প্রশ্নঃ ভগবান মানবের ন্যায় সাকার রূপ ধারণ করে সীমা-বিশিষ্ট হলে তাঁর অনন্ত ভাব বজায় থাকে কিভাবে ?


উত্তরঃ- তুমি মূর্খের ন্যায় কথা বলছ, অনন্ত হতে কি বিযুক্ত হওয়া যায়? প্রচণ্ড হিমে অনন্ত সমুদ্রের কোন স্থান যদি জমাট বেঁধে বরফে পরিণত হয়, তাহলে কি সেটা সমূদ্রের সাথে বিযুক্ত হয়? ফলত, আধারগত জীব অনন্তের ধারণা করতে পারে না, এক পাত্র জলে যার তৃষ্ণা নিবৃত্তি হয়, সমুদ্র জলের পরিমাণ করতে বৃথা প্রয়াস করা তার পক্ষে বিড়ম্বনা মাত্র, এজন্য মহাকাশের মধ্যে গৃহাকাশের ন্যায় শ্রীভগবান সাধকের ভাব ও ধারণা অনুযায়ী, আকার ধারণ করেন জানিও, পূর্বে এ সম্বন্ধে তোমাকে বিশেষ ভাবে বুঝিয়েছি, সুতরাং এখন তার পুনরায় উল্লেখ করা নিষ্প্রয়োজন। অপর কিছু জিজ্ঞাস্য থাকলে বল।

ক্রমশঃ
শ্রীহরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়।

শ্রীভগবান গীতায় বলেছেন ‘আমার চোখ কান আদি সর্বস্থানেই আছে,’ এর ভাব উপলব্ধি করতে পারছি না।


উত্তরঃ চোখ কান আদি ইন্দ্রিয়দের দ্বারা যে দেখা ও শুনার কাজ হয় প্রথমে তার মূল কি- তা হৃদয়ঙ্গম কর, মৃত্যুর পরে চোখ-কান অবয়ব বর্তমান থাকতেও যখন কেউ দেখতে বা শোনতে পায় না তখন এটা নিশ্চিত যে, কেবল চোখ-কান’ই দেখা-শোনার কর্তা নয়, এরা দ্বার স্বরূপ উপলক্ষ্য মাত্র। ঘরের ভিতরের মানুষ দ্বার খুলে বাইরের বস্তু দেখে বা শোনে, কিন্তু সেই মানুষ যখন ঘরের বাইরে যায়, তখন কেবল দ্বারের যেমন দেখা বা শোনার শক্তি থাকে না, তেমনি সেই সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম চৈতন্য বস্তু যা জীবদেহে অণূ রূপে বিরাজমান আছেন, যাঁর শক্তি মন বুদ্ধিতে প্রতিবিম্বিত হয়ে ইন্দ্রিয়দের পরিচালিত করছে, যিনি দেখা-শোনা সকল শক্তির কেন্দ্র স্বরূপ, যে অনোরণীয়ান্‌(ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জীবাত্মা-রূপে অণোরণীয়ান্‌) চৈতন্যের মহান্‌ জ্যোতিঃ প্রাণের চালক রূপে দেহভাণ্ডের মধ্যে ব্যাপ্ত, তিনিই জগৎ ব্রহ্মাণ্ডে মহতোমহীয়াণ(জগদাত্মারূপে মহতোমহীয়ান) রূপে পৃথিবী আদি পঞ্চভূতের প্রাণ স্বরূপে বিরাজমান আছেন জানবে। অতএব অণুতে যে শক্তি নিহিত আছে, অণূর সমষ্টি সরূপ বিরাটে তা অনন্ত ভাবে থাকবেই, সূক্ষ্ম জ্ঞান দৃষ্টির অভাবে যদিও আমরা সেই সর্বব্যাপী চৈতন্য সত্ত্বাকে প্রত্যক্ষ করতে পারি না, কিন্তু সময় বিশেষে সংসার সাগরের ঘুর্ণাবর্ত্তে পড়ে যখন মোহ জনিত অহঙ্কারের অসারতা বোধ হয়, চিন্তা শ্রোত যখন নশ্বর জগতের অতীত স্থানে চলে যায়, তখন কার্য দেখে কারণের ভাব উপলব্ধি হয় মাত্র, ফলত সাধনার দ্বারা জ্ঞানদৃষ্টির উন্মেষ না হলে পেচকের সূর্য্যালোক দেখার মত চৈতন্য জ্যোতি কে প্রত্যক্ষ করতে পারা যায় না, যুক্তির দ্বারা পরোক্ষ বোধ হয় বটে কিন্তু প্রত্যক্ষ করতে না পারলে তিনি যে সর্বদ্রষ্টা তার অপরোক্ষ বোধ হতে পারে না, পরোক্ষ বোধ আচ্ছন্ন হতে পারে কিন্তু অপরোক্ষ বোধে সে ভয় নেই।
শ্রবণের দ্বারা যে পরোক্ষ জ্ঞান অর্জন করেছ, সাধনের দ্বারা সেটাকে অস্থিমজ্জাগত করে যদি অপরোক্ষ জ্ঞান বা নিশ্চয়াত্মিকা বুদ্ধিতে পরিণত করতে পার, তবে চৈতন্য বিভূতির রসাস্বাদ করতে সক্ষম হবে ও ক্রমে এই রস পান করার লালসা যত বৃদ্ধি হবে, ভাব স্রোতে হৃদয় ততই পূর্ণ হতে থাকবে, পরে ভাবের পূর্ণতা হলে সেই রসের উৎস স্বরূপ শ্রীভগবানকে চাক্ষুষ প্রত্যক্ষ করতে সক্ষম হবে।

