নাগপঞ্চমী ও ব্রতকথা


নাগপ্রিয়া পঞ্চমী, বা নাগপুজাঙ্গং পঞ্চমী।

আষাঢ়মাসের কৃষ্ণাপঞ্চমী। এই পঞ্চমী তিথিতে মনসা ও নাগপুজা করতে হয়, এজন্য এই পঞ্চমীর নাম নাগপঞ্চমী।
“সুপ্তে জনাৰ্দ্দনে কৃষ্ণে পঞ্চম্যাং ভবনাঙ্গনে।
পূজয়েন্মনসাদেবীং স্নুহীবিটপসংস্থিতাম্॥
পদ্মনাভে গতে শয্যাং দেবৈঃ সর্ব্বৈরনস্তরম্ ।
পঞ্চম্যামসিতে পক্ষে সমুত্তিষ্ঠতি পন্নগী॥” (তিথিতত্ত্ব)

বিষ্ণুর শয়নে কৃষ্ণাপঞ্চমী তিথিতে সিজবৃক্ষ স্থাপন করে মনসা ও নাগপূজা করতে হয়। মনসাদেবীকে পূজা ও নমস্কার করলে সাপের ভয় থাকে না। এই পূজাতে ঘী ও দুধ নৈবেদ্য দিতে হয়।
“দেবীং সম্পূজ্য নত্বা চ ন সর্পভয়মাপ্নুরাৎ।
পঞ্চম্যাং পূজয়েন্নাগাননন্তাদ্যান্‌ মহোরগান্॥
ক্ষীরং সর্পিন্তু নৈবেদ্যং দেয়ং সর্পবিষাপহম্॥” (তিথিতত্ত্ব)

এই দিনে নিজ ঘরে নিমপাতা স্থাপন করবে এবং ব্রাহ্মণ ও বন্ধুদের সাথে মিলে তা খেতে হয়।
“পিচুমর্দ্দন্ত পত্রাণি স্থাপয়েদ্ভবনোদরে।
স্বয়ঞ্চাপি তদশ্নীয়াৎ ব্রাহ্মণাংশ্চৈব ভোজয়েৎ॥” (তিথিতত্ত্ব)

বরাহপুরাণ থেকে জানা যায়, পঞ্চমী তিথিতে নাগেরা ব্রহ্মার শাপ ও শাপ থেকে মুক্ত হওয়ার উপায় লাভ করে, এ জন্য পঞ্চমী তিথি এদের অত্যন্ত প্রিয়। এই তিথিতে দুধ দিয়ে নাগদেরকে স্নান করালে আর সর্পভয় থাকে না। নাগপঞ্চমী দিনে অনন্ত, বাসুকি, পদ্ম, মহাপদ্ম, তক্ষক, কুলীর, কর্কোট ও শঙ্খ এই অষ্টনাগের পুজা করতে হয়, এই অষ্টনাগ ভিন্ন আরও কতগুলি নাগের নাম উল্লেখ তিথিতত্ত্বে দেখা যায়। যথা- শেষ, পদ্ম, মহাপদ্ম, কুলিক, শঙ্খপালক, বাসুকি, তক্ষক, কালিয়, মণিভদ্রক, ঐরাবত, ধৃতরাষ্ট্র, কর্কোটক, ধনঞ্জয়। (গরুড়পুরাণে) অনন্ত, বাসুকি, শঙ্খ, পদ্ম, কম্বল, কর্কোটক, ধৃতরাষ্ট্র, শঙ্খক, কালিয়, তক্ষক, পিঙ্গল ও মণিভদ্রক এ সকল নাগপূজা করলে সাপের দংশন থেকে মুক্ত অর্থাৎ প্রথমে দংশিত পরে মুক্ত হয়ে স্বর্গলাভ হয়।
“শেষঃ পদ্মো মহাপদ্মঃ কুলিকঃ শঙ্খপালকঃ।
বাসুকিন্তক্ষকশ্চৈব কালিয়ো মণিভদ্ৰকঃ॥
ঐরাবতো ধৃতরাষ্ট্রঃ কর্কোটকধনঞ্জয়ৌ।
গরুড়েঽপি –
অনন্তং বাসুকিং শঙ্খং পদ্মং কম্বলমেবচ।
তথা কর্কোটকং নাগং ধৃতরাষ্ট্রঞ্চ শঙ্খকম্॥
কালিয়ং তক্ষকঞ্চাপি পিঙ্গলং মণিভদ্রকম্।
যজেত্তানসিতান্নাগান্ দষ্টমুক্তোদিবং ব্রজেৎ॥” (তিথিতত্ত্ব )

