রাজা রামমোহন রায়


রাজা রামমোহন রায়

Image result for রাজা রামমোহন রায়
সমগ্র ভারতের জাতীয় ভাবধারার এক মূর্ত প্রতীক, আধুনিক ভারতের নবযুগের প্রবর্তক, ভারতের জাতীয়তাবাদের জনক, রাজা রামমোহন রায় এমনি একজন অবিস্মরণীয় ব্যক্তিত্ব যিনি স্বদেশ ও স্বজাতির কল্যাণে ভারতের স্বাধীনত সংগ্রামের পথে অবিচল থাকার অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিলেন।
এই মহানপুরুষ ১৭৭৪ সালের ১০ মে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের হুগলী জেলার অন্তর্গত আরামবাগ সাবডিভিশনের রাধানগর গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত ব্রাহ্মণ জমিদার বংশে জন্মগ্রহণ করেন।
রামমোহনের প্রপিতামহ কৃষ্ণকান্ত বন্দোপাধ্যায় বাদশাহ ফররুখশিয়ারের আমলে বাংলার সুবেদারের অধীনে আমিনের কাজ করতেন। সেই সূত্রেই তাদের পরিবারে রায় উপাধি ব্যবহার প্রচলিত হয়। “রায়” নবাব সরকার প্রদত্ত উপাধি। এদের পূর্বপুরুষ পরশুরাম বন্দোপাধ্যায়ের কাজে খুশি হয়ে নবাব তাকে ‘রায়’ উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন। সেই থেকে তারা বন্দোপাধ্যায় বাদ দিয়ে ‘রায়’ উপাধি লিখতে শুরু করেন।
রামমোহনের পিতার নাম রমাকান্ত রায় এবং মাতার নাম তারিণী দেবী।
বাল্যকাল থেকেই রামমোহনের লেখাপড়ার প্রতি ছিল প্রবল আগ্রহ। তিনি আট বৎসর বয়সে গ্রামের স্কুলে বাংলা ও আরবী ভাষা শেখেন। তারপর আরও ভাল করে আরবী ভাষা শেখার জন্য পাটনায় যান। এখানে তিনি আরবী ও ফারসী দুটি ভাষাতেই যথেষ্ঠ পাণ্ডিত্য অর্জন করেন। এই সময়ে তিনি পড়লেন আরবী ভাষায় অনুবাদ করা অ্যারিষটটলের রচনাবলী। কিন্তু তাঁর মনকে গভীরভাবে নাড়া দিল কোরআন। একদিকে যেমন অ্যারিষ্টটলের রচনা তাঁর মনের মধ্যে যুক্তবাদী চিন্তার জন্ম দিয়েছিল অন্যদিকে কোরআনের একেশ্বরবাদ এবং পৌত্তিলিকতা বিরোধী মতবাদ ক্রমশঃ তাঁকে হিন্দুধর্মের প্রতি বিরূপ করে তুলেছিল।
রামমোহন রায় বাঙ্গালীদের সঙ্কীর্ণ আচার-ব্যবহার হাজার নিয়মের দুৎমার্গ কোনদিন মেনে নিতে পারেননি। তাই মুসলমান সমাজের স্বাধীনতা তাকে গভীরভাবে আকৃষ্ট করেছিল। এসময় তিনি সাজ-সজ্জা, আচার-ব্যবহার এমনকি খাওয়া-দাওয়াতে একেবারে খাঁটি মুসলমানের মত হয়ে উঠেছিলেন। ছেলের পরিবর্তন দেখে বাবা-মা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়লেন। ছেলেকে মুসলমান প্রভাব থেকে মুক্ত করে হিন্দুধর্মের মূল স্রোতে ফিরিয়ে আনার জন্য কাশীতে পাঠালেন। সেখানে এক সংস্কৃত পণ্ডিতের টোলে ভর্তি হলেন।
রামমোহন রায় নিজের অসাধারণ মেধাবলে সংস্কৃত, কাব্য, সাহিত্য, দর্শন, বেদ, উপনিষদ, পুরাণ অধিগত করলেন। উপনিষদের চিন্তাধারা তাঁর মনকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল। তাঁর মনে হল উপনিষদের ঋষিরা নিরাকার ব্রহ্মের কথা বলেছেন অথচ হিন্দুরা তার সম্পূর্ণ বিপরীত আচরণ করছে। এই সময় তিনি বেদান্ত শাস্ত্রাদির উপরেও গবেষণা করেন। তিনি সনাতন ধর্মের প্রচলিত সাকার উপাসনা পদ্ধতির বিরোধী ছিলেন। তিনি মূর্তিপূজা মানতেন না। এ সম্পর্কে মতবাদ ব্যক্ত করে তিনি “হিন্দধর্মের পৌত্তলিক ধর্মপ্রণালী” নামে একটি বই রচনা করেন। এই রচনা পড়ে তাঁর পিতা প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হয়ে উঠলেন। পিতা-পুত্রের মধ্যে সংঘাত শুরু হল। এরই পরিণতিতে গৃহত্যাগ করলেন। ঘুরে বেড়াতে থাকেন এখানে সেখানে। ঘুরতে ঘুরতে তিনি তিব্বতে চলে আসেন। তিনি বৌদ্ধ ধর্ম অনুশীলন করার জন্য তিব্বতে এসেছিলেন। কিন্তু বৌদ্ধ ধর্মের সব কথা তিনি মেনে নিতে পারলেন না। তিনি এক নিরাকার ঈশ্বরের কথা প্রচার করতে লাগলেন। এতে তিব্বতের বৌদ্ধ ভিক্ষুরা তাঁর প্রতি অসন্তুষ্ট হল। এমনকি কোন কোন উগ্রপন্থি বৌদ্ধভিক্ষু তাঁকে হত্যা করার জন্য ষড়যন্ত্র করতে লাগল।
এই দুঃসংবাদ কানে গেল পিতা রামকান্তের। তিনি বহুকষ্টে লোক পাঠিয়ে পুত্রকে দেশে ফিরিয়ে আনলেন। রামমোহন তখন ২০ বছরের যুবক। পরিবারের সকলের সাথে মানিয়ে চলা অসম্ভব বিবেচনা করে তিনি পৈতৃক বাসভবন ত্যাগ করে রাধানগর থেকে কিছুদূরে লাঙ্গলপাড়া নামক এক জায়গায় বসবাস আরম্ভ করেন। এই সময় তিনি জমিদারি সংক্রান্ত কাজকর্ম দেখাশুনা এবং বিভিন্ন শাস্ত্র অধ্যয়ন করে সময় কাটাতেন। ইডিতমধ্যে পৈত্রিক সম্পত্তি ভাগ হয়েছে। রামহোহন পিতার সম্পত্তির যে অংশ পেলেন অল্পদিনের মধ্যে নিজের বুদ্ধি ও পরিশ্রমের সাহায্যে বহুগুণে বাড়িয়ে ফেললেন।
বৈষয়িক কাজে রামমোহন বিভিন্ন সময়ে কলকাতা, বর্ধমান, ও লাঙ্গলপাড়ায় অবস্থান করতেন। সেই সময় তাঁকে ইংরেজী সিভিলিয়ানদের সাহচর্যে আসতে হয়। অসাধারণ মেধাবী রামমোহন রায় এই সুযোগে ইংরেজী ভাষা আয়ত্ত করেন।
রামমোহন ছিলেন বহুভাষাবিদ। মাত্র তেইশ বছর বয়সে তিনি দশটি ভাষায় পারদর্শিতা লাভ করেন। ইংরেজী, বাংলা, আরবী ছাড়াও তিনি গ্রীক, হিব্র“, ল্যাটিন, ফারসী, এবং উর্দু ভাষাতেও লিখতে ও পড়তে জানতেন। তাঁর ব্যক্তিত্ব, আচার-আচরণ, সাজপোশাক, ইংরেজী ভাষার উপর দখল দেখে ইংরেজরা মুগ্ধ হয়েছিলেন। রামমোহনের ইংরেজী রচনা পড়ে তৎকালীন কলকাতা হিন্দু কলেজের ইংরাজী ভাষার অধ্যাপক ডি. রোজারিও পর্যন্ত অবাক হয়ে গিয়েছিলেন।
কলকাতায় ইংরেজদের দেশীয় ভাষা শিক্ষার জন্য ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ গড়ে উঠেছিল। রামমোহন মাঝে মাঝে সেই কলেজে যেতেন। এখানেই পরিচয় হয় ইংরেজ সিভিলিয়ান মিঃ জহন ডিগবির সাথে। মিঃ ডিগবি রামমোহনকে দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন। তাদের দুজনের মধ্যে গভীর বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে।
১৮০৩ খৃষ্টাব্দে রামমোহন মুর্শিদাবাদের কালেক্টর উডফোর্ডের কাছে কাজ নেন এবং যশোরে যান। অবশ্য এই চাকরি দুই মাসের বেশী করেননি। মুর্শিদাবাদে থাকার সময় রামমোহন একেশ্বরবাদের উপর একটি বই লেখেন। এই বইতে তিনি বলেছেন, প্রত্যেকের ধর্মের মধ্যে মূলগত ঐক্য আছে। মানুষ ধর্মের বহিরঙ্গ, তার বাহ্যিক আচার-ব্যবহার নিয়ে এতখানি মত্ত থাকে, তারা ভুলে যায় ধর্মের মূল সত্যকে। এখানে কোন বিভেদ নেই, বিদ্বেষ নেই, আছে আনন্দ ও জীবনের কল্যাণ। কিন্তু মানুষকে বিপথে চালনা করে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য কিছু মানুষ ইচ্ছামত ধর্মের ব্যাখ্যা করে। ধর্মের নামে মানুষকে নানাভাবে বঞ্চিত করে।
