বেদ উপনিষদ পরবর্তী হিন্দুধর্ম (১১) শেষ পর্ব।


বেদ উপনিষদ পরবর্তী হিন্দুধর্ম (১১) শেষ পর্ব।
স্মৃতিশাস্ত্ৰে মানুষের সাধারণ ধর্ম সম্বন্ধে অনেক আলোচনা করা হয়। সাধারণ ধর্ম মানে যে ধর্ম সবারই করণীয়। আপনি হিন্দু না মুসলমান, আপনি ব্রাহ্মণ না শূদ্র তাতে কিছু আসে যায় না, এই ধর্মগুলো সার্বভৌম ধর্ম, সবাইকে এই ধর্ম পালন করতে হবে। পুরাণ সূতিশাস্ত্রের এই সাধারণ ধর্মকে স্বধৰ্ম বানিয়ে দিল। পুরাণের এটি একটি বড় রকম পরিবর্তন। যেমন অহিংসা, অহিংসা পালন করাটা সৰ্বসাধারণের আবশ্যক। এবার বলছেন, তুমি যদি শুধু অহিংসার অনুশীলন করে যাও তাহলে এই অহিংসা দিয়েই তোমার ঈশ্বর লাভ হয়ে যাবে। ঠিক তেমনি সত্য, কোন ধর্মই বলে না যে মিথ্যে কথা বলবে, সত্য কথা বলা সবারই জন্য। সত্য কথা বলা সাধারণ ধর্ম। এখন কেউ যদি সত্যে প্রতিষ্ঠিত হয়, তাহলে সে সেই সত্যকে দিয়ে ঈশ্বরকেও লাভ করতে পারবে। বেদ উপনিষদে এই জিনিষ কখন এভাবে আসেনি। পুরাণে সাধারণ ধর্মটাই ধীরে ধীরে পাল্টে গেল স্বধর্মে। আর স্বধৰ্মটাই সাধনা। গীতাতে যখন স্বধর্মের কথা বলা হচ্ছে তখন নানা রকমের শর্ত নিয়ে আসা হচ্ছে। যেমন বলছেন তোমার যে বৰ্ণাশ্রমের ধর্ম, সেই বৰ্ণাশ্রম ধর্মে তোমার যে কর্তব্য কর্মগুলো করা হচ্ছে, সেটাই তোমার ধর্ম, সেই ধর্ম পালনে তুমি জোর দাও। গীতার এই তত্ত্ব থেকে পুরাণ সরে এসে বলছে – তুমি ভুলে যাও তোমার স্বধৰ্ম কি, তুমি যে কোন একটা ধর্মকে বেছে নাও, তুমি হয় অহিংসাকে বেছে নাও, বা শৌচকে বেছে নাও, এবার সেই ধর্মে তুমি প্রতিষ্ঠিত থাক, এতেই তোমার সব কিছু হয়ে যাবে। এইভাবে পুরাণ হিন্দু ধর্মে অনেক কিছুর পরিবর্তন নিয়ে এসেছে আর আজকের দিনে হিন্দু ধর্ম যেখানে এসে দাঁড়িয়েছে এটাই পুরাণের ধর্ম।
সমাপ্ত।
বেদ উপনিষদ পরবর্তী হিন্দু ধর্ম বিষয়ক এই ধারাবাহিকটি রামকৃষ্ণ বিবেকানন্দ বিশ্ববিদ্যালয়ের কোর্স ‘ভারতের আধ্যাত্মিক ঐতিহ্য’ থেকে বিশেষ বিশেষ অংশ টুকু নেওয়া হয়েছিল। গণপতির কৃপায় সাধ্যমত আপনাদের কাছে সহজ ও সুখপাঠ্য করে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি, জানি না আপনাদের কতদূর চিত্তাকর্ষক করে তুলতে পেরেছি। ভুলভ্রান্তি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।
জয় সনাতন।
সম্পুর্ণ লেখাটি এই সাইটে সংরক্ষিত হবে

বেদ উপনিষদ পরবর্তী হিন্দুধর্ম (১০)


