ইতিহাসে প্রতিষ্ঠা।
ইতিহাসে ভারতের শীর্ষস্থান-সভ্যতায়, প্রাচীনত্বে, প্রাকৃতিক দৃশ্যে, জলবায়ু প্রভৃতিতে শ্রেষ্ঠত্ব – ম্যাক্সমূলার, হীরেণ, মারে, টড্, জোর্ণস-জার্ণা প্রভৃতির মতে ভারতবর্ষের অলৌকিকত্ব;-মিশর, গ্রীস, রোম প্রভৃতির সাথে তুলনা-বিপ্লবের শত ঝঞ্ঝাবাতেও ভারতীয় প্রতিষ্ঠার ক্রম-পর্যায়-রক্ষা,-ব্রাহ্মণত্ব-গৌরবের দৃষ্টান্ত;-প্রাচীনত্বে প্রাধান্য,-মিশরের মেনেস প্রভৃতির তুলনা,-সৃষ্টির অনস্তত্ব,-গণনাঙ্কে কোটি কোটি বৎসরের প্রতিষ্ঠা; —প্রাচীনত্ব বিষয়ে জোর্ণস্-জার্ণা, ষ্টাইল্স্, হ্যালবেড, বেলি, হীরেন, আবুল ফজেল প্রভৃতির মত, মেগাস্থেনীস এবং দেবী স্থান-গ্রন্থের বর্ণনা।
ভারতবর্ষই আদিভূত।
পৃথিবীর ইতিহাসে ভারতবর্ষ শীর্ষ-স্থান অধিকার করে আছে। ভারতবর্ষ-সভ্যতার, জ্ঞানের, মনুষ্যত্বের, বীরত্বের সকলেরই আদিভূত। সভ্যতার প্রস্রবণ প্রথমে কোথায় প্রবাহিত হয়েছিল? সে এই ভারতবর্ষে! জ্ঞানালোক প্রথমে কোথায় প্রস্ফুট হয়েছিল? সে এই ভারতবর্ষে! দর্শন, বিজ্ঞান, গণিত, জ্যোতিষ-সভ্য-জগৎ যার গৌরবে অধুনা গরীয়ান ভারতবর্ষই তার উৎপত্তি-স্থান নয় কি? সত্য, সরলতা, দয়া-দাক্ষিণ্য প্রভৃতি গুণগ্রামের উচ্চ আদর্শ’ই বা পৃথিবীর কোন দেশে প্রথম পরিদৃষ্ট হয়েছিল? শৌৰ্য বীর্য, আত্মত্যাগ, স্বদেশানুরাগ-মানব-চরিত্রের যে কিছু উচ্চ সম্পদ-ভারতবর্ষ সকলেরই আদিভূত নয় কি? ভারতীয় সভ্যতার কণিকামাত্র লাভ করেই পৃথিবীর অন্যান্য দেশ সুসভ্য ও গৌরবান্বিত হয়েছে। ভারতবর্ষ হতেই জ্ঞান-বিজ্ঞানের কিরণছটা দিগদিগন্তে বিশ্বত হয়ে পড়েছে। ভারতবর্ষই সকল গৌরবের আধার-স্থান। প্রকৃতি ভারতবর্ষকে অনুপম সৌন্দর্যে বিভূষিত করে রেখেছেন। এখানে, সকল সময়েই ষড়ঋতুর অপূর্ব সামঞ্জস্য। এখানে, ভ্রমর-গুঞ্জনে, কুসুম-কানন অহরহ গুঞ্জরিত; এখানে, বসন্তের মৃদুমন্দ মলয়ানিলে মনঃপ্রাণ স্নিগ্ধ-পরিপ্লুত; এখানে, মধুবনে কোকিল-পাপিয়া-শ্যামার-সুমধুর সুস্বর-লহরীতে ভারত-কানন প্রতিধ্বনিত। আবার এখানে, গ্রীষ্মের প্রখরতা, প্রবল বারিবর্ষণ, শীতের প্রচণ্ড হিম! একাধারে এ বৈচিত্র্য পৃথিবীর আর কোথায় আছে? এখানে, হিমালয়ের উচ্চ-শৃঙ্গে আরোহণ কর, শীতে হিমানীতে শরীর সঙ্কুচিত হবে; এখানে, গ্রীষ্মের প্রখর-তাপ যদি অনুভব করতে চাও, দক্ষিণাত্যে বিষুব-সান্নিধ্যে সে আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ হবে; আর যদি এখানে, সুজলা সুফলা শস্যাশ্যামল মূর্তি দেখতে চাও, তোমার সম্মুখেই এই বঙ্গদেশেই সে নয়নাভিরাম মূর্তি বিরাজমান। কোমলে-কঠোরে, মোহনে-ভীষণে, সৌন্দর্যে-গাম্ভীর্যে এমন একত্র সমাবেশ-ভারতবর্ষ ভিন্ন বুঝি অন্য কোথায়ও আর নাই! ভারতবর্ষের শ্রেষ্ঠত্ব অবিসম্বাদিত। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ পৰ্বত হিমালয় সে এই ভারতবর্ষে! পৃথিবীর পবিত্র নদী-পুণ্যপূত ভাগীরথী সে এই ভারতবর্ষে! পৃথিবীর বর্ণশ্রেষ্ঠ ব্রাহ্মণ সে এই ভারতবর্ষে! পৃথিবীর আদি-বাণী বেদ-সে এই ভারতবর্ষে! পৃথিবীর আদি-ধর্মের উৎপত্তি-স্থান সে এই তারতবর্ষে! এখনও ভারতবর্ষের এমন অধঃপতনের দিনেও পৃথিবীর অধিকাংশ লোক যে ধর্মের অনুসরণকারী সে ধৰ্মও এই ভারতবর্ষেরই! প্রকৃতি যেন আপন অনুপম শ্রেষ্ঠ সম্পদে ভারতবর্ষকে সাজিয়ে রেখেছেন। ভারতবর্ষের দৃশ্যাবলী মনঃপ্রাণ বিমুগ্ধকারী; ভারতবর্ষের ন্যায় ভূমির উর্বরা-শক্তিই বা কোথায় আছে? ভারতবর্ষের ন্যায় বিবিধ শস্য-সম্পদ ও বিচিত্র জীবজন্তুর একত্র-সমাবেশই বা কোথায় দেখতে পাই? ফলতঃ, সমগ্র পৃথিবীর সার-সামগ্ৰী নিয়েই বিধাতা যেন ভারতবর্ষের সৃষ্টি করেছেন!
