আর্যপ্রভা- বৈদিক ভাব ভারতের বাইরে


বৈদিক ভাব প্রসার-ভারতের বাইরে
সাম্প্রদায়িক বিরোধের কথা আগেও বলেছি। শ্রুতিতে ইন্দ্র-বিরোচনের গল্প আছে। একই গুরুর কাছে, একই শিক্ষা পেয়ে ইন্দ্র হলেন আত্মবিৎ আর বিরোচন দেহকেই ‘আত্মা’ মনে করলেন। এই বিরোধের ফল স্বরূপ বিরোচনের দল নতুন সম্প্রদায় স্থাপন করলেন ও সাম্প্রদায়িকতার ঈর্ষায় বৈদিক ধর্মের বিরুদ্ধে দাঁড়ালেন। ইন্দ্রপূজা ও সোমযাগ বহু প্রাচীন, এই উভয়ের সম্বন্ধও ঘনিষ্ঠ। আর্যদের মধ্যেই একদল ইন্দ্র বিরোধী হয়ে দাঁড়ান কিন্তু সোম ভক্ত থাকেন। উভয়েই গোড়া ছিলেন সপ্ত-সিন্ধুবাসী। প্রথমে আর্যদের মধ্যে প্রধান ব্যক্তিরা ঐ বিরোধ মিটমাট করতে এগিয়ে আসেন। নতুন দলের গোঁ ও গোঁড়ামিতে সব মিটমাটের ব্যবস্থা পণ্ড হয়। ইন্দ্র-বিরোধী দলকে ভারত ছেড়ে যেতে হয়। তাঁরা ‘আচেঁসিয়া’ (পারস্য) বা ইরাণে চলে যান। সেখানে সোম হলেন ‘হ্যাওম’, মিত্র হলেন ‘মিথ’ ইত্যাদি। ভারতে সোম, “যজ্ঞস্য আত্মা” (ঋগ্বেদ ৯/২/১০, ৬, ৮), বেদের ত্বষ্টা বা অগ্নি, আদিত্য ও মিত্র হলেন ইরাণীদের ‘ত্বষ্টৃ’, ‘অহুরমজদা’ (অসুরমঘবা= অহুরমজুবা) ও ‘মিথ্র’। ঋগ্বেদে ইন্দ্র হচ্ছেন ‘আদিত্য’ -অগ্নি অবয়বী, ত্বষ্টা বা অগ্নি, নরলোকের বা পৃথিরীর। জরতত্বষ্ট্র হলেন জরতুষ্ট্র (জোরোয়াষ্টার। নতুন দলের ‘অহুরমজদার’ সংক্ষেপ নাম হল ‘অরমাজদ্’, ‘আহিবিম্যান’ হলেন পাপ দেবতা ইত্যাদি)।

কয়েস সাহেব তাঁর লেকচারে বলেছেন যে, (J, C, Coyace, B A. L, L. B.-The Gatha Society Publication) জরথুষ্ট্র ধর্মের প্রথম অবস্থায়, ভগবানের কাছে দুটি প্রার্থনীয় বস্তু ছিল, (১) আত্মার অমরত্ব অর্থাৎ মৃত্যুর পর আত্মার পরলোকে স্থিতি, তাদের মতে সৎকর্মের পরিমাণ বেশী হলে অসৎ কর্মের প্রভাব কমে যায়। (২) স্বাস্থ্য। এ দুটি ছাড়া, শেষের দিনে বিচারের কথা আছে। আমাদের মনে রাখতে হবে যে, ভারত কখনো ধর্মবিশ্বাস নিয়ে বিবাদ করেনি। জরথুষ্ট্র বাদীদের ‘ধৰ্মযুদ্ধ’ (যে নাম নতুন দলই দিয়েছিলেন) সম্বন্ধে তিনি কয়েকটি বিষয় লক্ষ্য করতে বলেছেন, (১) সেটি মতবাদের বা ধর্মবিশ্বাসের ঝগড়া নয় কিন্তু ঐ বিবাদ সভ্যতার দুটি ধারা নিয়ে, (২) সেটি বহুকাল থেকে চলে আসছিল। এই বিরোধ জোরোয়াষ্টার (Zoroaster) আরম্ভ করেনি, কিন্তু তার প্রভাব ও আত্মশক্তিবলে প্রাচীন ধারা উল্টে দিয়েছিলেন। (৩) প্রতিদ্বন্দ্বীদল- অহুরাবিশ্বাসী ও দেব-বিশ্বাসীরা প্রতিবেশী ছিলেন, বস্তুতঃ তাদের মধ্যে অন্তৰ্মিশ্রণ ছিল (“indeed they were intermingled)”। জরথুষ্ট্রের নির্দেশে, কতকগুলো শৰ্তে ইরানীদের এই নব ধর্ম দেওয়া হত। ইরাণীরা “স” স্থানে “হ” বলতেন- ঐ দেশে বাস করায় তাদের উচ্চারণ বৈকল্য দেখা দেয়। জোরোযাষ্টার নামে একাধিক মহাজনের নাম পাওয়া যায়। তাঁরা বিভিন্ন সময়ে উদিত হন ও জরথুষ্ট্র ধর্মের পুষ্টি সাধন করেন। তাঁদের বিস্তৃত বিবরণ এখানে নিষ্প্রয়োজন, তবে একজন জরথুষ্ট্রের নাম পাওয়া যায় ইরাণীদের জারদুস্ত (Eardusht) গ্রন্থে। তাতে আছে যে ঈশ্বর জরথুষ্ট্রকে বলছেন, “পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জ্ঞানী, ব্যাস নামে একজন ভারত থেকে এসে যখন তোমাকে প্রশ্ন করবেন, ‘ঈশ্বর এক সঙ্গে সব সৃষ্টি করেননি কেন, তখন তুমি উত্তর দিও, ভগবানের প্রথম সৃষ্টিশক্তি পরে সেই শক্তির সহায়তায় সমস্ত সৃষ্টি হয়েছে। ঐ গ্রন্থের টিপ্পনিতে আছে যে, বালখ্, নগরে গুস্তাস্প (Gustasp) নামে রাজার সঙ্গে ব্যাস দেখা করেন। রাজা দেশের সমস্ত জ্ঞানীলোককে আহ্বান করেন, জরথুষ্ট্রও আসেন। গুস্তাস্প রাজার সময়েই জরথুষ্ট্র ধর্ম রাষ্ট্রধর্ম (State Religion) বলে গৃহীত হয়। এই ব্যাসের আগমনে জরথুষ্ট্র ধর্মে শক্তিবাদ দেখা দেয়, শক্তিবাদ গৃহীত হলেও ঐ শক্তিবাদ ভারতের ভাবে অনুপ্রাণীত হতে পারেনি, তা ঐ দেশের ভাবেই স্বীকৃত হয়। গ্রীকরা গুস্তাস্পকে বলে Hystaspes, আর, পণ্ডিতদের মতে তার সময় খৃঃ পূঃ ৫০০ বর্ষ। (প্রাচীন বাহ্লিক = ব্যাক্ট্রিয়া)। (দুর্গাদাস লাহিড়ীর পৃথিবীর ইতিহাস-ভারতবর্ষ দ্রঃ)।

ইরাণে চলে যাবার বহু পরে জরথুষ্ট্রের জন্ম হয়। এটা তাঁর বংশলতা থেকে জানা যায়। তিনি তিনবার বিয়ে করেন ও অনেকগুলো ছেলেমেয়ে হয়। বাইবেলের Paradise শব্দটি এসেছে আবেস্তার Parideza থেকে, Cyrus এর নাম অন্ততঃ ১৪ বার বাইবেলের Exita Books এ পাওয়া যায়। Darius একাধিক পারস্য রাজার নাম; এই Darius এর নামও অন্ততঃ ১৩ বার আছে, ঐ রকম Xerxes as Ahsaerus ও Artaxenses নামও ৭ বার বা ঐ রকম আছে। জরথুষ্ট্রের জন্মস্থান উরুমিয়া (Urumiah), সিরিয়া ও আরব্য ভাষায় লেখা এই নাম নিয়ে বেশ ঝগড়া বিবাদ আছে। তাঁর উপনয়ন (পৈতা) ও হয়েছিল। জরথুষ্ট্র নামে অনেক সংস্কারক ছিলেন।

[জরথুষ্ট্র বাদে যুগ বিভাগ ছিল- এক এক যুগ তিন হাজার বৎসরে বিভক্ত অর্থাৎ, চারযুগ ১২০০০ বৎসর (Farvarshi)। গ্রীক পণ্ডিতদের মতে, জরথুষ্ট্র খৃঃ পূঃ ৬০০০ বর্ষে ছিলেন, বড় প্লিনি (Pliny the Elder) বলেন খৃষ্টাব্দ ২৩-৭, Endoxud of Cudus, খৃঃ পূঃ ৩৬৮, Aristotle (এরিষ্টটল) -খৃঃ পূঃ ৩৫০ এবং Hernippus বলেন খৃঃ পূঃ ২৫০, হার্ণিপ্লাস লিখেছেন যে প্লেটোর মৃত্যুর ৬০০০ হাজার বৎসর পূর্রে অর্থাৎ ট্রোজান মহাযুদ্ধের (Trojan War এর) পাঁচ হাজার বর্ষ পূৰ্বে জরথুষ্ট্র বর্তমান ছিলেন। Lactantius বলেন যে, জরথুষ্ট্রের বন্ধু Hystaspes, রোম সম্রাজ্য গঠন হওয়ার বহু পূর্রে মিডিয়ার (Media) রাজা ছিলেন। সুইডাস (দশম শতাব্দী, roth century AD.) বলেন যে দুজন জোরোয়াষ্টার ছিলেন, একজন ট্রোজান মহাযুদ্ধের ৫ হাজার বংসর পূৰ্বের লোক, আর একজন নিনাসের (Ninusএর) সময়ে জ্যোতির্রিদ। Georgius Syrceilus বলেন যে, জরথুষ্ট্র বাবিলন দেশস্থ রাজা ছিলেন। একজন জরথুষ্ট্র ব্যাক্ট্রিয়ার রাজা ও যাদুবিদ্যায় পারদর্শী ছিলেন।]

এই রকম প্রাচীন পণ্ডিতেরা অনেকে জরথুষ্ট্রের নাম করেছেন। উল্লেখিত সংক্ষিপ্ত বিবরণ থেকে বোঝা যায় যে, পরোক্ষভাবে ভারতীয় ভাব কতদূর বিস্তৃতি লাভ করেছিল। ইউরোপীয় পণ্ডিতেরা জরথুষ্ট্রের সময় বলেন, খৃঃ পূঃ ৮০০ বর্ষ, কোন কোন পণ্ডিতের মতে জরথুষ্ট্র ও বিশতাস্প খৃঃ পূঃ ৬৬০ বর্ষে বৰ্তমান ছিলেন। তারা সব প্রাচীন মত উড়িয়ে দিয়ে একটি মতই স্থাপন করেছেন। সময় কমিয়ে দেখাতে তাদের কৃতিত্ব আছে, যাতে সবই বাইবেলের সৃষ্টি যুগে অর্থাৎ খৃঃ পূঃ ৩/৪০০০ বৎসর পরে হয়। আধুনিক পণ্ডিতরা অনেক পূৰ্বমত উল্টে দিচ্ছেন, কিন্তু ভারতে সাধারণ সমাজে আজও পূৰ্বমত বেশ চলেছে।

মিলস্ সাহেব বলেন, (A story of the Five barathrustian Gathas by Lawrence Mills D.D. দেখুন), যে, পরবর্তী ইহুদি (Jewish) ও খৃষ্টমতবাদের উপর জরথুষ্ট্র ধর্ম অসীম প্রভাব বিস্তার করেছেন। তিনি আরো দেখিয়েছেন Sadduceism, স্যাডুসিবাদ এর স্বাধীন চিন্তা থেকেই ক্যাথলিক মতবাদের রক্ষণশীলতা এসেছে; জরথুষ্ট্রবাদ বা পারসীকবাদ (Parsism) ইহুদি মতবাদের (Judaismএর) পরিবর্তিত নাম ফারিসাইবাদ (Pharisaism) মিল (Mills) সাহেব তার Zarathustra and the Greeks গ্রন্থে বলেন যে, ঈজিপ্ট থেকে বহুদূরে অবস্থিত ভারতে বেদ এর সঙ্গে অবেস্তার সাদৃশ্য বর্তমান, এমন কি উভয়ে একই প্রসঙ্গ দেখা যায়, যথা আদিত্য ও তাঁর মাতা অদিতি- এই দুই শব্দ। অদিতির আদি অর্থ অখণ্ডত্ব, অসীমত্ব, অপ্রতিহত শক্তি (Unboundedness, Infinitude, unfettered Power), এই রকম ভাগ (সংস্কৃত ভাগ্য) শব্দটির মনে সৌভাগ্য, ঐ অখণ্ড ও অসীম সকল বন্ধন মুক্ত স্বাধীন শক্তিকে মাতা বলা হয়েছে। সাহেবের মতে, একে ফাইলোবাদের পূনভ্যুদয় বলে বৈদিক মতের পুনরুক্তি বলাই ঠিক। তার মতে, বেদের ‘ঋত’, -অবেস্তার ‘আশা’ -একটি যথার্থ ইণ্ডো-ইরাণী ‘লোগাস’ (a true Indo-Iranian Logos)-শব্দটি বৈদিক ঋকে প্রায় তিনশত বার ব্যবহার হয়েছে, ফাইলো যখন ঈজিপ্টে বাস করেন, ঐ লোগাস’টি তার অপেক্ষা অন্ততঃ ৫০০ বা ৮০০ বৎসবে পূর্রবর্তী। ‘ক্ষাত্র’ শব্দটিও বেদে ও ‘ক্ষাত্র’ প্রায় ৪৪ বার ব্যবহার হয়েছে, এই রকম বহু দৃষ্টান্ত সাহেব দিয়েছেন। বৈদিক ঋষি বহুমনঃ’ই, অবেস্তায় বহুমানা হয়েছেন। সাহেব বলছেন যে, ফাইলোর যথার্থ গুরু প্লেটো, ভারতীয়দের ও ইরাণীদের সম্বন্ধ ভাল করে জেনে তার মতবাদ গঠন করেন। সাহেব স্পষ্ট স্বীকার করেছেন, যে সময় ভাবতীয় ঋষির মুখে সামগান গীত হয়, তখন গ্রীসে বা ঈজিপ্টে কোথাও কোন বিদ্যালয় পর্যন্ত ছিল না! অবেস্তা, ইহুদি-গ্রীকে উপর তো নির্ভর করেই না, বরং ফাইলোই অবেস্তার কাছে ঋণী, এমন কি এই কারণে (পারসিক সভ্যতার জন্য) বাবিরুষ(ব্যবিলিয়ন) সভ্যতার গ্রাস থেকে ইউরোপীয় সভ্যতা রক্ষা পেয়েছে। (saved out own from an absorption in the Babylonian)।

সাহেব তার অপর একটি বইতে (zaroastra, Philo, the Achaemendes and Israel) বলেন যে যদিও বিভিন্ন দেশে, আবেস্তায়, এমন কি বৈদিক লিপিতে সেমিটিক প্রভাব বর্তমান বলা হয়, এটা নিশ্চিত যে ইরানী ও ইহুদি শিক্ষার কৰ্ষণার ও বংশপরম্পরাগত কিংবদন্তির উৎপত্তি স্থান এক। এই রকম অক্ষরের বিষয় ছেড়ে দিয়ে পহ্লরী ভাষাতে সেমিটিক প্রভাবের কথা বলা হলে, আমাদের শুনানো হয় যে সেখানে পদগুলোই অক্ষর, পৃথক পৃথক অক্ষর নয়। সুদূর অতীতে সেমিটিক চিহ্ন বা সংকেত ব্যবহার দ্বারাই ঐ সব জাতির মধ্যে আদান প্রদান বোঝা যায়, পরে নব্য পারসিকদের (New Persian) পদগুলোতে সেমিটিক প্রভাব বর্তমান। সাহেব এখানে বলছেন যে, যদি ঐ মতটি ছেড়ে দেওয়া যায়, আবেস্তার মধ্যে কোথায় সেমিটিক গন্ধ ? আবেস্তায় সেমিতিক ভাষার একটি শব্দও নেই, কিন্তু বাইবেলময় ঝুড়ি ঝুড়ি পারসীক ভাষার শব্দ রয়েছে। সাহেবের মতে ‘আক্কাদ’ ও ‘সুমের’ জাতিদ্বয়- যাদের আদিম ভাষায় আর্য শব্দের অত্যন্ত প্রয়োগ আছে, তারা বাবিরুষের চেয়ে অন্ততঃ কিছু প্রাচীন বা পূর্রবর্তী।

[নিয়ত বর্ধমান সুমের জাতিরই এক ভাগ ক্রমে বাসের জন্য সুজলা সুফলা দেশ বিশেষের অন্বেষণে বের হয়ে স্ত্রী-পুং চিহ্নের উপাসনাদি নিয়ে ভারতে প্রবেশ করল। অনেক কাল সমৃদ্ধিশালী হয়ে ভারতে বাসের পর তারই এক শাখা আবার মালাবার উপকূল থেকে নৌযানে মিসরে গিয়ে নীলনদী তীরে অপর এক বৃহৎ সাম্রাজ্য স্থাপন করল”। (সূত্র ভারতে শক্তিপূজা-স্বামী সারদানন্দ)]।

এই সুমেররাই বারিরুষকে কৃষিবিদ্যা শেখান। আসুরীয় জাতিরাও এই সুমেরদের কাছে তাদের সভ্যতার জন্য ঋণী। এই সুমের জাতির ধর্ম ও পুরাণ (গল্পগাথা) ইহুদিরা তাদের দেশে নিয়ে যান। ঐ দ্রবিড় ও পণিদের মিশ্রণে ‘খলদে’ (Chaldeans) জাতির উদ্ভব হয়। যাহোক, সাহেব আরও কয়েকটি কথা বলে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। একজন সম্রাটের নাম ‘পতেশি’ (Pateshi), অবেস্তায় হয়েছে ‘পয়েতিশ’ (Pa(i)tish)। এমন কি বাবিরুষের গোড়ার সৃষ্টিতত্ত্বে ও সমগ্র ধর্মশাস্ত্রের মধ্যে যে ‘অপসু’ শব্দটি রয়েছে, সেটি সংস্কৃত ‘অপ’, বাইবেলের Taimet (তাইমেত) মানে ‘তমস’ বা অন্ধকার, ইরাণীতে অর্থ-পীড়াদায়ক, সমস্ত পীড়ার কারণ (Torment) আবার অবেস্তার Adar শব্দটি বাইবেলে হুবহু উদ্ধৃত হয়েছে ইত্যাদি।

সেমিটিক ভাষা কোন্ গঠন প্রণালীর ছায়া বৈদিক লিপিতে ইউরোপীয় পণ্ডিত দেখতে পান? প্রমাণ কোথায় ? ভারত থেকে কি ভাষা বা লিপি যেতে পারে না? ভারত কি পরেও অনেক জাতিকে ভাষা দান করেন নি ? প্রমাণ কোন দিকে বেশী ? ভাষা স্বস্থান ভ্রষ্ট হলে, লিপির ভঙ্গী কি অন্যরূপ ধারণ করতে পারে না ? তার প্রমাণ কি আজও দেখা যায় না? ‘ব্রাহ্মী ভাষাকেও সেমিটিক বলা হত পূৰ্বে। এখন প্রমাণ হয়েছে যে সেটি ভারতের নিজস্ব। (বঙ্গভাষা ও সাহিত্য-নবসংস্করণ দেখুন)-রায় বাহাদুর শ্রীদীনেশ্চন্দ্র সেন)।

আমরা দেখেছি যে ‘হেলয়’ এর স্থানে ‘হে অলয়’ ও ‘হেলয়’ উচ্চারণ করায় যেমন ‘হেলয়’ শব্দটিকে ‘ম্লেচ্ছে’ বা ম্লেচ্ছ উচ্চারণ ভঙ্গী বলা হয়েছিল, সেই রকম ইরাণীরা ‘অসুর’ শব্দটিকে ‘অহুর’ উচ্চারণ করা এবং তারা আর্য বিরোধী হওয়ায়, অসুর শব্দটির অর্থ ভারতে বোঝাতে আরম্ভ করে দেব-শত্রু। জরথুষ্ট্র ধর্মের প্রাচীন গাথা ‘অহুরা মজদা’ একমাত্র ঈশ্বর রয়েছেন দুজন প্রভু (Payu); এই দুই প্রভুই দুরকমের স্রষ্টা (Yasna XIX, 9)। পরে অর-মাজাদ ও আহিরীমাকে পৃথক সত্ত্বা মেনে নিয়ে ঐ দুজনের বিরোধ বর্ণিত হল- একজন হলেন ভাল দেবতা (Good God), আর একজন হলেন মন্দ দেবতা (Bad God)= স্পেন্টামৈনু ও আংগ্রামৈনু। সেমিটিকদের মধ্যে তাঁরা হলেন God and Satan, ভগবান এবং শয়তান। জরথুষ্ট্র দেখেছিলেন যে জগৎ উৎপত্তির দুটি কারণ আছে, কিন্তু ঐ দুই সত্ত্বা রয়েছে একেরই মধ্যে। বেদে ব্ৰহ্মের সগুণ ও নির্গুণ ভাবের কথা আছে, কিন্তু সেটি একেরই দুভাবে সাধনার কথা, সাধকের রুচি ও মানস অধিকার হিসাবে পৃথক সত্ত্বা নয়। মৈত্ৰায়ণ উপনিষদ (৬/২২) এ দেখি ব্ৰহ্মকে দু’ভাবে ধ্যান করার উপদেশ আছে। ভারতে ঐ রকম ভাবের উপদেশে চিন্তার পার্থক্য থাকলেও সাধন ক্ষেত্রে অভেদ ও অভিন্ন ভাবে ধ্যেয়। ইরাণীয় লোগাসবাদের (বাক্’এর) মূল পাওয়া যায় মৈত্ৰায়ণের ঐ উপদেশে, যা পরে আবেস্তা থেকে ফাইলো পান ও Alexandrian School এর লোগাস হয় ঐ দেশের সংস্কারানুযায়ী। ভারতের সংস্পর্শে এটা সম্ভব হয় প্রথম ইরাণে পরে অন্যত্র। ইরাণীরা আসূরীয়দের (Assyriansদের) ঘনিষ্ট সংস্পর্শে এসেছিলেন। জরথুষ্ট্রবাদীদের য়াষ্ট (Yasts) গ্রন্থের সাজানোর রীতি অবিকল শিরোজার (Shiroza) মত। মাস কে ৩০ দিনে ভাগ করে, প্রত্যেক দিন এক একটি দেবতার নামে নামকরণটি সেমিটিক জাতি থেকেই গৃহীত (Sacred Books of the East-The Zend Avesta, Part II-Max Muller দ্রঃ)। জরথুষ্ট্র ধর্মের সঙ্গে ইহুদি ধর্মের বহু সাদৃশ্য থাকায়, বহু মনীষিরা অনুমান করেন যে উভয় ধর্মেরই উৎপত্তিস্থান অভিন্ন।

