জীবনে গুরু বা আচার্যের স্থান কি ঈশ্বরের থেকেও গুরুত্বপূর্ণ ?


 

শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা স্কুল's photo.
প্রাচীন আর্য সমাজে শিক্ষক বা গুরুর স্থান কতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল‚ বোঝা যায় যখন ছাত্র-শিক্ষক বা গুরু-শিষ্য পরম্পরাকে সম্মানিত করতে একটি দিন উৎসর্গ করা হয় | তৎকালীন সমাজব্যবস্থায় অন্য কোনও সম্পর্ক এতটা গুরুত্ব পেয়েছে কি না সন্দেহ | গুরু বা শিক্ষককে শ্রদ্ধা জানাতে বৈদিক যুগ থেকেই পালিত হয়ে আসছে গুরু পূর্ণিমা | আজ‚ শিক্ষক দিবসের আড়ালে অনেকটাই ম্রিয়মাণ এই তিথি | আষাঢ় মাসের পূর্ণিমা‚ যাকে ডাকা হয় ‘গুরুপূর্ণিমা‘ নামে |
সংস্কৃতে ‘গূ‘ শব্দের অর্থ হল অন্ধকার | গুরু শব্দের মানে হল যিনি অন্ধকার দূর করেন | শিক্ষক বা গুরু আমাদের মনের সব সংশয়‚ সন্দেহ‚ অন্ধকার‚ জিজ্ঞাসা দূর করেন | নতুন পথের দিশা দেখান | তমসা থেকে জ্যোতির্ময়ের পথে চালিত করেন গুরু | হিন্দিতে একটা প্রবচন আছে‚ ‘ গুরু গোবিন্দ দুয়ো খাড়ে‚ কাকে লাগু পায় / বালিহারি গুরু আপনে যিন গোবিন্দ দিয়ো বতায়ে ‘ অর্থাৎ‚ এমন একটা পরিস্থিতি‚ যখন গুরু এবং গোবিন্দ বা ঈশ্বর দুজনেই সামনে দাঁড়িয়ে আছেন‚ আমি কাকে প্রথম পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করব ? তার পরের লাইনেই আছে সমাধান | যদি ঈশ্বর এবং গুরু দুজনে সামনে থাকেন‚ আগে গুরুর পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করবে | কৃতজ্ঞতা জানাবে | কারণ তিনিই আমাদের ঈশ্বরকে চেনান |
বৌদ্ধ ধর্মেও গুরুপূর্ণিমার গুরুত্ব অসীম | বলা হয়‚ বোধিজ্ঞান লাভের পরে আষাঢ় মাসের পূর্ণিমায় প্রথম উপদেশ দেন গৌতম বুদ্ধ | আজকের উত্তরপ্রদেশের সারনাথে | আবার হিন্দু পুরাণে আছে শিবের মাহাত্ম্য | মহাদেব হলেন আদি গুরু | তাঁর প্রথম শিষ্য হলেন সপ্তর্ষির সাতজন ঋষি—-অত্রি‚ বশিষ্ঠ‚ পুলহ‚ অঙ্গীরা‚ পুলস্থ্য‚মরীচি এবং ক্রতু ( নাম নিয়ে মতভেদ আছে) | আদিযোগী শিব এই তিথিতে আদিগুরুতে রূপান্তরিত হন | তিনি এদিন ওই সাত ঋষিকে মহাজ্ঞান প্রদান করেন | তাই‚ এই তিথি হল গুরুপূর্ণিমা |
ভারতের অনেক জায়গায় গুরু পূর্ণিমাকে মহাঋষি বেদব্যাসের জন্মতিথি হিসেবেও মানা হয় | যদিও তিনি ছিলেন ঋষি পরাশর এবং মৎস্যগন্ধা সত্যবতীর জারজ সন্তান | জন্মের পরে তাঁকে পরিত্যাগ করেন জন্মদাত্রী সত্যবতী | এই অবৈধ সন্তানই মহাঋষিতে পরিণত হন | সম্পাদনা ও পরিমার্জনা করেন চতুর্বেদের | ১৮ টি পুরাণ ছাড়াও রচনা করেন মহাভারত এবং শ্রীমদ্ভগবৎ | বলা হয়‚ আষাঢ় মাসের পূর্ণিমা তিথিতেই জন্ম হয়েছিল ব্যাসের |
প্রাচীন সভ্যতার মূলে থাকত চন্দ্র সূর্যের অবস্থান | তাই‚ পূর্ণিমা অমাবস্যাকে ঘিরে আবর্তিত হত বিভিন্ন পালা পার্বণ | গুরু পূর্ণিমার ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি | তবে প্রবর্তনের পিছনে যে কারণই থাক না কেন‚ এর উদ্দেশ্য আচার্যকে সম্মান প্রদান করা | শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের এই তিথির আদর্শ শ্লোক হল
‘ গুরুর্ব্রহ্মা গুরুর্বিষ্ণু‚ গুরুর্দেবো মহেশ্বরঃ |
গুরুরেব পরং ব্রহ্মম তস্মৈ শ্রীগুরবে নমঃ ‘ |
অর্থাৎ জীবনে গুরুই হলেন ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর | তিনিই আমাদের সৃষ্টি-স্থিতি-লয়ের জ্ঞান বা পরম ব্রহ্মজ্ঞান দান করেন | সেই গুরুর উদ্দেশে প্রণাম জানাই |