ভারতের প্রায় সর্বত্র এই ব্রত আচরিত হয়। স্ত্রীলোকেই এই ব্রত করে থাকে। অন্যান্য স্ত্রী-ব্রতের মতো নাগপঞ্চমী ব্রতেরও স্ত্রী-সুলভ ব্ৰত কথা আছে। আশ্চর্যের বিষয় এই, বাংঙালী স্ত্রীরা যেমন কথা বলে থাকেন, বোম্বাইয়ে প্রভু-কায়স্থ রমণীরা নাগপঞ্চমীর ব্রতকথা প্রায় ঠিক তেমনটাই বলেন। এখানে প্রভু-কায়স্থ রমণীদের বলা উপাখ্যানটি সংক্ষেপে তুলে ধরা হল :-
ব্রতের দিন প্রভুরমণীরা একটি কাঠের চৌকিতে চন্দন বা সিন্দুর দিয়ে ৯টা সাপের-চিত্র অংকন করে। এর মধ্যে দুইটি বড়, আর সাতটি ছোট। এদের পাদমূলে আর একটি লেজহীন ক্ষুদ্র সাপ আঁকে। তার কাছেই দীপহন্তা এক স্ত্রীমূর্তিও আঁকে। তার পাশেই একটি পাথরের টুকরা এবং একটা সাপের- বিবরও আঁকা হয়। বিবাহিতা রমণীরা প্রত্যেকে একে একে এই সর্গ-চিত্রের উপর ভাজা শসা, কলাই, কলার টুকরা, ফুটির টুকরা ও নারকেলের টুকরা দিয়ে থাকে। পাতার ঠোঙায় করে দুধ দেয়। তারপর ফুল চন্দন সিন্দুর দিয়ে পূজা করেন। পূজার পর সকলে মিলে সাপের কাছে পরিবারবর্গের মধ্যে কারও যেন সাপ থেকে অনিষ্ট না হয় এবং বাড়ীতে সাপের ভয় যেন না থাকে এই বর প্রার্থনা করে। তারপর গৃহিণী, কন্যা, বধূ প্রভৃতিকে একত্র করে ব্রতের কথা বলতে বসেন। ব্রতকথা এমন-
এক মণ্ডলের সাতজন পুত্রবধূ ছিল। ছোট বউটার বাপ মা ছিল না, সুতরাং বাড়ীর সমস্ত কাজ কর্ম সকলে তাকে দিয়েই করাত এবং পাঁচ জনের খাবারের অবশিষ্ট
খেতে দিত। এক দিন পুকুরঘাটে সাতটা বউ স্নান করতে গেল। বড় ছয় বউ পিতামাতাহীন সপ্তম বধূকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলতে লাগল, আমাদের বাপ ভাই আছে, তারা আমাদেরকে নিমন্ত্রণ করে নিয়ে যেতে এসেছে।
ছোট বউটা এই সকল শুনে মুখ ম্লান করে রইল। যেখানে তারা এ সকল কথা বলছিল, তার কাছেই এক সাপের গর্ত ছিল। এই গর্তবাসী সাপ ও সাপিনী তখন গর্তের মুখে থেকে তাদের সমস্ত কথা গুলি শুনল। সাপিনী তখন গর্ভিণী। সাপ বলল, তোমার এই অবস্থায় সেবার জন্য একজন লোকের আবশ্যক, এই পিতামাতাহীনা মনুষ্যকন্যাকে আমি নিয়ে আসি। আমি এর ভাই পরিচয় দিয়ে একে নিমন্ত্রণ করে আনব এবং তোমার প্রসবকাল পর্যন্ত এখানে রেখে পরে পাঠাবো। সাপিনী সম্মত হলে এক দিন অপরাহ্ণে ঐ ছোট বউটা গোরু চরাতে আসলে সাপ এক দিব্য যুবক মূৰ্ত্তি ধারণ করে এসে বলল, ভগ্নি! আমি তোমার ভাই, দূরদেশে ছিলাম, সুতরাং এত দিন তোমার খোঁজ খবর নিতে পারিনি। তুমি যখন শিশু ছিলে, তখন আমি বিদেশে গিয়েছিলাম, সুতরাং তুমি আমাকে কখন দেখনি। যাহোক এক দিন আমি তোমার শ্বশুর বাড়ী গিয়ে তোমাকে নিয়ে আসব। তুমি প্রস্তুত থেকো। একদিন বাড়ীর সবার খাওয়া হয়ে গেলে খাবারের অবশিষ্ট তুলে রেখে ছোট বউ বাসন মাজতে ও স্নান করতে গেল। ইতিমধ্যে সেই সাপ এসে সেই খাবার খেয়ে ফেলে। ছোট বউ স্নান করে এসে দেখে, তার খাওয়ার উচ্ছিষ্ট খাবার কয়টাও কে যেন খেয়ে ফেলেছে, তখন সে ভোক্তাকে গালি না দিয়ে বলল, আহারে কারো হয়তো ক্ষুধা পেয়েছিল, যেই বা খেয়েছে, তার ক্ষুধা শীতল হোক। সাপ এমন সহৃদয়তার কথা শুনে আনন্দিত হয়ে সেদিনই বউটাকে আনার জন্য স্বামীকে অনুরোধ করল। সাপ আগের মতো মানুষের আকার ধারণ করে মণ্ডলের বাড়ী গেল এবং নিজেকে মণ্ডলের কনিষ্ঠা বধূর ভাই পরিচয় দিয়ে তাকে নিয়ে যেতে চাইল। মণ্ডল অসম্মত হল না । ছোট বধূ এই নূতন ভাইয়ের সাথে নিঃসন্দেহ চলে গেল। পথে সাপ বধূকে নিজের প্রকৃত পরিচয় দিল এবং বলল, গর্তে প্রবেশের সময় সে সাপের রূপ ধারণ করবে এবং বউটা যেন তার লেজ ধরে থাকে যাতে করে অনায়াসে সাপের গর্তে প্রবেশ করতে পারবে। এবং সেটাই হল। বউটা গর্তে প্রবেশ করে দেখল, সুবর্ণময় প্রাসাদে রত্ন-খচিত দোলায় গর্ভিণী সাপিনী শুয়ে আছে। বউটা আসামাত্রই সাপিনীর সাতটা সন্তান ভূমিষ্ঠ হল। বউটা একটি দীপ হাতে যেমনি সেগুলিকে দেখতে গেল, অমনি একটা সদ্যজাত শিশু সাপ লাফিয়ে তার গায়ে উঠল। বউটা ভয়ে চমকে উঠল, হাতের দীপ পড়ে গেল এবং তার আঘাতে একটা শিশুর লেজ কেটে গেল। এই শিশুগুলি বড় হলে পূর্ণ দেহ ছয়টা সাপ লেজহীন সাপটাকে উপহাস করতে লাগিল। সে তখন জাতক্রোধ হয়ে সেই বধূকে দংশন করবে এমটা স্থির করল এবং একদিন সেই উদ্দেশে মণ্ডলের বাড়ীটে প্রবেশ করল। সেদিন ছিল নাগপঞ্চমী। যখন নিজ ঘরে বসে ছোট বউ নাগপঞ্চমীর ব্রত করে সাপেদের উদ্দেশে দুধ কলা উৎসর্গ করছে, এমন সময় জাতক্রোধ শিশু সাপ সেখানে উপস্থিত হল, কিন্তু মানবীকে সাপের পূজা করতে দেখে তার ক্রোধ দূর হল, তারপরে তার দেওয়া খাবার খেয়ে চলে গেল। সে পিতামাতাকে সমস্ত বিবরণ বলিল। সাপ ও সাপিনী শুনে পরম উল্লাসিত হয়ে বধূকে বিস্তর ধন রত্ন দান করল এবং বহু পুত্রবতী হওয়ার বর দিল।
এই পুণ্যকথা শুনে প্রভুরমণীরা সকলে চাউলের লাড্ডু ভোজন করে। পুণা প্রভৃতি স্থানে ঐ দিন সর্পনর্তকেরা গৃহস্থের বাড়ি বাড়ি গিয়ে নিজেদের সাপের পূজা করায়। গৃহস্থকামিনীরাও এ সকল জীবিত সাপদেরকে দুধ, কলা, ভাজা শস্য কলাই ইত্যাদি খেতে দেয় ও প্রত্যেকে একটা করে পয়সা দেয়। ঐ দিন প্রভুরমণীরা পাতার ঠোঙায় গৃহকোণে সাপেদের উদ্দেশে দুধ রেখে দেয় এবং পাছে সাপের কোন ক্ষতি না হয়, সে দিন জাঁতা পেসা, রান্না, শস্য ভাঁজা ইত্যাদি কাজ করে না।
বাংলা দেশের নাগপঞ্চমী ব্রতকথার একটু ভেদ আছে।
সাতারা অঞ্চলেও নাগপঞ্চমীর খুব ধুমধাম হয়। এই প্রদেশে অনেকগুলি গ্রামে সাপের-মন্দির আছে। যেখানে সাপের মন্দির আছে, সেখানে স্ত্রীলোকেরা মাটির সাপ বা কাঠের আসনে চন্দন ও সিন্দুরে অঙ্কিত সাপের-চিত্র ও পূজার দ্রব্য নিয়ে ঐ মন্দিরে উপস্থিত হয়। এই সকল স্ত্রীরা সাপের গর্ত দেখলে পরস্পর হাত ধরে সেখানে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করে এবং সেই গর্ভে দুধ কলা দেয়। বত্তিশা-সিরালেন নামের নগরে নাগকুলি নামে এক জাতীয় সাপ আছে, তাদের বিষ তত অনিষ্টকর নয়। সেখানকার লোকে নাগপঞ্চমীর আগের দিন এই সাপ ধরে হাঁড়িতে রাখে। পূজার দিন তাকে খেতে দেয় এবং পর দিন আবার বনে ছেড়ে দেয়।
দাক্ষিণাত্যে অনেক স্থানে নাগ মন্দির আছে। মাদ্রাজ শহরেই সর্বাপেক্ষা বেশী। মাদ্রাজের উপকণ্ঠে বসরাপাড় গ্রামে এক বৃহৎ নাগমন্দির আছে। সেখানে প্রতি রবিবার সকালে ব্রাহ্মণ-রমণীরা পূজা দিতে যায়। এখানকার পূজক বন্যয়েনড়ি জাতীয়।

