আশ্লিষ্য বা পাদরতাং পিনষ্টু মাম্
অদর্শনান্মর্মহতাং করোতু বা ।
যথা তথা বা বিদধাতু লম্পটো
মৎপ্রাণনাথস্তু স এব নাপরঃ ॥ ৮ ॥
যথা তথা বা বিদধাতু লম্পটো
মৎপ্রাণনাথস্তু স এব নাপরঃ ॥ ৮ ॥
অনুবাদঃ শ্রীকৃষ্ণ আমায় ভালবেসে আলিঙ্গনই করুন, কিংবা তাঁর পদতলে পিষেই ফেলুন, আমাকে দেখা না দিয়ে আমার হৃদয়কে পুড়িয়ে ছারখারই করুন, সে লম্পট যা ইচ্ছা তাঁর তাই করুন, তথাপি তিনিই আমার প্রাণনাথ, আর কেহ নয় ।
অমৃত-প্রভা ভাষ্যঃ
এই শ্লোকেই ভক্তের ব্যাধির অব্যর্থ মহৌষধী । আমার অসীমকে সীমার মধ্যে পেয়েছি । তাই এই principle-কে সবসময় আঁকড়ে ধরে রাখতে হবে । আমরা অসীমের সঙ্গে সম্বন্ধযুক্ত হতে যাচ্ছি, তখন একথাও মনে রাখতে হবে যে, তিনি প্রেমের, সৌন্দর্য্যের দেবতা হলেও তিনি অসীম । আমাদের কাছে তিনি এক, কিন্তু তাঁর ত’ আমাদের মত বহু ভক্ত, তিনি আমাদিগকে প্রেমে আলিঙ্গন, আদর করলেও আমরা তার উল্টোটার জন্যও প্রস্তুত থাকব । কৃষ্ণের আদর ও অনাদর—দুটোর জন্যই আমার নিজেকে প্রস্তুত রাখব; যে কোন বিপরীত ব্যবহার—অনভিপ্রেত ব্যবহার পাই, সবই সমানভাবে গ্রহণ করব ।
কৃষ্ণ কোন সময় উদাসীন হতে পারেন । তিনি আমাদের অনাদর করে যখন কোন পীড়া দেন তাতে তিনি যে নিকটতর তা বুঝতে হবে, কিন্তু যদি উদাসীনতা দেখান, তবে তা যথেষ্ট অসহ্য দণ্ড বলে মানতে হবে । ভক্ত তখন চিন্তা করে, কৃষ্ণ আমাকে এত এড়িয়ে যাচ্ছেন, এত অনাদর করছেন যে, বোধ হয় তিনি আমার সাথে কোন সম্পর্কই রাখতে চান না । তিনি কি আমাকে জানেন না ? আমি কি তাঁর পর ? তাঁর অজানা । তাঁর দণ্ডকেও তাঁর কৃপা বলে মাথা পেতে নেব । কিন্তু তাঁর উদাসীনতা ত’ অসহ্য!সবচেয়ে বেশী পীড়াদায়ক ।
ভক্তের বিরহবিধুর যন্ত্রণা এইখানেই শেষ হয় না । তা আরও গভীরভাবে তার মর্মস্থলে আঘাত হানে । কৃষ্ণ যখন আর কাউকে ভালবেসে আমার চক্ষের সামনেই আলিঙ্গন-চুম্বন করেন, তাতে একটুও দ্বিধা বোধ করেন না, তখন ভাবে এ ত’ আমারই দাবী; আমারই সামনে আর কেউ কেড়ে নেবে!—এই ভাবনাতেই তার দুঃখ-যন্ত্রণা আরও বাড়তে থাকে ।
এই ত’ প্রেমের রীতি, প্রেমের স্বভাব! প্রেমের রীতি সবই সহিতে পারে, কিন্তু উদাসীনতা তার অসহ্য । তবুও তা সহ্য করতেই হয় । গোড়া থেকেই আমাদের বুঝা দরকার যে, কৃষ্ণপ্রেমের অর্থই এই । সে ত’ Autocrat—স্বেচ্ছাচারী । সে ত’ প্রেমবিগ্রহ! আর প্রেম অর্থ দয়া justice নয় । প্রেমের রাজ্যে কোন নিয়ম খাটে না; There is no law there । তা জেনেই ত’ আমরা সেই কৃষ্ণপ্রেমকেই আমাদের সৌভাগ্য বলে বরণ করে নিয়েছি । তাই সেখানে justice আশা করার কোন মানে নাই । কৃষ্ণপ্রেমেও কোন শুদ্ধ আইনি বিধান নাই, তা ত’ স্বাধীন! তা যেখানে সেখানে যার তার প্রতি হয়ে যেতে পারে । তাই আমরা কিই বা দাবী, অধিকারটা সাব্যস্ত করব ?—আমাদের কোন অধিকারই ত’ সেখানে খাটে না!
