দুর্গা- সনাতন ধর্মাশ্রয়ী বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব হচ্ছে মহিষমর্দিনী শ্রীশ্রী দুর্গাদেবীর পূজা। শরৎকালের দুর্গোৎসব শুধু উৎসব নয়, মহা-উৎসব। দুর্গোৎসব মানেই বাঙালির প্রাণের উৎসব। জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সকলেই এই আনন্দ আয়োজনে সামিল হয় বলে দুর্গা পূজার নামকরন সর্বজনীন শারদীয়া দুর্গোৎসব।
দেবী আদ্যাশক্তি পরমাপ্রকৃতির নানারূপের পরিচয় পাওয়া যায় নামনিরুক্তিতে, দেবীর নামান্তর সমুহ-
উমা, কাত্যায়নী, গৌরী, কালী, হৈমবতী, ঈশ্বরা, শিবা, ভবানী, রুদ্রাণী, শর্ব্বাণী, সর্ব্বমঙ্গলা, অর্পণা, পার্ব্বতী, মৃড়াণী, চণ্ডিকা, অম্বিকা, শারদা, চণ্ডী, চণ্ডীবতী, চণ্ডা, চণ্ডনায়িকা, গিরিজা, মঙ্গলা, নারায়ণী, মহামায়া, বৈষ্ণবী, মহেশ্বরী, মহাদেবী, হিণ্ডী, ঈশ্বরী, কোট্টরী, ষষ্ঠী, মাধবী, নগনন্দিনী, জয়ন্তী, ভার্গবী, রম্ভা, সিংহরথা, সতী, ভ্রামরী, দক্ষকন্যা, মহিষমর্দ্দিনী, হেরস্বজননী, সাবিত্রী, কৃষ্ণপিঙ্গলা, বৃষাকপারী, লম্বা, হিমশৈলজা, কার্ত্তিকেয়প্রসু, আদ্যা, নিত্যা, বিদ্যা, শুভঙ্করী, সাত্বিকী, রাজসী, তামসী, ভীমা, নন্দনন্দিনী, মহামায়া, শূলধারা, সুনন্দা, শুম্ভঘাতিনী, হ্রী, পর্ব্বতরাজতনয়া, হিমালয়সুতা, মহেশ্বরবনিতা, সত্যা, ভগবতী, ঈশানী, সনাতনী, মহাকালী, শিবানী, হরবল্লভা, উগ্রচণ্ডা, চামুণ্ডা, বিধাত্রী, আনন্দা, মহামাত্রা, মহামুদ্রা, মাকরী, ভৌমী, কল্যাণী, কৃষ্ণা, মানদাত্রী, মদালসা, মানিনী, চার্ব্বজী, বাণী, ঈশা, বলেশী, ভ্রুমরী, ভূষ্যা, ফাল্গুনী, যতী, ব্রহ্মময়ী, ভাবিনী, দেবী, অচিন্তা, ত্রিনেত্রা, ত্রিশূলা, চর্চ্চিকা, তীব্রা, নন্দিনী, নন্দা, ধরিত্রী, মাতৃকা, চিদানন্দস্বরূপিণী, মনস্বিনী, মহাদেবী, নিদ্রারূপা, ভবানিকা, তারা, নীলসরস্বতী, কালিকা, উগ্রতারা, কামেশ্বরী, সুন্দরী, ভৈরবী, রাজরাজেশ্বরী, ভূবনেশী, ত্বরিতা, মহালক্ষ্মী, রাজীবলোচনী, ধনদা, বাগীশ্বরী, ত্রিপুরা, জালামুখী, বগলামুখী, সিদ্ধবিদ্যা, অন্নপূর্ণা, বিশালাক্ষী, সুভগা, সগুণা, নির্গুণা, ধবলা, গীতি, গীতবাদ্যপ্রিয়া, অট্রালবাসিনী, অট্রাট্টম্বাসিনী, ঘোরা, প্রেমা, বটেশ্বরী, কীৰ্ত্তিদা, বুদ্ধিদা, অবীরা, পণ্ডিতালয়বাসিনী, মণ্ডিতা, সংবৎসরা, কৃষ্ণরূপা, বলিপ্রিয়া, তুমুলা, কামিনী, কামরূপা, পুণ্যদা, বিষ্ণুচক্রধরা, পঞ্চমা, বৃন্দাবনস্বরূপিণী, ‘অযোধ্যারূপিণী, মায়াবতী, জীমূতবসনা, জগন্নাথস্বরূপিণী, কৃত্তিবসনা, ত্রিষামা, যমলার্জ্জনী, যামিনী, যশোদা, যাদবী, জগতী, কৃষ্ণজায়, সত্যভামা, সুভদ্রিকা, লক্ষ্মণা, দিগম্বরী, পৃথুকা, তীক্ষ্ণা, আচারা, অক্রুরা, জাহ্নবী, গণ্ডকী, ধ্যেয়া, জৃম্ভণী, মোহনী, বিকারা, অক্ষরবাসিনী, অংশক্ষা, পত্রিকা, পবিত্রকা, তুলসী, অতুলা, জানকী, বন্ধ্যা, কামনা, নারসিংহী, গিরীশা, সাধ্বী, কল্যাণী, কমলা, কান্তা, শান্তা, কুলা, বেদমাতা, কৰ্ম্মদা, সন্ধ্যা, ত্রিপুরসুন্দরী, রাসেশী, দক্ষযজ্ঞবিনাশিনী, অনন্তা, ধৰ্ম্মেশ্বরী, চক্রেশ্বরী, খঞ্জনা, বিদগ্ধা, কুঞ্জিকা, চিত্রা, সুলেখা, চতুর্ভুজা, রাকা, প্রজ্ঞা, ঋদ্ধিদা, তাপিনী, তপা, সুমন্ত্রা, দুতী ইত্যাদি।
দেবীর দুর্গা আদি নাম হওয়ায় কারণ দেবী পুরাণে এভাবে উল্লেখ করা আছে-
স্মরণাদভয়ে দুর্গে তারিতা রিপুসঙ্কটে।
দেবাঃ শত্রাদয়ো যস্মাত্তেন দুর্গা প্রক্ষীর্ত্তিতা।। ৩৭ অঃ।
স্মরণমাত্রই ইদ্র আদি দেবগণকে দুর্গম শত্রুসঙ্কট থেকে উদ্ধার করেছিলেন বলে তার নাম দুর্গা।
মার্কেণ্ডেয়পুরাণোক্ত দেবীমাহাত্ম্যের মতে-
তত্রৈব চ বধিষ্যামি দুর্গমাখ্যং মহাসুরম্।
দুর্গাদেবীতি বিখ্যাতং তন্মে নাম ভবিষ্যতি।।
আমি দুর্গা নামক মহাসুরকে বিনাশ করব, সেজন্য দুর্গাদেবী নামে আমার নাম বিখ্যাত হবে।
কাশীখণ্ডে(৭২অঃ) উল্লেখিত-
অদ্য প্রভৃতি মে নাম দূর্গেতি খ্যাতিমেষ্যতি।
দুর্গ দৈত্যস্য সমরে পাতনাৎ ঘোরদুর্গমাৎ।।
ব্রহ্মবৈবর্ত্তপুরানের প্রকৃতিখণ্ডের মতে-
দুর্গে দৈত্যে মহাবিঘ্নে ভববন্ধে চ কুকর্মনি৷
শোকে দুঃখে চ নরকে যমদণ্ডে চ জন্মনি৷৷
মহাভয়ে অতিরোগে চাপ্যাশব্দো হন্তৃবাচকঃ৷
এতান য হন্তেব যা দেবী সা দুর্গা পরি কীর্তিতা ৷৷
দুর্গ নামক দৈত্য মহাবিঘ্ন, সংসারবন্ধন, কর্ম, শোক, দুঃখ, নরক, যমদণ্ড, জন্ম, মহাভয়, অতিভয় এবং হন্তাকেও যে দেবী হনন করে থাকেন, তিনিই দুর্গা নামে খ্যাত। (প্রকৃতিখণ্ড ৫৭ অঃ)
অপরাপর সামনিরুক্তি সম্বন্ধে দেবীপুরাণে এরূপ পাওয়া যায়-
সর্ব্বাণি হৃদয়স্থানি মঙ্গলানি শুতানি চ।
দদাতি ইস্পিতাল্লোকে তেন সা সর্ব্বমঙ্গলা।।
দেবী সকলের হৃদয়ে থাকলে মঙ্গল শুভ ও অভিলষিত ফল দান করেন, এইজন্য লোকে তাঁর নাম সর্বমঙ্গলা।
শোভনানি চ শ্রেষ্ঠানি যা দেবী দদতে হরে।
ভক্তানামার্ত্তিহরণী মঙ্গল্যা তেন সা স্মৃতা।।
তিনি ভক্ত সকলকে শোভন অথবা শ্রেষ্ঠ ফল দান করেন এবং ভক্তদের দুঃখ নিবারণ করেন বলে তাঁর নাম মঙ্গল্যা।
শিবা মুক্তিঃ সমাখ্যাতা যোগিনাং মোক্ষগামিনী।
শিবায় যো জপেদ্দেবী শিবা লোকে ততঃ স্মৃতা।।
শিব শব্দের অর্থ মুক্তি, দেবী যোগিদের মোক্ষদায়িকা। শিবফলের নিমিত্ত দেবীর আরাধনা করে হয় বলেই তাঁর নাম শিবা।
সোমসূর্য্যানিলস্ত্রীণী যস্যা নেত্রাণী ভার্গব।
তেন সা ত্র্যম্বকা দেবী মুনিভিঃ পরিকীর্ত্তিতা।।
চন্দ্র, সূর্য ও বায়ু এনারা দেবীর ত্রিনেত্র স্বরূপ, এইজন্য মুনিগণ তাঁকে ত্র্যম্বকা বলে থাকেন।
যোগাগ্নিনা তু যা দদ্ধা পুনর্জাতা হিমালয়ে।
পূর্ণসূর্য্যেন্দুবর্ণাভা অতো গৌরীতি সা স্মৃতা।।
-যোগানলে যিনি নিজের তনুদগ্ধ করে হিমালয়ে পূর্ণসূর্য্যন্দু সদৃশ রূপ ধারণ করেছিলেন, তিনিই গৌরী।
কং ব্রহ্মা কং শিবঃ প্রোক্তমশ্মসারঞ্চ কং মতম্।
ধারণাদ্বসনাদ্বাপি কাত্যায়নী মতা বুধৈঃ।।
ক শব্দে ব্রহ্মা, ক শব্দে শিব ও ক শব্দে অশ্মসার(পাষাণ) বুঝায়। ব্রহ্মা ও শিব তাঁকে ধারণ করে আছেন এবং পাষাণ তাঁর বসন বলে তাঁর নাম কাত্যায়নী।
দেবীর স্বরূপ ব্রহ্মবৈবর্ত্তপুরাণের মতে-
আত্মা নারায়ণী শক্তিঃ সৃষ্টিস্থিত্যন্তকারিণী।
করোমি চ যয়া সৃষ্টিং যয়া ব্রহ্মাদি দেবতা।।
যয়া জয়তি বিশ্বঞ্চ যয়া সৃষ্টিঃ প্রজায়তে।
যয়া বিনা জগন্নাস্তি ময়া দত্তা শিবায় সা।।
দয়া নিদ্রা চ ক্ষুত্তৃপ্তিস্তৃষ্ণা শ্রদ্ধা ক্ষমা ধৃতিঃ।
তুষ্টিস্তথা শান্তিলর্জ্জাধিদেবতা হি সা ॥
বৈকুণ্ঠে সা মহাসাধ্বী গোলোকে রাধিকা সতী।
মৰ্ত্ত্যে লক্ষ্মীশ্চ ক্ষীরোদে দক্ষকন্যা সতী চ সা ॥
সা দুর্গা মেনকাকন্যা দৈন্যদুৰ্গতিনাশিনী।
স্বৰ্গলক্ষ্মীশ্চ দুর্গা সা শক্ৰাদীনাং গৃহে গৃহে ॥
সা বাণী স চ সাবিত্ৰী বিদ্যাধিষ্ঠাতৃদেবতা।
বহ্নৌ সা দাহিকা শক্তিঃ প্রভাশক্তিশ্চ ভাস্করে ॥
শোভা শক্তি পূর্ণচন্দ্রে জলে শক্তিশ্চ শীতলা।
শস্যপ্রসুতিশক্তিশ্চ ধারণা চ ধরাসু সা ॥
ব্ৰাহ্মণ্যশক্তি বিপ্রেষু দেবশক্তিঃ সুরেষু সা।
তপস্বিনাং তপস্যা সা গৃহিণাং গৃহদেবতা ॥
মুক্তিশক্তিশ্চ মুক্তানাং মায়া সাংসারিকস্য সা।
মদ্ভক্তানাং ভক্তিশক্তিঃ ময়ি ভক্তিপ্রদা সদা ॥
নৃপাণাং রাজ্যলক্ষ্মীশ্চ বণিজাং লভ্যরূপিণী।
পারে সংসারসিদ্ধ নাং ত্রয়ী দুস্তরতারিণী ॥
সৎসু সদ্বুদ্ধিরূপা চ মেধাশক্তিস্বরূপিণী।
ব্যাখ্যাশক্তিশ্রুতৌ শাস্ত্রে দাতৃশক্তিশ্চ দাতৃষু ॥
ক্ষত্রাদীনাং বিপ্রভক্তিঃ পতিভক্তিঃ সতীষু চ।
এবংরূপা চ যা শক্তির্ময়া দত্তা শিবায় সা ॥
-সৃষ্টি, স্থিতি ও লয়কারিণী আদ্যা নারায়ণী শক্তি। যে শক্তির সাহায্যে আমি ব্রহ্মা আদি দেবতা সৃষ্টি করেছি। যার দ্বারা বিশ্ব জয়যুক্ত হয়েছে, যার দ্বারা সৃষ্টি প্রক্রিয়া চলছে, যে শক্তিবিনা জগৎ থাকে না, সেই শক্তিই আমি শিবকে দিয়েছি; দয়া, নিদ্রা, ক্ষুধা, তৃপ্তি, তৃষ্ণা, শ্রদ্ধা, ক্ষমা, ধৃতি, তুষ্টি, পুষ্টি, শান্তি ও লজ্জার অধিদেবতা সেই শক্তি। তিনিই বৈকুণ্ঠে গোলোক ধামে ও মর্তে মহাসাধ্বী রাধিকা সতী, তিনিই ক্ষীরোদসমুদ্রে লক্ষ্মী, তিনিই দক্ষকন্যা সতী, তিনিই দৈন্যদুর্গতিনাশিনী, মনকার কন্যা দুর্গা, তিনিই বাণী, বিপ্রদের অধিষ্ঠাত্রী দেবী সাবিত্রী, তিনিই অগ্নির দাহিকাশক্তি, সূর্যের প্রভাশক্তি, পূর্ণচন্দ্রের শোভাশক্তি, জলের শীতলা শক্তি, ধরায় ধারণা ও শস্যপ্রসুতি শক্তি, তিনিই ব্রহ্মদের ব্রাহ্মণশক্তি, দেবগণের দেবশক্তি, তিনি তপস্বিদের তপস্যা, গৃহিদের গৃহদেবতা, মুক্তদের মুক্তি ও সাংসারিকদের মায়াশক্তি, ভক্তদের ভক্তিশক্তি, তিনি সর্বদা ভক্তিমতী, তিনিই রাজার রাজ্যলক্ষ্মী, বণীকের লভ্যরূপিণী, সংসারসাগর পার করতে তিনিই দুস্তরতরিণী ত্রয়ী, সজ্জনদের তিনিই বুদ্ধি ও মেধাশক্তিস্বরূপা, শ্রুতিশাস্ত্রের ব্যাখ্যাশক্তি, দাতার দানশক্তি, ক্ষত্রিয়দের বিপ্রভক্তি, সতীর পতিভক্তি, এরকম যে শক্তি তাঁকেই আমি মহাদেবকে দান করেছি।
