বঙ্গে কালীপুজোর উদ্ভব ও বিকাশ


বাংলার উত্সবের এক অন্যতম অঙ্গ এই কালীপুজো, যা শ্যামাপুজো নামেও পরিচিত। দুর্গাপুজোর মতোই কালীপুজোও যে ঠিক কে কবে আরম্ভ করেছিল তা সঠিক ভাবে বলা কঠিন, তবে অনুমান করা হয় বাংলায় কালীপুজোর ইতিহাস হয়তো বা দুর্গাপুজোর থেকেও প্রাচীন।

গবেষকরা মনে করেন খ্রিস্টের জন্মের প্রায় দু’হাজার বছর আগে, মধ্য এশিয়া থেকে আসা আর্য জাতিগোষ্ঠী ভারতবর্ষে এসে যে ধর্মাচারণের সূত্রপাত ঘটিয়েছিল, তারই এক পরিবর্তিত রূপ আজকের হিন্দুধর্ম। সেই সূত্রে আর্যদের প্রধান ধর্মগ্রন্থ বেদ— হিন্দু ধর্মের প্রধান আকর গ্রন্থ হিসাবে বিবেচিত হয়। তবে প্রশ্ন থেকে যায় যে বেদের তিন প্রধান দেবতা ইন্দ্র, মিত্রাবরুণ ও যম আজকের হিন্দু ধর্মের প্রধান দেবতা নন কেন? এর উত্তর, হিন্দু ধর্ম বলতে আজকের দিনে আমরা যা বুঝি তা আসলে তথাকথিত কোনও একক ধর্ম নয়, এক আচরণ মাত্র— যার মূল প্রোথিত রয়েছে ভারতবর্ষের সনাতন সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের মধ্যে।
আর্যদের এ দেশে আসার আগে এখানকার অধিবাসীদের মধ্যে যে সমস্ত ধর্মাচারণ ছিল, মূর্তিপুজো তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য। আর্যরা এ দেশের জনগোষ্ঠীর সঙ্গে যতই মিশে যেতে থাকে, এখানকার প্রাচীন আচার-ব্যবহার এবং বিভিন্ন ধর্মীয় আচরণ আর্য-সংস্কৃতির অন্তর্ভুক্ত হতে থাকে তত বেশি মাত্রায়। এই সাংস্কৃতিক আদান প্রদানের একটা পর্বে রচিত হয়েছিল রামায়ণ ও মহাভারতের মতো দু’খানি মহাকাব্য। মনে রাখতে হবে এই দুই কাব্য কিন্তু ধর্মগ্রন্থ নয়। এই সময়কাল থেকেই ঋগবেদের প্রধান ত্রিদেব ইন্দ্র, মিত্রাবরুণ ও যমের স্থলাভিষিক্ত হচ্ছেন অনার্য দেবতা ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বর। পাওয়া যায় মাতৃরূপিনী আদ্যাশক্তি মহামায়ার উপাসনার কথাও।

খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে প্রবর্তিত হয় বৌদ্ধ ধর্ম। এই ধর্ম প্রাথমিক ভাবে হিন্দু ব্রাহ্মণ্য ধর্মের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ স্বরূপ উদ্ভুত হলেও, একটা সময়ের পরে, বিশেষ করে গৌতম বুদ্ধের মৃত্যুর পর, এর মধ্যেও তন্ত্র-মন্ত্রজাত বিভিন্ন সংস্কার প্রবেশ করে। হিন্দু ধর্মের মতো বৌদ্ধ ধর্মেও রয়েছে অজস্র তন্ত্র-গ্রন্থ। বৌদ্ধেরা হিন্দুদের তথাকথিত দেবদেবীতে বিশ্বাসী না হলেও হিন্দু তন্ত্রকে তারা শুধু গ্রহণই করেনি, তাকে আরও পরিশীলিত ও পরিমার্জিত করেছিল বলা যায়।