সর্ব্বোচ্চ কৃষ্ণপ্রেমের রীতিটাই এই । এই প্রেম ত rate—ক্বচিৎ কারো ভাগ্যে ঘটে! তাই আমাদের দিক্ থেকে দ্বিধাহীন আশ্রয় নেওয়া, শরণাগতিই দরকার । এইটিই প্রকৃত প্রেম । এই প্রেমের জন্য সব কিছুকেই স্বীকার করে নিতে প্রস্তুত থাকতে হবে । ‘Die to live’ যদি তোমার এই মনোভাব নিয়ে ভাল-মন্দ সবটাকেই স্বচ্ছন্দে, নির্বিকারে মেনে নিতে পার, তবে সেই exalted plane-এ পৌঁছাতে পারবে ।
প্রেম আইনের ঊর্দ্ধেঃ
ন্যায় আইনের গণ্ডীর ভিতর থাকে । দয়া বা করুণাবৃত্তিটি কিন্তু আইনের উপরে, প্রেম ত’ বটেই । প্রেম আইনের উপরে, আবার প্রেমেরও নিজস্ব আইন law আছে । শ্রীল রূপগোস্বামিপাদের এই শ্লোকটিতে এইটিই বলা হয়েছে—
বিরচয় ময়ি দণ্ডং দীনবন্ধো দয়াম্বা
গতিরিহ ন ভবত্তঃ কাচিদন্যা মমাস্তি ।
নিপততু শতকোটিনির্ভরং বা নবাম্ভস্
তদপি কিল পয়োদঃ স্তূয়তে চাতকেন ॥
গতিরিহ ন ভবত্তঃ কাচিদন্যা মমাস্তি ।
নিপততু শতকোটিনির্ভরং বা নবাম্ভস্
তদপি কিল পয়োদঃ স্তূয়তে চাতকেন ॥
চাতক পাখীর স্বভাব ত’ সকলেই জানে । সে বর্ষার জল ছাড়া অন্য কোন জলই খাবে না । সে জল নদীরই হোক বা পুকুরের হোক বা সমুদ্রেরই হোক । সে কেবল উপরের দিকে ঠোঁট মেলে বর্ষার জলবিন্দুকেই চায় । শ্রীল রূপ গোস্বামী এই উপমাটি দিয়ে ভক্তগণকে বলতে চান যে তাঁরা যেন কৃষ্ণপ্রেমের একবিন্দু ব্যতীত অন্য কোন প্রেমই না চান ।
ভক্ত প্রভুর কাছে প্রার্থনা জানায়, “তুমি পতিত জনের বন্ধু, তাই আমার আশাবন্ধ । তুমি কৃপাই কর, আর দণ্ডই দাও, আমার তোমার পাদপদ্ম ছাড়া অন্য কোন আশ্রয় নাই ।”
আমাদের শরণাগতি ঠিক ঐ চাতক পাখীর মত হওয়া চাই । তার ত’ কেবল দৃষ্টি আকাশ থেকে সেই বারিবিন্দুর জন্য, সে বারি প্রচুর এসে তার তৃষ্ণা দূর করুক, তাকে ভাসিয়ে দিক্, অথবা বজ্রপাত হয়ে সে ধ্বংসই হোক, তার কেবলই প্রার্থনা সেই বর্ষার বারিবিন্দু । কৃষ্ণের প্রতি আমাদের সেইরূপ মনোভাব হওয়া চাই । তিনি কৃপা করুন, আর নাই করুন, আমার একমাত্র পথ—তাঁর চরণেই শরণাগতি ।