লেয়ার্ড সাহেব (A popular Account of Discoveries at Ninevan-Chapp V-By Austin Henry Layard Esq. D C L. দ্রঃ) বলেন যে সম্ভবতঃ ঈজিপসিয়ানদের মত আসিরিয়ানরাও বিভিন্ন বর্ণদ্বারা পুরোহিতের ও অপরের জাতি এবং লিঙ্গ নিরূপণ করতেন। সাহেব বলছেন যে, অন্যান্য মূৰ্তির সঙ্গে দুটি মূর্তি পাওয়া যায়, ঐ মূর্তি দুইটি সামনাসামনি দণ্ডায়মান, মধ্যে একটি পবিত্র বৃক্ষ আর তার উর্দ্ধে রয়েছে ভগবৎ প্রতীক স্বরূপ পাখীর ডানা ও পুচ্ছযুক্ত একটি নরাকার মূর্তি, ঐ ডানা পুচ্ছ দিয়ে বৃত্তাকারে বেষ্টিত। এটি অরমাজদের লিঙ্গস্বরূপ ইরাণীরা নিয়েছেন। (ঐ দ্রঃ)। হিন্দু পুরাণে গরুড়ের কথা আছে, কিন্তু গরুড় বিষ্ণুর বাহনমাত্র, একটি বৃক্ষে জীবাত্মা ও পরমাত্মারূপী দুই পাখীর কথা বেদে আছে, হিন্দু শাস্ত্রে কল্পবৃক্ষের কথাও আছে। ভারতে যে সব কথাগুলো আত্মজ্ঞানের উদ্দীপক, অন্যত্র সেই ধরণের গল্পগুলো কি বিভিন্ন ভাব প্রকাশ করে না? সাহেব লিখেছেন যে, এক যায়গায় খুঁজতে খুঁজতে একটি বাজমূর্তি দেখা যায়। রাজার গলায় ঝোলান ৫টি পবিত্র চিহ্ন- সূর্য, নক্ষত্র, অর্ধচন্দ্র, ত্রিশূল ও শৃঙ্গাকার টুপি- নরমুখী বৃষের যে রকম টুপি থাকে, টুপির আকার সেই রকম।

[গ্রন্থের পাদটীকায় সাহেব বলছেন যে, যদি শৃঙ্গাকার টুপিটি বাদ দেওয়া যায়, ভারতবর্ষে ও ঐ সব প্রতীক চিহ্ন দেখতে পাওয়া যায়, যা বৃষ প্রতীকের সঙ্গে যুক্ত হলে, আসিরিয়ানদের সঙ্গে অদ্ভুত সাদৃশ্যের কথাই মনে পড়ে। ভারতে শৃঙ্গাকার টুপি (horned cap) নেই, আর বেদে বৃষ মানে আকাঙ্খিত ফলবর্ষী-(ঋগ্বেদ ৯ম।৬৪/১/২/৩ ঋকে বৃষ কে সোম, দ্যু, ধর্ম, সত্য ইত্যাদি বলা হয়েছে)। বৃ= বৃদ্ধি, ষ= অন্ত। কারণ ও কার্য। কার্য = সৃষ্টি বা বৃদ্ধি। কারণ = লয়, অন্ত। কারণ কার্য, কার্য কারণ, এই আবর্তন শক্তিই বৃষ। ইনি অভীষ্ট ফল দেন]।

পুরাণের বৃষ, বৈদিক বৃষের প্রতীক মাত্র। Layard বলছেন যে ইরাণীদের ও আসিরিয়ানদের পোষাকও ছিল একই রকম আর পারসীক রাজাদের টুপি (নাম Cidars) ফ্রিজিয়ান বা স্বাধীনতা-প্রতীক-ফ্রেঞ্চ টুপির মত ছিল (resembled the Phrygian bonnet or the French Cap of Liberty)। আসিরিয়ানদের সঙ্গে ঘনিষ্ট সম্পর্কে আসা পারসীকরাও যে অসুর আখ্যা পান, এতে আশ্চর্য কি ? এটাও লক্ষ্য করার বিষয় যে ইরাণীরা সেমিটিক স্পর্শে এসে অসুর স্থানে করেন অহুর, কিন্তু অসিরিয়ানরা সংস্কৃত অসুর শব্দটি ও তার উচ্চারণটি ঠিক রেখেছিলেন অর্থাৎ আসূরীষেরা সেমিটিক উচ্চারণভঙ্গী গ্রহণ করেননি। ভারতীয় চিন্তাধারা, বৈদিক ভাবধারা কতদূর চলেছিল ও স্থানে স্থানে কি ভাবে গৃহীত হয়েছিল, তা বেশ বোঝ যায় এই সব থেকে। পুনঃ যখন ঐ সব ভাব ঘুরে মিশ্রিত হয়ে বা ম্লেচ্ছদেশ থেকে ভারতে ফিরে এসেছে, তখন ঐ সব ভাব ভারত কি ভাবে গ্রহণ করেছেন এ সব অনুধাবন করা প্রত্যেক ভারতবাসীরই উচিৎ। ভারতের ভাস্কর্যেও বৈশিষ্ট্য আছে, ঐক্য আছে, সমস্ত অপরা বিদ্যার আলোচনায় আজকাল যে সব নব নব তথ্য পাওয়া যাচ্ছে, তাতে এই সত্যটি দৃঢ় হচ্ছে।
ভাব সঞ্চরণ এভাবেই অগ্রসর হয়েছিল। ঈজিপ্টে এমন এক যুগ দেখা দিয়েছিল যখন ঐ দেশের দেবস্তুতিতে উচ্চ বা আধ্যাত্মিক অর্থ সংযোগ করার চেষ্টা চলেছিল। শ্রেষ্ঠ ও একমাত্র দেবতার- মহিমা বর্ণনায়, একাদশ বংশের শেষভাগে ফারোয়া রাজা খু-ন-এটেন (khu-n-Aten) ভাষায় প্রাণ ও ভাব সঞ্চার করেছিলেন, কিন্তু এই অধ্যাত্ম-প্রাণ ভাবটি এশিয়া থেকে আমদানি হয়েছিল (But the impulse to the reform came from Asia-The Religion of Ancient Egypt and Babylonia-Sayee.)। খু-ন-এটেনের মা ছিলেন বিদেশী। এশিয়ার ধর্মভাব ঈজিপ্টের ঘাড়ে চাপিয়ে দেবার চেষ্টা বিফল হয়েছিল। সূর্যকে ভগবৎ প্রতীক বলে জোর করে ঐ ফারোয়া রাজের সমস্ত রাজশক্তির পীড়নের মাধ্যমে চাপানোর চেষ্টা এটেনের জীবদ্দশা পর্যন্তই স্থায়ী হয়েছিল। এই রকম কবে ভাবপ্রচার কখনো ভারতে হয়নি। ঐ অত্যাচার বিশেষ ফলপ্রসূ না হলেও দুটি ভাব শিক্ষিতদের মনে গ্রথিত হয়ে উঠেছিল, (১) শিক্ষিত সম্প্রদায় বুঝতে আরম্ভ করেন যে, সাধারণ দেবালয় সমুহে যে নানা দেবতা রয়েছেন তারা সকলেই একেরই অভিব্যক্তি মাত্র, (২) এই জন্য তাঁরা প্রাচীন বিশ্বাসে কখনো আঘাত দেননি, পরে কিন্তু এ ভাব ছিল না। তাদের তখন মনে এল যে, যতই হোক ঐ দেবমূর্তি গুলো ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য রূপমাত্র, রূপ বা আকার বাদ দিলে, ঐ গুলোর মধ্যে ঈশ্বরের সত্ত্বা কিছুই নেই। রাজাই দেবতা, রাজাই-এমন কি ঈশ্বরের অবতার, এই মূল বিশ্বাসটি ঈজিপ্টের ফারোয়ারা আনেন এবং ঐ বিশ্বাসই আদিম বাবিরুষ কৃষ্টির সঙ্গে ফারোয়া সভ্যতার একটি যোগসূত্র। বাবিরুষে, মৃত্যুর পর রাজা দেবতা বলে গণ্য হতেন। বাবিরুষের অধিকাংশ রাজা যারা দেবতার সম্মান পেতেন, সকলেই সেমিটিক ছিলেন। সেই জন্যই, সম্ভবতঃ এই ভাবটি সেমিটিক জাতি থেকে এসেছে আর সম্ভবতঃ, সুমের জাতি প্রথমে এই ভাব গ্রহণ করায়, সুমের ও সেমিটিক সভ্যতার মিশ্রণে বাবিরুষ জাতিরও কৃষ্টির উদ্ভব হয়। রাজার জীবদ্দশাতেই ঐরকম গণ্য হবার ভাব খৃঃ পূঃ ৩৮০০ বর্ষেও বৰ্ত্তমান ছিল (সার্গন ও নারমিসিন সময় অবধি-“Can be traced back as far as Sargon and Naramsin”-Ibid)। পেরুর ইকাসদের মত ফারওয়া ছিলেন সূর্যবংশোদ্ভব। বাবিরুষদের বিশ্বাস ছিল যে, মানবদেহ দেব-দেহের সাদৃশ্যে সৃষ্ট, তাই বাবিরুষেব দেবতার নরাকৃতি। ঈজিপ্টে ছিল কিন্তু ঠিক এর বিপরীত, সেখানে প্রায় সব দেবতাদেরই পশুর আকার।

ভারতে ও রাজশরীরে দেবত্ব আরোপিত হত, সে শরীরও ছিল পবিত্র। রাজা ছিলেন ভারতে ঋষিকুলের অধীন ‘তপোবল সহায়’ পুরোহিতের অধীন। রাজাদের মধ্যে ব্রহ্মবিদ্যার আলোচনা খুব ছিল। আমরা তা দেখেছি, তারা দেহকে নশ্বর মনে করতেন। কিন্তু, ভারত ছাড়া অপর অনেক দেশে সে শরীরের মৃত্যু হয় না, তাই সে শরীর বিনষ্ট হবার পরও, রক্ষা করার জন্য কৌশল উদ্ভাবিত হয়েছিল।

স্বামীজি বলেছেন, “পাশ্চাত্যে এখন শিক্ষা দিচ্ছে যে, ঐ যে কটিতট আচ্ছাদনকারী অজ্ঞ, মূর্খ, নীচজাতি, উহারা অনার্যজাতি। উহারা আর আমাদের নয়!!!” (বর্তমান ভারত)। অধ্যাপক দাস মহাশয় তার Rgvedic India গ্রন্থে (২য় সংস্করণ) কয়েকটি তথ্য সুন্দর ভাবে নির্ণয় করেছেন। ঐ সমস্ত সুস্পষ্ট প্রমাণ হতে বেশ বুঝা যায় যে, কেন ঈজিপ্ট আদি দেশে প্রথম উচ্চ ভাব আসে ও পরে সে সব কেন বিকৃত ভাব ধারণ করে। দাস মহাশয় দেখিয়েছেন যে ঋগ্বেদে সময় ‘দাস’ ‘দস্যু ‘দ্রাবিড়’ প্রভৃতি জাতিদের আদিম বাসস্থল ছিল দক্ষিণ ভারতে। তারা আর্যজাতিদের মধ্যে উচ্ছৃঙ্খল দল মাত্র-অসভ্য ও বর্রর পর্যটক (Aryan nomads in Savage condition), অথবা, আর্যমতের সঙ্গে তাদের সম্পূর্ণ মিল ছিল না। পনিরা ছিল সপ্তসিন্ধু নিবাসী আর্য বৈশ্য (বণিক)। তারা দাক্ষিণাত্যে গিয়ে পাণ্ড্য ও কোলদের মধ্যে আর্যসভ্যতার বিস্তার করে। ঐ দ্রাবিড় জাতিরাই ঈজিপ্ট ও মেসোপোটেমিয়া যান আর পণিদের উপদেশে ঈজিপ্ট ও বাবিরুষে সভ্যতার ভিত্তি স্থাপন করেন। Punic race নামে খ্যাত এই পণিরাই পরে (Syria) সিরিয়ায় যায় ও সেখানে তাদের নাম হয় ফিনিসিয়ান। এইরকম, কাশীয়, হিত্থিতি, মিত্তানি, ফ্রিজিয়ান ও লিডিয়ান প্রভৃতি জাতি যাদের নাম ভারতে বাইরেও প্রচার আছে সকলেই আর্যশাখা, কিন্তু ঐ সব জাতিরা সেমিটিক জাতিদের সঙ্গে মিশে যান, ফলে সেমিটিক সভ্যতা তাঁদের গ্রাস করে।

[দাস মহাশয় “The Kossens, the Hithities, the Mittanis, the Phryginas and the Lydians প্রভৃতি জাতিদের “Pure Aryan immigrants (খাটি আর্য) বলেছেন, কিন্তু তারা “Completely absorbed by the great sematic race” হয়]।

আর্যের ঐ প্ৰকার অভ্যুদয় কত কাল পূৰ্বে হয়েছিল! দাস মহাশয় (Rigvedic India-২য় সংস্করণে) দেখিয়েছেন, বহু প্রমাণ সহ, যে উহা সংঘটিত হয়, ৫০-২৫ হাজার বৎসর পূর্বে অন্ততঃ। দাস মহাশয় আরও বলেন যে পশ্চিম কিম্বা মধ্য এশিয়া থেকে আর্যের আগমন ব্যাপার এই জন্য অসম্ভব যে, সে সময়ে ঐ সব স্থানে অস্তিত্ব ছিল না, অর্থাৎ উত্তর মেরুর নিকট পর্যন্ত সমস্ত স্থানটি সমুদ্র ছিল, ভূতত্ত্বই এর প্রমাণ। তখন এশিয়ার ভূমধ্য সাগর ও ইউরোপের ভূমধ্য সাগর ছিল (Asiatic Mediterranean Sea ও European Mediterranean Sea), ও তাদেরই পূর্ব নিদর্শন স্বরূপ বসফরাস সাগর, আরল সাগর, কৃষ্ণ সমুদ্র ইত্যাদি বৰ্তমান-ভূতত্ত্ববিদ্যা (Geology) এটা সমর্থন করে।

ইউরোপের পশ্চিমাংশে বিভিন্ন জাতির বাস ছিল। প্রস্তর যুগে জন্তু জানোয়ারের পরিষ্কার ছবি থাকলেও, পরবর্তী যুগে সে সব কিছুই নেই। এটাতে মাঝখানে অন্য জাতির আগমন ও প্রভাব বোঝা যায়। অতএব, এক যুগের একটা আদর্শ দেখে পরে তার নিদর্শন না পেলে বলা সঙ্গত নয় যে প্রথম যুগের আদর্শটি পরে প্রক্ষিপ্ত হয়েছে। যখন যে ভাব যে জাতির মধ্যে প্রবল হয়, সেই ভাবের দাগই সেই জাতি রেখে যায়। তাছাড়া, এক এক জাতির বিশেষ সংস্কার আছে, যেমন Esquimax (এসকিমো) জাতি সুন্দর নক্সা করতে পটু (fair draughtsman), কিন্তু Polynesians (পলিনিসিয়ানরা) বহু বিষয়ে অপেক্ষাকৃত উন্নত হলেও, নিজেরা ফিটফাট থাকতে শিখলেও, নিজেদের অস্ত্রে শস্ত্রে বেশ শিল্পের বাহাদুরী দেখাতে পারলেও, তাদের মধ্যে বৃক্ষলতা বা কোন চিত্র অঙ্কন দক্ষতা নেই বা এখন অতি সামান্য ভাবে পরিস্ফুট।

[On the origin of Civilizations and primitive Condition of Manby Right Hon Averbury P C F. R, S. D C. L. L L D দ্রঃ]

উক্ত মনীষী বিভিন্ন দেশে আদিম মানুষের আচার ব্যবহার ও ধর্ম বিশ্বাসের কথা বলেছেন। তিনি দেখিয়েছেন যে মানব-প্রকৃতি নিহিত সহজাত জ্ঞান প্রসূত আচার ও প্রথা অনেক স্থানেই প্রায় এক রকম। ঐ সব আচার থেকেই কোন কোন স্থানে ভাষার উৎপত্তি হয়েছে। পেরুভিযানরা দুই ফুট লম্বা সূতোর সঙ্গে এক একটি রঙিন সূতোর গাঁঠ বেঁধে ভাব প্রকাশ করতো৷ সাহেবের অনুমান যে, ঐ রকম গোলাকার গাঁঠ স্মৃতিশক্তির সহায়ক এবং ঐ রকম গাঁঠ বাঁধা প্রথা হতেই আদিম চীনা ভাষার উৎপত্তি, যার নাম Hotu ও Loshi (হোতি ও লোশি); এই রকম গাঁঠ বাঁধা প্রথা পশ্চিম আফ্রিকা ও আমেরিকার বহু আদিম জাতিতে বর্তমান। এখানে বলা যেতে পারে যে, স্মৃতিশক্তির উদ্বোধক স্বরূপ আজও বাঙ্গালীরা কাপড়ে গাঁঠ (গেরো) বাঁধার রীতি, বিশেষ নারীদের মধ্যে আছে। যা হোক এ সব সত্ত্বেও পার্থক্য দেখা যায়, অতএব, যার যা বৈশিষ্ট্য, যার যা সংস্কার, সেই দিক্ হতে তথ্যানুসন্ধান করা দরকার, তবেই সত্য পাওয়ার আশা করা যায়।

ঈজিপ্টের প্রাগৈতিহাসিক যুগ-খৃঃ পূঃ ৮০০০-৫৫০০ বর্ষ পর্যন্ত। ভাবহীন জড়তাপূর্ণ এই যুগে কলাবিদ্যার কোন অগ্রগতি-চিহ্ন ও নেই।
প্রথম বংশের সময়-খৃঃ পূঃ ৫৫০০ বর্ষে-এক নতুন জাতি এসে নতুন সভ্যতা স্থাপন করে জাতিতে প্রাণ সঞ্চার করেন। ঐ সময় হতে সাঙ্কেতিক্ লিপির আমদানি হয় ও ঐ লিপির দ্রুত উন্নতি হয় ও উহাই লিখিত ইতিহাসের আরম্ভ যুগ।
[ “Arts and Crafts of Ancient Egypt by Flinders Petric]
ঈজিপ্ট বা তার নিকটবর্তী কোন স্থানে, ভূমধ্যসাগরের আশেপাশে কোন স্থানে স্বর্ণ পাওয়া যায় না, অথচ ঈজিপ্টের প্রথম বংশ হতে স্বর্ণালঙ্কার ব্যবহার দেখা যায়। সাহেবের অনুমান যে নিউরিয়া ও এশিয়া মাইনর থেকেই ‘এশিয়ার সোণা’ (Asiatic Gold) আমদানি হ’ত। এই রকম স্বর্ণালঙ্কারের ব্যবহার বরাবর চলে এসেছে। তারপর ‘ত্ৰিচন্নপল্লী’ ধাঁজের অলঙ্কারের ব্যবহার দেখা দেয় ও তা রোমানদের সময় পর্যন্ত বর্তমান ছিল।

[“One new art appears, the plating of gold wire chains, in what is now commonly called Trichnopoly pattern This method was continued down to Roman times”]
খৃঃ পূঃ ৭০০ বর্ষে তামার কাজের মধ্যে সোণা বসানো কারিগরী পাওয়া যায়, যা ভারতের সাধারণ প্ৰথা। [This is a common system in India”-ঐ ]।

এই অলঙ্কারগুলোকে Keft work বলা হয়। কারণ, নাইল নদী হতে Keftই ছিল ভারতে বাণিজ্যযাত্রার পথ। যাকে আমরা এখন চীনামাটির বাসন বলি, সেই জিনিষের আশ্চর্যরকম বহুপ্রকার সূক্ষ্ম শিল্পের আবির্ভাব হয় ও বহুল প্রচলন হয়, আর সেই সময়ে তাম্রসূত্র দিয়ে গ্রথিত করা নতুন ধরণের টালি দিয়ে বাড়ী ঘর তৈরী হতে আরম্ভ হয় খৃঃ পূঃ ৫৫০০ বর্ষে (১ম বংশে)। ষষ্ঠ বংশে, খৃঃ পূঃ ৪০০০ বর্ষে, ভারতজাত ‘নীল’ দেখা দেয় (“a dark Indigo-blue”)। খৃঃ পূঃ ১০ হাজার বর্ষে বাদরিয়ান (Badarian Dynasty) বংশের সময়ে ঈজিপ্টে যান চলাচল করত। ভারত হ’তে তখন যে ভাব সঞ্চারিত হয়েছিল তার কথা আমরা যথাসময়ে জানাব। যাই হোক, ঐ যুগ সভ্য ছিল ও ঐ সভ্যতা দীর্ঘ ২০০০ হাজার বংসর স্থায়ী ছিল এবং তাবপর অন্ধকার যুগ আরম্ভ হয় খৃঃ পূঃ ৮০০০ বর্ষ হতে খৃঃ পূঃ ৫৫০০ বর্ষের প্রাক্কাল পর্যন্ত। Saee সাহেব বলেন যে ঈজিপ্টের ধর্ম, নানা জাতি, বিভিন্ন কৃষ্টি ও বিভিন্ন চিন্তার মিশ্রণে উৎপন্ন।
(Gifford Lectures-Lecture II; by A H Sayce D. D L. L. D Professor of Assyriology, Oxford, author of the Religions of Ancient Egypt and Babylonia)
এশিয়াবাসী ফারয়োয়াতেই শক্তি কেন্দ্রীভূত হয়েছিল ও তার ফলে যে ঐক্য এসেছিল তা সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত প্রভাবমাত্র (ঐ)। এখানে বলা বাহুল্য যে, ঈজিপ্ট কোন ভাবকে আত্মস্থ করে একটি মহান্ জীবনাদর্শরূপে পরিণত করতে সমর্থ হয় নি।

ভারতেতর অন্যান্য বহু প্রাচীন জাতির মধ্যে বিভিন্ন সভ্যতা ও বিভিন্ন সংস্কৃতির সংঘাত দেখতে পাওয়া যায়, কিন্তু তা সত্ত্বেও ভারতে একই ধারা আজ পর্যন্ত বর্তমান। অন্যস্থানে, আদিম মানব নৈসর্গিক ব্যাপার দেখে ভয়ে সেগুলোকে ‘দেবশক্তি’র খেলা মনে করেছে, অনন্যোপায় হয়ে ঐ ‘দেবশক্তির’ আরাধনা করেছে বাস্তবকে (Real-কে) আদর্শরূপে খাড়া করেছে (idealise করেছে), বৈজ্ঞানিক Kepler সাহেবও এ থেকে রক্ষা পাননি। এই ভয় প্রসূত Animism থেকেই, ইউরোপীয় মনীষীরা বলেন ‘রিলিজনের’ (Religion-এর-ধর্মের) উৎপত্তি। ভারতে, আর্য, গোড়া থেকেই সর্বত্র একেরই প্রকাশ দেখেছেন, এক সত্ত্বাই প্রত্যক্ষ করেছেন, একই তাঁদের আদর্শ, ভাবমুখে তারা বহুর মধ্যে এককেই পেয়েছেন-deal-কে realise করেছেন। নানাত্তের বা বিভিন্ন ভাবেই ক্রমপরিণতি হয়, এক তত্ত্বোপলব্ধির (Being and Becoming-এর) পথে বহুরই ক্রমাবরণ মুক্তি হতে পারে। ভারতে Animism হ’তে Religion-এর উৎপত্তি নয়, তার কোন প্রমাণও নেই। ইউরোপের Religion-এর অনুবাদ ধর্ম নয়।