দেবীর পরিচয়-
সর্বপ্রথম বাজসনেয়সংহিতায় (শুক্ল যজুৰ্ব্বেদ ৩/৫৭) অম্বিকার উল্লেখ পাওয়া যায়-
এষ তে রুদ্র ভাগঃ সহ স্বস্রাম্বিকয়া তং জুষস্ব স্বাহা।
হে রুদ্র! তোমার ভগিনী অম্বিকার সাথে আমাদের প্রদত্ত এই যজ্ঞের ঘি অনুগ্রহ করে গ্রহণ করে। (তৈত্তরীয় ব্রাহ্মণ ১/৬/১০/৪)
এখানে ভাষ্যকার মহীধর এভাবে লিখেছেন—
অম্বিকার রুদ্রভগিনীত্ব শ্রুতিতেই উল্লেখ আছে যে, অম্বিকা তাঁরই ভগিনীর নাম, তাঁর সাথে তাঁরও যজ্ঞ ভাগ আছে। এই রুদ্র নামক ক্রুরদেবতা তাঁর বিরোধীদের হনন ইচ্ছা করে থাকেন। তেমনি সাধনভূতা ক্রুরদেবী তাঁর ভগিনীর সাথে বিরোধীকে হনন করেন। সেই অম্বিকা শরৎ-রূপ গ্রহণ করে জরাদি উৎপাদন করে তাঁর বিরোধিকে বিনাশ করেন। রুদ্রও অম্বিকার উগ্রত্ব হবি দিয়ে প্রশমিত হোক। তিত্তিরিয়(কাঠক) শ্রুতিতে আছে, হে রুদ্র! এই তোমার ভাগ, ভগিনী অম্বিকার সাথে গ্রহণ কর। এই অম্বিকাই শরৎ রূপ ধারণ করে এদের হনন করেন, তোমার সাথে(আবার) শান্ত করেন।
এই প্রমাণ থেকে জানা যায় যে, দেবী অম্বিকা প্রথমে রুদ্রের ভগিনী রূপেই গণ্য ছিলেন। তারপরে তলবকার উপনিষদে উমা হৈমবতীর উৎপত্তি সম্বন্ধে এরকম বিবরণ পাওয়া যায়।-
এক সময় ব্ৰহ্ম দেবগণের জন্য যুদ্ধে জয় লাভ করেন। কিন্তু এই জয়লাভ তাঁদের নিজ বল দিয়ে সংঘটিত, এরকম সকলে মনে করতে লাগলেন। ব্রহ্ম তাঁদের ভ্রম ভাঙ্গানোর জন্য দেখা দিলেন। কিন্তু দেবতারা তাঁকে চিনতে পারলেন না। তাঁরা প্রথমে অগ্নি, তারপরে বায়ুকে তাঁর স্বরূপ জানার জন্য পাঠালেন। ব্রহ্ম তাঁদের পরিচয় জিজ্ঞাসা করলেন। অগ্নি বললেন, আমি সকলই পুড়িয়ে দিতে পারি। বায়ু বললেন, আমি সকলই উড়িয়ে দিতে পারি। তখন ব্রহ্ম তাঁদেরকে একগাছি তৃণ দিলেন। দেবতারা সেই তৃণের কিছুই করতে পারলেন না। তখন দেবতারা ইন্দ্রকে বললেন, মঘবন্! যান গিয়ে দেখে আসুন ভক্তির জিনিসটি কি? তিনি বললেন, তাই হোক এবং যেমন অভিমুখী হলেন, অমনি অদৃশ্য হয়ে গেলেন। সেই ব্রহ্ম বহু শোভমানা উমা হৈমবতী স্ত্রীমূর্তিতে আকাশে আগমন করলেন। তাঁকে ইন্দ্র জিজ্ঞাসা করলেন, এই ভক্তির পাত্র কি? সেই (স্ত্রীরূপা) বললেন, এই ব্ৰহ্ম। এই ব্রহ্মের বিজয় প্রভাবেই তোমরা মহত্ত্বলাভ করেছ। তখন থেকে তিনি ব্রহ্মকে জানলেন।
কেনোপনিষদের বিবরণ অনুসারে জানা যায় যে উমা হৈমবতীই ব্রহ্মবিদ্যা। তৈত্তিরীয় আরণ্যকের ভাষ্যে সায়ণাচার্যও এরকম লিখেছেন –
হিমবানের কন্যা গৌরীর ব্রহ্মবিদ্যা অভিমানী রূপ থাকায় গৌরীবাচক উমা শব্দ দ্বারা ব্রহ্মবিদ্যাই উপলক্ষ করেছেন। এই হেতু তলবকার উপনিষদে ব্রহ্মবিদ্যার মূর্তি বর্ণিত হয়েছে। সেই বহুশোভমানা উমা হৈমবতী তাঁকে বললেন, এভাবে উমার সাথে বর্তমান থাকায় সোম নাম হয়েছে।
আবার ঐ আরণ্যকের ৩৮ অনুবাকের সায়ণভাষ্যে এভাবে লেখা আছে-
উমা ব্রহ্মবিদ্যা তয়া সহ বর্ত্তমান সোম পরমাত্মন।
হে পরমাত্মন্ সোম! উমা ব্রহ্মবিদ্যা, তোমার সাথে বর্তমান। ঐ আরণ্যকের ১৮ অনুবাকে অম্বিকাপতয়ে শব্দ আছে, এখানেও ভাষ্যে ‘অম্বিকা জগন্মাতা পার্ব্বতী তস্যা ভর্ত্তে’ এরকম ব্যাখ্যা আছে।
কৈবল্যোপনিষদে ব্রহ্মবিদ্যাবিষয়ক প্রস্তাবে এরূপ বর্ণিত আছে-
উমাসহায়ং পরমেশ্বরং প্রভুং
ত্ৰিলোচনং নীলকণ্ঠং প্রশান্তং।
তৈত্তিরীয় আরণ্যকের নবম অনুবাকে দুর্গা সম্বন্ধে স্পষ্ট আভাস পাওয়া যায়। যথা-
কাত্যায়নায় বিদ্মহে কন্যাকুমারিং ধীমহি তন্নোদুৰ্গি প্রচোদয়াৎ।
সায়নাচার্য্যের মত এটাই বেদোক্ত দুর্গাগায়ত্রী। তিনি এর ভাষ্যে লিখেছেন-
সুবর্ণসদৃশ মস্তকে অৰ্দ্ধ চন্দ্রভূষিতা ইত্যাদি আগম প্রসিদ্ধ মূর্তিধারিণী দুর্গার প্রার্থনা করছি। কৃতি আচ্ছাদন করেন বলে রুদ্রের অপর নাম কাত্য, তিনি যার অধিষ্ঠান সেই কাত্যায়নী। অথবা কত নামক ঋষিবিশেষের অপত্য বলেই কাত্য নাম হয়েছে। কুৎসিত অনিষ্ট মারেন অর্থাৎ বিনাশ করেন বলে তাঁর নাম কন্যাকুমারী হয়েছে। দুর্গিই দুর্গা, এরকম লিঙ্গাদিব্যত্যয় বেদের সর্বত্রই দেখা যায়।
নারায়ণোপনিষদে দুর্গাগায়ত্রী এরকম আছে—
“কাত্যায়নায়ৈ বিদ্মহে কন্যাকুমারিং ধীমহি, তন্নো দুর্গা প্রচোদয়াৎ।”
ঋগ্বেদ পরিশিষ্টের রাত্রিপরিশিষ্টে দুর্গা সম্বন্ধে এই পাওয়া যায়-
স্তোষ্যামি প্রষতো দেবীং শরণ্যাং বহ্বৃচপ্রিয়াম্।
সহস্রসম্মিতাং দুর্গাং জাতবেদসে সুনবাম সোমম্।।
মহীধর বাজসনেয়সংহিতার ভায্যে ( ৬৬৩৯ ) এবং ভট্টতাঙ্কয়মিশ্র },
শান্ত্যর্থং দ্বিজাতিনামৃষিভিঃ সোমপাশ্রিতাঃ।
ঋগ্বেদে ত্বম্ সমুৎপন্নাহরাতি যতো নিদধাতি বেদঃ ॥ ৬
যে ত্বাম্ দেবি প্রপদ্যন্তে ব্রাহ্মণাঃ হব্যবাহনীম্।
অবিদ্যা বহুবিদ্যাঃ বাঁ স নঃ পর্শদতি দুর্গাণি বিশ্বা ॥ ৭
অগ্নিবর্ণাং শুভাং সৌম্যাং কীর্ত্তয়িষ্যন্তি যে দ্বিজাঃ।
তান্ তারয়তি দুর্গাণি নাবেব সিন্ধুং দুরিতাত্যগ্নিঃ ॥ ৮
দুর্গেষু বিষমে ঘোরে সংগ্রামে রিপুসঙ্কটে।
অগ্নিচোরনিপাতেষু দুষ্টগ্রহনিবারণে ॥৯
দুর্গেষু বিষমেষু ত্বাং সংগ্রামেষু বনেষু চ।
মোহয়িত্বা প্ৰপদ্যন্তে তেষাং মে অভয়ং কুরু ॥১০
কেশিনীং সৰ্ব্বভূতানাং পঞ্চমীতি চ নাম চ।
স মাং সমা নিশাঃ দেবী সৰ্ব্বতঃ পরিরক্ষতু ॥ ওম নমঃ। ১১
তামগ্নিবর্ণাং তপসা জ্বলন্তীং বৈরোচনীং কৰ্ম্মফলেষু যুষ্টাম্।
দুর্গাং দেবীং শরণমহং প্রপদ্যে সুতরসি তরসে নমঃ সুতরসি তরসে নমঃ ॥ ১২
দুর্গা দুর্গেষু স্থানেষু শং নো দেবীরভিষ্টয়ে।
যঃ ইমং দুর্গাস্তবং পুণ্য রাত্রৌ রাত্রৌ সদাপঠেৎ।। ১৩
দেব্যুপনিষদে মহাদেবীর এইরূপ পরিচয় আছে-
সকল দেবতা তাঁর চারপাশে বসে তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, “আপনি কে, মহাদেবি? তিনি বলেছিলেন, আমি ব্রহ্মস্বরূপিণী প্রকৃতিপুরুষাত্মক জগৎ, আমা হতেই জগৎ উৎপন্ন হয়েছে। আমি শূন্য ও অশূন্য, আমি আনন্দ অ অনানন্দ, আমি বিজ্ঞান ও অবিজ্ঞান, আমি ব্রহ্মা ও অব্রহ্মা আথর্ব শ্রুতিতে এটাই নির্দ্দিষ্ট আছে। আমি পঞ্চভূত ও অপঞ্চভূত, আমিই অখিল জগৎ, আমিই বেদ ও অবেদ, আমিই রুদ্রগণ ও বায়ুগণ, আমি আদিত্য ও বিশ্বদেব, আমি ইন্দ্র ও অগ্নি, আমিই অশ্বিনীকুমারদ্বয়, আমিই সোম, ত্বষ্টা, পূষা ও ভগ, আমিই বিষ্ণু, ব্ৰহ্মা ও প্রজাপতিকে ধারণ করি; যারা যজ্ঞ করে, সেই যজমানদের আমি বহু ধন দান করি, আমি সকল রাজ্যে বাস করি, জগতের পিতাকে আমিই প্রথম উৎপন্ন করি, সমুদ্র জলের মধ্যে আমার জন্ম, আমায় যে জানে, সে দেবীপদ প্রাপ্ত হয়। পরে দেবগণ বললেন- ইনিই আত্মশক্তি বিশ্ববিমোহিনী পাশাঙ্কুশ ও ধনুর্ব্বাণধারিণী ইনিই শ্রীমহাবিদ্যা। যে এনাকে জানে, সে শোক থেকে নিস্তার পায়।
বহ্বৃচোপনিষদে এরকম পরিচয় পাওয়া যায়-