এ প্রসঙ্গে আমার একটি শ্লোক মনে পড়ে । যখন শ্রীকৃষ্ণ কুরুক্ষেত্রে শ্রীরাধারাণী ও গোপীগণের সঙ্গে মিলিত হলেন, তখন তিনি নিজেকে তাঁদের কাছ থেকে এত দীর্ঘদিন দূরে রাখাতে তিনি যে ভয়ানক অন্যায় করেছেন, তা তাঁর অনুভব হল । তিনি তাতে নিজেকে এতটা অপরাধী মনে করলেন যে, শেষে তিনি শ্রীমতী রাধারাণীর পায়ে ধরে ক্ষমা চাইলেন ।
একজন ভক্তকবি এই প্রসঙ্গটিকে একটি শ্লোকের মাধ্যমে প্রকাশ করেছিলেন এবং শ্রীরূপ গোস্বামী স্বরচিত পদ্যাবলীতে উদ্ধার করেছেন । সে সময় কৃষ্ণ ভারতবর্ষের একছত্র সম্রাট, কিন্তু তিনি যখন বৃন্দাবনের মাঝে গোপীগণের কাছে এলেন তখন তিনি নিজেকে অত্যন্ত অপরাধী মনে করলেন, এবং অনুতপ্ত হয়ে নুয়ে পড়ে শ্রীরাধারাণীর পা ধরতে যাচ্ছেন এমন সময় শ্রীরাধারাণী পিছিয়ে গিয়ে বললেন, “এ তুমি কি করছ ?আমার পা ছুঁতে যাচ্ছ কেন ? আশ্চর্য্য! তোমার কি আত্মবিস্মৃতি ঘটল!
“আমিই প্রকৃত অপরাধী”ঃ
“তুমি এ বিশ্বের স্রষ্টা—প্রভু । তোমার কার্য্যের ত’কোন কৈফিয়ৎই দাবী করা চলে না—তুমিই আমার প্রাণনাথ, আমার হৃদয় সর্বস্ব, আমি তোমার ক্রীতদাসী । হতে পারে তুমি কোন কারণে অন্যত্র ব্যস্ত ছিলে । তাতে কি ক্ষতি হল ? তোমার তাতে দোষটা কি ? তাতে কিছুই আসে যায় না । যাবতীয় শাস্ত্র ও সমাজ ত’ তোমাকে সে অধিকার দিয়েই আছে । তাতে কোন দোষও নাই, অপরাধও নাই । তুমি কিছুই অন্যায় কর নাই ।”
“আমিই প্রকৃত অপরাধী । নীচতা আমাতেই আছে । সব দোষই ত’ আমার । আমাদের এই বেদনাদায়ক বিচ্ছেদের জন্য তুমি দায়ী নও । কেনই তুমি নিজেকে এত দোষী বলে মনে করছ ? আমিই যে প্রকৃত অপরাধী, তার জ্বলন্ত প্রমাণই হচ্ছে যে তোমার বিচ্ছেদেও আমি বেঁচে আছি! তোমার বিরহে মরে যাই নাই ।
জগতে আমি মুখ দেখাচ্ছি! তাই তোমার প্রতি আমার প্রকৃত প্রেমই নাই । তোমার প্রেমের গাঢ়তা ত’ আমার নাই! তাই আমিই ত’ অপরাধী, তুমি নও । শাস্ত্রে নারীর পাতিব্রত্য ও সতীত্বের প্রশংসা করা হয়েছে । তাই এখনকার মিলনে আমারই ত’ তোমার পায়ে ধরে ক্ষমা চাওয়ার কথা । তোমার প্রতি যে আমার প্রেম নাই সেই জন্যই । আমি এখনও দেহ ধরে রয়েছি, লোককে মুখ দেখিয়ে বেড়াচ্ছি । সত্যিই ত আমি তোমার যোগ্য নই । তাই তুমিই আমায় ক্ষমা কর । আর তা না করে তুমি ক্ষমা চাইছ ?এ তো বড়ই বিপরীত কথা! এ কি ? তুমি এমন কোরো না ।”
