শ্রীকৃষ্ণের জন্ম লীলা


শ্রীকৃষ্ণের জন্ম লীলা

কমলাপতি দাস ব্রহ্মচারী

Sri Krishna

অনেক মানুষের মনে শ্রীকৃষ্ণ নিয়ে বহু প্রশ্ন জাগে।  যেমন শ্রীকৃষ্ণ দেবকী পুত্র না যশোদা পুত্র।  কেন শ্রীকৃষ্ণের জন্ম তারিখ জানা যায় না,  শ্রীকৃষ্ণ কি আদৌ এসেছিলেন এই জগতে?  এই রকম বহু প্রশ্ন করেন ভক্তদের।  তাই সাধু-গুরু-বৈষ্ণবদের কৃপায় যা জেনেছি, সেটি ভক্তদের উপকারার্থে লেখার চেষ্টা করছি মাত্র।

প্রশ্ন করা জীবের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি।  শ্রীল সনাতন গোস্বামী মহাপ্রভুকে প্রশ্ন করেছিলেন আমি কে?  কেন আমি ত্রিতাপ দুঃখ পাচ্ছি?  আসলে ভগবানের করুণা লাভের একটি সহজ পন্থা ভক্তসঙ্গে ভগবানের কথা জানা।  ভগবানও তাঁর বিভিন্ন লীলার মাধ্যমে আমাদের সুযোগ প্রদান করে রেখেছেন যাতে আমরা ভক্তসঙ্গ লাভ করতে পারি।

আজ থেকে ৫,২৪২ বৎসর পূর্বে শ্রীকৃষ্ণ এই ধরাধামে আবির্ভূত হয়েছিলেন সেই দিন ছিল বুধবার, রোহিনী নক্ষত্র, হর্ষণযোগ, ভাদ্র মাস, কৃষ্ণপক্ষ, অষ্টমী তিথি এবং মধ্য রাত্রি।

জ্যোতিষ বিজ্ঞান অনুযায়ী কলি প্রবেশ করেছে এই জগতে শুক্রবার মাঘী পূর্ণিমার দিন।  কারণ এই দিন এই জগৎ থেকে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অন্তর্ধান হন।  তাই জ্যোতিষ বিজ্ঞান প্রমাণ করেছে খ্রীঃ পূর্ব ৩,১০১বৎসর + ২,০১৬ বৎসর + ১২৫ বৎসর = ৫,২৪২ বৎসর।

দেবকীনন্দন ও যশোদানন্দনের সঙ্গে কি সম্পর্ক তা ভালভাবে জানতে হলে আমাদের আগে বংশ সম্বন্ধে জানতে হবে এবং তার মাধ্যমে জানতে পারব শ্রীকৃষ্ণ কিভাবে এই জগতে এসেছিলেন।

ব্রহ্মার পুত্র অত্রি মুনি, তাঁর পুত্র সোম বা চন্দ্র, তাঁর পুত্র বুধ।  বুধের পুত্র পরম্পরায় মহারাজ নহুষ এবং তাঁর পুত্র মহারাজ যযাতি এবং তাঁর পুত্র যদু। তাই কখনও কখনও আমরা বলি শ্রীকৃষ্ণ চন্দ্র বংশে বা যদু বংশে জন্ম গ্রহণ করেছিলেন।

এই বংশ পরম্পরায় একজন ধার্মিক রাজা ছিলেন; তাঁর নাম ছিল দেবমীঢ়।  দেবমীঢ় দুই জনকে বিবাহ করেন।  একটি ক্ষত্রিয় কন্যাকে বিবাহ করে শূরসেন নামক পুত্র লাভ করেন।  আর বৈশ্য কন্যাকে বিবাহ করে পর্জন্য নামক পুত্র লাভ করেন।

পরবর্তীতে বৈশ্যকন্যার পিতা নাতি পর্জন্যকে নিয়ে গিয়ে গোপ বংশের যুবরাজ করে দিলেন।  পর্জন্য রাজা বরীয়সী গোপীকে বিয়ে করে নন্দীশ্বরে বাস করতে লাগলেন।  নারদ মুনির কৃপায় ও লক্ষ্মী-নারায়ণের কৃপায় পাঁচটি পুত্র ও দুই কন্যা লাভ করলেন।  পাঁচ পুত্রের নাম উপানন্দ, অভিনন্দ, নন্দ, সুনন্দন ও নন্দন।