প্রশ্ন- শেষ কথাটি ভাল বুঝতে পারলাম না।

উত্তর- ভাই! লবনের সত্ত্বা সমুদ্র জলের সর্বস্থানে ব্যাপ্ত, যে কোন স্থান থেকে জল নিয়ে জিহবায় দিলে আস্বাদ পাওয়া যায় ও এই আস্বাদ পাওয়াকে অনুভব প্রত্যক্ষ বলে, কিন্তু সেই লবণকে চাক্ষুষ প্রত্যক্ষ করতে হলে যেমন তাপের আবশ্যক হয়, তেমনি পঞ্চভূতের প্রতি অণুতে যে চৈতন্য সত্ত্বা বিদ্যমান আছে, অপরোক্ষ জ্ঞানের দ্বারা তাঁর সেই সর্বব্যাপিত্ব ও সর্বশক্তি মত্ত্বার প্রত্যক্ষ্যানুভব হয়, সাধক এই সময়ে রসলোলুপ হয়ে ভাবাশ্রয় করলে ঐ ভাবের তাপে চিৎ পরমাণু সকল ঘণীভূত হয়ে সাধকের বাসনা অনুযায়ী আকার ধারণ পূর্বক চাক্ষুষ প্রত্যক্ষের বিষয়ীভূত হন।

ক্রমশঃ
শ্রীহরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়।

গীতা সম্বন্ধীয় প্রশ্নোত্তর নং- ২৫


প্রশ্নঃ- যিনি বহু জন্ম ধরে সাধন করে এসেছেন ও সিদ্ধ হয়েছেন তিনিই পরমগতি প্রাপ্ত হন (৬/৪৫)। তাহলে যে সব মানুষ অনেক জন্ম সংসিদ্ধ নন অর্থাৎ পূর্বের অনেক জন্মে সাধনা করে সিদ্ধ হননি, তাঁরা এই জন্মে কীভাবে উদ্ধার পেতে পারেন ?

উত্তরঃ- এই শ্লোকটি যোগভ্রষ্টের প্রসঙ্গে বলা হয়েছে। পূর্বের মনুষ্যজন্মে সংসারে বীতরাগ হয়ে সাধনা করাতে শুদ্ধি লাভ হয়েছে কিন্তু জীবনের অন্তিমক্ষণে সাধনায় বিচলিত হওয়ায় তাঁর হয়তো স্বর্গাদি ফল প্রাপ্তি হল এবং সেখানে ভোগে অরুচি হওয়ায় শুদ্ধি প্রাপ্তি হয় এবং শুদ্ধাচারী এবং শ্রীসম্পন্ন ব্যক্তিদের গৃহে জন্ম হয়। এই জন্মে পরমাত্মাপ্রাপ্তির জন্য সাধনা করায় তাঁর শুদ্ধি হয়। এইরুপ তিন জন্মে শুদ্ধি ঘটাকেই বহুজন্মের দ্বারা সিদ্ধিলাভ বলা হয়। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, মানুষমাত্রই বহুজন্ম-সংসিদ্ধ অর্থাৎ বর্তমান মনুষ্য জন্মের পূর্বে সে যদি স্বর্গাদিলোকে গিয়ে থাকে, তাহলে স্বর্গাবাস দ্বারা পুণ্যের ফল ভোগ করায় পুণ্যফল থেকে শুদ্ধ হয়েহে আর যদি নরকবাস ঘটে, তাহলে সে পাপের ফল নরক ভোগ করে পাপ থেকে শুদ্ধ হয়েছে। আর যদি চুরাশি লক্ষ জন্ম প্রাপ্ত হয়, তাহলে চুরাশী লক্ষ জন্মের দ্বারা প্রাপ্ত কর্মফল ভোগ করে তার শুদ্ধি হয়েছে। এইভাবে শুদ্ধ হওয়াকেই বহুজন্ম দ্বারা সিদ্ধি প্রাপ্ত হওয়া বলা হয়। সুতরাং প্রত্যেক মানুষোই নিজের উদ্ধার ও কল্যাণ করতে পারে। প্রত্যেক মানুষই ভগবৎপ্রাপ্তির অধিকারী। যদি মানুষ ভগবৎপ্রাপ্তির অধিকারী না হয়, তাহলে ভগবান কেন এই মনুষ্য শরীর দেবেন ?

