“শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা রসামৃত” ভূমিকা


।।শ্রীহরিঃ।।
“শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা রসামৃত”

।।শ্রীহরিঃ।। "শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা রসামৃত"
।।শ্রীহরিঃ।। “শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা রসামৃত”

বসুদেবসুতং দেবং কংসচাণূরমর্দনম্‌।
দেবকীপরমানন্দং কৃষ্ণং বন্দে জগদ্‌গুরুম।।
অর্থ-কংস ও চাণূর নামক দুই মহাদৈত্যের বিনাশকর্তা ; মাতা দেবকীর পরমানন্দ স্বরূপ ; বসুদেবের পুত্র জগদ্গুরু ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে বন্দনা করি।।

সনাতন ধর্মের তিনটি শ্রেষ্ঠমার্গ(প্রস্থানত্রয়ী)-শ্রীমদ্‌ভগবদ্‌গীতা, উপনিষদ্‌ ও ব্রহ্মসুত্র । শ্রীমদ্‌ভগবদ্‌গীতা এই তিন প্রস্থানত্রয়ীর অন্যতম, মহাভারতের  ভীষ্মপর্বের ১৮টি অধ্যায়ের (১৮-২৫) অন্তর্গত ।
শ্রীমদ্‌ভগবদ্‌গীতা সম্বন্ধে বলা হয়েছে-
সর্বোপনিষদো গাবো দোগ্ধা গোপালনন্দনঃ।
পার্থো বৎসঃ সুধীর্ভোক্তা দুগ্ধং গীতামৃতং মহৎ।।
‘উপনিষদ্‌ হচ্ছে সর্বশাস্ত্রের সার আর গীতা হচ্ছে উপনিষদের সারাৎসার। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ গোপালরুপে এই গাভীরুপী উপনিষদ্‌ হতে এবং পার্থরুপী বৎস সামনে রেখে দুগ্ধরুপী গীতার নির্যাস সুধীজনকে (ভক্তজনে) বিলিয়ে দিয়েছেন ।’

শ্রীমদ্‌ভগবদ্‌গীতার ৭০০টি শ্লোকের মধ্যে ধৃতরাষ্ট্রের-০১, সঞ্জয়ের- ৪১, অর্জুনের- ৮৪ এবং অবশিষ্ট ৫৭৪টি শ্লোক স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ কথিত ।

শ্রীমদ্‌ভগবদ্‌গীতা ও শ্রীমদ্ভাগবত ও শ্রীচণ্ডীর মতো ষট সংবাদরুপে পরিবেশিত হয়েছে। কিন্তু শ্রীমদ্ভাগবত বা শ্রীচণ্ডীর মতো গীতা শুরুতেই ষট প্রশ্ন এবং তার ব্যাখ্যা দিয়ে বিস্তৃত হয়নি । শ্রীমদ্‌ভগবদ্‌গীতায় অর্জুন কৃত দ্বাদশটি প্রশ্ন আছে সমগ্র গীতাব্যাপী এবং ভগবানও যেমন যেমন সংশয় এসেছে তেমন তেমন নিরসন করেছেন ।

সৃষ্টির আদিতে পরমাত্মার সংকল্প জাগে যে ‘আমি সৃষ্টি করব’, ‘আমিই বহুরুপে ধারণ করব’। ‘একৈবাহং বহুস্যাম প্রজাজেয়’।
কিন্তু সৃষ্টি কেন ? ‘সৃষ্টা তু লীলা কৈবল্যম্‌’।
এ হচ্ছে পরমাত্মার সঙ্গে জীবাত্মার লীলাখেলা আর ভগবানের এই খেলায় জগৎ-সংসার, শরীরাদি হচ্ছে তাঁর খেলার সামগ্রী। জীবসকল কিন্তু এই প্রকৃত খেলা ভুলে, খেলার সামগ্রী অর্থাৎ শরীরাদিকে নিজস্ব ব্যক্তিগত সম্পত্তি মনে করে ভ্রান্ত ব্যবহারে প্রবৃত্ত হয় এবং ভগবৎ বিমুখ হয়ে পড়ে । জীব যাতে ঈশ্বরমুখী হয় এবং ভগবানের সঙ্গে তার নিত্য যোগ(সম্বন্ধ) খুঁজে পায় সেইজন্য যোগশাস্ত্ররুপী ভগবদ্‌গীতার আবির্ভাব । গীতায় তাই যোগের মাহাত্ম্য অনেক এবং একে যোগশাস্ত্র(ভগবানের সঙ্গে ভক্তের যুক্ত হওয়ার পথ) বলা হয়েছে ।