দেবীই সর্বাগ্রে একমাত্র ছিলেন, তিনিই ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি করেন, কামকলা ও শৃঙ্গারকলা নামে খ্যাত হয়েছেন; তা থেকেই ব্রহ্মা, বিষ্ণু, রুদ্রগণ, গন্ধর্ব্বগণ, অপ্সরোগণ, কিন্নরগণ ও সকল স্থানের বাদ্যযন্ত্র ও বাদ্যকারেরা জন্মগ্রহণ করেন। তিনিই সকল ভোগ্য উৎপাদন করেছেন, বাস্তবিক শক্তি থেকেই সমস্ত উৎপন্ন হয়েছে। অগুজ, স্বেদজ, উদ্ভিজ্জ ও জরাযুজ যে কোন প্রাণী স্থাবর, জঙ্গম, মনুষ্যাদি জন্মলাভ করেছে। এই দেবীই পরাভক্তি, শাম্ভরী বিদ্যা, কাদিবিদ্যা, হাদিবিদ্যা, সাদিবিদ্যা, রহস্য, ওঙ্কারাদি বাক্প্রতিষ্ঠা, তিনিই পুরত্রয় ও শরীরত্রয় ব্যাপিয়া দেশকাল ও বস্তুর আসঙ্গহেতু অন্তরে ও বাইরে প্রকাশিত, মহাত্রিপুরসুন্দরী, প্রত্যক্ চৈতন্য, তিনিই আত্মা, তিনিই অন্যপক্ষে অসত্য ও অনাত্মা, এই দেবীই ব্রহ্মসম্বিৎ ভাব-অভাব কালবিনির্মুক্ত, চিদ্বিদ্ দ্বিতীয়া, ব্রহ্মসম্বিৎ, সচ্চিদানন্দলহরী, মহাত্রিপুরসুন্দরী, অন্তরে ও বাহিরে অনুপ্রবেশ করে স্বয়ং একস্বরূপ প্রকাশমান, যা কিছু সৎ আছে, যা কিছু সৎ আছে, যা কিছু চিৎ বিদ্যমান, যার আনন্দই প্রিয়, তা এই সর্ব্বাকার মহাত্রিপুরসুন্দরী, সকল বিশ্ব সর্বদেবতা সর্বসাধারণ মহাত্রিপুরসুন্দরী, ইনিই সত্য ললিতা নামে আখ্যাত, বাস্তবিক ইনিই অদ্বিতীয় অখণ্ড পরব্রহ্ম। পঞ্চরূপ পরিত্যাগ করে অশ্বরূপ ধারণ করে অধিষ্ঠান করেছিলেন, তাই মহদাদি সৎ এক পরতত্ত্ব? আমি প্রজ্ঞান ব্রহ্ম, আমিই ব্রহ্ম, তত্ত্বমসি, আমিই আত্মা বাঁ পরব্রহ্ম, ব্রহ্মই আমি, যে আমি সেই আমি, যে এই সেই আমি, এরূপ যা বলা যায় বা ভাবা যায় সে সমস্তই তিনি, তিনিই এই ষোড়শী, শ্রীবিদ্যা, পঞ্চদশাক্ষরী, শ্রীমহাত্রিপুরসুন্দরী, বালাম্বিকা, বগলা, মাতঙ্গী, স্বয়ম্বরকল্যাণী, ভুবনেশ্বরী, চামুণ্ডা, চণ্ডা, বারাহী, তিরস্করিণী, রাজমাতঙ্গী, শুকশ্যামলা, লঘুশ্যামলা, অশ্বারূঢ়া, প্রত্যঙ্গিরা, ধুমাবতী, সাবিত্রী, গায়ত্রী, সরস্বতী ও ব্রহ্মানন্দকলা।
মহাভারত ও হরিবংশে এরকম বর্ণিত আছে। এখন পৌরাণিক বিবরণ বর্ণিত হয়েছে-
মহামায়ার আবির্ভাব কালিকাপুরাণের মতে, জ্যোতির্ময় পরব্রহ্মের অংশস্বরূপ ব্ৰহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বর আবির্ভূত হন। ব্ৰহ্মা ও বিষ্ণু সৃষ্টিস্থিতি সংরক্ষণের জন্য নিজ নিজ শক্তি গ্রহণ করলেন, কিন্তু মহেশ্বর তা করলেন না। তিনি যোগে তন্ময় হয়ে রইলেন। কুসুমশরের প্রভাবে ব্ৰহ্মা নিজ সৃষ্ট সন্ধ্যার প্রতি অনুরক্ত হন। এই কাজের জন্য মহাদেব তাকে যথেষ্ট উপহাস করেন। ব্রহ্মারও অনেকটা জেদ ধরলেন দেখে নিবেন, মহাদেব কিভাবে শক্তির সাথে মিলিত হয়! এদিকে মহাদেব পাণিগ্রহণ না করলে সৃষ্টি রক্ষা হয় না, কিন্তু মহাদেবের জীবনসঙ্গিনী হবার উপযুক্ত কোন রমণীও ছিলেন না। কাজেই সকলে বিশেষ চিন্তিত হলেন।
অবশেষে ব্রহ্মা অনেক চিন্তার পর দক্ষ ও মরীচি প্রভৃতিকে বললেন, সন্ধ্যা ও সাবিত্রীর আরাধ্য দেবতা বিশ্বমায়া ব্যতীত শিবকে ভুলাতে পারেন, এমন নারী কেউ নাই। আমি তাঁর স্তব করছি, অবশ্য তিনিই শিবকে মোহিত করবেন। দক্ষ! তুমিও সেই জগন্ময়ীর পূজা কর, তিনি যেন তোমার কন্যারূপে জন্মগ্রহণ করে শিবের পত্নীহন। ব্রহ্মার আদেশে দক্ষ প্রজাপতি তিন হাজার দিব্য বৎসর কঠোর তপস্যা করেছিলেন। মহামায়া প্রথমে ব্ৰহ্মা, তারপরে ধ্যানস্থ দক্ষের সামনে উপস্থিত হলেন; তিনি ব্রহ্মার কামনা পূর্ণ করবেন স্বীকার করলেন এবং দক্ষকে বললেন, “আমি অবিলম্বেই তোমার পত্নীর গর্ভে তোমার কন্যারূপে উৎপন্ন হয়ে শঙ্করের সহধর্মিণী হব। যখন তুমি আমাকে আর আদর করবে না, তখনই আমি দেহত্যাগ করব। পরে দেবী দক্ষপত্নী বীরিণীর গর্ভে জন্মগ্রহণ করলেন। ক্রমে মহামায়া শৈশব অতিক্রম করে যৌবনে পদার্পণ করলেন। মহাদেবকে পাবার জন্য মায়ের আদশে মহাদেবের পূজা করতে লাগলেন। যে মহাদেব বিবাহের সম্পূর্ণ বিদ্বেষী ছিলেন, এখন সতীর রূপে ও পূজায় তার মন টলল, ভোলানাথ ভুললেন। সতীকে দেখা দিলেন। সতী বর প্রার্থনা করলেন। দাক্ষায়ণীর কথা শেষ হতে না হতেই ‘তুমি আমার ভার্যা হও’ মহাদেব এই কথা বার বার বলতে লাগলেন। তখন সতী হাসতে হাসতে বললেন, ‘আমার পিতাকে জানিয়ে আমায় গ্রহণ করুন। এই বলেই সতী মায়ের কাছে চলে আসলেন। মহাদেবও হিমালয় গুহায় প্রবেশ করে সতীর বিরহে ব্যাকুল হলেন, ব্ৰহ্মাকে নিজের মনের কথা জানালেন। ব্রহ্মার মনোরথ পূর্ণ হল। তিনি দক্ষকে গিয়ে শিবের মনোভাব জানালেন। দক্ষও প্রফুল্লচিত্তে সতীকে সম্প্রদান করলেন। প্রকৃতিপুরুষের মিলন হল। কৈলাসগিরি-কন্দরে ও হিমালয়ে মহাকৌষী নদীপ্রপাতের কাছে শিবা শিবাণীর সাথে নানারূপে বিহার করতে লাগলেন। এভাবে কিছুদিন অতীত হল। দক্ষ মহাযজ্ঞের অনুষ্ঠান করলেন। সকল দেবতাই তাঁর যজ্ঞে নিমন্ত্রিত হলেন, কেবল মহাদেব কপালী, অতএব যজ্ঞার্হ নন, এই ভেবে দক্ষ তাঁকে নিমন্ত্রণ করলেন না। সতী তাঁর অতি প্রিয়তমা হলেও কপালীর ভার্যা বলে সে যজ্ঞে দোষদর্শী দক্ষ তাকেও আহ্বান করেন নাই। যখন সতী পিতার এই দুর্ব্যবহারের কথা শুনলেন ক্ষণমাত্র আর তাঁর জীবনধারণের ইচ্ছা রইল না তখন কোপারক্তনয়না সতী, যোগবলে শরীরের সকল দ্বার রোধ করে কুম্ভক করলেন। সেই মহকুম্ভকে তাঁর প্রাণবায়ু ব্ৰহ্মরন্ধ্র ভেদ করে নির্গত হল। মহাদেব গৃহে এসে বিজয়ার কাছে সতীর প্রাণত্যাগের কারণ শুনলেন। তখন রোষপূর্ণ মহারুদ্র অবলম্বে দক্ষযজ্ঞে উপস্থিত হয়ে যজ্ঞধ্বংস করতে উদ্যত হলেন। তখন রুদ্রভীত যজ্ঞ ব্রহ্মলোকে থেকে অবতরণ করে নিজ মায়ায় সতীর মৃত শরীরে প্রবিষ্ট হলেন। যজ্ঞানুগামী রুদ্র সতীর কাছে এসে ও তাঁকে মৃত দেখে যজ্ঞের কথা ভুলে গেলেন, শবদেহের পাশে বসে অত্যন্ত শোক করতে লাগলেন। তাঁর নয়ন সলিলে বৈতরণী নদীর উৎপত্তি হল। মহাদেব সতীর শব কাঁধে নিয়ে বিলাপ করতে করতে পূর্ব অভিমুখে যেতে লাগলেন। তখন ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও শনি এই তিন দেব সতীর শরীরে প্রবেশ করে তা খণ্ড খণ্ড করে ফেললেন। যে যে স্থানে সতীর অঙ্গ পতিত হল, সেই স্থানেই পূণ্যতীর্থ বাঁ মহাপীঠ হল। শিব মায়া মোহিত হয়ে সতীশোকে বিলাপ করছিলেন, জগজ্জননী মায়াই এর কারণ। যতদিন না সতী পুনরায় জন্মগ্রহণ করেন, ততদিন তিনি নিষ্কল পরব্রহ্মের ধ্যানে নিমগ্ন থাকুন, ব্রহ্মাদি দেবগণ এরকম চিন্তা করে মহামায়ার স্তব করতে লাগলেন। তাদের স্তবে তুষ্ট হয়ে মহামায়া যোগনিদ্রা শিবের হৃদয় পরিত্যাগ করলেনঃ। শিব প্রকৃতস্থ হয়ে আবার যোগাসীন হলেন। এদিকে হিমালয় ভার্যা মেনকা পুত্রার্থী হয়ে সাতাশ বৎসর মহামায়ার পূজা করতে থাকেন। আগে থেকেই দাক্ষায়ণী গিরিরাজ মহিষীর প্রতি সুপ্রসন্ন ছিলেন, এখন তাঁর ঐকান্তিক-ভক্তিতে আকৃষ্ট হয়ে তাঁর সামনে আবির্ভূত হলেন। মেনকা প্রার্থনা করলেন, দেবী! আমি বীর্যবান্ ও আয়ুষ্মান্ শতপুত্র এবং আনন্দরূপা ত্রিভুবনমোহিনী এক কন্যা প্রার্থনা করি। ভগবতী তাঁর প্রার্থনা পূর্ণ করলেন, নিজে মেনকার কন্যারূপে জন্ম নিলেন। এভাবে বসন্তকালে মৃগশিরা নক্ষত্র সপ্তমী তিথিতে অর্দ্ধরাত্রির সময় মহামায়া জন্ম নিলেন। হিমালয় তাঁর নাম ‘কালী’ ও বান্ধগণ ‘পার্বতী’ নাম রাখলেন।
একদিন নারদ এসে হিমালয়কে পরিচয় দিয়ে গেলেন, আপনার তনয়া কালী ভগবান হরকে প্রসন্ন করলে সুবর্ণাভা ও সুবর্ণের মতো গৌরাঙ্গী বিদ্যুতসম হবেন। শিবই এর যোগ্য বর। সে সময় মহাদেব হিমালয়ের ওষধি প্রস্থ-নগরের কাছে এক সানুতে ধ্যানরত ছিলেন। গিরিরাজ এখানে এসে একদিন যথাবিধানে মহাদেবের পূজা করলেন। মহাদেব তাঁর পূজা গ্রহণ করে বললেন, গোপনীয় স্থানে তপস্যার জন্য এসেছি, যেন কোন ব্যক্তি এখানে না আসতে পারে, তাই কর। গিরিরাজ তাঁর আদেশ পালন করলেন। কেবল তিনি নিজ তনয়াকে মহাদেবের পূজার জন্য রেখে গেলেন। কালীও প্রতিদিন ভক্তির সাথে শম্ভুর সেবা করতে লাগলেন। কিন্তু এবার ভোলানাথের মন সহজে ভুলল না। দেবীর সাধ্য সাধনায় মহাদেব দেখেও দেখলেন না।
এদিকে তারকাসুর প্রবল হয়ে স্বর্গরাজ্য অধিকার করে বসল। দেবতারা সকলেই ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়লেন। এ সময় মহাদেবের ঔরসজাত পুত্র ভিন্ন কেউই তারকাসূরকে বধ করতে সমর্থ নয়, ব্রহ্মা একথাও সকলে বললেন। মহাদেবকে মোহিত করার জন্য মদন রতি ও বসন্তের সাথে প্রেরিত হলেন। এবার কুসম আয়ুধেয় শর সন্ধান ব্যর্থ হল। মহাদেবের ক্রোধানলে তিনি ভস্মীভূত হলেন। তাতে ভগবতীর বিরহ জ্বালা আরও বেড়ে উঠল। তিনি পঞ্চতপা করে ক্ষীণ ও মলিন হয়ে পড়লেন। (হরিবংশে লেখা আছে, মেনকা কন্যার ঐ অবস্থা দেখে বলেছিলেন, ‘উমা’ আর তপস্যা করও না, তা থেকেই ভগবতীর উমা নাম হল)
