সনাতন ধর্মতত্ত্ব

3.5) আত্মসংস্থ-যোগ বা সমাধি-যোগ


উপনিষৎ যখন স্থির করলেন যে, দেহমধ্যে অন্তর্যামিরূপে যিনি বিরাজমান তিনিই ব্রহ্মাণ্ডেরও মূল তত্ত্ব পরব্রহ্ম – যা পিণ্ডে, তাই ব্রহ্মাণ্ডে, তখনই উপদেশ হল, আত্মাকে দর্শন করবে, শ্রবণ করবে, মনন করবে, ধ্যান করবে। এরকম আত্মচিন্তায় ব্রহ্ম উপাসনার যে প্রণালী বলা হল সেটাই সমাধি-যোগের মূল। এভাবে উপনিষদের জ্ঞানমার্গ থেকেই যোগ-প্রণালীর উদ্ভব হয়েছে। এই প্রণালীই যম, নিয়ম, আসন, প্রাণায়াম আদি বহিরঙ্গ-সাধন-সংযুক্ত হয়ে ক্রম উন্নতি লাভ করে অষ্টাঙ্গযোগ নামে পরিচিত হয়েছে। যোগমার্গ অতি প্রাচীন। বল আছে, ব্রহ্মা সেটির আদি বক্তা। পতঞ্জলি মুনি উহা সুশৃঙ্খলাবদ্ধ করে পরবর্তী কালে যে যোগানুশাসন প্রবর্তিত করেছিলেন, ‘যোগ’ বলতে এখন তাই বুঝায়। এটাই রাজযোগ, পাতঞ্জল-যোগ, অষ্টাঙ্গ-যোগ, আত্মসংস্থ-যোগ ইত্যাদি নামে অভিহিত হয়। সমাধি বা ইষ্টবস্তুতে চিত্তসংযোগ সর্ববিধ সাধনারই সাধারণ উদ্দেশ্য। সুতরাং যোগ-প্রণালী কোনো-না-কোনো ভাবে সকল সম্প্রদায়ই গ্রহণ করেছেন।

পরবর্তীতে- প্রতীকোপসনা – ভক্তিমার্গ

3.4) কাপিল সাংখ্য – পুরুষ-প্রকৃতিবাদ


পুরুষ-প্রকৃতিবাদ

উপনিষদে অধ্যাত্মতত্ত্বের বিচার আরম্ভ হলে জীব, জগৎ ও ব্রহ্মতত্ত্ব সম্বন্ধে নানারকম মৌলিক গবেষণা চলতে থাকে এবং জ্ঞানমার্গেও মতভেদের সৃষ্টি হয়ে বিবিধ দর্শন-শাস্ত্রের উৎপত্তি হয়। তারমধ্যে কাপিল সাংখ্যমত বিশেষ উল্লেখযোগ্য। সাংখ্যমতে মূলতত্ত্ব একমাত্র ব্রহ্ম নন; মূলতত্ত্ব দুই – পুরুষ ও প্রকৃতি। প্রকৃতি ও পুরুষ উভয়েই অনাদি, নিত্য। প্রকৃতি জড়া, গুণময়ী, পরিণামিনী, প্রসবধর্মিণী অর্থাৎ স্বয়ং সৃষ্টিসমর্থা। পুরুষ চেতন, নির্গুণ, অপরিণামী, অকর্তা, উদাসীন, সাক্ষিমাত্র। পুরুষ-প্রকৃতির সংযোগেই সৃষ্টি, এই দুঃখময় সংসার। প্রকৃতি-পুরুষের পার্থক্য-জ্ঞানেই মুক্তি। আধুনিক কালের ডার্বিন (Darwin), স্পেন্সার, হেকেল প্রমুখ পাশ্চাত্য বৈজ্ঞানিকরা ব্যাখ্যা করা বিবর্তনবাদ (Evolution Theory) এবং সাংখ্যের প্রকৃতি-পরিণামবাদ প্রায় একরকম। উভয়েই ঈশ্বর-তত্ত্ব বাদ দিয়েই জগৎ-উৎপত্তির মীমাংসা করেছেন। উভয়েই বলেন, ঈশ্বরের প্রত্যক্ষ প্রমাণ নাই। যাহোক, নিরীশ্বর হলেও সাংখ্যশাস্ত্র সবার মান্য; পুরাণ, ইতিহাস, মন্বাদি-স্মৃতি ও ভাগবত-শাস্ত্র, সর্বত্রই সাংখ্যশাস্ত্রের আলোচনা আছে এবং ঐ সকল শাস্ত্রে অনেক সিদ্ধান্তও গৃহীত হয়েছে। গীতাও সাংখ্যের অনেক সিদ্ধান্তই অবিকল গ্রহণ করেছেন। তা যথাস্থানে আলোচিত হয়েছে।

