ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয়াদি বর্ণ সকলের প্রকৃত তত্ত্ব কি ? এটি কি ভগবানের সৃষ্ট না মানবের কল্পনা প্রসূত! মানুষ ত সকলেই, তবে এই উচ্চনীচ ভেদের কারণ কি?


উত্তরঃ- ভাই! মানবের কর্ম অনুয়ায়ী গুণ ভেদে এই বর্ণ ভেদ শ্রীভগবানের ইচ্ছাতেই হয়েছে, ঋষিদের মধ্যে দিয়ে তিনিই জীবের ও সমাজের কল্যানের জন্য এই বর্ণাশ্রম ধর্মের প্রতিষ্ঠা করেছেন, যতদিন হিন্দুর রাজত্ব ছিল এবং সমাজের উপর রাজার ও রাজার উপর সূক্ষ্মদৃষ্টিসম্পন্ন ঋষিদের কর্ত্তৃত্ব ছিল, ততদিন এই বর্ণাশ্রম ধর্ম সমাজ দেহের প্রকৃত পুষ্টি সাধন করেছিল। আপন আপন অধিকার অনুয়ায়ী কর্ম করে সকলেই ক্রম উন্নতির দিকে অগ্রসর হচ্ছিল, ঋষি গণ জ্ঞান যোগে শ্রীভগবানের সাথে যুক্ত থাকায় প্রকৃতিকে বিশ্লেষণ করতে পারতেন, মানবের বাইরের অবয়ব দেখে তার অন্তর্নিহিত গুণের পরিমাণ করে রাজ শক্তির সাহায্যে তাকে উচ্চ বা নীচ বর্ণে উন্নীত বা অবনত করতেন, কষ্ঠি পাথরের সংস্পর্শে যেমন স্বর্ণ নিজের প্রকৃত গুণ লুকাতে পারেনা তেমনি ঋষিদের জ্ঞান দৃষ্টির নিকট সাধারণের গুণ অনুযায়ি বর্ণ প্রকাশিত হয়ে পড়ত, তাঁরা শ্রীভগবানের আদেশ জন সাধারণের নিকট প্রচার করার মধ্যবর্ত্তী স্বরূপ ছিলেন, কিন্তু হায়! এখন আর সে দিন নাই, রাজসিক মালিন্যের আধিক্য বশতঃ হিন্দু রাজগণ অধার্মিক হয়ে ঋষিগণের মধ্যবর্ত্তিতা আগ্রাহ্য করায় হিন্দু ধর্মের এই অধঃপতন! মোহ বশে শ্রীভগবানের মঙ্গলময় বিধান অবহেলা করার ফলে হিন্দু গণ আজ শক্তিহীন, এদিকে কলির প্রাধান্যে সনাতন ধর্মকে আচ্ছন্ন হতে দেখে প্রকৃত বর্ণ নির্ণয় করে সে অনুয়ায়ি ব্যবহার করার জ্ঞানাভাব বশত সমাজ এখন বর্ণ শঙ্করে প্লাবিত!! এই জন্যই সাধুগণ সমাজের সাথে ঘনিষ্ট সম্বন্ধ রাখেন না, গুণগত বর্ণ জ্ঞান থাকায় তাঁরা জন্মগত বর্ণের বিশুদ্ধতাস্বীকার করেন না, হয়ত জন্মগত শূদ্র বর্ণের মধ্যে গুণগত ব্রহ্মণত্ব দেখে তার সঙ্গ করেন, আবার জন্মগত ব্রাহ্মণের মধ্যে চণ্ডালত্ব দেখে তার ছায়া স্পর্শ করেন না।
