৯। শ্ৰীকৃষ্ণ-সনাতন ধর্মের উদ্ধার কর্তা


শ্ৰীকৃষ্ণ-সনাতন ধর্মের উদ্ধার কর্তা; কেন-না, ধর্ম সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার আদর্শ তিনিই দেখিয়ে গেছেন।
[ধর্ম ও সনাতন ধর্ম; শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাব-কারণ, ধর্ম ও সনাতন ধর্মের পরিচয়-লাভ; কোন্‌ ধর্মের গ্লানি দূরীকরণে শ্রীকৃষ্ণ আবির্ভূত হন, সে ধর্ম বর্ণাশ্রম ধর্ম; অধর্ম-বারণ ও ধর্ম-প্রতিষ্ঠা, শ্রীকৃষ্ণ কর্তৃক কিভাবে তা সংশোধিত হয়েছিল, তার নিদর্শন।]

ধর্ম ও সনাতন ধর্ম
ধর্ম শব্দের ব্যাখ্যায় আমরা প্রতিপন্ন করেছি যে, যা দ্বারা লোক-রক্ষা, সংসার-রক্ষা, সৃষ্টি-রক্ষা, আত্ম-রক্ষা হয়, তাহাই ধর্ম।ভ‘সনাতন ধর্ম’ শব্দের অর্থ নিত্য। সুতরাং ‘সনাতন ধর্ম’ শব্দে যে ধর্ম দ্বারা নিত্যকাল লোক, সৃষ্টি ও আত্ম-রক্ষা হয়ে আসছে, তাহাই বুঝা যায়। এই অর্থের অনুসরণে, কেউ বা সদ্‌গুণ সমূহকে সনাতন ধর্ম বলে কীর্তন করেছেন; কেউ বা, যে কর্ম সৎ ফলপ্রসূ, তাকেই ধর্ম বলে ঘোষণা করে থাকেন। প্রথমোক্ত মতে- অদ্রোহ, অস্ত্যেয়, দম, ব্রহ্মচর্য্য, সত্য, ক্ষমা, ধৃতি, অহিংসা প্রভৃতি ধর্ম মধ্যে পরিগণিত; কিন্তু শেষোক্ত মতে, কর্ম ও অকর্ম, হিংসা ও অহিংসা, উভয়ই ধর্ম মধ্যে পরিগণিত হতে পারে। শ্ৰীকৃষ্ণ নিজ উপদেশ ও কাজে ঐ দুই মতের সামঞ্জস্য সাধন করেছেন। তিনি দেখিয়েছেন, -সনাতন-ধর্মে সকলেরই স্থান আছে, অতিঘৃণ্য নরকের কীট হতে পরম পুরুষ পরাৎপর পর্য্যন্ত সকলেই সনাতন ধর্মের প্রভাব অন্তর্ভুক্ত। ফলতঃ, যে কিছুর সাহায্যে লোক-রক্ষা সৃষ্টি-রক্ষা হতে আত্মরক্ষা অর্থাৎ আত্ম-উৎকর্ষ বা আত্মায় আত্ম-সম্মিলনের পথ প্রশস্ত হয়, তাহাই সনাতন ধর্মের অন্তর্গত। তাই সনাতন ধর্ম রূপ কল্পবৃক্ষে ধর্ম অর্থ কাম মোক্ষ সকল ফলই স্তরে স্তরে সজ্জিত আছে।

শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাবের কারণে-
পৃথিবীতে নানা ধর্ম-মত ও নানা ধর্ম-সম্প্রদায় প্রচলিত অাছে। তার মধ্যে শ্ৰীকৃষ্ণ কোন ধর্ম-মতের অনুসরণ করেছিলেন ও কোন ধর্ম-মত প্রতিষ্ঠায় সমর্থ হয়েছিলেন, আর কেনই বা সে ধর্ম-মত কে সনাতন ধর্ম বলি; তার কয়েকটি তথ্য অনুসন্ধানের চেষ্টা করেছি। তা থেকে বুঝা যাবে, ধর্ম-সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার আদর্শ-প্রদর্শনে শ্ৰীকৃষ্ণ সনাতন ধর্মের উদ্ধার কর্তা বলে প্রখ্যাত আছেন। তিনি বলেছেন,- ধর্ম্ম সংস্থাপনার্থায় সম্ভবামি যুগে যুগে।” যখন ধর্মের গ্লানি উপস্থিত হয়, অধর্মের অভ্যুদয় ঘটে, সাধুদের পরিত্রাণের জন্য এবং দুষ্কৃত জনের দমনের জন্য তাঁর (ভগবানের) আবির্ভাব হয়। এই কারণেই অর্থাৎ সাধুদের পরিত্রাণ ও দুষ্কৃত জনের দমনের জন্যই ভগবানের মর্ত্যে অবতরণ; আর তাতেই অধর্মের অভ্যুত্থান রোধ এবং ধর্মের প্রতিষ্ঠা হয়ে থাকে। অতএব, ভগবদ উক্তিতে তাঁর দেহ-ধারণের চারটি কারণ দেখতে পাই , (ক) ধর্মের গ্লানি, (খ) অধর্মের অভ্যুত্থান, (গ) সাধুদের পবিত্ৰাণ, এবং (ঘ) দুষ্কৃত জনের দমন। এই কারণ-চতুষ্টয়ের প্রত্যেকটির সাথে প্রত্যেকটি সম্বন্ধযুক্ত। অধর্মের অভ্যুদয় নিবারণ হলেই ধর্মের গ্লানি দূর হতে পারে, আবার তাতেই দুষ্কৃতের বিনাশ এবং সাধুদের পরিত্রাণ আপনা-আপনিই সূচিত হয়ে থাকে। অধর্মের অভ্যুত্থান-নিবারণেই দুষ্কৃতের দমন, আর ধর্মের গ্লানি নিবারণে অর্থাৎ ধর্মের সু প্রতিষ্ঠায় সাধুদের পরিত্রাণ। এখন দেখা যাক, গ্লানি হয়েছিল-সে কোন ধর্মের ? যার অভ্যুত্থান হচ্ছিল- তাহাঁই বা কোন অধর্ম ? আরও দেখা যাক, যে দুষ্কৃতের তিনি দমন করেছেন -সেই বা কেমন দুষ্কৃত ? অারও, যে সাধুদের তিনি পরিত্রাণ করেছেন- তাঁরাই বা কি প্রকার সাধু ছিলেন ? এই সকল তথ্য নিষ্কাষণ করতে পারলে, সনাতন ধর্ম-প্রতিষ্ঠায় শ্রীকৃষ্ণের প্রভাব সম্যক ভাবে উপলব্ধি হবে। আমরা এখন একে একে ঐ চারটি বিষয়ের অনুসন্ধান করে দেখছি। তাতে বক্তব্য বিষয় বেশ বোধগম্য হওয়ার সম্ভাবনা।

কোন ধর্মের গ্লানি দূর করার জন্য আবির্ভূত হন ?
প্রথম দেখা যাক, শ্ৰীকৃষ্ণ কোন ধর্মের গ্লানি দূর করবার জন্য, কোন ধর্মের প্রতিষ্ঠা রক্ষা-কল্পে, অবতীর্ণ হন ? শ্ৰীমদ্ভগবদগীতার অস্থি-মজ্জায় দেখতে পাই, সে কোন ধর্মের ধর্ম -বর্ণাশ্রম ধর্ম। তিনি বলেছেন,- “চাতুৰ্ব্বণ্যং ময়া সৃষ্টং গুণকর্ম্মবিভাগশঃ।” চার বর্ণ তারই সৃষ্টি, অর্থাৎ বর্ণাশ্রম ধর্মের তিনিই প্রবর্তক। শারীরিক তপস্যার সংজ্ঞায়ও তিনি বলেছেন, ‘দেবতা, ব্রাহ্মণ, গুরু ও তত্ত্বজ্ঞ সাধুদের পূজা, শৌচ, সরলতা, ব্রহ্মচর্য ও অহিংসা, প্রভৃতি শারীরিক তপস্যা বলে উক্ত হয়।’ (দেবদ্বিজগুরুপ্রাজ্ঞপূজনং শৌচমার্জবম্‌। ব্রহ্মচর্য্যমহিংসা চ শারীরং তপ উচ্যতে।)। এখানেও বুঝা গেল, ব্রাহ্মণ আদির পুজায় বর্ণাশ্রম ধর্মেরই প্রাধান্য কীর্তন করলেন। তারপর ব্রাহ্মণ আদি বর্ণের কর্ম-বিভাগে এবং সে কর্ম অনুসারেই তারা যে সিদ্ধিলাভ করতে পারেন, তা বলেও বর্ণাশ্রম ধর্মেরই মাহাত্ম্য দেখালেন। যথা,-

“ব্রাহ্মণক্ষত্রিয়বিশাং শূদ্রাণাং চ পরন্তপ। কর্মাণি প্রবিভক্তানি স্বভাবপ্রভবৈর্গুণৈঃ॥
শমো দমস্তপঃ শৌচং ক্ষান্তিরার্জবমেব চ। জ্ঞানং বিজ্ঞানমাস্তিক্যং ব্রহ্মকর্ম স্বভাবজম্॥
শৌর্যং তেজো ধৃতির্দাক্ষ্যং যুদ্ধে চাপ্যপলায়নম্। দানমীশ্বরভাবশ্চ ক্ষাত্রং কর্ম স্বভাবজম্॥
কৃষিগোরক্ষ্যবাণিজ্যং বৈশ্যকর্ম স্বভাবজম্। পরিচর্যাত্মকং কর্ম শূদ্রস্যাপি স্বভাবজম্॥
স্বে স্বে কর্মণ্যভিরতঃ সংসিদ্ধিং লভতে নরঃ। স্বকর্মনিরতঃ সিদ্ধিং যথা বিন্দতি তচ্ছৃণু॥
যতঃ প্রবৃত্তির্ভূতানাং যেন সর্বমিদং ততম্। স্বকর্মণা তমভ্যর্চ্য সিদ্ধিং বিন্দতি মানবঃ॥
গীতা ১৮/ ৪১-৪৬।