কৃষ্ণের প্রতি আমাদের প্রেমের এই আদর্শই হওয়া চাই । সসীম আমরা অসীমের প্রতি এই রকমই ভাবধারা পোষণ করব ।
কোন সময় তিনি হয়ত আমাদিগের প্রতি কোন নজরই না দিতে পারেন; আমরা কিন্তু তাঁর প্রতি সর্বদা উন্মুখ হয়ে থাকব । এর কোন alternative নাই—বিকল্প নাই । শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু আমাদের উপদেশ দিয়ে বললেন যে, আমাদের কৃষ্ণের প্রতি ঐকান্তিক ভক্তি ব্যতীত অন্য পন্থা নাই, কারণ আমরা দীনাতিদীন, অতি নগণ্য এই-ই আমাদের বিচার ।
যদি আমরা এত বিরাট বস্তু পেতে চাই, তাহলে আমাদের নিজেদেরকে অবজ্ঞা করলে ত’কোন ক্ষতি নাই । নিজেকে পুরোপুরি ভুলে যাওয়া, নিজেকে সম্পূর্ণ বিলিয়ে দেওয়ার চিত্তবৃত্তিই একমাত্র কাম্য । যুদ্ধের জন্য, দেশের জন্য যে সৈনিক নিজেকে প্রস্তুত করছে তার আবার বিলাস, সুখ-সুবিধার চিন্তা করার অবসর কোথায় ?
এই প্রসঙ্গে আমার মনে আছে, গান্ধীজী যখন অহিংসা সংগ্রামসেনা গঠন করলেন, তখন একজন স্বেচ্ছাসেবক চাইলেন, “আমাদের জন্য একটু চায়ের ব্যবস্থা করা যাক,” গান্ধীজী তাকে বললেন, “তোমার জন্য নদীর জল মাত্র যোগাড় করা যেতে পারে । কিন্তু চা নয় । যদি তাতেই তুমি রাজি, তবে চলে এস ।” সেই রকম আমরা যখন কৃষ্ণের বৃন্দাবন-লীলার পরিকর হওয়ার বাসনা রেখেছি, তখন কোন চুক্তি করা চলে না । তাহলেই আমরা শ্রীমন্মহাপ্রভুর “তৃণাদপি সুনীচেন” উপদেশের মর্ম্ম উপলব্ধি করতে পারব । আমাদের দিক্ থেকে কোন অনুযোগ বা শর্ত রাখা চলবে না । শুধুমাত্র নিজের বর্তমান জীবনের বাহ্যিক অবস্থাতেই নয়, এমন কি আমাদের নিত্য জীবনে আমাদের দিক থেকে সকল প্রকার অভিযোগ বা শর্তকে সযত্নে পরিহার করে চলতে হবে এবং আমরা অপরিহার্য্য-ভাবেই আমাদিগকে প্রভু নির্দেশিত বিধানই সম্পূর্ণরূপে গ্রহণ করব । কৃষ্ণ আমাদের আত্মসাৎ করুন আর নাই করুন, আমরা তাঁকেই চাইব । তাহলেই সাধনরাজ্যে আমাদের উন্নতি হবে ।