খ্রিস্টীয় সপ্তম শতকে নালন্দা, বিক্রমশীলার বৌদ্ধ বিহারগুলিতে বৌদ্ধতন্ত্রের চর্চা ছিল। ঐতিহাসিক ও গবেষকদের রচনা থেকে জানা যায়, বিভিন্ন হিন্দু পুরাণে যে দশ মহাবিদ্যার (কালী, তারা, ষোড়শী, ভুবনেশ্বরী, ভৈরবী, ছিন্নমস্তা, ধূমাবতী, বগলা, মাতঙ্গী ও কমলা) উল্লেখ রয়েছে তা বৌদ্ধ তন্ত্রজাত। এ ছাড়া উগ্রা মহোগ্রা, বজ্রা, কালী, সরস্বতী, কামেশ্বরী, ভদ্রকালী, তারা নামের শক্তির অষ্ট রূপ ও তাদের মন্ত্রাবলীও বৌদ্ধতন্ত্র থেকেই এসেছে। প্রাথমিক পর্বে বৌদ্ধ ধর্মের মধ্যে কোনও মূর্তি পুজোর উল্লেখ না থাকলেও পরবর্তীকালে তার সংযুক্তি ঘটে। সাধনমালা নামে এক বৌদ্ধতন্ত্রে মহা সরস্বতী, বজ্রবীণা সরস্বতী ও আর্য সরস্বতীর ধ্যানের উল্লেখ রয়েছে। জাপানে চনস্টি নামের এক বহুভুজা দেবীমূর্তিকে বুদ্ধমাতৃকা রূপে আরাধনা করা হয়। তিব্বতি লামারা ঊষার দেবতা রূপে বৌদ্ধ মারিচী দেবীর পুজো করেন। মূর্তি ভেদে তা কখনও দ্বিভুজা, চতুর্ভুজা, দশভুজা কিংবা দ্বাদশভুজা। সাধারণ ভাবে এই তথ্যগুলি আশ্চর্য মনে হলেও এটাই স্বাভাবিক। ধর্ম অনেকাংশেই লোকাচার সম্ভূত। স্থান-কাল ভেদে মানুষের পোশাক, খাদ্যাভ্যাস যেমন বদলায়, তেমনই বদলায় ধর্মীয় আচার আচরণও।

বৌদ্ধধর্ম খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে প্রবর্তিত হলেও তা বিস্তৃতি লাভ করেছিল মৌর্য সম্রাট অশোকের রাজত্বকালে (সম্রাট অশোক রাজত্ব করেছেন খ্রিস্টপূর্ব ২৭৩ থেকে ২৩২ অব্দ পর্যন্ত) বা আরও স্পষ্ট ভাবে বলা যায় খ্রিস্টপূর্ব ২৬১ অব্দে কলিঙ্গ যুদ্ধের পরেই বৌদ্ধ ধর্মের প্রকৃত প্রসার আরম্ভ হয়েছিল। বাংলায় বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাব ও প্রতিপত্তি বৃদ্ধি পায় খ্রিস্টীয় অষ্টম-নবম শতক থেকে এবং তা চূড়ান্ত রূপ গ্রহণ করে পাল রাজাদের আমলে। বাংলায় বৌদ্ধযুগে লোকসাধারণের ধর্ম পাল্টাল বটে কিন্তু সংস্কার-লোকাচার রয়ে গেল বহুলাংশেই। এখানকার বিভিন্ন প্রাচীন লৌকিক দেবদেবী এ বার পূজিত হতে লাগল বৌদ্ধ তন্ত্রমন্ত্র অনুসারে।

পাল রাজাদের পর বাংলার শাসন ক্ষমতা আসে সেন রাজাদের হাতে। এঁরা ছিলেন কট্টর হিন্দু ধর্মাবলম্বী এবং বাংলায় হিন্দু যুগ ফিরিয়ে আনার প্রধান হোতা। ইতিমধ্যে শঙ্করাচার্য ও তাঁর অনুগামীদের হাতে বৌদ্ধ বিতাড়নের কাজ সম্পূর্ণ হয়ে উত্তর ভারতেও ফিরে এসেছে হিন্দু যুগ। বাংলার শক্তি আরাধনা চলতে লাগল আগের মতোই। তবে তার প্রকৃতি পাল্টে গেল হিন্দু যুগের আচার অনুযায়ী।

কিছু কালের মধ্যেই বাংলার রাজনৈতিক ও সামাজিক জীবনে এল এক বিরাট পরিবর্তন। হিন্দু রাজত্ব শেষ হয়ে কায়েম হল ইসলাম শাসন। রাজনৈতিক পট পরিবর্তন যে সামাজিক জীবনেও প্রভাব বিস্তার করবে সেটাই স্বাভাবিক। মুসলিমদের ধর্মীয় আগ্রাসন রুখতে আরম্ভ হল ভক্তিবাদ আন্দোলন। বাংলার সমাজ আন্দোলনের এমনই এক সন্ধি ক্ষণে ১৪৮৬ খ্রিস্টাব্দে নবদ্বীপে জন্মগ্রহণ করলেন শ্রীচৈতন্যদেব। আর তাঁর ভক্তি আন্দোলনের জোয়ারে মেতে উঠল সমগ্র বঙ্গদেশ।