পূর্বে শ্ৰীভগবান বলেছিলেন,-তিনি গুণকর্মানুসারে চতুর্বণের সৃষ্টি করেছেন। এখন আবার তিনি সেই চতুর্বর্ণের গুণকর্ম নির্দেশ করছেন। সঙ্গে সঙ্গে এটাও বলছেন, এই গুণকর্ম তাদের স্বভাবজঃ অর্থাৎ জন্ম অনুসারেই এই গুণকর্ম তার প্রাপ্ত হয়ে থাকেন। চতুর্বর্ণের সেই গুণকর্ম কি, শ্লোক-কয়েকটিতে তারই পরিচয় আছে। যথা,- ব্রাহ্মণের স্বভাব বিহিত কর্ম-শম অর্থাৎ মনঃসংযম, দম অর্থাৎ বাহ্যেন্দ্রিয় সংযম, তপস্যা, (১) শৌচ অর্থাৎ বাহির অন্তর শুদ্ধি, ক্ষান্তি অর্থাৎ ক্ষমা, আৰ্জব অর্থাৎ সরলতা, জ্ঞান অর্থাৎ বেদ-বেদাঙ্গ আদি শাস্ত্রার্থবোধ, বিজ্ঞান অর্থাৎ মানসিক প্রত্যক্ষ, আস্তিক্য অর্থাৎ ভগবদ্বিশ্বাস। এই সকল হল-ব্রাহ্মণের স্বভাবজঃ গুণ বা কর্ম বা পরিচয়-চিহ্ন। তার পর ক্ষত্রিয়ের কর্ম; যথা-শৌর্য্য, তেজ, ধৃতি, দক্ষতা, যুদ্ধে পলায়ন না করা, ঔদার্য, শাসন ক্ষমতা প্রভৃতি ক্ষত্রিয়ের স্বভাবজ কর্ম। বৈশ্যের কর্ম; যথা-কৃষি, পশুপালন, বাণিজ্য প্রভৃতি বৈশ্যদের স্বাভাবিক কর্ম। আর শূদ্রদের স্বাভাবিক কর্ম; পরিচর্য্যাত্মক। ‘নিজ নিজ কর্মে নিষ্ঠার দ্বারাই মানুষ সিদ্ধি লাভ করে। অন্তর্য্যামী পরমেশ্বর সর্বপ্রাণীর উৎপত্তির মূল এবং সর্বত্র পরিব্যাপ্ত আছেন; সুতরাং নিজ নিজ কর্ম দ্বারাই মানবগণ তাঁকে অর্চনা করে সিদ্ধিলাভ করেন।’ এইখানে নানা আপত্তির কথা উঠে থাকে। যারা বর্ণাশ্রম-ধর্মের বিরোধী, তারা বলেন,- ‘ঐ সকল গুণকর্মের বিচার করে দেখলে ব্রাহ্মণ আদি কোনও বর্ণেরই অস্তিত্ব থাকে না; কারণ, ঐ সকল গুণ এখন কোনও বর্ণেই নেই।’ এই সন্দেহ নিরসনের জন্য শ্রীকৃষ্ণ কি বলে গেছেন, স্মরণ করে দেখুন দেখি! তিনি বলেছেন,- “যার যা ধর্ম, তাই যদি তিনি সম্যকরূপে পালন করতে না পারেন, তাতেও দোষ নেই; বিকৃত অবস্থায় প্রাপ্ত অর্থাৎ বিকৃতভাবে অনুষ্ঠিত স্বধর্মে নিষ্ঠাযুক্ত থেকে মরণ শ্ৰেয়ঃ; তথাপি ধর্মান্তর গ্রহণ করতে নেই। স্বভাববশে অথাৎ জন্ম অনুসারে মানুষ যে ধর্ম প্রাপ্ত হয়, তা দোষযুক্ত হলেও তাই কখনই পরিত্যাজ্য নয়। কর্ম মাত্রই দোষযুক্ত; অগ্নিমাত্রেই ধুম আছে -এই মনে করে, দোষভাগ পরিত্যাগে সার-ভাগ-গ্রহণে (ধূমত্যাগে অগ্নি-গ্রহণের ন্যায়) মানুষ স্বধর্ম-নিষ্ঠ থেকে সিদ্ধির পথে অগ্রসর হোক।’ (২) এই সকল বিবেচনা করলে, শ্ৰীকৃষ্ণ যে বর্ণাশ্রম ধর্ম রক্ষার পক্ষে প্রয়াস পেয়েছিলেন, তা সর্বতোভাবে প্রতিপন্ন হয়। তার পর, তিনি যখন অৰ্জুনকে যুদ্ধার্থ উৎসাহিত করে বলছেন, “তুমি ক্ষত্রিয়; তোমার অন্য ধর্ম নেই, যুদ্ধই তোমার শ্ৰেয়ঃ ধর্ম”; তখন, বর্ণাশ্রম ধর্ম রক্ষার ও তার উপযোগিতার বিষয়ই দৃঢ়তার সাথে উপদেশ দেওয়া হচ্ছে -বুঝা যায় না কি ? এ সম্বন্ধে শ্ৰীকৃষ্ণের উক্তি সর্বথা স্মরণীয়।

“স্বধর্মমপি চাবেক্ষ্য ন বিকম্পিতুমর্হসি। ধর্ম্যাদ্ধি যুদ্ধাচ্ছ্রেয়োহন্যৎ ক্ষত্রিয়স্য ন বিদ্যতে॥৩১
যদৃচ্ছয়া চোপপন্নং স্বর্গদ্বারমপাবৃতম্। সুখিনঃ ক্ষত্রিয়াঃ পার্থ লভন্তে যুদ্ধমীদৃশম্॥৩২
অথ চেত্বমিমং ধর্ম্যং সংগ্রামং ন করিষ্যসি। ততঃ স্বধর্মং কীর্তিং চ হিত্বা পাপমবাপ্স্যসি॥৩৩
অকীর্তিং চাপি ভূতানি কথয়িষ্যন্তি তেহব্যয়ম্। সম্ভাবিতস্য চাকীর্তির্মরণাদতিরিচ্যতে॥৩৪
ভয়াদ্ রণাদুপরতং মংস্যন্তে ত্বাং মহারথাঃ। যেষাং চ ত্বং বহুমতো ভূত্বা যাস্যসি লাঘবম্ ॥৩৫
অবাচ্যবাদাংশ্চ বহূন্ বদিষ্যন্তি তবাহিতাঃ। নিন্দন্তস্তব সামর্থ্যং ততো দুঃখতরং নু কিম্ ॥৩৬
হতো বা প্রাপ্স্যসি স্বর্গং জিত্বা বা ভোক্ষ্যসে মহীম্। তস্মাদুত্তিষ্ঠ কৌন্তেয় যুদ্ধায় কৃতনিশ্চয়ঃ॥৩৭
সুখদুঃখে সমে কৃত্বা লাভালাভৌ জয়াজয়ৌ। ততো যুদ্ধায় যুজ্যস্ব নৈবং পাপমবাপ্স্যসি॥৩৮
গীতা ২/৩১-৩৮।

ক্ষত্রিয়ের এই যে ধর্ম-যুদ্ধ, লাভালাভ জয়-পরাজয় জ্ঞান না করে ক্ষত্রিয় এই যুদ্ধে প্রবৃত্ত হোক; তাতে মরণ হলেও তার মোক্ষ আছে। পূর্ব্বোক্ত বাক্যে শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে তাহাই বুঝিয়ে তাঁকে যুদ্ধার্থ উৎসাহ দিলেন। তবে এখানে একটি কথা বুঝবার আবশ্যক আছে যে, ক্ষত্রিয়ের ধর্ম যে যুদ্ধ, সে যুদ্ধ ধর্মযুদ্ধ; সে যুদ্ধ- রাজদ্রোহ বা উচ্ছৃঙ্খলা নয়। (৩) ফলতঃ, বৰ্ণাশ্রম ধর্ম যে কি, সে ধর্ম কাৰ্য্যতঃ কেমন করে পালন করতে হয়, শ্রীকৃষ্ণ তা তন্ন তন্ন করে প্রকাশ করে গেছেন। বর্ণাশ্রম ধর্ম রক্ষার বিষয়ে তাঁর উপদেশ-পরম্পরা যার বোধগম্য হবে, তিনি নিশ্চয়ই বুঝতে পারবেন,-বর্ণাশ্রম ধর্ম রক্ষার উদ্দেশে যেন তাঁর আবির্ভাব হয়েছিল। বর্ণাশ্রম ধর্ম রক্ষণ হলেই সৃষ্টি-রক্ষা সমাজ-রক্ষণ আত্ম-রক্ষা সব দিক রক্ষণ হবে,-এই উপদেশই যেন তাঁর বাক্যের ও কাজের মধ্যে জীবন্ত পরিদৃশ্যমান রয়েছে। তাঁর ধর্ম-সংস্থাপন উদ্দেশ্যে যে আবির্ভাব, তা সেই বর্ণাশ্রম-ধর্মের সংস্থাপন বলেই প্রধানতঃ মনে হয়। শান্তি সংস্থাপিত হলে, বর্ণাশ্রম ধর্ম রক্ষা পেলে, আত্মরক্ষা বা আত্মোৎকর্ষের পথ আপনিই সুগম হয়ে আসে। বর্ণাশ্রম ধর্মই সনাতন ধর্ম। বেশ বুঝা যায়, সেই ধর্ম রক্ষা করতেই তিনি আবির্ভূত হন।

(১) তপস্যা-কায়িক বাচিক ও মানসিক ভেদে ত্রিবিধ; সাত্ত্বিক রাজসিক ও তামসিক ভেদেও ত্রিবিধ। শারীরিক তপস্যার পরিচয় পূর্বে দেওয়া হয়েছে; ঐ শারীরিক তপস্যা ও অন্যান্য তপস্যার বিষয় গীতার ১৭শ অধ্যায়ে ১৩শ হতে ১৯শ শ্লোকে দেখুন।
(২) এ সম্বন্ধে শ্রীকৃষ্ণের উক্তি; শ্রেয়ান্ স্বধর্মো বিগুণঃ পরধর্মাৎ স্বনুষ্ঠিতাৎ। স্বভাবনিয়তং কর্ম কুর্বন্নাপ্নোতি কিল্বিষম্॥ সহজং কর্ম কৌন্তেয় সদোষমপি ন ত্যজেৎ। সর্বারম্ভা হি দোষেণ ধুমেনাগ্নিরিবাবৃতাঃ॥ এই সকল উক্তি পুনঃ পুনঃ উদ্ধৃত হলেও পুনরুক্তি দোষ ঘটে না। কেন না, এ সকল উক্তি সৎ সংশ্রব যুক্ত।
(৩) অর্জুনকে শ্রীকৃষ্ণ যে যুদ্ধে উৎসাহিত করেছিলেন, সে যুদ্ধ-ধর্মযুদ্ধ। এই খণ্ড পৃথিবীর ইতিহাসে ২১১-২১২ পৃষ্ঠায় শান্তি লাভে রাজভক্তি প্রসঙ্গে তার বিবরণ অনুধাবন করে দেখুন।