উদ্ধৃত শ্লোক-

প্রযত্নাদ্ যতমানস্তু যোগী সংশুদ্ধকিল্বিষঃ ৷
অনেকজন্মসংসিদ্ধস্ততো যাতি পরাং গতিম্॥৬/৪৫॥

অর্থ:- যোগী ইহজন্মে পূর্বজন্মকৃত যত্ন অপেক্ষা অধিকতর যত্ন করে পাপ মুক্ত হয়ে পূর্ব পূর্ব জন্মের সাধন সঞ্চিত সংস্কার দ্বারা সিদ্ধি লাভ করে পরম গতি লাভ করেন।

তথ্যসূত্র- গীতা দর্পণ(স্বামী রামসুখদাস)

গীতা সম্বন্ধীয় প্রশ্নোত্তর নং-২৪


প্রশ্নঃ- গীতাতে কোথাও বলা হয়েছে যে সাত্ত্বিক, রাজসিক, তামসিক ইত্যাদি গুণ ভগবান থেকে উৎপন্ন (৭/২২), কোথাও বলা হয়েছে প্রকৃতি থেকে উৎপন্ন(১৩/১৯, ১৪/৫), আবার কোথাও স্বভাবজাত বলে বর্ণনা করা হয়েছে (১৮/৪১)। তাহলে গুণগুলি ঠিক ঠিক কোথা হতে উৎপন্ন, ভগবান থেকে, না প্রকৃতি থেকে, নাকি স্বভাব থেকে ?

উত্তরঃ- যেখানে ভক্তির প্রকরণ আছে, সেখানে গুণগুলি ভগবান থেকে উৎপন্ন বলা হয়েছে, যেখানে জ্ঞানের প্রকরণ সেখানে বলা হয়েছে গুণগুলি প্রকৃতিজাত এবং যেখানে কর্ম্বিভাগের বর্ণনা আছে সেখানে গুণগুলি স্বভাবজাত বলে বর্ণিত হয়েছে। ভগবান সকলের প্রভু, সুতরাং প্রভুর দৃষ্টিতে যদি দেখা জ্যায় তাহলে গুণগুলি ভগবান থেকেই উদ্ভুত। সব কিছু উৎপত্তির কারণ প্রকৃতি, কারণের দৃষ্টিতে দেখলে গুণসমূহ প্রকৃতি হতে জাত। আবার ব্যবহারিক দৃষ্টিতে গুণগুলি প্রাণীদের স্বভাব থেকে উৎপন্ন হয়। এর তাৎপর্য এই যে, গুণগুলি প্রভুর বিবেচনায় ভগবানের থেকে জাত,কারণের দৃষ্টিতে প্রকৃতির এবং সাংসারিক আভিব্যক্তির দৃষ্টিতে ব্যক্তির নিজস্ব।সুতরাং তিনটি কথাই ঠিক।

উদ্ধৃত শ্লোক-

স তয়া শ্রদ্ধয়া যুক্তস্তস্যারাধনমীহতে।
লভতে চ ততঃ কামান্ময়ৈব বিহিতান্ হি তান্॥৭/২২॥

অর্থ:- সেই ব্যক্তি শ্রদ্ধাযুক্ত হয়ে সেই দেবতার আরাধনা করেন এবং সেই দেবতার কাছ থেকে আমারই দ্বারা বিহিত কাম্য বস্তু অবশ্যই লাভ করেন।

ইতি ক্ষেত্রং তথা জ্ঞানং জ্ঞেয়ং চোক্তং সমাসতঃ।
মদ্ভক্ত এতদ্বিজ্ঞায় মদ্ভাবায়োপপদ্যতে॥১৩/১৯॥

অর্থ:- এভাবেই ক্ষেত্র, জ্ঞান ও জ্ঞেয়- এই তিনটি তত্ত্ব সংক্ষেপে বলা হল। আমার ভক্তই কেবল এই সমস্ত বিদিত হয়ে আমার ভাব লাভ করেন।

সত্ত্বং রজস্তম ইতি গুণাঃ প্রকৃতিসম্ভবাঃ।
নিবধ্নন্তি মহাবাহো দেহে দেহিনমব্যয়্ম্॥১৪/৫॥

অর্থ:- হে মহাবাহো ! জড়া প্রকৃতি থেকে জাত সত্ত্ব, রজ ও তম- এই তিনটি গুণ এই দেহের মধ্যে অবস্থিত অব্যয় জীবকে আবদ্ধ করে।

ব্রাহ্মণক্ষত্রিয়বিশাং শূদ্রাণাং চ পরন্তপ।
কর্মাণি প্রবিভক্তানি স্বভাবপ্রভবৈর্গুণৈঃ॥১৮/৪১॥

অর্থ:- হে পরন্তপ ! স্বভাবজাত গুণ অনুসারে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্রদের কর্মসমূহ বিভক্ত হয়েছে।

তথ্যসূত্র- গীতা দর্পণ