১৮০৫ সালে রমমোহনের বন্ধু মিঃ ডিগবি রামগড়ের ম্যাজিষ্ট্রেট হলে রামমোহনকে সরাসরি ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানিতে চাকরী দিলেন। রাজস্ব ও ভূমি সংক্রান্ত বিষয়ে অপূব দক্ষতা ও কর্মকুশলতার জন্য ল্পদিনের মধ্যেই তিনি দেওয়ান পদে উন্নীত হন। চাকরীর সূত্রে রামমোহন ডিগবির সাথে বাংলা ও বিহারের বিভিন্ন অঞ্চল পরিক্রমণ করেন। চকরীজীবনে রামমোহন ডিগবি সাহেবের ছিলেন øেহভাজন ও বিশ্বস্ত। রামমোহনের অনেক ইংরেজী গ্রন্থের ভূমিকা লিখে দিয়েছিলেন কালেক্টর ডিগবি সাহেব।
রামমোহন চাকুরীসূত্রে দীর্ঘ সাত বৎসর ছিলেন রংপুরে। এই সময় তিনি বেসিয়ানের কাজ করতেন। এই কাজ করে তিনি প্রচুর অর্থ উপার্জন করেন। এই সময় তিনি বিভিন্ন মানুষের সাথে ধর্ম নিয়ে আলোচনা করতেন। তাঁর হিন্দুধর্ম বিরোধী মনোভাবের কথা সবাই জানত। তিনি সরাসরি সকলের সামনে পৌত্তিলকতার বিরুদ্ধে তীব্র ভাষায় নিজের অভিমত ব্যক্ত করতেন। কয়েক বছরের মধ্যে তাঁর নাম সমগ্র রংপুরে ছড়িয়ে পড়ল। তাঁর মতবাদের বিরুদ্ধে গোড়া হিন্দুরা “জ্ঞানাঞ্জন” নামে একটি বই লিখল। তা সত্ত্বেও রামমোহনের খ্যাতি উত্তোরোত্তর বৃদ্ধি পেল।
ইংরেজদের অধীনে চাকরী হলেও রামমোহন সর্বদা আত্মমর্যাদা বজায় রেখে চলতেন। একসময় চাকরী ক্ষেত্রে এই প্রশ্নেই স্যার ফ্রেডরিক হ্যামিলটনের সঙ্গে তাঁর বিবাদ উপস্থিত হয়। তিনি ১৮০৯ খ্রিষ্টাব্দের ১২ এপ্রিল তাঁর বিরুদ্ধে মিল্টোর কাছে অভিযোগ করেন। অভিযোগ পত্রটিকে রামমোহনের প্রথম ইংরেজী রচনা বলে জানা যায়।
১৮১৪ সালে মিঃ ডিগবি চাকরী ছেড়ে বিলেতে চলে যান। এরপর রামমোহনও চাকরী ছেড়ে স্থাঢীভাবে কলকাতায় বসবাস শুরু করেন। তিনি অল্পদিনের মদ্যেই অর্থ, প্রভাব, প্রতিপত্তি, পাণ্ডিত্য, হিন্দুধর্ম বিরোধী মতবাদের জন্য কলকাতার সমাজে বিশিষ্ট ব্যক্তি হিসাবে পরিচিত হলেন। কলকাতায় বসবাসকালেই রামমোহন বিবিধ সমাজ সংস্কারমূলক কাজে জড়িত হয়ে পড়লেন।
চাকরি সূত্রে তিনি বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ঘুরে বেড়িয়েছেন। দেখেছেন অজ্ঞানতা আর কুসংস্কার, ধর্মের নামে ভণ্ডামি, বাল্যবিবাহ, শিশুহত্যা, নারীর উপর অকথ্য নির্যাতন। সবচেয়ে নির্মম প্রথা হল সতীদাহ; পূণ্য অর্জনের নামে নারীদের জোর করে স্বামীর চিতায় পুড়িয়ে মারা।
রামমোহন প্রথম জীবনে মুর্শিদাবাদে বসবাসকালে তাঁর একেশ্বরবাদমূলক রচনা ফারসী ও আরবী ভাষায় তুহ্ফাৎ-উল-সুবাহহিদ্দীন প্রকাশিত হয়। ১৮১৫ সালে তিনি সংস্কৃত বেদান্তের বাংলায় ও হিন্দীতে অনুবাদ করেন। এই বইয়ের নাম দিলেন বেদান্ত গ্রন্থ। এর মধ্যে ছিল বি¯তৃত ব্যাখ্যা। আরো সহজভাবে প্রকাশ করার জন্য পরের বছর এই বইটির সংক্ষিপ্তসার প্রকাশ করলেন, নাম দিলেন অহ অনৎরফমবসবহঃ  ড়ভ ঠবফধহঃ। এভাবে বাংলাদেশে প্রথম উপনিষদ চর্চার ভিত্তি স্থাপিত হয়।
কলকাতাবাসের চার বছরের মধ্যেই রামমোহন একে একে রচনা করেন বেদান্ত গ্রন্থ, বেদান্ত সার, কেনোপনিষদ, ঈশোপনিশদ, কঠোপনিষদ, মাণ্ডুক্যোপনিষদ এবং মুণ্ডকোপনিষদ। এই সব অনুবাদের মধ্যদিয়ে একদিকে যেমন বেদান্তের প্রচার করতে লাগলেন অন্যদিকে পৌত্তলিকতার বিরুদ্ধে প্রচার শুরু করলেন। সমাজের রক্ষণশীল ও গোড়া ব্রাহ্মণের দল তার উপর ক্ষোভে ফেটে পড়ল। তারাও সমবেতভাবে রামমোহনের বিরুদ্ধে প্রচার শুরু করল। এই সময় ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের প্রাক্তন অধ্যাপক মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার রামমোহনের অভিমত খণ্ডন করে “বেদান্ত চন্দ্রিকা” লিখলেন। রামহোন এই বইয়ের সমস্ত যুক্তি খণ্ডন করে লিখলেন “ভট্টাচার্যের সহিত বিচার”।
এইভাওেব রামমোহন ধর্মবিষয়ে নানা বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন। কিন্তু একেশ্বরবিরোধী গোড়া হিন্দুদের সঙ্গে বাদানুবাদের সূত্রেই রামমোহনের চিন্তা ও লেখনীর স্পর্শে ধর্ম, সমাজ, রাষ্ট্র, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের উন্নতির পথ সুগম হয়।
ক্রমশই সমস্ত হিন্দুসমাজ রামমোহনের বিরুদ্ধে একজোট হয়ে দাঁড়াল। তাঁর ধর্মমত নিয়ে পারিবারিক জীবনে দেখা দেয় নানা রকম অশান্তি। কারণ তিনি কুসংস্কারমুক্ত মানুষ হলেও তাঁর পিতা রামকান্ত ছিলেন গোড়া ব্রাহ্মণ। তিনি পুত্রের নতুন মতবাদকে মেনে নিতে পারেননি। পারিবারিক বিরোধ শুধু তাঁর পিতার সঙ্গেই ছিল না, মতবাদ নিয়ে তাঁর মায়ের সঙ্গেও বিরোধ শুরু হয়। মা তারিণী দেবীও ছিলেন গোড়াপন্থী। প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন তারিণী দেবী। পুত্রের বিরুদ্ধে তার ক্ষোভ এত প্রবল হয়ে উঠেছিল যে, তিনি নাতি গোবিন্দ প্রসাদকে নিয়ে রামমোহনের বিরুদ্ধে মামলা করলেন। রামমোহনকে পিতৃসম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করার চেষ্টা করেন। কিন্তু মায়ের এ অপচেষ্টা ব্যর্থ হয়। রামমোহন পিতৃসম্পত্তির অধিকার নিয়ে মামলায় জিতেও সমুদয় সম্পত্তি আবার মাকেই ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। পরে মায়ের মৃত্যুর পর আবার সম্পত্তি ফিরে পান। এমনকি তাঁর বড় দুই ভাই নিঃসন্তান অবস্থায় মারা গেলে তাদের সম্পত্তি তাঁর অধিকারে আসে। ফলে তাঁর অর্থের অভাব দূর হয়। তখন থেকে তিনি সাহিত্য সাধনা, সমাজ সংস্কার ও ধর্ম প্রচারে মনেনিবেশ করেন।
তখন থেকেই তিনি সমাজসেবা আর সংস্কারমূলক কাজে হাত দেন। মানিকতলার বাড়ীতে তিনি “আত্মীয় সভা” নামে একটি সঙ্ঘ প্রতিষ্ঠা করেন। কিছুকালের মধ্যে তিনি বাংলায় “ব্রাহ্মণ পত্রিকা” এবং ইংরেজী “ঊধংঃ ওহফরধ এধুবঃঃব” নামে দুটো পত্রিকা বের করেন।