রামায়ণে দেখি, সুগ্রীব কর্তৃক দেশবিদেশে অতি দূর দূর দেশে ‘বানর’ সৈন্য প্রেরিত হয়েছিল। রামায়ণ পড়লে মনে হয়, তখন ভারত আরও একবার সমস্ত পৃথিবীর সমস্ত মানবজাতির সংস্পর্শে এসেছিলেন। আরও জানা যায় যে, ঐ সব ‘বানর’ সৈন্যদের মধ্যে বিভিন্ন বর্ণাবয়বী জাতি ছিল ও তারা অনেকে ভারতের বাইরে থেকে এসেছিল। তাদের নানা প্রকার বর্ণই এটা প্রমাণ করে। বানর রাজ সুগ্রীবের প্রভাবও কতদূর বিস্তৃত ছিল তারও এটাই প্রমাণ। ঐসব দূর দূরান্ত স্থান তখন অজ্ঞাত ছিল না অর্থাৎ ঐ সব স্থানের বিবরণ আগে থেকেই অনেকে জানত। এতে স্পষ্ট বোঝা যায় যে, তখন ভারতের সঙ্গে ভারতেতর দেশে বহু প্রকারর আদান প্রদান ছিল। বলা বাহুল্য, আদান প্রদান যেভাবেই হোক, ভাববিনিময় অবশ্যম্ভাবী। পবিত্রতা, সত্যনিষ্ঠা ও চরিত্রবলেই রামচন্দ্র সকলকে আপন করে নিয়েছিলেন; যে চরিত্ৰবল ও নেতার প্রতি একান্ত নিষ্ঠা দেখা দিয়েছিল, তার দৃষ্টান্তও ভারতেতর দেশে এ পর্যন্ত দেখা যায়নি।

মানব-বিজ্ঞানবিৎ (Anthropologists) ও তার অন্তৰ্গত জাতি বিজ্ঞানবিৎ (Ethnologists) ইউরোপীয় পণ্ডিতদের মধ্যে বিষম মতভেদ দেখা যায়। এক দলের মত যে, আদিম বর্রর জাতিই প্রথম অশ্বকে পোষ মানায়, অন্য দল বলেন যে, আর্যেরাই প্রথম ঘোড়াকে পোষ মানায়, কারণ, বৈদিক ‘অগ্ন্যাধানে’ ঘোড়ার দরকার হত, অপর এক দল বলে বসলেন যে মধ্য এশিয়ার (Central Asia) লোকই প্রথম পোষ মানায় ও দেশে লোকের পক্ষে এইটিই স্বাভাবিক; অমনি আর একটি দল বলে উঠলেন, তাহলে ঐ স্থান থেকে আগত এসকিমো জাতির ইতিহাসে সে সংস্কারের চিহ্ন পর্যন্ত পাওয়া যায় না কেন? আবার জন কতক পণ্ডিত ঐতিহাসিক প্রমাণ উদ্ধৃত করে দেখালেন যে, ওসব কাল্পনিক কেচাকেচি ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিতরূপে বলা যায় যে, খৃঃ পূঃ ৩০০০ বর্ষ পূর্বে বাবিরুষে ঘোড়া পোষ মানানোর প্রমাণ পাওয়া যায়। ঐ সব পণ্ডিতদের সহায়তা করতে নামলেন ভৌগলিক ও উদ্ভিদতত্ত্ববিদ পণ্ডিতেরা। এই চেষ্টার ফলে এটাই দৃঢ়রূপে প্রমাণ হল যে এশিয়ার সঙ্গে সমস্ত পাশ্চাত্য জগতের সম্বন্ধ অতি প্রাচীন। সুইজারল্যাণ্ডের গৃহপালিত জন্তু জানোয়ারের পূৰ্বপুরুষ এশিয়া থেকেই এসেছে। আলাস্কা থেকে টিবাডেল ফিউগো পর্যন্ত স্থানে প্রত্যেক কুকুরটি নেকড়ে থেকে এসেছে। বেবিং প্রণালী পার হয়ে এশিয়া থেকে কলার (কদলির) মত অনেক ফলমূল এশিয়ার লোকই এনে প্রাগঐতিহাসিক যুগে রোপণ করেছে, এ ব্যাপার আবার ওশেনিয়া ও আফ্রিকাতে দেখা যায়। বহু ভাষাবিদ পণ্ডিত মোক্ষমূলার সাহেব তাঁর Science of Religion গ্রন্থে দেখালেন যে old world O new world এ ভাষাগত ও ধর্মগত যে প্রমাণ পাওয়া যায় তাতে বোঝা যায় যে, কোন স্মরনাতীত প্রাগ্ঐতিহাসিক যুগে এশিয়া থেকে অ্যামেরিকায় কোন জাতির আমদানি হয়েছিল। তিলক প্রমুখ পণ্ডিতেরা ঐ সব দেখে অন্য প্রমাণ উপস্থাপন করলেন, যথা- ঋগ্বেদে যখন দীর্ঘ উষা, দীর্ঘ দিন রাত্রির বর্ণনা আছে, তখন আর্যেরা প্রথম উত্তর মেরুদেশেই ছিলেন। ঠাণ্ডা দেশ হতে আগত বলেই তারা অগ্নি প্রিয় ছিলেন! তার পূর্রে ইউরোপীয় পণ্ডিতেরা অনুমান করলেন যে মধ্য এশিয়া থেকে আর্যজাতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে, কারণ সেখান থেকেই ছড়িয়ে পড়াটা সহজ ছিল; সেখানে কাম্পিয়ান হ্রদের আশে পাশের কেরোসিনের খনি থেকে আগুন জ্বলে ওঠা দেখে আর্যেরা অগ্নিকে দেবতা ঠাওরালেন, তাই গ্রীক অগ্নিদেবতা Hesta এর পূজা- অগ্নিকে জিইয়ে রাখার প্রথা। রোমের অগ্নিদেবতা Vesta এর ও সেই ব্যবস্থা দেখা যায়, কারণ গ্রীক্ বা রোমানরা ও ছিল নাকি আর্যশাখা। এটি Animism এর আর এক প্রমাণ। আশ্চর্যের বিষয়ে এটা কারোর নজরে পড়ল না যে, ভারতীয় আর্যেরা অগ্নিকে কোন দৃষ্টিতে দেখতেন, উপাসনার মন্ত্রগুলোতে অগ্নি কিভাবে বর্ণিত, আর অগ্নি উপাসকদের মধ্যেও, ওসব দেশে ত্যাগ বৈরাগ্যের ভাব একেবারে নেই বললেই হয়। ভারত থেকেই তো আর্য সব যায়গায় যেতে পারেন এবং ঐ সব স্থানে লোকেরা তাঁদের নিজ নিজ ভাবে আচার গ্রহণ করেছিল, অথবা আর্য শিক্ষা পেয়েও সাধন প্রণালীর অভাবে বৈদিক ভাব আত্মস্থ করতে পারেনি-এটা অসম্ভব কিসে? আর্যাবর্তে পাহাড়ের জঙ্গলে ও অরণ্যে ইত্যাদিতে আপনি আগুণ জ্বলে উঠে, ঋগ্বেদে বাড়বানলের কথাও আছে- এসব তাঁদের নজর এড়িয়ে যায় কেন? অগ্নিহোত্রের আহুতি মন্ত্র, ‘ভূ ভূবঃ স্বঃ ওঁ অগ্নির্জ্যোতিঃ জ্যোতিবগ্নি স্বাহা’- এই অর্থে কি অন্যত্র অগ্নি গৃহীত হত? শ্রদ্ধা হোম- যাতে সত্যই মিথুন, যার সহায়তায় সাধক ত্রিলোকজয়ী হতে পারেন- এই মানস মোহের অনুরূপ কোন ভাব ও কি ঐ সব স্থানে ছিল ?

ভারত হতে যে সমস্ত অভিযানের কথা বলা হয়, সেগুলোকে সভ্যজাতির অভিযান বলা যেতে পারে। আমরা দেখেছি যে সেই স্মরণাতীত যুগে ও মানব জন্তু জানোয়ারকে পোষ মানিয়ে কাজে লাগাতে শিখেছে, তাঁদের প্রিয় গাছ পালা অন্য স্থানে নিয়ে রোপন করেছে, ভাষা ধর্ম বিস্তার করেছে। মানবতত্ত্ববিদ পণ্ডিতেরা ভারত হতে অসভ্য জাতির ঐরূপ বিস্তৃতির কথা বলেন। কিন্তু তারা অনেকেই ভারতীয় সভ্য আর্যজাতির আর্য-সংস্কৃতি বিস্তারের বেলায় নীরব। পূর্বে বা মনে করতেন যে বৌদ্ধযুগের আগে আর্য ভাব ভারতের বাইরে বিস্তার লাভ করেনি। তাঁদের মতে, ভারতে আর্যজাতি প্রবেশ করার পূৰ্বে সমগ্র ভারতময় এক কৃষ্ণকায় জাতির বাস ছিল। এই কৃষ্ণকায় জাতির বংশধররাই নাকি দ্রবিড় জাতি। এই দ্রবিড় জাতির এক শাখা সিংহলে গিয়ে বাস করে, তখন সিংহলে বাস করত তদপেক্ষা ঘোর কৃষ্ণকায় জাতি ‘বেদ্ধা’। বেদ্ধাদের জ্ঞাতিরা অষ্ট্রেলিয়ার আদিম নিবাসী। জাতি বিজ্ঞানের জনকতক পণ্ডিতেরা বলেন যে, আর্যেরা ভারতে এসে ঐ দ্রাবিড়দের ঠেঙাতে ঠেঙাতে দাক্ষিণাত্যে বিতাড়িত করলে, পরে সেখান থেকেও ঠেঙানির চোটে তাতা Eastern Peninsula, Indonesia ও Oceaniaতে—Malanesian বা যাদের আধুনিক প্রতিনিধি এবং অন্যদিকে Further India, Maldives ও Madagascar প্রভৃতি স্থানে ছড়িয়ে পড়ল। এরাই হল MalayoPolynesian Family বা মালাওপলিনিসিয়ান সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত জাতি।
[Vide Polynesian Journal, vol IV, December 1895 An article by Dr John Fraser, LLD] উক্ত সাহেবের মতে, Madagascar এর ভাষা South Sea ব অন্তর্গত সামাওয়াদের (Samoa) মত অনেকটা]।
ঐ সব স্থানের ভাষা দ্রাবিড় ও পালি মিশ্রিত। আর একদল বোঝানোর চেষ্টা করেছেন যে আৰ্য সংস্কৃতি ও সভ্যতার মূল আর্যকৃষ্টি নয়। মোহেনজোদাড়ো, হরপ্পা ও অন্যান্য নানা স্থানে যে সব নব নব তথ্য পাওয়া যাচ্ছে তাতে ইউরোপীয় ধারায় বিষম চাঞ্চল্য এসেছে, কিন্তু অনেকে তাদের পূর্ব বুলি এখনও পুরো ছাড়েন নি। তাদের মতে, ভারতে আর্যের আগমন হয় অপরাপর একাধিক জাতির বহু পরে। তারাও বলেন যে ভারতে আদিম নিবাসী ছিল বেঁটে ‘কালা-আদমি’–‘নিগ্রেটো’। তাদের বাস ছিল সমুদ্রের উপকূলে। বর্তমান যুগেও তাদের বংশধর, পারস্যে, দক্ষিণ ভারতে, আণ্ডামানে, এমন কি সুদূর নিউগিনি দ্বীপেও পাওয়া যায়। আসামের পথ দিয়ে ‘অষ্ট্রিক’ নামে আর এক জাতি ভারতে আসে। তারা ছিল অনেকটা সভ্য অর্থাৎ বড় বড় নৌকা তৈরী করে সমুদ্রে পাড়ি মারত, তাদের একটা ভাষা ছিল, ধর্ম বিশ্বাসও ছিল আর যুদ্ধ করতেও জানত। বাৰ্মার স্থানে স্থানে এদের সভ্যতার প্রসার ও উন্নতি হয়। ভারতে প্রবেশ করে এরা ক্রমশঃ সমস্ত ভারতবর্ষে ছড়িয়ে যায়; বাংলা দেশে এদের সভ্যতার একটি বিশিষ্টরূপ ফুটে ওঠে ও গঙ্গানদীর দুই উপকূলে সেটি বিস্তৃত হয়ে পড়ে। এই অষ্ট্রিক জাতির অভিযান শাখা প্রশাখায় বিভক্ত হয়ে, নানা মিশ্রিত ভাষার সৃষ্টি করে, ইন্দোনেশিয়া, নিউজিলাণ্ড পৰ্যন্ত অগ্রসর হয়। বর্তমান সাঁওতাল, কোল, মুণ্ডা প্রভৃতি জাতিদের ভাষা- ‘অষ্ট্রিক ভাষারই এক শাখা-ভাষাতত্ত্বের দিক দিয়ে পণ্ডিতেরা এটা প্রমাণ করেন। যা হোক, তাঁদের মতে, ভারতে আর্যের আগমন এই অষ্ট্রিক জাতির বহু পরে। আর্যের আগমন সম্বন্ধে কয়েকটি মতের কথা আগে বলেছি। আর এক দলের মত, আৰ্যেরা বেরিয়ে পড়েন জার্মাণি বা তার নিকটবর্তী কোন স্থান থেকে। এ সম্বন্ধে তারা আর যা বলেন তা বর্তমানে উড়ে গেছে, অতএব তা বলা অনাবশ্যক। ভারতে এসে কিন্তু এই সভ্য অষ্ট্ৰিক্ পরে আৰ্য ভাষা গ্রহণ করে ও ক্রমশঃ আখ্যায়িত হতে আরম্ভ করে। নদী পাহাড়ের নামকরণ নাকি অষ্ট্ৰিকরাই প্রথম করে ও আর্য ভাষা গ্রহণ করার পর নামগুলো তেমনি রূপান্তরিত করে।

অষ্ট্ৰিকরা আগে এসেছিল, বেশী সভ্য ছিল, তবে তারা আর্যায়িত হয় কেন? সাঁওতালাদির ভাষার মধ্যেও সংস্কৃত শব্দমূলক শব্দ পাওয়া যায় কেন? কেন অষ্ট্ৰিক আৰ্যভাষা গ্রহণ করে ? এসব প্রশ্নের কোন সদুত্তর পাওয়া যায় না। তবে ইউরোপীয়রা এখানে একটি অনুমান এনেছেন, অর্থাৎ আৰ্যে সভ্যতায় হীনতর হলেও, তাঁদের নাকি সংহতি-শক্তির জোর ছিল ও খুব উদ্ভাবনী শক্তি ছিল। তা হলে সভ্যতা মানে কি ? সংহতি-শক্তি আছে, কল্পনাশক্তি আছে, উদ্ভাবনীশক্তি আছে, সুতরাং উন্নততর সমাজশক্তিও আছে, তবে সভ্যতায় হীনতর কেন? তবে কি ঠেঙানির চোটে অষ্ট্ৰিকরা সায়েস্তা হয়েছিল ও জৈয়ির ভাষা তাদের ঘাড়ে চেপে বসেছিল ? তা হলেও ত, ইউরোপীয় হিসাবে, আৰ্যরাই বেশী সভ্য হয়ে যান না কি ? ঠেঙানির কৌশল ও ঐ সব গুণই ত বর্তমান সভ্যতা শব্দের অর্থ; কিন্তু এ সম্বন্ধে ইউরোপীয় পণ্ডিতরা প্রায় নীরব। আর্যের একদল না হয় জার্মাণী বা অন্যত্র থেকে ছড়িয়ে পড়তে পারে, কিন্তু ঐ সব স্থানে আর্যের বৈশিষ্ট কোথায়? অন্যত্ৰ আৰ্য-আচারের অনুকরণটা থাকতে পারে, কিন্তু কোথায় জীবনকে পবিত্র করার, সাধন করে সব প্রত্যক্ষ করার প্রবল সংস্কার, ওসব দেশে ? ভারতে বাইরে আর্যেরা যখন একত্র ছিলেন (যেমন বলা হয়), তখন তাদের বৈশিষ্ট্য দেখা দেয় নি, আর তা ফুটে উঠল ভারতে ঢুকেই ? তারপর, ঐ পণ্ডিতরা বলেন যে আদি দ্রাবিড়দের লম্বা মাথা, কিন্তু ভারতীয় দ্রাবিড়দের গোল মাথা- এটা যে কেমন করে হল, তার কারণ আজও নিরূপণ হয়নি। অথচ দ্রাবিড় ভাষার সঙ্গে বেলুচিস্থান অঞ্চলের ব্রাহুই জাতির ভাষাগত সাদৃশ্য দেখতে পাওয়া যায়, এমনি কি রুষদেশেও দক্ষিণ ভারতের একটি ভাষার সাদৃশ্য আছে। সাদৃশ্য থাকতে পারে অনেক কারণে; ঐ রকম অনুমান করে সিদ্ধান্তে আসা কি বৈজ্ঞানিক প্রণালী? বৈজ্ঞানিক প্রণালীর বিচার হয় বাস্তব ধরে, বস্তুকে বিশ্লেষণ করে ও সেই বাস্তব ও বিশ্লেষণের মধ্যে থাকতে পারে অনুমান সামান্য, সিদ্ধান্তে সহায়তা করার জন্য। ঐতিহাসিক ঐ রকম ব্যাপারে বাস্তবিকতাই বা কি, আর নির্দিষ্ট বস্তুই বা কি? সবই যদি আন্দাজ করা হয় ও তাকেই যদি যুক্তি বলা হয়, অন্য অনেক রকম আন্দাজ করা যেতে পারে, যেগুলো অপেক্ষাকৃত সহজ, স্বাভাবিক ও সঙ্গত। রক্তমিশ্রণের ফলেই হোক বা যে কারণেই হোক, গোল মাথা বা লম্বা মাথাই হোক, আর্যের ও মিশরীদের মাথার খুলির সাদৃশ্য থাকুক আর নাই থাকুক- যেখানে আর্যের বৈশিষ্ট্য নেই সেখানে কোন হিন্দুই শাস্ত্রানুসারে আৰ্য এই আখ্যা দেবেন না। আর, ঐ সব হাড় মাস চামড়া ও রক্তের দিক্ দিয়ে বিচার করলেও, এটা বুঝিয়ে দেওয়া দরকার- কেন ঐ সব স্থানে আৰ্য-সংস্কার বৈশিষ্ট্যের একান্ত অভাব, কেন ভারত সাধনের বৃহৎ সমর ক্ষেত্র আর কেন অন্যত্র পশুবলের সংগ্রামভূমি।

এই রকম ফিনিসিয়ানদের কথাও আছে। হেরোডোটাসের মতে, ইউফ্রেটিস ও তাইগ্রীস নদীর উপকূলেই ছিল তাদের আদিম নিবাস। বংশপরম্পরায় সেখানে বাস করায় তারা তাদের আদিম ভাষা ভুলে যায়। এই ফিনিসিয়ানরাই কাঁচ প্রস্তুত প্রণালী আবিষ্কার করে ও ইউরোপিয় প্রভৃতি একমতে তারাই প্রথম লিপি বা লিখনপ্রণালীর আবিষ্কারক। এই ফিনিসিয়ানরাই গায়ে পড়ে আর্যদের সঙ্গে ঝগড়া বাঁধাত তারও বৃহুতর প্রমাণ পাওয়া যায়। যাই হোক, লিপি ছিল অনেক প্রাচীন জাতির, কিন্তু, ইউরোপীয়দের মতে, ছিল না ভারতীয় আর্যের। স্বেচ্ছায় তারা কানা সাজলে তার উপায় কি? ঋগ্বেদ (৪ অষ্টক।২/১২) তে আছে যে রাহুর ছায়া সূর্যকে বিদ্ধ করে। এই যে গণনা বা বেদি আদি নির্মাণে যে গণিতবিদ্যার দরকার হত, তাও কি না লিখে হত ? ব্রাহ্মণগ্রন্থে ‘পংক্তি’ শব্দ পাওয়া যায়, তাও কি গুনে গুনে ঠিক করা হত ? রক্তের দিক দিয়ে, গ্রীকদেরও আৰ্য বলা হয়, বলা হয় উভয় সভ্যতার মূল এক। আদর্শ বা ভাবের ঐক্য বা সাদৃশ্য কোথায় ? গ্রীক-পুরাণে দেখা যায়, দেবতারা আত্মীয় স্বজনের মাংস খেয়ে তৃপ্তি লাভ করেন। বেদপন্থীর মধ্যে এরকম ভাব কোথায় ? ঋগ্বেদে মৃতের সৎকার দুরকম ভাবে হত- দাহ করা ও কবর (সমাধি) দেওয়া। এই দুই প্রথা ভারতে আজও বর্তমান। সন্ন্যাসীর দেহ সবস্থানে দাহ করা হয় না, সমাধি দেওয়াই (জলসমাধি দেওয়া বা কবরস্থ করা) হয়। সম্প্রদায় হিসাবেও বিভিন্ন প্রথা আছে। বীরশৈবেরা মৃতকে কবরস্থ করেন আজও। আচারের বাহ্য সাদৃশ্য বা শব্দার্থের সাদৃশ্য দেখে তাকে প্রমাণ বলে খাড়া করা নিরাপদ নয়। বৈদিক ভাব প্রসাব কত দিক্ দিয়ে, কত রকমে হয়েছে তা দেখার ক্রমশঃ চেষ্টা পাব। আমরা ভাবতীয় পণ্ডিতকুলকে সানুনয়ে এর ধারাবাহিক বিবরণ দিতে আহ্বান করছি।

আর্যপ্রভা-বৈদিক যুগ-প্রসঙ্গ


বৈদিক যুগ-প্রসঙ্গ
জগতের ইতিহাসে সর্বাপেক্ষা বিস্ময়কর ব্যাপার এই যে, ভারতের সমস্ত আস্তিক দর্শনগুলো বেদ সম্মত; অতএব বেদের ভাব সবার আগে ভারতীয় জাতির মধ্যে বিস্তার লাভ করেছিল; আবার সমস্ত দর্শন এর মধ্যে প্রাচীনতম দর্শন সাংখ্য। ব্রহ্মবিজ্ঞান এর সম্প্রসারণ কাজ কত দিন ধরে চলেছিল, কে জানে? যা হোক, ব্রহ্মবিজ্ঞানের উচ্চতম ভাব যে স্মরণাতীত যুগ থেকে ভারতে চলে আসছে সে বিষয়ে সন্দেহ করার কিছু থাকে না।

ইউরোপীয় মনীষিদের মতে, ঋগ্বেদ সর্বাপেক্ষা প্রাচীন হলেও তার মধ্যে সব মণ্ডল গুলো সেরকম প্রাচীন নয় ও মণ্ডল গুলোর মধ্যে যেখানে যেখানে উচ্চভাব আছে সেগুলো অপেক্ষাকৃত অপ্রাচীন বা আধুনিক। মণ্ডলের ক্রম অনুযায়ী সময় নির্ণয় করার একটা চেষ্টা হয়েছিল; কিন্তু তাতে তাদের উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয়নি। তারা দেখলেন, ৩য় মণ্ডলের কোন সূক্তে ঋষি হচ্ছেন বিশ্বামিত্র, কোন সূক্তের ঋষি তাঁর ছেলে মধুচ্ছন্দা, একই মধুচ্ছন্দা আবার নবম মণ্ডলের একজন ঋষি; ১০ম মণ্ডলের একজন ঋষি হচ্ছেন কুশিক, মধুচ্ছন্দার প্রপিতামহ, উচ্চভাব পরে উদয় হয়েছে প্রমাণ করা বড়ই দুষ্কর।