অধর্ম বারণ ও ধর্মপ্রতিষ্ঠা
এইবার দেখা প্রয়োজন, শ্রীকৃষ্ণ কোন অধর্মের অভ্যুত্থান নিবারণ করতে আবির্ভূত হয়েছিলেন ? সেই সঙ্গে বুঝা যাবে, দুষ্কৃত জনই বা কেমন বৃদ্ধি প্রাপ্ত হয়েছিল, আর কেমন করেই বা তারা বিধ্বস্ত হয়েছিল? সঙ্গে সঙ্গে আপনা-আপনিই পরিস্ফুট হয়ে আসবে, সাধু-গণই বা পরিত্রাণ পেয়েছিলেন কি প্রকারে ? শ্ৰীকৃষ্ণ প্রসঙ্গে পুর্বে যে সকল বিষয় আলোচিত হয়েছে, প্রকারান্তরে তারই মধ্যে এ সকল প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায়। কংস, জরাসন্ধ, দুর্যোধন, কালযবন, শিশুপাল প্রভৃতি অত্যাচারী নৃপতিবর্গের ক্রিয়াকলাপেই অধর্মের অভ্যুত্থান দেখতে পাই। তারা এবং তাদের পার্শ্বচর গণ দুষ্কৃত জন ভিন্ন আর কোন সংজ্ঞায় অভিহিত হতে পারেন ? সেই দুষ্কৃতজনের দমনে অধর্মের অভ্যুত্থান নিবারিত হয়েছিল; আর যুধিষ্ঠিরের ন্যায় ধর্মপর নৃপতির প্রতিষ্ঠায় সাধু সজ্জন সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন। কুরুক্ষেত্র মহাসমরের কারণ পরম্পরা স্মরণ করলে, আর কি কারণে কুরুপক্ষে পরাজয় অবশ্যম্ভাবী হয়েছিল, তা অনুধাবন করলে, সকল কথারই সদুত্তর পাওয়া যায়। অধিক উদাহরণের আবশ্যক নেই । যে কারণে দূরদর্শী ধৃতরাষ্ট্র কুরুপক্ষের পরাজয় প্রজ্ঞা চোখে প্রত্যক্ষ করেছিলেন, সেই কারণ গুলির বিষয় চিন্তা করলেই মূলতত্ত্ব বোধগম্য হতে পারে। (১) যদি সেই দুষ্কৃত জন তখন ধরণীর অঙ্ক হতে অপসৃত ন হত, তাহলে ধর্ম লোপ পেত; আর যদি যুধিষ্ঠির আদি সাধু সজ্জন সুপ্রতিষ্ঠিত না হতেন, তাহলেও সর্বনাশ ঘটত। পরীক্ষিতের কলি-নিগ্রহ অছিলাতে এই বিষয়টি বেশ বুঝতে পারা যায়। কলির আগমনের পূর্বে বৃষ রূপী ধর্মের সাথে গাভী রূপ ধারিণী ধরিত্রীর যে কথোপকথন হয়, তাতেই ঐ তত্ত্ব বিশদীকৃত। শ্রীকৃষ্ণের বিরহে যখন কলির কুটিল-দৃষ্টি সংসারের প্রতি নিপতিত হয়েছিল, সেই সময় দুঃখ প্রকাশ করে পৃথিবী কয়েকটি বিষয় ধর্মকে জ্ঞাপন করেছিলেন। শ্ৰীকৃষ্ণের আবির্ভাবে সমাজের কি শৃঙ্খলা, সাধিত হয়েছিল, ধর্মের অঙ্গ সকল কেমন পরিপুষ্ট হয়েছিল, গাভী-রূপিণী পৃথিবীর সেই উক্তিতে তা! জানতে পারি। পৃথিবী বলেছিলেন- “সে সময়ে (শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাব হওয়ায়) ধর্ম চারপদ হয়ে লোকের সুখ-ঐশ্বৰ্য্য বৃদ্ধি করেছিল। সত্য, শৌচ, দয়া, দান, ক্ষমা, সন্তোষ, সরলতা, শম, ইন্দ্ৰিয় দমন, স্বধর্ম-প্রতিপালন, তপস্যা, সমদৃষ্টিতা, তিতিক্ষা, লাভে উপেক্ষা, শাস্ত্রচর্চা, আত্মজ্ঞান, বৈরাগ্য, আত্মদমন, ধীরতা, ইন্দ্রিয়-বল, কর্তব্য বিবেচনা, স্বাধীনতা, কাজে নৈপুণ্য, সৌন্দর্য, ধৈর্য, মৃদু-চিত্ততা, বুদ্ধি, প্রতিভা, বিনয়, সৎ স্বভাব, মনে পটুতা, জ্ঞানেন্দ্রিয়ের ক্ষিপ্রকারিতা, গাম্ভীর্য, স্থৈর্য্য, শ্রদ্ধা, কীর্ত্তি, পূজ্যতা, নিরহঙ্কারতা, ব্রাহ্মণদের হিতৈষিতা, শরণত্ব প্রভৃতি মহত্ত্ব অভিলাষী সাধুদের বাঞ্ছিত গুণ সমূহ জগতে ব্যাপ্ত হয়েছিল। শ্ৰীকৃষ্ণ ঐ সকল গুণে গুণবান ছিলেন; সুতরাং সংসারে ও ঐ সকল গুণ ব্যাপ্ত হয়ে পড়েছিল।” তারপর প্রকাশ,- পাপভারে যখন ধরণী ভারাক্রান্ত হন, শ্রীকৃষ্ণ সে ভার লাঘব করেছিলেন।(২) শ্রীকৃষ্ণের সেই প্রভাবের ফলেই পরীক্ষিৎ যে কলি নিগ্রহে সমর্থ হয়েছিলেন, তাহাই বুঝতে পারা যায়। কলি আশ্রয় প্রার্থী হলে, পরীক্ষিৎ কলির জন্য কয়েকটি স্থান নির্দেশ করে দেন। তিনি কলিকে সম্বোধন করে বলেন,- যেখানে দ্যূতক্রীড়া, মদ্যপান,স্ত্রী ও প্রাণী হত্যা হয়, সেস্থান তোমার বসতি যোগ্য নির্দিষ্ট রইল।” কলি তখন আরও কয়েকটি স্থান প্রার্থনা করেন। তাতে রাজা পরীক্ষিৎ কলির বাসের অন্য আরও পাঁচটি স্থান নির্দেশ করে দেন। সে পাঁচটি স্থান- মিথ্যা, গর্ব, কাম, হিংসা ও বৈর। শ্রীকৃষ্ণের ইহলোক পরিত্যাগের পরও পাপের পথ রুদ্ধ রাখার জন্য সনাতন ধর্মের সাধন পথ সুগম করার পক্ষে কঠোর কঠিন বিধি ব্যবস্থা প্রবর্তিত ছিল; এই সকল উক্তিতে তাহাই প্রতিপন্ন হয়। মনে হয়, সেই অনুশাসনেরই ফলে আজও হিন্দুজাতি জীবিত রয়েছে, আজও তার বর্ণাশ্রম ধর্ম একেবারে লোপ পায়নি। উপদেশ প্রদানের সঙ্গে সঙ্গে আপন কার্য দ্বারা শ্ৰীকৃষ্ণ যে বর্ণাশ্রম ধর্ম-রক্ষার চেষ্টা পেয়েছিলেন, শাস্ত্রে তার ভূরি ভূরি প্রমাণ বিদ্যমান আছে। গোপ গণের মধ্যে যখন ইন্দ্র-পূজার প্রবর্তনার পক্ষে চেষ্টা করা হচ্ছিল, সেই সময় শ্রীকৃষ্ণ ব্রহবাসিদের তাঁদের স্বাভাবিক অর্থাৎ পিতৃপিতামহ প্রবর্তিত ধর্ম পরিত্যাগ করতে নিষেধ করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন,- “স্বভাবস্থ স্বকর্মকারী জীব কর্মেরই পূজা করবে। যথার্থ যার দ্বারা জীবিত থাকা যায়, সেই ইহার দেবতা। ব্রাহ্মণ- বেদ অধ্যাপন, ক্ষত্রিয়- পৃথিবী শাসন, বৈশ্য- বার্ত্তা এবং শূদ্র- ব্রাহ্মণের সেবা করে জীবিকা নির্বাহ করবে। বার্ত্তা চার প্রকার, কৃষি, বাণিজ্য, গোপালন ও কুসীদ। তারমধ্যে আমরা গোপালন করে থাকি; আমরা বনবাসী, অতএব গোগণ, ব্রাহ্মণ গণ এবং পর্বত এই সকলের উদ্দেশ্যেই আমাদের যজ্ঞ করা উচিত।” এইভাবে যে প্রকার যজ্ঞ ক্রিয়া গোপ জাতির অবলম্বনীয়, শ্রীকৃষ্ণ তাঁদেরকে তারই অনুসরণ করতে উপদেশ দেন। অন্যদিকে আবার শ্রীকৃষ্ণের নিজের এবং যুধিষ্ঠির আদির যজ্ঞ কর্ম কিভাবে সম্পন্ন হয়েছিল, তাও স্মরণ করে দেখুন। তার দ্বারা, বিভিন্ন স্তরের জন্য কি কর্ম বিহিত ছিল, তা বুঝা যেতে পারে। তাঁর বর্ণাশ্রম ধর্ম রক্ষার এক প্রধান নিদর্শন- তার ব্রহ্মণ ভক্তি। তিনি যুধিষ্ঠিরকে বলছেন,- এই ভূমণ্ডল মধ্যে ব্রাহ্মণ গণই আমার সর্বতোভাবে অর্চনীয়, ব্রাহ্মণদের নিকট সর্বদা প্রণতভাবে থাকলে, তাঁরা অনায়াসে প্রসন্ন হয়ে সেই প্রণত ভক্তদের মঙ্গল সাধন করবেন, (৩) কেবল মুখের উপদেশে নয়, শ্রীকৃষ্ণ কাজে ও ব্রাহ্মণদের প্রীত ভক্তির পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছিলেন। রাজসূয় প্রকরণে তিনি কোন কাজের ভার গ্রহণ করেছিলেন! মহাভারতে চির-বিঘোষিত রয়েছে, ‘চরণক্ষালনে কৃষ্ণো ব্রাহ্মণানাং স্বয়ং অভূৎ। সর্ব্বলোক সমাবৃত্তঃ পিপ্রীষুঃ ফলমুত্তমম্‌।’ অর্থাৎ, কৃষ্ণ সর্বলোকে বর্তনাধার হয়েও উৎকৃষ্ট ফল প্রাপ্তি বাসনায় ব্রহ্মণ গণের পদ প্রক্ষালনে স্বয়ং নিযুক্ত রইলেন। ভৃগুপদ চিহ্ন বুকে ধারণ করে বিষ্ণু যেভাবে ব্রাহ্মণের মাহাত্ম্য রক্ষা করে আসছেন, শ্রীকৃষ্ণের জীবনে ও কাজে তারই প্রতিচিত্র দেখতে পাই। (৪) তিনি ব্রাহ্মণ গণকে ভূদেব(ভূমিচরা দেবাঃ) বলে ঘোষণা করে গেছেন। ব্রাহ্মণ গণ তখনও ভূদেবোচিত গুণসম্পন্ন। সুতরাং সকলেরই পূজার্হ ছিলেন বলে বুঝতে পারা যায়। ব্রাহ্মণ গণই বর্ণাশ্রম-ধর্মের ভিত্তি-ভূমি। ভিত্তি-ভূমি দৃঢ় থাকলে সৌধ অচঞ্চল থাকবে, তাতে আর আশ্চর্য কি ? শ্রীকৃষ্ণ তাই সকল কাজেই ব্রাহ্মণের প্রাধান্য রক্ষা করে, বর্ণাশ্ৰম-ধর্ম-সৌধের ভিত্তি দৃঢ় করে গেলেন। বৰ্ণাশ্রম ধর্ম রক্ষার দ্বারাই তাঁর ধর্ম-সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা সার্থক হয়েছিল।

(১) ধৃতরাষ্ট্রের নৈরাশ্য ব্যঞ্জক উক্তি ‘পৃথিবীর ইতিহাস’ প্রথম খণ্ডে মহাভ্রত প্রসঙ্গে ২৪৮-২৫৫ পৃষ্ঠায় দেখুন।
(২) শ্রীমদ্ভাগবত, প্রথম স্কন্দ, ১৭ অধ্যায়; পরীক্ষিৎ ও ধর্মের কথোপকথন দেখুন।
(৩) মহাভারত, শান্তি পর্বে, ৩৯ অধ্যায়ে; যথা, বাসুদেব উবাচ। ব্রাহ্মণাস্তাত লোকেহস্মিন্ন্ররচ্চনীয়াঃ সদা মম। এতে ভূমিচরা দেবা বাগ্বিষাঃ সুপ্রসাদকাঃ।
(৪) ব্রহ্মাবিষ্ণুমহেশ্বর- তিনের মধ্যে কে শ্রেষ্ঠ ? ঋষিদের প্রশ্ন-মীমাংসার জন্য মহর্ষি ভৃগু ঐ তিন দেবতার নিকট গমন করেন। কিন্তু তিনি অভিবাদন না করায় ব্রহ্মা ও মহেশ্বর কুপিত হন। ক্ষমা প্রার্থনায় তাদেরকে তুষ্ট করে, তিনি বিষ্ণুর নিকট গমন করেন। বিষ্ণু তখন নিদ্রিত ছিলেন। ঋষি তাঁকে নিদ্রিত দেখে, তাঁর বুকে পদাঘাত করলেন। পদাঘাতে জগরিত হয়ে, রোষ প্রকাশ দূরে থাকুক, বিষ্ণু ঋষির নিকট কতই অপরাধী হয়েছেন, এই ভাব প্রকাশ করলেন। তাঁকে পদাঘাত করায় ঋষির চরণে আঘাত লেগেছে মনে করে তিনি ক্ষুব্ধ হলেন। মহেশ্বর ও ব্রহ্মাকে অভিবাদন না করায় তারা রুষ্ট হয়েছিলেন; আর বুকে পদাঘাত সত্ত্বেও ঋষির নিকট বিষ্ণু অবনত হলেন। এতে ঋষি বিষ্ণুকেই প্রধান বলে স্থির করলেন। বিষ্ণু ও গৌরব জনক চিহ্ন মনে করে ভৃগুপদচিহ্ন বুকে ধারণ করে রাখলেন।