নিবেদনে- কৃষ্ণকমল

নাগপূজার ইতিহাস


ভারতবর্ষের সর্বত্রই নাগপুজা প্রচলিত। ভারতবাসী ছাড়াও বহু জাতির মধ্যে এই পূজার প্রথা দেখা যায়। খৃষ্ট-জন্মের ২০০০ বৎসর পূর্বে ইহুদীদের মধ্যে এই পূজা আরম্ভ হয়েছিল। রোম থেকে ১৬ মাইল দুরে লাহুবিয়াম নামের স্থানে এক নিবিড় অন্ধকারময় নিকুঞ্জ ছিল। সেটি সতীর অধিষ্ঠাত্রীদেবী জুনোর (Juno) কুঞ্জ নামে বিখ্যাত। তারই কাছে একটা বড় আকার অজগরের আবাস ছিল। রোমকরা তাকে যথেষ্ট ভক্তি করত। প্রায় সকল হিন্দুই বিষধর ফণীকে অত্যন্ত ভক্তি করেন এবং সময় সময় ভারতের নানা গ্রামবাসী হিন্দু- মহিলারা নাগপূজার জন্য উইয়ের ঢিপি তথবা সে রকমই কোন স্থানে খুজে নেন।

হিন্দুরা যেমন মানুষের মৃতদেহের সৎকার করে, তেমনি নানা স্থানে নিহত সাপেরও সৎকার করা হয়। হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন প্রভৃতির দেব দেবীর প্রাচীন মূর্ত্তির মাথার উপর ছত্রাকারে সাপেরফণা বিস্তার করে আছে দেখা যায়। কোথাও ৩, ৫, ৭, বা ৯, অথবা কোথাও ১১টা সাপের ফণা বিস্তার করে রয়েছে।