এক দিকে মুসলিম আগ্রাসন, অন্য দিকে চৈতন্য প্রবর্তিত কৃষ্ণপ্রেমের জোয়ার— এই দুইয়ের মাঝে বাংলার সনাতন শক্তি-চেতনা যেন ক্রমেই কোণঠাসা হয়ে যেতে বসেছিল। এমন অবস্থায় ওই নবদ্বীপেই জন্ম নিলেন আর এক যুগস্রষ্টা পুরুষ কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ। কৃষ্ণানন্দের জন্ম-মৃত্যু সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা না গেলেও বলা হয়ে থাকে তিনি ছিলেন এক জন বিশিষ্ট শাক্ত তন্ত্রশাস্ত্র পণ্ডিত। বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা, শক্তি হিসাবে পূজিত লৌকিক দেবদেবীদের একটি সংহত রূপ দেওয়ার জন্য উদ্যোগী হন তিনি। পুরাণের বর্ণনা ও লৌকিক মূর্তি সমূহের আকৃতিগত বিভিন্নতা দূর করার জন্য কালীর একক মূর্তি প্রবর্তন করেন কৃষ্ণানন্দ। বর্তমানে আমরা কালীর যে প্রতিমা দেখি তার রূপকার ওই কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ।

পরবর্তী কালে বাংলার শাক্ত চেতনাকে জাগ্রত করার কাজে সাধক বামাক্ষ্যাপা, রামপ্রসাদ সেন, কমলাকান্ত এবং শ্রীরামকৃষ্ণদেবের অবদান বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য। একদা লৌকিক দেবী হওয়া সত্ত্বেও, কালীর আর্য দেবতা হয়ে ওঠায় বৌদ্ধ তন্ত্রের অবদান যেমন আছে, আবার লোকসাধারণের দেবী থেকে সর্বজনের দেবী হিসেবে উত্তরণে বাংলার ওই বিশিষ্ট সাধকদের ভূমিকাও কম নয়।

তথ্য: গৌতম বসুমল্লিক

বৈদিক বর্ণাশ্রম কি জন্মনির্ধারিত?


বৈদিক চারটি প্রধান বর্ণ ব্রাহ্মণ,ক্ষত্রিয়,বৈশ্য,শূদ্র এদের সংগা ও কিভাবে এদের শ্রেণীবিভাগ হয় এবং সমাজে তাদের অবস্থান নিয়ে আলোচনা করব । এই পোস্টে প্রাথমিক ধারণা ও পরে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে ।তার আগে আসুন দেখে নিই আমরা যে কথায় কথায় “caste” শব্দটি ব্যবহার করি “বর্ণ” অর্থে, সেই caste আর বর্ণ এক কি না ?আমরা caste শব্দটি যে অর্থে ব্যবহার করি বেদে এর সমার্থক কোন শব্দের লেশমাত্র নেই !! প্রকৃতপক্ষে “caste” “জাতি” “বর্ণ” প্রত্যেকটি ভিন্ন শব্দ এবং ভিন্ন অর্থবাচক।caste শব্দটি অনেক পরে ইউরোপ থেকে আমদানিকৃত।বর্ণাশ্রম (2)