পরবর্তীতে- আত্মসংস্থ-যোগ বা সমাধি-যোগ

3.3) ঔপনিষদিক ব্রহ্মবাদ – বেদান্ত


ব্রহ্মবাদ – বেদান্ত

পরমেশ্বরের জ্ঞান ব্যতীত কেবল কর্ম দিয়েই মোক্ষলাভ হয়, এই মতবাদ সকলের গ্রহনীয় নয়। আর্য-মনীষারা এতে অধিক দিন সন্তুষ্ট থাকতে পারেননি। অমৃতের সন্ধানে অনুসন্ধিৎসু আর্য ঋষিরা শীঘ্রই বেদার্থচিন্তনে নিমগ্ন হয়ে স্থির করলেন যে, নামরূপাত্মক দৃশ্য-প্রপঞ্চকের অতীত যে নিত্যবস্তু, জ্ঞানযোগে তাকেই জানতে হবে, তাই পরতত্ত্ব, তাই ব্রহ্ম – ‘তদ্‌ বিজিজ্ঞাসস্ব তদ্ব্রহ্ম’। জ্ঞানেই মুক্তি, কর্মে নয়; কর্ম বন্ধনের কারণ। এতে স্বর্গ আদি লাভ হতে পারে, কিন্তু স্বর্গ মোক্ষ নয়। বেদের আরণ্যক ও উপনিষৎ-ভাগে এই ব্রহ্মতত্ত্বই সবিস্তারে বিবৃত হয়েছে। উপনিষৎ বেদের অন্ত বা শিরোভাগ, এজন্য এর নাম বেদান্ত। উপনিষৎসমূহ বিভিন্ন ঋষি কর্তৃক কথিত হয়েছে। যা সংখ্যায় অনেক, তারমধ্যে ঈশ, ঐতরেয়, কৌষীতকী, তৈত্তিরীয়, বৃহদারণ্যক, কেন, ছান্দোগ্য, প্রশ্ন, কঠ, শেতাশ্বতর, মুণ্ডক, মাণ্ডূক্য – এই বারোটি প্রাচীন ও প্রামাণ্য। এদের মধ্যেও পরস্পর মতভেদ আছে। মহর্ষি বাদরায়ণ ব্রহ্মসূত্রে সে সমস্ত বিভিন্ন মতের বিচারপূর্বক তাদের বিরোধ মিমাংসা ও সমন্বয় বিধান করেছেন। বেদান্ত-দর্শন, উত্তর-মীমাংসা, শারীরকসূত্র, ব্যাসসূত্র প্রভৃতি ব্রহ্মসূত্রেরই নামান্তর।

এভাবে বৈদিক ধর্মের দুই স্বরূপ দেখা দিল। বেদের সংহিতা ও ব্রাহ্মণভাগ নিয়ে কর্মকাণ্ড এবং আরণ্যক ও উপনিষদ-ভাগ নিয়ে জ্ঞানকাণ্ড। দর্শন সমূহের মধ্যে জৈমিনিসূত্র বা পূর্ব-মীমাংসায় কর্মমার্গ এবং ব্যাসসূত্র বা উত্তর-মীমাংসায় বর্ণিত হয়েছে জ্ঞানমার্গ।