আশুতোষ আর কি স্থির থাকতে পারেন? দেবীকে বললেন, সুভগে! আমি তোমার বিরহ ভোগ করছি। আমার নেত্রানলে দগ্ধ মদন ভস্মরূপে আমার অঙ্গেই বাস করছে। সে যেন প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য তোমার সামনেই আমাকে দগ্ধ করছে। এখন তুমি আমার প্রতি প্রসন্ন হও। দেবী আর কি বললেন। ইঙ্গিতে তাঁর সখীদেরকে নিজের মনোভাব জানালেন, পিতাই কন্যাকে সম্প্রদান করে থাকেন, পিতাকে বললেই সকল দিক্ রক্ষা হবে। এই বলে লজ্জাবনত মুখে পার্বতী পিতার ঘরে চলে আসলেন। মরীচি প্রভৃতি ঋষিগণ মহাদেবের আদেশে গিরিরাজকে মহাদেবের ইচ্ছা জানালেন। গিরিরাজ হাতে যেন স্বর্গ পেলেন। মহা সমারোহে শিবের সাথে পার্বতীর বিয়ে সম্পন্ন হল। তারপরে মহাদেব কালীকে নিয়ে কৈলাসে গিয়ে মহানন্দে দিনাতিপাত করতে লাগলেন। একদিন মহাদেব উর্ব্বশী প্রভৃতি, স্বর্গের বেশ্যাকে দেখে পার্বতীকে সম্বোধন করে বললেন, ভিন্নাঞ্জনশ্যামলে কালী! তুমি উর্বশী প্রভৃতির সাথে আলাপ কর। এই বলে তিনি কালির কাছ থেকে সরে গেলেন। ভিন্নাঞ্জন শ্যামলা কালী এই কথা শুনে ভগবতীর ক্রোধ হল। তিনি অপ্সরাদের সামনে মহাদেবের ঐ কথায় নিজেকে নিন্দিত বোধ করলেন ও শৈলশিখরে গুপ্ত হয়ে প্রকৃতি ভাব প্রাপ্ত হলেন। মহাদেব অনেক খুঁজেও তাকে বের করতে পারলেন না, বড়ই ব্যাকুল হয়ে পড়লেন। মহাদেবকে বিশেষ কাতর জেনে সতী দেখা দিলেন। মহাদেব তাঁর মান ভাঙ্গতে গেলেন, কিন্তু কালী মানভরে বললেন, ‘যে পর্যন্ত আমার শরীর সোণার মত গৌর না হয়, সে পর্যন্ত আমি তোমার সহবাস করব না।’ এই বলে মহামায়া মহাকৌষীপ্রপাত নামক হিমালয়ে সানুতে গমন করলেন। এখানে তপস্যায় একশত বৎসর অতিবাহিত হল। তপস্যান্তে তিনি অন্তরে বাইর কেবল মহাদেবকেই দেখতে লাগলেন। এখন দেবীর অভীষ্ট সিদ্ধ হল, আকাশগঙ্গার জলে স্নান করে কালী বিদ্যুৎসদৃশা গৌরবর্ণ গৌরী হলেন। (কালিকাপুরাণ ৪৫অঃ)
কার্ত্তিক গণেশ এরই পুত্র। ইনিই মহিষীমর্দ্দিনীরূপে মহিষাসুরকে নিধন করেন।
দেবীভাগবতে দেবীর উৎপত্তি সম্বন্ধে এরকম লেখা আছে-
দেবগণ, মহিষাসুরের যুদ্ধে পরাস্ত হয়ে সকলে ব্রহ্মার শরণপন্ন হন। ব্রহ্মা আবার শিব ও দেবতাদের সঙ্গে নিয়ে বিষ্ণূলোকে উপস্থিত হলেন।
দেবগণ, মহিষাসুরের যুদ্ধে পরাস্ত হয়ে সকলে ব্ৰহ্মার শরণাপন্ন হন। ব্ৰহ্মা আবার শিব ও দেবতাদের সঙ্গে নিয়ে বিষ্ণুলোকে উপস্থিত হলেন। এখানে বিষ্ণুকে সকলে জানালেন যে, ব্ৰহ্মার বরে মহিষাসুর পুরুষের অবধ্য হয়েছেন। সুতরাং বরদানের বলে সে বড়ই উদ্ধত ও গর্বিত হয়ে পড়েছে, এদিকে এমন রমণীও দেখি না যে, তার সাথে যুদ্ধ করতে পারে। এখন যাতে তার মৃত্যু হয়, তার একটা উপায় বিধান করুন। বিষ্ণু তাঁদের কথা শুনে হাসতে হাসতে বললেন, যদি সেই অসুরকে বধ করতে চাও, তাহলে তোমরা নিজ নিজ স্ত্রীর সাথে মিলিত হয়ে নিজ নিজ তেজের প্রার্থনা কর, যেন উৎপন্ন তেজসমূহ সমবেত হয়ে এক নারীরূপে আবির্ভূত হন। সেই নারীকে আমরা রুদ্রাদির ত্রিশূল প্রভৃতি দিব্য-অস্ত্রে ভূষিত করব। সেই নারীই মদগর্বিত অসুরকে বিনাশ করতে সমর্থ হবেন। তখন ব্রহ্মার মুখ থেকে পদ্মরাগমণীর মতো রক্তবর্ণ দুঃসহ তেজ উৎপন্ন হল। একইভাবে শঙ্করের শরীর থেকে অত্যুদ্ভূত রৌপ্যবর্ণ, বিষ্ণুর শরীর হতে নীলবর্ণ, ইন্দ্রের শরীর হতে ত্রিগুণর্ময় বিচিত্রবর্ণ, কুবেরসম অনল ও বরুণের শরীর হতে একেবারে সুমহৎ তেজঃপুঞ্জ প্রাদুর্ভুত হল। পরে অন্যান্য দেবতাদের শরীর থেকে ভাস্বর তেজ নির্গত হল। তখন সেই মহাতেজের সমষ্টি অতীব উজ্জ্বল হয়ে উঠল। সেই তেজোরাশি অবলোকন করে বিষ্ণু প্রভৃতি সকলেই বিস্মিত হলেন। অকস্মাৎ সেই তেজঃপুঞ্জ থেকে এক অদ্বিতীয় রমণীমূর্তি আবির্ভূত হয়ে সকলের বিস্ময় উৎপাদন করলেন। এই রমণী মূর্তিই মহালক্ষ্মী, এই ভুবনমোহিনীর বাহু আঠারো, মুখমণ্ডল শ্বেতবর্ণ, নয়ন কৃষ্ণবর্ণ, অধর রক্তবর্ণ ও পাণিতল তাম্রবর্ণ। তিনি দিব্যভূষণভূষিতা কামনীয়া কান্তিধারিণী; তাঁর হাজার বাহু হলেও অসুরদের বিনাশের জন্য তেজোরাশি থেকে অষ্টাদশভুজারূপে আবির্ভুত হলেন।(দেবীভাগঃ ৮/৮ অঃ)
কার তেজ থেকে তাঁর শরীরের কোন স্থান উৎপন্ন হয়েছিল সে সম্বন্ধেও দেবীভাগবতে এরকম বর্ণিত আছে—
শঙ্করের তেজ থেকে তাঁর সুবিপুল শ্বেতবর্ণ ও মনোহর মুখকমল, যমের তেজ থেকে আজানুলম্বিত কৃষ্ণবর্ণ মনোহর কেশকলাপ, অগ্নির তেজ থেকে মধ্যস্থলে কৃষ্ণবর্ণতারকাযুক্ত ও প্রান্তভাগ রক্তবর্ণ এরকম ত্রিনয়ন; সন্ধ্যার তেজ থেকে কৃষ্ণবর্ণ ভ্রুযুগল, বায়ুর তেজ থেকে নাতিদীর্ঘ নাতিহ্রস্ব শ্রবণযুগল, কুবেরের তেজ থেকে তিলফুল সদৃশ নাসিকা, দক্ষাদির তেজ থেকে কুন্দকুসুম সদৃশ দন্তপঙক্তি, অরুণের তেজ থেকে রক্তবর্ণ অধর, কার্তিকের তেজ থেকে রমণীর ওষ্ঠ, বিষ্ণুর তেজ থেকে অষ্টাদশ বাহু, বসুদের তেজ থেকে রক্তবর্ণ আঙ্গুল সকল, সোমের তেজ থেকে উত্তম স্তনযুগল, ইন্দ্রের তেজ থেকে ত্রিবলীযুক্ত মধ্যস্থল, বরুণের তেজ থেকে জঙ্ঘা ও উরুযুগল এবং পৃথিবীর তেজ থেকে বিপুল নিতম্ব উৎপন্ন হল। তখন সেই পরাশক্তিকে দেবতারা নিজ নিজ অস্ত্র প্রদান করলেন- বিষ্ণু চক্র, শঙ্কর শূল, আর শঙ্খ, অগ্নি শতঘ্নী, বায়ু বাণপূর্ণ, ইন্দ্র বজ্র, যম কালদণ্ড, ব্ৰহ্মা গঙ্গাজলপূর্ণ কমণ্ডলু, বরুণ পাশ ও পদ্ম, কাল খড়গ ও চৰ্ম, কুবের সুরাপুর্ণ পানপাত্র, বিশ্বকর্মা পরশু ও গদা প্রদান করলেন। এভাবে অস্ত্র শস্ত্রে ভূষিত হয়ে মহাদেবী সিংহের উপর আরোহণ করে অসুর বিনাশে অগ্রসর হলেন। ঘোরতর যুদ্ধের পর মহাদেবীর হাতে মহিষাসুর পরাজিত ও নিহত হলেন।
মার্কণ্ডেয় চণ্ডীতেও সৰ্বদেবের তেজ থেকে সহস্রভূজা মহিষ মর্দ্দিনীর আবির্ভাবের কথা বর্ণিত হয়েছে। কালিকাপুরাণে মহামায়ার আবির্ভাব সম্বন্ধে এরকম উপাখ্যান বর্ণিত আছে-
যদিও মহাদেবী(দশভূজা) পশ্চাৎ মহিষাসুরকে বধ করেছিলেন, তবে আবার তিনি (ষোড়শভূজা) ভদ্রকালীরূপে যে মহিষাসুরকে বধ করেছিলেন, এরকম বলবার কারণ কি? দেবগণ যখন সেই ভদ্রকালী মূর্তি দর্শন করেছিলেন, তখন দেবীর পাদদেশে মহিষাসুর নিপতিত ও তার হৃদয়ে শূল বিদ্ধ দেখেছিলেন, এরই বা কারণ কি? ঔর্ব বললেন, হে মহারাজ! যেভাবে মহিষের সাথে ভদ্রকালী প্রাদুর্ভূত হয়েছিলেন,সেই বিষয় বলছি শ্রবণ করুন- বীর মহিষাসুর একদিন নিশাযোগে পৰ্বতে নিদ্রাকালিন অতি নিদারুণ ভয়ঙ্কর স্বপ্ন দেখেছিলেন- যেন মহামায়া ভদ্রকালী অতি ভীষণভাবে মুখবিস্তার করে খড়গ দিয়ে তার শিরচ্ছেদ করে তার রক্তপান করছেন। প্রাতঃকালে মহিষাসুর অতিশয় ভীত হয়ে আপন অনুচরবর্গের সাথে সেই মহামায়ার পূজা করলেন। অনন্তর মহাদেবী মহিষাসুর কর্ত্তৃক পূজিত হয়ে ষোড়শভূজা ভদ্রকালী রূপে আবির্ভূত হলেন। তারপর মহিষাসুর মহামায়াকে প্রণাম করে বলেছিল, দেবি! আমি সত্যই স্বপ্নে দেখেছি, আপনি আমার শিরচ্ছেদ করে রক্তপান করছেন। তাঁতে আমি নিশ্চয় বুঝেছি, আপনি আমার রুধির পান করবেন। আমি যে আপনার বধ্য, সে বিষয়ে সন্দেহ নাই, আমারও তাতে দুঃখ নাই। পর্বে আমার পিতা আমার জন্য আপনার সাথে শম্ভুর আরাধনা করেছিলেন, তাতেই আমার জন্ম হয়। আমি ইন্দ্রত্ব প্রাপ্ত হয়েছি ও অখণ্ড ব্রহ্মাণ্ডের আধিপত্য নির্বিবাদে উপভোগ করেছি, সুতরাং আর আমার বাঞ্ছনীয় কিছুই নাই। এখন আপনার আশ্রয় এই মাত্র আমার গ্রার্থনা। নিখিল যজ্ঞে যাতে আমি পূজ্য হই, তাই করুন। যতদিন সূর্য থাকবে, ততদিন যেন আমি আপনার পদত্যাগ না করি, এই বর প্রদান করুন। মহাদেবী বললেন, যজ্ঞের এমন একটি ভাগ নাই, যা এখন আমি তোমাকে দিতে পারি। কিন্তু তুমি যুদ্ধে আমার হাতে নিহত হয়েও কোনকালে আমার পদত্যাগ করবে না। যেখানে আমার পূজা হবে, সেখানেই তোমার এই শরীরের পূজা হবে।
তখন মহিষাসুর দেবীকে সাদরে নমস্কার করে জানতে চাইলেন, পরমেশ্বরি! যজ্ঞে আপনার কোন কোন মূর্ত্তির সাথে আমি পূজ্য হব ? দেবী জানালেন, উগ্ৰচণ্ডা, ভদ্রকালী ও দুর্গা এই তিন মূৰ্ত্তিতে তুমি সৰ্বদা আমার পাদলগ্ন হয়ে মনুষ্য দেব ও রাক্ষসদের পূজ্য হবে। আদি সৃষ্টিতে অষ্টাদশভূজা উগ্রচণ্ডি মূৰ্ত্তিতে তোমাকে বিনাশ করেছি।
দ্বিতীয় সৃষ্টিতে এই (ষোড়শভূজা) ভদ্রকালীরূপে তোমাকে বিনাশ করি। এখন(দশভূজা) দুর্গারূপে অনুচরবর্গের সাথে তোমাকে বধ করব।
দুর্গার আবির্ভাব সম্বন্ধে কাশীখণ্ডে এরকম বর্ণিত আছে-