৬। শ্রীকৃষ্ণ-পরম যোগী


৬। শ্রীকৃষ্ণ-পরম যোগী; কেন-না, যোগের সকল অঙ্গ সার-তত্ত্ব তিনি প্রদর্শন করেছেন।

[যোগ ও যোগী, যোগ কি ও যোগী কাকে বলে, শ্রীকৃষ্ণে যোগাঙ্গের পূর্ণ স্ফূর্তি, যোগ বিষয়ে তাঁর উপদেশে তাঁকে যোগশাস্ত্র বিশারদ বলে বুঝা যায়, শ্রীকৃষ্ণে যোগ সাধনার ফল, শ্রীকৃষ্ণ যে যোগ সাধনায় সিদ্ধিলাভ করেছিলেন, তাঁর কার্যাবলীতে তা প্রত্যক্ষীভূত।]

যোগ ও যোগী-
যোগ প্রভাবে মানুষ সর্ববিধ সিদ্ধিলাভে সমর্থ হয়, যোগ-প্রভাবে মানুষ কৈবল্য বা মুক্তি লাভ করে। যোগ কি, আর কেমন যোগে কিরকম সিদ্ধি অধিগত হয়, শ্রীকৃষ্ণ তা সকলই অবগত ছিলেন। গুরু-গৃহে যোগ সম্বন্ধে তিনি যে শিক্ষা লাভ করেছিলেন। জীবনে কাজের পরস্পরায় তার প্রভাব প্রত্যক্ষ করেছেন। যোগ কি আর যোগী’ই বা কেমন, প্রথমে তার, একটি পরিচয় দেওয়া যাক। তার পর শ্রীকৃষ্ণ কেমন যোগী কেমন যোগ-তত্ত্বজ্ঞ ছিলেন, তা বুঝা যাবে। শাস্ত্র (বিষ্ণু-পুরাণ, ষষ্ঠ খণ্ড, ৭ম পরিচ্ছেদ) বলেছেন-

অর্থাৎ, মনই মানুষের বন্ধন ও মুক্তির কারণ; মন যখন বিষয়ে আসক্ত হয়, তখন বদ্ধের এবং যখন বিষয়ে পরিত্যাগ করে, তখন মুক্তির কারণ হয়ে থাকে। জ্ঞানী মুনিজন বিষয় হতে মনকে সমাহৃত করে মুক্তির জন্য ব্রহ্মস্বরূপ পরমেশ্বরের চিন্তা করবেন। হে মুনে! যেমন চুম্বক লোহাকে আকৃষ্ট করে থাকে, তেমনি ব্রহ্মও এভাবে চিন্তিত হলে, স্বভাবতই যোগীকে আত্মভাবে আকৃষ্ট করে থাকেন। মনের এই প্রকার গতি নিজেরই যত্ন সাপেক্ষ; ব্রহ্মে সেই মনোগতির সংযোগের নামই যোগ। যার যোগ এরকম ধর্ম দ্বারা আক্রান্ত, সেই ব্যক্তিকে যোগী ও মুমুক্ষু বলা যায়।

এই যোগের বিষয় শ্রীকৃষ্ণ গীতা শাস্ত্রে তন্ন তন্ন করে আলোচনা করে গেছেন। গীতার আঠারো অধ্যায়ে, যোগকে ১৮ ভাগে ভাগ করে, তিনি যোগের গুহ্য ও চরম তত্ত্ব প্রকাশ করেছেন। যোগ প্রভাবে মানুষ কত অবস্থা লাভ করতে পারে, কত অলৌকিক আশ্চর্য কাজ সম্পন্ন করতে সমর্থ হয় এবং শেষে কেমন ভাবে আত্ম স্বরূপে বিলীন হয়ে যায়, তাঁর উক্তিতে নানা স্থানে সে তত্ত্ব বিশদীকৃত। গীতায় তিনি যোগ সম্বন্ধে যে উপদেশ প্রদান করেছেন, ভাগবতে সে উপদেশ যেন আরও একটু প্রশস্ত ভাবে প্রদত্ত হয়েছে। অণিমাদি অষ্টাদশ সিদ্ধির বিষয় গীতায় বিশেষভাবে উপদিষ্ট হয়নি। কিন্তু ভাগবতে সেই অষ্টাদশ সিদ্ধির বিষয় কীর্তিত হয়েছে। ভাগবতে উদ্ধবের প্রশ্নের উত্তরে শ্রীভগবান বুঝিয়েছেন যে, যোগ শাস্ত্র মতে সিদ্ধি অষ্টাদশ প্রকার। তার অন্তর্গত আটটি সিদ্ধি শ্রীভগবানের আশ্রয়-ভূত; অবশিষ্ট দশটি সত্ত্ব আদি গুণোৎকর্ষ হেতু সঞ্জাত। প্রথমোক্ত আটটি সিদ্ধি; যথা,- অণিমা, লঘিমা, মহিমা, প্রাপ্তি, প্রাকাম্য, ঈশিত্ব, বশিত্ব ও কামাবসারিতা। (১) এ সম্বন্ধে শ্রীভগবানের উক্তি (১১ স্কন্ধ ১৫ অধ্যায়); যথা-

এই অষ্টবিধ সিদ্ধির মধ্যে অণিমা, মহিমা ও লঘিমা তিন প্রকার সিদ্ধি দেহের সিদ্ধি মধ্যে গণ্য। প্রাপ্তি-নামের সিদ্ধি সর্ব প্রাণীর ইন্দ্রিয়গণ সহ তার অধিষ্ঠাত্রী দেবগণের সিদ্ধি মধ্যে গণ্য। পারলৌকিক ও দর্শনযোগ্য সমস্ত বিষয়ে যে ভোগ-দর্শন সামর্থ, তা প্রাকাম্য সিদ্ধি। মায়ার দ্বারা শক্তি সকলের যে প্রেরণ-ক্ষমতা, সেটাই ঈশিতা সিদ্ধি। বিষয় ভোগে সঙ্গহীনতা, এটাই বশিতা সিদ্ধি। যা কামনার অন্তর্ভুক্ত, তাই করতলগত,- এবম্ভুত যে সিদ্ধি, তাই কামাবসারিতা সিদ্ধি। এরপর, গুণের জন্য সিদ্ধি; যথা,-

“অনূর্ম্মিমত্ত্বং দেহহস্মিন্‌ দুরশ্রবণদর্শনম্‌। মনোজবঃ কামরূপং পরকায়প্রবেশনম্‌।
স্বচ্ছন্দমৃত্যুর্দেবানাং সহ ক্রীড়ানুদর্শনম্‌। যথা সঙ্কল্পসংসিদ্ধিরাজ্ঞা প্রতিহতা গতি।”

অর্থাৎ, ‘গুণ-হেতু সিদ্ধি ফলে ক্ষুধাতৃষ্ণা থাকবে না, অতি দূরের সামগ্রী দেখতে পাবেন, অতি দূরের শব্দ শ্রুতিগোচর হবে, মনের গতি অনুসারে দেহের গতি-সামর্থ্য জন্মাবে, যা ইচ্ছা তাই লাভ করা যাবে, পরের শরীরে প্রবেশ-ক্ষমতা জন্মাবে, মৃত্যু স্বেচ্ছাধীন থাকবে, দেবতা রূপ ধারণ করে অপ্সরাগণের সাথে ক্রীড়া করতে সামর্থ্য জন্মাবে, সঙ্কল্পের অনুরূপ প্রাপ্তি ঘটবে, আজ্ঞা অপ্রতিহত থাকবে।’ এই দশবিধ সিদ্ধি গুণ জনিত সিদ্ধি নামে অভিহিত হয়। এ ভিন্ন যোগ ধারণার প্রভাবে আরও কয়েক প্রকার সিদ্ধি নিজেই অধিগত হয়ে থাকে। যথা(শ্রীমদ্ভাগবত, ১১স্কন্ধ, ১৫ অধ্যায়),-

ত্রিকালজ্ঞত্বমদ্বন্দ্বং পরচিত্তাদ্যভিজ্ঞতা। অগ্ন্যর্কাম্বুবিষাদীনাং প্রতিষ্টম্ভোহপরাজয়ঃ।
এতাশ্চোদ্দেশতঃ প্রোক্তা যোগধারণসিদ্ধয়ঃ। যয়া ধারণয়া যা স্যাদ্‌ যথা বা স্যান্নিবোধ মে।

অর্থাৎ- যোগ ধারণায় আরও যে সিদ্ধি লাভ হয়, তা এই; যথা-ত্রিকালজ্ঞতা, শীত-উষ্ণ, সুখ-দুঃখ এবং রাগ-দ্বেষ আদি দন্ধের বশীভূত না হওয়া; অগ্নি, সূর্য, জল, বিষ আদির শক্তিকে স্তম্ভিত করে দেওয়া এবং কারো কাছে পরাজিত না হওয়া, ইত্যাদি। এমন বিবিধ অলৌকিক ক্রিয়া প্রদর্শন, বলা বাহুল্য, চরম সিদ্ধি নয়? চরম সিদ্ধির অবস্থায় যোগী উপনীত হন তখন-যখন তার আত্মা পরমাত্মায় বিলীন হয়ে যায়। তাই এই সকল সিদ্ধির বিষয় বলে শ্রীকৃষ্ণ পরিশেষে সারভূত সিদ্ধির প্রসঙ্গ উত্থাপন করেছেন। অণিমা, লঘিমা, মহিমা প্রভৃতি সিদ্ধির সার্থকতা কোথায়, উপসংহারে তা প্রদর্শন করা হয়েছে। শ্রীকৃষ্ণের উক্তি, যথা-

