মীরা চরিত


imagesA6BAKVYC

ভারতের এক প্রান্তে রাজস্থানে ক্ষেত্রে মারবাড় নামে প্রদেশ, নিজেদের উদারতা, সরলতা আর ভক্তি জন্য খুব প্রসিদ্ধ ছিল। মারবাড়কে শাসক দুদা সিং বড় প্রতাপী রাজা ছিল ।ওনার চর্তুথ পুত্র রতনসিংজী আর উনার পত্নী বীর কুংবরীজী জন্মগ্রহন করেন মীরা বাই ১৫৬১ (১৫০৪ইং) সালে।
দুদাজী তলবারে যেমন বীর ছিলেন। বৃদ্ধাবস্থায় উনার ছিল প্রবল ভক্তি।পুষ্কর তীর্থ থেকে অধিকাংশ সাধু রাজপরিবারে আমন্ত্রিত হত। পুরা রাজপরিবার সৎসঙ্গের সাগরে অবগাহন করে নিজেদের ধন্য করত।
মীরা দুদাজী হাতে লালন পালন হতে লাগল। মীরা সৌন্দর্য সুষমা অনুপম ছিল। মীরার ভক্তির পথে দুদাজী সাহায্য করত।ছোট্ট মীরা তাঁর দাদু দুদাজী কাছে অনেক ছোট্ট কীর্তন শিখে ছিল। কোন সাধুসন্ত রাজবাড়ি এলে দুদাজীর প্রেরনায় ছোট্ট মীরা আধ আধ ভাষায় কীর্তন শুনাত। আর সাধুরা মীরাকে আর্শীবাদ করত। নিজের বাবার কোলে বসে শান্ত মনে সাধুসন্তের মুখে কৃষ্ণকথা শুনত।
দুদাজীর ভক্তির ছায়ায় ধীরে ধীরে মীরা পাঁচ বছর বয়স হল। একবার মীরা রাজমহলে কাছে এক সাধুর কাছে ভোরবেলা হঠাৎ করে চলে গেল। সাধুজী ঐ সময় নিজে ঠাকুরের পুজা করছিল। প্রনাম করে মীরা ওখানে বসে পড়ল।আর বসে বসে প্রশ্ন করতে লাগল, এই ঠাকুরজী কে ? আপনি কেমন করে ওনার পুজা করেন ? সাধুও আনন্দের সাথে মীরার সকল প্রশ্নের উত্তর দিতে লাগলেন। মীরা বললেন, যদি আপনি আমাকে ঐ মূর্তি দেন,তাহলে আমি ওনার পূজা করতাম এইভাবে। সাধু বলেন, না লালী, নিজের ভগবান কাউকে দিতে নেই। ওটা আমার সাধনার সাধ্য ধন।
মীরা চোখে জল চলে আসল। নিরাশ হয়ে ঠাকুরের দিকে দেখে আর মনে মনে বলল- যদি তুমি নিজের ইচ্ছায় না আস, তোমাকে আমি কোথায় পাব? মীরা আর্তিভরা মনে নিজের মহলে চলে গেল।
mira-bai-1
মীরা পরের দিন সকালে সাধু নিবাসে ঠাকুরজী দর্শনের জন্য পৌঁছাল। মীরা প্রণাম করে একদিকে বসে রইল।
সাধু পুজা সমাপন করে মীরাকে প্রসাদ দিয়ে বলল, লালী, তুমি ঠাকুরজীর দর্শন পেতে চাও।
মীরা কাঁপতে স্বরে বলল- বাবা, এই ঠাকুরজী, তো আপনার সাধনার সাধ্য ধন।
সাধুজী বললেন- এই ঠাকুরের তো তোমার কাছে থাকা উচিত। তোমার সাধনার ধন হয়ে। এই রকম কথা কাল রাতে স্বপ্নে ঠাকুরই বললেন আমাকে এখন মীরাকে দিয়ে দাও। বলতে বলতে বাবাজী কান্নায় ভেঙে পড়লেন।
মীরা আশ্চার্য হয়ে আনন্দিত হয়ে, যেন কান বিশ্বাস করছিল না, বলল- সত্যিই ?