পুরাকালে দুৰ্গ নামে কুরুর এক পুত্র ছিল, এই মহাদৈত্য তপস্যার বলে ত্রিলোক জয় করে নিজের অধীন করে ছিল। ইন্দ্র, চন্দ্র, বায়ু, বরুণ প্রভৃতি সকলের পদই কেড়ে নিয়েছিল। তাঁর ভয়ে ঋষিদের তপস্যা ও ব্রাহ্মণদের বেদপাঠ বন্ধ হল। মহাবিপদে পড়ে দেবগণ মহেশ্বরের আশ্রয় নিলেন। মহেশ্বর সেই দুষ্ট অসুরকে বিনাশ করার জন্য দেবীকে পাঠালেন। মহাদেবী দেবগণকে অভয় দিয়ে যুদ্ধের উদ্যোগ করতে লাগলেন। প্রথমে তিনি কালরাত্রি নামের রুদ্রাণীকে পাঠালেন দৈত্যকে আনবার জন্য। দুর্গাসুর সেই মনোরম রুদ্রাণীর রূপে মোহিত হয়ে তাকে ধরে অন্তঃপুরে নিয়ে যেতে আদেশ করলেন, দৌত্যকার্যে এসেছেন বললেও তারা কোন কথাই শুনল না। দৈত্যানুচররা যেমন কালরাত্রিকে ধরতে যাবেন, অমনি দেবীর হুঙ্কারে রক্ষিগণ ভস্মীভূত হতে লাগল। তখন দুর্গাসুরের আদেশে অযুত সংখ্যক অসুর এসে সেই দেবীকে ধরার উপক্রম করল। তারা নিঃশ্বাস বায়ুতে দৈত্যগণ ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়তে লাগল। দেবীও আকাশমার্গে উঠে সে স্থান পরিত্যাগ করলেন। দুর্গাসুর দৈত্য বীরবর্গের সাথে তাদের অনুগমন করলেন। কিছুকাল পরে সেই মহাসুরগণ বিন্ধ্যাচলে এসে সহস্রভূজাম মহাতেজা, মহাপ্রহরণা মহাদেবীকে দেখতে পেল। আরও দেখল যে, কালরাত্রি এসে দেবীর কাছে তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করতেছেন। দুর্গাসুর মহামায়ার রূপ দর্শন করে কামশরে পীড়িত হল এবং যে কেউ তাঁকে ধরে আনতে পারবে তাকে বিশেষভাবে পারিতোষিক দেওয়ার লোভ দেখাল। তখন দৈত্যবীরগণ ভগবতীকে ধরার জন্য ছুটল। কিন্তু কাউকেও মহামায়ার সন্মুখীন হতে হল না। সকলেই পরাজিত হল। পরে দুর্গাসুর নিজে মহাদেবীর সাথে যুদ্ধে প্রবৃত্ত হল।
মহাদেবীর শরীর থেকে শক্তিগণ উৎপন্ন হয়ে দৈত্যসেনা ধ্বংস করতে লাগল। দুর্গাসুর সেনাদের দুর্দশা দেখে মহাগজ মূর্ত্তিধারন করে দেবীর প্রতি ধাবিত হল। মহাদেবী পাশাস্ত্র প্রহারে তাঁর ভীমশুণ্ড দ্বিখণ্ড করে ফেললেন। তখন দৈত্যপতি আবার মহিষরূপ ধারণ করে দেবীকে আক্রমণ করল, কিন্তু দেবী ত্রিশূল আঘাতে তাকে ভূমিশায়ী করলেন। অবিলম্বে সেই দৈত্য সহস্রভুজ পুরুষ মূর্ত্তিধারণ করে প্রাণোপণে যুদ্ধ করতে লাগল।
অবিলম্বে দেবী একটি মহাস্ত্র নিক্ষেপ করে তাকে খণ্ড বিখণ্ড করে ফেললেন। দুর্গাসুর নিহত হল। স্বর্গে দুন্দুভি বাজতে লাগল। দেবগণ দেবীর স্তব করতে লাগলেন। সেদিন থেকে মহাদেবী দুর্গা নামে বিখ্যাত হলেন। (কাশীখণ্ড ৭২ অঃ)
কালিকাপুরাণে একস্থানে উল্লেখ করা হয়েছে যে- সেই দশভুজা জগদ্ধাত্রীই মহিষাসুরকে নিধন করেছিলেন। ইনিই আশ্বিনমাসে কৃষ্ণপক্ষে চতুর্দ্দশীর দিন গ্রাদুর্ভূত হয়েছিলেন। পরে শুক্লপক্ষে সপ্তমীর দিন দেবতাদের তেজে সেই দেবীমূৰ্ত্তি ধারণ করেছিলেন। অষ্টমীতে দেবগণ তাঁকে নানা অলঙ্কার দিয়ে সাজিয়েছিলেন। নবমীতে মহাদেবী নানাবিধ উপচারে পূজিত হয়ে মহিষাসুরকে বিনাশ করেন এবং দশমীতে দেবগণ কর্তৃক বিসৃষ্ট হয়ে অন্তর্ধান করলেন।
পুরাকালে সায়ম্ভুব মন্বন্তরে এই দশভূজা দেবগণ কর্তৃক পূজিত হন। সপ্তশতীচণ্ডীর মতে— স্বারোচিষ মন্বন্তরে সুরথ রাজা ও সমাধি বৈশ্য দেবীর পুজা করেন। দেবী ভাগবতের মতে, ভারতভূমে সৰ্ব প্রথম সুযজ্ঞ রাজাই দেবীর পূজা করেছিলেন।
দেবীভাগবত, মহাভাগবত, কালিকাপুরাণ, বৃহন্নন্দিকেশ্বরপুরাণ ও বৃহদ্ধৰ্ম্মপুরাণে রামচন্দ্র কর্তৃক দেবীর অকালে (শরৎকালে) পূজার কথা বর্ণিত আছে। কালিকা পুরাণে ও বৃহদ্ধৰ্ম্মপুরাণে লিখিত আছে- রামের প্রতি অনুগ্রহ ও রাবণের বধের নিমিত্ত ব্ৰহ্মা রাত্রিকালে মহাদেবীর বোধন করেছিলেন। মহাভাগবতে আছে- রামচন্দ্র অষ্টোত্তর শত নীলপদ্ম দ্বারা দেবীর পূজায় প্রবৃত্ত হন, কিন্তু দেবী তাঁকে ছলনা করার জন্য একটি পদ্ম লুকিয়ে রাখেন। তখন রামচন্দ্র নিজের একটি চক্ষু উৎপাটন করে দেবীর পাদপদ্মে অর্পণ করতে অগ্রসর হন। দেবী তাঁকে নিরস্ত করে তাঁর মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করেন।
কারও মতে, রাবণ বসন্তকালে দুর্গাপূজা করেছিলেন, এই জন্য তা বাসন্তীপূজা নামে খ্যাত।
-দুর্গা পূজা বিধি-
শরৎকালে বার্ষিক যে মহাপূজা করা হয়, তাকে শারদীয়া মহাপূজা বলে এবং এই পূজার চারটি প্রধান কর্ম- মহাস্নান, পূজন, হোম ও বলিদান। এই পূজা তিথিত্রয় ব্যাপি করতে হয়।
“শরৎকালে মহাপুঞ্জ ক্রিয়তে যা চ বার্ষিকী।
শারদীয়া মহাপূজা চতুঃকৰ্ম্মময়ী শুভ৷৷
তাং তিথিত্রয়মাসাদ্য কুৰ্য্যাদ্ভত্ত্যা বিধানতঃ।
চতুঃকৰ্ম্মময়ী স্নপনপূজনবলিদানহোমরূপা সা।৷
প্রতি বৎসর আশ্বিন মাসে প্রত্যেকেরই এই পূজা অবশ্য কর্তব্য, যারা মোহ আলস্য দম্ভ বা দ্বেষপূর্বক পূজা না করেন, তাদের প্রতি দেবী ভগবতী ক্রুদ্ধ হয়ে তাদের সকল প্রকার অভিলাষ নষ্ট করেন। এই শরৎকালীন দুৰ্গা পুজার সকল প্রকারে নিত্যতা প্রতিপাদিত হয়েছে। না করলে প্রত্যব্যয়ভাগী হতে হবে। (তিথিতত্ত্ব)
দ্বিশরীরে চরে চৈব লগ্নে কেন্দ্রগতে রবৌ।
বর্ষে বর্ষে বিধাতব্যং স্থাপনঞ্চ বিসর্জ্জনং ॥
যো মোহাদথবালস্যাদ্দেবীং দুর্গাং মহোৎসবে।
ন পূজয়তি দস্তাদ্বা দ্বেষাদ্বাপ্যথ ভৈরব ॥
ক্রুদ্ধ ভগবতী তস্য কামানিষ্টান্ নিহন্তি বৈ ॥
দুর্গা পুজা করলে দেবতা সকল প্রীত হন এবং যিনি পূজা বিধির অনুষ্ঠান করেন, তিনি অতুল বিভূতি ও চতুৰ্ব্বৰ্গ ফল লাভ করেন। ধৰ্ম্ম অর্থ কাম ও মোক্ষ এর মধ্যে যিনি যাহা অভিলাষ করে ভক্তি সহকারে পূজা করেন, তিনি অচিরাং তা প্রাপ্ত হন। সমাধি নামক বৈশ্য ও সুরথ রাজা পুজা করেই সমাধি বৈশ্য নিৰ্ব্বাণ ও সুরথ রাজ রাজ্যাদি পুনঃ প্রাপ্ত হয়েছিলেন। যে যে কোন অভিলাষ করে দেবীর পূজা করে, তাহার সেই অভিলাষ পূর্ণ হয়। রোগী রোগ হতে মুক্ত হয়, মুমুক্ষু মুক্তিলাভ করে, এই সকল কারণে প্রত্যেকেরই এই পূজা করা অবশ্য কর্তব্য।
এই পূজার ৭টি কল্প বিহিত আছে- এই সকল ৭টা কল্পের মধ্যে সামর্থ্যানুসারে যে কোন কল্পে পূজা করতে হবে।
নবম্যাদি কল্প- ভাদ্রমাসের কৃষ্ণানবমী হতে আশ্বিন মাসের মহানবমী পর্যন্ত যে পূজা করা হয়, তাকে নবম্যাদি কল্প বলে। আশ্বিন মাসের শুক্ল প্রতিপদ হতে মহানবমী পর্যন্ত যে পূজা করা যায়, তাকে প্রতিপদাদি কল্প, আশ্বিন শুক্লাষষ্ঠী হতে মহানবমী পর্যন্ত ষষ্ঠ্যাদি কল্প, সপ্তমী হতে মহানবমী পর্যন্ত সপ্তম্যাদি কল্প, মহাষ্টমী হতে মহানবমী পৰ্যন্ত অষ্টম্যাদি কল্প, কেবল মহাষ্টমীর দিন অষ্টমীকল্প, এবং মহানবমীর দিন নবমীকল্প; এই সপ্তবিধকল্প উল্লেখ করা হয়েছে। এই সপ্তবিধ কল্পদ্বারা এর নিত্যত্ব প্রতিপাদিত হয়েছে। যিনি যেমন অবস্থাসম্পন্ন, তিনি এই সপ্তবিধ কল্পের মধ্যে যে কোন এক কল্পে পূজা করতে পারেন।
তত্তদ্বচনাৎ কৃষ্ণনবম্যাদি-প্রতিপদাদি- ষষ্ঠ্যাদি-সপ্তম্যাদি মহাষ্টম্যাদি কেবলমহাষ্টমী কেবলমহানবমী পূজারূপকল্পা উন্নেয়া।(তিথিতঃ)
কল্প আরম্ভের পর যদি অশৌচ হয়, তাহলে পূজার প্রতিবন্ধক হবে না। যেহেতু এরকম লেখা আছে-
ব্রতযজ্ঞবিহাহেষু শ্রাদ্ধে হোমেহর্চ্চনে জপে।
আরব্ধে সূতকং নস্যাদনারব্ধে তু সূতকং।। (তিথিতঃ)
ব্রত, যজ্ঞ, বিবাহ, শ্রাদ্ধ, হোম, অর্চ্চনা ও জপ আরম্ভ হলে সূতক অশৌচ হয় না, অনারব্ধ হলে সূতক অশৌচ হয়।
দুর্গোৎসব ব্রত বলে উল্লেখ হয়েছে। এই পূজা সাত্ত্বিকী রাজসী ও তামসী এই ত্রিবিধা। সাত্ত্বিকী পূজায় নিরামিষ নৈবেদ্য, জপ ও যজ্ঞাদি, পুরাণ আদিতে কীৰ্ত্তিত ভগবতীর মাহাত্ম্য পাঠ, এবং দেবীসূক্ত জপ প্রভৃতি করতে হয়। বলিদান ও সামিষ নৈবেদ্যাদি দ্বারা যে পূজা করা যায়, তাহাকে রাজসী পূজা কহে। জপ যজ্ঞ বিনা সুরামাংসাদি উপহারে যে পূজা হয়, তাকে তামসী পূজা বলে। এরূপ পূজা ম্লেচ্ছগণ ও দস্যুগণ অনুষ্ঠান করে থাকে।
শারদী চণ্ডিকা পূজা ত্রিবিধা পরিণীয়তে।
সাত্ত্বিকী রাজসী চৈব তামসী চেতি বিশ্রুতিঃ ॥
সাত্ত্বিকী জপযজ্ঞাদ্যৈ র্নৈবেদ্যৈশ্চ নিরামিষৈঃ।
মাহাত্ম্যং ভগবত্যাশ্চ পুরাণাদিষু কীৰ্ত্তিতং ॥
পাঠস্তস্য জপঃ প্রোক্তঃ পঠেদ্দেবী মনাস্তথা।
দেবীযুক্তজপৈশ্চৈব যজ্ঞো বহ্নিষু তৰ্পণং ॥
রাজসী বলিদানৈশ্চ নৈবেদ্যৈঃ সামিষৈস্তথা ॥
সুরামাংসাদ্যুপাহারৈ র্জপযজ্ঞৈ র্বিনা তথা।
বিনা মন্ত্রৈস্তামসী স্যাৎ কিরাতানাস্তু সন্নতা ॥” (তিথিতত্ত্ব)
পুজাস্থলে পূজকের তপোযোগ অধিক থাকে এবং পূজার আতিশয্য ও দেব প্রতিকৃতির স্বরূপ হয়, সেইস্থানে দেবতার সান্নিধ্য হয়ে থাকে।
অর্চ্চকস্য তপেযোগাদর্চ্চনস্যাতি শায়নাং।
আভিরূপ্যাচ্চ বিস্বানাং দেবঃ সান্নিধ্যমৃচ্ছতি ॥ (তিথিতত্ত্ব)