যে কোন উপায়েই হোক, যদি আমরা কৃষ্ণের সেবক-গোষ্ঠীতে প্রবেশ করতে পারি, তা হলে দেখতে পাব যে প্রায় প্রত্যেকেরই স্বভাব এই রকম । যখন তাঁরা মিলিত হন, তখন পরস্পর একে অন্যকে ঐ অবস্থায় সান্ত্বনা দিতে থাকেন । বিভিন্ন সেবা-সম্পর্কে একই স্বভাবের ভিন্ন ভিন্ন সেবকগোষ্ঠী রয়েছেন এবং তাঁরা কৃষ্ণকথা বলেই পরস্পরকে সান্ত্বনা দেন । শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় শ্রীকৃষ্ণ বলেন,
মচ্চিত্তা মদ্গতপ্রাণা বোধয়ন্তঃ পরম্পরম্ ।
কথয়ন্তশ্চ মাং নিত্যং তুষ্যন্তি চ রমন্তি চ ॥
কথয়ন্তশ্চ মাং নিত্যং তুষ্যন্তি চ রমন্তি চ ॥
আমার ভক্তগণ পরস্পর মিলিত হন, আমার কথা কীর্ত্তন করেন, এবং ভাব বিনিময় করে পরস্পরকে সান্ত্বনা দেন এবং তাঁরা এমনভাবে ব্যবহার করেন যাতে বুঝা যায়, তাঁরা আমার সম্বন্ধীয় আলাপেই বেঁচে থাকেন—এইটিই তাঁদের আহার । এইটিতেই তাঁরা সবচেয়ে বেশী আনন্দ পান এবং যখন তাঁরা আমার কথা বলেন, তাঁরা মনে করেন যেন তাঁরা আমার সঙ্গেই রয়েছেন ।
তেষামেবানুকম্পার্থমহমজ্ঞানজং তমঃ ।
নশ্যামি আত্মভাবস্থো জ্ঞানদীপেন ভাস্বতা ॥
নশ্যামি আত্মভাবস্থো জ্ঞানদীপেন ভাস্বতা ॥
“যখন আমার ভক্তগণ আমার বিরহে অত্যন্ত কাতর হয়ে পড়েন, তখন তাঁদের নিকট হঠাৎ আবির্ভূত হয়ে তাঁদের আমার সঙ্গদান করে তাঁদের তৃষ্ণা নিবারণ করি ।”
বেদনাতেও সুখানুভবঃ
শিক্ষাষ্টকের শেষ শ্লোকে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু আর একটি সুন্দর ও উচ্চতর সান্ত্বনার কথা প্রকট করেছেন । আর ঐ কথাটি শ্রীল কবিরাজ গোস্বামী বেশ ভালভাবে বুঝিয়ে দিয়েছেন—
বাহ্যে বিষজ্বালা হয়ভিতরে আনন্দময়
কৃষ্ণপ্রেমের অদ্ভুত চরিত ।
কৃষ্ণপ্রেমের অদ্ভুত চরিত ।
ভয় পেওনা । বাহিরের দিক্ থেকে তোমরা অত্যন্ত তীব্র বিরহবেদনা অনুভব করতে পার; কিন্তু অন্তরে একপ্রকার অতুলনীয় রস, একটা সুখকর প্রশান্তি, আনন্দ অথবা ecstacy অনুভব করবে । বাহ্যে বিরহ জ্বালা, অন্তরে প্রেমসুখাস্বাদন ।
এই ভাবে আমরা শাস্ত্রের কথাতে পাই; আর নিজের অন্তরের অনুভবও ঐ সূক্ষ্মতম ব্যাপার অনুমোদন করে । ইংরাজী কবি সেলি (shelley) লিখেছেন—
“Our sincerest laughter
With some pain is fraught;
Our sweetest songs are those
That tell of saddest thought.”
With some pain is fraught;
Our sweetest songs are those
That tell of saddest thought.”