ভাই! বর্ণাশ্রম ধর্মের বিশুদ্ধতা নষ্ট হওয়াতেই হিন্দু ধর্মের মহান্‌ ভাব মেঘাচ্ছন্ন তপনের ন্যায় তেজোহীন হয়ে পড়েছে, কেননা বর্ণজ্ঞান না থাকলে সঙ্গ নির্বাচিত হয় না, সুতরাং অসৎ সঙ্গের সংযোগে হৃদয়ে মলিন ভাব সঞ্চারিত হয়ে মনকে অবনত করে, ফলে মন মুঢ় ভাবাপন্ন ও ভ্রান্ত হয়ে রোগ, শোক ইত্যাদি আশান্তির দ্বারা তাড়িত হয়ে সংসার চক্রে ঘুর্ণিত হয়।
গীতায় ভগবান্‌ বলছেনঃ- চাতুর্ব্বণ্যং ময়া সৃষ্টং গুণকর্ম্ম বিভাগশঃ
অর্থাৎ গুণ জনিত কর্মের বিভাগ পূর্বক আমি চার বর্ণের সৃষ্টি করেছি। অতএব এটি নিশ্চয় যে বর্ণভেদ ঐশ্বরিক বিধান, এবং তাঁর বিধান অনুসারে সংসার পথে চলাই ধর্ম, কিন্তু হায়! জীব ভ্রমজ্ঞানে আচ্ছন্ন থাকায় তাঁর মঙ্গলময় বিধানের প্রকৃত মর্ম উপলব্ধি করতে পারে না, মধু জিহ্বায় না দিয়ে কানে ঢাললে যেমন কষ্টের কারণ হয়, তেমনি তাঁরা বর্ণের প্রকৃত তত্ত্ব ও ব্যবহার সম্বন্ধে অজ্ঞ থাকায় বিপরীত ফল লাভ করে মাত্র।
এখানে একটি গল্প মনে পড়ল, জনৈক কবিরাজের এক ভৃত্য ছিল, সে একদিন শুনল যে করিরাজ তাঁর ছাত্রদেরকে বলছেন “ঘৃতাদষ্ট গুণং তৈলং” অর্থাৎ ঘৃত অপেক্ষা তৈলের গুণ অষ্টগুণ অধিক, সে এই কথা শ্রবণ শুনে মনে করল যে তবে বৃথা অধিক ব্যয় করে ঘৃত খাওয়ার আবশ্যক কি! ফলতঃ সেদিন থেকে সে খাবারে অধিক পরিমাণে তেল খাওয়ায় কিছু দিনের মধ্যে নানারকম রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ল, কবিরাজ তার দুর্দশা দেখে কারণ জিজ্ঞাসা করায় সে বলল মহাশয়! আপনার উপদেশ শুনে আমি খাবারে অধিক পরিমাণে তেল খেয়েছি, এবং তাই সম্ভবত আমার স্বাস্থ অবনতির কারণ, তখন কবিরাজ সমস্ত বুঝে বলল, মুঢ়! তুই শ্লোকের অপর অংশ শুনো নাই কেন? তেল ব্যবহারের ফল ঘৃতের অপেক্ষা অষ্টগুণ অধিক বটে, কিন্তু “মর্দ্দনাৎ ন তু ভক্ষণাং” অর্থাৎ দেহে মাখলে এই ফল হয়, খাইলে নয়।