নবম্য্যাদিকল্প- রবি কন্যা রাশিতে গমন করলে অর্থাৎ আশ্বিনমাসের কৃষ্ণপক্ষের আর্দ্রানক্ষত্রযুক্ত নবমী তিথিতে দেবীর বোধন করতে হবে। যদি নবমীতে আর্দ্রানক্ষত্র না হয়, তাহলে কোন্ নবমীতে বোধন হবে? কালিকাপুরাণের মতে নবমীতে অষ্টাদশভূজার বোধন ও ষষ্ঠীতে দশভূজার বোধন করা কর্তব্য। স্মার্ত্তের মতে, এটি সঙ্গত নয়, কারণ কামাখ্যাপঞ্চমূৰ্ত্তি প্রকরণে এরকম লেখা আছে-
শরৎকালে পুরা যস্মাৎ নবম্যাং বোধিতাসুরৈঃ।
শরদা সা সমাখ্যাত্যা পীঠে লোকে চ নামতঃ॥
রূপমস্যাঃ পুরা প্রোক্তং সিংহস্থং দশ বাহুভিঃ।
রূপমেবং দশভুজং পূর্ব্বোক্তস্তু বিচিন্তয়েৎ।
উগ্রচণ্ডেতি সা মূর্ত্তি ভদ্রকালী ত্বহং পুনঃ।
যয়া মূর্ত্ত্যা ত্বাং হনিষ্যে সা দুর্গেক্তি প্রকীর্ত্তিতা ॥(তিথিতত্ত্ব)
অতীতে শরৎকালে নবমী তিথিতে দেবগণ কর্তৃক যে দেবী বোধিত হয়েছে, তাঁর নাম শারদা, ইনি দশবাহু সমন্বিতা এবং সিংহবাহিনী। ইত্যাদি পূর্ব্বোক্ত বচনানুসারে মহিষাসুরের পাদলগ্নত্ব হেতু পূজার বিষয় আগে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু অষ্টাদশভূজায় মহিষাসুরের প্রতি পাদলগ্নত্ব সম্ভাবনা নাই ইত্যাদি কারণে নবমীতে বা ষষ্ঠীতে দশভূজার বোধনই যুক্ত। “দুর্গায়াঃ পাদলগ্নত্বেন মহিষাসুরস্য পূজ্যত্বং পূর্ব্বমূক্তং অতএব অষ্টাদশভূজায়াঃ পাদলগ্নত্বং মহিষাসুরস্য ন সম্ভবতি তস্মাদ্দশভূজায়াঃ নবম্যাং ষষ্ঠ্যাং বা বোধনং। (তিথিতত্ত্ব)
(স্মার্ত্তের এই স্থানে কিছু বিরোধ দেখা যায়। কারণ কালিকা পুরাণে দশভূজা, ষোড়শভূজা ও অষ্টাদশভূজা এই তিন মূর্ত্তিরই পাদদেশে মহিষাসুর থাকবে ও পূজ্য হবে এরূপ বিবরণ পাওয়া যায়।)
নবমীতে বোধন করে জ্যেষ্ঠানক্ষত্রযুক্তা ষষ্ঠীতে বিল্ববৃক্ষ আমন্ত্রণ, মূলানক্ষত্রযুক্ত সপ্তমীতে পত্রিকাপ্রবেশ, পূর্ব্বাষানক্ষত্রযুক্ত নবমীতে বিবিধ বলিদ্বারা শিবাকে পূজা ও শ্রবণানক্ষত্রযুক্তা দশমীতে প্রণাম করে বিসর্জন করতে হবে। পূর্ব্বে যে সকল নক্ষত্র উক্ত হল, ঐ সকল তিথিতে যদি ঐ সকল নক্ষত্র যোগ না হয়, তাহলে ঐ সকল তিথিতেই কার্য্যাদি হবে, নক্ষত্রের কথা যা উক্ত হয়েছে, তা ফলাতিশয়ের জন্য। যদি ঐ তিথিতে পূর্ব্বোক্ত নক্ষত্রের যোগ হয়, তাহলে পূজাতেও বিশেষ ফল হয়।
ঈষে মাস্যসিতে পক্ষে কন্যারাশিগতে রবৌ।
নবম্যাং বোধয়েদ্দেবীং ক্রীড়াকৌতুকমঙ্গলৈঃ।।
জ্যেষ্ঠানক্ষত্রযুক্তায়াং ষষ্ঠ্যাং বিল্বাভিমন্ত্রণং।
সপ্তম্যাং মূলযুক্তায়াং পত্রিকায়াঃ প্রবেশনং।।
পূব্বাষাঢ়যুতাষ্টম্যাং পূজাহোমাদ্যুপোষণং।
উত্তরেণ নবম্যাস্তু বলিভিঃ পূজয়েচ্ছিবাং।।
শ্রবণেন দশম্যাস্তু প্রণিপত্য বিসর্জ্জয়েৎ। (তিথিতত্ত্ব)
প্রতিবৎসর কন্যারাশিতে সূর্য অবস্থান করলে অর্থাৎ আশ্বিনমাসে কর্তব্যত্বের অনুপ্রপত্তি হেতু সিংহকে অর্থাৎ ভাদ্রমাসে বোধন এবং তুলায় অর্থাৎ কার্ত্তিক মাসে স্থাপনাদি করবে। কিন্তু মলমাসে করবে না। যদি আশ্বিন মাস মলমাস হয়, তাহলে আশ্বিন মাসে পূজাদি কিছুই হবে না, কার্ত্তিক মাসে হবে। এমন স্থানে ভাদ্রমাসে বোধন ও কার্ত্তিক মাসে পূজা হবে, ভাদ্রের কৃষ্ণানবমী হতে প্রতিদিন দেবীমাহ্যাত্ম্য পাঠ ও পূজাদি করতে হবে।
কৃষ্ণানবমীতে যে বোধন হবে, তা দেবকৃত্যহেতু পূর্ব্বাহ্ণে হবে, যদি উভয় দিন পূর্ব্বাহ্ণে নবমী লাভ হয়, তাহলে পূর্ব্বদিনে এবং পূর্ব্বদিনে যদি আর্দ্রানক্ষত্র হয়, তাহলে পূর্ব্বদিনে পূর্ব্বাহ্নসময়ে দেবীর বোধন হবে। বোধন কার্য্যে যে রাত্রিপদ উল্লিখিত হয়েছে, তা দেবরাত্রিপর জানতে হবে। দক্ষিণায়ন দেবতাদের রাত্রি, এই জন্য রাত্রিপদ ব্যবহৃত হয়েছে। যদি পরদিনে আর্দ্রানক্ষত্র লাভ হয়, তাহলে পরদিনে বোধন হবে এবং পূর্ব্বাহ্ণেতর সময়ে যদি আর্দ্রানক্ষত্র লাভ হয়, তাহলে আর্দ্রানক্ষত্রানুরোধে পূর্ব্বাহ্ণেতরকালে বোধন হবে।
তত্র কৃষ্ণনবম্যাং দেবকৃত্যত্বেন পূর্ব্বাহ্ণে বোধনং।
উভয়দিনে পূর্ব্বাহ্ণে নবমীলাভে পূর্ব্বদিনে আর্দ্রানুরোধে তু পূর্ব্বাহ্ণং বিনা দিবামাত্রে যুগ্মাদরং বিনাপি পরদিনে বোধনং উভয়দিনে পূর্ব্বাহ্ণে নবম্যার্দ্রলাভে পূর্ব্বদিনে বোধনং যুগ্মাৎ। (তিথিতত্ত্ব)
ষষ্ঠীতে বোধন করতে হলে সায়ংকালে বোধন করতে হয়। যারা নবমীতে বোধন করতে সমর্থ হন না, তারাই ষষ্ঠীতে সায়ংকালে বোধন করবে।
ষষ্ঠ্যাং বিল্বতরৌ বোধং সায়ং সন্ধ্যাসু কারয়েৎ।
ষষ্ঠীতে বিল্ববৃক্ষে সায়ংকালে দেবীর বোধন করবে, যে সময় সন্ধ্যা পরিস্ফুট হয় নাই, তারকা সকল যখন ভাল করে দেখা যায় না, এইরূপ সময়ই প্রকৃত বোধনের কাল।
ষষ্ঠীতে সন্ধ্যাকালে বোধন আমন্ত্ৰণ করতে হবে, পত্রীপ্রবেশের পূর্বদিনে যদি সায়ংকালে ষষ্ঠী লাভ হয়, তাহলে একদিনে বোধন ও আমন্ত্রণ হবে। কিন্তু পত্রীপ্রবেশের পূৰ্বদিন সায়ংকালে ষষ্ঠীলাভ না হলে তার পূর্বদিন সায়ংকালে বোধন এবং পরদিনে সায়ংকালে আমন্ত্রণ হবে। যখন উভয়দিনে সায়ংকালে ষষ্ঠী হয়েছে, সেই সময় পরদিনে ষষ্ঠীতে বোধন হবে। যদি উভয়দিনই সায়ংকালে ষষ্ঠী না হয়, তাহলে পূর্ব্বাহ্ণে ষষ্ঠীতে বোধন করবে।
ষষ্ঠ্যাং বোধনামন্ত্রণকরণেহপি পত্রীপ্রবেশপূর্ব্বদিনে সায়ং ষষ্ঠীলাভে একদৈবোভয়করণং যদা তু পূর্ব্বদিনে সায়ংষষ্ঠীলাভ স্তদা পূর্ব্বোদ্যুর্ব্বোধনং পরদিনে সায়ং আমন্ত্রণং। যদা তূভয়দিনে সায়ং ষষ্ঠীলাভ স্তদা পরেহহ্নি ষষ্ঠ্যাং বোধনং উভয়দিনে সায়ং ষষ্ঠ্যভাবে পূর্ব্বাহে ষষ্ঠ্যাং বোধনং। (তিথিতত্ত্ব)
প্রতিপদাদি কল্প- আশ্বিন মাসের শুক্লপক্ষে নবরাত্রক বিধি অনুষ্ঠান করবে। প্রতিপদাদি ক্রমে মহানবমী পর্য্যন্ত যথাবিধানে পূজা করতে হবে। প্রতিপদে কল্পারম্ভ করে মহানবমী পর্য্যন্ত দেবীমাহাত্ম্য পাঠ ও পূজা করতে হবে। প্রতিপদে কেশসংস্কার দ্রব্য, দ্বিতীয়ায় পট্টডোর, তৃতীয়াতে দর্পণ, সিদুর ও অলক্তক, চতুর্থীতে মধুপর্ক, তিলক ও নেত্রমণ্ডল, পঞ্চমীতে অঙ্গরাগ ও যথাশক্তি অলঙ্কার, ষষ্ঠীতে সায়ংবিল্বতরুতে বোধন, সপ্তমীতে পূজান, অষ্টমীতে উপবাস ও অষ্টশক্তি পূজা, নবমীতে উগ্রচণ্ডা ও অন্যান্য দেবতার পূজা, বলিদান ও কুমারীপূজা করতে হবে, দশমীতে পূজা করেই বিসর্জন করতে হবে।
এভাবে বিধিদ্বারা যারা পূজা করে, তাদের সকল আপদ্ নাশ এবং পুত্র, দারা, ধন ও ধান্যাদি বিবিধ সুখ লাভ হয়; অন্তকালে এই দেহ পরিত্যাগ করে ভগবতীর গণ মধ্যে পরিগণিত হয়। এই বিধানকে নবরাত্রক বলে।
ষষ্ঠ্যাদিকল্প- ষষ্ঠীর দিন প্রাতঃকালে কল্পারম্ভ করে সায়ংকালে বিল্বশাখা ও ফলে দেবীর বোধন করবে, সপ্তমীতে বোধিত বিল্বশাখা এনে পূজা করতে হবে, অষ্টমীতে পূজা ও জাগরণ, নবমীতে প্রভূত বলিদান ও পূজা এবং দশমীতে শাবরোৎসব দ্বারা বিসর্জন করতে হবে।(ভবিষ্যপূরাণ)
সাধারণতঃ প্রায় এই তিন কল্প দেখা যায়, নবম্যাদি কল্প প্রতিপদাদিকল্প ও ষষ্ঠাদিকল্প। অনেক স্থলে এই ত্ৰিবিধ কল্পের মধ্যে যে কোন এক কল্পানুসারে দুর্গা পূজা হয়ে থাকে; কিন্তু কুলাচার অনুসারে যাঁদের যে কোন কল্পের বিধান থাকে, তারা সেই কল্পানুসারে পূজা করবে। যেহেতু কুলাচার উল্লঙ্ঘন করা শাস্ত্রসম্মত নয়।
কল্পারম্ভ হলে সেদিন থেকে মহানবমী পর্যন্ত পূজা ও বিজয়াদশমীতে বিসর্জন করতে হবে এবং প্রতিদিন দেবীমাহাত্ম্য ও ঋষিচ্ছন্দাদি পাঠ করতে হবে।
মাহাত্ম্যং ভগবত্যাশ্চ পুরাণাদিষু কীর্ত্তিতং।
পঠেচ্চ শৃণুয়াদ্বাপি সর্ব্বকামসমৃদ্ধয়ে ॥
পুরাণাদিতে কীর্ত্তিত ভগবতীর মাহাত্ম্য সকল কামনা সিদ্ধির নিমিত্ত পাঠ করবে। মার্কণ্ডেয়পুরাণ্বান্তর্গত চণ্ডীতে এভাবে লেখা আছে-
শরৎকালে মহাপূজা ক্রিয়তে যা চ বার্ষিকী।
তস্যাং মমৈতন্মাহাত্ম্যং শ্রুত্বা ভক্তিসমন্বিতঃ ॥
সর্ব্বাবাধাবিনির্ম্মুক্তো ধনধান্যসুতান্বিতঃ।
মনুষ্যো মৎপ্রসাদেন ভবিষ্যতি ন সংশয়ঃ ॥
শরৎকালে যে মহাপূজা হয়, তাতে আমার মাহাত্ম্য অবশ্য পঠনীয়, যারা ভক্তিপূর্বক এই দেবীমাহাত্ম্য পাঠ বা শ্রবণ করে, তারা সকল প্রকার বিপদ্ থেকে মুক্ত হয়। (চণ্ডিপাঠ শব্দ দেখ)
নবম্যাদি কল্পারম্ভ হতে মহানবমী পর্যন্ত প্রতিদিন একবার করে দেবীমাহাত্ম্য একবার পাঠ করলেই হয়। প্রতিদিন পাঠ করবার আবশ্যক কি? এতে রঘুনন্দন এরকম মীমাংসা করেছেন, একবার পাঠ করলে শাস্ত্রার্থ সিদ্ধ হয়, তথাচ ফলবাহুল্য হেতু পুনঃ পুনঃ পাঠ করা আবশ্যক।