শ্রী শ্রী কৃষ্ণদ্বৈপায়ণ বেদব্যাস বিরচিতম্-শ্রীমদ্ভাগবতম্-


শৃণ্বন্তি গায়ন্তি গৃণন্তভীক্ষ্নশঃ স্মরন্তি নন্দন্তি তবেহিতং জনাঃ।
ত এব পশ্যন্তচিরেণ তাবকং ভবপ্রবাহোপরমং পদাম্বুজম্ ।। [১/৮/৩৬]
তস্মাৎ সর্ব্বাত্মনা রাজন ! হরিঃ সর্ব্বত্র সর্ব্বদা।
শ্রোতব্যঃ কীর্ত্তিতব্যশ্চ স্মর্ত্তব্যো ভগবান্ ণৃনাম্।। [২/২/৩৬]

কুন্তিদেবীর উক্তি –
হে কৃষ্ণ! যে সকল মানব তোমার লীলাকথা নিরন্তর শ্রবণ করেন, কীর্ত্তন করেন, শিষ্যদের উপদেশ করেন, অভিনন্দিত করেন, সেই সকল মানব অচিরেই জন্মমরণ-প্রবাহরূপ সংসার-নিবর্ত্তক তোমার চরণ-কমল দর্শন করিয়া থাকেন।

শ্রীশুকের উক্তি –
অতএব, হে রাজন্! শ্রীহরি সকল অবস্থায়, সকল সময়ে, সর্ব্বান্তকরণে মানবগণের শ্রবণীয়, কীর্ত্তনীয় ও স্মরণীয়।

উৎসর্গ

ব্রজরস মাধুর্য্য লোলুপতায় ব্রজবনে পাগলপারা
সেই মাধুর্য্যামৃত শ্রীশ্রীপ্রভু জগদ্বন্ধুসুন্দরে প্রকট
কৃপা-স্বপ্নে ইহা জানিয়া
উন্মত্তপ্রায় আসেন ছুটিয়া
শ্রীঅঙ্গনে বন্ধুসুন্দরের চরণতলে
লভিলেন প্রভুর সেবা-ভাগ্য অসীম আর্ত্তিবলে
মহানাম প্রচারণে যিনি মহাশক্তিমান
চরণে আশ্রয় দিয়া করেন সর্ব্বজনে বন্ধুসুন্দরে দান
যাঁর কৃপা আশীর্ব্বাদে হইয়াছি ধন্য
যাঁর স্নেহ ভালোবাসায় জীবনপাত্র পূর্ণ
ব্রহ্মচর্য্যের মূর্তি সকলর দাদা
সেই পরম পূজ্যপাদ প্রদর্শক আচার্য্য