ভাই! আমাদের ও এখন এই দুর্দশা হয়েছে, ভগদবাক্যের “চাতুর্ব্বর্ণ্যং ময়া সৃষ্টং” অংশটি আমরা স্বীকার করলেও এর অপরার্দ্ধ “গুণকর্ম্ম বিভাগশঃ” অংশটি বাদ দেওয়াতেই ব্যবহার দোষে ভাবের বিশুদ্ধতা হারিয়েছি ও তার ফলে আমাদের আধ্যাত্মিক দেহের স্বাস্থ নষ্ট হয়েছে এবং ঐ গ্লানি স্থুল দেহ মনে সঞ্চারিত হচ্ছে।

প্রকৃতির দিন গুণ, সত্ব, রজ ও তম, এই তিন গুণের মধ্যে যার যে গুণ প্রবল তার সেই কর্ম ও সেই গুণ অনুয়ায়ি করা হয়, এবং এই গুণের কমবেশিই ব্রাহ্মণাদি বর্ণভেদের মূল কারণ, শুদ্ধ-রজো গুণে ক্ষত্রিয়, তম মেশানো রজো গুণে বৈশ্য ও রজো মেশানো তমো গুণে শূদ্র, এই চার বর্ণ নিয়েই হিন্দু সমাজ গঠিত, ব্রাহ্মণ এই সমাজ দেহের মস্তক, ক্ষত্রিয় বাহু, বৈশ্য উদর ও শূদ্র পদ স্বরূপ, জ্ঞান লাভ করে যাঁরা কার্য কারণের সম্বন্ধ বোধ হয়েছে, তিনি সহজেই কর্ম দেখে গুণের আভাস পেয়ে বর্ণের নির্ণয় করতে পারেন, অথচ আত্ম উন্নতির পিপাসায় অকপট হৃদয়ে যিনি জ্ঞান লাভের জন্য ব্যকুল হন, শ্রীভগবান তাঁর বাসনা অপূর্ণ রাখেন না, কিন্তু হায়! সুখ শান্তির নিদান ও ভগবন লাভের সোপান স্বরূপ যে জ্ঞান, তার দিকে কি কারও লক্ষ্য আছে ? শ্রীভগবানের কৃপায় যদি কখনো ব্রাক্ষণত্বের বিস্তার হয়, জ্ঞানের দ্বারা যদি কখনো গুরু পুরোহিতদের হৃদয় ভাণ্ডার পূর্ণ হয় এবং জন সাধারণের সাথে তাঁদের স্বার্থ গদ্ধ হীন প্রেমের সম্বন্ধ স্থাপিত হয়, তবেই হিন্দুর হিন্দুত্ব পুনঃ প্রতিষ্ঠিত হবে, বর্ণাশ্রম ধর্মের দ্বারা সমাজ দেহের পূর্ণ স্বাস্থ্য ফিরে আসবে, আপন আপন অধিকার অনুয়ায়ি কর্ম করে সকলেই ক্রম উন্নতির দিকে অগ্রসর হবে, নতুবা হিন্দু ধর্মের উন্নতি সুদূর পরাহত জেনো।

ভাই! ব্রাহ্মণত্ব লাভ ভিন্ন আত্যন্তিক দুঃখের নিবৃত্তি ও ত্রিতাপের বেগ প্রশমিত হয় না। যদি জন্ম মৃত্যুর করাল কবল থেকে মুক্ত হয়ে বিমল আনন্দ লাভ করতে চাও, তবে ব্রহ্মণত্ত্ব লাভের চেষ্টা কর, সকলেরই ব্রাহ্মণ হওয়ার অধিকার আছে, যখন বিশুদ্ধ বর্ণাশ্রম ধর্ম প্রচলিত ছিল তখন ব্রাহ্মণেত্বর বর্ণ সকল এই ব্রাহ্মণত্ব লাভের উদ্দেশেই ব্রাহ্মণের সাথে সমুচ্চয় করার জন্য লালায়িত হত, ব্রহ্মণের সেবা ও সঙ্গ করার ফলে সত্ব স্রোতের দ্বারা চিত্ত শুদ্ধ হলে যখন হৃদয়ে জ্ঞানের বিকাশ হত, তখন তাঁরা ব্রাহ্মণত্বের মধ্য দিয়েই মুক্তি লাভ করত, অতএব ব্রাহ্মণত্ত্বে উন্নীত হওয়ার উপযোগী জ্ঞান লাভ করতে যত্ন কর, চেষ্টা আন্তরিক হলে শ্রীভগবান সৎসঙ্গের সংযোগ করে দিবেন, মনকে একবার সৎসঙ্গের রসাস্বাদ করাতে পারলে তৎক্ষণাৎ তার অধোগতি রুদ্ধ হয়ে যাবে, পরে আস্বাদের মাত্রা যত বাড়বে হৃদয়ে ততই জ্ঞানের বিকাশ হয়ে তোমাকে ক্রমোন্নতির পথে অগ্রসর করে দিবে, ফলে আত্মোন্নতির জন্য ব্যাকুলতা রূপ উর্বর জমিতে সৎসঙ্গের বীজ বপিত হলে যে জ্ঞান বৃক্ষের উৎপত্তি হয়, ভক্তি, বিশ্বাস প্রভৃতি সেই বৃক্ষেরই অপার্থিব ফল মাত্র জানিও, এবং এই ফল সমূহ ভগবৎ চরণে অর্পিত হলেই মানব আনন্দময় শিবত্বে উন্নীত হয়ে অনন্ত কালের তরে কৃতার্থ হয়।