জাতিঃ

সহজভাবে জাতি শব্দের অর্থ হলো উৎপত্তি অনুসারে বিভাজন । ন্যায় শাস্ত্র মতে জাতি মানে একই উৎস থেকে যাদের সৃষ্টি। সহজভাবে বলতে গেলে আমরা যদি ঋষিদের করা আদি জাতিবিভাগের দিকে তাকাই তবে বিষয়টি সহজ হবে ; উদ্ভিজ্জ(যারা মাটি ভেদ করে জন্মায়।যেমনঃ সাধারণভাবে সকল গাছ),অণ্ডজ(যারা ডিম ফুটে বের হয়।যেমনঃ পাখি,কিংবা সরীসৃপ),পিন্ডজ(স্তন্যপায়ী) এবং উস্মজ (পুনরৎপাদনক্ষমতাসম্পন্ন।যেমনঃব্যাক্টেরিয়া প্রভৃতি)|একইভাবে গরু,ঘোড়া,গাধা,হরিণ,হাতি প্রভৃতি ভিন্নজাতি। আবার সমগ্র মানবকূল একটি “জাতি”|একটি নির্দিষ্ট জাতির শারীরিক বৈশিষ্ট অন্য জাতি থেকে সর্বদাই পৃথক হয় এবং সাধারণভাবে কখনই তাদের মধ্যে সংকরায়ন সম্ভব নয় । সাধারণভাবে মনুষ্য জাতির কারো দ্বারা কখনই কোন হাতির গর্ভাধান সম্ভব নয় । কারণ এরা দুটি ভিন্ন জাতি । কিন্তু তাদের নিজ জাতির মধ্যে তা সম্ভব। তাই দেখা যাচ্ছে যে, ব্রাহ্মণ ,বৈশ্য,শূদ্র কিংবা ক্ষত্রিয় এরা ভিন্ন জাতি নয়। কারণ তাদের শারীরিক গঠন ভিন্ন নয় এবং একই উৎস হতে তদের জন্ম ।

বর্ণঃ

প্রকৃতপক্ষে ব্রাহ্মণ ,বৈশ্য,শূদ্র কিংবা ক্ষত্রিয় এই শব্দগুলোর সাথে যে শব্দটি যায় সেটি হল “বর্ণ”,জাতি কদাপি নয় । “‘Varna’ means one that is adopted by choice.” বর্ণ হল নিজের কাজ ও গুণের মাধ্যমে নিজেই বেছে নেয়া । কিন্তু জাতি ঈশ্বর প্রদত্ত । এভাবেই বৈদিক ধর্মকে বলা হয় “বর্ণাশ্রম ধর্ম” । “The word Varna itself implies that this is based on complete freedom of choice and meritocracy.” যারা বুদ্ধিবৃত্তিক কাজের সাথে জড়িত থাকেন তারা বেছে নিয়েছেন “ব্রাহ্মণ বর্ণ” ,যারা যুদ্ধ ও প্রতিরক্ষায় নিয়োজিত তারা “ক্ষত্রিয় বর্ণ” ,যারা ব্যবসা-বাণিজ্য,কৃষি ও পশুপালনে জড়িত তারা “বৈশ্যবর্ণ” আরা যারা অন্যান্য কাজে জড়িত তারা বেছে নিয়েছেন “শূদ্র বর্ণ” । এটা স্পষ্ট প্রতীয়মান যে, বর্ণের সাথে এখানে “জাতি” বা জন্মের সাথে কোন সম্পর্ক নেই ,তা একান্তই ব্যক্তিগত পছন্দ ও যোগ্যতার উপর নির্ভরশীল!!

অনেক সময়ই বেদের পুরুষ সূক্তকে হাজির করা হয় জন্মের ভিত্তিতে বর্ণপ্রথার প্রমাণ হিসাবে বলা হয় যে “ব্রাহ্মণের উৎপত্তি ঈশ্বরের মুখ থেকে ,ক্ষত্রিয়ের হাত থেকে,বৈশ্যর ঊরু থেকে আর শূদ্রের পা থেকে”|কি হাস্যকর যুক্তি !! এর চেয়ে বড় প্রতারণা আর কি হতে পারে ??

ক) বেদে স্পষ্ট বলা আছে “ঈশ্বর নিরাকার” | তাহলে এটা কি পরস্পর বিরোধী বক্তব্য নয় যে একটা আকারহীন জিনিস একটা দৈত্যাকার রূপ নিল ।[যজর্বেদ ৪০/৮]।

খ) এই পুরুষাকার দেহের অংশ থেকে বর্ণ জন্ম নেবার গল্প যদি সত্য হয় তবে তা আবার বেদের যে কর্ম আছে তার বিরোধীতা করে। কেননা কর্মের মাধ্যমে একজন যে পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন তা পরিবর্তন করতে পারেন।আজকে যে শূদ্রের ঘরে জন্মেছে কর্মের মাধ্যমে সে পরজন্মে রাজার ঘরেও জন্ম নিতে পারেন।এখন একজন শূদ্র যদি ঈশ্বরের পা থেকেই জন্ম নেয় তবে কেমন করে সে আবার ঈশরের হাত থেকে জন্ম নেবে ??!!