শব্দ গঠনের সময় শব্দের বা ধাতুর মূল অর্থ বুঝলে, বোঝা যায় যে ঐ মূল ভাবটি জাতির মধ্যে আসার বহু পরে শব্দটি গঠিত হয়েছে অর্থাৎ ভাষার শব্দ বা ধাতু অপেক্ষা ভাবটি আরো প্রাচীন। ঋগ্বেদের ১ম মণ্ডলেই অদিতি শব্দটি আছে। (অদিতি= দ্বৈতহীন)। ঐ মণ্ডলের ১৬৪ সূক্ত। ৪/৫/৬/৭। ঋক্ গুলোতে প্রাণ ও আত্মার কথা আছে। আদিত্য কে সর্বব্যাপী ও তেজোময় বলা হয়েছে; ৪১ সূক্তে গৌরী শব্দ আছে, যার অর্থ- বাক, যিনি একপদী, দ্বিপদী, চতুষ্পদী বা নবপদী রূপে সবদিকে ব্যাপ্ত হয়ে রয়েছেন। এ রকম ভাব ১০ম মণ্ডলে ও পাওয়া যায়, অথর্ব বেদেও পাওয়া যায়। গৃৎসমদ ঋষির নাম ১ম মণ্ডল, ২ মণ্ডল, নবম মণ্ডল ও ১০ম মণ্ডলেও পাওয়া যায়। তাঁরা যে একই নামের ভিন্ন ভিন্ন ঋষি তার কোন প্রমাণই নেই। ঋত শব্দটি ১ম মণ্ডলেই আছে। ঋত কে প্রজ্ঞা প্রদান করার জন্য আহবান করা হচ্ছে (ঋত ঘোষা)। নবম মণ্ডলের সঙ্গে সামবেদের ও ১০ম মণ্ডলের সঙ্গে অথর্ব বেদের সম্বন্ধ স্পষ্ট বোঝা যায়। গৃৎসমদ, ঋষি অঙ্গিরা বংশোদ্ভব, শুনহোত্রের ছেলে। ইন্দ্র একসময়ে তাকে অসুরদের হাত থেকে রক্ষা করেন, তিনি ভৃগু বংশীয় শুনফের আশ্রয় গ্রহণ করেন, তাই নাম হয় তার শৌনক। ভৃগু বংশীয় যজমানের কথা ১ম মণ্ডলেও দৃষ্ট হয় (সূক্ত, ১৪৩/৪)। পরবর্তী পৌরাণিক যুগের মত কাহিনী ঋগ্বেদেও আছে। উদাহরণ স্বরূপ দীর্ঘতমা ঋষির গল্প, এ গল্পটি বলেছেন সায়ন। পণ্ডিতেরা বলেন যে ওরকম গল্প ঋগ্বেদে নেই, অথচ পরবর্তী ১৫২ সূক্তে ঐ গল্প সম্বন্ধীয় মমতার কথা আছে। গল্প, পল্লবিত হয়ে পরে বেড়ে যেতে পারে, কিন্তু প্রচলিত কোন কথা যে ছিল না, তা এ সব ইউরোপীয় যুক্তিতে প্রমাণ হয় না। অসুর শব্দটির মানে ছিল পূর্বে ভাল, ১০ম মণ্ডলে ভিন্ন ভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত। পণ্ডিত রমেশ চন্দ্র দত্ত দেখিয়েছেন, অসুর= বলবান শক্ত (১০ম অষ্টক ৫৪/৪), অসুরত্ব= ক্ষমতা (৯৯/২, (১৩২/৪) অসুর= মিত্র, তারপর ১৩৮/৩ থেকে অসুর= দেবশত্রু। পৌরাণিক যুগে অসুরের এই শেষ অর্থটি গৃহীত হয়েছে। একই শব্দের ভিন্ন ভিন্ন অর্থ ও তার বিভিন্ন প্রয়োগ দেখেই ঐ পণ্ডিতেরা ঠিক করে বসলেন যে ১০ম মণ্ডল আধুনিক। ১০ম মণ্ডলে ৫০ সূক্তে অসুর= দেবশত্রু বোঝালেও ৫৫, ৫৬, ৭৪ থেকে ১২৪ পর্যন্ত ভাল অর্থেই ব্যবহৃত। কখনো তার অর্থ সূর্য, কখনো দেবতা সম্বন্ধে, কখনো ইন্দ্র, কখনো মিত্র ইত্যাদি। ১ম মণ্ডলে অসুর নানা অর্থে ব্যবহৃত- রুদ্র, ইন্দ্র, স্বর্গ ইত্যাদি, ২য় মণ্ডলে বৃকদ্বর= অসুর। এই রকম নানা অর্থ ছেড়ে দিয়ে একটি মাত্র অর্থ গৃহীত হয়- এটি অসম্ভব কেন? পুরুষ সূক্ত (নারায়ণ ঋষি, ১০ম মণ্ডল ৯০) কেও ঐসব পণ্ডিতেরা আধুনিক বলেন। তাদের যুক্তির সার কথা, (১) অপরাপর ঋকের মত ভাষার কাঠিন্য নেই, (২) জাতিভেদ প্রথাটি সমর্থন করার জন্যই ব্রাহ্মণাদি চার বর্ণের কথা, এই অংশটিতে পরে যোগ করা হয়েছে, কারণ ঋগ্বেদ এর যুগে জাতি ভেদও ছিল না, পৌরহিত্য প্রথাও ছিল না। Murr সাহেব বলেন যে পুরুষকে বিশ্ব প্রভু বলা হয়েছে, অথচ তাকে ধরে বলি দেওয়ার কথা বলতে ঋষিরা লজ্জা বোধ করেন নি, এই Profanity বোধ (হীনতা বোধ) ও তাদের মাথায় আসেনি। এটা ঠিক ইউরোপীয় সংস্কৃতির সংস্কারের কথা, বিদেশী বিজাতীর কথা। যা হোক, এ সম্বন্ধে বক্তব্য, (১) পরিষ্কৃত (সংস্কৃত) ভাষা গঠনের কথা ১০ম/৭১সূক্ত/২ এ পাই; ঐ ১০/৩/১ এ দেখি যে যজ্ঞের মাধ্যমে ভাষার পথ লাভ করা যায় বলা হয়েছে (বাক্স্তুতি); এই সূক্তটিকে কিন্তু আধুনিক বলা হয়নি। ভাষা নবভাবে পুনর্গঠনের সময় সহজ হয়, ভাষা সজীব থাকলেই এটা হয়। অল্প দিনের মধ্যে বর্তমান কালে বিদ্যাসাগরী ভাষার চল প্রায় নেই। (২) জাতিভেদ তখন না থাকতে পারে, কিন্তু ভেদ নয় জাতি বিভাগের নামকরণ ও কি দোষের? নামকরণ দেখেই তাকে আধুনিক আখ্যা দেওয়া যায় কি ? ১০ম/৭১/৯ এ, ‘ন ব্রাহ্মণাসঃ সুতে করাণঃ’ মূলের ঐ ব্রাহ্মণ শব্দটির মানে কি বেদবিদ বা স্তোত্ৰ বিশারদ নয়? সকল পণ্ডিত মণ্ডলীর গৃহীত এই অর্থ পুরুষ সূক্তে থাকায় দোষ কোথায়? ‘ব্রাহ্মণোহস্য মুখমাসীৎ’ তার মুখই ছিল ব্রাহ্মণ, এখানে বংশগত ব্রাহ্মণের কথা আসে কোথা থেকে? অগ্নিমীড়ে পুরোহিতং, ঋগ্বেদের প্রথমেই আছে, এখানে পুরোহিত কি অর্থে প্রযুক্ত? পুরুষ-সূক্তে যেমন- চন্দ্র, সূৰ্য্য, ব্যোম আদি যা কিছু সমস্তই পুরুষ থেকে জাত, তেমনি ব্রাহ্মণ আদি বিভাগ সবই ঐ পুরুষ থেকে উৎপন্ন- ঐ সব বিভাগের মূলে পুরুষ, এই বলা হয়েছে। এ রকম বর্ণনা, মাত্র পুরুষের বিভিন্ন অংশের নামকরণ নয় কি ? যারা যুদ্ধ কাজে, দেশ রক্ষা প্রভৃতিতে লিপ্ত থাকেন তাদের বলা হল ক্ষত্রিয় ইত্যাদি। জাতি থাকলে কাজের বিভাগ বা শ্রেণী ও থাকে, নামকরণ ও আবশ্যক মত দরকার হয়। ১০ম মণ্ডলের ৯ সূক্তে ঋক্, সাম, ও যজু’র কথা আছে, এটিও বলা হয় পরে রচিত, এটাই ইউরোপীয়দের মত তাই। ১৬ সূক্তে বলা হয়েছে যে পুরুষ যজ্ঞই আদি যজ্ঞ, যজ্ঞদ্বারাই যজ্ঞ- এটাই প্রথম ধর্ম। ব্রাহ্মণ আদি যদি পুরুষের দেহজাতই হন, তাতে কি বোঝায় না যে ত্যাগরূপ যজ্ঞেই সমস্ত অনুষ্ঠানের বীজ বৰ্তমান? ভারতীয় আর্যের বোঝবার দিকই ছিল স্বতন্ত্র, এটা যেন আমরা না ভুলি। ভারতে আগে সত্য উপলব্ধি, তারপর সেই সত্য ঋষিমুখ নিঃসৃত। বেদবিভাগ বহু পরে হলেও, পৃথক পৃথক নামে বিভক্ত হলেও, ঋকের যে অংশ গীত হত তাকে সাম নামে অভিহিত করা হত গোড়া থেকেই ইত্যাদি- এটা ভুলে যাই কেন?

ঐতিহ্যের উদ্দেশ্য, জীবন ও নানাপ্রকার প্রসঙ্গ দিয়ে উপলব্ধ সত্যকে বিস্তার করা। বেদতত্ত্ব অনাদি, সুতরাং তাকে নানাভাবে বোঝাবার চেষ্টায় সময়ের অগ্রপশ্চাৎ বিচাৰ্য নয়- আৰ্য্যের এই ভাব; এটা আগে, ওটা পরে, তাতে কি এসে যায়? তাছাড়া, ঘটনা ও রচনা-কাল যে একই সময়ে হবে তার মানে কি ? ‘মোক্ষমূলার সাহেব ঋগ্বেদ (Vide Sacred Books of the East Vol. Lxxxll Part 1, ১০ম ম-১২১।অ, ৮, অ, ৭ বর্গ ৩/৪) তুলে যে মন্তব্য প্রকাশ করেছেন তার মর্ম এই যে, ঐ সূক্তে যখন একেশ্বরবাদ বা অদ্বৈতের কথা রয়েছে, তখন ওটি পরে নিশ্চয়ই রচিত, কারণ প্রথমে বহু ঈশ্বরবাদের বা দেবতার কল্পনা আসে, পরে আসে একেশ্বরবাদ- এটি সব যায়গায় ইতিহাস প্রমাণ করে। বেশ কথা, কিন্তু ভারত সম্বন্ধে তার প্রমাণ আছে কি? অন্যান্য দেশের ইতিহাসে যা ঘটেছে, ভারতেও তা হতেই হবে তার মানে কি? তার প্রমাণ কোথায়? জগতের সর্ব প্রাচীন গ্রন্থ ঋগ্বেদেও কি তা আছে? পূর্বে বলেছি যে একরার দলাদলির আভাষ মাত্র পেয়েই, আর্য মনীষিরা তা একেবারে দাবিয়ে দেন- এ দৃষ্টান্ত ও ইতিহাসে প্রথম। কেন তাঁরা দাবিয়ে দিতে পেরেছিলেন? যাই হোক, মোক্ষমূলার সাহেব স্বীকার করেন যে, ঐ সব মন্ত্রগুলো পরে রচিত হলেও আধুনিক নয়- ঐগুলো ব্রাহ্মণ গ্রন্থের, এমন কি মন্ত্র যুগের পূর্বে রচিত হয়। আর্য সংস্কৃতির প্রতি সহানুভূতি থাকলেও, অদ্বৈত বেদান্তের উপর শ্রদ্ধা থাকলেও, মনীষি মোক্ষমূলার অনেক গোল করেছেন, সময়ে সময়ে ইউরোপীয় প্রণালী ইউরোপের দিক দিয়ে ভারতীয় গবেষণা খাটাতে গিয়ে, ভাষা তত্ত্বের দিক দিয়ে ইতিহাসের বিচার করতে গিয়ে।

উচ্চভাব ঋগ্বেদের সর্বত্রই ছড়িয়ে আছে। ১০মণ্ডল ১৩০/৪/৫ ঋকে ছন্দের উৎপত্তি বর্ণিত আছে, অগ্নি থেকে গায়ত্রী, দেব সবিতা থেকে উষ্ণিক, সোম থেকে অনুষ্টুপ, সূর্য থেকে উকথ, বৃহস্পতির বাক থেকে বৃহতী, মিত্রাবরুণ থেকে বিরাট, সর্বদেব (বিশ্বান্দেবা) থেকে জগতী। একেও আধুনিক বলা হয়েছে, কারণ অত প্রাচীন যুগে, প্রাচ্য মতে, ৮টি ছন্দ ও উচ্চ ভাবার্থক দেবতার কল্পনা অসম্ভব, কারণ, ভারতেতর দেশে এটা অসম্ভব। মার্জিত বা পরিষ্কৃত (সংস্কৃত) ভাষার কথা পূর্বে বলা হয়েছে। ১ম মণ্ডল ১৪১/১ঋক্ বলেন যে ভর্গদেবের সাক্ষাৎকারের জন্যই (দর্শতং দেবস্য ভর্গ) বলিষ্ঠ (বলিখা) শরীর দরকার, ভর্গ তেজ দ্বারাই জ্ঞান সিদ্ধ হয়, এই হেতু অগ্নির উপাসনা দরকার। ২য় ঋকে অন্ন ও শরীরে নিত্য অগ্নি বর্তমান বলা হয়েছে, তিনি ‘সপ্তশিবাসু মাতৃষু’ -সপ্তমাতৃকাতে ও আছেন আর রয়েছেন ‘বৃষভস্য দোহসে’ -বৃষভের দোহনার্থে, ৩য় ঋকে বলা হয়েছে যে মহাযজ্ঞ থেকে হয় অগ্নির উৎপত্তি। উৎকৃষ্ট অন্নের জন্যই অগ্নির প্রণয়ন (৪র্থ ঋক) ইত্যাদি। দিকাদি মাতৃস্থানীয় (৫ম ঋক্)। ৩য় মণ্ডল ৫/১১ ঋকে বৈশ্বানরকে বৃষরূপী বলা হয়েছে। অগ্নিকে বৃষভ ও ধেনু উভয় স্বরূপই বলা হয়েছে। ‘অসচ্চ সচ্চ পরমে ব্যোম দক্ষস অগ্নির্হ নঃ প্রথমজা ঋতস্য পূর্ব্ব আযুনি বৃষভশ্চ ধেনু’ (৭ অ/১০ম/৫সূ)- ‘অগ্নি সৎ অসৎ উভয়ই, -আকাশে সূর্য রূপে প্রকাশমান ঋতের প্রথম রূপ, যজ্ঞের পূর্ববর্তী, বৃষভ ও ধেনু উভয়ই। ২য় মণ্ডল ২৪/২৫/২৬ সূক্তে ‘ব্রহ্মণস্পতি’ দেবতার ও উল্লেখ দেখি, তিনি সর্বতোব্যাপ্ত, সর্বকামী, তিনি সত্যরূপ জ্যা বিশিষ্ট, তিনি সবল ও দুর্বলের রক্ষা কর্তা ইত্যাদি। ব্রহ্মণ্যস্পতি থেকে ব্রহ্মণ্যদেব ও তার উপাসক ব্রাহ্মণের কল্পনা কি অসম্ভব ? ব্রহ্মণ্যষ্পতি, জ্যা বিশিষ্ট ও বাণক্ষেপী -এই উপমাটিও লক্ষ্য করবার বিষয়।

[২য় মণ্ডল ১৬/৫/৬/৭ ঋকে বৃষ শব্দের বারবার ব্যবহার আছে- ইন্দ্রই বৃষ, বজ্রই বৃষ, যজ্ঞের সবই বৃষ ইত্যাদি]।

ঋগ্বেদ আদিতে দেখি প্রথম ক্ষাত্রশক্তি, তারপর ক্ষাত্রশক্তি থেকে পৃথক ব্রহ্মণ্য শক্তির কল্পনা। এটা আমরা পাই জীবন দেখে ও অন্যান্য নানা দিক দেখে। বৈদিক যুগে ঋষি যোদ্ধাও দেখি আবার যুদ্ধ পারদর্শিনী ঋষি পত্নিও দেখি। সমাজ স্থিতির জন্যই প্রধানতঃ গুণকর্ম অনুযায়ী বর্ণ বিভাগ হয়। যখন বংশের বৈশিষ্ট্য বংশের শিক্ষা বা করার চেষ্টা হল, তখন বর্ণকে বংশগত করার ইচ্ছা হওয়াটা স্বাভাবিক। কিন্তু সে সময়েও গুণ কর্মের আদর বর্তমান। বৈদিক যুগের প্রথম অবস্থায় গুণকর্ম অনুসারে নামকরণ পর্যন্ত ছিল না। গুণ ও কর্ম কে নির্দেশ করার জন্যই পরে হয় নামকরণ। পুরুষ যজ্ঞে আমরা ঐ নামকরণটি দেখতে পাই (যখন ঋষি পুরুষ যজ্ঞে দর্শন করলেন, অর্জুনের বিশ্বরূপ দর্শনের ন্যায়)। এই নামকরণে ছোট বড় ভাব নেই, কারণ দেহের প্রতি অঙ্গই স্ব স্ব ক্ষেত্রে প্রধান। সমাজের আদর্শ ব্রাহ্মণত্ব পুরুষের মুখ। দেখা যায়, বংশের বিশেষ ধারা বজায় রাখার জন্য বংশ হিসাবে বর্ণনার সূত্রপাত আরণ্যক যুগে, বংশ অনুসারে নাম থাকলেও গুণগত কর্মের প্রাধান্য ছিল। বোঝা যায় যে, এই সময়ে জন শক্তির উদয় ও সমাজ শক্তির অভ্যুদয় হয়।

[মানুষের মতো দেবতারা ও চারবর্ণে বিভক্ত, দেবতাদের মধ্যে অগ্নি, বৃহস্পতি প্রভৃতি ব্রাহ্মণ (অগ্নে মহান অসি ব্রাহ্মণ ভারত- তৈং ব্রাং ৩/৫/৩, ব্রহ্ম বৈ দেবানাং বৃহস্পতি-তৈং সং ২/২/৯/১), ইন্দ্র বরুণ সোম প্রভৃতি ক্ষত্রিয় (তচ্ছ্রেয়োরূপমত্যসৃজং ক্ষত্রং যান্যোতানি দেবতা ক্ষত্রাণীন্দ্রোবরূণঃ সোমোরুদ্রঃ পর্জ্জন্যো যমো মৃত্যুরীশানঃ) বসু রুদ্র, অদিত্য, বিশ্বদেব ও মরুৎ প্রভৃতি বৈশ্য (সবিশসৃজত যান্যেতানি দেবজ্যতানি গণশ আখ্যায়ন্তে, বসবো রুদ্রা আদিত্যা বিশ্বদেব মরুতঃ), পূষা, প্রভূশি শূদ্র (সশৌদ্রং বর্ণমসৃজত পুষণমিতি- শতপথ ১৪/৪/২/২৩/৫) (ঐতরেয় ব্রাহ্মণ ১ম পঞ্চিকা দ্রঃ– রামেন্দ্র সুন্দর ত্রিবেদী)। মরুতেরা দেব গণের বৈশ্য, অদিতি ও গায়ত্রী ক্ষত্রিয় (ঐ দ্রঃ)! দেখা যায় যিনি একসময়ে ক্ষত্রিয়, অন্য সময়ে তিনিই আবার বৈশ্য। বৈদিক অনুষ্ঠান, যজ্ঞেই প্রতিষ্ঠিত। যজ্ঞই ব্রহ্ম। অগ্নিই যজ্ঞের মুখ, সুতরাং অগ্নি ব্রাহ্মণ। বৈদিক দেবতা ৩৩- অষ্টবসু, একাদশ রুদ্র, দ্বাদশ আদিত্য, প্রজাপতি ও বষট্কার। এই ৩৩ জন সোমপায়ী দেবতা। অসোমপায়ী দেবতা ৩৩- একাদশ প্রজাজ, ১১ অনুযাগ, ১১ উপযাজ। এ ছাড়া প্রাণীদেরকে দেবী বলা হয়েছে। দেবিকা ও আছেন। (পণ্ডিত রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী অনূদিত ঐতরেয় ব্রাহ্মণ দ্রঃ)। ঐতরেয় ব্রাহ্মণ সঙ্গে এই গ্রন্থে যে যে স্থানে প্রসঙ্গ আছে, অধিকাংশ স্থানে প্রায় সর্বস্থানে- ঐ কৃত অনুবাদ, পাদটীকা ও পরিশিষ্ট হতে উদ্ভূত হয়েছে]।

ইউরোপীয়দের অধ্যবসায় অদ্ভুত। তাঁদের অনুসন্ধানে অনেক নতুন আলো এই ঘুমন্ত ও আলস্য জাতির চোখে পড়েছে, তার জন্য সকলেই কৃতজ্ঞ, কিন্তু ইউরোপীয় মত খুব সাবধানে নিতে হয়। ঋগ্বেদ ৭ম, ২/৯ সূক্তে (একা চেতৎ আসমূদ্রাৎ), বলা হয়েছে যে সরস্বতী নদী পৰ্বত থেকে উৎপন্ন হয়ে সমুদ্রে পড়েছে, কিন্তু অধ্যাপক ম্যাক্ডোনাল্ (Professor Macdonell) সমুদ্র মানে করেছেন ‘Collection of waters’- জমা জল! বিদুষী রোগোজিন (Rogozin) করেছেন সিন্ধু নদের পঞ্চ শাখার সম্মিলিত জল। অথচ সরস্বতী সিন্ধু নদে পড়েনি! তখন রাজপুতানা সমুদ্রের অংশ ছিল, আরব সাগরের বাহু সেখানে প্রবেশ করেছিল ও সরস্বতী সেখানেই মিশেছিল। পুণার পণ্ডিত কেটকার (Mr, v. B. Ketkar) জ্যোতিষের সাহায্যে গণনা করে দেখিয়েছেন যে পুরাণ বর্ণিত রাজপুতানা সাগর ও গাঙ্গ সাগর (Gangetre Sea), যা দক্ষিণ ভারত বা জম্বুদ্বীপকে পৃথক করেছিল, খৃঃ পূঃ ৭৫০০ বৎসরের পরে বিলুপ্ত হয়। তা হলে, সরস্বতী ঐ সময়ের বহু বহু পূর্ব থেকে সমুদ্রে পড়ত। সরস্বতী এখন রাজপুতনা মরুভূমির মধ্যে বিলুপ্ত। Macdonell সাহেব বলেন যে মৎস্য শব্দটি মাত্র একরার ঋগ্বেদে ব্যবহৃত হয়েছে, অতএব তিনি ঠিক করে ফেললেন যে সমুদ্র মানে জমা জল। তা যদি হয়, ঋগ্বেদে ‘চতুঃসমুদ্রের’ কথা আসে কোথা থেকে? না হয় মৎস্য কথাটি একবার আছে। সিন্ধুনদ বিষয়ক কথা ও অনেকরার, চার বারের বেশী বলা হয়েছে। সকল সিন্ধুগণ সমুদ্রে প্রবিষ্ট হয়েছে, স্পষ্ট আছে (ঋগ্বেদ ৮/৯২ ও ৩/৩৬/৭ দ্রঃ)। সরস্বতী হচ্ছে আর্যদের দেবকৃত যোনী এবং সরস্বতী ও দৃশ্যদ্বতীর মধ্যস্থিত ভূভাগ দেবনির্মিত দেশ। (vide Rgvedic India-A. c. Das-2nd. Edition)। এ রকম ইউরোপীয় পণ্ডিতেরা এক একটি শব্দের স্বকপোল কল্পিত অর্থ করে বিষম গোল বাধিয়েছেন। ঐ সব শব্দের অর্থ আর্যেরা যে ভাবে গ্রহণ ও প্রয়োগ করেছেন, ঐ পণ্ডিতেরা সে ভাবে গ্রহণ করেননি সব সময়ে। তাঁরা করেছেন অর্থ (যেমন- আর্য, অনার্য, সুর ও অসুর, যবন, ম্লেচ্ছ ইত্যাদি) রক্তের দিক দিয়ে, ভারতে করা হয়েছে সংস্কৃতির দিক দিয়ে।