ভক্তি পত্রিকা নবম বর্ষ

শ্রীহরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়।

খনার বচনে গর্ভস্থ সন্তানের স্বরূপ নির্ণয় পদ্ধতি


আজ থেকে ১৫০০ বছর পূর্বে জন্ম নেওয়া ইতিহাসের এককিংবদন্তি ‘খনা’ বা ‘ক্ষণা।‘ কোন এক শুভক্ষণে তার জন্মবলে নাম দেওয়া হয় ‘ক্ষণা।‘ আর ‘ক্ষণা‘ থেকেই ‘খনা‘ নামের উৎপত্তি বলে মনে করা হয়। খনা ছিলেন সিংহলরাজার কন্যা। কথিত আছে, খনার আসল নাম লীলাবতী।তিনি ছিলেন জ্যোতির্বিদ্যায় পারদর্শী। তাঁর রচিতভবিষ্যতবাণীগুলোই মূলত ‘খনার বচন’ নামে আমরাজানি।খনার বচন
খনার বচনে গর্ভবতীর পেটের সন্তানের জেন্ডার নিরুপণ বা খনার বচনে গর্ভস্থ সন্তানের স্বরূপ নির্ণয় পদ্ধতি-
বানের পেটে দিয়ে বান
পেটের ছেলে গুণে আন।
নামে মাসে করি এক
আটে হবে সন্তান দেখ।
এক তিন থাকে বান
তবে নারীর পুত্র জান।
দুই চারি থাকে ছয়
অবশ্য তার কন্যা হয়।
থাকিলে শূন্য বা সাত
অবশ্য হয় গর্ভপাত।
এখানে খনার কবিতাটিতে বানের পেটে দিয়ে বান এর অর্থ করা যায়। পাঁচের পিঠে পাঁচ অর্থাৎ পঞ্চান্ন সংখ্যাটি। এই সংখ্যার সাথে যে গর্ভধারিনীর সন্তান গণনা করতে হবে তার নামের অক্ষর সংখ্যা এবং গর্ভ যতো মাসের সেই মাসের সংখ্যা নির্ভুলভাবে একত্রে যোগ করতে হবে। এই মোট সংখ্যাকে আট দিয়ে ভাগ করতে হবে। ভাগ্যের শেষে যদি পাঁচ অবশিষ্ট থাকে তাহলে পুত্র হবে এবং দুই, চার বা ছয় অবশিষ্ট থাকলে কন্যা হবে। ভাগশেষ যদি শূন্য বা সাত অবশিষ্ট থাকে তাহলে গর্ভিনীর গর্ভপাত হবে।
দ্বিতীয় মত
গ্রাম গর্ভিনী ফলে যুতা
তিন দিয়ে হর পুতা।
এক সুত দুইয়ে সুতা
শূন্য থাকিলে গর্ভ মিথ্যা।
একথা যদি মিথ্যা হয়
সে ছেলে তার বাপের নয়।
তৃতীয় মত
সাত মাসের গর্ভ নারীর
নামে যত অক্ষর
যত জনে শুনে তাহে
অঙ্ক দিয়া এক কর।
সাতে হরি চন্দ্র নেত্র
বান যদি রয়
সমে পুত্র, পরে কন্যা
জানিবে নিশ্চয়।
সংগ্রহে-রক্তবীজ ডেস্ক

বিয়েতে যে এতো আচার প্রথা তার কি কোনো দরকার আছে? কন্যাদান কি অপমানকর নয়? মেয়ে কি দানের বস্তু? গায়ে-হলুদ যজ্ঞ অর্থহীন বর্তমান যুগে। এসবের কি প্রয়োজন আছে?


বিয়েতে যে এতো আচার প্রথা তার কি কোনো দরকার আছে? কন্যাদান কি অপমানকর নয়? মেয়ে কি দানের বস্তু? গায়ে-হলুদ যজ্ঞ অর্থহীন বর্তমান যুগে। এসবের কি প্রয়োজন আছে?

