4) বৈদিক ধর্মের ক্রমবিকাশের পৌর্বাপর্য-নির্ণয়


বৈদিক ধর্মের ক্রমবিকাশ

বৈদিক ধর্মের বিভিন্ন অঙ্গসমূহের সংক্ষিপ্ত বিবরণ তুলে ধরা হয়েছে। ওগুলির ক্রম-বিকাশের ঐতিহাসিক পৌর্বাপর্যের জ্ঞান না থাকলে শাস্ত্রবিশেষের প্রকৃত তাৎপর্য-বিচার যথাযর্থভাবে করা যায় না। গীতার অর্থ-বিচারে যা বিশেষ প্রয়োজনীয়, কেননা দেখা যায় অনেক সাম্প্রদায়িক টীকাকার পরবর্তী সময়ে শাস্ত্রসমূহের সাহায্যে প্রাচীন গীতা থেকে অনেক অদ্ভুত তত্ত্ব নিষ্কাশন করে থাকেন। এই হেতু বৈদিক যুগ থেকে বর্তমানকাল পর্যন্ত সনাতন ধর্মের বিভিন্ন শাখাগুলির উৎপত্তিকাল ঐতিহাসিক-পরম্পরা অনুসারে নিম্নে তুলে ধরা হল।

উপরে মোটামুটিভাবে বিভিন্ন শাস্ত্রের ঐতিহাসিক কাল-পরম্পরা নির্দেশ করা হল। এ-বিষয়ে নানারকম মতভেদ আছে। আমরা অনেকস্থানে লোকমান্য তিলকের মতের অনুসরণ করেছি; অনেক পাশ্চাত্য প্রত্নতত্ত্বজ্ঞ পণ্ডিতও যুক্তিমত্তা স্বীকার করেছেন। প্রাচীনকালে কোনো ধর্মমত যখন প্রচারিত হত, তখনই সেটি বই আকারে লিপিবদ্ধ হত না, সুতরাং গীতা বা মীমাংসা দর্শনশাস্ত্র রচনা হওয়ার আগেই ঐ সকল ধর্মমত প্রচলিত ছিল, বুঝতে হবে। মহাভারত ও পুরাণাদি-শাস্ত্রের প্রকৃত সময় নির্দেশ একরকম দুঃসাধ্য; কারণ আমরা ঐ সকল গ্রন্থ যে আকারে পেয়েছি তা তাঁদের মূলস্বরূপ নয়। দৃষ্টান্ত – মহাভারতের নারায়ণীয় পর্ব-অধ্যায়ে দশাবতারের বর্ণনায় বুদ্ধদেবের উল্লেখ নেই, অথচ ভাগবতে বুদ্ধাবতার, জৈনধর্ম ও দ্রাবিড়দেশীয় বৈষ্ণব-ধর্মাদিরও কথা আছে। সুতরাং বর্তমান ভাগবত অপেক্ষাকৃত পরবর্তী কালে সঙ্কলিত হয়েছে এবং এতে অনেক নূতন বিষয় সংযোজিত হয়েছে, এটাই অনুমান করতে হয়। সর্বশাস্ত্রেই এরকম প্রাচীন-অর্বাচীনের সংমিশ্রণ দেখা যায়। পৌরাণিক গ্রন্থের আলোচনা দুইভাবে হতে পারে – (i) ঐতিহাসিক দৃষ্টিতে; (ii) ভক্ত ও ভাবুকের দৃষ্টিতে। ঐতিহাসিক আলোচনা ভাবুক ভক্তের কাছে বিরক্তিকর এবং তাতে তাঁর কোনো প্রয়োজনও নেই। যিনি অকৃত্রিম ভক্তি-বলে অপ্রাকৃত নিত্যলীলায় আস্থাবান, তাঁর কাছে ঐতিহাসিক তত্ত্বের মূল্য কি ? কিন্তু সেরকম ভাগ্যবান সুদুর্লভ। আমাদের পুস্তক-প্রকাশও সর্বসাধারণের জন্য, সুতরাং ভক্তিশাস্ত্রের আলোচনায়ও ঐতিহাসিক-দৃষ্টি একেবারে বর্জন করা চলে না।