সর্বগুণে শ্রেষ্ঠ ছিলেন নন্দ। তাই নন্দ রাজসিংহাসনে বসলেন।  পরবর্তীতে সুমুখ নামক এক গোপের কন্যা যশোদাকে বিয়ে করে নন্দ মহারাজ সুখে বসবাস করতে লাগলেন।  প্রকৃতপক্ষে এঁরা হলেন নিত্য ভগবদ জনকজননী।  এসব হলো লীলা।

অন্যদিকে দেবমীঢ় ক্ষত্রিয় কন্যাকে বিবাহ করে যে শূরসেন নামক পুত্র লাভ করেছিলেন।  তাকে নিজ রাজ্যপদ দান করলেন এবং পরবর্তীতে বিবাহ করে দশটি পুত্র ও পাঁচটি কন্যা লাভ করলেন।  বড় পুত্রের নাম হলো বসুদেব এবং বড় কন্যার নাম পৃথা বা কুন্তী যিনি পঞ্চপান্ডবের মা।  বসুদেব মথুরার সিংহাসনে উপবিষ্ট উগ্রসেনের ভাই দেবকের কনিষ্ঠ কন্যা দেবকীকে বিবাহ করেন।  কংস উগ্রসেনের বড় পুত্র তৎকালে সে যুবরাজ পদে প্রতিষ্ঠিত; তাই কংস ছোট ভগ্নিকে খুব ভালবাসেন শুধু নয়, বিবাহের সমস্ত ব্যয়ভার বহন করে নিজে রথ চালিয়ে শ্বশুর বাড়ী পৌঁছে দিতে গেলেন।  কংসরাজের আদেশে সকলের মহানন্দে উল্লাসে চলছে।

দেবতাগণ দেখলেন, যেভাবে কংস ভগ্নী ও ভগ্নীপতির সেবা করছে ‘প্রভু শ্রীকৃষ্ণ’ হলেন ভক্ত প্রিয় তাই তিনি পিতামাতার সেবা দেখে প্রসন্ন হয়ে যেতে পারেন।

যখন ধরিত্রী দেবী গোমাতার রূপ ধারণ করে পাপের ভারে অসহনীয় হয়ে ব্রহ্মার কাছে গিয়ে ছিলেন তখন  তেত্রিশ কোটি দেব দেবী  এমনকি শিবজি সহ গিয়ে ক্ষীর সমুদ্রের তীরে গিয়ে প্রার্থনা করেছিলেন তখন ‘প্রভু’ প্রার্থনায় সাড়া দিয়ে বলেছিলেন, “আমি বসুদেবের পুত্র হয়ে জন্মগ্রহণ করে পৃথিবীর ভার হরণ করার জন্য অসুরদের বিনাশ করব।”
এই সব চিন্তা করে দেবতাগণ আকাশ বাণী করে কংসকে বললেন, “হে অবোধ কংস!  তুমি যে ভগ্নি দেবকীকে এত যত্ন করে নিয়ে যাচ্ছ তাঁর অষ্টম গর্ভের সন্তান তোমাকে সংহার করবে।”  এইভাবে তিনবার ধ্বনি হলো।  কংস শ্রবণ মাত্রই অগ্নির মতো জ্বলে উঠল।  রথ থেকে নেমে দেবকীর ফুলমালা মণ্ডিত কেশগুচ্ছ ধরল এবং শানিত তরবারির দ্বারা আঘাত করতে চাইল।  বসুদেব তখন সুন্দরভাবে কংসকে বোঝাতে চাইলেন, “দেখুন ভোজরাজ কংস, এই জগতের প্রতিটি জীবকেই একদিন দেহ ত্যাগ করতে হবে, অতএব মৃত্যুর জন্য ভয় করে কি লাভ?  জীব কর্ম ও গুণ অনুযায়ী যেকোন যোনীতে জন্মগ্রহণ করুক না কেন, সেই দেহতেই সে একটা সুখ অনুভব করবে।  আর আপনি নিজের কানে শ্রবণ করেছেন দেবকীর অষ্টম গর্ভের সন্তান আপনাকে বধ করবেন, অতএব দেবকীর কাছ হতে কোন ভয়ের কারণ নেই।  আর এই দেবকীর সমস্ত সন্তান জন্মগ্রহণ করা মাত্রই আপনার হাতে তুলে দেব।”  কংসের মন একটু নরম হল এবং বসুদেবের প্রতিজ্ঞার উপর বিশ্বাস করে মথুরায় গমন করলেন।

শ্রীমদ্ রাধাগোবিন্দ স্বামী গুরুমহারাজ এই প্রতিজ্ঞা সম্বন্ধে বলেছিলেন, “বসুদেব এমনভাবে বলেছিলেন, যে সন্তানের কাছ থেকে তোমার ভয়, সেই সন্তান ছাড়া সব সন্তান তোমাকে জন্মগ্রহণ করা মাত্রই ফিরিয়ে দেব।”  বসুদেবের সব সন্তান ফিরে পাবো এটা কংস শ্রবণ করেই আনন্দ পেয়েছিলেন।