শ্রীশ্রীপাদ মহেন্দ্রজী’র

শ্রীকরকমলে
জীবনসহ এই ভক্তি-অর্ঘ্য
নিত্য-সমর্পিত

মহানামব্রত ব্রহ্মচারী

ব্যাসদেব


ব্যাসদেব
ব্যাসদেব

~~~~~~~~~~~~~~~~
অন্যান্য নাম : কৃষ্ণ-দ্বৈপায়ন, দ্বৈপায়ন, বাদরায়ণ, বেদব্যাস।
ইনি পৌরাণিক মহাকাব্য মহাভারত, অষ্টাদশ মহাপুরাণ ও উপপুরাণ, বেদান্তদর্শন, ভাগবত প্রভৃতির রচয়িতা এবং বেদের বিভাগকর্তা ঋষি।পরাশর মুনি সত্যবতীর সাথে মিলিত হলে, সত্যবতী গর্ভবতী হন। পরে যমুনা’র একটি দ্বীপে এঁর জন্ম হয়। যমুনার দ্বীপে জন্মগ্রহণ করেন বলে এর নাম হয় দ্বৈপায়ন। এঁর গায়ের রঙ কালো ছিল বলে, পুরো নাম দাঁড়ায় কৃষ্ণ-দ্বৈপায়ন। এঁর মাথায় কপিল বর্ণের জটা ছিল। তাঁর চোখ ছিল উজ্জ্বল ও মুখে পিঙ্গল বর্ণের দাড়ি ছিল। ইনি তপস্যাবলে মহর্ষিত্ব প্রাপ্ত হয়ে বেদকে চার ভাগে ভাগ করেছিলেন। এই কারণে ইনি বেদব্যাস বা ব্যাস নামে পরিচিত হন। জন্মের পরপরই ইনি তাঁর মায়ের অনুমতি নিয়ে তপস্যার জন্য যাত্রা করেন। এঁর তপস্যার স্থান ছিল বদরিকাশ্রম। এই কারণে ইনি বাদরায়ণ নামেও পরিচিত ছিলেন।
মহাভারতের মতে– ইনি মহাভারত লিপিবদ্ধ করার জন্য ব্রহ্মার কাছে একজন লিপিকার নিয়োগের পরামর্শ গ্রহণ করতে গেলে- ব্রহ্মা গণেশকে নিয়োগ করতে বলেন। গণেশ এই শর্তে লিপিকার হতে সম্মত হলেন যে, লিপিবদ্ধ করার সময় ইনি ক্ষণমাত্রও থামবেন না। ব্যাস তাতে রাজী হয়ে অপর একটি শর্ত জুড়ে দিয়ে বললেন যে, গণেশ কোন বাক্যের অর্থ সম্পূর্ণ না বুঝে লিপিবদ্ধ করতে পারবেন না। এরপর গণেশ এই শর্তে রাজী হলে– মহাভারত লিখা শুরু হয়।ব্যাসদেব তাঁর শ্লোক রচনার মাঝে মাঝে কিছু জটিল শ্লোক রচনা করেতন- গণেশ এই শ্লোকগুলির অর্থ বুঝে লিখতে যে সময় ব্যয় করতেন, সেই সময়ের মধ্যে ব্যাসদেব আরও অনেক শ্লোক বানিয়ে ফেলতেন।
ব্যাসদেব একটি পুত্র লাভের আশায় সুমেরু পর্বতে মহাদেবের তপস্যা করতে থাকেন। শতবর্ষ আরাধনার পর মহাদেব তাঁকে পুত্রলাভের বর দেন। ব্যাসদেব পুত্র সন্তানের নাম রাখেন শূক।
কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের সময় ব্যাসদেবের বরেই সঞ্জয় দিব্যচক্ষু লাভ করেন। এই দৃষ্টির বলে তিনি অন্ধ ধৃতরাষ্ট্রকে যুদ্ধের যথাযথ বিবরণ দিতে সমর্থ হয়েছিলেন। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের পর কুরু-পাণ্ডব রমণীদের ইনি জাহ্নবী থেকে উত্থিত মৃত আত্মীয়-স্বজনদের প্রত্যক্ষ করান। জ্ঞাতিবধের পাপস্খলনের জন্য ইনি যুধিষ্ঠিরকে অশ্বমেধ-যজ্ঞ করতে উপদেশ দেন।
গৌতমের রচিত ন্যায়শাস্ত্রের ত্রুটি ধরার কারণে, গৌতম ক্রুদ্ধ হয়ে বলেছিলেন যে, চোখ দিয়ে ব্যাসদেবের মুখ দেখবেন না। পরে ব্যাস অনুনয়-বিনয় দ্বারা গৌতমকে প্রসন্ন করলে, তিনি ব্যাসদেবের মুখদর্শনের ইচ্ছা পোষণ করেন। কিন্তু প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ হবে,- এই বিবেচনায় গৌতম তাঁর পায়ে চোখ স্থাপন করে ব্যাসদেবের মুখ দেখেছিলেন। সেই থেকে গৌতমের অপর নাম অক্ষপাদ।
ইনি বেদকে শতশাখাযুক্ত চার ভাগে বিভক্ত করে বেদব্যাস নামে অভিহিত হয়েছেন।
ব্যাসদেব অষ্টাদশ মহাপুরাণ ও উপপুরাণ রচনা করে খ্যাতি অর্জন করেন। বেদান্তদর্শন রচনাও ব্যাসদেব অন্যতম কৃতিত্ব।
বিষ্ণু অবতার ও কৃষ্ণ জীবনকথা নিয়ে রচিত ব্যাসদেবের এই অনবদ্য রচনায় মোট বারোটি স্কন্দ (সর্গ) ও প্রায় ১৮,০০০ শ্লোকে রয়েছে। হিন্দু সমাজে সুপরিচিত বহু উপকথার উৎসভাগবত পুরাণ।
তিনি বেদকে চার ভাগে ভাগ করেছিলেন এবং তার চার শিষ্যকে এক একটি বেদের সংরক্ষণ ও প্রচারের দায়িত্ব অর্পণ করেছিলেন । এই কারণে ইনি বেদব্যাস নামে খ্যাত হন। তাঁর এই পরিকল্পনার ফলেই দেশের ও জাতির বিপর্যয় এবং বিধর্মীদের হাতে কোটি কোটি হিন্দু হত্যা, হাজার হাজার মন্দির ও শাস্ত্র ধংসের পরেও হিন্দু ধর্মের ও সমাজের ভিত্তি —বেদ হারিয়ে যায় নি।
ভগবান ব্যাস পৃথিবীর বৃহত্তম ও মহত্তম মহাকাব্য মহাভারত, অষ্টাদশ মহাপুরাণ ও অষ্টাদশ উপপুরাণ, ব্রহ্মসূত্র প্রভৃতির রচয়িতা এবং বেদের বিভাগকর্তা ঋষি। কলিযুগে সনাতন হিন্দু ধর্মের বর্তমান কাঠামো অনেকটাই ব্যাসদেবের নির্মিত । শৈব -শাক্ত- বৈষ্ণব -দ্বৈতবাদী -অদ্বৈতবাদী নির্বিশেষে সনাতন হিন্দু ধর্মের সব সম্প্রদায়-ই কোন না কোন সূত্রে ব্যাসের জ্ঞান , ভক্তি, তপস্যা , জীবকল্যানের আদর্শের সাথে যুক্ত আছেন। সেকারনে তিনি সনাতন হিন্দু সমাজের সার্বজনীন গুরু।