উত্তরঃ- ভাই! মানবের কর্ম অনুয়ায়ী গুণ ভেদে এই বর্ণ ভেদ শ্রীভগবানের ইচ্ছাতেই হয়েছে, ঋষিদের মধ্যে দিয়ে তিনিই জীবের ও সমাজের কল্যানের জন্য এই বর্ণাশ্রম ধর্মের প্রতিষ্ঠা করেছেন, যতদিন হিন্দুর রাজত্ব ছিল এবং সমাজের উপর রাজার ও রাজার উপর সূক্ষ্মদৃষ্টিসম্পন্ন ঋষিদের কর্ত্তৃত্ব ছিল, ততদিন এই বর্ণাশ্রম ধর্ম সমাজ দেহের প্রকৃত পুষ্টি সাধন করেছিল। আপন আপন অধিকার অনুয়ায়ী কর্ম করে সকলেই ক্রম উন্নতির দিকে অগ্রসর হচ্ছিল, ঋষি গণ জ্ঞান যোগে শ্রীভগবানের সাথে যুক্ত থাকায় প্রকৃতিকে বিশ্লেষণ করতে পারতেন, মানবের বাইরের অবয়ব দেখে তার অন্তর্নিহিত গুণের পরিমাণ করে রাজ শক্তির সাহায্যে তাকে উচ্চ বা নীচ বর্ণে উন্নীত বা অবনত করতেন, কষ্ঠি পাথরের সংস্পর্শে যেমন স্বর্ণ নিজের প্রকৃত গুণ লুকাতে পারেনা তেমনি ঋষিদের জ্ঞান দৃষ্টির নিকট সাধারণের গুণ অনুযায়ি বর্ণ প্রকাশিত হয়ে পড়ত, তাঁরা শ্রীভগবানের আদেশ জন সাধারণের নিকট প্রচার করার মধ্যবর্ত্তী স্বরূপ ছিলেন, কিন্তু হায়! এখন আর সে দিন নাই, রাজসিক মালিন্যের আধিক্য বশতঃ হিন্দু রাজগণ অধার্মিক হয়ে ঋষিগণের মধ্যবর্ত্তিতা আগ্রাহ্য করায় হিন্দু ধর্মের এই অধঃপতন! মোহ বশে শ্রীভগবানের মঙ্গলময় বিধান অবহেলা করার ফলে হিন্দু গণ আজ শক্তিহীন, এদিকে কলির প্রাধান্যে সনাতন ধর্মকে আচ্ছন্ন হতে দেখে প্রকৃত বর্ণ নির্ণয় করে সে অনুয়ায়ি ব্যবহার করার জ্ঞানাভাব বশত সমাজ এখন বর্ণ শঙ্করে প্লাবিত!! এই জন্যই সাধুগণ সমাজের সাথে ঘনিষ্ট সম্বন্ধ রাখেন না, গুণগত বর্ণ জ্ঞান থাকায় তাঁরা জন্মগত বর্ণের বিশুদ্ধতাস্বীকার করেন না, হয়ত জন্মগত শূদ্র বর্ণের মধ্যে গুণগত ব্রহ্মণত্ব দেখে তার সঙ্গ করেন, আবার জন্মগত ব্রাহ্মণের মধ্যে চণ্ডালত্ব দেখে তার ছায়া স্পর্শ করেন না।
ভাই! বর্ণাশ্রম ধর্মের বিশুদ্ধতা নষ্ট হওয়াতেই হিন্দু ধর্মের মহান্ ভাব মেঘাচ্ছন্ন তপনের ন্যায় তেজোহীন হয়ে পড়েছে, কেননা বর্ণজ্ঞান না থাকলে সঙ্গ নির্বাচিত হয় না, সুতরাং অসৎ সঙ্গের সংযোগে হৃদয়ে মলিন ভাব সঞ্চারিত হয়ে মনকে অবনত করে, ফলে মন মুঢ় ভাবাপন্ন ও ভ্রান্ত হয়ে রোগ, শোক ইত্যাদি আশান্তির দ্বারা তাড়িত হয়ে সংসার চক্রে ঘুর্ণিত হয়।
গীতায় ভগবান্ বলছেনঃ- চাতুর্ব্বণ্যং ময়া সৃষ্টং গুণকর্ম্ম বিভাগশঃ