যখনই আমরা কোন মহাকাব্যে নায়ক-নায়িকার নির্মম তীব্র বিরহগাথা শ্রবণ করি, তখন তাতে চোখে জল আসলেও তা এত মধুর যে তা শুনা বা পড়া বন্ধ করি না—এইটাই ঐ বিরহবেদনার চমৎকারিতা । যখন আমরা অন্তঃসত্ত্বা সীতাদেবীর নির্জন বনে নির্বাসনের দুঃখের কাহিনী পড়ি তখন আমরা চোখের জল ফেলি, কিন্তু পড়া ছাড়তে পারি না । দুঃখের মধ্যেও যে আনন্দ আছে, এই তার প্রমাণ ।
কৃষ্ণের কাছ থেকে বিরহ ঠিক এই প্রকার । কৃষ্ণপ্রেমের বিশেষত্ব এই প্রকার । বাইরে তীব্র বিচ্ছেদ-যন্ত্রণা আগ্নেয়গিরির লাভার মত বয়ে যেতে থাকে, কিন্তু অন্তরে এক অনির্বচনীয় আনন্দের অনুভূতি আসে । শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু এই শ্লোকে তাই প্রকট করেছেন । তাঁর উপদেশ অনুসরণ করলে আমাদের ঐ প্রকার দুঃখানুভবের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে । বৃন্দাবনে প্রবেশের এইটিই পাথেয় । আর যখন আমরা আমাদের মতই বিরহবিধুর আরও বহু ভক্তকে দেখব তখন আমাদের মর্মবেদনার অন্ত থাকবে না; সুখানুভবের সীমা থাকবে না । অন্যেরাও আমাদের সান্ত্বনা দিতে থাকবে । এই জন্যই ত’ ভয়ের কোন কারণ দেখি না । এসব সত্ত্বেও আমরা জানি সেই ধামই আমাদের নিত্য বাসস্থলী । আমরা স্বধামে—প্রভুর কাছেই ফিরে যেতে চাই ।
সেখানে আমরা বিদেশী নই । এখানেই আমরা বিদেশী । এখানে সকলেই আমাকে তার কাজেই লাগাতে চায় । কিন্তু বৃন্দাবন ধাম ত’ আমার নিজের বাসস্থান । সেখানেই ত’ আমার সব কিছু; অন্তরের শান্তি-তৃপ্তি সব সেইখানেই আছে । এখানে থেকে প্রকৃত সুখ-শান্তি কি বস্তু তা জানতেই পারি না । এইটাই এখানে আমাদের অসুবিধা । তাই আমরা কৃষ্ণচেতনায় যতখানি প্রতিষ্ঠিত হতে থাকি, ততখানি প্রকৃত বাস্তব সুখের সন্ধান পেতে থাকি, সৌন্দর্য্য, আনন্দ ও চমৎকারিতার আস্বাদন পেতে থাকি—এইভাবেই আমরা উত্তরোত্তর উন্নতির পথে এগোতে থাকি । শ্রীল যমুনাচার্য্য বলেন—
যদবধি মম চেতঃ কৃষ্ণপাদারবিন্দে
নব-নব-রসধামন্যুদ্যতং রন্তুমাসীৎ ।
তদবধি বত নারীসঙ্গমে স্মর্য্যমাণে
ভবতি মুখবিকারঃ সুষ্ঠুনিষ্ঠীবনঞ্চ ॥
নব-নব-রসধামন্যুদ্যতং রন্তুমাসীৎ ।
তদবধি বত নারীসঙ্গমে স্মর্য্যমাণে
ভবতি মুখবিকারঃ সুষ্ঠুনিষ্ঠীবনঞ্চ ॥
“ব্রজের কৃষ্ণপ্রেমের সন্ধান যতদিন পর্য্যন্ত পাই নাই ততদিন পর্য্যন্ত জগতের সুখটাই আমার কাছে খুবই মূল্যবান মনে হত, কিন্তু এখন মনে কোন জাগতিক সুখের কথা এলেই মনে বিকার আসে, ঘৃণায় থুথু ফেলতে ইচ্ছা করে ।”