তবে জীবাত্মা ও পরমাত্মার, ভক্ত ও ভগবানের, যোগী ও ঈশ্বরের পার্থক্য অনেক । ভগবানের যে জগৎসংসারের উৎপত্তি, স্থিতি, প্রলয় ইত্যাদির সামর্থ্য আছে, সে ক্ষমতা যোগীর থাকে না, ব্রহ্মসুত্র বলছেন ভক্ত ‘জগৎ ব্যাপারবর্জম্‌'(ব্রহ্মসূত্র, ৪/৪/১৯) অর্থাৎ যোগীর জগৎ সংসার নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা থাকে না । তাঁর ক্ষমতা হয় কেবল সংসারের ওপর বিজয়প্রাপ্তির, সংসারের অনুকূল পরিস্থিতির প্রভাব তাঁর প্রতি না পড়ার ওপর ।

গীতায় অর্জুন যুদ্ধ নিয়ে প্রশ্ন করেননি, তিনি তাঁর কল্যাণ প্রার্থনা করেছিলেন। ভগবান তাই শাস্ত্রাদিতে যতপ্রকার কল্যাণকর সাধন প্রনালী আছে যথা- কর্মযোগ, জ্ঞানযোগ, ভক্তিযোগ, ধ্যানযোগ, হঠযোগ, লয়যোগ, প্রানায়াম, যজ্ঞ, দান, তপ ইত্যাদি সকল সাধন প্রানালীই গীতায় সংক্ষেপে অথচ পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বর্ণনা করেছেন । গীতায় কোথাও কাউকে সম্প্রদায় বা সাধনপথ পরিবর্তনের কথা বলা হয়নি, বলা হয়েছে পরিমার্জনের কথা; তাই সাধকজগতে শ্রীমদ্‌ভগবদ্‌গীতা বিশেষভাবে সমাদৃত । তবে সমস্ত যোগ বা ভগবানের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার সকল সাধনের মধ্যে ‘কর্মযোগ’, ‘জ্ঞানযোগ’ ও ‘ভক্তিযোগ’ই বিশেষভাবে প্রচলিত । তাই ভগবান গীতায় এই তিনটি যোগই মুখ্যরুপে বলেছেন । ভাগবতেও শ্রীকৃষ্ণ উদ্ধব সংবাদে ভগবান বলেছেন-

যোগাস্ত্রয়ো ময়া প্রোক্তা নৃণাং শ্রেয়োবিধিৎসয়া।
জ্ঞানং কর্ম চ ভক্তিশ্চ নোপায়োন্যোহস্তি কুত্রচিৎ।।(ভাগবত ১১/২০/৬)
‘নিজ কল্যাণকামী ব্যক্তিগণের জন্য আমি তিনটি যোগপথ বলেছি -জ্ঞানযোগ, কর্মযোগ অ ভক্তিযোগ । এই তিনটি ছাড়া কল্যাণ লাভের আর কোন পথ নাই।’

এর মধ্যে যাঁর কর্মে অধিক রুচি ও আগ্রহ থাকে তিনি কর্মযোগের অধিকারী, যাঁর মধ্যে নিজেকে জানার আগ্রহ প্রবল তিনি জ্ঞানযোগের অধিকারী এবং যাঁর মধ্যে ভগবানে শ্রদ্ধা ও বিশ্বাস বেশি তিনি ভক্তিযোগের অধিকারী । এই সকল যোগপন্থাই পরমাত্মা প্রাপ্তির পৃথক পৃথক সাধন এবং আর যা কিছু সাধন আছে সবই এই তিন সাধনার অন্তর্গত ।