●●●আপনার আপত্তি থাকলে রেজিস্ট্রি করুন ।
মুশকিল হলো, ধর্ম-ডাক্তারি-রাজনীতি এই তিনটি বিষয়ে সবাই পন্ডিত,স্পেসালিস্ট,কিছু জানুক আর
নাই জানুক। তবে একটা খবর আপনাকে দিই।বিখ্যাত কমুনিস্ট নেতা নম্বুদ্রিপদ কেরালায় তার মেয়ের বিয়ে দিয়েছিলেন নম্বুদ্রি-ব্রাহ্মণদের শাস্ত্রীয়
রীতিনীতি মেনে। (শঙ্করাচার্যও ছিলেন এই কুলীন ব্রাহ্মণ ধারার।)
বিয়েতে আচার-অনুষ্ঠান আসামে একরকম, কেরালায় আরেক রকম, গুজরাটে অন্য ধরণের। তবে সর্বত্র তিনটি প্রথা — যজ্ঞ, কন্যাদান, সপ্তপদী — রয়েছে। এগুলি বৈদিক, অন্যান্য প্রথা স্থানীয়।উদার প্রকৃতির জন্য হিন্দুধর্ম বেদের সাথে গণধর্মগুলিকেও স্বীকার করেছে, ধ্বংস করেনি।ফলে বিযেতেও এই সমন্বয় দেখা যায়। সব নিয়ে বিশদ আলোচনার বদলে শুধু বৈদিক 3টি প্রথা নিয়ে বলা যাক সংক্ষেপে।

যজ্ঞ : আগুনকে পবিত্র মনে করা হয় কারণ এটি সব ধাতুকে পুড়িয়ে শুদ্ধ করে ও আগুনের গতি সবসময় উপরদিকে। অর্থাত প্রথমেই মনে করিয়ে দেয়া হয় যে বিয়েটা এক পবিত্র বন্ধন। বর-বৌ মন্ত্র বলে “যদিদং হৃদয়ং মম…” (অর্থাত, আমার হৃদয় তোমার হোক …)। বিয়ের ভিত্তি যে হৃদয়ের মিলন, সেটা স্পষ্ট করা হয়। বর-কনে মন্ত্র পড়েপড়ে যজ্ঞের আগুনে ঘি আহুতি দেয় বারবার। কেন? এই যে সম্পর্ক হতে চলেছে একে সঞ্জীবিত (nurture) করে যেতে হবে জীবনের পথে। নাহলে এটা যান্ত্রিক হয়ে পড়বে।

কন্যাদান : দান কাকে করা হয়? অভাবী মানুষকে।
গরীবকে পয়সা দেয়া, ব্স্ত্রহীনকে কাপড় দেয়া, নিরক্ষরকে শিক্ষা দেয়া। কন্যাদান কেন? পুরুষ অনেক কিছুই শিখেছে, কিন্তু ঘর বাঁধতে শেখেনি।কেন? সে তো বাঁশ-খড় বা ইঁট-সিমেন্ট দিয়ে বাড়ি তৈরি করতে পারে! এখানে মুনি বলেছেন “গৃহিণী গৃহং উচ্যতে”(স্ত্রীই প্রকৃত ঘর)। স্বামী উপার্জন করে কিন্তু সংসার সামলায় স্ত্রী।
বরের এই অভাব মেটাবার জন্য কন্যা আসছে তার শক্তি নিয়ে।শিক্ষা যেমন নিরক্ষরকে শক্তি দেয়
তেমনি স্ত্রী শক্তি দেবে স্বামীকে, এ-কথাই মেয়ের বাবা বলছেন কন্যাদানের মাধ্যমে।
আর এজন্যই স্ত্রীর স্থান স্বামীর বাঁ দিকে। স্বামীর
ডান হাত শক্ত, ঐ হাত দিয়ে সে শিকার করে, অর্থ উপার্জন করে, যুদ্ধ করে। কিন্তু তার বাঁ হাত দুর্বল। স্ত্রী ঐদিককে শক্তি দেবে বলে স্ত্রীর স্থান স্বামীর বাঁ দিকে।

সপ্তপদী : এতক্ষণ বসেবসে মন্ত্র পড়ার পর এবার একসাথে সাত পা চলা। অর্থাত এখন থেকে যৌথ জীবন, একসাথে পথ চলা। আগুনকে ঘিরে কারণ জীবনে অনেক রকম পরিস্থিতি বহু বাঁধা আসবে, কিন্তু এর মোকাবিলা করতে হবে দুজনে মিলে।
সাত বার কেন? বাইরে 7 ভুবন (ভাল-মন্দ নানান পরিস্থিতি) আর ভেতরে 7 চ্ক্র (মনের নানা অবস্থা)। বাইরে-ভেতরে যাই হোক, স্বামী-স্ত্রীকে তার সমাধান করতে হবে একসঙ্গে — এটাই বলা হচ্ছে । সুখে-দু:খে একসাথে পথ চলার অঙ্গীকার ।