হিন্দু ধর্মের পরিবর্তনে পুরাণের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান হল- উপনিষদে মানব জীবনের উদ্দেশ্য হল মুক্তি, কিন্তু পৌরাণিক সাহিত্যে উদ্দেশ্যটা পরিবর্তিত হয়ে এসে গেল সেবা, লোকসংগ্ৰহ। লোকসংগ্ৰহ মানে, ভগবানের কথা দশজনকে শোনানো। ভগবানের কথা দশজনকে শোনানও জীবনের উদ্দেশ্য হতে পারে। এখানে মুক্তিটা আর উদ্দেশ্য থাকলো না, কিন্তু পুরাণ বলবে সেবা বা লোকসংগ্ৰহ এটাই তোমার মুক্তি। উপনিষদের বাইরে পুরাণ আবার তিন রকম মুক্তির কথা নিয়ে এল- সারূপ্য, সমীপ্য আর সালোক্য। মুক্তি সাধারণতঃ চার রকমের বলা হয়- একটা হল সাযুজ্য, যেখানে সাধক ভগবানের সাথে এক হয়ে যায়। বেদান্তে মুক্তি বলতে এই সাযুজ্যের কথাই বলা হয়, সাযুজ্য মানে ব্রহ্মের সাথে লীন হয়ে যাওয়া। কিন্তু পুরাণে এসে এনারা আরও তিনটে জিনিষকে যোগ করে দিলেন- সালোক্য, ভগবান যে লোকে আছেন সাধক সেই একই লোকে গিয়ে বাস করছেন। দ্বিতীয় সারূপ্য, ভগবানের যে সাকার রূপ নিয়ে সাধক সাধনা করেছেন তিনি ভগবানের সেই উজ্জ্বল সাকার রূপটা পেয়ে গেলেন, ভগবানের দিব্য রূপ নিয়ে সে ভগবানের সাথেই থাকেন। আর শেষে সামীপ্য, সাধক ঈশ্বরের সান্নিধ্যে থাকেন।
ঈশ্বরের প্রতি যাদের সেবা ভাব আছে তারা এগুলোকে এভাবে দেখেন- তোমার যদি ঈশ্বরে ভক্তি থাকে তুমি ভগবানের সাথে একই লোকে বাস করবে। ভক্তি যদি তোমার আরেকটু বেশী থাকে তাহলে তোমার রূপটাই ভগবানের রূপ হয়ে যাবে। আর ভক্তি যদি আরও গভীর হয় তাহলে তুমি ভগবানের কাছে কাছেই সব সময় থাকবে। কিন্তু পুরাণের ভক্ত কখন সাযুজ্য চাইবে না। সে বলবে আমি চিনি আস্বাদ করতে চাই চিনি হতে চাই না। আমি ভগবানের রূপ দৰ্শন করব, আমি ভগবানের লীলা আস্বাদ করব। এই সাযুজ্য, সালোক্য, সামীপ্য ও সারূপ্য এই ভাবগুলো যে কত গভীর আর এগুলো বোঝার জন্য মনের ভাবভক্তির গভীরতা যে কত দরকার সেই ধারণাই আমরা করতে পারবো না। আমরা কিছু না বুঝে সহজেই একটা মতামত দিয়ে দিই- সাযুজ্যই ভালো, কিংবা সালোক্যই তো ভালো। কিন্তু এভাবে এগুলোকে বিশ্লেষণ করা যায় না। যাঁরা এই পথে সাধনা করেন, সাধনা করে তাঁদের মনে ভাবের যে গভীরতা আসে সেটা অন্য ধরণের। তাঁরা যখন এই ধরণের কথা বলেন তখন এগুলোর একটা তাৎপর্য থাকে। আমাদের কাছে এগুলো শব্দ মাত্র।
ক্রমশঃ

বেদ উপনিষদ পরবর্তী হিন্দুধর্ম (৯)


উপনিষদে, বিশেষ করে ছান্দোগ্য উপনিষদে আমরা উপাসনার কথা পাই। কিভাবে উপাসনা করা হবে তার বর্ণনা ছান্দোগ্য উপনিষদে আলোচনা করা হয়েছে। উপনিষদের এই উপাসনাই পুরাণে এসে ভক্তিতে রূপান্তরিত হয়ে গেল। ভক্তিমাৰ্গ পুরাণে একটা বিশেষ স্থান পেয়েছে, সেইজন্য অনেকে পুরাণকে ভক্তিশাস্ত্রও বলেন, যদিও গীতার কয়েকটি অধ্যায়ে ভক্তির উপর অনেক মূল্যবান আলোচনা আছে। দেবতাদের অৰ্চনা করা, ধ্যান করা, উপাসনা করা এগুলো বেদ উপনিষদেই আছে, কিন্তু আজকে আমরা ভক্তিকে যে ভাবে পাচ্ছি। এটা পুরোপুরি পুরাণ সাহিত্যের অবদান।
পুরাণ আরেকটি নতুন ধারণা নিয়ে এল সেটা হল, ইষ্টদেবতার ধারণা। আমাদের সবারই একজন ইষ্টদেবতা আছেন, আমার একজন ইষ্টদেবতা, আপনার একজন ইষ্টদেবতা, এই ধারণাটা পুরোপুরি পুরাণ থেকে এসেছে। ইষ্টদেবতা ছাড়া মূর্তি পূজার ধারণাও পুরাণ থেকে এসেছে। বাল্মীকি রামায়ণে মূর্তি পূজার কোন উল্লেখ নেই, মহাভারতে কোথাও কোথাও হাল্কা করে বলা হয়েছে, বোঝা যায় যে পরম্পরার মধ্যে মূর্তি পূজার প্রথা আসতে শুরু হয়েছে। বাল্মীকি রামায়ণে কয়েকবার চৈত শব্দের উল্লেখ পাওয়া যায়। এই চৈত মানে কোন মন্দির নয়। বরঞ্চ সভাগৃহ বলতে যা বোঝায় চৈত ঠিক অনেকটা সেই রকম, একটা জায়গায় সবাই সমবেত হয়ে উপাসনা করবেন বা প্ৰবচন শুনবেন। এই চৈতীই আস্তে আস্তে রূপান্তরিত হয়ে পাল্টে গোল মন্দিরে। তারপর ইষ্টদেবতার ধারণাটাই মূর্তি পূজাতে চলে গেল। সেইজন্য সচারচর দেখা যায় ভারতে যত দেবী-দেবতার মূর্তি আছে বেশীর ভাগ মূর্তিই একশ কি দুশো বছর খ্ৰীষ্টপূর্বের তৈরী।
ক্রমশঃ

