তুলসীর বিষয়ে আধুনিক বৈজ্ঞানিক গবেষনাগারের ফলাফল বনাম বৈদিক ঋষিদের সিদ্ধান্ত!!


বৈষ্ণবীয় সাহিত্যে তুলসী সেবন লীলা বিষয়ে এভাবে লেখা হয়েছে-

“তুলসীর ভক্তি এবে শুন মন দিয়া।
যেরুপে কৈলেন লীলা তুলসী লইয়া এক ক্ষুদ্র ভান্ডে দিব্য মৃত্রিকা পূরিয়া ।
তুলসী দেখেন সেই ঘটে আরোপিয়া প্রভু বলে আমি তুলসীরে না দেখিলে ।
ভাল নাহি বাসোঁ যেন মত্স্য বিনে জলে ।।
যবে চলে সংখ্যা নাম করিয়া গ্রহণ তুলসী লইয়া অগ্রে চলে একজন ।।
পশ্চাতে চলেন প্রভু তুলসী দেখিয়া পড়য়ে আনন্দ ধারা
শ্রীঅঙ্গ বহিয়া সংখ্যা নাম লইতে যে স্থানে প্রভু বৈসে ।
তথায় রাখেন তুলসীরে প্রভু পাশে তুলসীরে দেখেন জপেন সংখ্যা আন ।।
এ ভক্তিযোগের তত্ত্ব কে বুঝিবে আন ।
পুনঃ সেই সংখ্যা নাম সম্পূর্ণ করিয়া । চলেন ঈশ্বর সঙ্গে তুলসী লইয়া।। ।।“
….. চৈঃ ভাঃ অঃ ১৫৪ -১৬১

তুলসী পাতা এতই পবিত্র যে, এটি একমাত্র পরমেশ্বর ভগবান শ্রীবিষ্ণুর পাদপদ্ম ব্যতীত অন্য কোন দেবতা বা দেবীর চরনে তুলসীপাতা অর্ঘ্য হিসাবে দেয়া যায় না। অবশ্য লক্ষ্মীদেবীর পুজোয় তুলসী পাতার প্রয়োজন হয় না। এছাড়া সকল দেবতা দেবী পূজোর ভোগে তুলসী পাতা ও মঞ্জুর অত্যাবশ্যক। তুলসী পাতা ভিজানো জল ছটা গৃহাদি পবিত্র করনের কাজে ব্যবহার করা হয়। গভীর ধর্মীয় আঙ্গিকে হিন্দু সমাজে তুলসী গাছের এতো মহিমা প্রচার করে এবং তদানুযায়ী এর পূজন ও যত্ন করা হয়।

এখন দেখা যাক বৈজ্ঞানিক ও প্রায়োগিক ব্যাখ্যায় তুলসীগাছ বিষয়ে কি বলা আছে –

তুলসী (Tulsi/Holy Basil/ thai Krapho) একটি Lamiaceae family এর অন্তর্গত সুগন্ধি জাতীয় উদ্ভিদ যার বৈজ্ঞানিক নাম Ocimum sanctum (sanctum অর্থ পবিত্র স্থান) । হাজার হাজার বছর ধরে সাধারণত হিন্দু পরিবারে কৃষ্ঞ ও রাধা তুলসী এই দুই প্রকারে প্রাপ্ত তুলসী হিন্দু গৃহে পবিত্রতার প্রতীক হিসেবে পূজিত হয়ে আসছে। এর পিছনে গভীর রয়েছে ধর্মীয়,পরিবেশগত ও বৈজ্ঞানিক কারণ ।

ধর্মীয় কারণ :
ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে তুলসীকে সীতাস্বরূপা, স্কন্দপুরাণে লক্ষীস্বরূপা, চর্কসংহিতায় বিষ্ণুর ন্যায় ভুমি, পরিবেশ ও আমাদের রক্ষাকারী বলে বিষ্ঞু প্রিয়া, ঋকবেদে কল্যাণী বলা হয়েছে । স্বয়ং ভগবান বিষ্ঞু, তুলসীদেবীকে পবিত্রাবৃন্দা বলে আখ্যায়িত করে এর সেবা করতে বলেছেন।