বৌ-ভাত : নববধূ পতিগৃহে এসে রান্না করে খাওয়ায় স্বামীর আত্মিয়-স্বজনকে। এর তাতপর্য —
বধূকে বলা হচ্ছে যে শুধু নিজের সংসারের জন্য কাজ করা নয়, সমাজের কথা ভাবতে হবে। গীতায়
বলা হয়েছে, যারা শুধু নিজের জন্য রান্না করে তারা চোর। সপ্তপদীতে যে যৌথজীবনের শুরু সেটা পরিণত হলো সমাজজীবনে। স্বামী-স্ত্রীকে বলা হলো, কেবল নিজের পরিবারে সীমাবদ্ধ না থেকে সমাজের কথা ভাবতে।

কার্টেসি-

●■●স্বামী সোমেশ্বরানন্দ

কপিল গুপ্ত

১৬টি সংস্কার


এমন কিছু কাজ যা ভবিষ্যৎ জীবনকে সুন্দর করে গড়ে তোলে এবং একজন ব্যক্তির উপর প্রভাব বিস্তার করে। সংস্কার মানুষকে পবিত্র, দোষত্রুটি মুক্ত এবং নির্মল করে। যে আচার-অনুষ্ঠান জীবনকে ধর্মীয় পরিবেশে সুন্দরভাবে গড়ে উঠতে সাহায্য করে তাই সংস্কার। প্রতিটা মানুষ চায় তার সন্তান একজন ভাল চরিত্রের মানুষ হিসাবে গড়ে উঠুক। চারপাশের পরিবেশ শিশুর চরিত্র গঠনে ভূমিকা রাখে। যেকোনো ভালো প্রভাব সুন্দর চরিত্র গঠনে সাহায্য করে। সনাতন ধর্মে ১৬টি সংস্কার আছে।এই ষোলটি সংস্কার জীবনকে উন্নত করে, খারাপ সঙ্গ থেকে রক্ষা করে এবং তাকে একজন সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলে।

১৬ টি সংস্কার হচ্ছে :