পরবর্তীতে- কাপিল সাংখ্য – পুরুষ-প্রকৃতিবাদ

3.2) ত্রয়ীধর্ম : বেদবাদ


ত্রয়ীধর্ম : বেদবাদ

সনাতন ধর্মে যাগযজ্ঞ আদির প্রাধান্য ক্রমশঃ বৃদ্ধি পায় এবং বৈদিক ধর্ম সম্পূর্ণ কর্মপ্রধান হয়ে উঠে। ঋক্‌, যজুঃ, সাম – এই তিন বেদই এই ধর্ম প্রতিপাদন করেন, এজন্য এর নাম ‘ত্রয়ীধর্ম’। (অথর্ববেদের যজ্ঞে ব্যবহার নেই তাই বোধ হয় উহা ত্রয়ীর মধ্যে পরিলক্ষিত হয়নি)। বেদের ব্রাহ্মণ-ভাগ এই সকল যাগ-যজ্ঞের বিস্তৃত বিধি-নিয়মে পরিপূর্ণ। বিভিন্ন ব্রাহ্মণ-গ্রন্থে বর্ণিত বিবিধ বিধি-নিয়মের বিরোধ মিমাংসা ও সামঞ্জস্য-বিধানে জৈমিনিসূত্র বা পূর্বমীমাংসা দর্শন প্রণীত হয়। কর্মমীমাংসা, যজ্ঞবিদ্যা ইত্যাদি এরই নামান্তর। মীমাংসা-দর্শন অপেক্ষাকৃত পরবর্তী কালের হলেও উহার কর্মমার্গ সর্বপ্রাচীন; অধুনা যাগ-যজ্ঞাদি শ্রৌতকর্ম অধিকাংশই লুপ্ত হয়েছে, কিন্তু বেদার্থ-অনুসরণে ব্যবস্থিত মন্বাদি-শাস্ত্রবিহিত পঞ্চমহাযজ্ঞ, বর্ণাশ্রম আচার, দান-ব্রত-নিয়ম আদি স্মার্তকর্ম এখনো অনেকাংশে প্রচলিত আছে। কর্মমার্গ বলতে এখন সেটাই বুঝায়। কিন্তু মীমাংসকরা বেদোক্ত কর্মকাণ্ড বা ত্রয়ীধর্মের যে ব্যাখ্যা করেন তার কিছুবিশেষত্ব আছে। এই মতে যাগযজ্ঞই একমাত্র নিঃশ্রেয়স, তাতেই স্বর্গ ও অমৃতত্ব লাভ হয়। যজ্ঞকর্মই জীবের একমাত্র ধর্ম – কারণ সেটি বেদের আদেশ। শব্দ নিত্য, বেদমন্ত্র অপৌরুষেয়, নিত্য, স্বতঃপ্রমাণ – কর্ম বাইরের অভিব্যক্তি, কর্মই তার একমাত্র প্রতিপাদ্য। সুতরাং বেদবিহিত কর্মই একমাত্র ধর্ম। মীমাংসকরা নিত্যশব্দবাদ ও স্ফোটতত্ত্বের বিচারে অসাধারণ পাণ্ডিত্য ও যুক্তিমত্তার পরিচয় দিয়েছেন; কিন্তু দুঃখের বিষয়, সেটি তাঁদেরকে নিরীশ্বর করেছে। মীমাংসা-শাস্ত্রে কোথাও ঈশ্বর প্রসঙ্গ নেই। ইন্দ্র আদি-দেবতাও তাঁরা স্বীকার করেন না, তাঁদের মতে দেবতা মন্ত্রাত্মক। ব্রহ্ম, ঈশ্বর, দেবতা সকলই অর্থবাদ; জ্ঞান, ভক্তি নিরর্থক। কর্মই কর্তব্য, আর-কিছু নেই। এর নাম বেদবাদ। গীতায় ‘বেদবাদরতাঃ’ ‘নান্যদস্তীতিবাদিনঃ’ ইত্যাদি বাক্যাংশে এই মতাবলম্বীদেরকে লক্ষ্য করা হয়েছে।

পরবর্তীতে- ঔপনিষদিক ব্রহ্মবাদ – বেদান্ত