বৈদিক ভাব প্রসার-ভারতের বাইরে
সাম্প্রদায়িক বিরোধের কথা আগেও বলেছি। শ্রুতিতে ইন্দ্র-বিরোচনের গল্প আছে। একই গুরুর কাছে, একই শিক্ষা পেয়ে ইন্দ্র হলেন আত্মবিৎ আর বিরোচন দেহকেই ‘আত্মা’ মনে করলেন। এই বিরোধের ফল স্বরূপ বিরোচনের দল নতুন সম্প্রদায় স্থাপন করলেন ও সাম্প্রদায়িকতার ঈর্ষায় বৈদিক ধর্মের বিরুদ্ধে দাঁড়ালেন। ইন্দ্রপূজা ও সোমযাগ বহু প্রাচীন, এই উভয়ের সম্বন্ধও ঘনিষ্ঠ। আর্যদের মধ্যেই একদল ইন্দ্র বিরোধী হয়ে দাঁড়ান কিন্তু সোম ভক্ত থাকেন। উভয়েই গোড়া ছিলেন সপ্ত-সিন্ধুবাসী। প্রথমে আর্যদের মধ্যে প্রধান ব্যক্তিরা ঐ বিরোধ মিটমাট করতে এগিয়ে আসেন। নতুন দলের গোঁ ও গোঁড়ামিতে সব মিটমাটের ব্যবস্থা পণ্ড হয়। ইন্দ্র-বিরোধী দলকে ভারত ছেড়ে যেতে হয়। তাঁরা ‘আচেঁসিয়া’ (পারস্য) বা ইরাণে চলে যান। সেখানে সোম হলেন ‘হ্যাওম’, মিত্র হলেন ‘মিথ’ ইত্যাদি। ভারতে সোম, “যজ্ঞস্য আত্মা” (ঋগ্বেদ ৯/২/১০, ৬, ৮), বেদের ত্বষ্টা বা অগ্নি, আদিত্য ও মিত্র হলেন ইরাণীদের ‘ত্বষ্টৃ’, ‘অহুরমজদা’ (অসুরমঘবা= অহুরমজুবা) ও ‘মিথ্র’। ঋগ্বেদে ইন্দ্র হচ্ছেন ‘আদিত্য’ -অগ্নি অবয়বী, ত্বষ্টা বা অগ্নি, নরলোকের বা পৃথিরীর। জরতত্বষ্ট্র হলেন জরতুষ্ট্র (জোরোয়াষ্টার। নতুন দলের ‘অহুরমজদার’ সংক্ষেপ নাম হল ‘অরমাজদ্’, ‘আহিবিম্যান’ হলেন পাপ দেবতা ইত্যাদি)।
কয়েস সাহেব তাঁর লেকচারে বলেছেন যে, (J, C, Coyace, B A. L, L. B.-The Gatha Society Publication) জরথুষ্ট্র ধর্মের প্রথম অবস্থায়, ভগবানের কাছে দুটি প্রার্থনীয় বস্তু ছিল, (১) আত্মার অমরত্ব অর্থাৎ মৃত্যুর পর আত্মার পরলোকে স্থিতি, তাদের মতে সৎকর্মের পরিমাণ বেশী হলে অসৎ কর্মের প্রভাব কমে যায়। (২) স্বাস্থ্য। এ দুটি ছাড়া, শেষের দিনে বিচারের কথা আছে। আমাদের মনে রাখতে হবে যে, ভারত কখনো ধর্মবিশ্বাস নিয়ে বিবাদ করেনি। জরথুষ্ট্র বাদীদের ‘ধৰ্মযুদ্ধ’ (যে নাম নতুন দলই দিয়েছিলেন) সম্বন্ধে তিনি কয়েকটি বিষয় লক্ষ্য করতে বলেছেন, (১) সেটি মতবাদের বা ধর্মবিশ্বাসের ঝগড়া নয় কিন্তু ঐ বিবাদ সভ্যতার দুটি ধারা নিয়ে, (২) সেটি বহুকাল থেকে চলে আসছিল। এই বিরোধ জোরোয়াষ্টার (Zoroaster) আরম্ভ করেনি, কিন্তু তার প্রভাব ও আত্মশক্তিবলে প্রাচীন ধারা উল্টে দিয়েছিলেন। (৩) প্রতিদ্বন্দ্বীদল- অহুরাবিশ্বাসী ও দেব-বিশ্বাসীরা প্রতিবেশী ছিলেন, বস্তুতঃ তাদের মধ্যে অন্তৰ্মিশ্রণ ছিল (“indeed they were intermingled)”। জরথুষ্ট্রের নির্দেশে, কতকগুলো শৰ্তে ইরানীদের এই নব ধর্ম দেওয়া হত। ইরাণীরা “স” স্থানে “হ” বলতেন- ঐ দেশে বাস করায় তাদের উচ্চারণ বৈকল্য দেখা দেয়। জোরোযাষ্টার নামে একাধিক মহাজনের নাম পাওয়া যায়। তাঁরা বিভিন্ন সময়ে উদিত হন ও জরথুষ্ট্র ধর্মের পুষ্টি সাধন করেন। তাঁদের বিস্তৃত বিবরণ এখানে নিষ্প্রয়োজন, তবে একজন জরথুষ্ট্রের নাম পাওয়া যায় ইরাণীদের জারদুস্ত (Eardusht) গ্রন্থে। তাতে আছে যে ঈশ্বর জরথুষ্ট্রকে বলছেন, “পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জ্ঞানী, ব্যাস নামে একজন ভারত থেকে এসে যখন তোমাকে প্রশ্ন করবেন, ‘ঈশ্বর এক সঙ্গে সব সৃষ্টি করেননি কেন, তখন তুমি উত্তর দিও, ভগবানের প্রথম সৃষ্টিশক্তি পরে সেই শক্তির সহায়তায় সমস্ত সৃষ্টি হয়েছে। ঐ গ্রন্থের টিপ্পনিতে আছে যে, বালখ্, নগরে গুস্তাস্প (Gustasp) নামে রাজার সঙ্গে ব্যাস দেখা করেন। রাজা দেশের সমস্ত জ্ঞানীলোককে আহ্বান করেন, জরথুষ্ট্রও আসেন। গুস্তাস্প রাজার সময়েই জরথুষ্ট্র ধর্ম রাষ্ট্রধর্ম (State Religion) বলে গৃহীত হয়। এই ব্যাসের আগমনে জরথুষ্ট্র ধর্মে শক্তিবাদ দেখা দেয়, শক্তিবাদ গৃহীত হলেও ঐ শক্তিবাদ ভারতের ভাবে অনুপ্রাণীত হতে পারেনি, তা ঐ দেশের ভাবেই স্বীকৃত হয়। গ্রীকরা গুস্তাস্পকে বলে Hystaspes, আর, পণ্ডিতদের মতে তার সময় খৃঃ পূঃ ৫০০ বর্ষ। (প্রাচীন বাহ্লিক = ব্যাক্ট্রিয়া)। (দুর্গাদাস লাহিড়ীর পৃথিবীর ইতিহাস-ভারতবর্ষ দ্রঃ)।
ইরাণে চলে যাবার বহু পরে জরথুষ্ট্রের জন্ম হয়। এটা তাঁর বংশলতা থেকে জানা যায়। তিনি তিনবার বিয়ে করেন ও অনেকগুলো ছেলেমেয়ে হয়। বাইবেলের Paradise শব্দটি এসেছে আবেস্তার Parideza থেকে, Cyrus এর নাম অন্ততঃ ১৪ বার বাইবেলের Exita Books এ পাওয়া যায়। Darius একাধিক পারস্য রাজার নাম; এই Darius এর নামও অন্ততঃ ১৩ বার আছে, ঐ রকম Xerxes as Ahsaerus ও Artaxenses নামও ৭ বার বা ঐ রকম আছে। জরথুষ্ট্রের জন্মস্থান উরুমিয়া (Urumiah), সিরিয়া ও আরব্য ভাষায় লেখা এই নাম নিয়ে বেশ ঝগড়া বিবাদ আছে। তাঁর উপনয়ন (পৈতা) ও হয়েছিল। জরথুষ্ট্র নামে অনেক সংস্কারক ছিলেন।