সাধু বাবাজী কষ্ট ভরে কন্ঠে বলল- পুজা তো তুমি দেখলে, আমার মতো স্নান করবে, বস্ত্র পড়াবে আর শৃঙ্গার করবে, খাওয়াবে। আবার আরতিও করবে। সব ভাল করে বুঝিয়ে দিলেন সাধুজী।
মীরা বললেন, আমি তো মন্ত্র জানি না। আপনি যে মন্ত্র বলেন তাও আমি জানি না।
সাধুজী বললেন- লালী মন্ত্র প্রয়োজন নেই। ওরে, এই ঠাকুরজী মনের ভাষা বুঝে। মন্ত্রতে তো বশ হয় না। ওকে বশ করতে হলে ওর সামনে হৃদয় খুলে রাখ। কোনো কিছু লুকাবে না, কিছু লোক দেখানো করবে না। এ দেখতে ধাতু তৈরি কিন্তু ধাতুর না। ও আমাদের মত একজন, আমাদের প্রিয়জন মনে করবে।
মীরা সাধুকে চরণে মাথা রেখে প্রণাম করল আর জনম জনমে ভিখারীর মত আঁচল অঞ্জলি পেতে দিল। সাধুজী নিজের প্রাণের ধন ঠাকুর মীরার হাতে দিয়ে, মীরার মাথায় হাত রেখে গদগদ কন্ঠে আর্শীবাদ দিয়ে বললেন, ভক্তি মহারাণী নিজের দুই পুত্র জ্ঞান ও বৈরাগ্য নিয়ে তোমার হৃদয়ে নিবাস করুক, প্রভু সদা তোমার উপর প্রসন্ন হন।
মীরা ঠাকুরজীকে দুই হাতে বুকে জড়িয়ে ধরল। প্রসন্ন বদনে মহলের অন্তঃপুর এলেন…

75000_108940539296506_918008237_nকৃপণের ধনের মত মীরা ঠাকুরজীকে নিয়ে লুকিয়ে নিজের মার ঘরে চলে এল। ওখানে নতুন চৌকি রেখে ওতে নিজের নতুন ওড়না বিছিয়ে ঠাকুরজীকে বিরাজমান করল। একুট দূরে বসে ঠাকুরজীকে প্রাণভরে দর্শন করতে লাগল। প্রাণ ভিতর থেকে কাঁদতে লাগল।
আজ এমন উপলব্ধি হল, মনে হল পুরো পৃথিবী আজ তুচ্ছ হয়ে গেল। আজ থেকে আপনজন পর হয়ে গেল। মনে হল আজ যে এল প্রাণের ঠাকুর যেন হাসতে হাসতে অাপন হয়ে গেল। যেন সবকিছু এই প্রিয়জনকে ঘিরে, হৃদয় আজ প্রসন্নতা ভরে উঠল মীরার।
মীরা গিরিধারীকে বলছে তুমি এমন করে আমার দিকে দেখছ কেন? আরে আমার তো ভুল হয়ে গেল। আপনি তো ভগবান আর আমি তো আপনাকে ভুল করে তুমি বলে ফেলেছি। থাক, তুমি কত ভাল, স্বয়ং কৃপা করে তুমি সাধুজী কাছ থেকে আমার কাছে চলে এলে। আর আমি যদি কোন ভুল করি, তুমি রাগ কর না, আমাকে বলে দিও। আচ্ছা তোমার মহাত্মাজীর কথা মনে পড়ছে না তো, উনি তো তোমাকে, আমাকে দিতে কান্না করে দিয়েছিলেন। আমি তোমাকে খুব ভালবেসে রাখব,- স্নান করাব, ঘুম পরাব আর এমন সাজাব কি সবাই দেখতে থাকবে। আমি বাবাসা (বাবা) কে বলে তোমার জন্য সুন্দর পোশাক,বিছানা,বালিস তৈরি করে দেব।আমি মাঝে মাঝে তোমাকে ফুলের বাগানে নিয়ে যাবে। আর কখনো কখনো চারভুজানাথ দর্শনে নিয়ে যাব।জান উনি এমন সাজে মনে হয় উনি এখনি বিয়ে করবে, যেন বর সেজেছে। ছোট্ট মীরা সরলভাবে মনের সব কথা ঠাকুরকে, নিজের প্রিয়জন মনে করে বলল। এখন আর মীরা কিছু খাওয়াতে মন নেই, কোন কাজে মন নেই। মা ঠাকুরজী দেখে বলল, মীরা,কি নিজে ঠাকুরজীকে উপবাস রাখবি, কিছু খেতে দে, তুইও সে প্রসাদ পেয়ে নে।