ব্রাহ্ম মতবাদের প্রচারকে কেন্দ্র করে খ্রিষ্টান মিশনারীদের সাথেও তাঁর বিরোধ শুরু হয়। এতদিন যারা নিুবর্ণের লোক খ্রিষ্টান মিশনারীদের প্রলোভন ও প্ররোচনায় খ্রিষ্টান ধর্ম গ্রহণ করত তারা রামহোনের প্রতি আকৃষ্ট হতে লাগল। এতে খ্রিষ্টান মিশনারীদের ধর্মান্তকরণ ব্যবসায় ক্ষতি হতে থাকল। তারা রামমোহনের উপরে চটে গেল। এই সাথে গোড়া হিন্দুদেরও বিরাগভাজন হলেন। এইভাবে প্রবল ও শক্তিশালী বাধাকে অতিক্রম করে রামমোহন তাঁর ধর্ম মতবাদ চালিয়ে যেতে লাগলেন। তিনি তাঁর ক্ষুরধার লেখনী ও যুক্তি দিয়ে পণ্ডিতমণ্ডলীকে বাকযুদ্ধে পরাজিত করতে লাগলেন। অবশেষে তাঁরই জয় হতে থাকল। ধীরে তাঁর প্রতি লোকের শ্রদ্ধা বাড়তে লাগল। তিনি নবপ্রবর্তিত ধর্মবাদের মূল বক্তব্যগুলো গদ্যভাষায় লিখে প্রকাশ করতে লাগলেন।
রামমোহন ১৮২৭ সালে প্রতিষ্ঠা করেন ধর্মালোচনা মূলক প্রতিষ্ঠান ব্রাহ্মসভা। যা পরবর্তীকালে ব্রাহ্মসমাজ নামে প্রসিদ্ধি লাভ করে। ব্রহ্মসভার মাধ্যমেই তিনি নতুন ধর্মমত প্রচা শুরু করেন। তিনি বেদে বর্ণিত অদ্বিতীয় ব্রহ্মের উল্লেখ করে প্রচার করেন যে, ঈশ্বর এক এবং অদ্বিতীয়, তিনিই বেদের ব্রাহ্ম। তিনি অদ্বিতীয় ও নিরাকারÑএই ব্রহ্মের যারা উপাসক তারা হলেন ব্রাহ্ম। রামহোহন এই ব্রাহ্ম ধর্মমতবাদের প্রতিষ্ঠাতা।
রামমোহন তাঁর প্রচারিত মতবাদের উপর ব্রহ্মোপাসনা এবং বেদান্ত গ্রন্থ নামে দুটো গবেষণামূলক গ্রন্থ রচনা করেন। তাঁর প্রচারিত মতবাদ সেকালে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। আজও বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবাংলায় ব্রাহ্মমতবাদের প্রচুর অনুসারী রয়েছে।
ব্রাহ্মধর্ম প্রচার ছাড়াও রামমোহনের আর একটি উল্লেখযোগ্য সমাজ সংস্কারমূলক কাজ হল সতীদাহ প্রথা নিবারণ। সতীদাহ ভারতের অতি প্রাচীন প্রথা। যদিও তা ছিল সীমাবদ্ধ। কদাচিৎ কোন নারী স্বেচ্ছায় সহমৃতা হতো। বৃটিশ রাজত্ব শুরু হবার পর থেকে এই মুত্যুর হার অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যায়। এক হিসাবে দেখা যায় ১৮১৫ থেকে ১৮১৮ চার বছরে প্রায় আড়াই হাজার মেয়েকে স্বামীর সাথে পোড়ানো হয়েছিল।
রামমোহন অসংখ্য সতীদাহ দেখেছিলেন। তিনি অনুভব করেছিলেন এই প্রথা সমাজের এক অভিশাপ। অনেকের অভিমত ১৮১২ সালে তাঁর বৌদিকে সহমৃত হতে দেখে প্রথম এর বিরুদ্ধে তাঁর মনে ঘৃণার সঞ্চার হয়েছিল। তখন থেকেই তিনি এই প্রথা উচ্ছেদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।
রামমোহন ১৮১৮ সালে সতীদাহের বিরুদ্ধে প্রথম প্রবন্ধ রচনা  করেন-“সহমরণ বিষয়ে প্রবর্তক ও নিবর্তকের সংবাদ”। এতে তিনি সতীদাহের সমর্থক ও সতীদাহের বিরোধী উভয়ের যুক্তির মাধ্যমে প্রমাণ করলেন সতীদাহ ধর্মবিরুদ্ধ।। এর একবছর পর প্রকাশ করলেন দ্বিতীয় প্রবন্ধÑ“সহমরণ বিষয়ে প্রবর্তক ও নিবর্তকের দ্বিতীয় সংবাদ।” এই প্রবন্ধ প্রকাশের সাথে সাথে হিন্দুসমাজে প্রচণ্ড আলোড়ন উঠল।
রামমোহন একদিকে যেমন সতীদাহের বিরুদ্ধে লিখে চলেছেন অন্যদিকে যীশুর উপদেশ ও তার ধর্ম উপদেশ সম্বন্ধে বেশ কয়েকটি প্রবন্ধ রচনা করেন। তিনি খ্রিষ্টের উপদেশ নামে ইংরাজিতে একটি বই লেখেন। এই বইতে রামমোহন খ্রিষ্টীয় ত্রিত্ত্ববাদ অস্বীকার করেন। ফলে মিশনারীদের সঙ্গে তাঁর সংঘর্ষ ও বাদ-প্রতিবাদ অনিবার্য হয়ে উঠল। খ্রিষ্টান ধর্মের উপর বিভিন্ন প্রবন্ধে তিনি যীশুকে কোন অলৌকিক শক্তির অধিকারী হিসেবে দেখেননি। কারণ তিনি অবতারবাদে বিশ্বাস করতেন না। মানুষের প্রতি যীশুর প্রেম, একই ঈশ্বরে বিশ্বাস তাঁকে  মুগ্ধ করেছিল। খ্রিষ্টানদের ধর্মীয় গোঁড়ামি দেখে তিনি ব্যথিত হতেন। তাই তিনি লিখলেন “যীশুর বাণী শান্তি ও সুখের পথ নির্দেশ”। তাঁর এই রচনা পড়ে খ্রিষ্টান মিশনারীরা ভয়ানক ক্রুদ্ধ হয়ে উঠল। এইভাবে রামমোহন গোড়া হিন্দুদের বিরোধিতা ও খ্রিষ্টান মিশনারীদের সমালোচনা দুইয়ের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বীরের মত একই সংগ্রাম করতে থাকেন।
রামমোহন ইউরোপের ইতিহাস পাঠ করে বুঝতে পারলেন, দেশের মানুষের উন্নতির জন্য সর্বপ্রথম প্রয়োজন শিক্ষার বিস্তার, জাতীয় চেতনার প্রসার, সমাজ রাষ্ট্র সম্বন্ধে সম্যক ধারণা। এ কাজে সবচেয়ে বড় সহায়ক সংবাদপত্র। ইতোমধ্যে তিনি ইউরোপের বিভিন্ন সংবাদপত্রের সাথে পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন। তারই অনুসরণে ১৮২২ সালের ৪ঠা ডিসেম্বর প্রথম প্রকাশ করলেন সাপ্তাহিক সংবাদপত্র “সংবাদ কৌমুদী”। এতে সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক বিষয়ের সাথে দেশের বিষয়ের সাথে দেশের মানুষের বিভিন্ন সমস্যার কথা তুলে ধরা হত। প্রকৃতপক্ষে সংবাদ কৌমুদী বাংলার প্রথম সংবাদপত্র।
সংবাদত্র প্রকাশের সাথে সাথে তিনি দেশের কিশোর বালকদের পাশ্চাত্য শিক্ষায় মিক্ষিত করার দিকে মনোনিবেশ করেন। ১৮২৩ খ্রিষ্টাব্দে তিনি প্রচলিত সংস্কৃত শিক্ষার বিরোধিতা করে আধুনিক শিক্ষা পদ্ধতি চালু করার প্রস্তাব দিয়ে লর্ড ামহাস্টকে চিঠি লেখেন। রামমোহন উপলব্ধি করেছিলেন যে, সনাতন শিক্ষা পদ্ধতির মধ্যে কেবল কাব্য আর ব্যাকরণ নিয়ে পড়ে থাকলে দেশ অন্ধকারেই পড়ে থাকবে। আধুনিক যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হলে ভারতবাসীকে ইংরেজী শিক্ষায় শিক্ষিত হতে হবে। ইংরেজীতে লেখাপড়া চালু করার জন্য ১৮২২ খ্রিঃ অ্যাংলো হিন্দু স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। এখানে ইংরেজি ছাড়াও পড়ানো হতো বিজ্ঞান, অংক, ইতিহাস। এখানকার ছাত্রদের মধ্যে ছিলেন মহর্ষি দেন্দ্রেনাথ ঠাকুর।
মাতৃভাষা শিক্ষা প্রসারের জন্য ইতিপূর্বে তিনি বাংলাভাষায় সংস্কৃত ব্যাকরণ গৌড়ীয় ব্যাকরণ প্রণয়ন করেছিলেন ১৮০৩ খ্রিষ্টাব্দে। বাংলাভাষাকে সংস্কৃতের নিগড় যুক্ত করে এই গ্রন্থেই তিনি তাঁর একটি নিজস্ব রূপ দান করেছিলেন। তিনি প্রথম বাংলা গদ্যে তদ্ভব শব্দের ব্যবহার এবং অসমাপিকা ক্রিয়া ও জটিল বাক্যের ব্যবহার বন্ধ করেন। বাপ, মাসী, মেঝে, গাই, কাপড়চোপড়, ভাই, পাগল, পগলী, ইত্যাকার যেসব শব্দ আমরা মুখের ভাষায় ব্যবহার করি, এসব রামমোহনই প্রথম ব্যবহার করেন।