পাশ্চাত্য-পণ্ডিতের মতামত।
নিজ দেশ নিজ জন্মভূমি বলে, অযথা গৌরব-গরিমা প্রকাশ করছি না। ভারতবর্ষের বিপুল-বৈভবের প্রতি যারই দৃষ্টি পড়েছে, তিনিই বিস্ময়-বিহবল হয়েছেন। পাশ্চাত্য পণ্ডিতগণের মধ্যে ম্যাক্সমুলারের স্থান কত উচ্চে, কে না অবগত আছেন? তারতবর্ষের প্রসঙ্গ যখনই তিনি উত্থাপন করেছেন, তখনই তিনি বলেছেন, “সমগ্ৰ পৃথিবীর মধ্যে যদি এমন দেশ আমায় কখনও সন্ধান করতে হয় প্রকৃতি যে দেশ ধনৈশ্বর্যে শক্তি-সৌন্দর্যে পরিপূর্ণ করে রেখেছেন এমন কি যে দেশ মর্ত্যে অমরপুরী বললেও অত্যুক্তি হয় না আমি মুক্তকণ্ঠে বলব, সে দেশ ভারতবর্ষ। যদি কেউ আমায় জিজ্ঞাসা করেন কোন আকাশের কোন প্রদেশে জ্ঞান-স্ফূর্তিতে মানসিক বৃত্তি পুর্ণ-পরিস্ফুট হয়েছিল, আর কোন দেশ জীবন-সমস্যার কঠোর প্রতিজ্ঞার প্রথম সমাধানে সমর্থ হয়েছিল, এবং সেই সমাধানে প্লেটো ও কান্ট প্রমুখ পাশ্চাত্য দার্শনিকগণের গবেষণাও প্রতিহত হয়ে আছে, তাহলে, আমি দেখিয়ে দিব-সে দেশ এই ভারতবর্ষ! যদি কেউ আমায় জিজ্ঞাসা করেন আমাদের ইহলৌকিক ও পারলৌকিক জীবন সুগঠিত করবার জন্য পৃথিবীর কোন দেশের কোন ভাষা হতে প্রকৃত তথ্য সংগ্ৰহ করতে পারি; প্রধানতঃ আমরা গ্রীক, রোমান এবং সেমিটিক-জাতীয় ইহুদীদের কাছে শিক্ষাপ্রাপ্ত হলেও, নিঃসঙ্কোচে দেখিয়ে দিব-তাও এই ভারতবর্ষেরই! কি ভাষা, কি ধৰ্ম, কি পুরাতত্ত্ব, কি দর্শনশাস্ত্র, কি বিধি-বিধান, কি আচার-ব্যবহার, কি আদিম শিল্প ও আদিম বিজ্ঞান মানুষ যে বিষয়ই অধ্যয়ন করতে অভিলাষী হন না কেন, মানব-জাতির ইতিহাসের সারভূত, শিক্ষাপ্রদ এবং মূলাধান যাবতীয় সামগ্রীই এই ভারতবর্ষে একমাত্র এই ভারতবর্ষের অনন্ত-ভাণ্ডারেই সঞ্চিত রহিয়াছে।” * অধ্যাপক হীরেণ বলেন, “কেবল এশিয়া মহাদেশ বলে নয়, সমগ্র পাশ্চাত্য-ভূখণ্ডের জ্ঞান এবং ধৰ্মের আধারস্থান এই ভারতবর্ষ!”+ মিঃ মারে বলেন, “ভারতবর্ষের মনোহর প্রাকৃতিক দৃশ্যের এবং অপর্যাপ্ত বিবিধ উৎপন্ন দ্রব্যের তুলনা পৃথিবীর কোনও দেশের কোথাও নাই!”++ কর্ণেল টড্ রাজস্থানের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লিখে গেছেন, “গ্ৰীক দার্শনিকগণ যাঁদের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন; প্লেটো, থেলস, পীথাগোরাস প্রভৃতি যাঁদের শিষ্যস্থানীয় ছিলেন; সেই আদর্শ-মনীষিগণের আদি-স্থান কোথায়, বলতে হবে কি? যাঁদের জ্যোতিৰ্বিদ্যার অলৌকিক প্রভাবে আজও ইউরোপ-খণ্ড বিচকিত ও বিমুগ্ধ,-সেই জ্যোতির্বিদ গণের আবাস-ভূমিই বা কোথায় ছিল? যাঁদের স্থাপত্যে-কারুকার্যে আজও আশ্চর্যান্বিত হতে হয়, তাঁরাই বা কোথায় ছিলেন? সেই সঙ্গীত-শাস্ত্র-বিশারদ্গণ-যাঁদের সঙ্গীতের সুধাধারায় কখনও বা আনন্দে অবসাদ আনয়ন করত, আবার কখনও বা অশ্রুধারায় হাস্যস্ফুর্ত্তি-সঞ্চারে সমর্থ হত, তাঁরাই বা কোন্ দেশে অবস্থিতি করতেন? $ সকলেরই আদিভূত এই ভারতবর্ষ নয় কি? কাউন্ট জোর্ণস জার্ণা বলেন, “ভারতের প্রত্যেক সামগ্রীই অভিনব বৈভব-সম্পন্ন এবং কৌতুহলোদ্দীপক। প্রকৃতি কি যাদুমূর্তি পরিগ্রহ করেই এখানে বিরাজমান রয়েছেন। এক দিকে, মুকুলমুঞ্জুর-পরিশোভিত কি সুন্দর শ্যামল প্রান্তর; অন্য দিকে, তুর্ণদ-প্রবাহ-বিচালিত কি ভীষণ প্রাবৃটের ঘনঘটা! এক দিকে, তুষার-ধবলিত রজত-শুভ্র হিমাচলের কি মহীয়সী মূর্তি; অন্য দিকে, অগ্নিস্রাবী মরু-প্রান্তরের কি শুষ্ক কঠোর ভীষণতা। এক দিকে, হিন্দুস্থানের প্রশান্ত-বিস্তৃত সমতল ক্ষেত্রের কি কমনীয় কান্তি; অন্য দিকে, উন্নত-শীর্ষ গিরিমালার কি অপরূপ গম্ভীর প্রকৃতি! এক দিকে, অতীত ইতিহাসের অনন্ত জীবন; অন্য দিকে, কবিত্বের পুষ্পপরাগে অতীতের অমল-স্মৃতি” ॥ এইরূপ কত জনের কত কথা উল্লেখ করব? যারাই নিরপেক্ষভাবে ভারতের তত্ত্ব আলোচনা করেছেন, ভারতের শ্রেষ্ঠত্ব-সম্বন্ধে তাঁরা সকলেই একবাক্যে এই কথারই প্রতিধ্বনি করে গেছেন। সার উইলিয়ম জোন্স, অধ্যাপক এইচ এইচ উইলসন, মিঃ কোলব্রুক, মিঃ পোকক্, সার উইলিয়ম হামিণ্টন, মিসেস ম্যানিং প্রভৃতি পাশ্চাত্য পণ্ডিতগণের সকলেরই প্রায় এ সম্বন্ধে এক মত।
- “If I were to look over the whole world to find out the country most richly endowed with all the wealth, power, and beauty that nature can bestow—in some parts a very paradise on earth—I should point to India. &c., &c.”—Maxmuller’s India: What can it teaches us.