মীরা বলল, আরে, এই কথা তো ভুলে গেলাম। এই বলে মীরা ভোগের ব্যবস্থা করল
মীরার দাদু দুদাজীর হাত ধরে ছোট্ট মীরা তার ঠাকুরজী দর্শন করতে নিয়ে আসল, আর সব কথা বলল দাদুকে।
মীরা বলল- দাদু, সাধুজী নিজে আমাকে ঠাকুরজীকে দিল। সাধুজীকে স্বপ্নে ঠাকুরজী বলল- এখন থেকে আমি মীরার কাছে থাকব।
দুদাজী দর্শন করে প্রণাম করে বলল, ভগবানকে কাঠের চৌকিতে কেন বসালে? আমি কালকে রূপার সিংহাসন আনব।
মীরা বলল- হাঁ দাদু, নরম বিছানা,চাদর, রূপার বাসন আনবে।
দুদাজী বলল- মীরা লালী, সন্ধ্যায় সব চলে আসবে।
মীরা – কিন্তু দাদু, সাধুজী থেকে ঠাকুরজীর নাম জিজ্ঞাসা করতে ভুলে গেছি।
দুদাজী বলল- মানুষের এক নাম হয়। কিন্তু ভগবানের অনেক গুণ, অনেক নাম আছে। তোমার যে নাম প্রিয় লাগে, তুমি সে নামে ডাক।
মীরা বলল- আপনি কিছু নাম বললেন দাদু। আমি শুনি তার থেকে আমি পছন্দ করছি।
দাদু বলল- কৃষ্ণ, গোবিন্দ, গোপাল, মাধব, কেশব, মনমোহন, গিরিধর…
মীরা–বস দাদু, মীরা নেচে উঠল বলল, এই গিরিধর নাম সবচেয়ে ভাল লাগল। এর অর্থ কি? ?
দুদাজী গিরিরাজ ধারনের লীলা শুনাল ভালবেসে।
মীরা ভাবে মুচ্ছিত হয়ে গেল
imagesMAO4I7R0 ছোট্ট মীরা দাদু দুদাজী মুখে গিরিধরে গিরিধারন লীলা শুনে মুচ্ছা হয়ে গেলে, মা ব্যাকুল হয়ে উঠল, নিজের চিন্তার কথা মীরার পিতা রতন সিং কে বলল। মীরার মা বীর কুংবরী চাইত যে মীরা রাজমহলে থেকে অন্য রাজকুমারীদের মত শাস্ত্রাভ্যাস, রাজনীতি, ঘোড়াচালানো,আর গৃহস্থী কাজ শিখে, যাতে শ্বশুড়বাড়িতে প্রত্যেক পরিস্থিতে নিজেকে সামলাতে পারে।
কিন্তু মীরা দাদু দুদাজীর কাছে যোগ আর সংগীত শিক্ষা আরম্ভ করল। মীরার দিনদিন ঠাকুর পূজা নিষ্ঠা বাড়তে লাগল। তা দেখে মীরার মার চিন্তা হতে লাগল। মীরা পুজা আর শিক্ষা ছাড়া যে সময় পেত দুদাজী সাথে বসে শ্রীমদ্ভাগবত শুনত , রাজমহলে যত সাধু আসত , তাঁদের সাথে সৎসঙ্গ লাভ করত। সাধু মীরার মুখে ভক্তিযুক্ত প্রশ্ন শুনে, মীরা প্রতিভা দেখে আশ্চর্য হয়ে যেতেন।
মীরার মা,মীরার এই সাধুসঙ্গ করা, সাধুর সাথে কথা বলা , তাদের সামনে ভজন গান করা মীরার মা পছন্দ করত না, কিন্তু দুদাজীর প্রিয় নাতনী মীরাকে মা কিছু বলতে পারত না।
দুদাজী ভালবাসায় মীরার ভক্তি বাড়তে লাগল। বৃন্দাবনের বাবা বিহারীদাসজীর কাছে মীরা সংগীতের শিক্ষা প্রারম্ভ করল। অন্তরমহলে রানীবাসে সবাই চর্চা করছে- এত রূপে গুণে অপরূপ মীরাকে কেন দুদাজী সাধু বনাছেন ? ?