গ) আমরা জানি আত্মা নিত্য তার কোন পরিবর্তন নেই ।আত্মা শাশ্বত পরমাত্মার অংশ ।তাই আত্মার কোন জন্ম হয় না ।তাই আত্মার কোন বর্ণ হয় না এবং সেই সুযোগও নেই । কিন্তু এই দেহ চলছে কিন্তু আত্মার কারণেই, আত্মার অনুপস্থিতি মানে মৃত্যু।এর অর্থ আত্মাই ব্যক্তির ভূমিকা পালন করছেন ।যেহেতু প্রত্যেক জীবিত মানুষের দেহেই আত্মা থাকে আর আত্মা যদি ঈশ্বরের দেহ থেকে জন্ম না নেয় তবে এটা কিভাবে সম্ভব যে দেহ খানি ঈশ্বরের দেহ থেকে জন্ম নিচ্ছে ?? যেহেতু এটা একটা চক্রের মতো আত্মা এক দেহ ত্যাগ করে অন্য দেহ ধারণ করছে তাই আপাত দৃষ্টিতে মহাপুরুষের অস্তিত্ব স্বীকার করলেও তার দেহ থেকেই যে বর্ণের সৃষ্টি তা সহজেই অস্বীকার করা যায়।তাই এটা কিভাবে বলা সম্ভব যে এই বর্ণ ঈশ্বরের এই অংশ থেকে আসছে ঐ বর্ণ ঐ অংশ থেকে আসছে।

এখন আসা যাক কারা আসলে ব্রাহ্মণ,কারা ক্ষত্রিয়,বৈশ্য,শূদ্র??

বেদের যজুর্বেদের পুরুষ সূক্তটি হল ৩১/১১|এখন দেখা যাক এর আগের সুক্তটি কি বলেঅর্থাৎ ৩১/১০ কি বলে ? ৩১/১০ এ একটি প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করা হয়েছে যে, কে মুখ ,কে হাত ,কে ঊরু এবং কে পা ? পরের মন্ত্রেই এর উত্তর পাওয়া যায়ঃ ব্রাহ্মণ হলেন মুখ , ক্ষত্রিয় হাত, বৈশ্য ঊরু আর শূদ্র পা । লক্ষ্য করুন মন্ত্রে কিন্তু এই কথা বলা নেই যে ব্রাহ্মণের জন্ম মুখ হতে কিংবা ক্ষত্রিয়ের হাত হতে । শুধু বলা আছে এরা মুখ,তারা হাত প্রভৃতি। কারণ প্রশ্নটাই ছিল কে মুখ ? উত্তরঃ ব্রাহ্মণ। বলা নেই কে কোথা থেকে জন্ম নিয়েছে । এখন ধরুন আপনাকে জিজ্ঞাস করা হল যে দশরথ কে ? আপনি উত্তর দিলেন রাম দশরথ থেকে জন্ম নিয়েছে !! উত্তর নিশ্চই অবান্তর !! অর্থাৎ সমাজে ব্রাহ্মণ হলেন তারা যারা বুদ্ধিবৃত্তিক কাজ করেন। এই জন্যেই বলা হল মুখ বা মস্তিষ্ক বা মাথা। ক্ষত্রিয়রা যেহেতু রক্ষাকার্যে নিয়োজিত তাই তারা হাতের রুপ ধারণ করেন। বৈশ্য বা ব্যবসায়ীরা হলেন উরু। অথর্ববেদে ঊরু শব্দটির বদলে “মধ্য” কথাটি রয়েছে । আর শূদ্ররা সমাজের শ্রমশক্তি তাই তা ভিত্তিমূল রুপে পায়ের রূপ ধারণ করেন এবং দেহ চলনে সহায়তা করেন । এই সূক্তের শুরুতেই বলা আছে যে এটি হল “রূপক”| তাই দুঃখ হয় যখন সমাজের এই সুন্দর গঠনের রূপক ব্যাখ্যাকে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করা হয় । অথচ পৃথিবীর যে কোন সমাজ এই গঠনের উপর দাঁড়িয়ে আছে । যে কোন সমাজ কে যদি কর্মানুসারে সাজানো যায় তাহলে কিন্তু এই গঠনই পাওয়া যাবে ।এই সূক্তের মাধ্যমে তো প্রকৃতপক্ষে শ্রমের মর্যাদাই প্রতিষ্ঠিত হয়। হিন্দু ধর্মের কোন শাস্ত্র/ধর্ম গ্রন্থই বলে না যে ঈশ্বর তার নিজ দেহের মাংস ছিড়ে ফুড়ে ব্রাহ্মণ/ক্ষত্রিয় প্রভৃতি সৃষ্টি করেছেন।