- “India is the source from which not only the rest of Asia but the whole western world derived their knowledge and their religion.”—Prof. Heeren, Historical Resarches. Vol II.
++ Murray’s History of India.
$ Colonel Tod’s Rajasthan,
॥ Count Björnstjerna—Theogony of the Hindus.
ভারতীয় সভ্যতার অবিচ্ছিন্নতা-
ভারতবর্ষের সভ্যতা কত কাল অব্যাহত, তার ইয়ত্তা হয় না। ভারতীয় সভ্যতার দীর্ঘ-জীবনের বিষয় চিন্তা করলেও বিস্মিত হতে হয়। উন্নতির উচ্চ-চুড়ায় আরোহণ করে, ভারতবর্ষ কত জাতির কতরূপ উত্থান-পতন দর্শন করল;– তার চোখের সামনে কত নুতন জাতির নুতন সাম্রাজ্যের অভ্যুদয় ও অবসান হল;–জলবুদবুদের ন্যায় কত জাতি কত সাম্রাজ্য উদ্ভূত হয়েই আবার কালসাগরে বিলীন হল; কিন্তু ভারতবর্ষের আর্য-হিন্দুজাতির কখনই ক্রমভঙ্গ হয় নাই;–তাঁদের ধৰ্ম, সমাজ ও সভ্যতার মৌলিকত্ব চিরদিন অটুট রয়েছে। সেই প্রণব-ধ্বনি-আজও আৰ্য-হিন্দুর প্রাণে প্রাণে প্রতিধ্বনিত! সেই ব্রহ্মণ্য-গৰ্ব-আজও এক প্রান্ত হতে অপর প্রান্ত পৰ্যন্ত সৰ্বত্র পরিদৃষ্ট! সেই সমাজ, সেই ধৰ্ম, সেই আচারব্যবহার, সেই রীতি-নীতি-পদ্ধতি আজও অবিচ্ছিন্নভাবে বিরাজমান! সেই শাস্ত্র, সেই বেদবেদাঙ্গ, সেই ব্রত, যাজ্ঞবল্ক্য, সেই পিতৃ-পরিচয় সেই সবই রয়েছে! এমন ক্রমপর্যায় বুঝি পৃথিবীর আর কোথাও নাই কোন জাতিরই নাই! দৃষ্টান্ত কি আর দিব? প্রাচীন মিশর, মানলাম, খৃষ্ট-জন্মের কয়েক হাজার বৎসর পুৰ্বে সভ্য-সমুন্নত বলে প্রতিষ্ঠালাভ করেছিল! কিন্তু অনন্ত কাল-সাগরে সে কয়দিন মাত্র! এখন, কোথায় সেই জাতি? কোথায় তাদের সেই প্রাচীন ধৰ্ম? কোথায় তাদের সেই প্রাচীন ভাষা-সাহিত্য? কয়েকটি মাত্র ‘পীরামিড’ প্রস্তরলিপি প্রভৃতি দেখে এখন তাদের অস্তিত্ব নির্ণয় করতে হচ্ছে! প্রাচীন রোম, খৃষ্টজন্মের সাড়ে সাত শত বৎসর পূৰ্বে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। কিন্তু তারই বা এখন কি ক্রমপর্যায় বিদ্যমান আছে? খৃষ্টজন্মের পাঁচ শত বৎসর পূৰ্বে পুরাবৃত্তে গ্রীস-দেশ উচ্চ-আসন লাভ করে। কিন্তু সেই গ্রীসেরই বা এখন সে পরিচয়-সম্বন্ধ কি আছে? ফিনিসীয়, কার্থেজীয়, বাইজেণ্টাইন এবং যুর প্রভৃতি প্রাচীন জাতি ভূমধ্য-সাগরের উপকূল-ভাগে কয়দিন পূৰ্বে কি প্রভাবই বিস্তার করে ছিল! কিন্তু তাদেরই বা কি পরিচয়-চিহ্ন এখন খুজে পাই? এরকম পৃথিবীর যে জাতির ইতিবৃত্তই অনুসন্ধান করি না কেন, দেখতে পাই, সকল জাতিরই ক্রম-পৰ্যায় ভঙ্গ হয়েছে; কেবল ভারতীয় আর্য-হিন্দুগণ আজ পৰ্যন্ত আপনাদের পিতৃপুরুষের পরিচয়-চিহ্ন অব্যাহত রেখে এসেছেন। বিপ্লবের কত প্রবল প্রবাহ ভারতবর্ষের উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে গেছে; কত বৈদেশিক জাতির কত ভীষণ আক্রমণে ভারতবর্ষ কত সময় বিপৰ্যস্ত হয়েছে, তার পবিত্র দেবমন্দির কলুষিত, দেবদেবী চুর্ণীকৃত, শাস্ত্রগ্রন্থ ভস্মীভূত,-কত অত্যাচারই তার উপর দিয়ে চলেছে; কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, তথাপি হিন্দুজাতির ক্রমভঙ্গ হয় নাই। সৃষ্টির আদিকালে যে ব্রাহ্মণ যে প্রণবধ্বনি উচ্চারণ করে আত্ম-পরিচয় দিয়ে এসেছেন, আজও সেই ব্ৰাহ্মণ সেই প্ৰণব-মন্ত্র উচ্চারণ করেই আত্ম-পরিচয় প্রদান করতে সমর্থ রয়েছেন।
তুমি যখনই জিজ্ঞাসা করবে, “ব্রাহ্মণ! তুমি কত দিনের?” তাঁর সেই একই উত্তর অনন্ত কাল হতে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে, “যাবচ্চন্দ্রসূৰ্য মহীতলে।” এমন পরিচয়, পৃথিবীর কোন ও জাতির নাই, থাকতে পারে না, থাকাও সম্ভবপর নয়। সৃষ্টির আদিকাল হতে যে ব্রাহ্মণ যেরূপ তেজোগৰ্বে বিরাজমান ছিলেন, আজও সেই ব্রাহ্মণ সেইভাবেই আপন প্রতিষ্ঠা রক্ষা করে আসছেন। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের তুলনায়, ভারতবর্ষের এটাই অলৌকিকত্ব!