রামমোহনের জীবনের শ্রেষ্ঠ কীর্তি সতীদাহ নিবারণ। ১৮২০ সালের পর থেকে সতীদাহ ক্রমশঃ বৃদ্ধি পাচ্ছিল। অনেক ইংরেজ এই বিভৎস প্রথা দেখে বিচলিত হয়ে পড়লো। তারা সরাসরি এ প্রথা বন্ধ করার জন্য বড়লাটের কাছে আবেদন জানালো। কিন্তু বড়লাট আমহার্স্ট এই প্রথা বিলোপ করার ক্ষেত্রে আইন প্রণয়ন এর পক্ষে ছিলেন না, কারণ তার অভিমত ছিল তাতে দেশীয় মানুষের ধর্মে হস্তক্ষেপ করা হবে।
লর্ড আমহার্স্টের পরে আসেন লর্ড বেন্টিঙ্ক। তিনি ছিলেন দৃঢ়চেতা মানুষ। সতীদাহের বিরুদ্ধে অধিকাংশ মানুষের ক্ষোভ তিনি অনুভব করলেন। তিনি এ দেশের মানুষের মধ্যে রামমোহনের কথা পূর্বে শুনেছিলেন। তিনি রামমোহনের সাথে সাক্ষাৎ করলেন। রামমোহন তাকে এই অভিশপ্ত প্রথা বন্ধ করার জন্য অনুরোধ জানালেন। রামমোহন যুক্তি দেখালেন যে, এতে হিন্দুসমাজের এক অংশ বিরোধিতা করলেও সমাজের শিক্ষিত মানুষের বৃহৎ অংশ সতীদাহ নিবারণের আইনকে সমর্থন করবে।১৮২৯ সালের ৪ ডিসেম্বর লর্ড বেন্টিঙ্ক সতীদাহ প্রথাকে অবৈধ ও দণ্ডণীয় অপরাধ বলে ঘোষণা করলেন। সাথে সাথে গোড়া হিন্দু সমাজ প্রতিবাদমূখর হয়ে উঠল। প্রায় ৮০০ মানুষ এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদে বড়লাটের কাছে প্রতিবাদপত্র পাঠালেন। তারা ধর্মের নানান যুক্তি দেখাল। কিন্তু রামমোহনের যুক্তি এতই অকাট্য এবং পাণ্ডিত্যপূর্ণ যে, লর্ড বেন্টিঙ্ক এই প্রতিবাদে সামান্যতম বিচলিত হলেন না।
এদেশের ইংরেজ সরকারের কাছ থেকে কোন সমর্তন পাওয়া যাবেনা বিবেচনা করে হিন্দু সম্প্রদায়ের নেতৃবৃন্দ সরাসরি ইংল্যাণ্ডের রাজসরকারের কাছে আবেদন জানানোর জন্য সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলো।
এই সময় দিললীর সিংহাসনে ছিলেন মুঘল বাদশাহ দ্বিতীয় আকবর শাহ। বাদশাহ স্থির করলেন তার বৃত্তি বৃদ্ধির জন্য রামমোহনকে তার দূত হিসেবে বিলেত পাঠাবেন। তাই তাঁকে ‘রাজা’ উপাধি দেওয়া হলো। রামমোহনের নিজেরও ইচ্ছা ছিল ইংল্যাণ্ড যাওয়ার তাছাড়া  সতীদাহ প্রথার বিলোপ আইনের বিরুদ্ধে আবেদন করার জন্য ইংল্যাণ্ডে দূত পাঠানো স্থির করেছিল রক্ষণশীল হিন্দুসমাজ। সেই কারণেও তিনি ইংল্যাণ্ড যেতে চাইলেন।
১৮৩০ ক্রিষ্টাব্দের ১৯ নভেম্বর রামমোহন কলকাতা থেকে ইংল্যাণ্ডের পথে রওয়ানা হলেন। তিনিই প্রথম ভারতীয় যিনি সমস্ত ধর্মের গোড়ামি থেকে মুক্ত হয়ে সাগর পেরিয়ে ইংল্যাণ্ডে গমণ করেন।
তিনি ইংল্যাণ্ডে অবস্থানকালে ভারতে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে কৃষকরা যে চরম দুর্দশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছে সে কথা উল্লেখ করে খাজনা হ্রাসের স্বপক্ষে যুক্তি দেখান। তিনি আদালতে ফার্সির পরিবর্তে ইংরেজী প্রবর্তনের স্বপক্ষে বক্তব্য রাখেন।
ইংল্যাণ্ডে প্রিভি কাউন্সিলে যখন সতীদাহ প্রথার বিরুদ্ধে শুনানী চলছিল তখন রাজা রামমোহন এই আইনের স্বপক্ষে জোরালো বক্তব্য রাখেন। অবশেষে ১৮৩২ সালের ১১ জুলাই প্রিভি কাউন্সিল সতীদাহ প্রথা বিলোপের স্বপক্ষে রায় দিলেন। রাজা রামমোহনের সুদীর্ঘ কালের সংগ্রাম স্বার্থক হলো। চিরতরে বন্ধ হয়ে গেল ধর্মের নামে এক ভয়ংকর হত্যাকাণ্ড।
বিলাতে অবস্থানকালে তিনি বাদশাহের পক্ষে পার্লামেন্টে বক্তৃতা দান করেন এবং বাদশাহের বৃত্তির হার বৃদ্ধি করতে সক্ষম হন।
রামমোহনের চেষ্টায় সতীদাহ নামক কুপ্রথা যেমন সমাজে আইনত নিষিদ্ধ হয়েছিল তেমনি তিনি বহুবিবাহ সম্পর্কেও সোচ্চার প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। রামমোহনের জীবনীকার নগেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় এই সম্বন্ধে লিখেছেন, “রাজা রামমোহন রায় বলেন যে, গভর্ণমেন্ট এইরূপ ব্যবস্থা করিলে অত্যন্ত উপকার হয় যে, কোন ব্যক্তি এক স্ত্রীর জীবদ্দশায় পুনর্বার বিবাহ করিতে ইচ্ছা করিলে ম্যাজিষ্ট্রেটের বা অন্য কোন রাজকর্মচারীর নিকট প্রমাণ করিতে হইবে যে, তাহার স্ত্রীর স্বাস্থ্যে নির্দিষ্ট কোন দোষ আছে। প্রমাণ করিতে সক্ষম না হইলে, সে পুনরায় বিবাহ করিতে অনুজ্ঞা প্রাপ্ত হইবে না।”
শুধু সতীদাহ প্রথা রোধ নয়, তাঁর প্রচেষ্টায় বাংলাদেশের বাল্যবিবাহ, কন্যাপণ এবং গঙ্গায় সন্তান নিক্ষেপের মত আরও কিছু সামাজিক কুপ্রথা বন্ধ হয়।
রাজা রামমোহন রায় এমন একজন আন্তরিক সমাজ সংস্কারক ছিলেন যিনি খুবই আধুনিক এবং প্রগতিশীল চিন্তাধারার অধিকারী। তিনি সব ধরনের সামাজিক গোড়ামি, রক্ষণশীলতা এবং কুসংস্কারের বিরুদ্ধে অসীম সাহসিকতার সাথে দাঁড়িয়েছিলেন।
রাজা রামমোহন রায় ছিলেন রাজনৈতিক চিন্তাভাবনার সূত্রে ভারতে আন্তর্জাতিক মনন ও আদর্শের প্রবক্তা। তিনিই প্রথম ভারতীয় যিনি ভারতের বাইরের নানা ঘটনার প্রতি আগ্রহ দেখিয়েছেন এবং পৃথিবীর বিভিন্ন অংশে মানুষের উপর নিপীড়নের বিরুদ্ধে মতামত ব্যক্ত করেছেন। জানা যায়, দক্ষিণ আমেরিকা স্পেনের অধিকারভূক্ত হলে সেই আনন্দে বাড়ীতে তিনি ভোজসভার আয়োজন করেছিলেন। ১৮২২ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর সম্পাদিত সাপ্তাহিক পত্রিকা মিরাত-উল-আখবার এ আয়ারল্যাণ্ড ওপর ইংরেজ সরকারের অত্যাচারের প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন।
রাজা রামমোহন রায় ১৮৩২ সালে ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে গমণ করেন। সেসময় সারা ইউরোপ জুড়ে রাজা রামমোহনের নামডাক। ফ্রান্সের সম্রাট লুই ফিলিপ তাঁর সম্মানে এক ভোজ সভার আয়োজন করেন এবং রাজোচিত সংবর্ধনা জ্ঞাপন করেন।
পরের বছর তিনি আবার ইংল্যাণ্ডে ফিরে আসেন। ইংল্যাণ্ডের ব্রিস্টল শহরে অবস্থানকালে সহসা গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। ১৮৩৩ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর ইহলোক ত্যাগ করেন। ব্রিস্টল নগরীর স্টেপলটন গ্রেভে তাঁকে সমাহিত করা হয়। পরে রবীন্দ্রনাথের পিতামহ প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর ব্রিস্টল যেয়ে তাঁর পবিত্র দেহ উক্ত সাথান থেকে সরিয়ে আরনোজভেল নামক স্থানে সমাহিত করেন।
রাজা রামমোহন রায় ভারতের রেনেসার নবজাগরণের উদ্যোক্তা হিসেবে অমর হয়ে আছেন।