জ্ঞানযোগে বিবেকের (জানার) প্রাধান্য এবং ভক্তিযোগে শ্রদ্ধার (মানার) প্রাধান্য থাকে । প্রকৃতপক্ষে পরমাত্মাকে জানার ও মানার বিষয়ে জাগতিক কোনো উদাহরণই দেওয়া সম্ভব নয়; কারণ জগৎকে জানার ও মানার ব্যাপারে মন ও বুদ্ধির সাহায্য নিতে হয় কিন্তু পরমাত্মাকে জানার ও মানার ব্যাপারে মন ও বুদ্ধির কোনো ভূমিকাই নাই কারণ পরমাত্মার অনুভব স্ব-স্বরুপে হয়, মন-বুদ্ধির দ্বারা নয় ।
যেমন একটি স্ত্রী ও পুরুষের বিবাহ পরস্পরকে জানলে বা কথা বললে হয় না, যখন তারা পরস্পরকে গ্রহণ করে তখনই বিবাহ সংঘটিত হয়, সেইরকম যখন স্বয়ং নিজে জড় সংস্কার পরিত্যাগ করে পরমাত্মাকে গ্রহণ করে তখনই যোগ সংঘটিত হয়, তাঁরা যুক্ত হন । কর্মযোগে সকল প্রাণীতে আত্মভাবই জড়ভাবকে পরিত্যাগ করায় । জ্ঞানযোগে স্বয়ংই স্বয়ংকে (আত্মস্বরুপ) জেনে জড়ভাবকে পরিত্যাগ করায় । জ্ঞানযোগে স্বয়ংই স্বয়ংকে (আত্মস্বরুপ) জেনে জড়ভাব পরিত্যাগ করে এবং ভক্তিযোগে স্বয়ংই ভগবানের শরনাগত হয়ে জড়ভাব পরিত্যাগ করে ।

শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার প্রথম অধ্যায়টির নাম ‘অর্জুনবিষাদযোগ’ অর্থাৎ অর্জুনের মোহের বর্ণনা । আসক্তিতে মোহ’র শুরু এবং আত্মা-উপলব্ধিতে মোহ’র অন্ত (মোক্ষসন্ন্যাসযোগ-অষ্টাদশ অধ্যায়), এই হচ্ছে গীতার বর্ণনা ।
বস্তুত গীতা উপদেশের প্রারম্ভের বীজ হচ্ছে প্রথম অধ্যায়ের শেষ শ্লোকটি-
এবম্‌ উক্তাঃ অর্জুন সংখ্যে রথোপস্থ উপবিশত্ ।
বিশৃজ্য সশরম চাপম্‌ শোক সংবিগ্ন মানসঃ ।১/৪৭
‘অতঃপর অর্জুন বিষাদযুক্তভাবে গাণ্ডীব ধনু পরিত্যাগ করে এবং যুদ্ধ না করার মনস্থ করে রথে উপবেশন করলেন।’
এই মোহজনিত অবস্থা থেকে অর্জুনের ক্রম উত্তরণ হয়েছে প্রতি অধ্যায়ে এবং তাঁর পূর্ণতা প্রাপ্ত হয়েছে অষ্টাদশ অধ্যায়ে । অর্জুনের পরের পর প্রশ্নের ধারাতেই তা বোঝা যায় ।

যদিও সমগ্র গীতায় বিভিন্ন স্থানে অর্জুন মোট ২৯টি প্রশ্ন করেছেন, তবে আলোচ্য বইটিতে আমরা সগুলি সংযোজিত করে মুখ্যরুপে ১২টি প্রশ্নের মাধ্যমে আলোচনা করিব ।
দ্বিতীয় থেকে নবম(ও আংশিক দশম)অধ্যায় অর্জুন শ্রীকৃষ্ণকে আটটি প্রশ্ন করেছেন তা মূলত কর্মজনিত সংশয় সম্বন্ধে ।
দশম অধ্যায়ে বিভূতিযোগ ও একাদশ অধ্যায়ের বিশ্বরুপদর্শনযোগ মূলত শ্রদ্ধা ও বিস্ময়ভরা অর্জুনের আকুতি ও স্তুতি ।
অর্জুনের পরবর্তী ৪টি প্রশ্ন (দ্বাদশ হতে অষ্টাদশ অধ্যায়) অনেক পরিণত এবং জ্ঞান ও ভক্তি পরিপ্লুত ।
শেষ অধ্যায়ে এসে অর্জুনের প্রশ্ন সমাপ্ত, সংশয় তিরোহিত । তিনি বলেছেন-
নষ্টঃ মোহ স্মৃতি লব্ধা তত্ প্রসাদাত্ ময়া অচ্যুত ।
স্মিতঃ অস্মি গত সন্দেহঃ করিষ্যে বচনম তব ।।৭৩
অর্থ-অর্জুন বললেন, হে কৃষ্ণ, হে অচ্যুত তোমার কৃপায় এখন আমার মোহ দুর হয়েছে। আমার স্মৃতি ফিরে এসছে এবং আমার সমস্ত সন্দেহ দুর হয়েছে। আমি এখন তোমার নির্দ্দেশ অনুসারে আচরন করব।

সংকলনে- #কৃষ্ণকমল ।