প্রাচীনত্বে ভারতের শীর্ষস্থান।
আর অলৌকিকত্ব-তার প্রাচীনত্বে। অন্য জাতির কল্পনায়ও যা আসে না, ভারতবর্ষের প্রাচীনত্ব তত কালের। পৃথিবী-সৃষ্টির ইতিহাসে পাশ্চাত্য পণ্ডিতগণের কল্পনা কয়েক হাজার বৎসর মধ্যেই নিবদ্ধ আছে। বাইবেলোক্ত সৃষ্টিতত্ত্বের ইতিহাস আলোচনা করলে, যদিও হিব্রু, সামারিটান, সেপ্টুয়াজিণ্ট প্রভৃতির মধ্যে মতানৈক্য দেখা যায়, কিন্তু তথাপি কেউই খৃষ্টজন্মের ছয় সাত সহস্ৰ বৎসরের অধিক পূৰ্বে পৃথিবী-সৃষ্টির কল্পনা মনোমধ্যে স্থান দিতে পারেন নাই। হিব্রু-মতের অনুবর্তী হয়ে, আয়লণ্ডের পাদরী উষার খৃষ্ট-জন্মের ৪০০৪ বৎসর পূৰ্বে এই পৃথিবীর সৃষ্টি হয়েছিল বলে সিদ্ধান্ত করে গেছেন। ইউরোপের অনেকেই এখনও পৰ্যন্ত উষারের সেই মতই প্রকৃষ্ট বলে মান্য করেন। কোনও কোনও প্রাশ্চাত্যপণ্ডিতের মতে—উষারের গণনা অবশ্য প্রমাদ-শূন্য নয়। তারা বলেন,-“মিশর-দেশই পৃথিবীর সভ্যতার আদিক্ষেত্র। মিশর-দেশে প্রথম যে রাজা রাজত্ব করেছিলেন, তিনি খৃষ্ট-জন্মের ৫৮৬৭ বৎসর পূৰ্বে বিদ্যমান ছিলেন। সে রাজার নাম মেনেস। তিনি মেনেথো বা “টিনাইট থেবাইন’ নামক আদিবংশের প্রতিষ্ঠিতা । গির্জে পীরামীডের প্রতিষ্ঠাতা মিশরের অন্যতম প্রাচীন রাজা সুফির রাজত্বকালের দুই হাজার বৎসর পূৰ্বে মেনেস আবিভূত হয়েছিলেন।” মেনেসের রাজত্বকাল সম্বন্ধে আরও অবশ্য নানা মত প্রচলিত আছে; বুধের মতে ৫৭০২ পূৰ্ব-ধৃষ্টাব্দে, বুন্সেনের মতে ৩৬৪৩ পুৰ্ব-খৃষ্টাব্দে, লেপসিয়সের মতে ৩৮৯২ পূৰ্ব-খৃষ্টাব্দে, হেনরীর মতে ৫৩০৫ পূৰ্ব-খৃষ্টাব্দে, সার্পের মতে ২০০০ পূৰ্ব-খৃষ্টাব্দে, নোলানের মতে ২৬৭৩ পূর্ব্ব-খৃষ্টাব্দে, এবং পুলের মতে ২৭১৭ পূৰ্ব খৃষ্টাব্দে; ইত্যাদি। * ফলতঃ, পাশ্চাত্য পণ্ডিতগণের মতামত ভিত্তি-স্বরূপ গ্রহণ করলে, খৃষ্ট-জন্মের ছয় সাত সহস্ৰ বৎসরের অধিক কাল পূৰ্বে পৃথিবী-সৃষ্টির কল্পনা কখনই মনোমধ্যে স্থান দেওয়া যেতে পারে না –পাশ্চাত্য-পণ্ডিতগণ উহার অধিক পূৰ্বের কোনও কথাই উল্লেখ করতে সমর্থ হন না। মিশরের পৌরাণিক তত্ত্ব আলোচনা করলে, মেনেসের পূৰ্বে মিশর-দেশের অবস্থা কেমন ছিল, তার কিঞ্চিৎ আভাস পাওয়া যায়। সেই পুরাতত্ত্বে প্রকাশ,—“মেনেস, মিশরের আদি-রাজা বটে; কিন্তু তার পূৰ্বে চারি হাজার বৎসর কাল সেমি-গড’ বা উপদেবতাগণ এবং তৎপূৰ্বে বিশ্বকৰ্ম, সূৰ্য, শনি, বায়ু, রাহু, কেতু প্রভৃতি দেবতাগণ তথায় রাজত্ব করতেন। দেবতাদের ১৩ হাজার ৯০০ শত বৎসর রাজত্বের প্রাচীনত্বে ভারতের শীর্ষস্থান।
*জেম্স্ উষারের (James Usher) “Annals of the old and New Testament”, “Chamber’s Encyclopedia”, or “Theogony of the Hindus” প্রভৃতি গ্রন্থ দ্রষ্টব্য।
এরপর, উপদেবতাগণ রাজ্যলাভ করেন।” * এই পৌরাণিক সিদ্ধান্ত মান্য করে, নিলেও, কোনক্রমেই খৃষ্ট-জন্মের চব্বিশ হাজার বৎসর পূৰ্বের কল্পনা মনোমধ্যে জাগতে পারে না। কিন্তু তারতবর্ষের সভ্যতা, ভারতবর্ষের গৌরব-গরিমা, ভারতবর্ষের অতীত-স্মৃতি কত অনন্তকালের ্সাথে বিজড়িত রয়েছে, তা স্মরণ করলেও চমকিত হতে হয়। যেদিন হতে ভারতবর্ষের অধঃপতনের সুত্রপাত হয়, কুরুক্ষেত্রের রণক্ষেত্রে পাণ্ডবকৌরবের ঘোর-সমরে ভারতের গৌরব-রবি যেদিন