। তখন নবদ্বীপের জগন্নাথ মিশ্রের বিরহ স্তব্ধ গৃহে কি মহাগম্ভীরা লীলা হয় নাই?আমরা হতভাগ্য বাঙ্গালী জাতি নিজের ঘরের মহাধন চিনি না।তীর্থ করিতে উড়িষ্যায়,যুক্তপ্রদেশে ঘুরিয়া বেড়াই। নদীয়া ঠাকুরকে নদীয়াই রাখিতে ঐ একটি মন্ত্রই আছে।–
“জয় শচী নন্দন জয় গৌর হরি।
বিষ্ণূপ্রিয়া প্রাণণাথ নদীয়া বিহারী।।”

-ভাগবত গঙ্গোত্তরী ড,মহানামব্রত ব্রহ্মচারী।