প্রায় সকল পৌরাণিক গ্রন্থে সাপের অমরত্বের নিদর্শন বর্ণনা করা আছে। নাগদের খোলস পরিবর্তনের পর নূতন খোলস ও নববিষের আবির্ভাব দেখে এবং সাপের লেজ তার মুখে প্রবেশ করালে যে অনির্দিষ্ট সীমায় দেহ বৃদ্ধি হয় তাই দেখে মনোমধ্যে চিরযৌবন ও অনন্তকালের বিষয় উদয় হয়। ইজিপ্ট ও গ্রীসের ইতিহাসেও নানা প্রকার নাগোপাখ্যান আছে।

গরুড়ের সাথে নাগদের যে যুদ্ধের কথা শুনা যায় এবং গরুড় যে নাগদমন করেছিলেন, পাশ্চাত্য পণ্ডিতেরা তার এই ব্যাখ্যা করেন। গরুড় বিষ্ণু উপাসকের দৃষ্টান্ত স্বরূপ এবং নাগেরা বলতে শাক্যমুনির প্রতিষ্ঠিত বৌদ্ধধৰ্ম্মাবলম্বী ব্যক্তিরা। গরুড় নাগজয় করেছিলেন অর্থাৎ প্রবলতর বৈষ্ণবধৰ্ম হীনতেজ বৌদ্ধধর্মকে পরাভূত করেছিল।

মহাভারত সহ প্রাচীন গ্রন্থে থেকে জানা যায় যে, পরীক্ষিতের পুত্র জনমেজয় সাপক্ষয় যজ্ঞ করেন। এই যজ্ঞে রাজা জনমেজয় প্রায় সমস্ত নাগ নিধন করেছিলেন। বাস্তবিক দেখতে গেলে, এই ঐতিহাসিক ঘটনা সেসময়কার একটা যথার্থ ঘটনার আভাস বর্ণনা করা হয়েছে। যখন জনমেজয় নাগপুজা বন্ধ করেন, সে সময় স্থানীয় কুসংস্কার দুর হয়ে বেদের সনাতন ধর্ম সে স্থান অধিকার করে।

কাশ্মীর প্রদেশে সর্ব প্রথমে নাগপূজা ও মনসাপুজা প্রচলিত ছিল। খৃঃ পূর্ব ৩৫০/৪০০ শতাব্দীতে কাশ্মীর অঞ্চলের প্রায় সাতশ স্থানে নাগপূজা হত(আবুল ফজল এর তথ্য)। সমস্ত ভারতবর্ষে এই নাগপুজা প্রচলিত ছিল।

কোথাও জীবিত গোখুরা সাপের পূজা হয়, কোথাও বা খোদাই করা প্রতিমূর্তির পূজা করতে দেখা যায়। প্রায় প্রত্যেক ঘরেই মনসাদেবীর প্রতিরূপ মনসাগাছ আছে। অনেকে তারই পূজা করেন। কোন কোন স্থানে এমন প্রতিমূৰ্ত্তি আছে যে, একটি সাপ ফণা বিস্তার করে আছে, কোথাও বা দেখা যায় যে, অষ্টনাগ খোদাই করা আছে। অধিকাংশই আবার দুইটা সাপ একত্র দেখা যায়।

দাক্ষিণাত্যে সর্বত্রই সাপের আবাসে পূজার্থিরা উপস্থিত হয়ে সেখানে সিন্দুর লেপন করে, চিনি মিশানো গোধূম ও হরিদ্রাচূর্ণ দিয়ে আঁকে এবং সুগন্ধি কুসুমের মালা গেঁথে এর কাছে ঝুলিয়ে রাখে।

মহারাষ্ট্রের নারীরা নাগপুজার্থে অনেকে একত্র হয়ে নাগ মন্দিরে যান এবং পরস্পর হাত ধরে গান করতে করতে পাঁচবার মন্দির প্রদক্ষিণ করার পর অভীষ্ট বর প্রার্থনা করে ভূমিষ্ঠ হয়ে প্রণাম করেন। শ্রাবণ মাসে নাগপঞ্চমী। ঐ দিন হিন্দুরা সাপ খুঁজতে বের হয় এবং সাপুড়েদের সাহায্যে সাপ ধরে নিয়ে আসে । পরে ভক্তিপূর্বক তাকে পূজা করে দ্রব্য দান করে। সে দিন বোম্বাই প্রদেশের প্রত্যেক হিন্দু গৃহস্থই সাপের মূৰ্ত্তি কাঠে বা কাগজে এঁকে দেওয়ালের উপরে স্থাপন করে অর্চনা করে থাকে। অজন্তার গুহামন্দিরে নাগপূজার প্রাচীন নিদর্শন দেখা যায়। ছত্র গ্রামের পশ্চিমের দেওয়ালে একটা কেউটে সাপের মূৰ্ত্তি আঁকা আছে। সাপেরা চলার সময় যেমন বক্রভাবে যায়, এই চিত্রটাও সেরকম। নাগ উপাসকেরা বলে যে, এই সাপ লঙ্কা অভিমুখে যাচ্ছে এবং যখন তাদেরকে বলা যায় যে, লঙ্কার যেতে বহুদিন লাগবে, তখন তারা এর প্রতি বিদ্রূপ প্রকাশ করে থাকে।