ভূতসূক্ষ্মাত্মনি ময়ি তন্মাত্রং ধারয়েন্মনঃ। অণিমানমবাপ্নোতি তন্মাত্রোপসাকো মম।
মহত্যাত্মন্ময়ি পরে যথাসংস্থং মনো দধৎ। মহিমানমবাপ্নোতি ভূতানাং চ পৃথক্‌ পৃথক্‌।
পরমাণুময়ে চিত্তং ভূতানাং ময়ি রঞ্জয়ন্‌। কালসূক্ষ্মার্থতাং যোগী লঘিমানমবাপ্নুয়াৎ।
ধারয়ন্‌ ময্যহংতত্ত্বে মনো বৈকারিকেহখিলম্‌। সর্বেন্দ্রিয়াণামাত্মত্বং প্রাপ্তিং প্রাপ্নোতি মন্মনাঃ।
মহত্যাত্মনি যঃ সূত্রে ধারয়েন্ময়ি মানসম্‌। প্রাকাম্যং পারমেষ্ঠ্যং মে বিন্দতেহব্যক্তজন্মনঃ।
বিষ্ণৌ ত্র্যধীশ্বরে চিত্তং ধারয়েৎ কালবিগ্রহে। স ঈশিত্বমবাপ্নোতি ক্ষেত্রক্ষেত্রজ্ঞচোদনাম্‌।
নারায়ণে তুরীয়াখ্যে ভগবচ্ছব্দশব্দিতে। মনো ময্যাদধদ্‌ যোগী মদ্ধর্মা বশিতামিয়াৎ।
নির্গুণে ব্রহ্মণি ময়ি ধারয়ন্‌ বিশদং মনঃ। পরমানন্দমাপ্নোতি যত্র কামোহবসীয়তে।

অর্থাৎ, পঞ্চভূতের সূক্ষ্মতম মাত্রা আমারই দেহ। যে সাধক কেবল সেই শরীরের উপাসনা করে এবং নিজ মনকে অনুরূপ করে তাতে যুক্ত করে অর্থাৎ আমার তন্মাত্রাত্মক শরীর ছাড়া অন্য কোন বস্তুর চিন্তা করে না তার অণিমা সিদ্ধির অর্থাৎ প্রস্তরখণ্ড ভেদ করে প্রবেশ করার অণুত্ব শক্তি প্রাপ্তি হয়। মহত্তত্ত্ব রূপেও আমিই প্রকাশিত এবং সেই রূপে যে নিজ মনকে মহত্তত্ত্বাকার করে তন্ময় করে দেয় তার মহিমা নামক সিদ্ধি প্রাপ্তি হয়। এইভাবে আকাশ আদি পঞ্চভূতে যা আমারই শরীর তাতে পৃথক পৃথক ভাবে মন যুক্ত করলে তার মহত্ত্ব প্রাপ্ত হয়ে যাওয়াও মহিমা সিদ্ধিরই অন্তর্গত। যে যোগী বায়ু আদি চতুষ্টয় ভূতের পরমাণুতে আমারই রূপ জ্ঞানে চিত্তকে অনুরূপ করে দেয় তার লঘিমা নামক সিদ্ধি প্রাপ্তি হয়, তার পরমাণু রূপ কালবৎ সূক্ষ্ম বস্তু হওয়ার সামর্থ্য প্রাপ্তি হয়। যে সাত্ত্বিক অহংকারকে আমার স্বরূপ জ্ঞানে আমার সেই রূপেই চিত্তে ধারণা করে, সে সমস্ত ইন্দ্রিয়সমূহের অধিষ্ঠাতা হয়ে যায়। এইভাবে আমার ধ্যানধারণা কারী ভক্ত ‘প্রাপ্তি’ নামক সিদ্ধি প্রাপ্ত করে নেয়। যে আমার মহত্তত্ত্বাভিমানী সূত্রাত্মাতে নিজ চিত্ত স্থির করে, সে আমার অব্যক্ত জন্ম(সূত্রাত্মা)র প্রাকাম্য নামক সিদ্ধি লাভ করে যাতে ইচ্ছানুসারে সকল ভোগ প্রাপ্তি হয়। যে ত্রিগুণময়ী মায়ার অধিকর্তা আমার কালস্বরূপ বিশ্বরূপের ধারণা করে, সে শরীর ও জীবসকলকে নিজ ইচ্ছানুসারে প্রেরণ করবার সামর্থ্য প্রাপ্ত করে। এই সিদ্ধির নাম ‘ঈশিত্ব’ যে যোগী আমার নারায়ণ-স্বরূপে, যাকে তুরীয় এবং ভগবানও বলে, মন যুক্ত করে, তার মধ্যে আমার স্বাভাবিক গুণ প্রকাশিত হতে শুরু করে ও তার বশিতা(অথবা বশিত্ব) সিদ্ধি প্রাপ্তি হয়। নির্গুণ ব্রহ্মও আমিই। যে নিজ নির্মল মন আমার এই ব্রহ্ম স্বরূপে প্রতিষ্ঠিত করে তার কামাবসায়িতা সিদ্ধির প্রাপ্তি হয়। এর প্রাপ্তিতে তার সমস্ত কামনা পূর্ণ হয়ে যায়, সে পূর্ণকাম হয়ে যায়।
এখানে চিদবস্থার প্রসঙ্গ উত্থাপিত। লোকালোকের অতীত চিন্ময়ের সাথে চিত্তের সংযোগ যে অবস্থায় হয়, তারই বিষয় এখানে বলা হয়েছে। এ হিসাবে, সকল সিদ্ধির সার সিদ্ধি-কামাবসায়িতা। এই সিদ্ধিতেই সকল সিদ্ধির পরাকাষ্ঠা; এই সিদ্ধির প্রথম স্তর-কর্মফল ত্যাগ-কামনা-বিসর্জন।

শ্রীকৃষ্ণে যোগ-অঙ্গের পূর্ণ স্ফূর্তি।
যে বিষয়ে যার অভিজ্ঞতা যত অধিক, সেই বিষয়ে তিনি তত সুন্দরভাবে বোঝাতে সমর্থ হন। সংসারের শিক্ষায় দেখতে পাই, যে অধ্যাপক যে বিষয়ে অধিক অভিজ্ঞ, অধ্যাপনায় সেই বিষয়ে তার অধিক পারদর্শিতা প্রকাশ পায়। গীতায়, ভাগবতে এবং অন্যান্য স্থানে যোগ বিষয়ে শ্রীকৃষ্ণ যে উপদেশ দিয়েছেন, তাতে যোগ শাস্ত্র সম্বন্ধে তার সর্ববিধ অভিজ্ঞতার নিদর্শন দেখা যায়। তিনি যেমন ভাবে যোগ ক্রিয়ার বিভাগ বিধান করে গেছেন, তিনি যেভাবে আপামর সাধারণ সকলকে যোগ মার্গে অগ্রসর করাবার জন্য শিক্ষা দিয়ে গেছেন, তাতে যোগের গুহ্যাতিগুহ্য তত্ত্ব যে তার অধিগত ছিল, তা বেশ বুঝতে পারি। যম নিয়ম প্রভৃতি যোগের অঙ্গ গুলিকে অতি অল্প কথায় তিনি যেমন বোধগম্য করিয়েছেন; তারপর যোগের সার সমুদ্ধারে-ভক্তিযোগ, জ্ঞানযোগ ও ক্রিয়াযোগ বিষয়ে- তিনি যেমন সরল ব্যাখ্যা করে গেছেন; তেমন আর দ্বিতীয় দেখা যায় না। যোগ অঙ্গের এক একটি বিষয় জানানোর জন্য উদ্ধব তাঁকে প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করেন। যম নিয়ম কি, শম দম তিতিক্ষাই বা কি, দান তপ শৌর্য সত্য প্রভৃতিই বা কি, – এই বিবিধ প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করলে, শ্রীকৃষ্ণ কত সরলভাবে, কিরকম উত্তর দিয়েছিলেন, অনুধাবন করুন (শ্রীমদ্ভাগবত, ১১শ স্কন্ধ, ১৯শ অধ্যায়)-অহিংসা সত্যমস্তেয়মসঙ্গো হ্রীরসঞ্চয়ঃ। আস্তিক্যং ব্রহ্মচর্য্যং চ মৌনং স্থৈর্য ক্ষমাভয়ম্‌।

শৌচং জপস্তপো হোমঃ শ্রদ্ধাতিথ্যং মর্দচনম্‌। তীর্থাটনং পরার্থেহা তুষ্টিরাচার্যসেবনম্‌।
এতে যমাঃ সনিয়মা উভয়োর্দ্বাদশ স্মৃতাঃ। পুংসামুপাসিতাস্তাত যথাকামং দুহন্তি হি।
শমো মন্নিষ্ঠতা বুদ্ধের্দম ইন্দ্রিয়সংযমঃ। তিতিক্ষা দুঃখসংমর্ষো জিহ্বোপস্থজয়ো ধৃতিঃ।
দণ্ডন্যাসঃ পরং দানং কামত্যাগস্তপঃ স্মৃতম্‌। স্বভাববিজয়ঃ শৌর্যং সত্যং চ সমদর্শনম্‌।
ঋতং চ সূনৃতা বাণী কবিভিঃ পরিকীর্তিতা। কর্মস্বসঙ্গমঃ শৌচং ত্যাগঃ সংন্যাস উচ্যতে।
ধর্ম ইষ্টং ধনং নৃণাং যজ্ঞোহহং ভগবত্তমঃ। দক্ষিণা জ্ঞানসন্দেশঃ প্রাণায়ামঃ পরং বলম্‌।
ভগো ম ঐশ্বরো ভাবো লাভো মদ্ভক্তিরুত্তমঃ। বিদ্যাহহত্মনি ভিদাবাধো জুগুপ্সা হ্রীরকর্মসু।
শ্রীর্গুণা নৈরপেক্ষ্যাদ্যাঃ সুখং দুঃখসুখাত্যয়ঃ। দুঃখং কামসুখাপেক্ষা পণ্ডিতো বন্ধমোক্ষবিৎ।
মূর্খো দেহাদ্যহংবুদ্ধিঃ পন্থা মন্নিগমঃ স্মৃতঃ। উৎপথশ্চিত্তবিক্ষেপঃ স্বর্গঃ সত্ত্বগুণোদয়ঃ।
নরকস্তমউন্নাহো বন্ধুর্গুরুরহং সখে। গৃহং শরীরং মানুষ্যং গুণাঢ্যো হ্যাঢ্য উচ্যতে।
দরিদ্রো যস্ত্বসন্তুষ্টঃ কৃপণো যোহজিতেন্দ্রিয়ঃ। গুণেষ্বসক্তধীরীশো গুণসঙ্গো বিপর্যয়ঃ।