পতি বসুদেবের গৃহে ফিরে এসে দেবকী দেবী কাঁদতে কাঁদতে বললেন, “হে নাথ! জীবনের প্রথম মুহূর্তে এত বিপদ, ভবিষ্যতে না জানি কত বিপদ আছে?”  বসুদেব বললেন, “প্রিয়ে, শ্রবণ কর, যে হরির চরণ যোগীগণ শত শত জন্ম ধরে তপস্যা করেও পান না, তুমি বিনা তপস্যায় পুত্র রূপে পাচ্ছ।  আর এতটুকু ক্লেশ যদি সহ্য করতে না পার তবে অত বড় দুর্লভ বস্তুকে কি করে পাবে?”  দেবকী দেবী পতিদেবকে বন্দনা করে স্নানাদি কার্য সমাপ্ত করলেন।

আমরা জানি কংস বসুদেবের ছয় পুত্রকে হত্যা করেছিল।  এখন প্রশ্ন আসবে তারা কে ছিল কেনই বা মারা গেল।

এখন কেউ প্রশ্ন করতে পারেন কংসের পিতা উগ্রসেন তো অসুর ছিলেন না, কিন্তু কংস কি করে অসুর হল এবং কেনই বা তার ছয় জন ভাগ্নেকে নিজের হাতে মারলেন?

এর উত্তর হচ্ছে উগ্রসেনের স্ত্রী পদ্মাবতী যখন একদিন ছাদের উপর ভ্রমণ করছিলেন তখন দ্রুমিল নামে এক অসুর মায়াবী শক্তির বলে ছদ্মবেশে এসে সঙ্গ করছিল।  তাই উগ্রসেনের সন্তান হওয়া সত্ত্বেও কংসের মধ্যে অসুরের স্বভাব ছিল।  আর কেন ভাগ্নেদের নিজে হাতে মারলেন?  এর উত্তর হচ্ছে এক সময় ব্রহ্মা নিজ কন্যার প্রতি কামবশতঃ পিছনে পিছেন দৌঁড়াতে দেখে ব্রহ্মার পৌত্র অর্থাৎ মরীচির ছেলেরা হোহো করে উচ্চৈস্বরে হেসেছিল।  তখন ব্রহ্মা ক্রোধান্বিত হয়ে অভিশাপ দিয়েছিলেন, তোমরা অসুর যোনিতে জন্ম গ্রহণ কর।

পরবর্তীতে মরীচির ছয় জন পুত্র হিরণ্যাক্ষের পুত্র কালনেমির পুত্র রূপে জন্মগ্রহণ করে।  পূর্ব সংস্কার হিসেবে ভগবানের আরাধনা করতে গেলে হিরণ্যকশিপু ক্রোধান্বিত হয়ে অভিশাপ দেন তোমরা পিতৃকুলের মর্যাদা লঙ্ঘন করে পিতৃশত্রু শ্রীহরির উপাসনা করতে গিয়েছো তাই তোমাদের মৃত্যু পিতৃ হস্তে হবে।  তাই তারা জন্ম নিল একে একে মা দেবকীর গর্ভে এবং কালনেমি জন্ম নিল কংস রূপে।  তাই কংসের হাতে তাদের মৃত্যু হয়ে হিরণ্যকশিপুর শাপ থেকে মুক্ত হলেন।  সেই কারণে কংস তাদেরকে নিজের হাতে মারলো।

শ্রীল বিশ্বনাথ চক্রবর্তী ঠাকুরের মতে (শ্রীমদ্ভাগবতম্ ১০/২/২৮)  মরীচি হচ্ছে মনের অবতার আর মনের ছয়টি পুত্র- কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ এবং মাৎসর্য।  এই ছয়টি পুত্রের বিনাশের পর ভগবানের আবির্ভাবের উপযুক্ত আয়োজন করার জন্য।  সপ্তম গর্ভে বলদেব আবির্ভাব হলেন।  ভগবানের সর্ববিধ লীলার সহায়ক বলদেব।  দেবকী মায়ের গর্ভ স্থান শুদ্ধ করার জন্য বলদেব প্রথমে দেবকীর গর্ভে সপ্তমাস অবস্থান করার পর ভগবানের নির্দেশে যোগমায়া আকর্ষণ করে গোকুলে অবস্থানরতা মা রোহিনীর গর্ভে স্থাপিত করলেন।  কিন্তু এই কার্যটি উভয়পক্ষ কাউকেও জানতে দিলেন না।  দেবকী দেবীর গর্ভশূন্য দেখে সকলেই আশ্চর্য হলেন।