[আর্য ও ঋষি শব্দদ্বয়ের নানা অর্থের জন্য মৎপ্রনীত ভারত ধারা ২য় খণ্ড বিবিধ প্রসঙ্গ দ্রঃ)। সুখের বিষয় যে দেশী পণ্ডিতেরা যথাসম্ভব ভারতীয় দৃষ্টিতে অনুসন্ধান করছেন। যবন, ম্লেচ্ছ শব্দদ্বয় বর্তমানে যে অর্থে গৃহীত, আগেকার দিনে তেমন অর্থ ছিল না।]

মহাভারতের যুগেও কালযবন নাম পাওয়া যায়। তিনি ও ছিলেন হিন্দু দেব উপাসক। যবনাচার্যের নাম জ্যেতিষ শাস্ত্রেও আছে। যবন সিদ্ধান্ত, জাত স্কন্ধ বিষয়ক তাজিক নামে পরিচিত গ্রন্থাদি ও আছে। রোমক সিদ্ধান্ত থেকে জানা যায় যে ব্রহ্মার কাছে সূর্য শিক্ষা পান, আর ঐ গ্রন্থ কর্তা যবন, সূর্যের নিকট হতে যা উপদেশ পান তার নামই তাজিক। সদ্ধায়ন-রত্ন বই থেকে তাজিকে’র কথা জানা যায় একটি শ্লোক আছে তার অর্থ যে, জ্যোতিষ শাস্ত্রে সম্যক জ্ঞান লাভ হলে যবন বা ম্লেচ্ছও ঋষিতুল্য হন। ঐ শব্দগুলো Heathen এর মত ঘৃণাবাচক নয়। সেই রকম হিন্দু শব্দটি অভারতীয়েরা যেভাবেই প্রথম ব্যবহার করুন, এই জাতির গৃহীত অর্থ, ভারতীয় আর্যের মানস বংশধর, একই কৃষ্টির অন্তর্গত, একই সংস্কৃতির ধারা প্রবাহের মধ্যে যারা বাস করেন। ইউরোপীয় পণ্ডিতেরা এক রকম জোর করেই আর একটি মত চালিয়েছেন যার কোন প্রমাণ পাওয়া যায় না, যেটি তাদের অনুমান মাত্র। সে মতটি আর্যেরা ভারতে আগমনের কথা। স্বামীজি ও এ বিষয়ে বলেছেন। ঐ সব পণ্ডিতদের মতে, ভারতের বাহির থেকে আর্য জাতির একটি বড় দল প্রথম ভারতে আসেন, বিভিন্ন জাতির ভাষাগত সাদৃশ্য তার প্রমাণ ইত্যাদি। এটা তাদের মনে হয় না যে, যখন বৈদিক সভ্যতার উদয় হয়েছিল, তখন অন্য স্থানে অনেক জাতির জন্মই হয়নি। কেন মনে হয় না যে ভারতীয় সভ্যতার প্রসারের সঙ্গেই, বিভিন্ন জাতির সংস্পর্শে আসায়, সেই সব জাতি ভাষা জ্ঞান ও আর্যের কাছ থেকে পেয়েছেন ? এখনও যে প্রায় সমস্ত দক্ষিণ এশিয়ার ও চিন ছাড়া সমস্ত পূর্ব এশিয়ার ভাষা গঠন প্রণালী সংস্কৃতানুরূপ ? ইউরোপের বোঝবার দিক্ই অন্যরকম, সেজন্য তারা গোলযোগে পড়েন, যেমন মৎস্য কথাটির একবার প্রয়োগ দেখেই ঠিক করলেন সমুদ্র মানে সাগর নয়। এ রকম ভ্রম হওয়া তার স্বাভাবিক, কারণ অন্যান্য জাতির ইতিহাস প্রমাণ করে যে নদী বা সমুদ্র উপকূল বাসীরা মৎস্য প্রিয় হয়, কিন্তু আর্যেরা ছিলেন মাংস প্রিয়, মৎস্য প্রিয় মোটেই নয়, আজও উত্তর পশ্চিমাঞ্চলের জাতিগুলোর সেই রুচি প্রিয়তা বর্তমান। এটাও আশ্চর্য যে ভারত অসংখ্য সম্প্রদায় অবাধেই গড়তে দিয়েছেন, কিন্তু সাম্প্রদায়িকতার প্রশ্রয় দেয়নি ও কখনো অপরের ধর্ম বিশ্বাসকে চুর্ণ করার জন্য যুদ্ধাভিযান করেনি।

[(তে হ সুরাঃ হেলয়ো হেলয় ইতি কুর্ব্বন্তঃ পরাবুভুস্তমাদ্ ব্রাহ্মণেন ন ম্লেচ্ছিত বৈ ম্লেচ্ছিত বৈ নাপ ভাষিত বৈ ম্লেচ্ছো হবা এষ যদপশব্দঃ)]।

ঋগ্বেদ ১/২৪/১৪ মন্ত্রে ‘হেলঃ’ শব্দ দেখা যায়। ‘হে অবয়’ স্থানে ভূল করে বলেছিল ‘হে অলয়ঃ (হেলয়ঃ); র স্থানে ল এবং স্বরপ্লুত হে পদটির সন্ধি করেছিল, যেটি ব্যাকরণে অসিদ্ধ, সুতরাং যে ওরকম উচ্চারণ ভঙ্গী করে, সে ম্লেচ্ছ শব্দের উচ্চারণ করে (মহাভাষ্য দ্রঃ)। ‘হেলঃ শব্দের অর্থ সায়ন ক্রোধ করেছেন। ….প্রথম যখন আর্যেরা আফগানিস্তান কাশ্মীর এবং পশ্চিম তুর্কিস্থানে একত্রে বাস করতেন তখন অসুর শব্দের অর্থ ছিল বলশালী, দেব শব্দের অর্থ দ্যুতিমান এবং হেল শব্দের অর্থ ছিল তেজঃ”। বিবাদের পর অর্থ বদলে যায়। ‘১/২৫/২ মন্ত্রে সায়ন জিহীলান শব্দের ধাতু অনাদারাৰ্থক হেল করেছেন। …বৈদিক শব্দানুশাসন বিধিতে দেখা যায়, সেই সুরেরা হেলি (হেলয়) হেলি বলতে বলতে পলায়ন করেন। কিন্তু মন্ত্র সকলের মধ্য থেকে এরকম ইতিহাসে আবিষ্কারের দ্বারা বেদের অনাদিত্ব অসিদ্ধ হয় না এবং পূর্বোক্ত মত সকল অধিকতর আধুনিক পাশ্চাত্য পণ্ডিতদেরও সম্মত নয়। ভারতবর্ষেও এমন প্রশ্ন এক সময়ে উঠেছিল। জৈমিনী তাঁর পূর্বমীমাংসা সূত্রে (১/২/৩৯) এই পূর্ব পক্ষ তুলেছেন যে কীকট জনপদ, নৈচশাখা নগর, প্রমংগদ রাজা, ববর প্রবাহিনী প্রভৃতি অনিত্য দেশ ও লোকের নাম যদি বেদে দেখা যায়, তাহলে বুঝতে হবে বেদ তার পরে লেখা। তাতে তিনি উত্তর দেন, ববর আদি যে অনিত্য শব্দ বেদে দেখা যায় তা শব্দ সামান্য মাত্র। সেখানে অনিত্য ববরাখ্য কোনও পুরুষ বিবক্ষিত হয় না। ববর একটি শব্দের অনুকরণ মাত্র। ববর অর্থে ভরভর শব্দকারী বাযুকেই বলা হচ্ছে। সেই ববর বায়ুই প্রবাহনি অর্থাৎ প্রকৃষ্টরূপে বহনশীল। এই ভাবে সকল নাম ও দেশের অর্থ করে নিতে হবে। (সায়নকৃত ঋগ্বেদ উপপদ্ঘাত ভাষ্য)।’ (উদ্বোধন, অগ্রহায়ন-৩৬বর্ষ ১১শ সংখ্যা দ্রঃ)। ভাষাতত্ত্বের দিক দিয়ে বিচার কখনো নির্ভুল হয় না। ভাষা গৃহীত হয়, ভাষা ঘাড়ে চাপানো যেতে পারে, জেতার জেদে পুরাতন ভাষা লোপ পেয়ে নতুন ভাষা দেশীয় ভাষা বলে অনুমিত হতে পারে- ইউরোপীয় মনীষিরা এটাও দেখিয়েছেন।

আর্যপ্রভা-ব্রহ্মবিজ্ঞানে বিভিন্ন দৃষ্টি কোণ


ব্রহ্মবিজ্ঞানে বিভিন্ন দৃষ্টি কোণ

আমরা গুরু তত্ত্বের ও অন্যান্য দর্শনের মূলতত্ত্ব বোঝার চেষ্টা করেছি। পুরাণ ব্রহ্ম-বিজ্ঞান বুঝিয়েছেন গল্প গাঁথার মধ্যে দিয়ে। বেদকে সকলেই প্রামাণ্য বলে স্বীকার করেছেন।

ঈশ্বরবাদ নিয়ে জগতের সকল ধর্মের আরম্ভ। এ সম্বন্ধে প্রধানতঃ কয়েকটি মত দেখা যায়। এই জগৎ বর্তমান, সুতরাং এর একজন স্রষ্টা নিশ্চয়ই আছেন, আর জগতে যখন বহুত্ব রয়েছে, আর যখন তার কাজ দেখা যাচ্ছে, তখন ঐ বহুত্বের মধ্যে একটা অশরীরী কিছু আছেই। এ ভাবটি আদিম ভাব। ভারতীয় দর্শন আরম্ভ হয়েছে এই ভাবের অধিকতর বিকাশের অবস্থা থেকে। ভারতে প্রধানতঃ তিনটি বাদ দেখা যায়- দ্বৈতবাদ, বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ ও অদ্বৈতবাদ, অন্যান্য যত বাদ ঐ তিনটির মধ্যে একটিতে পড়ে। সব দর্শন সৃষ্টি রহস্য ভেদ করার চেষ্টা পেয়েছেন, সৃষ্টি উপাদান অন্বেষণে চিন্তা রাজ্যের উচ্চ থেকে উচ্চতম ভূমিতে গিয়ে স্তব্ধ হয়েছেন। ঋগ্বেদে প্রশ্ন ও উত্তর এ আমরা দেখেছি শূন্য হতে সৃষ্টি হতে পারে না।

ব্রহ্ম দ্বৈতাদ্বৈতবিবর্জ্জিতম্- দুই বা এক হীন। এক জ্ঞান থাকলে দুই জ্ঞান থাকে। যেখানে জ্ঞান বোধ আছে, সেখানে অজ্ঞান বোধ ও আছে। জ্ঞান অজ্ঞান বোধ হীন যা তাই ব্রহ্ম জ্ঞানাতীত, জ্ঞান অজ্ঞান বিবর্জিত, বাক্য মনের অতীত। দ্বৈতাদ্বৈতবিবর্জ্জিতমের কোন সাধনা বা উপাসনা হয় না। আমিই সেই -এই পর্যন্তই সাধনা। অস্তিনাস্তিহীন, সর্বহীন, সর্ববিরতি, অনুচ্ছিষ্ট যা, তার সাধন হয় না। ব্রহ্ম অপরিণামী-পরিণাম হয় না। পরিণাম অর্থাৎ অবস্থান্তর প্রাপ্তি যদি বোঝা যায়, সেটি বোধাতীত হয় না। বুদ্ধি দিয়ে বুঝতে গিয়ে তাকে একং বলা হয়; তার জোড়া আর এক থাকলে সেটি সসীম হয়ে যায়। অতএব ‘একং’ মানে অসীম, অনন্ত। বেদ বা অদ্বৈতকে এই বোধ ভাবের ভেতর দিয়ে বোঝার যে চেষ্টা তাই হচ্ছে ভারতীয় দর্শন।

দেশ, কাল, নিমিত্ত- এই তিন নিয়ে জগৎ। জগৎরূপী একই অবয়বের দুটি বিভাগ করা হয়-বর্হিজগৎ ও অন্তর্জগৎ। ঐ তিনের সমষ্টির নাম মায়া- নামরূপ। ব্রহ্ম, মায়া, জগৎ- একটির পর একটি, বুদ্ধির স্তর হিসাবে উচ্চনীচ। তাহলে, যখন ব্রহ্ম আছেন, তখন মায়া বা জগৎ নেই- জগন্মিথ্যা। ব্রহ্মানুভূতিতে অন্য কিছুরই স্থান নেই। আবার, জগতের দিক দিয়ে দেখলে মায়াকে সত্য বলতে হয়। মায়া বাস্তব ঘটনার বিবৃতি মাত্র, কিন্তু সন্দেহ ও থেকে যায়। যার পরিণাম, অবস্থান্তর প্রাপ্তি বা মৃত্যু নেই, তার নামই সত্য, মায়াকে অথচ মিথ্যাও বলা যায় না -সমস্ত ইন্দ্রিয় গ্রাহ্যের বোধ এর সভ্যতা বুঝিয়ে দেয়। বোধ, প্রকাশক সৎ বা অস্তি কে অপরিণামী বলে বুঝতে পারার নামই চিৎ- সৎ ও চিৎ এখানে অভিন্ন। কিন্তু মায়া কে সৎ বা অসৎ কিছুই বলা যায় না, অর্থাৎ যখন মায়া সৎ রূপে প্রতিভাত হন, তখন তিনি চিন্ময় বা চিন্ময়ী, অসৎরূপে প্রতিভাত হলে জড়- দ্বিত্ব, বহুত্ব। এই যে আসল রূপ যা দুরকমে দেখা যায়, সেটি অনির্বচনীয়- সম্বিৎ বা প্রজ্ঞা। ফল পড়ল বলা যায় তখন, যখন ফল, স্থানাদি আছে, কেন ও কি জিজ্ঞাসা করা যায় যখন কার্য কারণ সম্বন্ধ থাকে। ব্রহ্মে কার্য কারণ সম্বন্ধ নেই- প্রশ্নই হয় না। অতএব, ব্রহ্ম দৃষ্টিতে জগন্মিথ্যা। যতক্ষণ মায়া বোধটি আছে, ততক্ষণ সবই আছে, যখন থাকবেনা, তখন থাকবে না- নিজেকে নিজে ডিঙ্গাতে পারা যায় না। অখণ্ড খণ্ড হন নি, খণ্ডভাবে প্রতিভাত হচ্ছেন। জগতের দিক দিয়ে বুঝতে গেলে মনে হয়, সবেরই পরিণতি আছে- বাস্তব সত্য। দেশ, কাল, নিমিত্তের বোধ, আমার বোধের উপর নির্ভর করে- আমিই দেশকাল নিমিত্ত দেখি। নিত্য বস্তু কারোর অপেক্ষা রাখে না- নিরপেক্ষ। অথচ দেশ কাল নিমিত্ত কে স্বতন্ত্র ভাবে বোঝাও যায় না। এই হেঁয়ালির মত যে বোধ, তার নাম মায়া। ব্রহ্ম, অজ্ঞেয় বলা হয়- জানা যায় না। সাধারণতঃ আমরা যাকে অজ্ঞানাবস্থা বা মূর্চ্ছাবস্থা বলি, সেই অবস্থায় কোন জিনিষ জানা যায় না, এটি সে রকম নয়। যা জানলে সব জানা হয়, সেটি নিশ্চয় জ্ঞানস্বরূপ- জানার ও অধিক। অহং বোধ না থাকলে কোন বোধ হয় না- আমি টা্ সর্ব নিকটতম ও প্রিয়তম বস্তু- সদা বর্তমান, সুতরাং, সমষ্টি অহং (পাকা আমি) সর্ব প্রকাশক ও সর্ব প্রকার জ্ঞানই তার অংশ। অংশ দেখে সমষ্টি জ্ঞান হয় না, তাই সেটি অজ্ঞেয়।

ঋগ্বেদে, ‘অপ্রকেতং সলিলং গূঢ় তমসাবৃতং’- গূঢ় তমসাবৃত অজ্ঞান সমুদ্রের কথা আছে। ঐ অজ্ঞান সমুদ্র বা মোহ অন্ধকার দ্বারা পরমাত্মা আবৃত। এই আবরণ বা আচ্ছাদন পূর্ব পূর্ব সৃষ্টির সংস্কারের জন্য। তার পর, “সর্ব্বাতীবাপঃ মতো অর্ণঃ সুপ্রকেতং সলিলং” -সর্বব্যাপ্ত অখণ্ড জ্যোতির্ময় সমুদ্র- জ্ঞান বা অমৃত সাগর- পরমাত্মার জ্যোতি; সেই ব্ৰহ্ম জ্যোতিতেই সব জ্যোতিষ্মান।

[-“ন তত্র সূর্য্যো ভাতি ন চ চন্দ্র তারকম্। কে মা বিদ্যুতো ভান্তি কুতোহয়মগ্নিঃ তমেব ভান্তি অনুভাতি সর্ব্বম্। তস্য ভাসা সর্ব্বমিদং বিভাতি”। (কঠ ২য় ২/১৫)]।

ঋগ্বেদের ১০/৮১/১ সূক্তে আছে যে বিরাট পুরুষ নিজ স্বরূপ আবৃত করে বিশ্বে অনুপ্রবিষ্ট হলেন। মায়া শব্দটি ঋগ্বেদে বিভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত, কোন স্থানে মায়া- পালনীশক্তি, কোন স্থানে ইন্দ্রজাল বা ছলনা ইত্যাদি। মায়াবাদ শ্রীশঙ্করের নয়, তিনি যুক্তিসঙ্গত একটি ব্যাখ্যা দিয়েছেন মাত্র। মায়া, অবিদ্যা অর্থেও ব্যবহৃত হয়। মায়াধীন অবস্থায় থেকে মায়াতীত অবস্থার- উপলব্ধি হয় কখন?

মায়া মিথ্যা বা অবাস্তব নয়। দুটি শব্দ ব্যবহৃত হয়- অধ্যাস ও বিবর্ত্ত। অধ্যাস হচ্ছে পূর্বে দেখা জিনিষের যে স্মৃতি, তার অনুরূপ অবভাস, যেমন ঝিনুকে রূপার ভ্ৰম, রজ্জুতে সর্পভ্রম। ঐ সব স্থানে রূপা বা সর্প বোধের আরোপ হয়েছে, ভ্ৰমটি ইন্দ্রিয় দোষ। ভ্ৰমটি হয়, সব দিক না দেখে, না বুঝে। আবার, পূর্ব কল্পিত ভ্রমকে আশ্রয় করে ও অবিদ্যা বা অজ্ঞান উপজাত হয়। বিবর্ত্ত মানে বস্তুর অবস্থান্তর প্রাপ্তি না হলেও অন্যরূপ দেখা, বিকার মানে অবস্থান্তর প্রাপ্ত হওয়া ও সেই অবস্থান্তরে অন্যরকম জ্ঞান হওয়া। ভ্রম বলে একটি নতুন জিনিষ দেখা দেয়। ভ্রমটি আসল জিনিষের আবরক। সেটি দূর হলে আসল রূপটি প্রকাশ পায়। কার্য কারণ সম্বন্ধহীন ব্ৰহ্ম, বিশ্বের কারণ হতে পারে না, জগৎ সুতরাং ব্রহ্মের বিবৰ্ত্ত, ব্রহ্মের পরিণাম নয়। মায়াই বিশ্বের মূল কারণ। মায়া মিথ্যা বা অস্তিত্বহীন নয়, কারণ অস্তিত্বহীনে অধ্যাস হয় না। এইজন্য শ্রীশংকর একটি ব্যবহারিক সত্তা মেনেছেন, কিন্তু এটাও ঠিক যে জ্ঞানোদয়ে মায়া থাকেনা। এই হল অদ্বৈতবাদীদের কথা। পূর্বে বলেছি যে সব রকম মনস্তত্ত্ব বেদে পাওয়া যায়। একই বেদান্তের- একই ব্ৰহ্মসূত্রের- উপর ভিত্তি করে নানা মত উঠেছে। আচার্য শংকর যেমন অদ্বৈতবাদের শ্রেষ্ঠ প্রচারক, বিশিষ্টাদ্বৈতের তেমনি শ্রীরামানুচার্য্য। বিশিষ্টাদ্বৈত = অদ্বৈতের বিশেষ অর্থাৎ গুণ। এই মতে সৃষ্টি ব্রহ্মের গুণ বা শক্তি। চিৎ বা গুণ প্রতি জীবে বর্তমান, জড় মানে অচিৎ। অবিদ্যা সৃষ্টির কারণ হতে পারে না- অজ্ঞানে সৃষ্টি সম্ভব নয়। গুণ গুলি সত্য ও নিত্য, কিন্তু সর্বাবস্থাতে ঈশ্বর অধীন। ব্রহ্ম চিন্ময় (জ্ঞানময়), তিনিই জ্ঞাত, আর এই বহুত্ব, তার গুণফল। কর্ম প্রভাবে গুণের প্রভাব বা সংকোচ হয়। ব্রহ্ম সত্য ও অবিকারী, আর যা কিছু সমস্ত অসত্য বা পরিণামী। বিকাশ ও সংকোচ ব্যাপারের নাম পরিণাম, বিবর্ত্ত নয়। ব্রহ্মের দুই অবস্থা প্রলয়ে তিনি সৎ-অস্তিমাত্র, জগৎ তাঁর মধ্যে সুপ্ত। ‘স ঐক্ষৎ বহু স্যাং প্রজায়েয ইতি’,-এই শ্রুতি বাক্যে বোঝা যায় তা দ্বিতীয় অবস্থা বা সৃষ্টিসংকল্প। এটাই তাঁর অন্তঃপ্রবেশ। সমভাবে ও নিরপেক্ষভাবে সকলকে কর্মফল দান করাই সৃষ্টির উদ্দেশ্য, সৃষ্টি তাঁর ‘লোকবৎ লীলা কৈবল্যং’- তাঁর স্বভাব নয় (যেমন শংকর বলেন)। ব্ৰহ্মই একমাত্র সৃষ্টি উপাদান ও নিমিত্ত কারণ- মায়া বা অবিদ্যা নয়। সূক্ষ্মাবস্থায় কাৰ্য কারণের একীভাব থাকে, পরে পরিণাম দেখা দেয়। বিচারে সত্য নিৰ্ণয় হয় না। আজ যা যুক্তিতে সত্য বলে বোধ হয়, কাল তা খণ্ডিত হয়। অতএব, বিচারের উপরেও একটি জিনিষ আছে- শ্রীভগবানের প্রত্যাদেশ- প্রকট বাণী। এটাই সত্য নিরূপণের একমাত্র উপায়। অপর ব্রহ্ম বা কার্য ব্ৰহ্ম = মায়া, রামানুজ বলেন যে ব্রহ্মকে এরকম ছোট বড় ভাবে বিভাগ করা অন্যায়। ভাব পরিবর্তন নেই, আছে গুণ গুলির। শ্রীশংকর মতে, বৃহদারণ্যকের ‘নেতি নেতি’ = গুণ গুলির নিঃশেষ, শ্রীরামানুজ মতে, ব্রহ্ম অজ্ঞেয়, তাই ‘ন ইতি ন ইতি’ তিনি ‘সত্যস্য সত্যং’। প্রাণই সত্য, জীবাত্মাই সত্য, কিন্তু পরমাত্মা ‘সত্যস্য সত্যং’-অপরিণামী। অবিদ্যা কখন চিন্ময়ের উপর ক্রিয়া করতে পারে না, ‘সদসৎ অনির্ব্বনীয়’ মানে, কিছু বিশেষ বোঝা যায় না যা অজ্ঞান, কর্মজাত। রামানুজ মায়াবাদ স্বীকার করেন না। মুক্তির একটি বিমুক্ত পথ প্ৰপত্তি বা ঈশ্বরে সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ- সর্বপ্রকার বিদ্যা বা সাধনা এর অন্তর্গত। ভগবদ্ অনুগ্রহ বিনা মুক্তি হয় না। দৃঢ়বিশ্বাস ও কৃপা ভিন্ন জীবের অসহায় অবস্থা দূর হয় না। প্রপত্তি’ই জীবকে কর্ম প্রভাব থেকে রক্ষা করে, কর্ম প্রভাবকে বিনষ্ট করে। প্ৰপত্তি ভক্তির ও উর্দ্ধে। শ্রীরামানুজের বহু বহু পূৰ্ব থেকে- যীশু জন্মাবার পূর্বে থেকে, এই রকম ঈশ্বরে পূর্ণ নির্ভরতা সম্পন্ন মহাজনদের আবির্ভাব হয়েছিল দাক্ষিণাত্যে- রামানুজের দেশে। এরা আলওয়ার নামে পরিচিত। তাঁরা সংস্কৃত জানতেন না। তামিল ভাষায় তাঁদের রচনা আজও দাক্ষিণাত্যের অনেক মন্দিরে পঠিত হয়, বিশিষ্টাদ্বৈতবাদীদের কাছে তাদের রচনা প্রিয়। আলওয়াবদের মধ্যে সর্বজাতিই আছেন- শূদ্র, এমন কি পারিয়া ও বাদ পড়েনি। সংস্কৃতজ্ঞ না হয়েও তাঁরা উপনিষদের সগুণ ব্ৰহ্মবাদ বেশ বুঝতেন। জনসাধারণের মধ্যে অধ্যাত্মবিজ্ঞান প্রচারের ব্যবস্থা তখন ছিল নানা উপায়ে। শ্রীশংকর ব্রাহ্মণের উপর ঝুঁকেছেন, কিন্তু শ্রীরামানুজের হৃদয় অন্ত্যজদের জন্য ও ব্যথিত হয়েছে।