রাজা রামমোহন রায় ও একেশ্বরবাদ


Image result for রাজা রামমোহন রায়

১৮ শতকের বাঙালী সংস্কারকদের অন্যতম রাজা রামমোহন রায়। তিনি হিন্দুধর্মের প্রচ্ছন্ন একশ্বেরবাদকে সমাজে নতুন করে প্রতিষ্ঠা করেন। ধর্মের মধ্যে যুক্তি বুদ্ধিকে প্রতিষ্ঠার ব্রত নেন। এছাড়া হিন্দু সমাজে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা কিছু প্রথার মূলে কুঠারাঘাত করেন। যেমন- সতীদাহ। তার সঙ্গে এগিয়ে এসেছেন আরও অনেকে। সেখানে হিন্দুধর্ম নতুন দার্শনিক, নৈতিক ও ব্যবহারিক মর্ম ধারণ করে। তাকে দেখা হয় ভারতীয় ধর্মীয়-সামাজিক পুনর্গঠন আন্দোলন ব্রাহ্মসমাজের প্রতিষ্ঠাতা এবং বাঙালি দার্শনিক ও আধুনিক অগ্র দৃষ্টিমান চিন্তানায়ক ও বাংলার নবজাগরণের অগ্রদূত হিসেবে। বাংলা গদ্যে তার উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রয়েছে। তৎকালীন রাজনীতি, জনপ্রশাসন, ধর্মীয় ও শিক্ষাক্ষেত্রে তার উল্লেখযোগ্য প্রভাব ছিল।

রাজা রামমোহন রায় ১৭৭২ সালে হুগলি জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। রামাকান্ত রায় এবং তারিণী দেবীর সন্তান রামমোহন খুবই মেধাবী ছিলেন। তিনি সংস্কৃত, আরবী, উর্দু, ফারসী ও ইংরেজি ভাষায় পণ্ডিত ছিলেন। এ ছাড়া হিব্রু, গ্রিক ও সিরীয় প্রভৃতি ভাষায় দক্ষতা অর্জন করেন। ইসলাম, খ্রিষ্ট ও বৌদ্ধ ধর্ম সম্পর্কে তার গভীর জ্ঞান ছিল। ১৮৩০ সালে খেতাবসর্বস্ব মুঘল সম্রাট রামমোহন রায়কে ‘রাজা’ উপাধি দেয়। ১৮৩৩ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর মেনিনজাইটিসে আক্রান্ত হয়ে ইংল্যান্ডের বিস্টলে মৃত্যুবরণ করেন। বিস্টল আরনস ভ্যাল সমাধিস্থলে তাকে সমাহিত করা হয়।

তিনি ১৮০৩ থেকে ১৮১৪ সাল পর্যন্ত রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর দেওয়ানরূপে রংপুরে কাজ করেন। ১৮১৫ সাল থেকে কলকাতার স্থায়ী বাসিন্দা হন, এখন থেকেই প্রকাশ্যে তার সংস্কার-প্রচেষ্টার শুরু। তার প্রথম প্রকাশিত বই ফারসী ভাষায় লেখা (ভূমিকা অংশ আরবীতে) ‘তুহফাতুল মুবাহ হিন্দীন’। বইটিতে একেশ্বরবাদের সমর্থন আছে। এরপর একেশ্বরবাদ (বা ব্রাহ্মবাদ) প্রতিষ্ঠা করার জন্য বেদান্ত-সূত্র ও তার সমর্থক উপনিষদগুলি বাংলার অনুবাদ করে প্রচার করতে থাকেন। ১৮১৫ থেকে ১৮১৯ সালের মধ্যে প্রকাশিত হয়- বেদান্তগ্রন্থ, বেদান্তসার, কেনোপনিষদ, ঈশোপনিষদ, কঠোপনিষদ, মাণ্ডূক্যোপনিষদ ও মুণ্ডকোপনিষদ। রক্ষণশীল ব্যক্তিরা তার লেখার প্রতিবাদ করতে থাকেন। রামমোহন কটুক্তি এবং বিদ্বেষপ্রবণ প্রতিবাদের উত্তর দেন যুক্তি ও ভদ্রভাষায়। ‘বেদান্তগ্রন্থ’ প্রকাশের সঙ্গে তিনি ব্রহ্মনিষ্ঠ একেশ্বর উপাসনার পথ দেখালেন আত্মীয় সভা প্রতিষ্ঠা করে। এই আত্মীয় সভাকেই পরে তিনি ব্রাহ্মসমাজ নাম ও রূপ দেন।

সে সময় রামমোহন উদার মন নিয়ে সকল গুরুত্বপূর্ণ ধর্মগ্রন্থ পড়েন। হিন্দু ধর্মগ্রন্থ বেদ যেমন ছিল তেমনি ছিল আরবী ভাষায় কুরআন এবং হিব্রু ভাষা ও গ্রীক ভাষায় বাইবেল। এ পাঠ থেকে বুঝতে পারেন সকল ধর্মেরই উদ্দেশ্য অভিন্ন- মানব জাতির নৈতিক পুনর্জাগরণ। তিনি চেয়েছেন সে নৈতিক আকাঙ্ক্ষাকে সময়ের নিরিখে ব্যাখ্যা করতে। ধর্মের এই সর্বজনীন মূল্য থেকে বুঝতে পারেন হিন্দুধর্ম ত্যাগ করে অন্য কোন ধর্ম গ্রহণের পেছনে কোন যুক্তি নেই। বরং, ধর্মের গোড়ামীকে মুখ্য না করে তার সর্বজনীন নৈতিক উপদেশাবলীই গুরুত্বপূর্ণ। তাই তিনি প্রতিমা পূজা বর্জন করেন এবং বিশ্বাস করতেন এক সর্বজনীন ঈশ্বর পূজায়। ১৮২৮ সালের আগস্ট মাসে তিনি ব্রাহ্ম সভা প্রতিষ্ঠা করেন। ধাপে ধাপে এর মধ্যে কিছু পরিবর্তন সাধিত হয়। এমনকি বিরোধও দেখা দেয়।

একেশ্বরবাদী ধারণা সম্বলিত উপনিষদের নির্বাচিত অংশসমূহের ওপর ভিত্তি করে ব্রাহ্ম ধর্মবিশ্বাস পুনর্নিমাণের প্রচেষ্টা নেওয়া হয়। ব্রাহ্ম সমাজের সংশোধিত মতবাদটি ১৮৫০ সালে ‘ব্রাহ্ম ধর্ম’ অথবা ‘এক সত্য ঈশ্বরের পূজারীদের ধর্ম’ নামে পুস্তকাকারে প্রকাশিত হয়। এতে বেদের অভ্রান্ততা স্বীকার করা হলেও ব্রাহ্ম আন্দোলনে অপরিহার্য হিন্দু চরিত্র ধরে রাখা হয়।

ব্রাহ্মসমাজ তিনটি ভাগে বিভক্ত: রক্ষণশীল আদি সমাজ যারা পরিপূর্ণভাবে হিন্দু ধর্মীয় পুস্তক বিশেষ করে উপনিষদের উপর নির্ভরশীল, নববিধান সমাজ যারা হিন্দু ধর্মীয় পুস্তকের বাইরে বৌদ্ধ, খ্রিস্টান বা ইসলাম ধর্ম থেকে ধার করতে বলে এবং সবশেষে সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ- যারা জাতপ্রথাকে অস্বীকার করে, ভিন্ন জাতের বিবাহকে মানে ও অন্যান্য ধর্মের সাথে নিজেদের মহিলাদের ব্রাহ্ম রীতি অনুযায়ী বিবাহতেও এদের আপত্তি নেই। এই ব্রাহ্মসমাজ মূলত একেশ্বরবাদী ধারণা থেকে উদ্ভুত। ব্রাহ্মসমাজের মনোযোগের প্রধান বিষয় হল- ১. একেশ্বরবাদ, ২. জাতপাত দূরীকরণ, ৩. যৌতুক প্রথার বিলোপ, ৪. সতীদাহ প্রথার বিলোপ ও ৫. জ্ঞানের বিস্তার।

সারবত্তা হচ্ছে, রামমোহন রায় হিন্দুধর্মের মধ্যে খুব অনুজ্জ্বলভাবে বিদ্যমান একেশ্বরবাদীতাকে তার ধর্মের চালিকাশক্তি করেন। এর বাইরের দিকটি ছিল ইসলাম ও খ্রিষ্টান ধর্মের মতো একশ্বেরবাদের সঙ্গে যুক্ততা। কারণ রাজনৈতিক, জ্ঞানগত ও ধর্মীয় দিক থেকে হিন্দুধর্মের বহু ঈশ্বরবাদ ও জাতপ্রথা নানাভাবে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছিল বলে তারা মনে করতেন। যা একইসঙ্গে নব্য শিক্ষিত ও নীচু শ্রেণীর মানুষদের ক্রমবর্ধমানহারে ধর্মান্তরিত করছিল।