তাই আমরা যখন কৃষ্ণপ্রেমরসের একবিন্দুর আস্বাদন পাই, তখন বুঝতে পারি জগতের যাবতীয় সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য, আনন্দ তার তুলনায় অতি তুচ্ছ, অতি হেয় মনে হয়, আবার তার সঙ্গে সঙ্গেই আমরা সেই ভূমিকায় যেতে পারলে জগতের কোন দুঃখ-যন্ত্রণাই তাতে বাধা দিতে পারে না ।
এর আর একটা দিকও আছে । যদিও আমাদের কৃষ্ণবিচ্ছেদ-দুঃখ সহনের জন্য উপদেশ দেওয়া যায়, কিন্তু আসলে তা দুঃখই নয় । কৃষ্ণ নিজেই বলেন—
“ময়ি তে তেষু চাপি অহম্”
আমি সব সময় আমার ভক্তগণের সঙ্গেই থাকি । যেখানেই একজন ঐকান্তিক ভক্ত থাকেন, কৃষ্ণ ছায়ার মত তার কাছে কাছেই থাকেন, যদিও তাঁকে দেখতে পাওয়া যায় না । এইটিই ত’ কৃষ্ণের স্বভাব ।
অহং ভক্তপরাধীনো হ্যস্বতন্ত্র ইব দ্বিজ ।
সাধুভির্গ্রস্তহৃদয়ো ভক্তৈর্ভক্তজনপ্রিয়ঃ ॥
সাধুভির্গ্রস্তহৃদয়ো ভক্তৈর্ভক্তজনপ্রিয়ঃ ॥
দুর্বাসাকে কৃষ্ণ বলেছেন, আমি ত’ আমার ভক্তেরই অধীন, দাস । ভক্তের ইচ্ছা ছাড়া কোন স্বঃতন্ত্রতাই আমার নাই । কারণ তারা আমাকে শুদ্ধাভক্তির দ্বারা বশ করে ফেলেছে । আমি সব সময় তাদের হৃদয়েই বাস করে থাকি । আমি শুধু ভক্তের অধীন নই, ভক্তের ভক্তগণেরও অধীন । আমার ভক্তের সেবক যারা, তারাও আমার ততখানি প্রিয় ।
কৃষ্ণ ত’ লাড্ডু নন!ঃ
আমরা কৃষ্ণের জন্য সবকিছু সহ্য করবার জন্য প্রস্তুত থাকব, এটা সত্যি, কিন্তু এতে নিরুৎসাহিত হওয়ার কিছু নাই । কৃষ্ণ প্রেমময়; আমাদের প্রতি তাঁর করুণার তুলনা নাই । তথাপি শ্রীমন্মহাপ্রভু আমাদের সতর্ক করে দিয়ে বলছেন, “তুমি কৃষ্ণকে পেতে চাও? কৃষ্ণ ত’ ময়রার দোকানের লাড্ডু নন যে কিনে টুপ্ করে গিলে ফেলবে! তুমি যখন সবচেয়ে সেরা জিনিষটা চাইছ, তখন তার জন্য সব কিছুতেই প্রস্তুত থাক ।”
সেই বেলায় ভক্তগণও আমাদের কাছে এসে বলেন, “ভয় কিসের ? আমরা ত’ তোমারই মত । চল আমরা একসঙ্গেই চলি, ভয় নাই, আমরা ত’ আছি ।” শাস্ত্র বলেন, কৃষ্ণের চেয়ে কৃষ্ণভক্তগণ আরও কৃপালু । তাই আমাদের আশা-ভরসা ত’ কৃষ্ণের ভক্তেরাই । আর কৃষ্ণ ত’ নিজেই বলেন,
“মদ্ভক্তানাং চ যে ভক্তা”
আমার ভক্তের ভক্তরাই আমার প্রকৃত ভক্ত ।
তাই সাধুসঙ্গই আমাদের সবচেয়ে বেশী মূল্যবান । কৃষ্ণের কাছে যেতে গেলে পথপদর্শক বা guide ত’ সাধুরাই ।
“সাধুসঙ্গ সাধুসঙ্গ সর্বশাস্ত্রে কয় ।
লবমাত্র সাধুসঙ্গে সর্বসিদ্ধি হয়॥”
সমস্ত শাস্ত্রের সার কথাই হল সাধুসঙ্গ । এই সাধুসঙ্গের ফলে ভক্তিরাজ্যের সবকিছুই সহজে পাওয়া যায় । জীবনের চরমসিদ্ধিতে পৌঁছাতে গেলে সাধুসঙ্গই সহায়-সম্পদ ।
You must be logged in to post a comment.