দেবকী দেবীর এবার অষ্টম গর্ভ সর্ব জগৎ নিয়ন্তা তার গর্ভের মধ্যে আবির্ভূত হলেন।  কংস দেবকী দেবীর দিকে দৃষ্টিপাত করতে পারছে না, কারণ এক মহা তেজপুঞ্জ যেন তাকে দগ্ধ করছে।  অলক্ষ্যে দেব-দেবীগণ এসে মা দেবকী দেবীর গর্ভকে লক্ষ্য করে স্তুতি করতে লাগলেন।

গোকুলে নন্দ মহারাজ ও যশোদা পুত্র কামনায় অনেক প্রকার পূজা তথা তীর্থ ভ্রমণ করলেন।  অবশেষে নন্দরাণী গৃহাভ্যন্তরে নারায়ণের কাছে কান্না করতে লাগলেন।  অন্যদিকে বড় ভাই বিরাট যজ্ঞ করতে লাগলেন।  নন্দ মহারাজ একদিন যশোদা রাণীকে বললেন, “দেখ প্রিয়ে স্বপ্ন মধ্যে বা ধ্যানের মধ্যে কখনও কখনও আমি তোমার বক্ষস্থলে এক অবর্ণনীয় শিশুকে তোমার স্তন পান করতে দেখেছি।”  যশোদা রাণী বললেন, “হে স্বামী!  আমিও দেখেছি কিন্তু লজ্জাবশতঃ  তা ব্যক্ত করিনি।”  ব্রজেশ্বরী বললেন, “হে দেব!  নারায়ণের সন্তুষ্টি বিধানের জন্য আমরা এক বৎসর দ্বাদশী ব্রত করব।”

সেই সময় দেবদুন্দুভী ধ্বনিতে দশদিক মুখরিত হয়ে উঠল।  ব্রত সমাপনান্তে স্বয়ং নারায়ণ স্বপ্নে এসে নিত্য পিতা-মাতাকে জানিয়ে দিলেন, তোমরা পূর্বে ধরা ও দ্রোণ ছিলে, পুত্র রূপে আমার সেবা করতে চেয়েছিলে, সেই আশা অতি শীঘ্র পূর্ণ হবে।  নারায়ণ এইরূপ বলে অন্তর্ধান হলেন।  নন্দ, যশোদা জেগে উঠলেন এবং আনন্দসিন্ধুতে ভাসতে লাগলেন।  অতঃপর অতি হর্ষভরে যমুনায় স্নান করে বহু সাধুসন্ন্যাসী, এমনকি যারা উপস্থিত ছিলেন সকলকে দান দিলেন।  গৃহে ফিরে এসে দ্বারদেশে মহাযোগিনী পৌর্ণমাসি এবং ব্রহ্মচারী মধুমঙ্গলকে দেখলেন।  তাঁদের গৃহাভ্যন্তরে যথাযোগ্য সম্মান প্রদর্শন করলেন।  পৌর্ণমাসি বললেন, অতি শীঘ্র সর্বানন্দ কন্দ কদম্ব স্বরূপ সুন্দর পুত্র হবে।

অনন্তর মাঘ মাসে কৃষ্ণপক্ষ প্রতিপদ তিথির রাত্রকালে যখন যশোদা মা শ্রীনন্দ মহারাজের সেবা করেছিলেন, ঐ সময় যশোদা মা এক স্বপ্ন দেখলেন এক শ্যামবর্ণ বালক পূর্বে যাকে তার বক্ষস্থলে খেলা করতে দেখেছিলেন সেই বালকটিকে এক স্বর্ণকান্তি যুক্তা একটি বালিকা আবৃত করতঃ যেন নন্দ মহারাজের হৃদয় থেকে তার হৃদয়ে প্রবেশ করলেন।  এরপর থেকে নন্দরাণীর গর্ভ চন্দ্রাকলার ন্যায় দিন দিন বাড়তে লাগল।  অলক্ষ্যে দেবতাগণ স্তুতি গান করতে লাগলেন।  নন্দপুরী সর্বদাই আনন্দময়, গোপ-গোপীগণ সর্বদা বিবিধ বেশভুষাদি সজ্জায় সজ্জিত হচ্ছেন।  ব্রাহ্মণগণ, দেবগণ, সাধুগণ, সকলেই হরিকীর্তনে মগ্ন থাকলেন।