তবে এটা সত্য যে বেদে ব্রাহ্মণদের সর্বোচ্চ সম্মান দেয়া হয়েছে। এটা বর্তমান যে কোন সমাজের দিকে তাকালেই বোঝা যায়। পন্ডিত ও গুণী ব্যক্তিরাই আমদের সম্মান লাভ করেন কারণ তারাই সমগ্র মানব জাতির পথ-প্রদর্শক । কিন্তু বেদে সর্বত্রই শ্রমের মর্যাদা সমান নিশ্চিত করা হয়েছে কোথাও কোন বৈষম্য করা হয় নি ।

বৈদিক সংস্কৃতিতে সবাই শূদ্র হিসেবে জন্ম নেয় বলে ধরে নেয়া হয় ।পরবর্তীতে তার কাজ,শিক্ষা প্রভৃতি অনুসারে সে ব্রাহ্মণ,ক্ষত্রিয়,বৈশ্য হয়। তাই শিক্ষার সমাপ্তকরণ কে দ্বিতীয় জন্ম ধরা হয়। এই জন্যই প্রথম তিন বর্ণকে বলা হয় “দ্বিজ”|যে অশিক্ষিত,অজ্ঞান থেকে যায় সে শূদ্র হিসাবেই জীবন চালিয়ে যায়। তাই একজন ব্রাহ্মণের ছেলে যদি উপযুক্ত শর্তাদি পূরনে ব্যর্থ হয় সে শূদ্র হিসাবে গণ্য হবে ।অন্যদিকে একজন শূদ্রর ছেলে যদি উপযুক্ত শর্তাদি পূরন করতে পারবে তবে সে ব্রাহ্মণ/ক্ষত্রিয়/বৈশ্য বলে গণ্য হবে । এতে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই । এটা সম্পূর্ণ নিজ যোগ্যতার ব্যপার অন্য কিছুই নয় । আজকাল যেভাবে সমাবর্তন করা হয় ঠিক তেমনি শিক্ষা শেষে যজ্ঞোপবীত দেওয়া হত। তাছাড়া নির্দিষ্ট বর্ণের আচার-বিধি পালনে ব্যর্থ হলে তা কেড়ে নেওয়া হত।

কিছু উদাহরণঃ

১.ঐতেরিয় ঋষি ছিলেন একজন দস্যুপুত্র । কিন্তু তিনি নিজ গুনে ব্রাহ্মণ হোন এবং ঐতিরিয় ব্রাহ্মণ ও উপনিষদ রচনা করেন।

২.সত্যকাম জাবাল ছিলেন একজন গণিকার ছেলে কিন্তু তিনিও নিজ গুণে ব্রাহ্মণ হন ।

৩. প্রিসাধ্য(প্রিশাদ?) ছিলেন দক্ষরাজার ছেলে কিন্তু তিনি শূদ্র হয়ে যান ,পরবর্তীতে তিনি অনুশোচনা বশত তপস্যা করেন পুনরায় মুক্তি লাভের আশায় ।(বিষ্ণুপুরাণঃ ৪.১.১৪)|কই শুদ্র বলে তো কেউ তাকে আটকায় নি তপস্যা করছেন বলে?

৪.ধৃষ্ট যিনি কিনা নাবাঘ নামে শূদ্রের ছেলে ছিলেন তিনি হয়েছিলেন ব্রাহ্মণ আর তার ছেলে হয়েছিল ক্ষত্রিয় !! বাহরে বাহরে বাঃ, আমাদের সমাজে লম্পট চরিত্রহীনরা নিজেদের ব্রাহ্মণ পুত্র বলে আর আমরা বিনা বাক্য ব্যয়ে তার পা ধোয়ার ব্যবস্থা করি!!