[জরথুষ্ট্র বাদে যুগ বিভাগ ছিল- এক এক যুগ তিন হাজার বৎসরে বিভক্ত অর্থাৎ, চারযুগ ১২০০০ বৎসর (Farvarshi)। গ্রীক পণ্ডিতদের মতে, জরথুষ্ট্র খৃঃ পূঃ ৬০০০ বর্ষে ছিলেন, বড় প্লিনি (Pliny the Elder) বলেন খৃষ্টাব্দ ২৩-৭, Endoxud of Cudus, খৃঃ পূঃ ৩৬৮, Aristotle (এরিষ্টটল) -খৃঃ পূঃ ৩৫০ এবং Hernippus বলেন খৃঃ পূঃ ২৫০, হার্ণিপ্লাস লিখেছেন যে প্লেটোর মৃত্যুর ৬০০০ হাজার বৎসর পূর্রে অর্থাৎ ট্রোজান মহাযুদ্ধের (Trojan War এর) পাঁচ হাজার বর্ষ পূৰ্বে জরথুষ্ট্র বর্তমান ছিলেন। Lactantius বলেন যে, জরথুষ্ট্রের বন্ধু Hystaspes, রোম সম্রাজ্য গঠন হওয়ার বহু পূর্রে মিডিয়ার (Media) রাজা ছিলেন। সুইডাস (দশম শতাব্দী, roth century AD.) বলেন যে দুজন জোরোয়াষ্টার ছিলেন, একজন ট্রোজান মহাযুদ্ধের ৫ হাজার বংসর পূৰ্বের লোক, আর একজন নিনাসের (Ninusএর) সময়ে জ্যোতির্রিদ। Georgius Syrceilus বলেন যে, জরথুষ্ট্র বাবিলন দেশস্থ রাজা ছিলেন। একজন জরথুষ্ট্র ব্যাক্ট্রিয়ার রাজা ও যাদুবিদ্যায় পারদর্শী ছিলেন।]
এই রকম প্রাচীন পণ্ডিতেরা অনেকে জরথুষ্ট্রের নাম করেছেন। উল্লেখিত সংক্ষিপ্ত বিবরণ থেকে বোঝা যায় যে, পরোক্ষভাবে ভারতীয় ভাব কতদূর বিস্তৃতি লাভ করেছিল। ইউরোপীয় পণ্ডিতেরা জরথুষ্ট্রের সময় বলেন, খৃঃ পূঃ ৮০০ বর্ষ, কোন কোন পণ্ডিতের মতে জরথুষ্ট্র ও বিশতাস্প খৃঃ পূঃ ৬৬০ বর্ষে বৰ্তমান ছিলেন। তারা সব প্রাচীন মত উড়িয়ে দিয়ে একটি মতই স্থাপন করেছেন। সময় কমিয়ে দেখাতে তাদের কৃতিত্ব আছে, যাতে সবই বাইবেলের সৃষ্টি যুগে অর্থাৎ খৃঃ পূঃ ৩/৪০০০ বৎসর পরে হয়। আধুনিক পণ্ডিতরা অনেক পূৰ্বমত উল্টে দিচ্ছেন, কিন্তু ভারতে সাধারণ সমাজে আজও পূৰ্বমত বেশ চলেছে।
মিলস্ সাহেব বলেন, (A story of the Five barathrustian Gathas by Lawrence Mills D.D. দেখুন), যে, পরবর্তী ইহুদি (Jewish) ও খৃষ্টমতবাদের উপর জরথুষ্ট্র ধর্ম অসীম প্রভাব বিস্তার করেছেন। তিনি আরো দেখিয়েছেন Sadduceism, স্যাডুসিবাদ এর স্বাধীন চিন্তা থেকেই ক্যাথলিক মতবাদের রক্ষণশীলতা এসেছে; জরথুষ্ট্রবাদ বা পারসীকবাদ (Parsism) ইহুদি মতবাদের (Judaismএর) পরিবর্তিত নাম ফারিসাইবাদ (Pharisaism) মিল (Mills) সাহেব তার Zarathustra and the Greeks গ্রন্থে বলেন যে, ঈজিপ্ট থেকে বহুদূরে অবস্থিত ভারতে বেদ এর সঙ্গে অবেস্তার সাদৃশ্য বর্তমান, এমন কি উভয়ে একই প্রসঙ্গ দেখা যায়, যথা আদিত্য ও তাঁর মাতা অদিতি- এই দুই শব্দ। অদিতির আদি অর্থ অখণ্ডত্ব, অসীমত্ব, অপ্রতিহত শক্তি (Unboundedness, Infinitude, unfettered Power), এই রকম ভাগ (সংস্কৃত ভাগ্য) শব্দটির মনে সৌভাগ্য, ঐ অখণ্ড ও অসীম সকল বন্ধন মুক্ত স্বাধীন শক্তিকে মাতা বলা হয়েছে। সাহেবের মতে, একে ফাইলোবাদের পূনভ্যুদয় বলে বৈদিক মতের পুনরুক্তি বলাই ঠিক। তার মতে, বেদের ‘ঋত’, -অবেস্তার ‘আশা’ -একটি যথার্থ ইণ্ডো-ইরাণী ‘লোগাস’ (a true Indo-Iranian Logos)-শব্দটি বৈদিক ঋকে প্রায় তিনশত বার ব্যবহার হয়েছে, ফাইলো যখন ঈজিপ্টে বাস করেন, ঐ লোগাস’টি তার অপেক্ষা অন্ততঃ ৫০০ বা ৮০০ বৎসবে পূর্রবর্তী। ‘ক্ষাত্র’ শব্দটিও বেদে ও ‘ক্ষাত্র’ প্রায় ৪৪ বার ব্যবহার হয়েছে, এই রকম বহু দৃষ্টান্ত সাহেব দিয়েছেন। বৈদিক ঋষি বহুমনঃ’ই, অবেস্তায় বহুমানা হয়েছেন। সাহেব বলছেন যে, ফাইলোর যথার্থ গুরু প্লেটো, ভারতীয়দের ও ইরাণীদের সম্বন্ধ ভাল করে জেনে তার মতবাদ গঠন করেন। সাহেব স্পষ্ট স্বীকার করেছেন, যে সময় ভাবতীয় ঋষির মুখে সামগান গীত হয়, তখন গ্রীসে বা ঈজিপ্টে কোথাও কোন বিদ্যালয় পর্যন্ত ছিল না! অবেস্তা, ইহুদি-গ্রীকে উপর তো নির্ভর করেই না, বরং ফাইলোই অবেস্তার কাছে ঋণী, এমন কি এই কারণে (পারসিক সভ্যতার জন্য) বাবিরুষ(ব্যবিলিয়ন) সভ্যতার গ্রাস থেকে ইউরোপীয় সভ্যতা রক্ষা পেয়েছে। (saved out own from an absorption in the Babylonian)।
সাহেব তার অপর একটি বইতে (zaroastra, Philo, the Achaemendes and Israel) বলেন যে যদিও বিভিন্ন দেশে, আবেস্তায়, এমন কি বৈদিক লিপিতে সেমিটিক প্রভাব বর্তমান বলা হয়, এটা নিশ্চিত যে ইরানী ও ইহুদি শিক্ষার কৰ্ষণার ও বংশপরম্পরাগত কিংবদন্তির উৎপত্তি স্থান এক। এই রকম অক্ষরের বিষয় ছেড়ে দিয়ে পহ্লরী ভাষাতে সেমিটিক প্রভাবের কথা বলা হলে, আমাদের শুনানো হয় যে সেখানে পদগুলোই অক্ষর, পৃথক পৃথক অক্ষর নয়। সুদূর অতীতে সেমিটিক চিহ্ন বা সংকেত ব্যবহার দ্বারাই ঐ সব জাতির মধ্যে আদান প্রদান বোঝা যায়, পরে নব্য পারসিকদের (New Persian) পদগুলোতে সেমিটিক প্রভাব বর্তমান। সাহেব এখানে বলছেন যে, যদি ঐ মতটি ছেড়ে দেওয়া যায়, আবেস্তার মধ্যে কোথায় সেমিটিক গন্ধ ? আবেস্তায় সেমিতিক ভাষার একটি শব্দও নেই, কিন্তু বাইবেলময় ঝুড়ি ঝুড়ি পারসীক ভাষার শব্দ রয়েছে। সাহেবের মতে ‘আক্কাদ’ ও ‘সুমের’ জাতিদ্বয়- যাদের আদিম ভাষায় আর্য শব্দের অত্যন্ত প্রয়োগ আছে, তারা বাবিরুষের চেয়ে অন্ততঃ কিছু প্রাচীন বা পূর্রবর্তী।
[নিয়ত বর্ধমান সুমের জাতিরই এক ভাগ ক্রমে বাসের জন্য সুজলা সুফলা দেশ বিশেষের অন্বেষণে বের হয়ে স্ত্রী-পুং চিহ্নের উপাসনাদি নিয়ে ভারতে প্রবেশ করল। অনেক কাল সমৃদ্ধিশালী হয়ে ভারতে বাসের পর তারই এক শাখা আবার মালাবার উপকূল থেকে নৌযানে মিসরে গিয়ে নীলনদী তীরে অপর এক বৃহৎ সাম্রাজ্য স্থাপন করল”। (সূত্র ভারতে শক্তিপূজা-স্বামী সারদানন্দ)]।