প্রতিপদাদি কল্পে প্রতিপদ হতে মহানবমী পর্যন্ত ও ষষ্ঠ্যাদি কল্পে ষষ্ঠী হতে মহানবমী পর্যন্ত পাঠ করতে হবে। নবম্যাদি কল্পে নবমীতে বোধন করে পত্রীপ্রবেশ পূর্বদিনে অর্থাৎ ষষ্ঠীতে সায়ংকালে আমন্ত্রণ ও অধিবাস এবং নবমীর দিন বোধন করতে অসক্ত হলে ষষ্ঠীর দিন বোধন, আমন্ত্রণ ও দেবীর অধিবাস করতে হবে।
বোধন ও আমন্ত্রণের মন্ত্র ভেদানুসারেই পৃথকৃত্ব অর্থাৎ দুইটি ভিন্ন ভিন্ন মন্ত্রদ্বারা বোধন ও আমন্ত্রণ পৃথক, এইরুপ সূচিত হয়েছে।
বোধন মন্ত্র-
শ্রীবৃক্ষে বোধয়ামি ত্বাং যাবৎ পূজাং করোম্যহং ॥
ঐং রাবণোস্য বধার্থায় রামস্যানুগ্রহায় চ।
অকালে ব্রহ্মণা বোধো দেব্যাস্ত্বয়ি কৃতঃ পুরা ॥
অহমপ্যাশ্বিনে তদ্বৎ বোধয়ামি সুরেশ্বরীং।
শক্রেণাপি চ সংবোধং প্রাপ্তং রাজ্যং সুরালয়ে ॥
তস্মাদহং ত্বাং প্রতিবোধয়ামি বিভূতিরাজ্যপ্রতিপত্তিহেতোঃ।
যথৈব রামেণ হতো দশাস্য স্তথৈব শত্রূন্ বিনিপাতয়ামি ॥
আমন্ত্রণের মন্ত্র-
মেরুমন্দারকৈলাসহিমবচ্ছিখরে গিরৌ।
জাতঃ শ্ৰীফলবৃক্ষ ত্বং অম্বিকায়াঃ সদাপ্ৰিয়ঃ ॥
শ্রীশৈলশিখরে জাতঃ শ্রীফলঃ শ্ৰীনিকেতনঃ।
নেতব্যোহসি ময়া গচ্ছ পূজ্যো দুর্গা স্বরূপতঃ ॥
এই দুইটি মন্ত্রদ্বারা বোধন ও আমন্ত্রণ এই দুইটি পৃথক অর্থাৎ বোধনের সময় পূৰ্ব্বোক্ত বোধনমন্ত্র এবং আমন্ত্রণ সময়ে আমন্ত্রণের মন্ত্র পাঠ করতে হবে।
সপ্তম্যাদিকল্প।
আশ্বিনমাসের শুক্লা সপ্তমী হতে মহানবমী পর্য্যন্ত দেবীর পূজা করতে হবে। সপ্তমী তিথিতে কল্পারম্ভ করে নবপত্রিকা ও মৃণ্ময়ী ভগবতী প্রতিমাপূজা ও অষ্টমীতে মহাস্নান করাতে হবে। পঞ্চগব্য, গায়ত্রী, কম্বায়, পুষ্পরত্নাদি, তোয় প্রভৃতি এবং গীতবাদিত্রনাট্য সহকারে মহাস্নান করাতে হয়। পরে পূজা, নানাবিধ উপহারাদি দ্বারা নৈবদ্য ও তিলধান্যাদি সংযক্ত বিল্বপত্র দ্বারা হোম করতে হবে। সংসারে যে সকল কাম্য সুখ আছে, তাহা এই হোম দ্বারা হয় এবং দীর্ঘায়ু, পুত্র ও বিপুল ধনধান্যাদি লাভ হয়। নবমীতে এই বিধি অনুসারে পূজা এবং দেবীর প্রীতির নিমিত্ত বলি প্রদান করবে। এরূপ বিধি অনুসারে পূজা করলে ইহজন্মে বিবিধ ভোগ করে অন্তে দেবীপুরে গতি হয়।
আশ্বিনে শুক্লপক্ষে তু সপ্তম্যাদি দিনত্রয়ে।
তত্র পূজাবিশেষেণ কর্ত্তব্যা মম মানবৈঃ ॥
বিশেষং তত্র বক্ষ্যামি শৃণু পুত্রক সম্মতং।
সপ্তম্যাং পত্রিকাপূজা রম্ভাদি নবভির্য্যুতা ॥
মহীময়ী চ মূর্ত্তি র্মে পুত্রায়ুর্ধনবৃদ্ধয়ে।
অষ্টমী সা মহাপুণ্যা তিনিঃ প্রীতিকরী মম ॥
গায়ত্রীভিঃ কষায়ৈশ্চ গন্ধাদ্যৈস্তীর্থবারিভিঃ ॥
ওষধীভিশ্চ সর্ব্বাভি র্ভৃঙ্গারৈঃ কলসৈস্তথা।
গীতবাদিত্রনাট্যেন স্নাপয়েন্মাঞ্চ ভক্তিতঃ।
পূজা সদুপহারৈশ্চ নৈবেদ্যৈশ্চ মনোহরৈঃ ॥
বিল্বপত্রৈঃ ঘৃতাক্তৈশ্চ তিলধান্যাদিসংযুতৈঃ।
জুহুয়াজ্জ্বলিতে বহ্নৌ তস্য পুণ্যফলং শৃণু ॥
সংসারে যানি সৌখ্যানি কাম্যানি নরপুঙ্গব।
দীর্ঘমায়ুর্যশঃপুত্রং বিপুলং ধনধান্যকং।
লভতে মৎপ্রসাদেন অন্তে মম পুরং ব্রজেৎ ॥
অনেন বিধিনা যস্তু নবমীমতিবাহরেৎ।
ভুঙ্ক্তে চ বিপুলান্ ভোগানন্তে শিবপুরং ব্রজেৎ ॥
পত্রীপ্রবেশ-ব্যবস্থা-মূলানক্ষত্রযুক্ত সপ্তমী তিথিতে বা কেবল সপ্তমীতে পূর্ব্বাহ্ণ সময়ে পত্রীপ্রবেশ অর্থাৎ নবপত্রিকা স্থাপন করতে হবে, উভয় দিন যদি পূর্ব্বাহ্ণ লাভ হয়, তাহলে পরদিনে পত্রীপ্রবেশ হবে। এতে তিথিযুগ্মাদি আদরণীয় হবে না।
ততঃ সপ্তম্যাং মূলযুক্তায়াং কেবলায়াং উভয়ত্র পূর্ব্বাহ্ণে সপ্তমীলাভে পরত্র।
যুগাদ্যা বর্ষবৃদ্ধিশ্চ সপ্তমী পার্ব্বতী প্রিয়া।
রবেরুদয়মীক্ষন্তে ন তত্র তিথিযুগ্মতা ॥ (তিথিতত্ত্ব)
পূর্ব্বাহ্ণ সময়ে নবপত্রিকাপ্রবেশ অত্যন্ত শুভ এবং সকল সিদ্ধিদায়িনী। মধ্যাহ্ন সময়ে পত্রীপ্রবেশ জনপীড়ন ও ক্ষয়, সায়াহ্নকালে বধ, বন্ধন ও নানা প্রকার অশুভ হয়ে থাকে। এই জন্য পূর্ব্বাহ্ণ সময়ে নবপত্রিকা প্রবেশ প্রশস্ত।
নবপত্রিকা
কদলী, দাড়িমী, ধান্য, হরিদ্রা, মানক, কচু, বিল্ব, অশোক ও জয়ন্তীপত্র এই নয়টি নবপত্রিকা-
কদলী দাড়িমী ধান্যং হরিদ্রা মানকং কচুঃ।
বল্বোহশোকঃ জয়ন্তী চ বিজ্ঞেয়া নবপত্রিকা ॥ (তিথিতত্ত্ব)
পত্রীস্থাপন করে মৃণ্ময়ীমূর্ত্তির প্রাণ প্রতিষ্ঠা করতে হবে। কারণ দেবপ্রতিমার প্রাণোপ্রতিষ্ঠা না করলে তাতে দেবত্ব হয় না।
অন্যেষামপি দেবানাং প্রতিমাস্বপি পার্থিব।
প্রাণপ্রতিষ্ঠা কর্ত্তব্যা তস্যাং দেবত্বসিদ্ধয়ে ॥ (তিথিতত্ত্ব)
প্রাণপ্রতিষ্ঠার পর যথাবিধি নানা প্রকার উপহার দ্বারা, দেবীপূজা করতে হবে।
মহাষ্টমীর দিন উপবাস, নানা প্রকার উপহার ও বলিদ্বারা ভগবতীর পূজা করতে হবে। অষ্টমীতে বলিদানের বিষয় ব্যবস্থাপিত হয়েছে, কিন্তু দেবীপুরাণের বচনান্তরে লেখা আছে, অষ্টমীতে বলিদান করলে বংশনাশ হয়। এতে রঘুনন্দন এরূপ মীমাংসা করেছেন, অষ্টমীতে যে বলিদান নিষিদ্ধ হয়েছে, তা সন্ধিপূজাপর; কারণ সন্ধিপূজা অষ্টমীর শেষ দণ্ড ও নবমীর প্রথম দণ্ড, এই দুই দণ্ডের মধ্যে এই সন্ধিপূজা হয়, উভয় তিথিকৃত্য হেতু সাবকাশ স্থল হয়েছে, এজন্য ঐ অষ্টমীতে বলিদান না করে নবমীতে বলিদান নিষিদ্ধ, এরূপ অভিপ্রায় নচেৎ অন্যবচনে লিখিত আছে, অষ্টমীতে বলি প্রভৃতি উপহার দ্বারা দেবীর পূজা করতে হবে এই বচন নিরর্থক হয়।
অষ্টম্যাং পশুঘাতশ্রুতেঃ-
অষ্টম্যাং রুধিরৈর্ম্মাংসৈ মহামাংসৈঃ সুগন্ধিভিঃ।
পূজয়েন্বহুজাতীয়ৈর্ব্বলিভির্ভোজয়েচ্ছিবাং ॥
ইতি কালিকাপুরাণাচ্চ।
অষ্টম্যাং বলিদানেন পুত্রনাশো ভবেৎ ধ্রুবং।
ইতি দেবীপুরাণীয়ং। সন্ধিপূজাবলিদানপরং তৎপূজায়া উভয়তিথিকর্ত্তব্যত্বেন তদ্বলিদানস্য নবম্যাং সাবকাশত্বাৎ। (তিথিতত্ত্ব)
সন্ধিপূজা- অষ্টমী ও নবমীর সন্ধিতে যোগিনীগণের সাথে দেবীর পূজা করতে হবে। এতে অষ্টমীর শেষদণ্ড ও নবমীর প্রথমদণ্ড যে দেবীর পূজা করা যায়, তাহা অতিশয় ফলদায়ক; অষ্টমী ও নবমীর সন্ধি রাত্রিভাগেই প্রশস্ত অর্দ্ধরাত্রে দশগুণ, সন্ধ্যারাত্রে ত্রিগুণ ফলদায়ক। এই সন্ধিকালকে উমামহেশ্বরতিথি কহে।
অষ্টমী নবমী সন্ধ্যৌ তৃতীয়া থলু কথ্যতে।
তত্র পূজ্যাত্বহং পুত্র যোগিনীগণসংযুক্তা ॥
অষ্টম্যাঃ দেষদণ্ডশ্চ নবম্যাঃ পূর্ব্বএব চ।
অত্র যা ক্রিয়তে পূজা বিজ্ঞেয়া সা মহাফলা ॥
অষ্টমী নবমীযোগো রাত্রিভাগে বিশিষ্যতে।
অর্দ্ধরাত্রে দশগুণং সন্ধায়াং ত্রিগুণং ভবেৎ ॥
অষ্টমী নবমীযুক্তা নবমী চাষ্টমীষুতা।
অর্দ্ধনারীশ্বরপ্রায়া উমা মাহেশ্বরী তিথিঃ ॥ (তিথিতত্ত্ব)
মহাষ্টমী তিথিতে পুত্রবান্ ব্যক্তি উপবাস করবে না নবমীতে বিবিধ বলি প্রভৃতি উপহার দ্বারা দেবীর মধ্যে যে কোন একদিনে হোম করতে হবে, কিন্তু মহাষ্টমীর দিনে হোম প্রশস্ত। জপ ও স্তোত্রপাঠ করে নবমীর দিন দক্ষিণান্ত করতে হবে। দেবীর পূজোপচার সম্বন্ধে যাঁহার যে প্রকার শক্তি, তিনি সেই শক্ত্যনুসারে পূজা করবেন।
উপবাসং মহাষ্টম্যাং পুত্রবান্ন সমাচরেৎ।
যথা তথৈব পূতাত্মা ব্রতী দেবীং প্রপূজয়েৎ ॥
নবম্যাং বলিদান্তু কর্ত্তব্যং বৈ যথাবিধি।
জপং হোমঞ্চ বিধিবৎ কুর্য্যাত্তত্র বিভূতয়ে ॥ (তিথিতত্ত্ব)
মহাষ্টমীর দিনই উপবাস করতে হবে, মহাষ্টমী পূজার পর দিন যদি সন্ধিপূজা হয়, তাহলে সেদিন উপবাস হবে না।
মহানবমী পূজাকল্প-
আশ্বিন মাসে মহানবমীতে ভগবতীর পূজা করতে হবে।
লব্ধাভিষেকা বরদা শুক্লে চাশ্বযুজস্য চ।
তস্মাৎ সা তত্র সংপূজ্যা নবম্যাঞ্চণ্ডিকা বুধৈঃ ॥ (তিথিতত্ত্ব)
কেবল অষ্টমী ও কেবল নবমীকল্প-আশ্বিনমাসে মহাষ্টমী ও মহানবমী তিথিতে বিশুদ্ধভাবে ভগবতিকে যথা শক্ত্যুপচারে পূজা করতে হবে।
ভদ্রকালীং পটে কৃত্বা তত্র সংপূজয়েদ্দ্বিজঃ।
আশ্বিনে শুক্লপক্ষেস্য চাষ্টম্যাং নিরতস্ততঃ ॥ (বিষ্ণুধর্ম্ম)
উপোষিতো দ্বিতীয়েহহ্নি পূজয়েৎ পুনরেব তাং।
যস্ত্বেকস্যা যথাষ্টম্যাং নবম্যাং বাথ সাধকঃ।
পূজয়েদ্বরদাং দেবীং শুদ্ধভাবেন চেতসা ॥ (কালিকাপুরাণ)
অষ্টম্যাদি কল্পারম্ভে-অষ্টমী ও নবমী এই দুই দিন যথাবিহিত পূজাদি করতে হবে।
দুর্গার ধ্যান-
জটাজুট সমাযুক্তাং অর্ধেন্দু কৃতশেখরাম্।
লোচনত্রয় সংযুক্তাং পূর্ণেন্দু সদৃশাননাম্ ॥২॥
অতসীপুষ্প বর্ণাভাং সুপ্রতিষ্ঠাং সুলোচনাম্।
নবযৌবন সম্পন্নাং সর্ব্বাভরণ ভূষিতাম্ ॥৪॥
সূচারু দশনাং তদ্বৎ পীনোন্নত পয়োধরাম্।
ত্রিভঙ্গস্থান সংস্থানাং মহিসাসুরমর্দীনিম্ ॥৬॥
মৃণালায়াত সংস্পর্শ দশবাহু সমন্বিতাম্।
ত্রিশুলং দক্ষিণে ধ্যেয়ং খর্গং-চক্রং ক্রমাদধঃ ॥৮॥
তীক্ষ্ণবাণং তথা শক্তিং দক্ষিণেষু বিচিন্তয়েৎ।