৫.ভাগবত অনুসারে অগ্নিবৈশ্য ব্রাহ্মণ হয়েছিলেন যদিও তিনি রাজা হয়ে জন্ম নিয়েছিলেন ।

এই রকম অসংখ্য উদাহরণ দেয়া যাবে “জন্মসূত্রে” বর্ণাশ্রমের বিরুদ্ধে ।

১.রাবণ নিজে ছিলেন মহামুনি প্যুলস্তের নাতি অথচ তিনি কর্মবলে হয়েছিলেন রাক্ষস।

২. ত্রিশঙ্কু ছিলেন একজন রাজা অথচ তিনি চন্ডালে পরিণত হোন ।

৩. বিশ্বমিত্রের পুত্ররা বৈশ্য ছিলেন অথচ তিনি নিজে ক্ষত্রিয় থেকে ব্রাহ্মণ হয়ে ছিলেন ।

৪. মহাভারতের বিদুর ছিলেন চাকরের ছেলে অথচ তিনি হস্তিনাপুরের মন্ত্রী হয়েছিলেন।

বৈশ্য শব্দটি বেদে ২০ বার ব্যবহৃত হয়েছে ।কিন্তু কোথাও শূদ্র শব্দটি অবমাননাকর কিংবা অস্পৃশ্য কিংবা বেদ পাঠের অযোগ্য কিংবা অন্য বর্ণের চেয়ে কম মর্যাদা সম্পন্ন কিংবা যজ্ঞ অধিকারহীন বলা হয় নি । বেদে শূদ্রকে বলা হয়েছে কঠোর পরিশ্রমী। [যজুর্বেদঃ ৩০/৫]

যদিও চারবর্ণ চার ধরনের কাজ নির্দেশ করে। কিন্তু একজন ব্যক্তি জীবনের নানা সময়ে এই চার ধরনের বৈশিষ্টই প্রদর্শন করেন । এর অর্থ হল প্রত্যেক ব্যক্তিই চার বর্ণের অধিকারী। তবে তার প্রধান পেশাই তার বর্ণ নির্দেশ করে । এই জন্যই প্রত্যেক মানুষেরই সর্বোচ্চ চেষ্টা করা উচিত চারটি বর্ণেরই গুণ ধারণ করা । বেদের পুরুষ সূক্তের মাহাত্ম হল এই । বশিষ্ঠ,বিশ্বামিত্র,অঙ্গিরা,গৌতম,বামদেব,কানভ্য এঁরা সবাই চার বর্ণেরই গুণাবলী ধারণ করেছেন।তাঁরা বৈদিক মন্ত্রের অর্থ বের করেছেন,দস্যু বিনাশ করেছেন, সাংসারিক কার্যাদি করেছেন , সমাজের উন্নতির জন্য সম্পদের ব্যবহার করেছেন ।আমাদের উচিত একইভাবে জীবন ধারণ করা।

উপরের আলোচনা থেকে এই প্রতীয়মান হয় যে বৈদিক সমাজ সকল মানুষকে একটি মাত্র ‘জাতি’ হিসেবে বিবেচনা করত,তারা শ্রমের মর্যাদায় বিশ্বাস করত এবং সকলের সমান অধিকার নিশ্চিত করেছিল নিজেই নিজের বর্ণ বেছে নেয়ার জন্য । “জন্মসূত্রে” যে কোন প্রকার বর্ণবৈষম্য বেদের সম্পূর্ণ বিরুদ্ধাচরণ। আসুন আমরা সবাই একটি পরিবারের মতো একত্রিত হই । ভাই-বোনের মতো হাতে হাত রেখে এগিয়ে চলি। আর যারা “জন্মসূত্রে” বৈষম্যের কথা বলে আমাদের ভুল পথে পরিচালিত করে নিজের স্বার্থ সিদ্ধি করতে চায় ,আসুন দস্যু হিসাবে,রাক্ষস হিসাবে তাদের চিহ্নিত করে ধ্বংস করি। সবাই বেদের ছায়াতলে এসে একটি পরিবার হয়ে মানবতার কল্যাণে কাজ করি ।