বিশিষ্টাদ্বৈত মতে, জড়ের তিন রকম পরিণতি আছে, (১) শুদ্ধ সত্ত্ব- অপবিত্রতা এখানে নেই, এটা তাঁর নিত্যবিভূতি (নিত্যলীলাভূমি); (২) মিশ্রসত্ত্ব- পবিত্রতা, অপরিচ্ছন্নতা ও তমসার স্থান- এই জগতের (লীলাবিভূতি), (৩) গুণশূন্য অবস্থা- কাল, দেশ আকাশের অন্তর্গত। জীব বহু অবস্থার মধ্য দিয়ে গিয়ে মুক্ত হয় বা শ্রীভগবানের সাক্ষাৎকার লাভ করে। বিশিষ্টাদ্বৈতবাদী, সাংখ্যের বহু পুরুষবাদ মানেন না। রামানুজ সম্প্রদায় আজ ও ভারতের ধর্ম জগতে প্রভাব বিস্তার করছেন। গৌড়ীয় বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের মূল ঐ রামানুজ সম্প্রদায়।

এবার আমরা ঐ সব বিভিন্ন মতের তুলনা সংক্ষেপে বোঝবার চেষ্টা করতে পারি। সকলেই ‘পূর্ণং’ এর বিভিন্ন দিক দেখিয়েছেন। যিনি যে দিক্ দেখেছেন তিনি সেই দিকটির উপর জোর দিয়েছেন। সাংখ্যমতে প্রকৃতি হতে পরমাণু পর্যন্ত সমস্তই জড়। পুরুষের অবিবেক মূল গুণ সঙ্গের নাম হেয় আর সম্যক্ বিবেক প্রাপ্ত বা গুণ সঙ্গ বর্জিত অবস্থার নাম হান বা মুক্তি। সুতরাং অবিবেক = হেয় হেতু, আর বিবেক = হানোপায়।


[‘শক্তিতশ্চেতি। তদ্ধানে প্রকৃতি পুরুষো বা। তয়োরন্যত্বে তুচ্ছত্বম। -সাংখ্যপ্রবচনসূত্র (সাংখ্যদর্শন) -১ম ১৩২/১৩৩/১৩৪ সূত্র]।

অর্থাৎ পরিমিত শক্তি বিশিষ্ট বস্তু অপর শক্তির ঘাত প্রতিঘাত ও মিলন হতে উদ্ভব হয় বা নষ্ট হয়। মহদাদি ও পরিমিত শক্তি সম্পন্ন, সুতরাং তাও অপর শক্তির কার্য। মহদাদি রূপে তখনই প্রকাশ থাকে না যখন প্রকৃতি অথবা পুরুষতা প্রাপ্তি হয়, বিশেষ শক্তিমত্তার অভাবে। প্রকৃতি ও পুরুষ ছাড়া আর যা কিছু সবই তুচ্ছ- তুচ্ছ, জগৎ কারণ হতে পারে না। (তুচ্ছ = নগণ্য, অল্প শক্তি)। অতএব প্রকৃতিই মূল শক্তি, কিন্তু হেয় হেতু বা জড়। যখন পুরুষতা প্রাপ্তি হয়, তখন প্রকৃতি কোথায় এ বিষয়ে সাংখ্য নীরব। ঐ দুই প্রাপ্তি অব্যক্ত, অথচ দুটি পৃথক (পুরুষ ও প্রকৃতি)। পুরুষ প্রকৃতির সংযোগে সৃষ্টি। বিশিষ্টা দ্বৈতবাদীদের মতে, সবটা নিয়ে ব্রহ্ম অর্থাৎ ঈশ্বর+আত্মা+জগৎ= ব্রহ্ম। এরা উপনিষদের সগুণ ব্রহ্মের উপাসক। অদ্বৈতবাদীদের মতে, জগৎ ব্রহ্মের বিকার নয়- ব্রহ্মের বিবৰ্ত্ত। তন্ত্রের সঙ্গে কোন মতের বিরোধ নেই, কিন্তু তন্ত্র আর এক দিক দেখেছেন। এখানে স্মরণ রাখতে হবে যে তন্ত্রশাস্ত্র, সাধনশাস্ত্র। সাংখ্য ২৫টি তত্ত্ব স্বীকার করেছেন, তন্ত্র করেছেন ৩৬টি তত্ত্ব। দ্বৈতাদ্বৈতবিবর্জ্জিত সৰ্বপ্ৰকার বাদের অতীত। বাদ কথা, সিদ্ধান্ত ও প্রকাশের জন্য। তন্ত্রে সদাশিব, শিব, পরশিব প্রভৃতি শব্দগুলি কখন বিভিন্ন অর্থে, কখন বা একই অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে, কখন বা শিবকে সগুণ ও পরশিবকে নির্গুণ, কখন বা শিব = নির্গুণ পরশিব বলা হয়েছে। ব্যবহার ও প্রয়োগ অনুসারে অর্থ বুঝতে হয়। শক্তি নিঃশেষ রূপে গুটিয়ে পরশিবে অবস্থিতি করেন। এই অবস্থান জন্য পুনঃসৃষ্টি– পুনঃপ্রকাশ সম্ভব হয়। নিষ্ক্রিয়ত্ব অর্থাৎ শক্তিহীনত্ব বা শূন্য সৃষ্টির কারণ হয় না। নিষ্ক্রিয়ত্ব যাকে শূন্য বলা হয়, সেই শূন্যের মধ্যে শক্তির অবস্থান হেতু, শূন্যতা দূর হয়ে উচ্ছন্নতা অর্থাৎ প্রসার বা স্ফীতি আনায়। তারপর আরম্ভ হয় লম্ফঝম্প আবৰ্ত্ত উচ্ছ্বাস, কম্পনের ফলে। সূক্ষ্ম বা স্থূলরূপে প্রকাশের কারণ তিনটি- ইচ্ছা, জ্ঞান, ক্রিয়া। ইচ্ছা ভিন্ন প্রকাশ হয় না- কার্যের ইচ্ছা থাকা চাই, কার্যের উপাদান বিষয়ে প্রত্যক্ষ জ্ঞান থাকা চাই, নতুবা শৃঙ্খলা আসে না, আর শৃঙ্খলার অভাব বা বিচ্যুতি মানে ধ্বংসমুখ- সৃষ্টির বিপরীত। তার পর আসে ক্রিয়া। শক্তি যদি জ্ঞানময়ী না হন, ঐ জ্ঞান আসে কোথা হতে? সাংখ্য বলেন, চিৎ সান্নিধ্যে ঐ চেতনা উপজাত হয়। চেতনা থাকলে যে সমাবেশ কৌশল থাকবে তা প্রমাণ হয় না, তা ছাড়া প্রত্যেকের স্বাতন্ত্র্য বোধ ও অণু পরমাণুর আকর্ষণ বোধ (যেমন Positive ও Negative হয়), বিজাতীয়কে দূরে রাখার বোধ ইত্যাদি সংস্কারের কাৰ্য হয় কেমন করে? অতএব তন্ত্র বলেন, ব্রহ্ম ও শক্তি অভিন্ন সম্বন্ধে সম্বন্ধ যুক্ত- অগ্নি ও দাহিকা শক্তির ন্যায়। জগৎ ও ব্রহ্মে আত্যন্তিক ভেদ নেই। জগৎ মিথ্যা নয়, মিথ্যা-জগৎ ও ব্রহ্মে ভেদ কল্পনা। জগৎ ব্রহ্মের বিবৰ্ত্ত নয়, একেরই বহুরূপে প্রকাশ, একই বহু হয়েছেন। শক্তিই জগতের কারণ, শক্তির পরা অবস্থাই ব্ৰহ্ম। অতএব, শক্তির মধ্যে বিপরীত ভাবে একসঙ্গে সমাবেশ সম্ভব হয়েছে। তন্ত্র মতে শূন্য কোন তত্ত্বের অন্তর্গত নয় তত্ত্বাতীত। বহু হব এই ইচ্ছাই ১ম তত্ত্ব- শিবতত্ত্ব। তত্ত্বের উদয় সিসৃক্ষার পর হয়। সিসৃক্ষা বা ইচ্ছাশক্তির নাম শক্তিতত্ত্ব- ২য় তত্ত্ব, তৃতীয় তত্ত্বে বিশ্ব অহংরূপে স্ফুটিত হয়- সদাশিবতত্ত্ব, জগতের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত পৃথকীকৃত ইদং বোধ- ৪র্থ তত্ত্ব-ঈশ্বরতত্ত্ব; আমিই জগৎ- অহন্তা ও ইদন্তার ঐক্যবোধ বা সদাশিবের বৃত্তি- ৫ম তত্ত্ব-বিদ্যাতত্ত্ব; অহং হতে ইদং পৃথক, ঈশ্বরের এই বৃত্তি- ষষ্ঠ তত্ত্ব-মায়াতত্ত্ব; বিদ্যার আবরণ কারিণী ও বিরোধিনী শক্তি- ৭ম তত্ত্ব-অবিদ্যাতত্ত্ব। এই পর্যন্ত এখানে বলা যথেষ্ট। বিভিন্ন মতে ঐ বিভাগ সম্বন্ধে একটু আধটু এদিক্ ওদিক্ আছে। যাই হোক, তন্ত্র ঐ সমস্ত তত্ত্বগুলিকে শক্তিরূপিণী বলেছেন, বিদ্যা, মায়া ও অবিদ্যা-এই তিনটিকে পৃথক করে দেখিয়েছেন। অদ্বৈতবাদীর মতে দৃশ্য জগৎ, প্রতীতি মাত্র (apparent)। বিভিন্ন সাধন পথ নিয়ে ভারতে সমাজ-বিপ্লব ও ব্যাপক রক্তপাত না হলেও সাম্প্রদায়িকতার গোঁড়ামির অভাব হয়নি। সেই জন্য নতুন যুগ-তন্ত্র বলেন যে, প্রত্যেক সাধনার বিভিন্ন অবস্থা, সেই সেই অবস্থানুযায়ী সত্য- ভ্রম নয়। স্বামীজি একস্থানে বলেছেন যে, যদি সূর্যের ফটো-একরার দশ মাইল উপরে গিয়ে, পরে পরে এইভাবে লক্ষ মাইল ও আরও উর্দ্ধে উঠে-নেওয়া হয়, প্রত্যেক ফটোই হবে একই সূর্যের ফটো, কিন্তু কত বিভিন্ন। আমরা ভ্রম হতে সত্যে যাই না, অল্প সত্য হতে অধিকতর সত্যে যাই। তন্ত্রমতে, সর্বজ্ঞই অল্পজ্ঞ হন- ‘জ্ঞ’ নিত্য বর্তমান। তাই অল্পজ্ঞ সদা উন্মুখ, ‘জ্ঞ’য়ে ফিরে যাবার জন্য, তাই ‘শিবোহহং’ জ্ঞানে সাধকের সাধনা সার্থক হয়।

তন্ত্র শক্তিকে মা বলেছেন। তাই সাধক যাই অর্চনা করেন, তিনি মায়ের পূজাই করেন, তাই যে কোন বস্তু অবলম্বন করেই হোক না কেন, ব্রহ্মেরই অর্চনা করা হয়, ফল আসক্তের পূজাও ব্রহ্মেরই অর্চনা। (মহানির্বাণতন্ত্র ১০ম উ২১০/২১১)। এটাই প্রতীকোপাসনা- জড়ের পূজা নয়, পৌত্তলিকতা বা ইউরোপীয় Animism ও নয়, এই রকম অর্চনা কল্পিত বস্তুতে আরোপ ও নয়- এ হচ্ছে যেন ন্যায় শাস্ত্রে প্রতিজ্ঞা ও নিগমন। এই রকম সিদ্ধান্তে অনেক অধিকরণ সিদ্ধান্ত (corrolary) ও উদিত হতে পারে।

[ন্যায়দর্শন বলেন যে সিদ্ধান্তে আসতে গেলে ৫টি জিনিষ দরকার- প্রতিজ্ঞ, হেতু, উদাহরণ, উপনয় ও নিগমন, যথা (১) প্রতিজ্ঞা- ঐ পর্বতে বহ্নি আছে, (এটা প্রমাণ করতে হবে)। (২) হেতু-ধোঁয়া দেখা যাচ্ছে। (৩) উদাহরণ যেখানে ধোয়া থাকে, সেখানে বহ্নি থাকে (যেমন রান্নাঘর)। (৪) উপনয়-পর্বত ও ধূমবান। (৫) নিগমন-অতএব, ঐ পর্বতে বহ্নি আছে।
এখানে প্রতিজ্ঞা ও নিগমন এক, মাত্র অতএব যোগ করা হয়েছে। ইহা সাধ্য ধর্ম ভাবী দৃষ্টান্ত। অন্য প্রকার দৃষ্টান্ত দ্বারাও (১) ও (৫) সমান। যন্ সাধন তন্ সিদ্ধি। সিদ্ধ বস্তুই সাধনা দ্বারা উপলব্ধি করতে হয়।]

সাংখ্য মতে প্রকৃতি জড় কিন্তু উপমা দিয়েছেন ধেনু ও বৎসের মত প্রকৃতির সঙ্গে অসংখ্য পুরুষের সম্পর্কে। তন্ত্রে শক্তি জগন্মাতা- বহুর সম্পর্কে, কিন্তু তিনি শিব সঙ্গিনী, মহাকাল রমণী। সাংখ্যে পুরুষ ও প্রকৃতি’র সম্বন্ধ এইভাবে বর্ণিত, প্রকৃতিকে দর্শন বা ভোগ করবার জন্য পুরুষ আর পুরুষের মুক্তি সাধনের জন্য পুরুষ প্রকৃতির সংযোগ হয়, এই সংযোগ পঙ্গু ও অন্ধের সহকারিতার ন্যায় (সাংখ্যকারিকা ২১)। অন্যত্র প্রকৃতিকে গুণবতী, নিঃস্বার্থ বলা হয়েছে, আবার বলা হয়েছে যে প্রকৃতির মত লজ্জাশীলা আর নেই। (ঐ-৬০-৬১)। প্রকৃতিকে সর্বপ্রকারে দেখার (ভোগ করার) পর, পুরুষ প্রকৃতি হতে উপরত হন, তখন প্রকৃতিও আর নিজের কাৰ্য্য দেখান না (ঐ ৬৬)। সাংখ্যের প্রকৃতি’র নিজের ইচ্ছা নেই- জড়; তন্ত্রে দেবীও ব্রহ্মের ইচ্ছামাত্র অবলম্বন করে সৃষ্টি করেন (“তস্যেচ্ছামাত্ৰমালম্ব…” মহানিৰ্বাণ তন্ত্র, ৩য়, ২৯), প্রভেদ এই যে, দরকার হলে, বল পূর্বক বিপরীত বিহারে তিনি মহাকালের চেতনা সম্পাদন করেন। প্রয়োজনটিও দেবীর নয়- প্রয়োজন কারূণ্য প্রকাশ। সংখ্যাচাৰ্য্যের সাংখ্যশাস্ত্রের আর একটি নাম দেন-“ষষ্টি তন্ত্র” অর্থাৎ ৬০ টি বিষয় প্রতিপাদন করা হয়েছে। শংকর মতকে যে হিসাবে প্রচ্ছন্ন বৌদ্ধবাদ বলা যায়, সাংখ্যকেও সেই হিসাবে প্রচ্ছন্ন তন্ত্রবাদও বলা যেতে পারে। সাংখ্য ও তন্ত্রের এই দিক থেকে যদি হিন্দু সমাজকে দেখা যায়, বিরাট হিন্দুসমাজ যে মহামায়ার ছায়া এটা বুঝা যায়।

[স্বামীজি জীববাদ বা দ্বৈতবাদ সম্বন্ধে যা বলেছেন, তা যথাসম্ভব সংক্ষেপে বলব (Sankhya and Vedanta নামে বক্তৃতার-Mayvati Editon-পৃঃ ৫৯-৬৬ এবং ৯৪-১০০ দ্রঃ)]।

দ্বৈতবাদীর মতে, জগৎ ও জীব-এই উভয়ের একমাত্র প্রভু ঈশ্বর। ঈশ্বর সর্বত্র বর্তমান, সর্ব্বজ্ঞ, বিশ্বের একমাত্র নিয়ন্তা। সৃষ্টি অনাদি, সুতরাং জীব ও অনাদি। জীব স্বভাবতই পবিত্র, কিন্তু কর্মফলের আবরণে সেই পবিত্রতা ঢাকা পড়েছে। পুণ্য কর্ম দ্বারা ঐ স্বাভাবিক পবিত্রতা জীব লাভ করতে পারে। প্রাণ ও আকাশ সর্বত্র বর্তমান সর্বভূতে অনুপ্রবিষ্ট। খণ্ড খণ্ড রূপে আকাশেই সমগ্র বিশ্ব ভাসছে। প্রাণই আকাশ কে বহুরূপে পরিবর্তন করছে। স্থূল ভাবে, প্রাণের অভিব্যক্তির জন্য আকাশ হতে গঠিত হয়েছে এই স্থূল রূপী যন্ত্র বা শরীর। চলা, বসা, কথা কওয়া ইত্যাদি প্রাণেরই অভিব্যক্তি। চিন্তা রূপে প্রাণের অভিব্যক্তির জন্য সূক্ষ্ম শরীর আকাশে সূক্ষ্ম হতে নির্মিত। স্থূল দেহ, তারপর সূক্ষ্ম দেহ, তারপর জীব। জীব’ই আসল মানুষ। স্থূল দেহ স্বল্পকাল স্থায়ী, সূক্ষ্ম দেহ যুগ যুগ স্থায়ী, জীব অতি সূক্ষ্ম। দ্বৈতবেদান্তমতে, জীব ও ঈশ্বর নিত্যকাল স্থায়ী; প্রকৃতিও তাই, কিন্তু পরিবর্তনশীল। প্রকৃতির মূল বস্তু প্রাণ ও আকাশ অনন্তকাল স্থায়ী; কিন্তু অনন্তকাল যাবৎ বিভিন্ন আকারে পরিবর্তন হচ্ছে। জীব, প্রাণ বা আকাশ হতে উদ্ভূত হয় নি, জীব মিশ্র পদার্থ নয়, অজড়, সুতরাং জীবের জন্ম বা মৃত্যু নেই, স্থূল বা সূক্ষ্ম দেহ মিশ্র পদার্থ, তাই তাদের উৎপত্তি ও ধ্বংস আছে। সমগ্র প্রকৃতিতে অসংখ্য অসংখ্যরূপে ঈশ্বরাধীনে এই জীব বর্তমান। জীব সৃষ্ট পদার্থ নয়। কর্ম দ্বারা পবিত্রতা লাভ করলে, জীব দেবযানে যায়। বাক্য ভিন্ন চিন্তা সম্ভব নয়, তাই তখন বাক্ মনে প্রবিষ্ট হয়, মন প্রাণে পরিণত হয়, প্রাণ হয় জীবে। জীব তখন দেহ হতে বেরিয়ে সূর্যলোকে যায়। এই বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন লোক আছে। সূর্যলোক হতে জীব যায় বিদ্যুৎলোকে; সেখানে আর একটি জীব-যিনি পূর্ণত্ব লাভ করেছেন-ঐ জীব কে স্বর্গের উচ্চতম ভূমি ব্রহ্মলোকে নিয়ে যান। ব্রহ্মলোকে জন্মমৃত্যু নেই, আছেন সেখানে বিশ্ব প্রভু শ্রীভগবান। সেখানে জীব সৃজনী-শক্তি ছাড়া, আর সব শক্তি লাভ করেন। তখন যদি জীব, শরীর ধারণ করে বিশ্বে কোন এক স্থানে আসতে চান, আসতে পারেন। দ্বৈতবাদীদের মতে, এই অবস্থাই মানুষের চরম অবস্থা; ঈশ্বরের সঙ্গে নিজেকে অভিন্ন ভাবা-‘সোহহং বা ‘শিবোহহং’ ভাবা-মহা অপরাধ। জীব কখনও ঈশ্বরত্ব লাভ করতে পারে না। ঐ চরম অবস্থা প্রাপ্ত জীব অপেক্ষা নিম্ন স্তরের জীব আছেন। এরা সর্ব বাসনা ত্যাগ করেছেন, সম্পূর্ণ নিঃস্বার্থ, সম্পূর্ণ পবিত্র, এরা শ্রীভগবানের পূজা ও তার ভালবাসা ছাড়া আর কিছুই চান না। তার পরের থাকে আছেন ফলকামী ভক্ত জীব। মৃত্যুর পর এদের আর একরকম গতি হয়। বাক্ মনে প্রবেশ করে, মন যায় প্রাণে, প্রাণ যায় জীবে, জীব যায় চন্দ্রলোকে, সেখানে কর্ম জনিত ভোগ ক্ষয়ে আবার নিজ নিজ সংস্কার অনুযায়ী নরলোকে জন্ম গ্রহণ করে। এই চন্দ্রলোকের জীবেরাই দেবতা নামে আখ্যাত, এরাই খৃষ্টান ও মুসলমানদের angel বা স্বর্গদূত। ঐ দেবতা এক একটি পদ (আসন), বৈদিক দেবতা ইন্দ্রাদির নামে ঐ পদগুলির নাম দেওয়া হয়। স্বর্গে মাঝে মাঝে অসুরের উৎপাৎ হয়। এই উপদ্রব ছাড়া জীবে সেখানে সুখেই থাকেন। মানব দেহেরই কর্ম ও কর্ম ফল আছে। দেব শরীরে কর্মের ফলভোগ হয় মাত্র, নতুন কর্ম হয় না। দেব শরীরে, ফলাকাঙ্ক্ষীর ফলভোগ ছাড়া আর কিছুই হয় না। এই সব দেবতা অপেক্ষা অসুরেরা অনেক বিষয়ে ভাল দেবতারা প্রায় কামুক।