খেটকং পূর্ণচাপঞ্চ পাশমঙ্কুশমেব চ ॥১০॥
ঘণ্টাং বা পরশুং বাপি বামতঃ সন্নিবেশয়েৎ।
অধস্থান মহিষং তদ্বৎবিশিরক্ষং প্রদর্শয়েৎ ॥১২॥
শিরোচ্ছেদোদ্ভবং তদ্বৎ দানবং খর্গ পাণিনম্।
হৃদি শুলেন নির্ভিন্নং নির্যদন্ত্র বিভূষিতম্ ॥১৪॥
রক্তারক্তী কৃতাঙ্গঞ্চ রক্তবিস্ফুরিতেক্ষণম্।
বেষ্টিতং নাগপাশেন ভ্রূকুটি ভীষণাননাম্ ॥১৬॥
সপাশ বামহস্তেন ধৃতকেশঞ্চ দুর্গয়া।
বমদ্রুধির বক্ত্রঞ্চ দেব্যা সিংহং প্রদর্শয়েৎ ॥১৮॥
দেব্যাস্তু দক্ষিণাং পাদং সমং সিংহোপরিস্থিতম্।
কিঞ্চিৎ ঊর্ধ্বং তথা বামঅঙ্গুষ্ঠং মহিষোপরি ॥২০॥
স্তুয়মানঞ্চ তদ্রূপ মমরৈঃ সন্নিবেশয়েৎ।
প্রসন্নবদনাং দেবীং সর্ব্বকাম ফলপ্রদাং ॥২২॥
উগ্রচন্ডা প্রচন্ডা চ চন্ডোগ্রা চন্ডনায়িকা।
চন্ডা চন্ডবতী চৈব চন্ডরূপাতিচন্ডিকা ॥২৪॥
অষ্টাভি শক্তিভিরষ্টাভিঃ সততং পরিবেষ্টিতাম্।
চিন্তয়েৎ জগতাং ধাত্রিং ধর্মকামার্থ মোক্ষদাম্ ॥২৬॥
দেবীর মাথায় জটা, সাথে অর্ধচন্দ্রের মত কপাল। পূর্ণিমার চাঁদের মত মুখ তাঁর ও গায়ের রঙ অতসীফুলের মতো। তিনি সদ্য যৌবনপ্রাপ্ত এবং তাঁর সর্বাঙ্গ বিভিন্ন অলঙ্কার দ্বারা ভূষিত। ।২-৪।
তাঁর দাঁত সুন্দর এবং ধারালো, স্তন সম্পূর্ণ। তিন ভাঁজে দাঁড়িয়ে তিনি দৈত্য নিধন করছেন। দশহাতভর্তি অস্ত্র তাঁর যা দেখতে শাখা-প্রশাখা সমন্বিত পদ্ম গাছের মতো। ডানদিকের উপরের হাতে অবস্থান করে ত্রিশুল, তারপর ক্রমান্বয়ে খর্গ এবং চক্র। ।৬-৮।
দেবীর দক্ষিণের সর্বনিম্ন দুই হাতের অস্ত্র ধারালো তীর এবং বর্শা। দেবীর ধ্যানে বর্ণিত হয় তাঁর বাঁ হস্ত। সেদিকে সবচেয়ে নিচের হাতে থাকে চামড়ার ঢাল ও তার উপরের হাতে ধনুক। সেগুলির উপরের হাতে থাকে সর্প, অঙ্কুশ এবং কুঠার (ক্রমান্বয়ে উপরের দিকে)। দেবীর পায়ের কাছে দৈত্যরাজের মাথার স্থান। ।১০-১২।
মহিষের কাটা মাথা থেকে মহিসাসুরের দেহ অর্ধেক উত্থাপিত, হাতে তাঁর খর্গ এবং হৃদয়ে দেবীর ত্রিশূল দ্বারা বিদ্ধ। তাঁর পেট থেকে নাড়িভূঁড়ি নির্গত হয়েছে। শরীর রক্তলিপ্ত। দেবীর হাতে ধরা সাপ দ্বারা অসুরের দেহ বেষ্টিত। তবে উত্থিত ভ্রূ তে দৈত্যের রূপও ভয়ঙ্কর। ।১৪-১৬।
দেবী তাঁর বাম হাত দিয়ে দৈত্যরাজের চুল টেনে রেখেছেন। দেবীর ডান পা বাহন সিংহের উপরে এবং বাঁ পা কিঞ্চিৎ উর্ধে মহিষের উপরে অবস্থান করে। প্রবল যুদ্ধরত অবস্থাতেও দেবী তাঁর শান্তিপূর্ণ মুখাবয়ব ও আশীর্বাদী রূপ বজায় রেখেছেন এবং সমস্ত দেবতা দেবীর এই রূপের স্তুতি করেন। ।১৮-২২।
দেবীর উপরোক্ত রূপ দেবতাদের আট শক্তি উগ্রচন্ডা, প্রচন্ডা, চন্ডোগ্রা, চন্ডনায়িকা, চন্ডা, চন্ডবতী, চন্ডরূপ ও অতিচন্ডিকা দ্বারা পরিবেষ্টিত। গৃহকর্তার মানব জীবনের সমস্ত ইচ্ছা পূর্ণ করেন এই দেবী। তাই ধর্ম, অর্থ, কাম ও মোক্ষ লাভের জন্য জগন্মাতৃকা দেবী দুর্গার ধ্যানই মানবজাতির হওয়া উচিত। ।২৪-২৬।
এই মন্ত্রে দেবীর ধ্যান করে মহাস্নানপূর্ব্বক ষোড়শোচার ও বলিদানাদি দ্বারা পূজা করতে হবে এবং আবরণ ও দেবতা পূজা করবে। এরূপে সপ্তমী, অষ্টমীও নবমী পূজা করবে।
বিজয়াদশমীকৃত্য- উক্তরূপে পূজা সমাপন করে দশমী দিনে বিসর্জ্জন করতে হবে।
‘চরলগ্নে বিসর্জ্জয়েৎ’ এই বচনানুসারে চরলগ্নে বিসর্জ্জন করতে হবে। যদি চরলগ্ন না পাওয়া যায়, তাহলে কেবল তিথিতেই বিসর্জ্জন করতে হবে। দেবীর যাত্রাকালে নিমজ্জন করতে হয়, তারপর বিসর্জ্জন করতে হবে, নৌযান বা নরযান দ্বারা ভগবতী শিবাকে নিয়ে ক্রীড়া কৌতুক আদি মঙ্গলদ্বারা স্রোতোজলে নিক্ষেপ করতে হবে।
দুর্গে দেবী জগন্মাতঃ স্বস্থানং গচ্ছ পূজিতে।
সংবৎসরব্যতীতে তু পুনরাগমনায় চ।
নিমজ্জান্তসি দেবি ত্বং চণ্ডিকা প্রতিমা শুভা।
পুত্রায়ুর্ধনবৃদ্ধ্যর্থং স্থাপিতাসি জলে ময়া ॥
বিসর্জ্জন করে গৃহে আগমন করে অচ্ছিদ্রাবধারণ করবে। তারপর ঘটস্থিত জল দ্বারা এই মন্ত্র যজমানকে অভিষেক করতে হবে।
অভিষেকমন্ত্র-
ওঁ উত্তিষ্ঠ ব্রহ্মণস্পতে যজন্তস্ত্বেমহে দেবা উপপ্রয়ন্ত মরুতঃ সুদানবে ইন্দ্রপ্রায়ুর্ভবা সচা।
ওঁ সুরাস্ত্বামভিষিঞ্চন্তু ব্রহ্মাবিষ্ণু মহেশ্বরাঃ।
বাসুদেবো জগন্নাথ স্তথা সঙ্কর্ষণঃ প্রভু ॥
প্রদ্যুয়শ্চানিরুদ্ধশ্চ ভবন্তু বিজয়ায় তে।
আখণ্ডলোগ্নির্ভগবান্ যমো বৈ নৈঋতস্তথা ॥
বরুণঃ পবনশ্চৈব ধনাধ্যাক্ষস্তথা শিবঃ।
ব্রহ্মণা সহিতো শেষো দিক্পালাঃ পান্তু তে সদা ॥
কীর্ত্তির্লক্ষ্মীর্ধ্বতির্মেধা পুষ্টিঃ শ্রদ্ধা ক্ষমা মতিঃ।
বুদ্ধির্লজ্জা বপুঃ শান্তিঃ পুষ্টিঃ কান্তিশ্চ মাতরঃ ॥
এতাভিস্তাভিষিঞ্চস্তু ধর্ম্মপালাঃ সুসংযতাঃ।
আদিত্যশ্চন্দ্রমা ভৌমো বুধজীবসিতার্কজাঃ ॥
গ্রহাস্ত্বামভিষিঞ্চন্তু রাহুকেতুশ্চ তর্পিতা।
ঋষয়ো মুনয়ে গাবো দেবমাতর এব চ।
দেবপত্ন্যোহধ্বরা নাগা দোইত্যাশ্চাপ্সরসাং গণাঃ।
অস্ত্রাণি সর্ব্বশস্ত্রাণি রাজানো বাহনানি চ।
ঔষধানি চ রত্নানি কালস্যাবয়বাশ্চ যে ॥
সরিতঃ সাগরাঃ শৈলাস্তীর্থানি জলদা হ্রদাঃ।
দেবদানবগন্ধর্ব্বা যক্ষরাক্ষসপন্নগাঃ।
এতে ত্বামভিষিঞ্চন্তু ধর্ম্মকামার্থসিদ্ধয়ে ॥ (বৃহন্নন্দিকেশ্বরপুরাণ)
এই বিজয়া দশমীর দিন অপরাজিতা পূজা করতে হবে। এই দশমী তিথিতে রাজাদের বিজয়যাত্রা করতে হয়, এই যাত্রা অতিশয় শুভদায়ক। যদি দশমী উল্লঙ্ঘন করে-নৃপগণ যাত্রা করে; তাহলে তার রাজ্যে সংবৎসরের মধ্যে কোন বিজয় হবে না।
দশমীং যঃ সমুল্লঙ্ঘ্য প্রস্থানং কুরুতে নৃপঃ।
তস্য সংবৎসরং রাজ্যে ন ক্বাপি বিজয়ো ভবেৎ ॥ (তিথিতত্ত্ব)
স্বয়ং যাত্রা করতে অশক্ত হলে খড়গাদির যাত্রা করতে হবে। এই বিজয়া দশমীর দিন দুর্গানাম জপ করতে হবে, যে কোন বিপদ্ হোক না কেন দুর্গানাম জপ করলে তা দুর হয়।
দুর্গা দুর্গেতি দুর্গেতি দুর্গানামং পরং মনুং।
যো জপেৎ সততং চণ্ডি জীবন্মুক্তঃ স মানবঃ ॥
মহোৎপাতে মহারোগে মহাবিপদি সঙ্কটে।
মহাদুঃখে মহাশোকে মহাভয়সমুত্থিতে ॥
যঃ স্মরেৎ সততং দুর্গাং জপেৎ যঃ পরমং মনুং।
স জীবলোকো দেবেশি নীলকন্ঠত্বমবাপ্নুয়াৎ ॥ (মুণ্ডমালাতঃ)
প্রাতঃকালে উঠে যারা দুর্গানাম স্মরণ করে, তাদেরও কোন বিপদ হয় না। দুর্গানাম ভবসমুদ্র উদ্ধারের একমাত্র তরণি স্বরূপ। ভক্তিপূর্বক দুর্গানাম করে যে যা চায়, সে তা প্রাপ্ত হয়। দুর্গানামে সকল বিপদ দূর হয়। দুর্গাদেবীর বিসর্জন হওয়ার পর সম্বৎসরের শুভাশুভের নিমিত্ত দুর্গামণ্ডপে বসে দুর্গানাম জপ করে যাত্রা করবে। দেবীকে বিসর্জন করে এসে পিতা, মাতা ও গুরুজনদের প্রণাম ও আত্মীয়, স্বজন, বন্ধু বান্ধবদের প্রেমালিঙ্গনে সম্ভাষণ করতে হয়।
বঙ্গবাসী হিন্দুদের দুর্গোৎসবই সৰ্ব প্রধান উৎসব বলে গণ্য। বৎসরান্তে এমন মহাপূজার ধুমধাম আর কোন দেশে দেখা যায় না। দুর্গাপূজার তিন দিন বাঙ্গালি হিন্দুমাত্রেই অন্য সকল কৰ্ম পরিত্যাগ করে এই মহোৎসবে যোগদান করেন। হিন্দুগণ ভাবেন, এমন দিন আর আসবে না। এই কয় দিন আমরা যেভাবে কাটাব, সারাবৎসর তেমনি যাবে। তাই এই কয় দিন সকলেই নব বেশে নবোল্লাসে মহাসুখী হওয়ার চেষ্টা করেন এবং দেবীর কাছে নিজের মনের কথা প্রকাশ করে কৃতকৃতাৰ্থ জ্ঞান করেন। পূজার চতুর্থ দিন অর্থাৎ বিজয়ার দিন বৎসরের মধ্যে প্রধান দিন বলে গণ্য। মহামায়াকে বিসর্জন দিয়ে এসে মনের আবেগে শান্তির জল গ্রহণ করে জাতীয় সজ্জন একত্র হন। সকল অত্যাচার দুর্ব্যবহার ভুলে গিয়ে শক্রকেও কোলে নিয়া থাকেন। এ সময় শক্রমিত্র জ্ঞান থাকে না, সকলেই পরস্পরে কোলাকুলী করেন, আশীর্বাদ নমস্কারাদি করে থাকেন।
বঙ্গের সর্বত্রই কাৰ্ত্তিক, গণেশ, লক্ষ্মী, সরস্বতী প্রভৃতি পরিবৃত দশভূজা দুর্গার মৃণ্ময়ী প্রতিমার পূজা হয়। বাংলাদেশ ভিন্ন আর কোথাও এমন মৃণ্ময়ী প্রতিমার পূজা হতে দেখা যায় না। আর্য্যাবর্ত্ত ও দাক্ষিণাত্যের অপরাপর স্থানে যেখানে ভগবতীর শক্তিমূর্ত্তি প্রতিষ্ঠিত আছে, সেখানেই ঐ কয়দিন দেবীপূজা ও উৎসাবাদি হয়ে থাকে। অনেক স্থানে ঘটস্থাপন করেও মহাদেবীর পূজা হয়ে থাকে। বাংলা ভিন্ন অপর সকল স্থানে এই উৎসব ‘দশেরা’ নামে খ্যাত। দুর্গোৎসব উপলক্ষে যেমন এ দেশে চণ্ডীপাঠ হয়, দশেরার কয়দিন দাক্ষিণাত্যের নানাস্থানে ঘরে ঘরে বেদপাঠ হয়ে থাকে।
বিশ্বকোষ, দুর্গাদাস লাহিড়ী
সঙ্কলনে-কৃষ্ণকমল
You must be logged in to post a comment.