অর্থাৎ গুণ জনিত কর্মের বিভাগ পূর্বক আমি চার বর্ণের সৃষ্টি করেছি। অতএব এটি নিশ্চয় যে বর্ণভেদ ঐশ্বরিক বিধান, এবং তাঁর বিধান অনুসারে সংসার পথে চলাই ধর্ম, কিন্তু হায়! জীব ভ্রমজ্ঞানে আচ্ছন্ন থাকায় তাঁর মঙ্গলময় বিধানের প্রকৃত মর্ম উপলব্ধি করতে পারে না, মধু জিহ্বায় না দিয়ে কানে ঢাললে যেমন কষ্টের কারণ হয়, তেমনি তাঁরা বর্ণের প্রকৃত তত্ত্ব ও ব্যবহার সম্বন্ধে অজ্ঞ থাকায় বিপরীত ফল লাভ করে মাত্র।
এখানে একটি গল্প মনে পড়ল, জনৈক কবিরাজের এক ভৃত্য ছিল, সে একদিন শুনল যে করিরাজ তাঁর ছাত্রদেরকে বলছেন “ঘৃতাদষ্ট গুণং তৈলং” অর্থাৎ ঘৃত অপেক্ষা তৈলের গুণ অষ্টগুণ অধিক, সে এই কথা শ্রবণ শুনে মনে করল যে তবে বৃথা অধিক ব্যয় করে ঘৃত খাওয়ার আবশ্যক কি! ফলতঃ সেদিন থেকে সে খাবারে অধিক পরিমাণে তেল খাওয়ায় কিছু দিনের মধ্যে নানারকম রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ল, কবিরাজ তার দুর্দশা দেখে কারণ জিজ্ঞাসা করায় সে বলল মহাশয়! আপনার উপদেশ শুনে আমি খাবারে অধিক পরিমাণে তেল খেয়েছি, এবং তাই সম্ভবত আমার স্বাস্থ অবনতির কারণ, তখন কবিরাজ সমস্ত বুঝে বলল, মুঢ়! তুই শ্লোকের অপর অংশ শুনো নাই কেন? তেল ব্যবহারের ফল ঘৃতের অপেক্ষা অষ্টগুণ অধিক বটে, কিন্তু “মর্দ্দনাৎ ন তু ভক্ষণাং” অর্থাৎ দেহে মাখলে এই ফল হয়, খাইলে নয়।
ভাই! আমাদের ও এখন এই দুর্দশা হয়েছে, ভগদবাক্যের “চাতুর্ব্বর্ণ্যং ময়া সৃষ্টং” অংশটি আমরা স্বীকার করলেও এর অপরার্দ্ধ “গুণকর্ম্ম বিভাগশঃ” অংশটি বাদ দেওয়াতেই ব্যবহার দোষে ভাবের বিশুদ্ধতা হারিয়েছি ও তার ফলে আমাদের আধ্যাত্মিক দেহের স্বাস্থ নষ্ট হয়েছে এবং ঐ গ্লানি স্থুল দেহ মনে সঞ্চারিত হচ্ছে।
প্রকৃতির দিন গুণ, সত্ব, রজ ও তম, এই তিন গুণের মধ্যে যার যে গুণ প্রবল তার সেই কর্ম ও সেই গুণ অনুয়ায়ি করা হয়, এবং এই গুণের কমবেশিই ব্রাহ্মণাদি বর্ণভেদের মূল কারণ, শুদ্ধ-রজো গুণে ক্ষত্রিয়, তম মেশানো রজো গুণে বৈশ্য ও রজো মেশানো তমো গুণে শূদ্র, এই চার বর্ণ নিয়েই হিন্দু সমাজ গঠিত, ব্রাহ্মণ এই সমাজ দেহের মস্তক, ক্ষত্রিয় বাহু, বৈশ্য উদর ও শূদ্র পদ স্বরূপ, জ্ঞান লাভ করে যাঁরা কার্য কারণের সম্বন্ধ বোধ হয়েছে, তিনি সহজেই কর্ম দেখে