কাগজে আঁকা শিবলিঙ্গের উপর প্রায়ই সাপের মূৰ্ত্তি ফণা বিস্তার করে রয়েছে দেখা যায়। শিবমূৰ্ত্তি সচরাচর এভাবেই গড়া হয় যে, বাঘের চামড়ার উপর শিব বসে আছেন এবং মাথায় সাপ ও গলায় জড়িয়ে আছে। প্রচলিত আছে, সমুদ্রমন্থনে যে বিষ উঠেছিল মহাদেব তা পান করে যন্ত্রণায় অস্থির হয়ে জ্বালা নিবারণ করার জন্য গলায় সাপ জড়িয়ে রেখেছিলেন। ভগবান বিষ্ণু যখন অনন্তশয্যায় শয়ন করেছিলেন, তখন তাঁর অন্য অবতার না হওয়া পর্যন্ত সাপেরা ফণা বিস্তার করে তাঁকে ছায়া প্রদান করছিল।

দক্ষিণভারতে মহিসুরের পশ্চিমাংশে সুব্রহ্মণ্যদেবীর এক মন্দির আছে। এই মন্দির মধ্যে মাটির তৈরি প্রতিমূৰ্ত্তি আছে। অধিবাসিরা নাগদের উদ্দেশে সুব্রহ্মণ্যের পূজা করে থাকেন। বর্তমান সময়েও সেখানে নাগপুজাপদ্ধতি আগের মতোই অক্ষুণ্ণ রয়েছে।

১৮৪১ খৃষ্টাব্দে আহ্মদনগরে একদিন পৌর্ণমাসী নিশিতে কোন কুটির থেকে পাঁচজোড়া সাপ বের হয়। আশ্চর্যের বিষয়, ৫ জোড়া সাপই যুগল অবস্থায় ছিল। এরকম নাগ- মিথুন দেখে এক ইউরোপীয় যুবক অত্যন্ত কৌতূহলাক্রান্ত হয়ে তাঁর কোন বন্ধুর সাথে গল্প করছিলেন। তখন তাঁর বন্ধু বললেন, “মহাশর! আমিও একদিন ২টা সাপকে যুগল অবস্থায় দেখেছিলাম। এ সময় তারা লেজের উপর ভর দিয়া সোজা হয়ে দাঁড়ায়। ভারতবাসীরা এটাকে সাপের নাচ বলে। তাদের বিশ্বাস যে এমন নাগ- দর্শন সৌভাগ্যসূচক। সেই সময় যদি কেউ একটি নবরত্ন সাপেদের গায়ের উপর নিক্ষেপ করতে পারে, তাহলে তার অসীম পুণ্য সঞ্চয় হয়। পরে সেই বস্ত্র ঘরে এনে রাখলে লক্ষ্মী চিরদিনের জন্য তার ঘরে আবদ্ধ থাকেন।”

হিন্দুরা সাধারণতঃ সাপ বিনাশ করতে চায় না । সাপ দেখলে তারা অন্য দিক দিয়ে চলে যায়। আধুনিক ইংরাজী ভাষাজ্ঞ হিন্দু যুবকরা প্রাচীন ধারা অতিক্রম করে অনেকে সাপের প্রাণ নিধন করছেন, সত্য বটে; কিন্তু পুরাকালে হিন্দুরা কখন সাপ হত্যা করতেন না। একবার বৌদ্ধ বণিক গৃহস্থের বাড়িতে দুইজন অতিথি উপস্থিত হয়। বণিক গৃহ- স্বামী বাজারে বের গেলে, তার পত্নী জল আনার জন্য জলাশয়ে যান। যখন অতিথিরা গৃহস্বামীর অপেক্ষায় বসে আছেন, তখন এক বড় আকারের সাপ তাদের সামনে উপস্থিত হল। এটি দেখেই তাদের মধ্যে একজন লাঠি দিয়ে সাপের মধ্যভাগ মাটির উপর চেপে ধরল; দ্বিতীয় ব্যক্তি আরেকটি লাঠি নিয়ে সাপটিকে হত্যা করতে উদ্যত হলে, বৌদ্ধ বণিকের স্ত্রী পেছন থেকে তাদের বললেন, ‘মহাশয়! থামুন, থামুন, একে হত্যা করবেন না। ইনি আমাদের পূর্বজ-দেব। ইনি আমার শাশুড়ি ঠাকুরাণীর মাথার উপর গিয়ে তার সর্বশরীর কাঁপিয়ে যেন এবং আমার শ্বশুর মহাশয়ের নাম ধরে বলেন যে, তিনিই দেহ ত্যাগ করে সাপের দেহ ধারণ করেছেন। একদিন ইনি আমাদের এক প্রতিবেশীকে দংশন করেন। পরে যখন তার চিকিৎসার জন্য যতি আসল, পূৰ্বজ-দেব প্রতিবেশীর শরীর কাঁপিয়ে বলল, “আমার পুত্রের সাথে বিবাদ করেছ তাই আমি একে দংশন করেছি। আর কখনও তার সাথে কলহ করবেনা, স্বীকার করলে আমি একে ছেড়ে দিব।” সেই থেকে অজগর কারও ঘরে প্রবেশ করলে, কেউই উর প্রতি নিষ্ঠুর ব্যবহার করেন না। কয়েকদিন হল অমরা একে প্রায় ১০ মাইল দূরে ছেড়ে দিয়ে এসেছিলাম। কিন্তু কি চমৎকার, সেই ১০ মেইল দূর থেকে আবার ফিরে এসেছে। অনেকবার আমি ঘটনাক্রমে উর গায়ে পা দিয়েছি, কিন্তু কোনদিন আমাকে কিছু বলেনি এবং শিশুসন্তানকে রেখে জল আনতে গেলে, তার সাথে খেলা করে কান্না থামায়।

এ কথা শুনে অতিথিরা সাপকে ছেড়ে দিলেন এবং বিনীতভাবে তার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করলেন।