অস্তমিত হন, সেও আজ কত কালের কথা! বৰ্তমান বৈবস্বত মন্বন্তরের আটাশ চতুর্যুগের অন্তর্গত যে কলিযুগ, সেই কলিযুগেরই এখন ৫০১০ বৎসর অতীত-প্রায়। * কুরুক্ষেত্র সমর ঘদি উক্ত চতুর্যুগান্তর্গত ত্রেতা ও কলির সন্ধিস্থলে সংঘটিত হয়ে থাকে, তাহলেও, হিন্দুগৌরবের অবসানের দিন এসেছে,-সেও প্রায় পাঁচ হাজারের অধিক বৎসর অতীত হতে চলল। সুতরাং হিন্দু জাতির সভ্যতা যে তারও কত পূৰ্বের, সহজেই প্রতীত হয় না কি ? কাল অনন্ত; সংসার-অনন্তকাল। গণনাঙ্কের গণ্ডী-বন্ধনে, কে বলো, অনন্তকে আয়ত্ত করতে পারে? পৃথিবীর অন্য জাতি সেই অনন্ত কাল-প্রবাহকে সীমাবদ্ধ করতে প্রয়াসী হলেও, আর্য-হিন্দুগণের প্রস্ফুট মস্তিষ্ক কিন্তু তার স্বরূপ-তত্ত্বই প্রকাশ করে গেছেন। কাল অনাদি, সৃষ্টি অনাদি, ব্রহ্মাণ্ড অনাদি, প্রাণিপর্যায় অনাদি, সৃষ্টিকর্ত্তা অনাদি,- আৰ্য-হিন্দু ব্যতীত কে তা নির্ণয় করতে সমর্থ হয়েছেন? অনাদি ঈশ্বর, অনাদি কাল, ওতঃপ্রোতঃ বিরাজমান আছেন, এই সংসার তারই অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বা অভিব্যক্তি মাত্র, এ নিগূঢ় তত্ত্ব যারা ব্যক্ত করে গেছেন, তাঁরা কখনই, মৃগমদানুসন্ধিৎসু বিভ্রান্ত মৃগের ন্যায়, পৃথিবীর জন্মদিন অনুসন্ধানের জন্য ইতস্ততঃ ঘুরে বেড়ান নাই। তাঁরা বুঝতেন, পৃথিবী অনন্তকাল বিরাজমান আছে, পৃথিবী অনন্তকাল বিরাজমান থাকবে; মহাসাগরে জলবুদবুদের ন্যায় স্বল্প-সামগ্ৰী-প্রাণিপৰ্যায় তাতেই উৎপন্ন হয়ে তাতেই বিলীন হবে। বলা বাহুল্য, সেই অনন্তত্ব ধারণার দৃঢ়-ভিত্তির উপরই পরবর্তিকালে শাস্ত্রে ও পুরাণ ইতিহাসে যুগযুগান্তরাদির একটি সীমা-পরিমাণ নির্দিষ্ট হয়ে আছে। কিন্তু সে সীমা-পরিমাণও অধুনাতন মানুষের ধারণ-শক্তির অতীত বললেও অত্যুক্তি হয় না। যেহেতু, তদ্বারাও প্রতিপন্ন হয়-ভারতবর্ষের সভ্যতা অন্যুন এক শত সাতানব্বই কোটি বৎসর পূৰ্বে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। *
*পাশ্চাত্য জাতিদের ভাষায় মিশর দেশের সেই দেবগণের নাম এরকম লেখা হয়েছে,— Vulcan or Ptah, Helios the Sun or Ra, Saturn or Seb ইত্যাদি।
প্রত্যেক শুভ অনুষ্ঠানে এবং তীৰ্থকৃত্যের সময় হিন্দুমাত্রকেই একটি সঙ্কল্প-মন্ত্র উচ্চারণ করতে হয়। সে সঙ্কল্প মন্ত্র এই,- “ওঁ তৎসৎ শ্রীব্রহ্মণো দ্বিতীয়প্রহরার্দ্ধে বৈবস্বতে মন্বন্তরেরহষ্টাবিংশতিতমে কলিযুগে কলিপ্রথমচরণে আর্যাবর্ত্তান্তরৈকদেশে অমুক-নগরে অমুক-সংবৎসরায়ণর্ত্তু মাসপক্ষদিননক্ষত্রমুহুর্ত্তেহত্রেদং কার্যং কৃতং ক্রিয়তে বা।”
বলা বাহুল্য, কালভেদে, দেশভেদে, মাসভেদে, ঋতুভেদে এই মন্ত্রের বিশেষ বিশেষ বিশেষ শব্দের পরিবর্তন হয়ে থাকে। যা হোক, এই মন্ত্রানুসারে বুঝতে পারা যায়—এখন বৈবস্বত মন্বন্তরের অন্তর্গত অষ্টাবিংশতি কলিযুগ চলছে। অর্থাৎ, পূর্ববর্তী ছয় মন্বন্তরের(৭১x৬)৪২৬ চতুর্যুগ এবং বর্তমান মন্বন্তরের সপ্তবিংশ চতুর্যুগ অতীত হয়ে অষ্টাবিংশতি চতুর্যুগেরও সত্য-ত্রেতা-দ্বাপরান্তে কলিযুগের ৫০১০ বৎসর চলে গেছে।