এই সুমেররাই বারিরুষকে কৃষিবিদ্যা শেখান। আসুরীয় জাতিরাও এই সুমেরদের কাছে তাদের সভ্যতার জন্য ঋণী। এই সুমের জাতির ধর্ম ও পুরাণ (গল্পগাথা) ইহুদিরা তাদের দেশে নিয়ে যান। ঐ দ্রবিড় ও পণিদের মিশ্রণে ‘খলদে’ (Chaldeans) জাতির উদ্ভব হয়। যাহোক, সাহেব আরও কয়েকটি কথা বলে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। একজন সম্রাটের নাম ‘পতেশি’ (Pateshi), অবেস্তায় হয়েছে ‘পয়েতিশ’ (Pa(i)tish)। এমন কি বাবিরুষের গোড়ার সৃষ্টিতত্ত্বে ও সমগ্র ধর্মশাস্ত্রের মধ্যে যে ‘অপসু’ শব্দটি রয়েছে, সেটি সংস্কৃত ‘অপ’, বাইবেলের Taimet (তাইমেত) মানে ‘তমস’ বা অন্ধকার, ইরাণীতে অর্থ-পীড়াদায়ক, সমস্ত পীড়ার কারণ (Torment) আবার অবেস্তার Adar শব্দটি বাইবেলে হুবহু উদ্ধৃত হয়েছে ইত্যাদি।
সেমিটিক ভাষা কোন্ গঠন প্রণালীর ছায়া বৈদিক লিপিতে ইউরোপীয় পণ্ডিত দেখতে পান? প্রমাণ কোথায় ? ভারত থেকে কি ভাষা বা লিপি যেতে পারে না? ভারত কি পরেও অনেক জাতিকে ভাষা দান করেন নি ? প্রমাণ কোন দিকে বেশী ? ভাষা স্বস্থান ভ্রষ্ট হলে, লিপির ভঙ্গী কি অন্যরূপ ধারণ করতে পারে না ? তার প্রমাণ কি আজও দেখা যায় না? ‘ব্রাহ্মী ভাষাকেও সেমিটিক বলা হত পূৰ্বে। এখন প্রমাণ হয়েছে যে সেটি ভারতের নিজস্ব। (বঙ্গভাষা ও সাহিত্য-নবসংস্করণ দেখুন)-রায় বাহাদুর শ্রীদীনেশ্চন্দ্র সেন)।
আমরা দেখেছি যে ‘হেলয়’ এর স্থানে ‘হে অলয়’ ও ‘হেলয়’ উচ্চারণ করায় যেমন ‘হেলয়’ শব্দটিকে ‘ম্লেচ্ছে’ বা ম্লেচ্ছ উচ্চারণ ভঙ্গী বলা হয়েছিল, সেই রকম ইরাণীরা ‘অসুর’ শব্দটিকে ‘অহুর’ উচ্চারণ করা এবং তারা আর্য বিরোধী হওয়ায়, অসুর শব্দটির অর্থ ভারতে বোঝাতে আরম্ভ করে দেব-শত্রু। জরথুষ্ট্র ধর্মের প্রাচীন গাথা ‘অহুরা মজদা’ একমাত্র ঈশ্বর রয়েছেন দুজন প্রভু (Payu); এই দুই প্রভুই দুরকমের স্রষ্টা (Yasna XIX, 9)। পরে অর-মাজাদ ও আহিরীমাকে পৃথক সত্ত্বা মেনে নিয়ে ঐ দুজনের বিরোধ বর্ণিত হল- একজন হলেন ভাল দেবতা (Good God), আর একজন হলেন মন্দ দেবতা (Bad God)= স্পেন্টামৈনু ও আংগ্রামৈনু। সেমিটিকদের মধ্যে তাঁরা হলেন God and Satan, ভগবান এবং শয়তান। জরথুষ্ট্র দেখেছিলেন যে জগৎ উৎপত্তির দুটি কারণ আছে, কিন্তু ঐ দুই সত্ত্বা রয়েছে একেরই মধ্যে। বেদে ব্ৰহ্মের সগুণ ও নির্গুণ ভাবের কথা আছে, কিন্তু সেটি একেরই দুভাবে সাধনার কথা, সাধকের রুচি ও মানস অধিকার হিসাবে পৃথক সত্ত্বা নয়। মৈত্ৰায়ণ উপনিষদ (৬/২২) এ দেখি ব্ৰহ্মকে দু’ভাবে ধ্যান করার উপদেশ আছে। ভারতে ঐ রকম ভাবের উপদেশে চিন্তার পার্থক্য থাকলেও সাধন ক্ষেত্রে অভেদ ও অভিন্ন ভাবে ধ্যেয়। ইরাণীয় লোগাসবাদের (বাক্’এর) মূল পাওয়া যায় মৈত্ৰায়ণের ঐ উপদেশে, যা পরে আবেস্তা থেকে ফাইলো পান ও Alexandrian School এর লোগাস হয় ঐ দেশের সংস্কারানুযায়ী। ভারতের সংস্পর্শে এটা সম্ভব হয় প্রথম ইরাণে পরে অন্যত্র। ইরাণীরা আসূরীয়দের (Assyriansদের) ঘনিষ্ট সংস্পর্শে এসেছিলেন। জরথুষ্ট্রবাদীদের য়াষ্ট (Yasts) গ্রন্থের সাজানোর রীতি অবিকল শিরোজার (Shiroza) মত। মাস কে ৩০ দিনে ভাগ করে, প্রত্যেক দিন এক একটি দেবতার নামে নামকরণটি সেমিটিক জাতি থেকেই গৃহীত (Sacred Books of the East-The Zend Avesta, Part II-Max Muller দ্রঃ)। জরথুষ্ট্র ধর্মের সঙ্গে ইহুদি ধর্মের বহু সাদৃশ্য থাকায়, বহু মনীষিরা অনুমান করেন যে উভয় ধর্মেরই উৎপত্তিস্থান অভিন্ন।
লেয়ার্ড সাহেব (A popular Account of Discoveries at Ninevan-Chapp V-By Austin Henry Layard Esq. D C L. দ্রঃ) বলেন যে সম্ভবতঃ ঈজিপসিয়ানদের মত আসিরিয়ানরাও বিভিন্ন বর্ণদ্বারা পুরোহিতের ও অপরের জাতি এবং লিঙ্গ নিরূপণ করতেন। সাহেব বলছেন যে, অন্যান্য মূৰ্তির সঙ্গে দুটি মূর্তি পাওয়া যায়, ঐ মূর্তি দুইটি সামনাসামনি দণ্ডায়মান, মধ্যে একটি পবিত্র বৃক্ষ আর তার উর্দ্ধে রয়েছে ভগবৎ প্রতীক স্বরূপ পাখীর ডানা ও পুচ্ছযুক্ত একটি নরাকার মূর্তি, ঐ ডানা পুচ্ছ দিয়ে বৃত্তাকারে বেষ্টিত। এটি অরমাজদের লিঙ্গস্বরূপ ইরাণীরা নিয়েছেন। (ঐ দ্রঃ)। হিন্দু পুরাণে গরুড়ের কথা আছে, কিন্তু গরুড় বিষ্ণুর বাহনমাত্র, একটি বৃক্ষে জীবাত্মা ও পরমাত্মারূপী দুই পাখীর কথা বেদে আছে, হিন্দু শাস্ত্রে কল্পবৃক্ষের কথাও আছে। ভারতে যে সব কথাগুলো আত্মজ্ঞানের উদ্দীপক, অন্যত্র সেই ধরণের গল্পগুলো কি বিভিন্ন ভাব প্রকাশ করে না? সাহেব লিখেছেন যে, এক যায়গায় খুঁজতে খুঁজতে একটি বাজমূর্তি দেখা যায়। রাজার গলায় ঝোলান ৫টি পবিত্র চিহ্ন- সূর্য, নক্ষত্র, অর্ধচন্দ্র, ত্রিশূল ও শৃঙ্গাকার টুপি- নরমুখী বৃষের যে রকম টুপি থাকে, টুপির আকার সেই রকম।
[গ্রন্থের পাদটীকায় সাহেব বলছেন যে, যদি শৃঙ্গাকার টুপিটি বাদ দেওয়া যায়, ভারতবর্ষে ও ঐ সব প্রতীক চিহ্ন দেখতে পাওয়া যায়, যা বৃষ প্রতীকের সঙ্গে যুক্ত হলে, আসিরিয়ানদের সঙ্গে অদ্ভুত সাদৃশ্যের কথাই মনে পড়ে। ভারতে শৃঙ্গাকার টুপি (horned cap) নেই, আর বেদে বৃষ মানে আকাঙ্খিত ফলবর্ষী-(ঋগ্বেদ ৯ম।৬৪/১/২/৩ ঋকে বৃষ কে সোম, দ্যু, ধর্ম, সত্য ইত্যাদি বলা হয়েছে)। বৃ= বৃদ্ধি, ষ= অন্ত। কারণ ও কার্য। কার্য = সৃষ্টি বা বৃদ্ধি। কারণ = লয়, অন্ত। কারণ কার্য, কার্য কারণ, এই আবর্তন শক্তিই বৃষ। ইনি অভীষ্ট ফল দেন]।