[স্বামীজী বলছেন, “In all mythologies you read how these demons and gods fought although many times, it seems, the demons did not do so many wicked things as the gods In all mythologies, for instance, you will find the Devas fond of women” পুরাণাদি পাঠে জানা যায় যে অসুরেরা থাকত পাহাড়ে, মরু প্রান্তরে বা সমুদ্রে (সমুদ্রের ধারে)। ঐ সমস্ত স্থানই অনুর্বরা। অসুরেরা হোত বোম্বেটে, লুট পাট করাই ছিল তাদের কাজ। তারা ছিল সুস্থ, বলবান-দেবতাদের চেয়ে শারীরিক বলে বলীয়ান। দেবতাদের ছিল বুদ্ধি বেশী। অসুরদের সঙ্গে যুদ্ধে দেবতাদের পরাজয় ঘটত, কিন্তু শেষে বুদ্ধিবলে অসুরেরা বিতাড়িত হত। অসুরেরা সকলকে নিজ মতে আনবার চেষ্টা করত, বিপরীত মত তারা সহ্য করতে পারত না। তারা ও ছিল ব্রহ্মা, শিব আদির উপাসক আর্য্যের মত, তবে তারা ছিল ঐশ্বর্য্যকাঙ্ক্ষী। পররাজ্য লুণ্ঠনে তারাই হত অনেক সময়ে অগ্রগামী। অনেক আর্য বংশীয় সন্তানেরা ও অসুরবৃত্তি অবলম্বন করে হোত অসুর। অসুরদের মধ্যেও তপস্যা পরায়ণ ভক্ত ও উচ্চ সাধক জন্মেছেন, ভারতের বা আর্য্য-সংস্কৃতির বাইরে বা কেউই ছিলেন না। অসুরেরা ছিল মাত্র উৎকট ফলকাঙ্ক্ষী, দুর্দ্ধর্ষ ও বীর]।

পতন হলে দেবতারা মেঘ বৃষ্টির মধ্য দিয়ে বীজ বা বৃক্ষে প্রবিষ্ট হন, তখন মানুষ বা অন্য প্রাণীর দ্বারা ভুক্ত হয়ে মর্ত্তে জন্মান। পূর্ব সুকৃতি ও সুসংস্কার দ্বারা পুণ্য অর্জন করে কর্মক্ষয়ান্তে ব্রহ্মলোকে তার গতি হয়। এইভাবে সৃষ্টি প্রবাহ চলেছে-স্ব স্ব কর্মফল সবাই ভোগ করে, ঈশ্বর তার জন্য দায়ী নন।

দ্বৈত মতের সঙ্গে সাংখ্যের কোথায় কোথায় মিল আছে লক্ষ্য করলেই আমরা বুঝতে পারব। গীতাতে ও এই মতের প্রসঙ্গ আছে। উহার আলোচনা নিষ্প্রয়োজন। সৃষ্টি উপাদান তিনটি-সত্ত্ব, রজঃ ও তম। এই গুলি উপাদান (Elements), কার্য দেখে আমরা এঁদেরকে গুণ বলি। তম হচ্ছে আকর্ষণ, যাতে জমাট বাঁধায়, রজ হচ্ছে বিকর্ষণ বা প্রতিক্ষেপ, যাতে নতুন নতুন জিনিষের উৎপত্তি হয়, অপ্রয়োজনীয়কে বের করে দেয়, ঐ তম ও রজঃ শক্তি দ্বয়ের মাত্রা ঠিক রাখে যা তার নাম সত্ত্বশক্তি (গুণ), সত্ত্ব শক্তিতে সাম্য আনায়। তাই বহুর চাঞ্চল্য হতে উর্দ্ধে যেতে হলে চাই সত্ত্ব গুণের বিকাশ। এই তত্ত্বটি সবাই স্বীকার করেছেন; জীব যে স্বভাবতঃই পবিত্র, এটাও দ্বৈতবাদীরা স্বীকার করেন। প্রত্যেক সাধনক্রম লক্ষ্য স্থানে পৌছবার এক একটি ধাপ; প্রত্যেক ভাবই স্ব স্ব ক্ষেত্রে বড়। বড় ছোট বলা দরকার হয় জল্প কথায়, তুলনামূলক সমালোচনায় সাধন সময়ে নয়। প্রত্যেকের কাছে তার নিজস্ব, ভাব-স্ব ইষ্ট শ্রেষ্ঠ সাধন ক্ষেত্রে। এই ইষ্টবাদ ভারতের ঘোর দ্বৈতবাদীরাও স্বীকার করেন, অর্থাৎ স্বীকার করেন একং সৎ বিপ্রাঃ বহুধা বদন্তি। পারমার্থিক ও ব্যবহারিক দিক বলা হয়; কিন্তু ব্যবহার কোনটি ? পরমার্থেরই প্রয়োগ, এটা আমরা ভুলে যাই।

সব জিনিষের নিজ সত্ত্বা (Thing in itself) অজ্ঞাত ও অজ্ঞেয়। জলে ঢিল্ পড়ল, তরঙ্গ ঢিলের দিকে গেল। তরঙ্গ ঢিলের ন্যায় একরারেই নয় সম্পূর্ণ বিভিন্ন। এই তরঙ্গ ব্যাপারটি অজ্ঞেয়। তোমাকে আমি দেখছি। তুমি সত্ত্বা হিসাবে অজ্ঞাত ও অজ্ঞেয়- ক। ক আমার মনে এসে আঘাত করলে, যে দিক হতে আঘাতটি এল মন সেই দিকে তরঙ্গ ছোটালো। তখন তরঙ্গটির নাম হল অমুক মহাশয়। বোধের দুটি দিক্ রয়েছে, একটি বাইরের, অপরটি আসছে ভিতর হতে, আর দুটির সংযোগ ফল হচ্ছে ক+ মন= বহির্জগৎ। ক্রিয়া থাকলেই প্রতিক্রিয়া থাকবে। সব জ্ঞানই প্রতিক্রিয়ার দ্বারাই উপজাত হয়। আমি সত্ত্বা ও সেই রকম অজ্ঞাত ও অজ্ঞেয়-খ। যখন আমি নিজেকে অমুক লোক বা অমুক নামে বুঝি, তখন খ+মন = অন্তর্জগৎ। অতএব ক+খ =বহির্জগৎ+অন্তর্জগৎ = সমগ্র বিশ্ব অর্থাৎ, দেশ, কাল ও নিমিত্তের জন্যই এই বোধটি হচ্ছে। দেশ, কাল, নিমিত্ত এই তিন তুলে নাও দেখবে মনও নেই, সুতরাং ক ও খ কে, মনই বহির্জগৎ ও অন্তর্জগৎ রূপে দেখাচ্ছে। ক ও খ মনের অতীত সত্ত্বা বলেই অভেদ ও এক, ঐ সত্ত্বা মন হতে জাত হয় নি। গুণ মনজাত, অতএব ক ও খ এই দুয়ে কোন গুণ আরোপ করা যায় না একই আছেন। নামরূপ বা দেশ-কাল-নিমিত্ত হতেই বুদ্ধি (মহৎ), মনও আর সব। একই বহু হয়েছেন, “তমেব ভান্তি, অনুভাতি সর্বং” সর্বং টিও সেই।।

[শ্রীরামকৃষ্ণের একটি উদাহরণঃ- রাম, সীতা ও লক্ষণ। সীতা মাঝখানে। সীতা না সরলে, লক্ষণ রাম কে দেখতে পান না। সীতা কিন্তু ইচ্ছা মাত্রেই লক্ষণকে দেখতে পান আর রামের দিকে তিনি ত চেয়েই আছেন। ব্রহ্ম, মায়া, জগৎ। যার শুধু জগৎ বোধ, মায়াকে সে আবরণ দেখতে বাধ্য। যে জগৎ ও মায়ার অভেদত্ব দেখে বা যার একাত্মবোধ হয়, তার ব্রহ্ম দৃষ্টি খুলে যায়।]

আর্যপ্রভা-অধ্যাত্ম বিজ্ঞানে সৃষ্টিতত্ত্ব


অধ্যাত্ম বিজ্ঞানে সৃষ্টিতত্ত্ব
কত উগ্র তপস্যার কৃচ্ছ্র, কত কঠোর সাধনার ক্লেশ সহন করে আর্য ভারত মৌলিকতা অর্জন করেছেন। মনে পড়ে সেই সৰ্ব্বংসহা জনকদুহিতার কথা, ভারত মাতার কথা। ভারত আজ সর্ব-জাতির জননী।

আধুনিক বিজ্ঞান সৃষ্টি রহস্য সম্বন্ধে যে সব নব নব তত্ত্ব আবিষ্কার করেছেন ও করছেন, সে সমস্তই অদ্বৈত বেদান্তের প্রতিধ্বনি। ভারতে অধ্যাত্ম বিজ্ঞান ও বস্তু বিজ্ঞান আজ মুখামুখি। গ্রীক মনক্রম পরিস্ফুটিত হয়ে আজ যে অপরূপ রূপে সামনে এসে দাঁড়িয়েছে ও যার প্রভাবে আজ ধরা আলোড়িত, সেটি বিশেষ ভাবে ভারতকে নিজস্ব করে নিতে হবে। ইউরোপের ব্যবহারিক দিক্-অদম্য উৎসাহ, সুন্দর সুঠাম গ্রীক-বলিষ্ঠ দেহ এ সমস্তই ভারত কে গ্রহণ করতে হবে ভারতের নিজ স্বভাবে।

ইন্দ্রিয়দের কাজের শক্তি পরিমিত ও সীমাবদ্ধ, সুতরাং বহু দ্বন্দ্বময়। ঐ দ্বন্দ্বের ঘাত প্রতিঘাতে জীবের সুখ দুঃখ ভোগ অবশ্যম্ভাবী। দুঃখ বর্জিত স্থানই বেদের স্বর্গ। ঋগ্বেদ আদিতে নরক নেই। এই স্বর্গ প্রাপ্তি অল্পকাল স্থায়ী, ভোগ শেষে আবার দেহ-ধারণ (জন্ম) ও দ্বন্দ্ব ময় জীবন হয়। “রাগবিরাগযোর্যোগঃ সৃষ্টি”-রাগ (আসক্তি) হতেই সৃষ্টি, বিরাগ হতে যোগ (সাংখ্য প্রবচন সূত্র, ২য় অধ্যায় ৯)। সৃষ্টি মানে বৈচিত্র্য, প্রতি বৈচিত্র্যই সীমাবদ্ধ। অতএব এর বাইরে মোক্ষ সর্ব বন্ধন থেকে মুক্তি। “বিরক্তস্য তৎসিদ্ধি” ‘বিরক্তেরই তাতে সিদ্ধি- বৈরাগ্যেই মুক্তি। “ন স্বভাবতো বদ্ধস্য মোক্ষ-সাধনোপদেশ বিধি”, বদ্ধভাবই যদি জীবের স্বভাব হয়, মোক্ষ উপদেশ বৃথা (ঐ ঐ ১ম অধ্যায় ৭)। যার যা নেই তার তা আসবে কেমন করে, কোথা হতে? কারণ না থাকলে কাজ হয় না। বহুর মধ্যে ‘সামান্যীকরণ’ (Generalization) করে এক দেখার চেষ্টা মানুষের কেন? উন্নতি মানে কি ? মোক্ষ-নিত্য ও স্বভাব সিদ্ধ, এছাড়া সবই অনিত্য, অস্বাভাবিক-সংস্কার রঞ্জিত দৃষ্টি।

সৃষ্টি ব্যাপারে, সুখ-দুঃখ, শান্তি-অশান্তি দুই মিশে আছে। যেমন অনুকম্পা বা কৃপা আছে, তেমনি কঠোরতা ও ভীষনতা আছে। যা কিছু দেখছ, সবই প্রাণের কম্পনে নিঃসৃত হয়েছে, যারা এই প্রাণ নামক ব্ৰহ্মকে মহৎ ভয় স্বরূপ উদ্যত বজ্রের মত জানেন, তাঁরাই অমৃতত্ব লাভ করেন। (কঠ ৩/২)। এর ঠিক পূৰ্বের অধ্যায়ে উপনিষদ বলছেন, ‘যিনি সর্বভূত অন্তরাত্মা ও এক হয়েও, অবিকৃত থেকে ও বহুরূপে বর্তমান, সেই তাকে, যিনি হৃদয়ে দেখেন, তিনি শান্তি লাভ করেন, তিনিই পরম সুখ লাভ করেন। (ঐ-২/৯/১২/১৩)। ভীমবক্ত্রা মহাঘোরা মুক্তকেশী দেবী কালিকা বিগ্রহে বরাভয় হাত ও আছে- একই অবয়বে বিপরীত ভাবের সমাবেশ। দ্বন্দ্বকে যিনি পৃথক না ভেবে, সবই ঐ একেরই রূপ বলে জানেন, তিনি অমর হন। “দ্বৈতাৎ ভয়ং”, দ্বন্দ্বেই প্রকাশিত হয়েছে বিশ্ব, তাই তাঁরই ভয়ে মাত্র (দ্বন্দ্ব রূপী থাকায়) অগ্নি ও সূৰ্য্য তাপ দিচ্ছেন…। (ঐ)। এখানে বলা হচ্ছে না যে ভয়’ই আধ্যাত্মিকতার মূলে, বলা হচ্ছে যে দ্বৈত বোধ থেকেই ভয় এবং “অভয়ং অমৃতম্।” সবই মায়ের রূপ-মা। সুখ নিজে সুখ ভোগ করে না, দুঃখ নিজে দুঃখ ভোগ করে না কোথায় অস্তিত্ব তাদের, দ্বন্দ্বের সংস্কার ছাড়া? দ্বন্দ্ব বোধই, অতএব ভয়।

“জন্মাদস্য যতঃ” (ব্রহ্মসূত্র)। যা হতে এই জগতের জন্ম, স্থিতি ও লয় হয়। ইহা ব্রহ্মের তটস্থ লক্ষণ, “সদ্ভাণং স্বরূপং”-সতের ভাণ বলা হয়েছে (তন্ত্রে)। “দ্বে ব্ৰহ্মণী বেদিতব্যো পরঞ্চাপরমেবঞ্চ।” এখানে পর ও অপর এই দুই ভাবে ব্রহ্মের সাধনা হয়, এই বলা হয়েছে- দুজন ব্রহ্ম নয়। বিশ্ব ব্যাপারই যখন তটস্থ লক্ষণ, তখন সুখ দুঃখ রূপ নানা দ্বন্দ্ব থাকায় তাতে যেমন অনুকম্পা বা করুণা আছে, তেমনি আবার মহাঘোরা ও ভীমা রূপ ও আছে, অথচ সত্তা বিচ্যুত নয়। তটস্থ লক্ষণ দ্বারা ব্রহ্ম প্রাপ্তি সমাধিলভ্য (মহানির্বাণ ৩য় উ১০)। দ্বন্দ্ব ভাব, সংকল্প বিকল্প ও দেহে আত্মাভিমান বর্জিত সাধকই সমাধি যোগে স্বরূপতা লাভ করেন (ঐ, ঐ।১০)। একটি জিনিষ লক্ষ্য করা যায় যে, অনুষ্ঠান বহুল সাধকদের মধ্য থেকেই জগতে বেশী মহামানবের আবির্ভাব হয়েছে; কারণ, তারা অনুকম্পাময় হয়ে যান ও তাদের মধ্যে কখনও শুষ্কতা আসে না, তাঁরা স্বরূপ-ভাব হতেও বিচ্যুত থাকেন না। কিন্তু যারা স্বরূপ ভাবকে শুধু কবিত্বের মধ্য দিয়ে ভবসাগর পার হতে চান, তাঁদের বিবেক চূড়ামণির সাবধান বাণী সর্বদা স্মরণ রাখা উচিত, আর উচিত তাঁদের, যারা মনে করেন, বিনা বৈরাগ্যে ও সব হয়ে যায়ঃ-
“আপাত বৈরাগ্যবতো মুমুক্ষাণ্ ভবাদ্ধিপাবং প্রতি যাতুমুদ্যতান্।
আশাগ্রহো মজ্জয়তেহন্তরালে, নিগৃহ্যকণ্ঠে বিনিবর্ত্ত্যবেগাৎ॥” (বিবকেচূড়ামণি)
‘বৈরাগ্য আশ্রয় না করে যে সাধক ভবসাগর পার হতে উদ্যত হন, বাসনা রূপ গ্রহ তাকে ঝুটি ধরে বলপূর্বক ঐ সাগরে ডুবিয়ে দেয়। স্বরূপ ভাবের ঠিক ঠিক সাধক জগতে বিরল, তবু স্বরূপ ভাব কি, তা বোঝার চেষ্টা করাও ভাল, তাতে আদর্শের দিকে লক্ষ্য ঠিক থাকে। স্বরূপতা লাভ করে ও যারা বিশ্ব কল্যাণে রত থাকেন তারা বিশেষ আধিকারীক পুরুষ। সাধনার উদ্দেশ্য সৃষ্টিতত্ত্বের অতীত হওয়া, তাই প্রথম সাধন তত্ত্ব শোনা চাই, ভাবা চাই।

“জন্মাদস্য যতঃ।”

কারণ কার্য রূপে প্রকট হয়, অতএব ‘সর্ব্বং খল্বিদং ব্রহ্ম’- এটা জীব ভুলে যায়। মায়াটা কি? তন্ত্র বলেন, মায়া একটি শক্তি বিশেষ- যে শক্তি দ্বারা বস্তু বহুরূপে দেখা দেয়। তার লক্ষণ, (১) বিক্ষেপ (Projection)- বাইরে আসা, যেন বহু হচ্ছেন, (২) আবরণ- স্ব কে প্রচ্ছন্ন রাখা, তার ফল ত্বং বা ইদং আপনাকে স্বতন্ত্র বোধ করেন ও পাকা অহং কে ভুলে যান, সুতরাং ইদং গত অহং (কাচা আমি) তখন নিজেকে বদ্ধ ভাবে গণ্ডীগত বোধ করেন। আবার যখন ঐ কাঁচা আমি নিজে স্বরূপ জানতে চান- পাকা আমি কে পেতে চান অর্থাৎ (৩) বরণ করেন- আবরণ মুক্ত হতে চান তখন দরকার হয় সাধনা। আবরণী ও বিক্ষেপ শক্তির ফলে নানাত্ব ও জগতের অনাদিত্ব বোধ আসে। বরণ শক্তিতে, সমষ্টি বোধে একত্ব জ্ঞান ও প্রবাহ রূপে নিত্যত্ব বোধ উদ্ৰিক্ত হয়ে সাধক আরো অগ্রসর হন। মায়া শক্তি যখন আবরণ ও বিক্ষেপ করেন তখনই সৃষ্টি কল্পনা সম্ভব, সুতরাং সৃষ্টি অর্থে আবরণী ইচ্ছা। অতএব, ঈশ্বর মায়া শক্তির মধ্যে থেকে ও মায়াধীশ। আকাশ কে লিঙ্গ বা লক্ষণাক্রান্ত বা শিব এবং প্রাণকে যোনি বা শক্তির আধার বলা হয়। শক্তির আধার বলেই প্রাণ ক্রিয়াশীল বা চঞ্চল। চিদাকাশ- আভাষ বা প্রকাশ বোধরূপ ব্যাপ্ত ভাব। আকাশকে তিন ভাবে দেখা হয় (১) মহাকাশ- বাহ্য জগৎ বা বাহ্য জগতে যা কিছু সমস্তই মহাকাশে বর্তমান, (২) চিত্তাকাশ- চিন্তা ও সিদ্ধান্ত আদির স্থান মন, অতএব এই মনোময়ই চিত্তাকাশ, (৩) চিদাকাশ- জ্ঞানময় আকাশ-পূর্ণ জ্ঞান ভূমি। স্থূল সূক্ষ্ম আদি শরীরধারী অহং দেশে অবস্থিত, চেতন অহং কালে অবস্থিত, সুতরাং দেশ কাল বা আকাশ-এই অহং এরই একাংশ, এই অহং’ই দেশ ও কালের আধার। বলা বাহুল্য সাংখ্যের জড়া প্রকৃতির জড় ও ইউরোপীয় বা সাধারণ ধারণার জড় এই দুয়ে আকাশ পাতাল প্রভেদ।

সাংখ্য দর্শন জগতের মধ্যে সর্ব প্রাচীন দর্শনশাস্ত্র। জগতের সর্ব প্রকার দর্শনশাস্ত্র বা মনস্তত্বের মূল এই সাংখ্য দর্শন।

[পাইথাগোরাস (জন্মকাল খৃঃ পূঃ ৫৮২-cir 582 B c.) ভারতে এসে সাংখ্য তত্ত্ব শিখে গিয়ে গ্রীকদের শেখান। পাইথাগোরাসের পূৰ্বে থেলস (Thales born circa 640 B c. খৃঃ পূঃ ৬৪০,) ও পরে সক্রেটিশ (খৃঃ পূঃ ৪৬৯-৩৯৯), ষ্টোরিক জিনো (Zeno the Stoic-খৃঃ পূঃ ৩৫০-২৫৮) প্রভৃতি সকলেই ভারতের কাছে ঋণী। অমরা ক্রমশঃ দেখব যে ভারতের সংস্পর্শে সমস্ত জাতিই এসেছিলেন।]