মুসলিমরা যখন বাংলায় প্রবেশ করে, তখন তারা ব্রাহ্মণ রাজপূত ও অন্যান্য যুদ্ধবাজ গোত্রগুলোর উপর নিজেদের সামরিকভাবেই যে কেবল শ্রেষ্ঠত্ব দেখিয়েছিল তা নয়, বরং উপমহাদেশের ধর্মীয় সংস্কারেও প্রভাব বিস্তার করেছিল। যার ফলশ্রুতিতে মধ্যযুগে একেশ্বরবাদ হিন্দু সংস্কার আন্দোলনের খুব গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে যায়। এমনকি বাঙলায় লোক সমাজের ভক্তি আন্দোলনের দিকে তাকালে দেখা যায় এখানে জাতপাতহীনতা ও একেশ্বরবাদ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। এছাড়া ইংরেজদের খ্রিষ্টান ধর্ম নতুন ধরনের চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দেয়। সেদিক থেকে হিন্দু সমাজে রামমোহনের ভূমিকা অনস্বীকার্য।

(দ্য রিপোর্ট/ডব্লিউএস/একেএম/ফেরুয়ারি ০৭, ২০১৪)- See more at: http://www.thereport24.com/article/15505/index.html#sthash.woapMIiK.dpuf

রাজা রামমোহন রায়


রাজা রামমোহন রায় [Raja Rammohan Roy] :- মোগল সাম্রাজ্যের পতনের পর রাজনৈতিক আবর্তে বাংলার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছিল এবং নানা কুসংস্কারের চাপে সমাজের স্বাভাবিক ধারা রুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল । উনবিংশ শতকের প্রথমার্ধে পাশ্চাত্য শিক্ষা, সংস্কৃতি ও সভ্যতার সংস্পর্শে এসে বাংলার সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় জীবনে পুনরায় যে নতুন জাগরণ সৃষ্টি হয়, তাকেই বাংলার নবজাগরণ বলা হয়  । পঞ্চদশ শতাব্দিতে ইটালিতে যে নবজাগরণ হয় তা যেমন কালে কালে সমগ্র ইউরোপে পরিব্যাপ্ত হয়েছিল বাংলার নবজাগরণ তেমনি ক্রমে ক্রমে সমগ্র ভারতভূমিকে প্লাবিত করেছিল । পেত্রার্কবোকাচ্চিও যেমন ইটালির নবজাগরণের অগ্রদূত ছিলেন তেমনি পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত রাজা রামমোহন রায় ছিলেন বাংলা তথা ভারতীয় নবজাগরণের অগ্রদূত । ১৭৭২ খ্রিস্টাব্দের ২২ শে মে (মতান্তরে ১৭৭৪ খ্রিস্টাব্দে ১৪ ই আগস্ট) হুগলী জেলার রাধানগর গ্রামে রাজা রামমোহন রায় জন্ম গ্রহণ করেন । রাজা রামমোহন রায় পরিচালিত সংস্কার আন্দোলনে যুক্তিবাদী ও মানবতাবাদী চেতনার প্রতিফলন পড়েছিল । প্রচলিত সামাজিক কুসংস্কার ও গোঁড়ামির অপসারণ করে তিনি সমাজ জীবনকে কলুষ মুক্ত করতে চেয়ে ছিলেন ।

শিক্ষা সংস্কার [Educational Reforms]:- স্বদেশ ও স্বদেশবাসীর প্রতি রাজা রামমোহন রায়ের প্রীতি ও শ্রদ্ধা ছিল সুগভীর এবং দেশবাসীর সামাজিক, ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক পুনরুজ্জীবনের জন্য তিনি সারা জীবন ধরে কঠোর পরিশ্রম করে গেছেন । ভারতীয় সমাজের দুরবস্থা ও সমকালীন দুর্নীতি তাঁকে ব্যথিত করেছিল । সে সময়ে সমাজে জাতপাতের বিচার ছিল প্রবল, ধর্ম ছিল কুসংস্কারে ভরা এবং ধর্মের নামে অশিক্ষিত ও দুর্নীতিপরায়ন পুরোহিত শ্রেণির আধিপত্য ছিল প্রবল । উচ্চশ্রেণির মানুষ ছিল স্বার্থপর । নিজেদের সংকীর্ণ স্বার্থসিদ্ধির জন্য সমাজের বৃহত্তর স্বার্থ জলাঞ্জলি দিতেও তাঁরা কুন্ঠিত হতেন না । প্রাচ্যের ঐতিহ্যময় দার্শনিক তত্ত্বের প্রতি রাজা রামমোহন রায়ের শ্রদ্ধা ছিল অগাধ, কিন্তু সেই সঙ্গে ভারতীয় সমাজের পুনরুজ্জীবনের জন্য পাশ্চাত্যের যুক্তিবাদ, বৈজ্ঞানিক মনোভাব ও মানবতাবাদের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে সমাজের সকল শ্রেণির মানুষের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠাই ছিল রাজা রামমোহন রায়ের জীবনের সংকল্প । প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের শিক্ষা, সংস্কৃতি ও ধর্ম সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করার ফলে তাঁর চরিত্রে বহুত্বের এক বিরাট সমন্বয় ঘটেছিল বলে তাঁকে ‘প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের এক পূর্ণ সমন্বয়ের প্রতীক’ বলে অভিহিত করা হয়েছে ।

ধর্ম সংস্কার [Religious Reforms]:- রাজা রামমোহন রায়ের আবির্ভাবের সময় থেকে বাংলা তথা ভারতে নবজাগরণের সূত্রপাত হয় । বেদ, বাইবেল, কোরান, পুরাণ, উপনিষদ, গীতা, ভাগবত, জেন্দাবেস্তা, ত্রিপিটক ইত্যাদি সকল ধর্মশাস্ত্র গভীর মনোনিবেশ সহকারে অধ্যয়নের পর তিনি এই সত্যে উপনীত হয়েছিলেন যে সকল ধর্মই মূলত এক । একই ঈশ্বরে বিশ্বাস সকল ধর্মের মূল কথা । সামাজিক ও ধর্মীয় আচার আচরণ ও বাধা নিষেধের কোনো মূল্য নেই । রাজা রামমোহন রায় হিন্দুধর্মকে সংস্কারমুক্ত করার জন্য তিনি ১৮১৫ খ্রিস্টাব্দে প্রথমে ‘আত্মীয় সভা’ [Atmiya Sabha] গঠন করেন । ১৮২৫ খ্রিস্টাব্দের আগস্ট মাসে তিনি একে ‘ব্রাহ্মসভা‘য় [Brahmo Sabha] পরিণত করেন । ১৮২৮ এটি আবার ‘ব্রাহ্মসমাজ’ [Brahmo Samaj] নামে পরিচিত হয় । ব্রাহ্মসভার মূল বক্তব্য ছিল, ঈশ্বর এক ও অভিন্ন, সকল ধর্মের মূল কথা এক । তিনি মনে করেছিলেন ব্রাহ্ম আন্দোলনের মাধ্যমে ভারতীয়গণের মধ্যে ধর্মগত ভেদাভেদ দূর হবে ।

সমাজ সংস্কার [Social Reforms]:- রাজা রামমোহন রায় সমাজ সংস্কারের দিকেও মনোনিবেশ করেছিলেন । ভারতীয় নারীদের জন্য রাজা রামমোহন রায়ের  চিরস্মরণীয় অবদান হল সতীদাহ প্রথার অবসান ঘটানো ।

(১) সতীদাহ প্রথা [Practice of Sati]:- রাজা রামমোহন রায়ের চিরস্মরণীয় পদক্ষেপ হল সতীদাহ প্রথার অবসান ঘটানো । তত্কালে হিন্দু সমাজে মৃত স্বামীর জ্বলন্ত চিতায় বিধবাদের পুড়ে মরতে হত । মৃত স্বামীর জ্বলন্ত চিতায় বিধবাদের সহমরণকে ‘সতীদাহ প্রথা’ বলা হত । প্রাচীনকাল থেকে এই প্রথার চল ছিল । এই নিষ্ঠুর প্রথা দূরীকরণের জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করে ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দ থেকেই রাজা রামমোহন রায় এই প্রথার বিরুদ্ধে প্রবল জনমত গড়ে তুলতে প্রয়াসী হন । তিনি বিভিন্ন হিন্দুশাস্ত্র উদ্ধৃত করে এই মত প্রচার করেন যে, সতীদাহ প্রথা ধর্মবিরুদ্ধ, সেই সঙ্গে তিনি জনমত গড়ে তোলেন । তাঁর প্রচেষ্টায় বড়লাট লর্ড বেন্টিঙ্ক ১৮২৯ খ্রিস্টাব্দে ‘সপ্তদশ-বিধি’ নামে আইন পাস করে এই বর্বর ‘সতীদাহ প্রথা’ নিষিদ্ধ করেন ।

(২) বহু-বিবাহ ও বর্ণভেদ প্রথার বিরুদ্ধেও রাজা রামমোহন রায় তীব্র আন্দোলন চালিয়ে যান ।