যম ও নিয়মের সাধন দ্বারা মানুষ মোক্ষ আহরণ করতে সমর্থ হয়। প্রবৃত্তি ও নিবৃত্তি মার্গ অবলম্বীদের দ্বাদশটি করে যম ও নিয়ম বিহিত আছে; যথা- অহিংসা, সত্য, অস্তেয় (চুরি না করা), অসঙ্গতা, লজ্জা, সঞ্চয়-রাহিত্য (আবশ্যকতা থেকে অধিক ধন সঞ্চয়), আস্তিক্য(অর্থাৎ স্বধর্মে বিশ্বাস), ব্রহ্মচর্য, মৌন, স্থৈর্য, ক্ষমা এবং অভয়। নিয়ম ও বারো সংখ্যক- শৌচ, বাহির অন্তরের পবিত্রতা, জপ, তপ, হবন, শ্রদ্ধা, অতিথি সেবা, আমার পূজা, তীর্থযাত্রা, পরোপকার করার চেষ্টা, সন্তোষ এবং গুরুসেবা-এই ভাবে যম ও নিয়ম দুইই বারো সংখ্যক। ইহা সকাম ও নিষ্কাম দুই প্রকারের সাধকদের জন্যই প্রযোজ্য। হে উদ্ধব! যে ব্যক্তি এর পালন করে এই যম ও নিয়ম তার ইচ্ছানুসারে তাঁকে ভোগ এবং মোক্ষ দুইই প্রদান করে থাকে। বুদ্ধির আমাতে যুক্ত হওয়াই ‘শম(শান্তি মাত্র হয়)’। ইন্দ্রিয় সমূহের সংযমের নাম ‘দম;। ন্যায় প্রাপ্ত দুঃখ সহ্য করা ‘তিতিক্ষা’। জিহ্বা ও জননেন্দ্রিয়ের উপর জয়লাভ করাই ‘ধৈর্য’। কারো উপর দ্রোহ না করে অভয় দান করা হল ‘দান’। কামনা সমূহ ত্যাগ হল ‘তপ’, নিজ বাসনা সকলের উপর হয় জয়লাভ করা ‘শৌর্য’, সর্বত্র সমস্বরূপ সত্যস্বরূপ পরমাত্মার দর্শনই ‘সত্য’। এইভাবে সত্য ও মধুর হিতকর বাণীকে মহাত্মাগণ ‘ঋত’ আখ্যা দিয়ে থাকেন। কর্মে আসক্তি ত্যাগই ‘শৌচ’। কামনা সমূহের ত্যাগই সত্য ‘সন্ন্যাস’। ধর্মই মানবের অভীষ্ট ‘ধন’ (সম্পদ)। আমি পরমেশ্বরই ‘যজ্ঞ’। জ্ঞানোপদেশ দানই ‘দক্ষিণা’। প্রাণায়ামই শ্রেষ্ঠ ‘বল’। আমার ঐশ্বর্যই ‘ভগ’, আমার উপর শ্রেষ্ঠ ভক্তিই উত্তম ‘লাভ’। যথার্থ ‘বিদ্যা’ সেই যাতে ব্রহ্ম ও আত্মার বিভেদ মুছে যায়। পাপ করতে ঘৃণা হওয়াই হল ‘লজ্জা’। আপ্ত-কাম আদি গুণই শরীরের যথার্থ সৌন্দর্য-‘শ্রী’, দুঃখ-সুখের অনুভূতি সর্বতোভাবে বিলুপ্ত হওয়ার নাম ‘সুখ’। বিষয়ভোগের কামনাই ‘দুঃখ’। যে বন্ধন ও মোক্ষ তত্ত্ব অবগত সেই ‘পণ্ডিত’। শরীর আদিতে যার আমিত্ব বর্তমান সেই ‘মূর্খ’। যা সংসার আদি থেকে নিবৃত্ত করে আমার প্রাপ্তি করিয়ে দিতে সহায়ক তাই যথার্থ ‘সুপথ’। চিত্তের বহির্মুখী হওয়া ‘কুমার্গ’। সত্ত্বগুণের বৃদ্ধিই হল ‘স্বর্গ’ এবং তমোগুণের বৃদ্ধিই হল ‘নরক’। গুরুই যথার্থ ‘আত্মীয়স্বজন’ এবং সেই গুরু আমি স্বয়ং। এই মানব শরীরই প্রকৃত ‘গৃহ’ এবং যথার্থ ‘ধনী’ সেই যে সকল গুণসম্পন্ন, যা কাছে গুণের সম্পদ আছে। যার চিত্তে অসন্তোষ ও অভাবের বোধ আছে সেই ‘দরিদ্র’। যে জিতেন্দ্রিয় নয় সেইই ‘কৃপণ’। সমর্থ, স্বতন্ত্র এবং ‘ঈশ্বর’ সে যার চিত্তবৃত্তি বিষয়াসক্ত নয়। বিপরীতে যে বিষয়সকলে আসক্ত সেই সর্বতোভাবে ‘অসমর্থ’।
এইভাবে শম-দম আদির অর্থ নির্ধারণ করে শ্রীকৃষ্ণ বললেন,-

কিং বর্ণিতেন বহুনা লক্ষণং গুণদোষয়োঃ। গুণদোষদৃষির্দোষো গুণস্তুভয়বর্জ্জিতঃ।

অর্থাৎ, আমি তোমাকে দোষ-গুণের লক্ষণ পৃথক ভাবে কতদূর বলব? সমস্তের সার এতেই জেনো যে দোষ-গুণের উপর দৃষ্টিপাত করাই সব থেকে বড় দোষ এবং দোষ-গুণের উপর দৃষ্টিপাত না করে শান্ত নিঃস্পৃহ স্বরূপে অবস্থান করাই সর্বোত্তম গুণ।
সেই দোষগুণ বিবর্জিত অবস্থাই বা কেমন, আর কিভাবে বা সেই দোষ গুণের অতীত অবস্থায় উপস্থিত হওয়া যায়, ভক্তিযোগ জ্ঞানযোগ ও ক্রিয়া-যোগ নিরূপণ প্রসঙ্গে শ্রীকৃষ্ণ তা বিবৃত করছেন,-

যোগাস্ত্রয়ো ময়া প্রোক্তা নৃণাং শ্রেয়োবিধিৎসয়া। জ্ঞানং কর্ম চ ভক্তিশ্চ নোপায়োহন্যোহস্তি কুত্রচিৎ।
নির্বিণ্ণানাং জ্ঞানযোগো ন্যাসিনামিহ কর্মসু। তেষ্বনির্বিণ্ণচিত্তানাং কর্মযোগস্তু কামিনাম্‌।
যদৃচ্ছয়া মৎকথাদৌ জাতশ্রদ্ধস্তু যঃ পুমান্‌। ন নির্বিণ্ণো নাতিসক্তো ভক্তিযোগোহস্য সিদ্ধিদঃ।

অর্থাৎ, আমি মানব কল্যাণ কামনায় বেদে ও অন্যত্র অধিকার ভেদে এই তিনটি যোগের মাহাত্ম্য বর্ণনা করেছি। যোগ তিনটি হল- জ্ঞানযোগ, কর্মযোগ, ভক্তিযোগ। এই পরম কল্যাণকর পথ, এছাড়া অন্য পথ নেই। হে উদ্ধব! কর্ম ও তার ফল এ বৈরাগ্যযুক্ত বা ফল পরিত্যাগী ব্যক্তি জ্ঞানযোগের অধিকারী, আর যাদের কর্ম ও তার ফল এ বিরক্তি আসেনি বা তার ফল যে দুঃখ হবে সে ধারণা জন্মায়নি সেই সকাম ব্যক্তিগণ কর্মযোগের অধিকারী। যে ব্যক্তি চরম বিরক্ত ও চরম আসক্ত দুই’ই নয় এবং যার পূর্বজন্ম-কৃত কর্মফলে সৌভাগ্যবশত আমার লীলা কথায় শ্রদ্ধাযুক্ত হয়েছে সেই প্রকৃত ভক্তিযোগের অধিকারী। এই পথেই তার সিদ্ধিলাভ সম্ভব। কর্ম বিষয়ক বিধি-নিষেধ পালন করে কর্ম সম্পাদনে যুক্ত থাকাই বাঞ্ছনীয়। কিন্তু যখন কর্মময় জগত ও আমার লীলা-কথা শ্রবণ-কীর্তনে শ্রদ্ধার উদয় হবে তখন কর্ম ত্যাগ করাই বিধেয়।
কঠোর যোগ-তত্ত্বকে শ্রীকৃষ্ণ কতভাবে কতরকমে সাধারণের বোধগম্য করার চেষ্টা করেছেন, তার ইয়ত্তা নেই। সর্ব অবস্থায় সকল মানুষ যোগ-পথে অগ্রসর হতে পারে, এই উদ্দেশ্যে যোগের প্রতি-স্তর প্রতি-সোপান, তিনি প্রদর্শন করে গেছেন। অভ্যাসই যে যোগের আদি স্তর, অভ্যাসে অভ্যস্ত হতে হতে মানুষ যে যোগ-শিক্ষায় সমর্থ হবে, এ উপদেশ তিনি বার বার প্রদান করেছেন। উদ্ধবের প্রশ্নের উত্তরে যোগের প্রথম স্তর তিনি কিভাবে বিশদভাবে বুঝিয়েছেন, দেখুন (শ্রীমদ্ভাগবত, একাদশ স্কন্ধ, চতুর্দশ অধ্যায়)-

সম আসন আসীনঃ সমকায়ো যথাসুখম। হস্তাবুৎসঙ্গ আধায় স্বানাসাগ্রকৃতেক্ষণঃ।
প্রাণস্য শোধয়েন্মার্গং পূরককুম্ভকরেচকৈঃ। বিপর্য্যয়েণাপি শনৈরভ্যসেন্নির্জ্জিতেন্দ্রিয়ঃ
হৃদ্যবিচ্ছিন্নমোঙ্কারং ঘণ্টানাদং বিসোর্ণবৎ। প্রাণেনোদীর্য্য তত্রাথ পুনঃ সংবেশয়েৎ স্বরম্‌।
এবং প্রণবসংযুক্তং প্রাণমেব সমসভ্যসেৎ। দশকৃত্বস্ত্রিষবণং মাসাদর্ব্বাগ্‌ জিতানিলঃ।
হৃৎপুণ্ডরীকমন্তঃস্থমূর্দ্ধনালমধোমুখম্‌। ধ্যাত্বোর্দ্ধমুখমুন্নিদ্রমষ্টপত্রং সকর্ণিকম্‌।
কর্ণিকায়াং ন্যসেৎ সূর্য্যসোমাগ্নীনুত্তরোত্তরম। বহ্নিমধ্যে স্মরেদ্রূপং মমৈতদ্ধ্যানমঙ্গল্‌।
সমং প্রশান্তং সুমুখং দীর্ঘচারুচতুর্ভুজম্‌। সুচারু সুন্দরগ্রীবং সুকপোলং শুচিস্মিতম্‌।
সমানকর্ণবিন্যস্তস্ফুরন্মকরকুণ্ডলম্‌। হেমান্বরং ঘনশ্যামং শ্রীবৎসশ্রীনিকেতনম্‌
শঙ্খচক্রগদাপদ্ম বনমালাবিভূষিতম। নূপুরৈর্বিলসৎপাদং কৌস্তুভপ্রভয়া যুতম্‌।
দ্যুমৎ কিরীটকটক-কটিসূত্রাঙ্গদাযুতম্‌। সর্ব্বাঙ্গসুন্দরং হৃদ্যং প্রসাদসুমুখেক্ষণম্‌।
সুকুমারমভিধ্যায়েৎ সর্ব্বাঙ্গুষু মনো দধৎ। ইন্দ্রিয়াণীনিয়ার্থেভ্যো মনসাকৃষ্য তন্মনঃ।
বুদ্ধ্যা সারথিনা ধীরঃ প্রণয়েন্ময়ি সর্ব্বতঃ। তত সর্ব্বব্যাপকং চিত্তমাকৃষ্যৈকত্রধারয়েৎ।
তচ্চ ত্যক্ত্বা মদারোহো ন কিঞ্চিদপি চিন্তয়েৎ। এবং সমাহিতমতির্মামেবাত্মনমাত্মনি।
বিচষ্টে ময়ি সর্ব্বাত্মন্‌ জ্যোতির্জ্যোতিষিসংযুতম। ধ্যানেনেত্থং সুতীব্রেণ যুঞ্জতো যোগিনো মনঃ।
সংযাস্যত্যাশু নির্ব্বাণং দ্রব্যজ্ঞানং ক্রিয়াভ্রমঃ। (৩২শ-৪৬শ শ্লোক)