এই বিষয় একটু বিশদভাবে বুঝার আবশ্যক হলে, জানতে হয়—শাস্ত্রে পৃথিবীর কারণ ও লয় দুই অবস্থার বিষয় বলা আছে। সেই দুই অবস্থারই নামান্তর ‘ব্রহ্মদিন’ ও ‘ব্রহ্মরাত্রি’। সহস্র চতুর্যুগে(দিব্যযুগে) একটি ব্রহ্মদিন হয়; এবং সেই ব্রহ্মদিনের পরিমাণ-৪৩২ কোটি বৎসর। যথা,- “শতংতেহযুতংহায়নান্দ্বেযুগে ত্রিণি চত্বারি কৃন্মঃ।”—অথৰ্ববেদ। ব্ৰহ্মদিন আবার চতুর্দশ মন্বন্তরে এবং এক এক একটি মন্বন্তর আবার একসপ্ততি চতুর্যুগে বিভক্ত। যথা,- “যুগানাং সপ্ততি সৈকা মন্বন্তরমিহোচ্যতে।”-সূর্যসিদ্ধান্ত। “ষৎপ্রাগ, দ্বাদশ সহস্রমুদিতং দৈবিকং যুগং। তদেক সপ্ততি গুণং মন্বন্তরমিহোচ্যতে ॥”-মনু। এক্ষণে বৈবস্বত মন্বন্তর অর্থাৎ সপ্তম মন্বন্তর চলছে। পূৰ্বে বলা হয়েছে-৭১ চতুর্যুগে একটি মন্বন্তর হয়। এক একটি চতুর্যুগে ১২ সহস্ৰ দিব্যবৰ্ষ বা ৪৩ লক্ষ ২০ সহস্ৰ সাধারণ বর্ষ। দিব্যবর্ষের পরিমাণ-সম্বন্ধে ‘সূর্যসিদ্ধান্তের’ গগনা এই,— “তদ্দাদশ সহস্রাণি চতুর্যুগমুদাহৃত। সূৰ্যাব্দসংখ্যয়া দ্বিত্রিসাগরৈরযুতাহতৈঃ ॥ সন্ধ্যা সন্ধ্যাংশ্সাথেং বিজ্ঞেয়ং তচ্চতুর্যুগং। যুগস্য দশমো ভাগশ্চতুস্ত্রিদ্ব্যেক সংগুণঃ। ক্ৰমাৎ কৃতযুগাদীনাং ষষ্ঠাংশঃ সন্ধ্যয়োঃ স্বকঃ ॥” ইহার তাৎপর্যার্থ এই যে, সত্যযুগে ৪৮০০, ত্রেতাযুগে ৩৬০০, দ্বাপরযুগে ২৪০০ এবং কলিযুগে ১২০০ দিব্যবর্ষ আছে। মনু বলেন,-৩৬০ সাধারণ বৎসরে এক দিব্যবর্ষ হয়। সে হিসাবে সত্যযুগে ৪৮০০ দিব্যবর্ষ বা ১৭ লক্ষ ২৮ হাজার সাধারণ বর্ষ, ত্রেতাযুগে ৩৬০০ দিববর্ষ বা ১২ লক্ষ ৯৬ হাজার সাধারণ বর্ষ, দ্বাপরযুগে ২৪০০ দিব্যবৰ্ষ বা ৮ লক্ষ ৬৪ হাজার সাধারণ বর্ষ এবং কলিযুগে ১২০০ দিব্যবর্ষ বা ৪ লক্ষ ৩২ হাজার সাধারণ বর্ষ আছে। তাহলেই বুঝা যায়, এক একটি মন্বন্তরে ৪৩,২০,০০০৭১=৩০,৬৭,২০,০০০ বৎসর। পূর্বে বলা হয়েছে, এক্ষণে সপ্তম মন্বন্তর চলছে। সে হিসাবে, ছয় মন্বন্তরের ১,৮৪০,৩২০,০০০ বৎসর এবং বর্ত্তমান মন্বন্তরের সপ্তবিংশতি চতুর্যুগ(৪৩,২০,০০০*২৭=১১,৬৬,৪০,০০০ বৎসর) ও অষ্টাবিংশতি চতুর্যুগের অতীত-কাল (৩৮,৯৩,০১০ বৎসর) অতীত হয়ে গিয়াছে; অর্থাৎ, সৰ্বসাকুল্যে ১৯৬ কোট ৮ লক্ষ ৫৩ হাজার বৎসর কাল অতীত হয়েও এখনও একটি ব্রহ্মদিন পূর্ণ হয় নাই। তবেই বুঝুন, পৃথিবী-সৃষ্টির ইতিহাস কোন্ অনন্ত কাল-সাগরে ভাসমাস রয়েছে! এতেই প্রতিপন্ন হয় না কি-পাশ্চাত্য-কল্পনাই পৃথিবী-সৃষ্টির কত পূৰ্বে ভারতবর্ষের সভ্যতালোকে কি দিব্যজ্যোতি প্রকাশ পেয়েছিল।
প্রাচীননত্বে পাশ্চাত্য পণ্ডিতগণ।
সত্য-ত্রেতা-দ্বাপর অতি-দুর অতীতের কথা বিস্মৃতির অন্ধতম গর্ভে নিমজ্জিত রেখেও আদি কেউ নিরপেক্ষভাবে ভারতবর্ষের প্রাচীনত্ব-বিষয়ে পৰ্যালোচনা করেন, কি পাশ্চাত্য, কি প্রাচ্য, যিনিই হোন না কেন, তিনিই বা কি সিদ্ধান্তে উপনীত হন ? এতৎ প্রসঙ্গেও কয়েক জন পাশ্চাত্য-পণ্ডিতের গবেষণার ফল প্রদর্শন করছি। জৰ্মণীর প্রসিদ্ধ প্রত্নতত্ত্ববিৎ পরিব্রাজক কাউন্ট জোর্ণস্-জারণা-পাশ্চাত্য-জগতে যাঁর পাণ্ডিত্য-খ্যাতির অবধি নাই, তিনি পুনঃপুনঃ মুক্তকণ্ঠে বলে গেছেন, “ভারতবর্ষের ধৰ্ম ও সভ্যতার প্রাচীনত্বে পৃথিবীর কোনও জাতিই সমকক্ষতা-লাভে সমর্থ নয়।” * আমেরিকার সুপ্রসিদ্ধ ‘ইয়েল কলেজের’ প্রেসিডেন্ট ষ্টাইল্স, হিন্দুদের রচনাবলীর প্রাচীনত্বের বিষয় আলোচনা করে, বিস্ময়-বিহবল হয়ে, সার উইলিয়ম জোন্স্কে অনুরোধ করেছিলেন, “আদমের ইতিহাস-মূলক আদি-পুস্তকও বোধ হয়, হিন্দুদের নিকট অনুসন্ধান করলে পাওয়া যেতে পারে।”