পরিবেশগত কারণ :
সাধারণতঃ উদ্ভিদ মাত্র দিনে অক্সিজেন ও রাতে কার্বডাইঅক্সাইড ত্যাগ করে। পরীক্ষা করে দেখা গেছে যে তুলসীগাছ একমাত্র উদ্ভিদ যা দিন ও রাত চব্বিশ ঘণ্টা অক্সিজেন সরবরাহ করে বায়ু বিশুদ্ধ রাখে। যেখানে অন্য যেকোন গাছ রাত্রিতে কার্বন ডাই অক্সাইড ত্যাগ করে তাই রাতের বেলাতে তুলসীতলায় শয়ন করাও ব্যক্তির জন্য উপকারী। এছাড়া তুলসীগাছ ভুমি ক্ষয় রোধক এবং তুলসী গাছ লাগালে মশা কীটপতঙ্গ ও সাপ থেকে দূরে রাখে।

বৈজ্ঞানিক ও স্বাস্থ্যগত কারণ:
তুলসীতে Eugenolঅধিক পরিমাণে থাকায় তা Cox-2 Inhibitorরূপে কাজ করে বলে তা ব্যথানাশক হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
• Hypoglycemic drugs এর সাথে তুলসী খেলে তা টাইপ ২ ডায়াবেটিস রোগে দ্রুত গ্লুকোজের মাত্রা কমিয়ে দেয়।
• তেজস্ক্রিয়তার ফেলে ক্ষতিগ্রস্থ কোষসমুহকে মেরামত করে।
• চর্বিজনিত হৃদরোগে এন্টি অক্সিডেন্টের ভুমিকা পালন করে।
• তুলসী একশেরও বেশি Phytochemicals(যেমন oleanolic acid ,beta caryophyllene ইত্যাদি)বহন করে বলে ক্যান্সার চিকিত্সালয় ব্যবহৃত হয়।
• তুলসীর অ্যালকোহলিক নির্যাস Immune system এর রোগ প্রতিরোধ করার ক্ষমতাকে বৃদ্ধি করে।
• তুলসী স্নায়ুটনিক ও স্মৃতিবর্ধক।
• শ্বসনতন্ত্রের বিভিন্নরোগ যেমন ব্রঙ্কাইটিস, ইনফ্লুয়েঞ্জা ,হাঁপানি প্রভৃতি রোগের নিরাময়ক।
• সর্দি ,কাশি, জ্বর, বমি, ডায়ারিয়া, কলেরা, কিডনির পাথর, মুখের আলসারসহ চোখের বিভিন্ন রোগে ইহা ওষুধ হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
• দাঁতের রোগে উপশমকারী বলে টুথপেস্ট তৈরিতে ব্যবহার করা হয়।

তুলশী পাতার এতো ভেজস গুন সেটি আধুনিক বৈজ্ঞানিক গবেষনার ভিত্তিতে প্রমাণিত সত্যি। একারণে শিক্ষিত সভ্য সমাজের এর কদর বেড়েছে। কিন্তু আজ থেকে হাজার হাজার ধরে হিন্দুরা তুলশীর মর্যাদা দিয়ে আসছেন আদি ঋষিদের সিদ্ধান্তমতে। আর্য ঋষিরা বিভিন্ন পুরাণ, মহাপূরান কিংবা সংহিতার তুলশির বিষয়েে বলেছেন -“যারা প্রত্যহ তুলসীর দর্শন, স্পর্শন, ধ্যান, গুণ কীর্তন, প্রণাম, গুণশ্রবন, রোপন, জল প্রদান ও পূজা এই নয় প্রকারে তুলসীর ভজনা করেন তারা সহস্র কোটি যুগ পর্যন্ত বিষ্ঞুলোকে বসতি লাভ করেন”। হিন্দুরা তুলশীকে পরিবারের অবিচেছদ্য অংশ ও অতীব গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসাবে বিবেচনা করে। নিত্য কর্ম হোক, পূজা কিংবা পার্বণ, বিবাহ কিংবা মৃতে অথবা যে কোন শুভ কাজে তুলশী চাই ই চাই। তুলশী না হলে হিন্দুদের সকল মাঙ্গলিক কর্মই বন্ধ থাকে।

আদিরা ঋষিরা জানতেন তুলশীর ভেজস গুন এবং সেজন্য এটির পরিচর্যা, ব্যবহার ও সেবনের পরামর্শ দিয়ে গেছেন। এখন প্রশ্ল হল হাজার হাজার বছর আগেতো কোন ল্যাব ছিলো না, যে গবেষনা করে তার ফলাফল লিখে দিতে পারে। তখন কিসের ভিত্তিতে ঋষিরা তুলসী গাছের এতো গুন আবিস্কার করেছিলেন? তাহলে শুধু তুলশীর দ্বারাই কি প্রমাণিত হয় না -বৈদিক ঋষিদের বাণী অখন্ডনীয়, অপরিবর্তণীয়?

অরুন চন্দ্র মজুমদার
mojumderarun69@gmail.com