কেমনভাবে যোগ আসনে উপবেশন করতে হবে, কোনভাবে পূরক কুম্ভক রেচক দ্বারা প্রাণপথ শোধন করতে হবে, কেমনভাবে প্রাণায়াম প্রত্যাহার অভ্যাস করতে হবে, কেমনভাবে অষ্টাঙ্গ যোগ সাধন করতে হবে, আর পরিশেষে কেমনভাবে যোগী নির্বাণ মুক্তি লাভ করবেন, উপরে উদ্ধৃত শ্লোক কয়েক পংক্তিতে শ্রীকৃষ্ণ তারই আভাস দিয়েছেন। যোগমার্গ অবলম্বীদের তার ঐ উপদেশ অনুসরণে উপযুক্ত গুরুর সাহায্যে যোগ মার্গে অগ্রসর হতে পারেন। ইন্দ্রিয়দের ইন্দ্রিয় জনিত বিষয় থেকে আকর্ষণ করে মনকে সর্বতোভাবে ভগবানে ন্যস্ত রাখতে হবে। অগ্নির মধ্যে তার সেই অনুপম রূপ ধ্যান করতে করতে তন্ময়ত্ব আসবে। চরণ পঙ্কজ হতে ক্রমে ক্রমে মুখ-কমলে দৃষ্টি ন্যস্ত হবে, শেষে আত্মাতে আত্মার দর্শন লাভ ঘটবে। ফলতঃ যোগের স্তর পর্যায় প্রদর্শন করে নিগূঢ় যোগ-তত্ত্ব প্রকাশে শ্রীকৃষ্ণ যে নিজের যোগ অভিজ্ঞতার বিশিষ্ট পরিচয় প্রদান করে গেছেন, তাতে কোনই সংশয় নেই।

শ্রীকৃষ্ণে যোগ সাধনার ফল।

যোগ শাস্ত্রের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণে শ্রীকৃষ্ণকে যেমন যোগজ্ঞ বলে বুঝতে পারি, তার অমানুষিক কর্ম পরম্পরা দেখে তাকে সেরকম যোগী শ্রেষ্ঠ পরম-যোগী বলে বুঝতে পারি। যোগী যোগ প্রভাবে অনেক দূরের শব্দ শুনতে পান; আবার যোগী যোগ প্রভাবে মন-গতির ন্যায় দ্রুতগতি লাভ করতে পারেন। শ্রীকৃষ্ণের জীবনে এই দুই দৃশ্যই দৃশ্যমান। কোথায় হস্তিনা, আর কোথায় দ্বারকা! দ্রৌপদী কাতর কণ্ঠে ডাকলেন, হে গোবিন্দ! হে দ্বারকাবাসিন্! আমার লজ্জা নিবারণ করুন। শ্রীকৃষ্ণ দ্বারকা থেকে সেই ক্রন্দন শুনতে পেলেন, সঙ্কট মোচন, দ্রৌপদীর সে সঙ্কট মোচন করলেন। একবার নয়, একটি দৃষ্টান্তে নয়; মূর্তিমান ক্রোধ স্বরূপ দুর্বাসা যখন পাণ্ডবদের আশ্রমে গিয়ে আতিথ্য গ্রহণ করলেন, দ্রৌপদী কি সঙ্কটে পড়ে কি ডাক ডেকেছিলেন, স্মরণ করে দেখুন। কত দূরের কান্নার ধ্বনি কেমন ভাবে তিনি দ্রৌপদীর মুখ রক্ষা করেছিলেন, তা ও স্মরণ করে দেখুন। সে কি যোগীর যোগ প্রভাব নয়? সে কি ‘দূরশ্রবণদর্শনম’ দূরে শ্রবণ দর্শনে সিদ্ধি লাভ নয়? আর, সে কি ‘মনোজরঃ’ অর্থাৎ মনো-বেগে দেহের গতি নয়? অভিলষিত রূপ লাভ, পরের শরীরে প্রবেশ, ত্রিকালজ্ঞতা প্রভৃতি দৃষ্টান্ত শ্রীকৃষ্ণে অপ্রচুর। শর-শয্যায় ভীষ্মের দেহে প্রবেশ করে শ্রীকৃষ্ণ তাকে যে ত্রিকাল দর্শন জ্ঞান দান করেছিলেন, মহাভারত পাঠকের এ বিষয়ে অজানা নয়। সঙ্কল্পিত বিষয় প্রাপ্তি, অপ্রতিহত আজ্ঞা, – কোন পক্ষে তার যোগৈশ্বর্যের পরিচয় না পাই? যোগ সাধনার চরম স্ফূর্তি- তার ইচ্ছামৃত্যু। কৃষ্ণ-দ্বেষী নাস্তিকদের বিশ্বাস এই যে, ব্যাধের বাণে তার অপমৃত্যু ঘটে। যারা ইতিহাস অবগত নন, যারা শাস্ত্র গ্রন্থের মধ্যে প্রবেশ করেনি, তারাই এই রটনার মূলীভূত। নইলে, শ্রীকৃষ্ণ যে মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হয়ে ছিলেন এবং মরণের অস্ত্রটা পর্যন্ত তিনি প্রস্তুত করে রেখেছিলেন, শাস্ত্র সে নিদর্শন বুকে ধারণ করে আছেন। ব্রহ্ম শাপে যদুবংশের ধ্বংস অনিবার্য হল; সেও শ্রীকৃষ্ণেরই লীলা মাহাত্ম্য। যদুবংশ-ধ্বংসের প্রবর্তনায় তিনি দেখালেন, তার আত্মীয় ও কেউ নয়, স্বজন ও কেউ নয়; অথচ, তার আত্মীয় স্বজনেই সংসার পরিবৃত। তিনি বোঝালেন,- পুত্র পরিজন কেউ আত্মীয় নয়; আত্মীয়-ধর্মপরায়ণ নিষ্পাপ জন। তাই তিনি পাপকর্মে অনুরক্ত বংশের ধ্বংস সাধনে পরাঙ্মুখ হলেন না; আবার অন্যদিকে তিনি সাধু-সজ্জনের মুক্তির বা অমরত্বের পথ প্রশস্ত করে দিলেন। যদু বংশ ধ্বংস প্রাপ্ত হলে শ্রীকৃষ্ণ যখন দেখলেন- ধরার ভার লাঘব হল; আরও যখন দেখলেন-তার অগ্রজ বলরাম যোগ অবলম্বনে মানুষ-লোক পরিত্যাগ করলেন; তখন তার মনে নির্বেদ উপস্থিত হল। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তখন কেমন ভাবে তূষ্ণীম্ভাবাবলম্বনে তনুত্যাগ প্রযত্নপর হলেন, তখন কেমনভাবে কি অবস্থায় তিনি আত্মাতে আত্ম-যোজনা করে কমল-নয়ন মুদ্রিত করলেন, আর তখন কেমনভাবে আগ্নেয় যোগ প্রভাবে নিজ দেহ দগ্ধ করে নিজধামে উপনীত হলেন, শ্রীমদ্ভাগবতে তার তত্ত্ব কথা অবগত এভাবে বলা হয়েছে (ভাগবত, ১১শ স্কন্ধ ৩০শ অধ্যায়)-

রামনির্যণমালোক্য ভগবান্‌ দেবকীসুতঃ। নিষসাদ ধরোপন্থে তূষ্ণীমাসাদ্য পিপ্পলম্‌।
বিভ্রমচ্চতুর্ভুজং রূপং ভ্রাজিষ্ণু প্রভয়া সওয়া। দিশ বিতিমরাঃ কুর্বন্‌ বিধূম ইব পাবকঃ।
শ্রীবৎসাঙ্কং ঘনশ্যামং তপ্তহাটকবর্চসম্‌। কৌশেয়াম্বরযুগ্মেন পরিবীতং সুমঙ্গলম্‌।
সুন্দরস্মিতবক্ত্রাব্জং নীলকুন্তলমণ্ডিতম্‌। পুণ্ডরীকাভিরামাক্ষং স্ফুরন্মকরকুণ্ডলম্‌।
কটিসূত্রব্রহ্মসূত্রকিরীটকটকাঙ্গদৈঃ। হারণূপুরমুদ্রাভিঃ কৌস্তভেন বিরাজিতম্‌।
বনমালাপরীতাঙ্গং মূর্তিমদ্ভির্নিজায়ুধৈঃ। কৃত্বোরৌ দক্ষিণে পাদমাসীনং পঙ্কজারুণম্‌।

অর্থাৎ, যখন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ দেখলেন যে তাঁর অগ্রজ বলরাম পরমপদে লীন হয়ে গেলেন তখন তিনি এক অশ্বত্থ বৃক্ষের তলায় গিয়ে শান্ত হয়ে ভূমিতে উপবেশন করলেন। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তখন অঙ্গকান্তিতে সমুজ্জ্বল চতুর্ভুজ রূপ ধারণ করেছেন। তাঁর অঙ্গকান্তি ধূম রহিত অগ্নিসম প্রকাশমান হয়েছিল। তাঁর নবজলদ শ্যামল অঙ্গ থেকে তপ্ত কাঞ্চনবৎ অঙ্গজ্যোতি বিচ্ছুরিত হচ্ছিল। বক্ষস্থলে সেই শ্রীবৎস চিহ্ন, তাঁর অঙ্গে কৌপেয় বস্ত্র ও উত্তরীয় পরম শোভান্বিত ছিল। তাঁর সেই রূপ অতি মঙ্গলময় রূপ। তাঁর অধরে ছিল রহস্যজনক স্মিতহাস্য ও কপোলে নীলকুণ্ডল অনুপম সৌন্দর্যের সমাবেশ। সুন্দর সুকুমার পদ্মপলাশলোচন-যুগল তার ভক্তদের পরম কৃপা বিতরণে সতত সচেষ্ট ছিল। কর্ণে মকরকুণ্ডল-দ্বয়ও দিব্য আলোক বিতরণ করছিল। তাঁর অনুপম শোভায় কটিতে কটিসূত্র, স্কন্ধে যজ্ঞোপবীত, মস্তকে কিরীট, করদ্বয়ে বলয়য়, বাহু-যুগলে বাজুবন্ধ, কণ্ঠে কন্ঠাহার, চরণ-যুগলে মঞ্জীর, অঙ্গগুলিতে অঙ্গবীর ও বক্ষঃস্থলে কৌস্তভমণি স্ব মহিমায় বিরাজমান ছিল। বনমালা ছিল আজানুলম্বিত। শঙ্খ, চক্র, গদা, আদি আয়ুধ রূপ পরিগ্রহ করে যেন প্রভুর সেবায় সতত নিয়োজিত ছিল। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তখন বাম চরণ দক্ষিণ জানুতে স্থাপন করে উপবিষ্ট ছিলেন। তাঁর অরুণ পদতল রক্তকমলবৎ প্রকাশমান ছিল।
তারপর গড়ুরবাহিত রথ এসে তাঁকে আপন স্থানে নিয়ে যায়। সে যে কেমন ভাবে তিনি দিব্যধামে প্রয়াণ করেন, শুকদেবের বর্ণনায় তা পাঠ করে দেখুন, যথা-

লোকভিবামাং স্বতনুং সাবণাধ্যানমঙ্গলম্‌। যোগধারণয়াগ্ন্যেদ্‌য্যাদগ্ধা ধামাবিশৎ স্বকম্‌।