একদিন মীরা দাদু দুদাজীকে বলল– দাদু, আমার গিরিধারীর জন্য আলাদা ঘর চাই।
দাদু দুদাজী বলল- অবশ্যই দাদুভাই, আমি ব্যবস্থা করব।
পরের দিন মহলের ফুলের বাগানে মধ্যে গিরিধর গোপালের জন্য মন্দির নির্মাণ আরম্ভ করল।
imagesX12P7RBC একদিন মীরা নিজে গিরিধর গোপালের পূজা করে মা- এর পাসে বসে আসে। তখন হঠাৎ বাহিরে গানের আওয়াজ শুনে দৌড়ে বাহিরে গেল। এবং কি হচ্ছে দেখতে দৌড়ে দেখে গেল মীরা।
মাকে ছোট্ট জিজ্ঞাসা করল, মা, এত সেজে এত লোক এত গান করতে করতে কোথায় যাচ্ছে?
মা বললেন- লালী,এটা বরযাত্রী। মীরা বলল- মা বরযাত্রী কি? এত সেজে ঐ হাতিতে কে বসে মা?
মা বলল- ও সে বর, ও দুলহা মীরা, ঐ রাজকুমারীকে বিয়ে করতে এসেছে। আমাদের নগরে শেঠজীর মেয়ের বিয়ে হচ্ছে। মা বরের দিকে তাকিয়ে বললেন।
সব মেয়ের কি বর হয়? সবাইকে বিয়ে করতে দুলহা আসে? মীরা জিজ্ঞাসা করল।
মা বললন, হাঁ লালী, মেয়েদের তো বিয়ে করতেই হয়। মেয়েদের তো বাবার ঘর ছেড়ে যেতে হয়। চল, নীচে গিয়ে দেখি।
মীরা তো অন্যান্য চিন্তায় ছিল, সে বলল- মা, আমার বর কোথায় মা??
তোর বর বললে, মা হাসতে লাগল। আমি কি করে জানব, তোর বর কোথায়, যেখানে বিধাতা লিখেছে, সেখানে যেতে হবে তোকে।
মীরা দৌড়ে, লাফিয়ে জিদ করতে লাগল, আর বলতে লাগল- তুমি বলল মা, আমার বরকে ? এবং মীরা কাঁদতে লাগল।
মা মীরা কি করবে ভেবে না পেয়ে বললেন- (বড় মা) দিদাকে,তা না হলে বাবাকে জিজ্ঞাসা কর।
মীরা মাকে বলল- আমি কাউকে জিজ্ঞাসা করব না, তুমি বলল মা…. বলে মীরা মাটি পড়ে কাঁদতে লাগল।
মা মীরা কান্না থামিয়ে মীরাকে মাটি থেকে তুলে শান্ত করতে করতে বলল-আমি বলছ তোর বরকে, তুই কান্না করিস না। এই দিকে দেখ ? এই কে বলল?
মীরা বলল- এ তো আমার গিরধর গোপাল।
মা বললেন- ওরে পাগলি,এই তো তোর বর। উঠ, কখন থেকে একটা কথা বলছিস।
মীরা খুশি হয়ে আশ্চর্য হয়ে বললেন- সত্যি, মা ।
সত্যি তো বলল, মিথ্যা কেন বলল। যা আমার কাজ আছে বলে মা চলে গেল।
মীরা গিরধর গোপালের দিকে তাকল। মনে হল প্রথমবার আজ দেখছে গিরধরকে। এমন ভাবে তাকাছে মীরা কাঁদতে ভুলে গেল। মা বলা প্রতিটি কথা যেন মীরা ভাগ্যে পরিণত হল। যেন কথা গুলো মীরার জীবনে পরিনত হল।
604117_499982576716078_585707710_nবাকি অংশ পরে। কেমন লাগছে জানি না।
জয় গিরিধরী লাল।