পুরাণের বৃষ, বৈদিক বৃষের প্রতীক মাত্র। Layard বলছেন যে ইরাণীদের ও আসিরিয়ানদের পোষাকও ছিল একই রকম আর পারসীক রাজাদের টুপি (নাম Cidars) ফ্রিজিয়ান বা স্বাধীনতা-প্রতীক-ফ্রেঞ্চ টুপির মত ছিল (resembled the Phrygian bonnet or the French Cap of Liberty)। আসিরিয়ানদের সঙ্গে ঘনিষ্ট সম্পর্কে আসা পারসীকরাও যে অসুর আখ্যা পান, এতে আশ্চর্য কি ? এটাও লক্ষ্য করার বিষয় যে ইরাণীরা সেমিটিক স্পর্শে এসে অসুর স্থানে করেন অহুর, কিন্তু অসিরিয়ানরা সংস্কৃত অসুর শব্দটি ও তার উচ্চারণটি ঠিক রেখেছিলেন অর্থাৎ আসূরীষেরা সেমিটিক উচ্চারণভঙ্গী গ্রহণ করেননি। ভারতীয় চিন্তাধারা, বৈদিক ভাবধারা কতদূর চলেছিল ও স্থানে স্থানে কি ভাবে গৃহীত হয়েছিল, তা বেশ বোঝ যায় এই সব থেকে। পুনঃ যখন ঐ সব ভাব ঘুরে মিশ্রিত হয়ে বা ম্লেচ্ছদেশ থেকে ভারতে ফিরে এসেছে, তখন ঐ সব ভাব ভারত কি ভাবে গ্রহণ করেছেন এ সব অনুধাবন করা প্রত্যেক ভারতবাসীরই উচিৎ। ভারতের ভাস্কর্যেও বৈশিষ্ট্য আছে, ঐক্য আছে, সমস্ত অপরা বিদ্যার আলোচনায় আজকাল যে সব নব নব তথ্য পাওয়া যাচ্ছে, তাতে এই সত্যটি দৃঢ় হচ্ছে।
ভাব সঞ্চরণ এভাবেই অগ্রসর হয়েছিল। ঈজিপ্টে এমন এক যুগ দেখা দিয়েছিল যখন ঐ দেশের দেবস্তুতিতে উচ্চ বা আধ্যাত্মিক অর্থ সংযোগ করার চেষ্টা চলেছিল। শ্রেষ্ঠ ও একমাত্র দেবতার- মহিমা বর্ণনায়, একাদশ বংশের শেষভাগে ফারোয়া রাজা খু-ন-এটেন (khu-n-Aten) ভাষায় প্রাণ ও ভাব সঞ্চার করেছিলেন, কিন্তু এই অধ্যাত্ম-প্রাণ ভাবটি এশিয়া থেকে আমদানি হয়েছিল (But the impulse to the reform came from Asia-The Religion of Ancient Egypt and Babylonia-Sayee.)। খু-ন-এটেনের মা ছিলেন বিদেশী। এশিয়ার ধর্মভাব ঈজিপ্টের ঘাড়ে চাপিয়ে দেবার চেষ্টা বিফল হয়েছিল। সূর্যকে ভগবৎ প্রতীক বলে জোর করে ঐ ফারোয়া রাজের সমস্ত রাজশক্তির পীড়নের মাধ্যমে চাপানোর চেষ্টা এটেনের জীবদ্দশা পর্যন্তই স্থায়ী হয়েছিল। এই রকম কবে ভাবপ্রচার কখনো ভারতে হয়নি। ঐ অত্যাচার বিশেষ ফলপ্রসূ না হলেও দুটি ভাব শিক্ষিতদের মনে গ্রথিত হয়ে উঠেছিল, (১) শিক্ষিত সম্প্রদায় বুঝতে আরম্ভ করেন যে, সাধারণ দেবালয় সমুহে যে নানা দেবতা রয়েছেন তারা সকলেই একেরই অভিব্যক্তি মাত্র, (২) এই জন্য তাঁরা প্রাচীন বিশ্বাসে কখনো আঘাত দেননি, পরে কিন্তু এ ভাব ছিল না। তাদের তখন মনে এল যে, যতই হোক ঐ দেবমূর্তি গুলো ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য রূপমাত্র, রূপ বা আকার বাদ দিলে, ঐ গুলোর মধ্যে ঈশ্বরের সত্ত্বা কিছুই নেই। রাজাই দেবতা, রাজাই-এমন কি ঈশ্বরের অবতার, এই মূল বিশ্বাসটি ঈজিপ্টের ফারোয়ারা আনেন এবং ঐ বিশ্বাসই আদিম বাবিরুষ কৃষ্টির সঙ্গে ফারোয়া সভ্যতার একটি যোগসূত্র। বাবিরুষে, মৃত্যুর পর রাজা দেবতা বলে গণ্য হতেন। বাবিরুষের অধিকাংশ রাজা যারা দেবতার সম্মান পেতেন, সকলেই সেমিটিক ছিলেন। সেই জন্যই, সম্ভবতঃ এই ভাবটি সেমিটিক জাতি থেকে এসেছে আর সম্ভবতঃ, সুমের জাতি প্রথমে এই ভাব গ্রহণ করায়, সুমের ও সেমিটিক সভ্যতার মিশ্রণে বাবিরুষ জাতিরও কৃষ্টির উদ্ভব হয়। রাজার জীবদ্দশাতেই ঐরকম গণ্য হবার ভাব খৃঃ পূঃ ৩৮০০ বর্ষেও বৰ্ত্তমান ছিল (সার্গন ও নারমিসিন সময় অবধি-“Can be traced back as far as Sargon and Naramsin”-Ibid)। পেরুর ইকাসদের মত ফারওয়া ছিলেন সূর্যবংশোদ্ভব। বাবিরুষদের বিশ্বাস ছিল যে, মানবদেহ দেব-দেহের সাদৃশ্যে সৃষ্ট, তাই বাবিরুষেব দেবতার নরাকৃতি। ঈজিপ্টে ছিল কিন্তু ঠিক এর বিপরীত, সেখানে প্রায় সব দেবতাদেরই পশুর আকার।
ভারতে ও রাজশরীরে দেবত্ব আরোপিত হত, সে শরীরও ছিল পবিত্র। রাজা ছিলেন ভারতে ঋষিকুলের অধীন ‘তপোবল সহায়’ পুরোহিতের অধীন। রাজাদের মধ্যে ব্রহ্মবিদ্যার আলোচনা খুব ছিল। আমরা তা দেখেছি, তারা দেহকে নশ্বর মনে করতেন। কিন্তু, ভারত ছাড়া অপর অনেক দেশে সে শরীরের মৃত্যু হয় না, তাই সে শরীর বিনষ্ট হবার পরও, রক্ষা করার জন্য কৌশল উদ্ভাবিত হয়েছিল।
স্বামীজি বলেছেন, “পাশ্চাত্যে এখন শিক্ষা দিচ্ছে যে, ঐ যে কটিতট আচ্ছাদনকারী অজ্ঞ, মূর্খ, নীচজাতি, উহারা অনার্যজাতি। উহারা আর আমাদের নয়!!!” (বর্তমান ভারত)। অধ্যাপক দাস মহাশয় তার Rgvedic India গ্রন্থে (২য় সংস্করণ) কয়েকটি তথ্য সুন্দর ভাবে নির্ণয় করেছেন। ঐ সমস্ত সুস্পষ্ট প্রমাণ হতে বেশ বুঝা যায় যে, কেন ঈজিপ্ট আদি দেশে প্রথম উচ্চ ভাব আসে ও পরে সে সব কেন বিকৃত ভাব ধারণ করে। দাস মহাশয় দেখিয়েছেন যে ঋগ্বেদে সময় ‘দাস’ ‘দস্যু ‘দ্রাবিড়’ প্রভৃতি জাতিদের আদিম বাসস্থল ছিল দক্ষিণ ভারতে। তারা আর্যজাতিদের মধ্যে উচ্ছৃঙ্খল দল মাত্র-অসভ্য ও বর্রর পর্যটক (Aryan nomads in Savage condition), অথবা, আর্যমতের সঙ্গে তাদের সম্পূর্ণ মিল ছিল না। পনিরা ছিল সপ্তসিন্ধু নিবাসী আর্য বৈশ্য (বণিক)। তারা দাক্ষিণাত্যে গিয়ে পাণ্ড্য ও কোলদের মধ্যে আর্যসভ্যতার বিস্তার করে। ঐ দ্রাবিড় জাতিরাই ঈজিপ্ট ও মেসোপোটেমিয়া যান আর পণিদের উপদেশে ঈজিপ্ট ও বাবিরুষে সভ্যতার ভিত্তি স্থাপন করেন। Punic race নামে খ্যাত এই পণিরাই পরে (Syria) সিরিয়ায় যায় ও সেখানে তাদের নাম হয় ফিনিসিয়ান। এইরকম, কাশীয়, হিত্থিতি, মিত্তানি, ফ্রিজিয়ান ও লিডিয়ান প্রভৃতি জাতি যাদের নাম ভারতে বাইরেও প্রচার আছে সকলেই আর্যশাখা, কিন্তু ঐ সব জাতিরা সেমিটিক জাতিদের সঙ্গে মিশে যান, ফলে সেমিটিক সভ্যতা তাঁদের গ্রাস করে।