জহর কান্তি সরকার

*লেখক: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদ্যার্থী

খনার বচনে গর্ভস্থ সন্তানের স্বরূপ নির্ণয় পদ্ধতি


আজ থেকে ১৫০০ বছর পূর্বে জন্ম নেওয়া ইতিহাসের এককিংবদন্তি ‘খনা’ বা ‘ক্ষণা।‘ কোন এক শুভক্ষণে তার জন্মবলে নাম দেওয়া হয় ‘ক্ষণা।‘ আর ‘ক্ষণা‘ থেকেই ‘খনা‘ নামের উৎপত্তি বলে মনে করা হয়। খনা ছিলেন সিংহলরাজার কন্যা। কথিত আছে, খনার আসল নাম লীলাবতী।তিনি ছিলেন জ্যোতির্বিদ্যায় পারদর্শী। তাঁর রচিতভবিষ্যতবাণীগুলোই মূলত ‘খনার বচন’ নামে আমরাজানি।খনার বচন
খনার বচনে গর্ভবতীর পেটের সন্তানের জেন্ডার নিরুপণ বা খনার বচনে গর্ভস্থ সন্তানের স্বরূপ নির্ণয় পদ্ধতি-
বানের পেটে দিয়ে বান
পেটের ছেলে গুণে আন।
নামে মাসে করি এক
আটে হবে সন্তান দেখ।
এক তিন থাকে বান
তবে নারীর পুত্র জান।
দুই চারি থাকে ছয়
অবশ্য তার কন্যা হয়।
থাকিলে শূন্য বা সাত
অবশ্য হয় গর্ভপাত।
এখানে খনার কবিতাটিতে বানের পেটে দিয়ে বান এর অর্থ করা যায়। পাঁচের পিঠে পাঁচ অর্থাৎ পঞ্চান্ন সংখ্যাটি। এই সংখ্যার সাথে যে গর্ভধারিনীর সন্তান গণনা করতে হবে তার নামের অক্ষর সংখ্যা এবং গর্ভ যতো মাসের সেই মাসের সংখ্যা নির্ভুলভাবে একত্রে যোগ করতে হবে। এই মোট সংখ্যাকে আট দিয়ে ভাগ করতে হবে। ভাগ্যের শেষে যদি পাঁচ অবশিষ্ট থাকে তাহলে পুত্র হবে এবং দুই, চার বা ছয় অবশিষ্ট থাকলে কন্যা হবে। ভাগশেষ যদি শূন্য বা সাত অবশিষ্ট থাকে তাহলে গর্ভিনীর গর্ভপাত হবে।
দ্বিতীয় মত
গ্রাম গর্ভিনী ফলে যুতা
তিন দিয়ে হর পুতা।
এক সুত দুইয়ে সুতা
শূন্য থাকিলে গর্ভ মিথ্যা।
একথা যদি মিথ্যা হয়
সে ছেলে তার বাপের নয়।
তৃতীয় মত
সাত মাসের গর্ভ নারীর
নামে যত অক্ষর
যত জনে শুনে তাহে
অঙ্ক দিয়া এক কর।
সাতে হরি চন্দ্র নেত্র
বান যদি রয়
সমে পুত্র, পরে কন্যা
জানিবে নিশ্চয়।
সংগ্রহে-রক্তবীজ ডেস্ক

শঙ্খ বাজাতে বাজাতে যুদ্ধক্ষেত্রে এগিয়ে এসো আমি তোমাদের রথের সারথী জেনে।


2ad50-1আমি শিংগায় ফু দিয়ে চলেছি— আমি শঙ্খ বাজিয়ে তোমাদের ডাক দিচ্ছি— আমার হাতের বাঁশি বেজে চলেছে সুর ও তাল নিয়ে—তোমাদের এখনো কেন ঘুম ভাঙ্গছে না— যুদ্ধ সাজে বেড়িয়ে যখন আসতেই হবে সংগ্রাম মঞ্চে তখন আর অলসতা নিয়ে আরাম শয্যায় স্বপ্ন দেখে তোমাদের কি লাভ হবে? যার হাতে যে শঙ্খ-বাঁশী- শিংগা আছে তা নিয়েই সুর তোল যুদ্ধের—ঢাল তলোয়ার যার যা আছে তাই নিয়ে বেড়িয়ে পড়ো—তানাহলে সেগুলি কালের কবলে সব মরচে লেগে ধ্বংস হয়ে যাবে—কোন কাজেই লাগাতে পারবেনা। যে সম্পদের মায়া করছো তাও ধ্বংস হয়ে যাবে—আমার শিংগার ধ্বনির শব্দে কিছুই ধরে রাখতে পারবেনা। আমি তোমাদের অন্তরে থেকে সদায় ধর্মযুদ্ধের ডাক দিয়ে চলেছি বিশ্বমানব শিক্ষার মঞ্চে—তোমরা নিজ নিজ চেতনা শক্তিকে জাগ্রত করে এগিয়ে এসো—শঙ্খ বাজাও তোমাদের শঙ্খের ধ্বনি শুনে সবায় শঙ্খ বাজাতে শুরু করবে—মহাবিপ্লব শুরু হয়ে যাবে স্বাভাবিক ভাবে বিশ্বজুড়ে।

লিখেছেন- বাসুকি নাথ মিশ্র