কিছুদিন পরে একটা বিড়াল ঐ সাপের জীবন নষ্ট করে। গৃহস্বামী এর মৃতদেহ আগুনে দগ্ধ করে এবং চিতানল মধ্যে চন্দনকাঠ, নারিকেল ও ঘি দেন। এমন প্রথা এখনো অনেকস্থানে প্রচলিত আছে। 

নাগপুজার প্রচলন ছিল না, সমস্ত পৃথিবীর মধ্যে এমন স্থান অতি অল্প। সমস্ত এশিয়ার মধ্যে কেবলমাত্র চীনে কোন কোন স্থানে এই পূজা ছিল না। এতদ্ব্যতীত আফ্রিকা, কালদীয়া, পালেস্তিন, বাবিলন, পারস্য, কাশ্মীর, কাম্বোজ, তিব্বত, ভারতবর্ষ, লঙ্কাদ্বীপ প্রভৃতি স্থানে এবং ইউরোপের অনেক জায়গার, এমন কি আমেরিকার মধ্যেও কোন কোন স্থানে নাগপূজার রীতি ছিল এমন স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া গেছে।

রাজপুতেরা সাপ দেবতার প্রতিমূর্তি অর্ধেক মানুষের আকারে নির্মাণ করে। দিওদোরস্ স্কিদীর (শক) জাতির সাপ- জননীর আকৃতিও এরকম বর্ণনা করেছেন। হিন্দুদের মতে, মনসাদেবী নাগমাতা। তার ভাই অনন্তনাগ সাপদের রাজা। ‘অনন্ত’ অর্থাৎ সীমারহিত। সাপের গোলাকার অবস্থায় অবস্থিতি থেকেই ঐ নামের উৎপত্তি।

যদিও এমনো উল্লেখ আছে যে, ক্ষীরোদশায়ী বিষ্ণুকে অনন্ত নাগ অতলস্পর্শ সাগর মাঝে আশ্রয় দিয়েছিলেন, তথাপি পুরাণে এও উল্লেখ আছে যে, অনন্তনাগই স্বয়ং বিষ্ণু অর্থাৎ সেই অনাদি মহাপুরুষ বিষ্ণুর অন্য নাম ‘অনন্ত’।

যেমন হিন্দুদের মধ্যে সূর্যের পুত্র অশ্বিনীকুমারদ্বয় প্রসিদ্ধ দেব বৈদ্য, তেমনি গ্রীক ও রোমানদের মধ্যে একুলাপিয়াস্ (Esculapius) দেব বৈদ্য নামে খ্যাত। এর হাতের দণ্ড দুইটা সাপ দিয়ে বেড়ানো। ফিনিকীয়দের নাগ দেবতার নাম এমন, মিশরবাসীদের হার্মিস (Hermes), কালদীয়দের ওব, বাবিলনে বেল, ইত্যাদি বিভিন্ন দেশে নাগদেব বিভিন্ন নামে অভিহিত।

লঙ্কাদ্বীপ ও গুজরাতবাসিরা অর্চনা করার মানসে এবং ইদুর বিনাশের উদ্দেশে বাড়ীতে সাপ ধরে রাখে। গুজরাতবাসীরা কেউই সাপ মারেনা, কিন্তু সাপ ধরে নগরের বাইরে ছেড়ে দিয়ে আসে। সিংহলে পোকা মারার জন্যও সাপ রাখা হয়। অতি প্রাচীনকাল থেকে আলেজেণ্ডারের সময় পর্যন্ত টায়রে সাপের প্রতি বিশেষ সম্মান প্রদর্শিত হয়েছে। যদিও বর্তমান সময়ে সেখানে নাগপূজা হয় না, তথাপি ওফাইট (Ophites), নিকোলেটা (Nicoletans) এবং নষ্টিক (Gnosties) নামে খৃষ্টান সম্প্রদায়ের মধ্যে এই নাগপূজা প্রচলিত। ওফাইটরা সর্ম্পকে যীশুখৃষ্ট অপেক্ষা অধিক ভক্তি করত। তারা বাক্সের মধ্যে একটা জীবিত সাপ ধরে রাখত এবং তাকেই ঈশ্বর মানত। পোলাগুদেশে ঊনবিংশতি শতাব্দীর শেষ পর্যন্ত ও নাগপূজা হত। সমস্ত জাতিই যে, সাপের প্রতি বিশেষ শ্রদ্ধা ও ভক্তি করত, তা নিচের ঘটনাগুলি থেকে স্পষ্ট বুঝা যাবে। 

পৃথিবীর অনেক অসাধারণ লোক সাপ থেকে জন্মগ্রহণ করেছেন এমন পরিচয় দিয়েছেন। রোমান সেনাপতি সিপিও (Scipio Africanus) নাগের সন্তান হিসেবে পরিচিত। Augustus বলেন যে, তার মাতা আটিয়া (Atia) নামের সাপ থেকে গর্ভবর্তী হয়েছিলেন। অনেকের বিশ্বাস ছিল যে, আলেকজাণ্ডারের নাগনন্দন ছিলেন।

এন্দরের (Endor) স্ত্রীলোকদেরকে ওবের উপপত্নী বলা হয়। ইস্রাইলের রাজা যোথাম নাগপূজার জন্য সাপ- দেবতার একটা মনোহর মন্দির নির্মাণ করেছিলেন।

