বৈদিক ধর্মের ক্রমবিকাশ
বৈদিক ধর্মের বিভিন্ন অঙ্গসমূহের সংক্ষিপ্ত বিবরণ তুলে ধরা হয়েছে। ওগুলির ক্রম-বিকাশের ঐতিহাসিক পৌর্বাপর্যের জ্ঞান না থাকলে শাস্ত্রবিশেষের প্রকৃত তাৎপর্য-বিচার যথাযর্থভাবে করা যায় না। গীতার অর্থ-বিচারে যা বিশেষ প্রয়োজনীয়, কেননা দেখা যায় অনেক সাম্প্রদায়িক টীকাকার পরবর্তী সময়ে শাস্ত্রসমূহের সাহায্যে প্রাচীন গীতা থেকে অনেক অদ্ভুত তত্ত্ব নিষ্কাশন করে থাকেন। এই হেতু বৈদিক যুগ থেকে বর্তমানকাল পর্যন্ত সনাতন ধর্মের বিভিন্ন শাখাগুলির উৎপত্তিকাল ঐতিহাসিক-পরম্পরা অনুসারে নিম্নে তুলে ধরা হল।
খ্রীষ্টপূর্বাব্দ(BC)/খ্রীষ্টাব্দ(AD) | শাস্ত্র |
---|---|
4500 BC | ঋগবেদ |
2500 BC | অন্যান্য বেদ – ব্রাহ্মণগ্রন্থ; বৈদিক কর্মমার্গ – বেদবাদ। |
1600 BC | প্রাচীন উপনিষৎ; ব্রহ্মবাদ – জ্ঞানমার্গ। |
1400 BC | সাংখ্য, যোগ, ন্যায়; জ্ঞান-কর্ম-সমুচ্চয়মার্গ; সূত্র-গ্রন্থাদি। ভক্তিমার্গ ও ভাগবত-ধর্মের আবির্ভাব। গীতোক্ত ধর্মের প্রচার। |
900 BC | মহাভারত ও গীতার রচনাকাল |
500 BC | বৌদ্ধধর্মের প্রচার – ধর্মবিপ্লব। |
200 AD | শাণ্ডিল্য-সূত্রাদিতে ভক্তির ব্যাখ্যা। পৌরাণিক যুগ আরম্ভ – ব্রহ্মপুরাণ, বিষ্ণুপুরাণ, হরিবংশ প্রভৃতি গ্রন্থে শ্রীকৃষ্ণলীলাবর্ণন। শ্রীমদ্ভাগবতে শ্রীকৃষ্ণলীলা ও ভাগবত-ধর্মের বিস্তৃত বর্ণনা। নারদসূত্র, দেবী-ভাগবত প্রভৃতি শাক্ত পুরাণ। |
800 AD | শঙ্করাচার্যের আবির্ভাব, বৈদিক ধর্মের পুনঃপ্রতিষ্ঠা, অদ্বৈত মায়াবাদ ও সন্ন্যাসবাদ প্রচার এবং সে অনুযায়ী বেদান্ত ও গীতার ব্যাখ্যা। |
1000 AD | রামানুজাচার্য কর্তৃক মায়াবাদের প্রতিবাদ, বাসুদেব-ভক্তি ও বিশিষ্টাদ্বৈত মত প্রচার এবং সে অনুযায়ী গীতার ব্যাখ্যা। |
1000-1200 AD | নিম্বার্ক, মধ্বাচার্য প্রমুখ কর্তৃক মায়াবাদের প্রতিবাদ ও ভক্তিবাদ প্রচার। |
1500-1600 AD | শ্রীচৈতন্যদেবের আবির্ভাব ও ভক্তিমার্গ প্রচার। গৌড়ীয় গোস্বামিপাদগণ কর্তৃক বৈষ্ণবশাস্ত্র প্রণয়ন ও প্রচার। গীতার ভক্তিপর ব্যাখ্যা। |
1800 AD | শাক্ত ও ভক্তের বাদ-বিসংবাদ |
1900 AD | পরমহংসদেবের আবির্ভাব; সমন্বয়বাদ প্রচার। আধুনিক যুগে গীতার অসাম্প্রদায়িক ব্যাখ্যা। |
উপরে মোটামুটিভাবে বিভিন্ন শাস্ত্রের ঐতিহাসিক কাল-পরম্পরা নির্দেশ করা হল। এ-বিষয়ে নানারকম মতভেদ আছে। আমরা অনেকস্থানে লোকমান্য তিলকের মতের অনুসরণ করেছি; অনেক পাশ্চাত্য প্রত্নতত্ত্বজ্ঞ পণ্ডিতও যুক্তিমত্তা স্বীকার করেছেন। প্রাচীনকালে কোনো ধর্মমত যখন প্রচারিত হত, তখনই সেটি বই আকারে লিপিবদ্ধ হত না, সুতরাং গীতা বা মীমাংসা দর্শনশাস্ত্র রচনা হওয়ার আগেই ঐ সকল ধর্মমত প্রচলিত ছিল, বুঝতে হবে। মহাভারত ও পুরাণাদি-শাস্ত্রের প্রকৃত সময় নির্দেশ একরকম দুঃসাধ্য; কারণ আমরা ঐ সকল গ্রন্থ যে আকারে পেয়েছি তা তাঁদের মূলস্বরূপ নয়। দৃষ্টান্ত – মহাভারতের নারায়ণীয় পর্ব-অধ্যায়ে দশাবতারের বর্ণনায় বুদ্ধদেবের উল্লেখ নেই, অথচ ভাগবতে বুদ্ধাবতার, জৈনধর্ম ও দ্রাবিড়দেশীয় বৈষ্ণব-ধর্মাদিরও কথা আছে। সুতরাং বর্তমান ভাগবত অপেক্ষাকৃত পরবর্তী কালে সঙ্কলিত হয়েছে এবং এতে অনেক নূতন বিষয় সংযোজিত হয়েছে, এটাই অনুমান করতে হয়। সর্বশাস্ত্রেই এরকম প্রাচীন-অর্বাচীনের সংমিশ্রণ দেখা যায়। পৌরাণিক গ্রন্থের আলোচনা দুইভাবে হতে পারে – (i) ঐতিহাসিক দৃষ্টিতে; (ii) ভক্ত ও ভাবুকের দৃষ্টিতে। ঐতিহাসিক আলোচনা ভাবুক ভক্তের কাছে বিরক্তিকর এবং তাতে তাঁর কোনো প্রয়োজনও নেই। যিনি অকৃত্রিম ভক্তি-বলে অপ্রাকৃত নিত্যলীলায় আস্থাবান, তাঁর কাছে ঐতিহাসিক তত্ত্বের মূল্য কি ? কিন্তু সেরকম ভাগ্যবান সুদুর্লভ। আমাদের পুস্তক-প্রকাশও সর্বসাধারণের জন্য, সুতরাং ভক্তিশাস্ত্রের আলোচনায়ও ঐতিহাসিক-দৃষ্টি একেবারে বর্জন করা চলে না।
You must be logged in to post a comment.