(৩) নারী ও পুরুষের সমানাধিকার ।

(৪) নারীরা যাতে স্বাধীনভাবে বাঁচতে পারে তার জন্য বিষয় সম্পত্তিতে নারীদের উত্তরাধিকারের দাবি প্রতিষ্ঠিত করার ব্যাপারেও রামমোহন রায়ের চেষ্টার ত্রুটি ছিল না । যদিও নারীশিক্ষা বিস্তারে তাঁর আগ্রহের অভাব কিছুটা বিস্ময়ের সৃষ্টি করে ।

(৫) রাজা রামমোহন রায় বিশ্বাস করতেন যে, পাশ্চাত্য শিক্ষার দ্বারাই ভারতীয়দের উন্নতি সম্ভব হবে । তাই যাতে ভারতে রসায়ন শাস্ত্র, শারীরবিদ্যা, চিকিত্সাশাস্ত্র প্রভৃতি শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয় তার জন্য তিনি লর্ড আমহার্স্টকে পত্র লিখেছিলেন । কিন্তু তাঁর দাবি উপেক্ষিত হয় । সরকার কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হয়ে দূরদর্শী রাজা রামমোহন রায় , রাজা রাধাকান্ত দেব, ভূকৈলাসের জয়নারায়াণ ঘোষাল ও মহাপ্রাণ ডেভিড হেয়ারের সহযোগিতায় ১৮১৭ খ্রিস্টাব্দে ২০ জানুয়ারী হিন্দু কলেজ (পরবর্তী কালে প্রেসিডেন্সি কলেজ ও বর্তমানে প্রেসিডেন্সি ইউনিভার্সিটি নামে পরিচিত) স্থাপন করেন । ১৮১৩ খ্রিস্টাব্দে চার্টার আইন অনুযায়ী যে এক লক্ষ টাকা পাশ্চাত্য শিক্ষার জন্য ব্যয় করার সিদ্ধান্ত হয়, তার পিছনেও রাজা রামমোহন রায়ের ভূমিকা ছিল অপরিসীম । ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দে আলেকজান্ডার ডাফকে জেনারেল অ্যাসেম্বলী ইনষ্টিটিউশন বা স্কটিশ চার্চ কলেজ প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে সাহায্য করেছিলেন ।

বিবিধ সংস্কার:-

(১) বাংলা গদ্য সাহিত্যে রাজা রামমোহন রায়ের অবদান উল্লেখযোগ্য । তিনি ধর্ম সংস্কারর জন্য যে সকল গ্রন্থ রচনা করেছিলেন সেগুলি বাংলা গদ্যের বিকাশে সহায়ক হয়েছিল । তিনি গৌড়ীয় ব্যাকরণ নামে একটি ব্যাকরণও রচনা করেন । তাঁর পূর্বে বাংলা ভাষায় দর্শন, সাহিত্য, ধর্ম, ইতিহাস নিয়ে কোনও গ্রন্থাদি রচিত হয় নি ।

(২) সংবাদপত্রের উপর থেকে সরকারি নিয়ন্ত্রণ তুলে দিয়ে ভারতবাসীকে স্বাধীন মত প্রকাশের অধিকার দেবার দাবি জানিয়ে ১৮২৩ খ্রিস্টাব্দের ‘প্রেস রেগুলেশন’ এর প্রতিবাদ জানিয়ে রাজা রামমোহন রায় সুপ্রীম কোর্টে দরখাস্ত পেশ করেছিলেন । ১৮২৭ খ্রিস্টাব্দের বৈষম্যমূলক ‘জুরি আইন’ বন্ধ করার জন্য এবং কৃষকদের ওপর করের বোঝা কমাবার জন্য রাজা রামমোহন রায় বহু চেষ্টা করেন ।

(৩) ১৮৩৩ খ্রিস্টাব্দে কোম্পানির সনদ প্রাপ্তির সময় রাজা রামমোহন রায় বিলাতের পার্লামেন্টে যে প্রতিবেদন পাঠান, তা তাঁর প্রগতিশীল অর্থনৈতিক চিন্তার পরিচায়ক । তিনি চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে শোষিত কৃষককুলের সপক্ষে বক্তৃতা করেছিলেন । নতুন সনদে তিনি কৃষকদের স্বার্থরক্ষা জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানান ।

(৪) ভারতীয়দের অন্ধবিশ্বাসের পরিবর্তে যুক্তিবাদ গ্রহণ, স্বাধীনতা এবং মানবাত্মার মহত্ত্ব প্রতিষ্ঠায় রাজা রামমোহন রায় উল্লেখ যোগ্য অবদান রেখে গেছেন । উনবিংশ শতাব্দীর বাংলা সমাজ, সংস্কৃতি এবং বাঙালির মনে রাজা রামমোহন রায়ের সুস্পষ্ট প্রভাব বর্তমান ।  তাই তাঁকে বাংলা তথা ভারতের নবজাগরণের জনক বা আধুনিকতার অগ্রপথিক রূপে বর্ণনা করা হয় । ১৮৩৩ খ্রিস্টাব্দে ২৭ শে সেপ্টেম্বর ইংল্যান্ডের ব্রিস্টল শহরে রাজা রামমোহন রায়ের জীবনাবসান হয় ।

উনিশ শতকের সমাজ-সংস্কার আন্দোলনগুলির প্রধান লক্ষ্য ছিল

১) যুক্তিবাদী হয়ে ভারতীয় সমাজে প্রচলিত বিভিন্ন কুপ্রথা ও কুসংকারের উচ্ছেদ ঘটানো ।

২) জাতিভেদ প্রথা ও ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরোধিতা করা ।

৩) ধর্মের নামে অধর্ম এবং সামাজিক অত্যাচারের প্রতিকার করা ।

৪) নারীদের মধ্যে উচ্চশিক্ষার বিস্তার ঘটিয়ে নারীসমাজের মান উন্নয়ন ঘটানো ।

৫) নিজেদের সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি ও ভেদবুদ্ধি ত্যাগ করে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে ওঠা এবং দেশাত্মবোধ জাগরিত করা ।

৬) সমাজসেবা ও জনকল্যাণমূলক আদর্শ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটানো ।

**

রাজা রামমোহন রায়


জীবনী ও রচনা – রাজা রামমোহন রায়
রামমোহন রায়, অথবা রাজা রাম মোহন রায় লেখা হয় রাজা রামমোহন রায় (মে ২২, ১৭৭২ – সেপ্টেম্বর ২৭, ১৮৩৩) প্রথম ভারতীয় ধর্মীয়-সামাজিক পুনর্গঠন আন্দোলন ব্রাহ্মসমাজের প্রতিষ্ঠাতা এবং বাঙালি দার্শনিক। তৎকালীন রাজনীতি, জনপ্রশাসন, ধর্মীয় এবং শিক্ষা ক্ষেত্রে তিনি উল্ল্যেযোগ্য প্রভাব রাখতে পেরেছিলেন। তিনি সবচেয়ে বেশী বিখ্যাত হয়েছেন, সতীদাহ প্রথা বিলুপ্ত করার প্রচেষ্টার জন্য। তখন হিন্দু বিধবা নারীদের স্বামীর চিতায় সহমরণে যেতে বা আত্মহুতি দিতে বাধ্য করা হত। রামমোহন রায় কলকাতায় আগস্ট ২০,১৮২৮ সালে ইংল্যান্ড যাত্রার আগে দ্বারকানাথ ঠাকুরের সহিত ব্রাহ্মসমাজ স্থাপন করেন।পরবর্তী কালে এই ব্রাহ্মসমাজ এক সামাজিক ও ধর্মীয় আন্দোলন ও বাংলার পূনর্জাগরণের পুরোধা হিসাবে কাজ করে।
বাংলাদেশের তথা ভারতবর্ষের প্রথম আধুনিক অগ্রদৃষ্টিমান চিন্তানায়ক ও কর্মনেতা। জন্ম আধুনিক হুগলি (তখনকার বর্ধমান) জেলার আন্তর্গত রাধানগর গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত কুলীন (বন্দোপাধ্যায়) ব্রাক্ষ্মণবংশে। প্রপিতামহ কৃষ্ণকান্ত ফারুখশিয়ারের আমলে বাংলার সুবেদারের আমিনের কার্য করতেন। সেই সুত্রেই বোধ করি এদের ‘রায়’ পদবীর ব্যবহার। কৃষ্ণকান্তের কনিষ্ঠপুত্র ব্রজবিনোদ রামমোহনের পিতামহ। পিতা রামকান্ত। রামকান্তের তিন বিবাহ। মধ্যমা পত্নী তারিণীর এক কন্যা ও দুই পুত্র-জগমোহন ও রামমোহন। এঁদের বংশ ছিল বৈষ্ণব, কিন্তু রামমোহনের মাতা ছিলেন ঘোর তান্ত্রিক ঘরের কন্যা। রামকান্ত পৈত্রিক এজমালি ভদ্রাসন ছেড়ে পার্শবর্তী লাঙ্গুলপাড়া গ্রামে সপরিবারে উঠে যান। রামমোহন সংস্কৃত পড়েন ও ফারসী শেখেন। তাঁর ফারসী ও আরবী শিক্ষা রাধানগরের শিক্ষিত মুসলমানদের কাছেই। ফারসী-আরবী পড়ে তাঁর মনে প্রচলিত হিন্দুধর্মের আচার-বিচার সম্বন্ধে সংশয় জাগে। অনুমান হয়, এ নিয়ে পিতামাতার সঙ্গে তাঁর মতবিরোধ হয়। পনেরো-ষোলো বছর বয়সে তিনি গৃহত্যাগ করে নানাস্থানে ঘোরেন। কাশীতে ও সম্ভবতঃ পাটনায় কিছুকাল ছিলেন এবং নেপালে গিয়েছিলেন। এর আগে তাঁর সঙ্গে তন্ত্রশাস্ত্রবেত্তা সুপণ্ডিত নন্দকুমার বিদ্যালঙ্কারের (পরে হরিহরানন্দ তীর্থস্বামী কুলাবধূত নামে পরিচিত) যোগাযোগ হয়। রামমোহনের সংস্কৃতে বুত পত্তি, তাঁর বেদান্তে অনুরাগ নন্দকুমারের সহযোগিতায় হয়েছিল। ব্রক্ষ্ম-উপাসনায় প্রতিষ্ঠায় হরিহরানন্দই তাঁর দষ্কিণ-হস্ত ছিলেন।