[দাস মহাশয় “The Kossens, the Hithities, the Mittanis, the Phryginas and the Lydians প্রভৃতি জাতিদের “Pure Aryan immigrants (খাটি আর্য) বলেছেন, কিন্তু তারা “Completely absorbed by the great sematic race” হয়]।
আর্যের ঐ প্ৰকার অভ্যুদয় কত কাল পূৰ্বে হয়েছিল! দাস মহাশয় (Rigvedic India-২য় সংস্করণে) দেখিয়েছেন, বহু প্রমাণ সহ, যে উহা সংঘটিত হয়, ৫০-২৫ হাজার বৎসর পূর্বে অন্ততঃ। দাস মহাশয় আরও বলেন যে পশ্চিম কিম্বা মধ্য এশিয়া থেকে আর্যের আগমন ব্যাপার এই জন্য অসম্ভব যে, সে সময়ে ঐ সব স্থানে অস্তিত্ব ছিল না, অর্থাৎ উত্তর মেরুর নিকট পর্যন্ত সমস্ত স্থানটি সমুদ্র ছিল, ভূতত্ত্বই এর প্রমাণ। তখন এশিয়ার ভূমধ্য সাগর ও ইউরোপের ভূমধ্য সাগর ছিল (Asiatic Mediterranean Sea ও European Mediterranean Sea), ও তাদেরই পূর্ব নিদর্শন স্বরূপ বসফরাস সাগর, আরল সাগর, কৃষ্ণ সমুদ্র ইত্যাদি বৰ্তমান-ভূতত্ত্ববিদ্যা (Geology) এটা সমর্থন করে।
ইউরোপের পশ্চিমাংশে বিভিন্ন জাতির বাস ছিল। প্রস্তর যুগে জন্তু জানোয়ারের পরিষ্কার ছবি থাকলেও, পরবর্তী যুগে সে সব কিছুই নেই। এটাতে মাঝখানে অন্য জাতির আগমন ও প্রভাব বোঝা যায়। অতএব, এক যুগের একটা আদর্শ দেখে পরে তার নিদর্শন না পেলে বলা সঙ্গত নয় যে প্রথম যুগের আদর্শটি পরে প্রক্ষিপ্ত হয়েছে। যখন যে ভাব যে জাতির মধ্যে প্রবল হয়, সেই ভাবের দাগই সেই জাতি রেখে যায়। তাছাড়া, এক এক জাতির বিশেষ সংস্কার আছে, যেমন Esquimax (এসকিমো) জাতি সুন্দর নক্সা করতে পটু (fair draughtsman), কিন্তু Polynesians (পলিনিসিয়ানরা) বহু বিষয়ে অপেক্ষাকৃত উন্নত হলেও, নিজেরা ফিটফাট থাকতে শিখলেও, নিজেদের অস্ত্রে শস্ত্রে বেশ শিল্পের বাহাদুরী দেখাতে পারলেও, তাদের মধ্যে বৃক্ষলতা বা কোন চিত্র অঙ্কন দক্ষতা নেই বা এখন অতি সামান্য ভাবে পরিস্ফুট।
[On the origin of Civilizations and primitive Condition of Manby Right Hon Averbury P C F. R, S. D C. L. L L D দ্রঃ]
উক্ত মনীষী বিভিন্ন দেশে আদিম মানুষের আচার ব্যবহার ও ধর্ম বিশ্বাসের কথা বলেছেন। তিনি দেখিয়েছেন যে মানব-প্রকৃতি নিহিত সহজাত জ্ঞান প্রসূত আচার ও প্রথা অনেক স্থানেই প্রায় এক রকম। ঐ সব আচার থেকেই কোন কোন স্থানে ভাষার উৎপত্তি হয়েছে। পেরুভিযানরা দুই ফুট লম্বা সূতোর সঙ্গে এক একটি রঙিন সূতোর গাঁঠ বেঁধে ভাব প্রকাশ করতো৷ সাহেবের অনুমান যে, ঐ রকম গোলাকার গাঁঠ স্মৃতিশক্তির সহায়ক এবং ঐ রকম গাঁঠ বাঁধা প্রথা হতেই আদিম চীনা ভাষার উৎপত্তি, যার নাম Hotu ও Loshi (হোতি ও লোশি); এই রকম গাঁঠ বাঁধা প্রথা পশ্চিম আফ্রিকা ও আমেরিকার বহু আদিম জাতিতে বর্তমান। এখানে বলা যেতে পারে যে, স্মৃতিশক্তির উদ্বোধক স্বরূপ আজও বাঙ্গালীরা কাপড়ে গাঁঠ (গেরো) বাঁধার রীতি, বিশেষ নারীদের মধ্যে আছে। যা হোক এ সব সত্ত্বেও পার্থক্য দেখা যায়, অতএব, যার যা বৈশিষ্ট্য, যার যা সংস্কার, সেই দিক্ হতে তথ্যানুসন্ধান করা দরকার, তবেই সত্য পাওয়ার আশা করা যায়।
ঈজিপ্টের প্রাগৈতিহাসিক যুগ-খৃঃ পূঃ ৮০০০-৫৫০০ বর্ষ পর্যন্ত। ভাবহীন জড়তাপূর্ণ এই যুগে কলাবিদ্যার কোন অগ্রগতি-চিহ্ন ও নেই।
প্রথম বংশের সময়-খৃঃ পূঃ ৫৫০০ বর্ষে-এক নতুন জাতি এসে নতুন সভ্যতা স্থাপন করে জাতিতে প্রাণ সঞ্চার করেন। ঐ সময় হতে সাঙ্কেতিক্ লিপির আমদানি হয় ও ঐ লিপির দ্রুত উন্নতি হয় ও উহাই লিখিত ইতিহাসের আরম্ভ যুগ।
[ “Arts and Crafts of Ancient Egypt by Flinders Petric]
ঈজিপ্ট বা তার নিকটবর্তী কোন স্থানে, ভূমধ্যসাগরের আশেপাশে কোন স্থানে স্বর্ণ পাওয়া যায় না, অথচ ঈজিপ্টের প্রথম বংশ হতে স্বর্ণালঙ্কার ব্যবহার দেখা যায়। সাহেবের অনুমান যে নিউরিয়া ও এশিয়া মাইনর থেকেই ‘এশিয়ার সোণা’ (Asiatic Gold) আমদানি হ’ত। এই রকম স্বর্ণালঙ্কারের ব্যবহার বরাবর চলে এসেছে। তারপর ‘ত্ৰিচন্নপল্লী’ ধাঁজের অলঙ্কারের ব্যবহার দেখা দেয় ও তা রোমানদের সময় পর্যন্ত বর্তমান ছিল।
[“One new art appears, the plating of gold wire chains, in what is now commonly called Trichnopoly pattern This method was continued down to Roman times”]
খৃঃ পূঃ ৭০০ বর্ষে তামার কাজের মধ্যে সোণা বসানো কারিগরী পাওয়া যায়, যা ভারতের সাধারণ প্ৰথা। [This is a common system in India”-ঐ ]।