3.6) প্রতীকোপসনা – ভক্তিমার্গ


ষড়দর্শন-সমূহের মধ্যে বেদান্ত ব্যতীত আর সকলই নিরীশ্বর বললেও চলে। বেদান্তের নির্গুণ ব্রহ্মবাদেও ভক্তির সমাবেশ হয়নি। যা নির্গুণ, নির্বিশেষ, নিষ্ক্রিয়, যাকে সৃষ্টিকর্তা, প্রভু বা ঈশ্বর কিছুই বলা চলে না – মানুষ তা ধারণা করতে পারে না এবং তার সাথে ভাব-ভক্তির কোনো সম্বন্ধ স্থাপন করতে পারে না। তা অচিন্ত্যস্বরূপ, নিজবোধরূপ। অথচ কোনো তত্ত্বে চিত্ত স্থির না করলে আত্মবোধও জন্মে না। একারণে নির্গুণ ব্রহ্মোপাসনায় মন স্থির করার জন্য প্রতীকোপাসনা অর্থাৎ যা ব্রহ্মা নয় তাকে ব্রহ্মরূপে ভাবনা করার ব্যবস্থা আছে। যেমন মনকে ব্রহ্মরূপে ভাবনা করবে, সূর্যকে ব্রহ্মরূপে ভাবনা করবে ইত্যাদি। এটি অবশ্য প্রকৃতপক্ষে উপাসনা নয়, সগুণ ব্রহ্ম ভিন্ন ভক্তিমূলক উপাসনা সম্ভপর নয়। কিন্তু ক্রমে রুদ্র, বিষ্ণু প্রভৃতি বৈদিক-দেবতারাও ব্রহ্মের প্রতীকরূপে কল্পিত হন এবং কোনো কোনো উপনিষদে রুদ্র, বিষ্ণু প্রভৃতি পরমাত্মা বা পরমেশ্বরেরই রূপ, এমনও স্পষ্টই উল্লেখ রয়েছে [মৈত্র|৭|৭; রাম পুঃ|১৬; অমৃতবিন্দু|২২]। কোথাও পরব্রহ্মের বর্ণনায় দেব, ঈশ্বর, মহেশ্বর, ভগবান প্রভৃতি শব্দও ব্যবহৃত হয়েছে এবং ‘যস্য দেবে পরা ভক্তিঃ’ [শেতঃ ৬|৩৩] ইত্যাদি বাক্যও আছে। এ-সকল অবশ্য সগুণ ব্রহ্মেরই বর্ণনা। অস্থূল-অনণু, অহ্রস্ব-অদীর্ঘ ইত্যাদি নির্গুণ স্বরূপের বর্ণনা [শঙ্কর]; সর্বকর্মা, সর্বকামঃ ইত্যাদি সগুণ স্বরূপের বর্ণনা [শাণ্ডিল্য]। ছান্দোগ্য-উপনিষদের শাণ্ডিল্য ঋষিই সগুণ উপাসনা বা ভক্তিমার্গের প্রবর্তক বলে পরিচিত [বেদান্তসার|৬]। স্থূলকথা, ভক্তিমার্গ বেদোপনিষদ থেকেই বহির্গত হয়েছে এবং পরে অবতারবাদ ও প্রতিমা-পূজার প্রবর্তন হলে সেটি নানা শাখা-প্রশাখায় বিভক্ত হয়ে পূর্ণ অবয়ব লাভ করেছে