এশিয়া মাইনরের বহুসংখ্যক প্রাচীন মুদ্রার উপর সাপের আকৃতি আঁকা দেখা যায়। খৃষ্ট-জন্মের পরে গ্রীকদেশে Esculapius এর দণ্ড জড়ানো সাপদ্বয় দেবতার মতোন সম্মানিত হত। কথিত আছে, ৪৬২ খৃষ্টাব্দে রোমনগরে মহামারি উপস্থিত হলে, গ্রীস থেকে একটা জীবিত সাপ সেখানে আনা হয়, এবং নগরের সমস্ত লোক ও রাজকীয় মহাসভার

সভাসদ একত্র হয়ে যথাবিধি সম্মান পূর্বক এর অভ্যর্থনা করেছিলেন। এই ঘটনার পর, একদিন রোম- নগরের কোন স্থানে একটা সাপ দেখা যায়; এই সাপটি আশ্চর্য অবস্থায় সেখানে অবস্থান করছিল, এটা দেখে রোম বাসী ঐ স্থানকে পুণ্যক্ষেত্র নির্দ্দিষ্ট করেছেন।

পদ্মপুরাণ এবং গরুড়পুরাণ এই উভয় পুরাণেই কালিয় নাগের বিবরণ আছে। কৃষ্ণ শৈশব অবস্থায় একে নিধন করেন। ভারতে বর্তমান সময়েও কালিয় নাগের পূজা হয়ে থাকে। শ্রাবণমাসের শুক্লপক্ষের পঞ্চমী তিথিতে “নাগপঞ্চমী” হয়ে থাকে। ভারতের উত্তরাংশে, মহারাষ্ট্রে এবং তৈলঙ্গে নাগ-পঞ্চমীর পরিবর্তে ‘নাগচৌতি’ উৎসব প্রচলিত। এই উৎসব শ্রাবণের শুক্লপক্ষের চতুর্থীতে হয় এ জন্যই এই নাম হয়েছে। নাগচৌতি ভারতের আরও অনেক স্থানে হয়। নাগ-পঞ্চমী পূজার দিন হিন্দুমহিলারা স্নান করে বহুমূল্য বসন- ভূষণে সেজে নাগপূজা করতে বহির্গত হয়। তারপর থেকে যেখানে নাগমূর্তি স্থাপিত আছে সেখানে, অথবা উয়ের ঢিপির নিকট দুধ, পীঠা, ফল, মূল, পান, সুপারি ইত্যাদি উপহার প্রদান করে থাকে এবং নানা প্রকার পুষ্পমালা, বিশেষতঃ সিমুলফুলের মালা অর্পণ করে থাকে। ঐ দিবসে পূজান্তে সকলে নাগরাজের কাছে নিজ নিজ অভীষ্ট বর প্রার্থনা করেন।

হিন্দুদের বিশ্বাস যে, নাগপূজা করলে কুষ্ঠ, চক্ষুউঠা, বন্ধ্যাদোষ প্রভৃতি রোগ ভাল হয়। এক ব্রাহ্মণ ঢোল্‌কা নগরে একটা পুরাতন বাড়ি কিনেছিল। ঐ পুরাণ বাড়িটি খনন করে সেখানে একটা নতুন বাড়ি নির্মাণ করার জন্য ঐ স্থানটি খুঁড়তে খুঁড়তে দেখলেন যে, মাটির মধ্যে বহুসংখ্যক স্বর্ণমুদ্রাবিশিষ্ট একটা কলসী জড়িয়ে এক প্রকাণ্ড অজগর রয়েছে। রাতে স্বপ্ন অবস্থায় ঐ সাপটি এসে তাকে বলল, “তুমি এই ভাঙা মন্দির নষ্ট করওনা। এই ধন- সম্পত্তি আমার এবং আমি এই সমস্ত রক্ষা করছি। যদি তুমি আমার কথা অমান্য করে, এর প্রতি লোভ কর, তবে আমি তোমাকে সবংশে নির্বংশ করব।” ভোরবেলা ব্রাহ্মণ ঘুম থেকে উঠে সাপের গায়ে উত্তপ্ত তেল ঢেলে দিলেন এবং ভাঙা মন্দির গুড়িয়ে মহানন্দে ধনরত্ন নিয়ে ঘরে আসলেন। কিন্তু ঐ ব্রাহ্মণের পুত্র সস্তান হল না এবং তার কন্যারও সস্তানসন্ততি কিছুই হয়নি। অধিক কি যারা ঐ ধনের অতি সামান্ত অংশ গ্রহণ করেছিল অথবা যারা তার কর্মচারী ও ভৃত্য হয়েছিল বা যারা তার কুলপুরোহিতের কাজ করেছিলেন, তারা সকলেই নিঃসস্তান হলেন। ১৮৩০ খৃষ্টাব্দে এই ঘটনা ঘটেছিল। মান্দ্রাজের কাছে ত্রিবেতুর, পেরাম্বর, বাসর পাড়ী এবং পশ্চিম ঘাটে কয়েকটা নাগমন্দির আছে। অনেক হিন্দুযাত্রী পশ্চিমঘাটে সুবর্ণমণির মন্দিরে গিয়ে থাকেন এবং সেখান থেকে কিঞ্চিৎ মাটি এনে বন্ধ্যা ন্ত্রীলোকদেরকে তিলকধারণ করার জন্য ও কুষ্ঠ রোগীকে শরীরে লেপন করেন।

ফারগুসান লিখেছেন যে, বৃক্ষপূজা ও নাগপূজা সমস্ত মানুষের আদিধর্ম। যেখানেই নরবলি দেওয়া হত, সেখানেই নাগপুজা ছিল। মেক্সিকো ও দাহোমি নামক দেশে নাগপূজা সর্ব সাধারণের প্রিয় ধর্ম ছিল। দাহোমি নাগপূজার একটা প্রধান স্থান। এখানে আজ পর্যন্ত নাগপুজা মহা সমারোহের সাথে সুসম্পন্ন হয়ে থাকে। 