এই অলঙ্কারগুলোকে Keft work বলা হয়। কারণ, নাইল নদী হতে Keftই ছিল ভারতে বাণিজ্যযাত্রার পথ। যাকে আমরা এখন চীনামাটির বাসন বলি, সেই জিনিষের আশ্চর্যরকম বহুপ্রকার সূক্ষ্ম শিল্পের আবির্ভাব হয় ও বহুল প্রচলন হয়, আর সেই সময়ে তাম্রসূত্র দিয়ে গ্রথিত করা নতুন ধরণের টালি দিয়ে বাড়ী ঘর তৈরী হতে আরম্ভ হয় খৃঃ পূঃ ৫৫০০ বর্ষে (১ম বংশে)। ষষ্ঠ বংশে, খৃঃ পূঃ ৪০০০ বর্ষে, ভারতজাত ‘নীল’ দেখা দেয় (“a dark Indigo-blue”)। খৃঃ পূঃ ১০ হাজার বর্ষে বাদরিয়ান (Badarian Dynasty) বংশের সময়ে ঈজিপ্টে যান চলাচল করত। ভারত হ’তে তখন যে ভাব সঞ্চারিত হয়েছিল তার কথা আমরা যথাসময়ে জানাব। যাই হোক, ঐ যুগ সভ্য ছিল ও ঐ সভ্যতা দীর্ঘ ২০০০ হাজার বংসর স্থায়ী ছিল এবং তাবপর অন্ধকার যুগ আরম্ভ হয় খৃঃ পূঃ ৮০০০ বর্ষ হতে খৃঃ পূঃ ৫৫০০ বর্ষের প্রাক্কাল পর্যন্ত। Saee সাহেব বলেন যে ঈজিপ্টের ধর্ম, নানা জাতি, বিভিন্ন কৃষ্টি ও বিভিন্ন চিন্তার মিশ্রণে উৎপন্ন।
(Gifford Lectures-Lecture II; by A H Sayce D. D L. L. D Professor of Assyriology, Oxford, author of the Religions of Ancient Egypt and Babylonia)
এশিয়াবাসী ফারয়োয়াতেই শক্তি কেন্দ্রীভূত হয়েছিল ও তার ফলে যে ঐক্য এসেছিল তা সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত প্রভাবমাত্র (ঐ)। এখানে বলা বাহুল্য যে, ঈজিপ্ট কোন ভাবকে আত্মস্থ করে একটি মহান্ জীবনাদর্শরূপে পরিণত করতে সমর্থ হয় নি।
ভারতেতর অন্যান্য বহু প্রাচীন জাতির মধ্যে বিভিন্ন সভ্যতা ও বিভিন্ন সংস্কৃতির সংঘাত দেখতে পাওয়া যায়, কিন্তু তা সত্ত্বেও ভারতে একই ধারা আজ পর্যন্ত বর্তমান। অন্যস্থানে, আদিম মানব নৈসর্গিক ব্যাপার দেখে ভয়ে সেগুলোকে ‘দেবশক্তি’র খেলা মনে করেছে, অনন্যোপায় হয়ে ঐ ‘দেবশক্তির’ আরাধনা করেছে বাস্তবকে (Real-কে) আদর্শরূপে খাড়া করেছে (idealise করেছে), বৈজ্ঞানিক Kepler সাহেবও এ থেকে রক্ষা পাননি। এই ভয় প্রসূত Animism থেকেই, ইউরোপীয় মনীষীরা বলেন ‘রিলিজনের’ (Religion-এর-ধর্মের) উৎপত্তি। ভারতে, আর্য, গোড়া থেকেই সর্বত্র একেরই প্রকাশ দেখেছেন, এক সত্ত্বাই প্রত্যক্ষ করেছেন, একই তাঁদের আদর্শ, ভাবমুখে তারা বহুর মধ্যে এককেই পেয়েছেন-deal-কে realise করেছেন। নানাত্তের বা বিভিন্ন ভাবেই ক্রমপরিণতি হয়, এক তত্ত্বোপলব্ধির (Being and Becoming-এর) পথে বহুরই ক্রমাবরণ মুক্তি হতে পারে। ভারতে Animism হ’তে Religion-এর উৎপত্তি নয়, তার কোন প্রমাণও নেই। ইউরোপের Religion-এর অনুবাদ ধর্ম নয়।
রামায়ণে দেখি, সুগ্রীব কর্তৃক দেশবিদেশে অতি দূর দূর দেশে ‘বানর’ সৈন্য প্রেরিত হয়েছিল। রামায়ণ পড়লে মনে হয়, তখন ভারত আরও একবার সমস্ত পৃথিবীর সমস্ত মানবজাতির সংস্পর্শে এসেছিলেন। আরও জানা যায় যে, ঐ সব ‘বানর’ সৈন্যদের মধ্যে বিভিন্ন বর্ণাবয়বী জাতি ছিল ও তারা অনেকে ভারতের বাইরে থেকে এসেছিল। তাদের নানা প্রকার বর্ণই এটা প্রমাণ করে। বানর রাজ সুগ্রীবের প্রভাবও কতদূর বিস্তৃত ছিল তারও এটাই প্রমাণ। ঐসব দূর দূরান্ত স্থান তখন অজ্ঞাত ছিল না অর্থাৎ ঐ সব স্থানের বিবরণ আগে থেকেই অনেকে জানত। এতে স্পষ্ট বোঝা যায় যে, তখন ভারতের সঙ্গে ভারতেতর দেশে বহু প্রকারর আদান প্রদান ছিল। বলা বাহুল্য, আদান প্রদান যেভাবেই হোক, ভাববিনিময় অবশ্যম্ভাবী। পবিত্রতা, সত্যনিষ্ঠা ও চরিত্রবলেই রামচন্দ্র সকলকে আপন করে নিয়েছিলেন; যে চরিত্ৰবল ও নেতার প্রতি একান্ত নিষ্ঠা দেখা দিয়েছিল, তার দৃষ্টান্তও ভারতেতর দেশে এ পর্যন্ত দেখা যায়নি।
মানব-বিজ্ঞানবিৎ (Anthropologists) ও তার অন্তৰ্গত জাতি বিজ্ঞানবিৎ (Ethnologists) ইউরোপীয় পণ্ডিতদের মধ্যে বিষম মতভেদ দেখা যায়। এক দলের মত যে, আদিম বর্রর জাতিই প্রথম অশ্বকে পোষ মানায়, অন্য দল বলেন যে, আর্যেরাই প্রথম ঘোড়াকে পোষ মানায়, কারণ, বৈদিক ‘অগ্ন্যাধানে’ ঘোড়ার দরকার হত, অপর এক দল বলে বসলেন যে মধ্য এশিয়ার (Central Asia) লোকই প্রথম পোষ মানায় ও দেশে লোকের পক্ষে এইটিই স্বাভাবিক; অমনি আর একটি দল বলে উঠলেন, তাহলে ঐ স্থান থেকে আগত এসকিমো জাতির ইতিহাসে সে সংস্কারের চিহ্ন পর্যন্ত পাওয়া যায় না কেন? আবার জন কতক পণ্ডিত ঐতিহাসিক প্রমাণ উদ্ধৃত করে দেখালেন যে, ওসব কাল্পনিক কেচাকেচি ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিতরূপে বলা যায় যে, খৃঃ পূঃ ৩০০০ বর্ষ পূর্বে বাবিরুষে ঘোড়া পোষ মানানোর প্রমাণ পাওয়া যায়। ঐ সব পণ্ডিতদের সহায়তা করতে নামলেন ভৌগলিক ও উদ্ভিদতত্ত্ববিদ পণ্ডিতেরা। এই চেষ্টার ফলে এটাই দৃঢ়রূপে প্রমাণ হল যে এশিয়ার সঙ্গে সমস্ত পাশ্চাত্য জগতের সম্বন্ধ অতি প্রাচীন। সুইজারল্যাণ্ডের গৃহপালিত জন্তু জানোয়ারের পূৰ্বপুরুষ এশিয়া থেকেই এসেছে। আলাস্কা থেকে টিবাডেল ফিউগো পর্যন্ত স্থানে প্রত্যেক কুকুরটি নেকড়ে থেকে এসেছে। বেবিং প্রণালী পার হয়ে এশিয়া থেকে কলার (কদলির) মত অনেক ফলমূল এশিয়ার লোকই এনে প্রাগঐতিহাসিক যুগে রোপণ করেছে, এ ব্যাপার আবার ওশেনিয়া ও আফ্রিকাতে দেখা যায়। বহু ভাষাবিদ পণ্ডিত মোক্ষমূলার সাহেব তাঁর Science of Religion গ্রন্থে দেখালেন যে old world O new world এ ভাষাগত ও ধর্মগত যে প্রমাণ পাওয়া যায় তাতে বোঝা যায় যে, কোন স্মরনাতীত প্রাগ্ঐতিহাসিক যুগে