বেদ উপনিষদ পরবর্তী হিন্দুধর্ম (৮)


বেদে শুধু নির্গুণ নিরাকার ঈশ্বরের বর্ণনাই করা হয়েছে, নিৰ্গুণ ঈশ্বরের বাইরে যাঁদের কথা আছে তাঁরা হলেন দেবতা, যদিও তাঁদের গুণ, কার্য, বৈশিষ্ট্য আলাদা। পুরাণে এসে সেই নির্গুণ নিরাকার ভগবানই সগুণ সাকার হয়ে যাচ্ছেন। একবার যখন নির্গুণ নিরাকার ভগবানকে সগুণ সাকার করে দেওয়া যায়, এরপর অবতারে নামিয়ে আনার জন্য শুধু একটা ধাপ বাকি থেকে যায়। বেদের অমূর্ত ভগবানকে পুরাণে মূর্ত করে দেওয়া হল। একবার মূর্ত করে দেওয়ার পর ভগবানের রূপ বার বার পাল্টাতেও কোন বাধা থাকবে না।
পুরাণে এসে বৈদিক ধর্মের আরেকটি খুব বড় পরিবর্তন হল, ইন্দ্র, বরুণ, অগ্নি, মিত্ৰাদি যত বেদের মুখ্য দেবতা ছিলেন পুরাণে সেই দেবতারা একবারে গৌণ হয়ে গেলেন। এই পরিবর্তনটা মহাভারতেই অনেকটা শুরু হয়ে গিয়েছিল। বিষ্ণু বেদে যিনি একজন খুব ছোট্ট যজ্ঞের দেবতা রূপে ছিলেন, পুরাণ সেই বিষ্ণুকে সরাসরি ভগবান বানিয়ে বিরাট গুরুত্ব দিয়ে দিল। মহাভারতে ইন্দ্র ও ব্রহ্মার সাথে শ্রীকৃষ্ণের কিছু লড়াইয়ের বর্ণনা এসেছে কিন্তু ভাগবতে তো শ্রীকৃষ্ণের সাথে ইন্দ্রের লড়াই খুব ভালো মত জায়গা করে নিয়েছে।
ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বরকে নিয়ে পুরাণ হিন্দু ধর্মে ত্রিমূর্তির ধারণা নিয়ে এসেছে। ভগবানেরই তিনটে রূপ এই ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বর। মহাভারতেও এই ত্রিমূর্তির ধারণা এসে গিয়েছিল। কিন্তু পুরাণের মত এত গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। মজার ব্যাপার হল এই ত্রিমূর্তির ধারণা বেদেও ছিল, বেদে এই ত্রিমূর্তি হলেন অগ্নি, বায়ু আর সূর্য। আরও একটা লক্ষণীয় ব্যাপার, সারা ভারতে ব্রহ্মার জনপ্রিয়তাটা একেবারে তলানিতে এসে ঠেকেছে, একমাত্র পুস্কর ছাড়া কোথাও ব্রহ্মার মন্দির আছে বলে আমাদের জানা নেই। ব্রহ্মার পূজা দেশ থেকে বলতে গেলে উঠেই গেছে। কিন্তু ত্রিমূর্তির ধারণাটা দেশে থেকে গেল। ত্রিমূর্তির ব্রহ্মা চলে গেলেন, থেকে গেলেন বিষ্ণু আর মহেশ। তাহলে তৃতীয় নতুন কাকে ব্রহ্মার জায়গায় নেওয়া যেতে পারে? এনারা পরে সেখানে শক্তিকে নিয়ে এলেন। আজকে দেশে বিভিন্ন রূপে এই তিনজনেরই পূজা হয়, বিষ্ণু, মহেশ্বর আর শক্তি। এই ত্রিমূর্তি বেদে একভাবে ছিল, মহাভারত একভাবে নিয়ে এসেছে আর পুরাণে আসার পর এটাই ভালো ভাবে সারা দেশে স্থায়ী ভাবে বসে গেল। কিন্তু পূজা করার সময় আবার পাল্টে গেল। বিষ্ণু, শিব আর শক্তিরই পূজা এখন সারা দেশে হচ্ছে, শুধু ব্রহ্মাকে সরিয়ে দিয়ে তাঁর জায়গায় এলেন শক্তি।
ক্রমশঃ