+ খৃষ্টিয় ধৰ্ম-গ্রস্থের মতে ঈশ্বর মনুষ্য-সৃষ্টির প্রারম্ভেই আদম ও ইভকে সৃষ্টি করেছিলেন। কিন্তু ডাক্তার ষ্টাইল্স্, সেই আদম ও ইভের বৃত্তান্ত-কথা হিন্দু-জাতির নিকট সন্ধান নেওয়ার জন্য অনুরোধ করছেন। তবেই বুঝুন, ভারতীয় হিন্দু-জাতির প্রাচীনত্ব-বিষয়ে তাঁর মনে কি ধারণাই না উদিত হয়েছিল! হিন্দুজাতির যুগচতুষ্টয়ের বিষয় আলোচনা করতে করতে, সসন্মানে মস্তক অবনত করে, মিঃ হালবেড বলেছেন,-“সে তুলনায় বাইবেলের সৃষ্টি-তত্ত্বকে কলাকার ঘটনা বললেও অত্যুক্তি হয় না।”++ প্রসিদ্ধ ফরাসী-জ্যোতিৰ্বিদ মুসে-বেলির মতে “খৃষ্ট-জন্মের তিন সহস্ৰ বৎসর পূর্বে ভারতবর্ষ জ্যামিতি ও জ্যোতিৰ্বিদ্যায় প্রতিষ্ঠা-লাভ করেছিল।” $ একটা জাতি কতদূর উন্নত হলে, এমন বিদ্যায় পারদর্শী হতে পারে, তা স্মরণ করেও, হিন্দু জাতির প্রাচীনত্ব-বিষয়ে অধুনা বহু পাশ্চাত্য পণ্ডিতের মস্তক বিঘূর্ণিত হতেছে। ‘রাজতরঙ্গিণীর’ অনুবাদক আবুল ফজেল ইতিহাস উল্লেখ কাশ্মীরের রাজগণের রাজত্বকালের পরিমাণ নিৰ্দ্ধারণ করে দেখেছেন, তত্ৰত্য রাজবংশাবলী ৪১০৯ বৎসর ১১ মাস ৯ দিন রাজত্ব করেছিলেন। ভারতবর্ষে ধারাবাহিক ইতিহাস লেখার পদ্ধতি, অনেকাংশে আধুনিক বললেও বলা যেতে পারে। সুতরাং ধারাবাহিক এই ইতিহাস লেখার কত পুৰ্বে এ দেশে সভ্যতা-প্রতিষ্ঠা হয়েছিল—সহজেই অনুমান করা যায়। // অধ্যাপক হীরেণ বলেন, “গ্রীকরাজদূত মেগাস্থিনীস যখন চন্দ্রগুপ্তের রাজসভায় আগমন করেন, তখন তিনি প্রমাণ পেয়েছিলেন, চন্দ্রগুপ্তের পূর্ববর্তী রাজগণ ৬০৪২ বৎসর রাজত্ব করেছিলেন।” মেগাস্থিনীস ভারতবর্ষে এসেছিলেন- খৃষ্ট-জন্মের ৩১৭ বৎসর পূৰ্বে। সুতরাং খৃষ্ট-জন্মের প্রায় সাড়ে ছয় হাজার বৎসর পূৰ্ববর্তী রাজগণের পরিচয়, তাঁর বর্ণনাতেই পাওয়া যায়। তিনি বিদেশী; অল্পদিন মাত্র এদেশে অবস্থান করেছিলেন; সুতরাং এদেশের পুঙ্খানুপুঙ্খ পূৰ্ববৃত্তান্ত সংগ্ৰহ করা তাঁর পক্ষে কদাচ সস্তবপর নয়। চন্দ্রগুপ্তের রাজ-দরবার হতে মোটামুটি তৎকালের যে পরিচয় পেয়েছিলেন, সেটাই তিনি সংগ্রহ করে লইয়া গিয়েছেন। অধ্যাপক ম্যাক্স-ডঙ্কার বলেন,- “স্পেতাম্বস বা ডাইও-নিসাস ৬৭১৭ পূর্ব্ব-খৃষ্টাব্দে সিংহাসনে অধিষ্ঠিত ছিলেন।”* এক্ষণে দেখা যাউক, এই ‘স্প্বতাম্বস’ বা ‘ডাইওনিসাস’ কে ছিলেন! ইহারা দুই ব্যক্তি, কি একই ব্যক্তি দুই ব্যক্তি, কি একই ব্যক্তি দুই নামে পরিচিত হয়েছেন? অধ্যাপক হীরেণ বলেন, “ডাইওনিসাস হতে সান্দ্রোকোটাস (চন্দ্র গুপ্ত) রাজার রাজত্ব-কালের ব্যবধান ৬০৪২ বৎসর।” আবার মেগাস্থেনীস বলেন, “স্পেতাম্বস হতে সন্দ্রোকোটাস রাজার রাজত্বকালের ব্যবধান-৬০৪২ বৎসর।” অধ্যাপক মাক্সডঙ্কার এবং কাউন্ট জোর্ণস-জারণা প্রভৃতির মতেও ঐ দুই রাজার মধ্যে ঐরুপ কাল-বাবধান দেখা যায়। ‘স্পেতাম্বস’ বা ‘ডাইওনিসাস’ যে একই ব্যক্তিছিলেন,-এতে সেটাই প্রতিপন্ন হয়। যদি সেটাই হয়, ঐ ‘স্পেতাম্বস’ বা ‘ডাইওনিসাস’ কে ছিলেন? সংস্কৃত পীতাম্বর’ এবং ‘দীনেশ’ বা ‘দানবেশ’ ঐ দুই শব্দের রূপান্তরে পাশ্চাত্য-ভাষায় ঐ স্পেতাম্বস’ এবং ডাইওনিসাস’ শব্দের উৎপত্তি হয়েছে বলেই মনে হয়। ‘চন্দ্র গুপ্ত’ নাম যখন ‘সান্দ্রোকোটাস’ হতে পারেন, তখন পীতাম্বর এবং দীনেশ (দানবেশ) যথাক্রমে স্পেতাম্বস বা ডাইওনিসাস হওয়া অসম্ভব নয়। বিশেষতঃ, ইংরেজি গ্রন্থেই আমরা দেখতে পাই, পাশ্চাত্য-পণ্ডিতগণ বলরামকে বেলস’ এবং শ্ৰীকৃষ্ণকে ‘ডাইওনিসাস’ বলে উল্লেখ করে গেছেন। * এটাই অনেকে যুক্তিযুক্ত বলে মনে করেন। বিশেষতঃ কলিযুগের কাল-পরিমাণ হিসাব করলেও দেখা যায়, শ্ৰীকৃষ্ণ ঐ সময়েই বিদ্যমান ছিলেন। ফলতঃ, ‘স্পেতাম্বস’ এবং ‘ডাইওনিসাস’ যে শ্ৰীকৃষ্ণকেই বুঝাইত, তাঁর পীতাম্বর ও দানবেশ নাম পাশ্চাত্য-জাতির উচ্চারণে বিকৃত হয়েই যে ঐ আকার ধারণ করে আছে, তাতে কোনই সংশয় থাকতে পারে না। অধ্যাপক ম্যাক্সডঙ্কার যুধিষ্ঠিরের কাল-নির্ণয় প্রসঙ্গে বলেন, “বিক্রমাদিত্যের রাজত্বের ৩০৪৪ বৎসর পূৰ্বে অর্থাৎ প্রায় ৩১০০ পূৰ্ব-খৃষ্টাব্দে যুধিষ্ঠির বিরাজমান ছিলেন।” যদিও এ সকল সিদ্ধান্ত প্রমাদ-শূন্য নয়, তথাপি কেউই যে ভারতের প্রাচীনত্ব-বিষয়ে দ্বিধা করতে পারেন নাই, তা দেখানোর জন্যই এতৎ প্রসঙ্গের অবতারণা করলাম। ‘দেবীস্থান’-গ্রন্থে প্রমাণ পাওয়া পাওয়া যায় “প্রায় আট হাজার বৎসর পূৰ্বে ভারতবর্ষে সভ্যতার উজ্জ্বল আলোক বিকীর্ণ হয়েছিল।” কত দেখাব? ভারতের প্রাচীনত্ব-সে যে স্বতঃসিদ্ধ! -সে কি আর প্রমাণ, করবার প্রয়োজন হয়? আর তাই বলছিলাম, পৃথিবীর ইতিহাসে ভারতবর্ষ শীর্ষস্থান অধিকার করে আছে!
*“No nation on earth can vie with the Hindus in respect of the antiquity of their civilization and the antiquity of their religion.”— Theogony of the Hindus.
Ward’s Mythology mentioned in the Hindu Superiority.
++” To such antiquity the Mosaic creation is but as yesterday.”
$ M. Bailly’s History of Astronomy-Histoire del’ Astronomie Ancienne. ফরাসীরাজ চতুর্দ্দশ লুইর রাজত্বকালে, ১৬৮৭ খৃষ্টাব্দে, শ্যামদেশে দূত-প্রেরণে এবং ভারতবর্ষের কর্ণাট প্রদেশের জ্যোতির্ব্বিদ ব্রহ্মণগণের নিকট হতে গণনাঙ্কের যে পদ্ধতি সংগৃহ করা হয়েছিল, তাহা আলোচনা করে বেলি বুঝিতে পারেন, ব্রাহ্মণ জ্যোতির্ব্বিদগণ ৪৩৮৩ বৎসরের যে গণনা নির্দ্ধারণ করে রেখেছিলেন, তা সম্পূর্ণ বিজ্ঞানসম্মত। বলা বাহুল্য, সেই ব্যাপার দর্শনেই ভারতীয় সভ্যতার প্রাচীনত্ব-সম্বন্ধে বেলির মনে দৃঢ় ধারণা জন্মেছিল।
বর্তমান কালে যে প্রণালীতে ইতিহাস লেখা হয়, প্রাচীন ভারতের ইতিবৃত্তে সে প্রণালী অবলম্বিত হয় নাই, এটা নিঃসন্দেহ। তবে উচ্চ সভ্যতার পরিচয়-চিহ্ন যে ইতিহাস, ভারতীয় সাহিত্যে সে ইতিহাস বহুকাল হতেই লিপিবদ্ধ হয়ে! এসেছে। যথাস্থানে সে প্রসঙ্গ উত্থাপনে প্রয়াস পাব।
*Max Dunker’s History of Antiquity. Vol. FV.Historical Researches. Vol. II.
++ মিঃ গ্রাউস (Mr. Growse) মথুরা-জেলার বিবরণী-গ্রন্থে এই কথাই লিখে গেছেন। তাঁর সুদ্ধান্তে প্রতিপন্ন হয়, -বলরাম ‘বেলাস’ (belus) এবং শ্রীকৃষন ‘ডাইওনিয়াস’ (Dionysius) নাম গ্রহণ করে আছেন। Mr. Growse’s Memoirs of Mathura District.
You must be logged in to post a comment.