গুণের আভাস পেয়ে বর্ণের নির্ণয় করতে পারেন, অথচ আত্ম উন্নতির পিপাসায় অকপট হৃদয়ে যিনি জ্ঞান লাভের জন্য ব্যকুল হন, শ্রীভগবান তাঁর বাসনা অপূর্ণ রাখেন না, কিন্তু হায়! সুখ শান্তির নিদান ও ভগবন লাভের সোপান স্বরূপ যে জ্ঞান, তার দিকে কি কারও লক্ষ্য আছে ? শ্রীভগবানের কৃপায় যদি কখনো ব্রাক্ষণত্বের বিস্তার হয়, জ্ঞানের দ্বারা যদি কখনো গুরু পুরোহিতদের হৃদয় ভাণ্ডার পূর্ণ হয় এবং জন সাধারণের সাথে তাঁদের স্বার্থ গদ্ধ হীন প্রেমের সম্বন্ধ স্থাপিত হয়, তবেই হিন্দুর হিন্দুত্ব পুনঃ প্রতিষ্ঠিত হবে, বর্ণাশ্রম ধর্মের দ্বারা সমাজ দেহের পূর্ণ স্বাস্থ্য ফিরে আসবে, আপন আপন অধিকার অনুয়ায়ি কর্ম করে সকলেই ক্রম উন্নতির দিকে অগ্রসর হবে, নতুবা হিন্দু ধর্মের উন্নতি সুদূর পরাহত জেনো।
ভাই! ব্রাহ্মণত্ব লাভ ভিন্ন আত্যন্তিক দুঃখের নিবৃত্তি ও ত্রিতাপের বেগ প্রশমিত হয় না। যদি জন্ম মৃত্যুর করাল কবল থেকে মুক্ত হয়ে বিমল আনন্দ লাভ করতে চাও, তবে ব্রহ্মণত্ত্ব লাভের চেষ্টা কর, সকলেরই ব্রাহ্মণ হওয়ার অধিকার আছে, যখন বিশুদ্ধ বর্ণাশ্রম ধর্ম প্রচলিত ছিল তখন ব্রাহ্মণেত্বর বর্ণ সকল এই ব্রাহ্মণত্ব লাভের উদ্দেশেই ব্রাহ্মণের সাথে সমুচ্চয় করার জন্য লালায়িত হত, ব্রহ্মণের সেবা ও সঙ্গ করার ফলে সত্ব স্রোতের দ্বারা চিত্ত শুদ্ধ হলে যখন হৃদয়ে জ্ঞানের বিকাশ হত, তখন তাঁরা ব্রাহ্মণত্বের মধ্য দিয়েই মুক্তি লাভ করত, অতএব ব্রাহ্মণত্ত্বে উন্নীত হওয়ার উপযোগী জ্ঞান লাভ করতে যত্ন কর, চেষ্টা আন্তরিক হলে শ্রীভগবান সৎসঙ্গের সংযোগ করে দিবেন, মনকে একবার সৎসঙ্গের রসাস্বাদ করাতে পারলে তৎক্ষণাৎ তার অধোগতি রুদ্ধ হয়ে যাবে, পরে আস্বাদের মাত্রা যত বাড়বে হৃদয়ে ততই জ্ঞানের বিকাশ হয়ে তোমাকে ক্রমোন্নতির পথে অগ্রসর করে দিবে, ফলে আত্মোন্নতির জন্য ব্যাকুলতা রূপ উর্বর জমিতে সৎসঙ্গের বীজ বপিত হলে যে জ্ঞান বৃক্ষের উৎপত্তি হয়, ভক্তি, বিশ্বাস প্রভৃতি সেই বৃক্ষেরই অপার্থিব ফল মাত্র জানিও, এবং এই ফল সমূহ ভগবৎ চরণে অর্পিত হলেই মানব আনন্দময় শিবত্বে উন্নীত হয়ে অনন্ত কালের তরে কৃতার্থ হয়।
ভক্তি পত্রিকা নবম বর্ষ
শ্রীহরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়।
You must be logged in to post a comment.