পরবর্তিতে- ধর্মশাস্ত্র বা স্মৃতিশাস্ত্র

3.5) আত্মসংস্থ-যোগ বা সমাধি-যোগ


উপনিষৎ যখন স্থির করলেন যে, দেহমধ্যে অন্তর্যামিরূপে যিনি বিরাজমান তিনিই ব্রহ্মাণ্ডেরও মূল তত্ত্ব পরব্রহ্ম – যা পিণ্ডে, তাই ব্রহ্মাণ্ডে, তখনই উপদেশ হল, আত্মাকে দর্শন করবে, শ্রবণ করবে, মনন করবে, ধ্যান করবে। এরকম আত্মচিন্তায় ব্রহ্ম উপাসনার যে প্রণালী বলা হল সেটাই সমাধি-যোগের মূল। এভাবে উপনিষদের জ্ঞানমার্গ থেকেই যোগ-প্রণালীর উদ্ভব হয়েছে। এই প্রণালীই যম, নিয়ম, আসন, প্রাণায়াম আদি বহিরঙ্গ-সাধন-সংযুক্ত হয়ে ক্রম উন্নতি লাভ করে অষ্টাঙ্গযোগ নামে পরিচিত হয়েছে। যোগমার্গ অতি প্রাচীন। বল আছে, ব্রহ্মা সেটির আদি বক্তা। পতঞ্জলি মুনি উহা সুশৃঙ্খলাবদ্ধ করে পরবর্তী কালে যে যোগানুশাসন প্রবর্তিত করেছিলেন, ‘যোগ’ বলতে এখন তাই বুঝায়। এটাই রাজযোগ, পাতঞ্জল-যোগ, অষ্টাঙ্গ-যোগ, আত্মসংস্থ-যোগ ইত্যাদি নামে অভিহিত হয়। সমাধি বা ইষ্টবস্তুতে চিত্তসংযোগ সর্ববিধ সাধনারই সাধারণ উদ্দেশ্য। সুতরাং যোগ-প্রণালী কোনো-না-কোনো ভাবে সকল সম্প্রদায়ই গ্রহণ করেছেন।

পরবর্তীতে- প্রতীকোপসনা – ভক্তিমার্গ

3.4) কাপিল সাংখ্য – পুরুষ-প্রকৃতিবাদ


পুরুষ-প্রকৃতিবাদ

উপনিষদে অধ্যাত্মতত্ত্বের বিচার আরম্ভ হলে জীব, জগৎ ও ব্রহ্মতত্ত্ব সম্বন্ধে নানারকম মৌলিক গবেষণা চলতে থাকে এবং জ্ঞানমার্গেও মতভেদের সৃষ্টি হয়ে বিবিধ দর্শন-শাস্ত্রের উৎপত্তি হয়। তারমধ্যে কাপিল সাংখ্যমত বিশেষ উল্লেখযোগ্য। সাংখ্যমতে মূলতত্ত্ব একমাত্র ব্রহ্ম নন; মূলতত্ত্ব দুই – পুরুষ ও প্রকৃতি। প্রকৃতি ও পুরুষ উভয়েই অনাদি, নিত্য। প্রকৃতি জড়া, গুণময়ী, পরিণামিনী, প্রসবধর্মিণী অর্থাৎ স্বয়ং সৃষ্টিসমর্থা। পুরুষ চেতন, নির্গুণ, অপরিণামী, অকর্তা, উদাসীন, সাক্ষিমাত্র। পুরুষ-প্রকৃতির সংযোগেই সৃষ্টি, এই দুঃখময় সংসার। প্রকৃতি-পুরুষের পার্থক্য-জ্ঞানেই মুক্তি। আধুনিক কালের ডার্বিন (Darwin), স্পেন্সার, হেকেল প্রমুখ পাশ্চাত্য বৈজ্ঞানিকরা ব্যাখ্যা করা বিবর্তনবাদ (Evolution Theory) এবং সাংখ্যের প্রকৃতি-পরিণামবাদ প্রায় একরকম। উভয়েই ঈশ্বর-তত্ত্ব বাদ দিয়েই জগৎ-উৎপত্তির মীমাংসা করেছেন। উভয়েই বলেন, ঈশ্বরের প্রত্যক্ষ প্রমাণ নাই। যাহোক, নিরীশ্বর হলেও সাংখ্যশাস্ত্র সবার মান্য; পুরাণ, ইতিহাস, মন্বাদি-স্মৃতি ও ভাগবত-শাস্ত্র, সর্বত্রই সাংখ্যশাস্ত্রের আলোচনা আছে এবং ঐ সকল শাস্ত্রে অনেক সিদ্ধান্তও গৃহীত হয়েছে। গীতাও সাংখ্যের অনেক সিদ্ধান্তই অবিকল গ্রহণ করেছেন। তা যথাস্থানে আলোচিত হয়েছে।

পরবর্তীতে- আত্মসংস্থ-যোগ বা সমাধি-যোগ