তাঁর তিন বিবাহ। প্রথম পত্নী অকালে মৃত। দ্বিতীয় পত্নীর গর্ভে তাঁর দুই পুত্রের জন্ম হয়-রাধাপ্রসাদ  ও রমাপ্রসাদ । ১৭৯৬ খ্রীষ্টাব্দের পর রামমোহন অর্থোপার্জনে মন দেন। কলকাতায় প্রায়ই আসতেন এবং নবাগত সিভিলিয়ানদের সঙ্গে পরিচিত হয়ে তাঁদের নানা বিষয়ে সাহায্য করেন। এই সুযোগে ভালো করে ইংরাজি শিখে নেন। ঈস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির কাজে সিভিলিয়ান কর্মচারীদের মধ্যে জন ডিগবীর সঙ্গে তাঁর সর্বাধিক ঘনিষ্ঠতা হয়। কোম্পানির কাজে এর অধীনে তিনি দেওয়ানরূপে রং পুরে কাজ করেন-মোটামুটি ১৮০৫ থেকে ১৮১৪ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত। এই সময়ের মধ্যে তিনি দু’বার ভূটান সীমান্তে যান কোম্পানির হয়ে দৌত্যকার্যে ডিগবীর সাহচর্যে তাঁর সমস্ত নূতন চিন্তা এই সময়ের মধ্যেই পরিপক্কতা লাভ করে। ১৮১৫ খ্রীষ্টাব্দ থেকে রামমোহন কলকাতার স্থায়ী বাসিন্দা হন, এখন থেকেই প্রকাশ্যে তাঁর সংস্কার-প্রচেষ্টার শুরু। তাঁর প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ ফারসী ভাষায় লেখা (ভূমিকা অংশ আরবীতে) ‘তুহফাতুল মুবাহ হিন্দীন’ । বইটিতে একেশ্বরবাদের সমর্থন আছে। এরপর একেশ্বরবাদ (বা ব্রক্ষ্মবাদ) প্রতিষ্ঠা করার জন্য বেদান্ত-সূত্র ও তার সমর্থক উপনিষদগুলি বাংলার অনুবাদ করে প্রচার করতে থাকেন। ১৮১৫ থেকে ১৮১৯ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যে বের হয়ে গেল ‘বেদান্তগ্রন্থ’, ‘বেদান্তসার’, ‘কেনোপনিষদ’, ‘ঈশোপনিষদ’, ‘কঠোপনিষদ’, ‘মাণ্ডূক্যোপনিষদ’ ও ‘মুণ্ডকোপনিষদ’। রক্ষণশীল ব্যক্তিরা ক্রুদ্ধ হয়ে তাঁর লেখার প্রতিবাদ দেখাতে লাগলেন। এই সব প্রতিবাদ কটুক্তিপূর্ণ এবং বিদ্বেষ ভাবাপন্ন। রামমোহনও প্রতিবাদের প্রতিবাদ করলেন যুক্তি দিয়ে ও ভদ্রভাষায়। প্রতিবাদ-কর্তারা অবিলম্বে থেমে গিয়েছিলেন। প্রতিবাদ-কর্তাদের মধ্যে প্রথম ও প্রধান ছিলেন মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার, এঁর গ্রন্থের নাম ‘বেদান্তচন্দ্রিকা’ । ‘বেদান্তচন্দ্রিকা’র প্রতিবাদে রামমোহন ”ভট্টাচার্যের সহিত বিচার’  লিখে প্রতিবাদীদের মুখ বন্ধ করে দিয়েছিলেন। ‘বেদান্ত গ্রন্থ’ প্রকাশের সঙ্গে তিনি ব্রক্ষনিষ্ঠ একেশ্বর উপাসনার পথ দেখালেন ‘আত্মীয় সভা’ প্রতিষ্ঠা করে । এই আত্মীয় সভাকেই পরে তিনি ‘ব্রাক্ষসমাজ’ নাম ও রূপ দেন ।

বেদান্ত-উপনিষদগুলি বের করবার সময়ই তিনি সতীদাহ অশাস্ত্রীয় এবং নীতিবিগর্হিত প্রমাণ করে পুস্তিকা লিখলেন ‘প্রবর্তক ও নিবর্তকের সম্বাদ’ । প্রতিবাদে পুস্তিকা বের হল ‘বিধায়ক নিষেধকের সম্বাদ’। তার প্রতিবাদে দ্বিতীয় ও তৃতীয় পুস্তিকা  বের হয়। এই বছরেই ডিসেম্বর মাসে আইন করে সহমরণ-রীতি নিষিদ্ধ করা হয়। তবুও গোঁড়ারা চেষ্টা করতে লাগল যাতে পার্লামেন্টে বিষয়টি পুনর্বিবেচিত হয়। এই চেষ্টায় বাধা দেবার জন্য রামমোহন বিলেত যেতে প্রস্তুত হলেন।

বাংলায় ও ইংরাজীতে সাময়িকপত্র ছাড়া তিনি ফারসীতে একটি সাপ্তাহিক সংবাদপত্র চালিয়েছিলেন এক বছর ধরে (১৮২২-২৩ খ্রী)। সংবাদপত্রটির নাম ‘মিরাতুল-আখবার’। ভারতবর্ষের নানাস্থানে এমনকি ইরাণেও এই ফারসী সংবাদপত্রটির গ্রাহক ছিল। গভর্নর জেনারেল যখন হুকুমজারি করলেন যে, সংবাদ ও সাময়িকপত্র মাত্রই রেজেস্টারিভুক্ত হওয়া প্রয়োজন, তখন তিনি সে হীনতা স্বীকার না করে কাগজটি উঠিয়ে দিলেন।

১৮৩০ খ্রীষ্টাব্দের ১৯ নভেম্বর তিনি কলকাতা থেকে বিলেত যাত্রা করেন। দিল্লীর বাদশাহ তাঁকে ‘রাজা’ উপাধি দিয়ে ভার দিলেন বিলেতে গিয়ে রাজদরবারে যেন বাদশাহের তনখা বৃদ্ধির সুপারিশ করেন। ১৮৩১ খ্রীষ্টাব্দের ৮ এপ্রিল রামমোহন লিভারপুলে পৌঁছলেন। সেখানে সম্ভ্রান্ত ও বিদ্বতসমাজে তাঁর প্রচুর সমাদর হয়েছিল। ১৮৩২ খ্রীষ্টাব্দের শেষের দিকে কিছুদিনের জন্য তিনি ফ্রান্সেও গিয়েছিলেন। ফিরে ব্রিস্টলের নিকটবর্তী স্টেপলটনহিল গ্রামে থাকার সময়ে তিনি হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং ২৭ সেপ্টেম্বর ১৮৩২ খ্রীষ্টাব্দে তাঁর মৃত্যু হয়। ১৮ অক্টোবর দেহ ব্রিস্টলে সমাথিস্থ হয়।

তিনিই প্রথম ব্যক্তি যিনি ভারতবর্ষকে এগিয়ে যাবার পথনির্দেশ করেছিলেন। তিনিই আমাদের দেশের প্রথম লিঙ্গুয়িস্ট। বাংলা ছাড়া তিনি জানতেন সংস্কৃত, ফারসী, আরবী, হিব্রু (কিছু) ও গ্রীক (কিছু)। বাংলা গদ্যের তিনি জনক-এই অর্থে যে তিনিই প্রথম বাংলা গদ্যে স্বীর স্বাধীন চিন্তা লিপিবদ্ধ করেন এবং তাঁর ভাষা কোনও গ্রন্থের অনুবাদ-গন্ধী নয়। তাঁর বাংলা ভাষার ব্যাকরণ (ইংরেজীতে লেখা, পরে বাংলায় অনুদিত) বাংলা ভাষায় তাঁর গভীর জ্ঞানের পরিচায়ক। স্বাধীন চিত্ততার প্রকাশে তাঁর জুড়ি নেই। সংস্কৃত কলেজ করবার আবশ্যক নেই, আমাদের ইংরেজী ও বিজ্ঞান শিখতে হবে-উচ্চকণ্ঠে এ-কথা ঘোষণা করবার সাহস সেকালে তাঁর ছাড়া অন্য কারও ছিল না।