১৮৭২ খৃঃ মাদ্রাজ নগরে অসাধারণ ধীসম্পন্ন এক ব্রাহ্মণের এক কন্যা সন্তান জন্মগ্রহণ করেন। গর্ভধারণকালে এক সাপ দেখেছিলেন এজন্য ঐ কন্যার নাম “নাগম্মা” রাখা হয়। এসব দেখে স্পষ্ট প্রতীত হয় যে, ভারতবর্ষে নাগপূজার প্রভাব বিশেষভাবেই ছিল।

এছাড়া বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মগ্রন্থেও নাগপুজার উল্লেখ দেখা যায়।

নিবেদনে- কৃষ্ণকমল

মনসা পূজার তাৎপর্য্য


 

চৈতন্যদেবের সময় বাংলাদেশে মাটির প্রতিমা গড়ে ঘটা করে মনসা পূজা হতো। মনসা পূজা দুভাবে হয়ে থাকে- কোনও কোনও পূজায় পাঠা বলি দিয়ে হয়। আবার পাঁঠাবলি ছাড়াও পূজা হয়। আইনি জটিলতার কারণে এখন আর বলি প্রথার চল বিশেষ নেই।
মনসা পূজার প্রতিমাতেও পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। কেউ কেউ মনসা প্রতিমা বানিয়ে পূজা করে থাকে। আবার কেউ কেউ পঞ্চ সর্পের ফণা যুক্ত প্রতিমার পূজা করে। গোত্র ও অঞ্চল ভেদে প্রথার ওপর ভিত্তি করে মনসা দেবী বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন রূপে তার ভক্তদের দ্বারা পূজিত হয়ে থাকেন।
‘মনস’ শব্দের উত্তর স্ত্রীলিঙ্গের আপ প্রত্যয় করে ‘মনসা’ শব্দের উৎপত্তি। ব্যুৎপত্তিগত অর্থে মনসা মনের অধিষ্ঠাত্রী দেবতা। দেবী ভাগবত ও ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ মতে সর্পভয় থেকে মনুষ্যগণকে পরিত্রাণের জন্য ব্রহ্মা কশ্যপ মুনিকে মন্ত্র বা বিদ্যা বিশেষ আবিষ্কারের জন্য আদেশ করেন। ব্রহ্মার আদেশে কশ্যপ যখন মনে মনে এ বিষয়ে চিন্তা করছিলেন তখন তাঁর মনন ক্রিয়ার সাকার রূপ পরিগ্রহ করে এক মহাদেবী দীপ্যমান হন। তিনটি কারণে এই মহাদেবীর নাম হয় মনসা। প্রথমত তিনি কশ্যপ মুনির মানস কন্যা, দ্বিতীয়ত মনুষ্যগণের মনই তাঁর ক্রীড়া ক্ষেত্র, তৃতীয়ত তিনি নিজেও মনে মনে বা যোগবলে পরমাত্মার ধ্যান করেন। মনসার দ্বাদশটি নাম আছে। জরৎকারু, জগদ্গৌরি, মনসা, সিদ্ধ যোগিনী, বৈষ্ণবী,নাগ ভগিনী, শৈবী, নাগেশ্বরী, জরৎকারু-প্রিয়া, আস্তিক-মাতা, বিষহরী, মহাজ্ঞানযুতা।

মনসা শব্দটির বিশ্লেষণ করলে অর্থ দাঁড়ায় মনে চিন্তন। কিন্তু দেবী রূপে মনসা কি চিন্তনের কোন বিষয়? মনের মধ্যে বিষ থাকতে পারে, সেই বিষ অবশ্যই মনকে বিষাক্ত করে এবং চিন্তার খোরাক যোগায়, মনন কে সুখশ্রাবী করার জন্য মন্ত্রের উদ্ভব। মন্ত্রই মনকে ঊর্ধ্বগামী করে। সেই মন যদি বিষক্রিয়ায় জর্জরিত হয় তবে তো সমগ্র দেহই বিষাক্ত হয়ে যাবে। তাই মনসার উৎপত্তি যেমন আর্যঋষি গণ দেখিয়েছেন বিষহরী দেবীরুপে সেরূপ বিষহরণ করে মনকে বিষযুক্ত করারও ব্যবস্থা তার হাতে। সাপের দাঁতে বিষ আছে কিন্তু নিজে যখন খায় তাতে বিষ লাগে না। কিন্তু হিংসায় বা আত্মরক্ষায় যখন দংশন করে তখন দংশিত স্থানে বিষ ছড়ায়। তাই মনে বিষ হলো হিংসা ক্রোধ, লোভ এগুলো দূর করার দেবী মনসা। চিন্তা থেকে আমাদের মুক্তি নেই তবু চিন্তা যাতে যুক্ত হতে পারে, চিন্তা যাতে রিপুর বশ না হয় তার চেষ্টাই আমাদের করতে হবে-এই শিক্ষাই দিয়েছেন দেবী মনসা।

দেবীর বাহন
সরস্বতীর মতো দেবী মনসার বাহন হংস। বাহনকে দেখেই আমরা সিদ্ধান্ত নিতে পারি যে মনসাও জ্ঞানযুতা, জ্ঞানলক্ষণা। দেবী মনসার জ্ঞানশক্তি মনোময়। শুদ্ধযোগ ও আধ্যত্ম জ্ঞানের সাধন সিদ্ধি দেবী মনসার দান।