হরিবংশ গ্রন্থে এইভাবে উল্লেখ আছে, অষ্টম মাস পূর্ণ হলে কৃষ্ণাষ্টমী তিথি, ভাদ্রমাস, বুধবার হর্ষণযোগ রোহিনী নক্ষত্র মধ্য রাত্রি কাল উপস্থিত হল, একই সময়ে সর্বানন্দময় সচ্চিদানন্দ ভগবান দেবকীদেবীর গর্ভ হতে শ্রীকৃষ্ণের প্রাভব বিলাস চর্তুভুজ রূপে মা দেবকী ও বসুদেবের সম্মুখে আবির্ভূত হলেন।  ঠিক একই সময়ে গোকুলে শ্রীযশোদার গর্ভ সিন্ধু হতে স্বয়ং রূপ ভগবান দ্বিভুজ নরশিশুর ন্যায় জন্মগ্রহণ করলেন এবং কয়েক ক্ষণের মধ্যে কন্যা যোগমায়া ও মহামায়ার সহিত জন্ম গ্রহণ করলেন।  কিন্তু যশোদা মা কেবল অনুভব করলেন সন্তান হয়েছে, তা পুত্র না কন্যা কিছুই বুঝতে পারলেন না।  (শ্রীমদ্ভাগবতম্ ১০/২/৯ এবং ১০/৫/২ তাৎপর্য)

srikrishna-birth-jananam-desibantu

এইদিকে মা দেবকীর সম্মুখে ভগবান চতুর্ভুজ রূপে দর্শন দিয়ে বলতে লাগলেন, “হে সতী! স্বায়ম্ভুব মন্বন্তরে তুমি পৃশ্নি এবং বসুদেব সুতপা নামক প্রজাপতি ছিলে।  তপস্যায় সন্তুষ্ট হয়ে এই রকম চতুর্ভুজ রূপ দর্শন দিয়েছিলাম।  তখন তোমরা আমার ন্যায় পুত্র কামনা করেছিলে, সেই কারণে দিব্য চতুভুর্জ মূর্তিতে দর্শন দিলাম।  এখন আমাকে গোকুলে নন্দ মহারাজের গৃহে রেখে এসো।  আমি উপযুক্ত সময়ে এসে কংসকে বধ করে তোমাদের যাবতীয় দুঃখ মোচন করব।  ভগবান এরূপ বলতে বলতে সামান্য শিশু রূপ প্রকাশ করলেন।
বসুদেব কৃষ্ণকে কোলে নেওয়া মাত্রই সকল বন্ধন খুলে গেল।  প্রহরীরা গভীর নিদ্রায় নিদ্রিত হলো।  যমুনা পার হয়ে বসুদেব নন্দগৃহে এসে নন্দরাণীর কন্যাটিকে গ্রহণ করে স্বপুত্রকে যশোদার কাছে রেখে পুনর্বার সেই পথে মথুরায় ফিরে এলেন।  এখন কেউ প্রশ্ন করতে পারেন, বসুদেব কি স্বয়ং কৃষ্ণকে দেখতে পাননি।  তার উত্তরে বলা হয়েছে, যোগমায়া নিজ কান্তির দ্বারা আচ্ছাদিত করে রেখেছিলেন এবং মেঘের মধ্যে যেমন সৌদামিনী বিলীন হয় তদ্রুপ বসুদেবের পুত্র নন্দপুত্রে বিলীন হলেন।

বসুদেব মহামায়াকে নিয়ে গেলেন কারণ যোগমায়াকে অসুর স্পর্শ করতে পারে না।  যোগমায়া গোকুলে থেকে সারারাত্র পাহারা দিয়ে কাউকে জানতে দিলেন না।  রাত্রি শেষ হলে ভগবানও দেখলেন, সকলকে আমি জাগাব।  এই বলে ওঁম, ওঁম শব্দে অতি উচ্চস্বরে যেন কেঁদে উঠলেন।  ঐ ধ্বনি সকল গোকুল মণ্ডলকে জাগিয়ে দিল।  সকলে এসে এমনভাবে আনন্দ উৎসব করতে লাগল, এই উৎসব একমাস ধরে চললো।

যশোদানন্দন ও দেবকীনন্দনের মধ্যে কী পার্থক্য ?

স্বয়ংরূপের গোপবেশ, গোপ-অভিমান।
বাসুদেবের ক্ষত্রিয়-বেশ, ‘আমি ক্ষত্রিয়’-জ্ঞান ॥
(চৈঃ চঃ মধ্য ২০ পরিচ্ছেদে শ্লোক ১৭৭)