এশিয়া থেকে অ্যামেরিকায় কোন জাতির আমদানি হয়েছিল। তিলক প্রমুখ পণ্ডিতেরা ঐ সব দেখে অন্য প্রমাণ উপস্থাপন করলেন, যথা- ঋগ্বেদে যখন দীর্ঘ উষা, দীর্ঘ দিন রাত্রির বর্ণনা আছে, তখন আর্যেরা প্রথম উত্তর মেরুদেশেই ছিলেন। ঠাণ্ডা দেশ হতে আগত বলেই তারা অগ্নি প্রিয় ছিলেন! তার পূর্রে ইউরোপীয় পণ্ডিতেরা অনুমান করলেন যে মধ্য এশিয়া থেকে আর্যজাতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে, কারণ সেখান থেকেই ছড়িয়ে পড়াটা সহজ ছিল; সেখানে কাম্পিয়ান হ্রদের আশে পাশের কেরোসিনের খনি থেকে আগুন জ্বলে ওঠা দেখে আর্যেরা অগ্নিকে দেবতা ঠাওরালেন, তাই গ্রীক অগ্নিদেবতা Hesta এর পূজা- অগ্নিকে জিইয়ে রাখার প্রথা। রোমের অগ্নিদেবতা Vesta এর ও সেই ব্যবস্থা দেখা যায়, কারণ গ্রীক্ বা রোমানরা ও ছিল নাকি আর্যশাখা। এটি Animism এর আর এক প্রমাণ। আশ্চর্যের বিষয়ে এটা কারোর নজরে পড়ল না যে, ভারতীয় আর্যেরা অগ্নিকে কোন দৃষ্টিতে দেখতেন, উপাসনার মন্ত্রগুলোতে অগ্নি কিভাবে বর্ণিত, আর অগ্নি উপাসকদের মধ্যেও, ওসব দেশে ত্যাগ বৈরাগ্যের ভাব একেবারে নেই বললেই হয়। ভারত থেকেই তো আর্য সব যায়গায় যেতে পারেন এবং ঐ সব স্থানে লোকেরা তাঁদের নিজ নিজ ভাবে আচার গ্রহণ করেছিল, অথবা আর্য শিক্ষা পেয়েও সাধন প্রণালীর অভাবে বৈদিক ভাব আত্মস্থ করতে পারেনি-এটা অসম্ভব কিসে? আর্যাবর্তে পাহাড়ের জঙ্গলে ও অরণ্যে ইত্যাদিতে আপনি আগুণ জ্বলে উঠে, ঋগ্বেদে বাড়বানলের কথাও আছে- এসব তাঁদের নজর এড়িয়ে যায় কেন? অগ্নিহোত্রের আহুতি মন্ত্র, ‘ভূ ভূবঃ স্বঃ ওঁ অগ্নির্জ্যোতিঃ জ্যোতিবগ্নি স্বাহা’- এই অর্থে কি অন্যত্র অগ্নি গৃহীত হত? শ্রদ্ধা হোম- যাতে সত্যই মিথুন, যার সহায়তায় সাধক ত্রিলোকজয়ী হতে পারেন- এই মানস মোহের অনুরূপ কোন ভাব ও কি ঐ সব স্থানে ছিল ?
ভারত হতে যে সমস্ত অভিযানের কথা বলা হয়, সেগুলোকে সভ্যজাতির অভিযান বলা যেতে পারে। আমরা দেখেছি যে সেই স্মরণাতীত যুগে ও মানব জন্তু জানোয়ারকে পোষ মানিয়ে কাজে লাগাতে শিখেছে, তাঁদের প্রিয় গাছ পালা অন্য স্থানে নিয়ে রোপন করেছে, ভাষা ধর্ম বিস্তার করেছে। মানবতত্ত্ববিদ পণ্ডিতেরা ভারত হতে অসভ্য জাতির ঐরূপ বিস্তৃতির কথা বলেন। কিন্তু তারা অনেকেই ভারতীয় সভ্য আর্যজাতির আর্য-সংস্কৃতি বিস্তারের বেলায় নীরব। পূর্বে বা মনে করতেন যে বৌদ্ধযুগের আগে আর্য ভাব ভারতের বাইরে বিস্তার লাভ করেনি। তাঁদের মতে, ভারতে আর্যজাতি প্রবেশ করার পূৰ্বে সমগ্র ভারতময় এক কৃষ্ণকায় জাতির বাস ছিল। এই কৃষ্ণকায় জাতির বংশধররাই নাকি দ্রবিড় জাতি। এই দ্রবিড় জাতির এক শাখা সিংহলে গিয়ে বাস করে, তখন সিংহলে বাস করত তদপেক্ষা ঘোর কৃষ্ণকায় জাতি ‘বেদ্ধা’। বেদ্ধাদের জ্ঞাতিরা অষ্ট্রেলিয়ার আদিম নিবাসী। জাতি বিজ্ঞানের জনকতক পণ্ডিতেরা বলেন যে, আর্যেরা ভারতে এসে ঐ দ্রাবিড়দের ঠেঙাতে ঠেঙাতে দাক্ষিণাত্যে বিতাড়িত করলে, পরে সেখান থেকেও ঠেঙানির চোটে তাতা Eastern Peninsula, Indonesia ও Oceaniaতে—Malanesian বা যাদের আধুনিক প্রতিনিধি এবং অন্যদিকে Further India, Maldives ও Madagascar প্রভৃতি স্থানে ছড়িয়ে পড়ল। এরাই হল MalayoPolynesian Family বা মালাওপলিনিসিয়ান সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত জাতি।
[Vide Polynesian Journal, vol IV, December 1895 An article by Dr John Fraser, LLD] উক্ত সাহেবের মতে, Madagascar এর ভাষা South Sea ব অন্তর্গত সামাওয়াদের (Samoa) মত অনেকটা]।
ঐ সব স্থানের ভাষা দ্রাবিড় ও পালি মিশ্রিত। আর একদল বোঝানোর চেষ্টা করেছেন যে আৰ্য সংস্কৃতি ও সভ্যতার মূল আর্যকৃষ্টি নয়। মোহেনজোদাড়ো, হরপ্পা ও অন্যান্য নানা স্থানে যে সব নব নব তথ্য পাওয়া যাচ্ছে তাতে ইউরোপীয় ধারায় বিষম চাঞ্চল্য এসেছে, কিন্তু অনেকে তাদের পূর্ব বুলি এখনও পুরো ছাড়েন নি। তাদের মতে, ভারতে আর্যের আগমন হয় অপরাপর একাধিক জাতির বহু পরে। তারাও বলেন যে ভারতে আদিম নিবাসী ছিল বেঁটে ‘কালা-আদমি’–‘নিগ্রেটো’। তাদের বাস ছিল সমুদ্রের উপকূলে। বর্তমান যুগেও তাদের বংশধর, পারস্যে, দক্ষিণ ভারতে, আণ্ডামানে, এমন কি সুদূর নিউগিনি দ্বীপেও পাওয়া যায়। আসামের পথ দিয়ে ‘অষ্ট্রিক’ নামে আর এক জাতি ভারতে আসে। তারা ছিল অনেকটা সভ্য অর্থাৎ বড় বড় নৌকা তৈরী করে সমুদ্রে পাড়ি মারত, তাদের একটা ভাষা ছিল, ধর্ম বিশ্বাসও ছিল আর যুদ্ধ করতেও জানত। বাৰ্মার স্থানে স্থানে এদের সভ্যতার প্রসার ও উন্নতি হয়। ভারতে প্রবেশ করে এরা ক্রমশঃ সমস্ত ভারতবর্ষে ছড়িয়ে যায়; বাংলা দেশে এদের সভ্যতার একটি বিশিষ্টরূপ ফুটে ওঠে ও গঙ্গানদীর দুই উপকূলে সেটি বিস্তৃত হয়ে পড়ে। এই অষ্ট্রিক জাতির অভিযান শাখা প্রশাখায় বিভক্ত হয়ে, নানা মিশ্রিত ভাষার সৃষ্টি করে, ইন্দোনেশিয়া, নিউজিলাণ্ড পৰ্যন্ত অগ্রসর হয়। বর্তমান সাঁওতাল, কোল, মুণ্ডা প্রভৃতি জাতিদের ভাষা- ‘অষ্ট্রিক ভাষারই এক শাখা-ভাষাতত্ত্বের দিক দিয়ে পণ্ডিতেরা এটা প্রমাণ করেন। যা হোক, তাঁদের মতে, ভারতে আর্যের আগমন এই অষ্ট্রিক জাতির বহু পরে। আর্যের আগমন সম্বন্ধে কয়েকটি মতের কথা আগে বলেছি। আর এক দলের মত, আৰ্যেরা বেরিয়ে পড়েন জার্মাণি বা তার নিকটবর্তী কোন স্থান থেকে। এ সম্বন্ধে তারা আর যা বলেন তা বর্তমানে উড়ে গেছে, অতএব তা বলা অনাবশ্যক। ভারতে এসে কিন্তু এই সভ্য অষ্ট্ৰিক্ পরে আৰ্য ভাষা গ্রহণ করে ও ক্রমশঃ আখ্যায়িত হতে আরম্ভ করে। নদী পাহাড়ের নামকরণ নাকি অষ্ট্ৰিকরাই প্রথম করে ও আর্য ভাষা গ্রহণ করার পর নামগুলো তেমনি রূপান্তরিত করে।