আমরা দেখেছি যে ত্রিবিধ দুঃখের আত্যন্তিক নিবৃত্তি হয়ে মোক্ষ লাভই সাংখ্যের উদ্দেশ্য। দুঃখ’ই মূল, সুখ মানে দুঃখের অভাব। দুঃখ নিবৃত্তির যে সব সৃষ্ট উপায় অবলম্বিত হয়, তার কাজ ক্ষণিক-দুঃখের আত্যন্তিক নিবৃত্তি হয় না। দুঃখের সঙ্গে সুখ জড়িত, সুখের সঙ্গে দুঃখ জড়িত, অতএব সুখ-দুঃখ এই দুয়েরই নিবৃত্তি হওয়া চাই। যার যা স্ব-ভাব, তা কখনও বদলায় না। আসল রূপ বদলায় না, মাত্র একটি শক্তির উদ্ভব (প্রকাশ) ও অন্যরকম শক্তির অনুদ্ভব (অপ্রকাশ) হয় (সাংখ্য প্রবচন সূত্র-১ম অ ১১) ভাঁজা বীজ ও যোগ শক্তি বলে তার স্বভাব ফিরে পায়। নিত্য যেটি তার সঙ্গে কোন অনিত্য বস্তুর সম্বন্ধ স্থাপিত হয় না, কারণ নিত্য হচ্ছে অখণ্ড, অতএব বন্ধন হীন। সম্বন্ধ মানে বন্ধন। পুরুষ অসঙ্গ (ঐ, ১/১৫)। দিক্ কাল আদির জন্য বস্তুর আকাশ হতে উৎপত্তি। পুরুষ বা আত্মার জন্য বস্তু নয়। পুরুষ, স্বমুক্ত-তাঁকে মুক্তি দেবে কে? প্রকৃতি, পরতন্ত্র। পর বা পুরুষের জন্যই প্রকৃতির চেষ্টা। [অস্ত্যাত্মা, নাস্তিত্ব সাধনাভাবাৎ (ঐ ৬ অ। ১। ঐ-১ম অ-৪৯ দ্রঃ)]। আত্মা আছেন, নেই- এটা প্রমাণ হয় না বরং অনুকূল প্রমাণ- আত্ম প্রতীতি। আত্মার গতি নেই- তিনি নিষ্ক্রিয় (কঠ-২০/১/১১)। শ্রুতিতে যে আত্মার গতির কথা আছে, যথা ‘আসীনো দূরং ব্রজতি শয়ানে যাতি সর্ব্বতঃ। তার মানে, দেশ কাল উপাধি যোগে গতি বিশিষ্ট মনে হয় (সা. প্র. সূ, ৬/৫৯) গতি, প্রকৃতির কাজ, ঘট নাড়লে, ঘট স্থিত স্থির আকাশ গতিশীল বলে প্রতীয়মান হয়। গতিশীলতা অবয়বের, স্বরূপের নয়। এই বন্ধন’টি অবিবেক জনিত (ঐ ১/৫৫)। এই অবিবেক, প্রধানের বিকাশ রূপ কার্য হতে আসে (ঐ ১/৫৭)। আত্ম সাক্ষাৎকার বিনা ঐ বাধ দূর হয় না, যেমন দিগ ভ্রমের মূঢ়তা সহজে যায় না (ঐ ১/৫৯)। অতএব, এই জগতের স্বরূপ জানা চাই, যাতে, অনাত্ম বস্তুকে আত্মার সঙ্গে পৃথক বোধে, বিবেকের উদয় হয়। বিবেকের প্রতিষ্ঠা সাংখ্য দেখতে চান।

স্থূল সূক্ষ্মে পরিণত হয়, সূক্ষ্ম’ই স্থূল রূপে দেখা দেয়, অতএব সূক্ষ্ম অবস্থাই স্থূলের কারণ। ধ্বংস মানে স্থূলের সূক্ষ্মাবস্থা। কোন জিনিষের একান্ত ধ্বংস বা নিঃশেষ অবস্থা হয় না। একটি বিরাট জড় সমুদ্র পড়ে রয়েছে। এই জড়ের সূক্ষ্মতম অবস্থা হতেই সৃষ্টির বিকাশ। সংসারের উৎপত্তি আছে, এটি শ্রুতি সিদ্ধ। বীজ অঙ্কুরের দৃষ্টান্ত, অনাদি প্রবাহ সম্বন্ধেই খাটে, সুতরাং জীবের সংসার সম্বন্ধ অনাদি হতে পারে না, বিদ্যা জীবের স্বরূপ গত নয়। জগতে আমরা তিন রকম শক্তির খেলা দেখতে পাই- সত্ত্ব, রজঃ ও তম। যে শক্তিতে সব প্রকাশ পায় তার নাম সত্ত্বগুণ, রজোগুণের লক্ষণ চঞ্চলতা, তমোগুণ আবরক ঐ গুণত্রয়ের শুদ্ধ অবস্থার (মিলিত একত্বে স্থিতির অবস্থার) নাম প্রকৃতি-ত্রিগুণের সাম্যাবস্থা (ঐ ১/৬১)। সৃষ্টি ক্রম- সূক্ষ্মতম অবস্থা হতে পর পর ক্রম অবতরণ, যথা- প্রকৃতি, মহৎ (মহত্তত্ব), অহঙ্কার (অহংতত্ত্ব), পঞ্চতন্মাত্র, মন, পঞ্চ কর্ম ইন্দ্রিয় ও পঞ্চ জ্ঞান ইন্দ্রিয়, পঞ্চমহাভূত-এই ২৪টি ও পুরুষ। এই ২৫টির নাম গণ বা তত্ত্ব। ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ, ব্যোম এই পঞ্চ ভূতাত্মক জগৎ, এই স্থুলের সূক্ষ্ম অবস্থার নাম তন্মাত্র বা শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস, গন্ধ। ঐ পাঁচটিকে বিভিন্ন স্থানে ও ভাবে যেটি গ্রহণ করে তার নাম ইন্দ্রিয়। চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা ও ত্বক-৫টি জ্ঞান ইন্দ্রিয়, বাক্, পাণি, পায়ু, পাদ, উপস্থ-৫টি কর্মেন্দ্রিয়। এই দুই রকম ইন্দ্রিয় বিভাগ ও তন্মাত্র অপেক্ষা সূক্ষ্ম-অহং তত্ত্ব বা অহংকার (অভিমান)।

[“যুগপজ্জ্ঞানানুৎপত্তির্ম্মনসো লিঙ্গম্”-গৌতম সূত্র, (ন্যায়দর্শন) ১ম অঃ ১ম অঃ ১৬)। ন্যায় ও সংখ্যা আদির প্রমাণের এটাই একটি সামান্যেতোদৃষ্টের উদাহরণ।]

শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস, গন্ধ ইন্দ্রিয় সমূহের নিজ নিজ বিষয়ের সান্নিধ্য হলেও, সে বিষয়ক জ্ঞান যুগপৎ উৎপত্তি সমকালে হয় না। এই সহকারী নিমিত্তই মন। এক সঙ্গে সকল ইন্দ্রিয়ের বোধ আত্মায় প্রতিভাত হয় না, অতএব এমন একটা কিছু আছে যা আত্মার ও ইন্দ্রিয়ের সংযোগ কে নিয়মিত করে ঐ বোধ আনায়, এর নামই মন। মনের সংযোগ না হলে কোন ইন্দ্রিয়ার্থের বোধ হয় না। মন ঐ অহং তত্ত্বের বিকার। অহংকার এক প্রকার বোধ, যা আরো সূক্ষ্ম ও ব্যাপক। এই ব্যাপক বোধ বা অন্তঃকরণ’কে মহত্তত্ত্ব বলা হয়।

[করণ= বহিঃসংঘাতকে যা ইন্দ্রিয়ের কাছে নিয়ে যায়। ইন্দ্রিয় (Nerve Centre) ভেতরে করণ, বাইরের চক্ষু, কর্ণাদি। বুদ্ধি + অহংকার + মন = অন্তঃকরণ। জ্ঞানেন্দ্রিয় ও কর্মেন্দ্রিয়- এই ১০টি, বাহ্যকরণ (বাহ্যবিষয় আহরণ, ধারণ ও প্রকাশের কারণ)। এই ত্রিবিধ করণের বিষয় বর্তমান কালে স্থিত, কিন্তু অন্তঃকরণ ত্রিকালকেই বিষয় করে। (সাংখ্যকারিকা ৩২/৩৩)। অনুমান প্রমাণ তিন রকম- পূর্ববৎ, শেষবৎ, সামান্যতোদৃষ্ট (গৌতম)। দৃষ্ট বস্তু সম্বন্ধীয় ব্যাপ্তি জ্ঞান সহায়তায়, অদৃষ্ট অনুরূপ জাত্যন্তরীয় বস্তু বিষয়ে যে অনুমান হয় সেটাই ‘সামান্যতোদৃষ্ট’ অনুমান। যেমন করণের সাহায্য ভিন্ন কর্তা কাজ করতে পারেন না, কিন্তু কর্তার দর্শন শ্রবণ আদি কর্ম ও আর একটি করণ দ্বারা সাধিত হয়, এই রকম ইন্দ্রিয় সকলের অস্তিত্ব ঠিক করা ‘সামান্যতোদৃষ্ট’ অনুমান দ্বারা সিদ্ধ হয়। ইত্যাদি।]

সাংখ্য প্রকৃতিকে ‘সংজ্ঞামাত্রম’ বলেছেন [সাংখ্য প্র. সূ. ১ম/৬৮]। প্রকৃতি অব্যক্ত, পুরুষ ও প্রকৃতি উভয়ই সমান অলিঙ্গ ও নিত্য (ঐ, ঐ, ৬৯)। প্রভেদ এই যে, পুরুষ অবিকারী, প্রকৃতির বিকার হয়। প্রকৃতি জড়া সুতরাং তার থেকে যা কিছু আসে সবই জড়। ‘চিদবসানো ভোগঃ (ঐ ১ম/১০৪) ভোগের শেষ, চিৎস্বরূপতায়। অহংকারের বিকৃতিতে সত্ত্বাংশে মন আবির্ভূত হয় (ঐ ২য়/১৮)। অন্তঃকরণের বৃত্তি সমুদায়ের নিবৃত্তিতে পুরুষের উপরাগ শান্ত হয় ও স্বরূপে স্থিতি হয় (ঐ ২য়/৩৩/৩৪)। অহংতত্ত্ব + ১১টি ইন্দ্রিয় + পঞ্চ তন্মাত্র- এই সপ্তদশ তত্ত্বের সম্মিলনে লিঙ্গ শরীর গঠিত হয় (ঐ ৩য়/৯)। কেউ কেউ মহতত্ত্ব কে নিয়ে ১৮টি বলেন। এই লিঙ্গ শরীর খুব সূক্ষ্ম-স্থুল দেহেরই সূক্ষ্ম অবস্থা সুতরাং এটাও জীব দেহ (ঐ, ৩য়/১১)। জ্ঞানমুক্তি (ঐ ৩য়/২৩)। বৈরাগ্য ও অভ্যাস দ্বারাই ইন্দ্রিয় বৃত্তির নিরোধ হয় (ঐ, ৩য়/৩৬)। উট যেমন পরের জন্য কুঙ্কুম(জাফরান, কুসুম, ফুল) ভার বহন করে, প্রকৃতি ও সেই রকম পুরুষের বন্ধন দূর করার জন্য এই সৃষ্টি কাজের সেবায় থাকেন (ঐ ষষ্ঠ অ/৪০)। অহংকারই কর্তা, অতএব অহংকার কৃত কর্মেরই ভোগ হয়, সুতরাং অহংকারের অবসানে আত্মজ্ঞান স্বতঃস্ফূর্ত হয় (ঐ ষষ্ঠ অ ৫৪,৫৫)। প্রমাণ তত্ত্বজ্ঞানের প্রধান সহায়। দুই পক্ষের মধ্যে এক পক্ষের বা একটির যে নিশ্চিত ‘পরিচ্ছিত্তি’ (ধারণা বিজ্ঞান) তার নাম প্রমা। প্রমা বা বোধ যার দ্বারা সিদ্ধ হয় সেটাই প্রমাণ। প্রমাণ ফলই প্রমা= বোধ। প্রমাণ ত্রিবিধ (১) প্রত্যক্ষ (২) অনুমান (৩) আপ্তবাক্য। আপ্তবাক্যের নাম শব্দ প্রমাণ। বিষয়ের সঙ্গে ইন্দ্রিয় সংযোগের নাম বৃত্তি। যার সঙ্গে বিশিষ্ট সম্বন্ধ হয় ও বুদ্ধির সেই আকার ধারণরূপ বিজ্ঞানের নাম প্রত্যক্ষ (ঐ ১ম অ/৮৯)। সত্ত্ব গুণ প্রকাশক, সুতরাং ত্রিগুণাত্মিকা বুদ্ধির তমোগুণ অভিভূত হয়ে সত্ত্ব গুণ উদ্ভব হলে, তা সে আকার ধারণ করে বা প্রকাশ পায়। এই যে সত্ত্বের সমুদ্ভব, এর নাম অধ্যবসায় (বৃত্তি+জ্ঞান)। বুদ্ধির বৃত্তি রূপ জ্ঞানই প্রমাণ। ঐ জ্ঞানে চিৎ এর যে প্রতিবিম্বন সেটাই বোধ বা প্রমা। প্রকৃতি জড়, সুতরাং বুদ্ধি বা বুদ্ধির অধ্যবসায় ও জড়। পুরুষ চেতন ও অপরিণামী, অপরিণামী পুরুষের জ্ঞান বা বৃত্তি রূপ পরিণাম হতে পারে না। বুদ্ধি, বিষয়াকার, বুদ্ধিবৃত্তি প্রকাশের সঙ্গে বিষয়ের প্রকাশ হয়। তাই সব সময়ে সর্ব বিষয় প্রকাশ পায় না। তমোগুণ মলিন তাই চিৎ এর প্রতিবিম্ব, তমোগুণে অভিভূত বৃদ্ধি সত্ত্বে পড়ে না; রজোগুণ চঞ্চল-স্থির প্রতিবিম্ব সেখানে অসম্ভব, সত্ব গুণ নির্মল, তাই পুরুষের প্রতিবিম্ব সেখানে পড়া মাত্রই চিত্তের উজ্জ্বলতা আসে বা প্রকাশ স্বরূপতা প্রকাশ পায়। তাই তখন বুদ্ধি সত্ত্বের ধর্ম ও পুরুষের ধর্ম বলে মনে হয়। মহর্ষি কপিল বলেন যে, সকাম বা নিষ্কাম কর্ম এই উভয়ের কোনটির দ্বারা মোক্ষ প্রাপ্তি হয় না (ঐ ১ম অ/৮৫)। এটা কেবল আত্মানত্ম বিবেকেই হয়। নিষ্কাম কর্মে যদি এই বিবেক না থাকে বা বিবেক উদয় না হয়, তা হলে মুক্তি আসে না, কারণ জড়, জড়ই উৎপাদন করে।

“অথাতো ব্রহ্মজিজ্ঞাসা” (ব্রহ্মসূত্র)।

বিবেক বৈরাগ্যের পর ব্রহ্ম জিজ্ঞাসা (ব্রহ্ম কে জানবার ইচ্ছা) আসে। সাধন দরকার। সব রকম সাধনেই চরম লক্ষ্যে পৌঁছান যায়। সাধন চতুষ্টয় যে সকলেরই অবশ্য করনীয় তা নয়, অথবা বেদ অধ্যয়ন ও কর্মকাণ্ড আদি অনুষ্ঠানের পর যে ব্রহ্ম জিজ্ঞাসা আসে তাও নয়। বেদ অধ্যয়ন ও কর্মকাণ্ড সাধনের মধ্যে যদি বিবেক বৈরাগ্য না থাকে, ওগুলির মূল্য কতটুকু? “যদহরেব বিরজেত্তদহরেব প্রব্রজেত্তদ্ধৈকে।”(জাবালোপনিষৎ-৪র্থ/৪)। যখনই বৈরাগ্য আসবে তখনই প্রবজ্যা(পরিব্রাজকের কাজ বা ব্রত) অবলম্বন করবে। জনক-যাজ্ঞবল্ক্য সংবাদে, যাজ্ঞবল্ক্য উপদেশ করছেন যে, ব্রহ্মচর্য শেষে গার্হস্থ্য আশ্রমে প্রবেশ করতে হয়, তারপর বাণপ্রস্থ ও সন্ন্যাস আশ্রম গ্রহণ করতে হয়, আবার ব্রহ্মচর্য্যের পরই প্রবজ্যা গ্রহণ করা যায়, কিন্তু যদি ব্রহ্মচারির অনুষ্ঠেয় কর্ম না করেও, সাধক বৈরাগযুক্ত হন, তা হলে তিনি সাঙ্গ বেদ সমাপ্ত করুন বা না করুন, স্নাত বা অজ্ঞাতই থাকুন, সাগ্নিক বা নিরগ্নিক হোন্-যখনই বৈরাগ্যোদয় হবে তখনই প্রবজ্যা গ্রহণ করবেন। এর সত্যতার ভুরি ভুরি নিদর্শন বৈদিক যুগ হতে আজ পর্যন্ত রয়েছে।

[‘অথ’- সব সময়ে ‘অনন্তর’ নয়। বিজ্ঞান ভিক্ষু তাঁর বিজ্ঞানামৃত ভাষ্যে ‘অত’, হেত্বৰ্থে না করে ৫মী করে মানে করেছেন, “এই সূত্র হতে ব্ৰহ্ম জিজ্ঞাসা।” (শেতপথ ব্রাহ্মণ, ২য় কা, ৪প্র, ২ ব্রা ইহা সমর্থন করেছেন। পণ্ডিত বিধূশেখর ভট্টাচাৰ্য্য মহামহোপাধ্যায় অনূদিত শতপথ ব্রাহ্মণকেই অধিকাংশ সময়ে এই গ্রন্থে অনুসরণ করেছি)। ত্রিবর্ণেরই বেদে অধিকার, এটা তন্ত্রশাস্ত্ৰই প্ৰথম অস্বীকার করেন। তন্ত্র সাধনায় মানুষ মাত্র’ই অধিকার। এটাও কঠোর সত্য যে সৰ্ববর্ণ থেকেই মহাপুরুষের আবির্ভাব হয়েছে, এই বাস্তবটি তন্ত্রশাস্ত্র স্পষ্ট ক’রে বলেছেন মাত্র]।

সাংখ্য বলেন যে প্রকৃতি হতে বিকার আসে, প্রকৃতিই আদি কারণ। ব্ৰহ্মসূত্রে (জন্মাদস্যসূত্রে), ব্ৰহ্মশক্তিকে ‘কারণ’ বলা হয়েছে। সাংখ্যমতে ‘পুরুষ’ কখন ‘কারণ’ ‘হতে পারে না, কর্মই যখন সূক্ষ্মরূপে ‘কারণ’ হয়। কর্ম মানে বিকার। ‘পুরুষ’ অবিকারী। সাংখ্যমতে ‘পুরুষ’ অসংখ্য-প্রতি অবয়বে অধিষ্ঠিত, প্রত্যেক ‘পুরুষই’ অনাদি, অনন্ত ও চৈতন্যময়। সাংখ্য, এই পর্যন্তই বলেছেন। এর অতিরিক্ত কথা অদ্বৈতবেদান্ত বলেছেন; তাই এখানেই অদ্বৈতবেদান্তের সঙ্গে সাংখ্যের বিরোধ। ‘পুরুষ’ ও ‘প্রকৃতি দুইই অনাদি ও অনন্ত-এই সংশয়ে আমাদের কয়েকটি জিনিষ বোঝা দরকারঃ-(১) সাংখ্য উপাধি যোগে ‘পুরুষের’ গতি স্বীকার করেছেন, গতি মানেই বিকার, উপাধি মানেই নানাত্ব, অতএব, উপাধি-বিশিষ্ট বহু পুরুষ ‘প্রকৃতিতে’ প্রত্যক্ষ। পুরুষ কিন্তু অপরিণামী, (২) সাম্যাবস্থা মানে সমতা (Equilibrium), সে অবস্থায় বিকার নেই, সুতরাং অব্যক্ত-‘পুরুষের’ বিকার কোন অবস্থাতে হয় না; উপাধিযোগে ‘পুরুষের’ বদ্ধ অবস্থা হয়; এই বদ্ধ অবস্থার অসহায়তা হতে মুক্ত করবার জন্য প্রকৃতির কাজ বা বিকৃতি, প্রকৃতির কোন নিজ কর্মচেতনা নেই-পুরুষের সন্নিধ্যেই তাঁর ক্রিয়া। বাছুর সন্নিধ্যে যেমন গাভির দুধ, আপনা হ’তে ক্ষরিত হয় অচেতন সত্ত্বেও, প্ৰকৃতির কর্মচেষ্টা পুরুষের সন্নিধ্যেই হয়। দুধ, অচেতন, অথচ ক্ষরিত হয় বৎসের জন্যই (সাংখ্যকারিকা ৫৭/৫৯দ্রঃ)। বহুরূপী পুরুষই বৎস। সৃষ্টি ব্যাপার সম্ভব হতে গেলে চাই ‘পুরুষ’, চাই ‘প্রকৃতি’। (‘পুরুষ’ বা ‘প্রধান’= আত্মা বা চিৎ)। চিচ্ছক্তি বা ব্ৰহ্মশক্তি হতেই সৃষ্টি, এটা অদ্বৈতবেদান্ত ও তন্ত্রসম্মত। সাংখ্য ও স্পষ্ট বলছেন যে পুরুষ, প্রকৃতি এই দুই থাকলেও মুক্ত পুরুষের কাছে প্রকৃতির নিবৃত্তি হয়। তখন থাকেন একমাত্র পুরুষ। গোল এই যে, বহু অসীম হয় কেমন করে? সাংখ্য দ্বৈত স্বীকার করেন, কিন্তু ভাব ভেদক কি তা বলেন নি এই মাত্র। দ্বৈতের দিক দিয়ে সাংখ্য ঐ পৰ্যন্তই বলেছেন, তাঁর উদ্দেশ্য বিবেকখ্যাতির প্রতিষ্ঠা করা, এই পর্যন্ত বলাতেই সেটি সিদ্ধ হয়েছে। স্বামীজি বলেন, সাংখ্য যে সৌধ নির্মাণ করেছেন, তাতে বালি চুন প্রভৃতি ধরানো অদ্বৈতবেদান্তের সহজ হয়েছে (Vedanta and Sankhya দ্রঃ)। সাংখ্যের ইঙ্গিত কিন্তু গেছে বহুদূর। “প্রকৃতি ও পুরুষ- এই দুয়ের বা একের প্রতি ঔদাসিন্যেই মোক্ষ (সাংখ্যদর্শন ৩য় আ ৬৫)”। “যার আত্মসাক্ষাৎকার হয় নি, সে ‘ইতর’ অর্থাৎ প্রকৃতি সঙ্গদোষে বদ্ধ” (ঐ, ঐ, ৬৪)। প্রকৃতির নিবৃত্তি হলে থাকেন একমাত্র পুরুষ’, ‘পুরুষের’ নিবৃত্তি হয় না, কারণ তিনি চেতনস্বরূপ, কিন্তু উভয়ের নিবৃত্তি মানে কি দ্বৈতাদ্বৈতবিবর্জ্জিতম? অথবা ‘পুরুষের’ প্রতি ঔদাসিন্য প্রকৃতিলীন মহাপুরুষকে বলা হয়েছে এবং উভয়ের প্রতি ঔদাসিন্য মানে উভয়কে অভিন্ন ভাবা-দুটি স্বতন্ত্র, এই ভেদ বোধে ঔদাসিন্য ?

সাংখ্য, একজন কর্তা ঈশ্বর (Personal God) মানেন না বা মানা নিষ্প্রয়োজন বলেন। কয়েকজন পণ্ডিতদের মতে, সাংখ্যদর্শনের (৩য় অঃ) ৯২, ৯৩, ৯৪, ৯৫ ও ৯৬ সুত্র মিলিয়ে পড়লে, ‘তৎ’ শব্দটি ঈশ্বরকেই লক্ষ্য করা হয়েছে দেখা যায় অর্থাৎ সাংখ্যের ‘পুরুষ’ ও ‘ঈশ্বর’ একার্থবাচক। সাংখ্যমতে, যাঁরা মুক্ত হতে চেষ্টা করছেন, তাঁরা প্রকৃতিলীন হয়ে থাকলে, কল্পান্তে তাঁদের মধ্যে সৃজনী শক্তি ছাড়া আর সব শক্তি আসে। তাঁদের মধ্যে এক এক জন তখন কল্পেশ্বর’ হয়ে জীবনে মুক্তির পথ দেখান। ধোলো যাকে Design Theory বলেন, সাংখ্য তাকে প্রচণ্ড আঘাতে চূর্ণ করেছেন।

আর্যপ্রভা- শ্রীসুরেন্দ্ৰনাথ সেন

সংকলনে- কৃষ্ণকমল।