১. গর্ভদান : বিবাহের পর স্বামী-স্ত্রী সন্তান জন্মদানের জন্য সকলের আশীর্বাদ পান। এই সংস্কার দ্বারা তারা স্বাস্থ্যবান, মহৎ এবং উদার হৃদয়ের সন্তান প্রার্থনা করেন।
২. পুংসবন : গর্ভদানের ৩ মাস পর এই সংস্কার পালন করতে হয়। গর্ভাবস্থায় সন্তানের সুস্থভাবে বেড়ে ওঠার জন্য ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করা হয়।
৩. সীমন্তোন্নয়ন : এটা গর্ভধারণের ষষ্ঠ বা অষ্টম মাসের শেষে করা হয় সন্তানের অঙ্গ প্রত্যঙ্গ পরিপূর্ণ বিকাশের জন্য।
৪. জাতকর্ম : জন্মগ্রহণের দিন সন্তানকে জাতকর্মের মাধ্যমে পৃথিবীতে স্বাগতম জানান হয়।
৫. নামকরণ : জন্মের এগার মাসে এই সংস্কার পালন করা হয় এবং সন্তানকে একটি নাম দেওয়া হয়।
৬. নিষ্ক্রমণ : জন্মের চতুর্থ মাসে এই সংস্কার পালন করা হয়। শিশু সন্তানকে বাইরের পরিবেশে উন্মুক্ত করা হয়। যাতে সূর্যের আলো তাকে স্বাস্থ্যবান করে তোলে। দীর্ঘায়ুর জন্য প্রার্থনা করা হয়। এই সময় থেকে সন্তান প্রকৃতির কোলে প্রাকৃতিকভাবে বড় হতে থাকে।
৭. অন্নপ্রাসন : সন্তানের যখন দাঁত উঠতে থাকে সাধারণত ছয় থেকে আট মাস বয়সে এই সংস্কার পালন করা হয়। তখন থেকেই তাকে শক্ত খাবার দেওয়া হয়।
৮. চূড়াকরণ : প্রথম থেকে তৃতীয় বছর বয়সের মধ্যে এই সংস্কার পালন করা হয়। প্রথম বারের মতো মাথার সব চুল ফেলে দেওয়া হয়। সুস্বাস্থ্য এবং সুস্থ মানসিক বিকাশের জন্য প্রার্থনা করা হয়।
৯. কর্ণভেদ : তিন বছর বয়সে কান ফোরানো হয় এবং শারীরিক সুস্থতার জন্য প্রার্থনা করা হয়।
১০. উপনয়ন : ৫ থেকে ৮ বছর বয়সে উপনয়নের মাধ্যমে একটি শিশু গুরু/শিক্ষকের সান্নিধ্যে আসে। গুরুর নিকট জ্ঞান, কর্ম, ভক্তিসহ বিভিন্ন নিয়মানুবর্তিতা অর্থাৎ শাস্ত্রে জীবন যাপনের যে পদ্ধতি উল্লেখ আছে তার অনুশীলন করে। ব্রহ্মচর্য জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করা এবং সব রকম খারাপ কাজ থেকে বিরত থাকার অভ্যাস ছাত্র জীবনেই করতে হয়। নিয়মিত পড়ালেখা এই সংস্কারের পরেই শুরু হয়।
১১. বেদারম্ভ : উপনয়ন এর পরেই এই সংস্কার পালন করা হয়। এই সময় বেদ এবং বিভিন্ন শাস্ত্র অনুসারে আধ্যাত্মিক জ্ঞান অর্জন শুরু হয়। জ্ঞানের সকল শাখায় তাকে বিচরণ করতে হয় এবং এর মাধ্যমে সে জাগতিক বিষয়ের সঙ্গে আধাত্মিক বিষয় সম্পর্কে জানতে পারে।
১২. সমাবর্তন : ২১ থেকে ২৫ বছর বয়সের মধ্যে যখন শিক্ষা গ্রহণ শেষ হয়, তখন এটি পালন করা হয়। গুরু ছাত্রকে যোগ্যতা অনুযায়ী ডিগ্রি প্রদান করেন। এরপর একজন ছাত্র আত্মনির্ভর এবং স্বাধীন জীবন যাপন করে।
১৩. বিবাহ : ব্রহ্মচর্য শেষে একজন বিয়ে করে পরবর্তী গৃহস্থ জীবনে পদার্পণ করে। একজন পুরুষ আর একজন মহিলা যারা এতদিন স্বাধীন জীবন যাপন করেছে এখন একসঙ্গে জীবনভর চলার সপথ গ্রহণ করে। বিয়ের পর সন্তান হয় এবং পরিবারের ধারা চলতে থাকে।
১৪. বানপ্রস্থ : ৫০ বছর বয়সে গৃহস্থ আশ্রম শেষে বানপ্রস্থ আশ্রম শুরু হয়। নিজের সুবিধার জন্য তিনি যে সব কাজ করতেন তার সবকিছু পরিত্যাগ করেন। পরিবারের সব দায়িত্ব সন্তানের হাতে তুলে দিয়ে পূজর্চনা, ধ্যান এবং মানবসেবায় নিয়োজিত হন।
১৫. সন্ন্যাস : যদিও ৭৫ বছর বয়সে সন্ন্যাস গ্রহণ করার কথা বলা আছে তারপরেও আত্মনিয়ন্ত্রণ এবং আধ্যাত্মিকতা দ্বারা যিনি জাগতিক সবকিছু থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারেন তিনিই সন্ন্যাস গ্রহণ করবেন। এ সময় তিনি ধনসম্পদ, সামাজিক ও পারিবারিক বন্ধন এবং সকল ইচ্ছা আকাক্সক্ষা পরিত্যাগ করবেন । গাঢ় হলুদ রঙের ঢিলেঢালা পোশাক এই কঠোর জীবনের প্রতীক। তার কোনো নির্দিষ্ট পরিবার সমাজ অথবা গৃহ নেই।
১৬. অন্ত্যেষ্টী : মৃত্যুর পর শবদাহ করা হয়। কিন্তু আত্মা অমর। যখন দেহ অগ্নিতে দাহ করা হয় তখন শরীর যে পাঁচটি উপাদান দিয়ে তৈরি, যেমন মাটি, জল, আগুন, বাতাস এবং আকাশ প্রকৃতিতে মিশে যায়। মৃতের আত্মার শান্তিতে প্রার্থনা করা হয়। শবদাহ হচ্ছে মৃতদেহ সৎকারের সবচেয়ে ভালো উপায়।