অষ্ট্ৰিকরা আগে এসেছিল, বেশী সভ্য ছিল, তবে তারা আর্যায়িত হয় কেন? সাঁওতালাদির ভাষার মধ্যেও সংস্কৃত শব্দমূলক শব্দ পাওয়া যায় কেন? কেন অষ্ট্ৰিক আৰ্যভাষা গ্রহণ করে ? এসব প্রশ্নের কোন সদুত্তর পাওয়া যায় না। তবে ইউরোপীয়রা এখানে একটি অনুমান এনেছেন, অর্থাৎ আৰ্যে সভ্যতায় হীনতর হলেও, তাঁদের নাকি সংহতি-শক্তির জোর ছিল ও খুব উদ্ভাবনী শক্তি ছিল। তা হলে সভ্যতা মানে কি ? সংহতি-শক্তি আছে, কল্পনাশক্তি আছে, উদ্ভাবনীশক্তি আছে, সুতরাং উন্নততর সমাজশক্তিও আছে, তবে সভ্যতায় হীনতর কেন? তবে কি ঠেঙানির চোটে অষ্ট্ৰিকরা সায়েস্তা হয়েছিল ও জৈয়ির ভাষা তাদের ঘাড়ে চেপে বসেছিল ? তা হলেও ত, ইউরোপীয় হিসাবে, আৰ্যরাই বেশী সভ্য হয়ে যান না কি ? ঠেঙানির কৌশল ও ঐ সব গুণই ত বর্তমান সভ্যতা শব্দের অর্থ; কিন্তু এ সম্বন্ধে ইউরোপীয় পণ্ডিতরা প্রায় নীরব। আর্যের একদল না হয় জার্মাণী বা অন্যত্র থেকে ছড়িয়ে পড়তে পারে, কিন্তু ঐ সব স্থানে আর্যের বৈশিষ্ট কোথায়? অন্যত্ৰ আৰ্য-আচারের অনুকরণটা থাকতে পারে, কিন্তু কোথায় জীবনকে পবিত্র করার, সাধন করে সব প্রত্যক্ষ করার প্রবল সংস্কার, ওসব দেশে ? ভারতে বাইরে আর্যেরা যখন একত্র ছিলেন (যেমন বলা হয়), তখন তাদের বৈশিষ্ট্য দেখা দেয় নি, আর তা ফুটে উঠল ভারতে ঢুকেই ? তারপর, ঐ পণ্ডিতরা বলেন যে আদি দ্রাবিড়দের লম্বা মাথা, কিন্তু ভারতীয় দ্রাবিড়দের গোল মাথা- এটা যে কেমন করে হল, তার কারণ আজও নিরূপণ হয়নি। অথচ দ্রাবিড় ভাষার সঙ্গে বেলুচিস্থান অঞ্চলের ব্রাহুই জাতির ভাষাগত সাদৃশ্য দেখতে পাওয়া যায়, এমনি কি রুষদেশেও দক্ষিণ ভারতের একটি ভাষার সাদৃশ্য আছে। সাদৃশ্য থাকতে পারে অনেক কারণে; ঐ রকম অনুমান করে সিদ্ধান্তে আসা কি বৈজ্ঞানিক প্রণালী? বৈজ্ঞানিক প্রণালীর বিচার হয় বাস্তব ধরে, বস্তুকে বিশ্লেষণ করে ও সেই বাস্তব ও বিশ্লেষণের মধ্যে থাকতে পারে অনুমান সামান্য, সিদ্ধান্তে সহায়তা করার জন্য। ঐতিহাসিক ঐ রকম ব্যাপারে বাস্তবিকতাই বা কি, আর নির্দিষ্ট বস্তুই বা কি? সবই যদি আন্দাজ করা হয় ও তাকেই যদি যুক্তি বলা হয়, অন্য অনেক রকম আন্দাজ করা যেতে পারে, যেগুলো অপেক্ষাকৃত সহজ, স্বাভাবিক ও সঙ্গত। রক্তমিশ্রণের ফলেই হোক বা যে কারণেই হোক, গোল মাথা বা লম্বা মাথাই হোক, আর্যের ও মিশরীদের মাথার খুলির সাদৃশ্য থাকুক আর নাই থাকুক- যেখানে আর্যের বৈশিষ্ট্য নেই সেখানে কোন হিন্দুই শাস্ত্রানুসারে আৰ্য এই আখ্যা দেবেন না। আর, ঐ সব হাড় মাস চামড়া ও রক্তের দিক্ দিয়ে বিচার করলেও, এটা বুঝিয়ে দেওয়া দরকার- কেন ঐ সব স্থানে আৰ্য-সংস্কার বৈশিষ্ট্যের একান্ত অভাব, কেন ভারত সাধনের বৃহৎ সমর ক্ষেত্র আর কেন অন্যত্র পশুবলের সংগ্রামভূমি।
এই রকম ফিনিসিয়ানদের কথাও আছে। হেরোডোটাসের মতে, ইউফ্রেটিস ও তাইগ্রীস নদীর উপকূলেই ছিল তাদের আদিম নিবাস। বংশপরম্পরায় সেখানে বাস করায় তারা তাদের আদিম ভাষা ভুলে যায়। এই ফিনিসিয়ানরাই কাঁচ প্রস্তুত প্রণালী আবিষ্কার করে ও ইউরোপিয় প্রভৃতি একমতে তারাই প্রথম লিপি বা লিখনপ্রণালীর আবিষ্কারক। এই ফিনিসিয়ানরাই গায়ে পড়ে আর্যদের সঙ্গে ঝগড়া বাঁধাত তারও বৃহুতর প্রমাণ পাওয়া যায়। যাই হোক, লিপি ছিল অনেক প্রাচীন জাতির, কিন্তু, ইউরোপীয়দের মতে, ছিল না ভারতীয় আর্যের। স্বেচ্ছায় তারা কানা সাজলে তার উপায় কি? ঋগ্বেদ (৪ অষ্টক।২/১২) তে আছে যে রাহুর ছায়া সূর্যকে বিদ্ধ করে। এই যে গণনা বা বেদি আদি নির্মাণে যে গণিতবিদ্যার দরকার হত, তাও কি না লিখে হত ? ব্রাহ্মণগ্রন্থে ‘পংক্তি’ শব্দ পাওয়া যায়, তাও কি গুনে গুনে ঠিক করা হত ? রক্তের দিক দিয়ে, গ্রীকদেরও আৰ্য বলা হয়, বলা হয় উভয় সভ্যতার মূল এক। আদর্শ বা ভাবের ঐক্য বা সাদৃশ্য কোথায় ? গ্রীক-পুরাণে দেখা যায়, দেবতারা আত্মীয় স্বজনের মাংস খেয়ে তৃপ্তি লাভ করেন। বেদপন্থীর মধ্যে এরকম ভাব কোথায় ? ঋগ্বেদে মৃতের সৎকার দুরকম ভাবে হত- দাহ করা ও কবর (সমাধি) দেওয়া। এই দুই প্রথা ভারতে আজও বর্তমান। সন্ন্যাসীর দেহ সবস্থানে দাহ করা হয় না, সমাধি দেওয়াই (জলসমাধি দেওয়া বা কবরস্থ করা) হয়। সম্প্রদায় হিসাবেও বিভিন্ন প্রথা আছে। বীরশৈবেরা মৃতকে কবরস্থ করেন আজও। আচারের বাহ্য সাদৃশ্য বা শব্দার্থের সাদৃশ্য দেখে তাকে প্রমাণ বলে খাড়া করা নিরাপদ নয়। বৈদিক ভাব প্রসাব কত দিক্ দিয়ে, কত রকমে হয়েছে তা দেখার ক্রমশঃ চেষ্টা পাব। আমরা ভাবতীয় পণ্ডিতকুলকে সানুনয়ে এর ধারাবাহিক বিবরণ দিতে আহ্বান করছি।
You must be logged in to post a comment.