স্বশরীরে স্বধামে গমন, আত্মায় আত্মসংযোজন করে দিব্য-ধামে প্রয়াণ,- এ কি মৃত্যু ? এমন মৃত্যুর অধিকারী কয়জন হতে পারে ? শ্রীকৃষ্ণের স্বধাম গমনে স্বর্গে দুন্দুভিধ্বনি হল; আকাশে পুষ্পবৃষ্টি হল; ব্রহ্ম আদি দেব গণ বিস্মিত হলেন; এ কি মৃত্যু ? অথবা, এ কি যোগ সাধনার চরম স্ফূর্তি নয় ? যিনি যোগ-প্রভাবে এমন অলৌকিক অমানুষিক ব্যাপার প্রত্যক্ষ করিয়ে গেছেন, তিনি পরম যোগী নন তো পরম যোগী কে ? তাই বলি- শ্রীকৃষ্ণ পরম যোগী।

() শ্রীকৃষ্ণের ইহলোক পরিত্যাগ সম্বন্ধে জরা ব্যাধ কর্তৃক তাঁর সংহার সাধনের এক রূপক আখ্যায়িকা প্রচলিত আছে। জরা নামক ব্যাধ মৃগ ভ্রমে বাণ দ্বারা তাঁকে বিদ্ধ করেছিল, আর তাতেই তাঁর মৃত্যু হয়। যে বাণে তাঁর দেহান্তর ঘটে, সে বাণ যদুকুলনাশন মুষলের অবশিষ্ট লৌহখণ্ডে প্রস্তুত হয়েছিল বলে প্রকাশ আছে। এ ঘটনা সত্য বলে স্বীকার করে নিলে তাতেও কৃষ্ণের যোগ তত্ত্ব পরিজ্ঞাত হয়। তিনি যে মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হয়েছিলেন, এ প্রসঙ্গে তা অস্বীকৃত নয়। পরন্তু জর ব্যাধের সাথে তার কথোপকথনে এবং লোকান্তরের পূর্বে সারথির প্রতি দ্বারকার পরিণাম বিষয় সম্বন্ধে উপদেশ দানে তাঁর ভবিষ্যৎ অভিজ্ঞতারই পরিচয় পাওয়া যায়। তারপর জরা ব্যাধ শব্দ যদি রূপক জরকে লক্ষ করা হয়ে থাকে, তাও তাঁর ইচ্ছামৃত্যু বলতে হয়। কেন না, মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হয়ে অশ্বত্থ বৃক্ষের নিচে বসে তিনিই তো জরাকে ডেকে এনেছিলেন। ফলতঃ যে দিক দিয়েই দেখি, শ্রীকৃষ্ণ যে আপন ইচ্ছায় জন্ম গ্রহণ করেছিলেন এবং আপন ইচ্ছায় ইহলোক পরিত্যাগ করেছিলেন, সেই বিষয়ে কোনই মতান্তর থাকতে পারে না। ব্যাধের বাণে শ্রীকৃষ্ণের মৃত্যু প্রসঙ্গে আর একটি বড় উচ্চ ভাব মনে আসতে পারে। শ্রীকৃষ্ণ ব্যাধকে স্বর্গে প্রেরণ করেছিলেন। যে তাঁর হত্যাকারী, তাকে ক্ষমা করে তার সদ্গতি বিধান, ভগবানেই শোভা পায়। মহাত্মা যীশু খৃষ্ট সম্বন্ধেও এমন একটি কাহিনী লিপিবদ্ধ আছে। যারা তাঁকে ক্রুশে হত্যা করেছিল, যিশুখ্রিস্ট তাদের সম্বন্ধে ভগবানের নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করেছিলেন; বলেছিলেন, –

‘Father, forgive them for they know not what they do.’ S.luke, X111, 34; Mathew, V 44.87.

(১) মার্কেণ্ডেয় পুরাণে এই অষ্ট সিদ্ধি একটু বিশেষভাবে আলোচিত আছে; যথা-
অণিমা লঘিমা চৈব মহিমা প্রাপ্তিরেব চ। প্রাকামাঞ্চ তথেশিত্বং বিশিত্বঞ্চ তথা পরম্‌।
যত্র কামাবসায়িত্বং গুণানেতাংস্তথোইশ্বরান্‌। প্রাপ্নোত্যষ্টৌ নরব্যাস্ত্র পরং নির্ব্বাণসুচকান্‌।
সূক্ষ্মাৎ সূক্ষ্মতমোহণীয়ান্‌ শীঘ্রত্বং লঘিমা গুণ। মহিমাশেষ পূজ্যত্বাৎ প্রাপ্তির্নাপ্রাপ্যমস্য যৎ।
প্রাকামামস্য ব্যাপি

তথ্যসূত্র-
ভারতবর্ষের ইতিহাস, বিশ্বকোষ, পৃথিবীর ইতিহাস(দুর্গাদাস লাহিড়ী)

সংকলনে- শ্রীকৃষ্ণকমল মিন্টু।

৫। শ্রীকৃষ্ণ-পরম জ্ঞানী


৫। শ্রীকৃষ্ণ-পরম জ্ঞানী; কেন-না, জ্ঞানের চরম স্ফুর্তি তাঁতে প্রকাশ পেয়েছে।
[জ্ঞানের স্বরূপ কি, অভিধানের মত; বদ্ধমুক্তের লক্ষণ জ্ঞানের পরাকাষ্ঠা, শ্রীকৃষ্ণের উপদেশে তাঁর জ্ঞান মহিমা পরিস্ফুট, শ্রীকৃষ্ণ সকল জ্ঞানে জ্ঞানবান, সংসারের সকল তত্ত্বই তাঁর অধিগত।]

কথায় ও কাজে জ্ঞানের পরিচয়-
জ্ঞানীকে বুঝতে হলে, জ্ঞান কি-বুঝার প্রয়োজন হয়। আবার জ্ঞানের স্বরূপ-তত্ত্ব যিনি উপলব্ধি করেছেন, তাঁকেই জ্ঞানী বলে বুঝতে পারি। জ্ঞানীর জ্ঞানের নিদর্শন তাঁর কথায় ও কাজে বিকাশমান। শ্রীকৃষ্ণ যে পরম জ্ঞানী, গীতার দার্শনিক তত্ত্ব আলোচনায় তা বিশেষভাবে হৃদগম্য হয়। শ্রীকৃষ্ণের জ্ঞান বারিধির গভীরতা যে অতলস্পর্শী, এক গীতাই নয়, যেখানেই তিনি প্রকাশমান, সেখানেই তা প্রত্যক্ষীভূত। মহাভারতে শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় তাঁর জ্ঞানপ্রভা মানুষের অজ্ঞান-অন্ধকার দূর করার জন্য যেমন আলোর সঞ্চার করে আছে, শ্রীমদ্ভাগবতে, ব্রহ্মপুরাণে, গরুড় পুরাণে, অগ্নিপুরাণে, ব্রহ্মবৈবর্ত-পুরাণে এবং অন্য যে কোনও স্থানে তাঁর আবির্ভাব দেখি, সেখানেই তাঁর জ্ঞান-রশ্মি সমভাবে বিচ্ছুরিত রয়েছে। গীতায় অর্জুনের মোহনাশ প্রসঙ্গে যেমন জ্ঞানগর্ভ উপদেশ, শ্রীমদ্ভাগবতে উদ্ধব-সম্মিলনে তাঁর উক্তিতে তেমনি জ্ঞানের প্রস্রবণ উন্মুক্ত দেখি। গরুড় পুরাণে পূর্ব-খণ্ডে গীতাসার বর্ণন-প্রসঙ্গে, তাঁর জ্ঞানের সেই পরিচয়ই দেদীপ্যমান। ব্রহ্মপুরাণে তার জীবন কাহিনীতে সেই জ্ঞানই উদ্ভাসিত। আর আর যেখানে যেখানে তিনি, সেই সেই স্থানেই, তাঁর বাক্যে ও কাজে জ্ঞানীর জ্ঞান বিকাশমান। শ্রীকৃষ্ণের বাক্যে ও কাজে, তিনি যে জ্ঞানের আধার, সর্বথা তা পরিব্যক্ত রয়েছে।

জ্ঞানের স্বরূপ কি?
বিষয়-বিশেষকে বুঝাতে হলে, কতগুলি লক্ষণ নির্ণয় করার প্রয়োজন হয়। যে বিষয়টি যে লক্ষণ আক্রান্ত, লক্ষণ জেনে, সে অনুসারে তাঁকে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে। জ্ঞান ও জ্ঞানী-উভয়েরই পরিচায়ক লক্ষণ আছে। তাই দেখে, জ্ঞান কি ও জ্ঞানী কে, নির্ণয় করা হয়। পরীক্ষার সেই কষ্টিপাথর দিয়ে যদি কেউ শ্ৰীকৃষ্ণের জ্ঞান-গবেষণার পরিমাণ নির্ধারণ করতে চান, শ্রীকৃষ্ণের জ্ঞানের প্রভাব লক্ষ্য করে তাঁকে বিস্ময়-বিমুগ্ধ হতে হবে। সুতরাং প্রথমে দেখা যাক-জ্ঞান কি? অভিধান মতে ‘জ্ঞানম্‌ বিশেষেণ সামান্যেন চাববোধঃ।’ অমরকোষ অনুসারে,- ‘মোক্ষে ধীর্জ্ঞানমন্যত্র বিজ্ঞানং শিল্পশাস্ত্রয়োঃ।’ অমরকোষের টীকাকার এই সুত্রের অর্থ এরকম ব্যাখ্যা করে লিখে গেছেন; যথা,-
‘মোক্ষে শিল্পে শাস্ত্রে চ যা ধীঃ সা জ্ঞানং বিজ্ঞানঞ্চোচ্যতে এষা বিশেষ প্রবৃত্তিঃ।
অন্যত্র ঘটপটাদৌ যা ধীঃ সাপি জ্ঞানং বিজ্ঞানঞ্চোচ্যতে এষা সামান্যপ্রবৃত্তিঃ। মোক্ষে ধীর্জ্ঞানং বিজ্ঞানঞ্চ যথাজ্ঞানান্মুক্তিরিতি সা যাচিতা চ বিজ্ঞানং তুষ্টা ঋদ্ধিং প্রযচ্ছতি ইতি। অন্যত্র তথা জ্ঞানমস্তি সমস্তস্য জন্তোর্বিষয়গোচরে ইতি ঘটত্ব প্রকারকজ্ঞানমিতি যে কেচিৎ প্রাণিনো লোকে সর্ব্বেবিজ্ঞানিনো মতাঃ ইতি। ব্রহ্মণো নিত্যবিজ্ঞানানন্দ রূপত্বাদিতি এবং চিত্রজ্ঞানং ব্যাকরণজ্ঞানং ঘটপটবিজ্ঞানমিত্যাদিকং প্রযুজ্যত এব। মোক্ষনিমিত্তং শিল্পশাস্ত্রয়োর্ধীর্জ্ঞানমুচ্যুতে তন্নিমিত্ততোহন্যনিমিত্তঃ যা তয়োধীঃ সা বিজ্ঞানমিতি কেচিৎ। মোক্ষবিষয়া মোক্ষফলা ধীর্জ্ঞানং অন্যধীর্বিজ্ঞানং ক্বান্যত্র ইত্যাহ শিল্পশাস্ত্রয়োরিতি কেচিৎ। অবরোধ ইত্যধ্যাহৃত্য মোক্ষবিষয়ে অবরোধো ধীঃ অন্যত্র ঘটপটাদি বিজ্ঞানং শিল্পশাস্ত্রবিষয়ে বিজ্ঞানমিতি কেচিৎ। ইতি ভরতঃ।

এ হিসাবে ইহলৌকিক ও পারলৌকিক সর্ববিধ বিষয়ে অভিজ্ঞতা ও নৈপুণ্য লাভই, জ্ঞানের অন্তর্ভুত। মোক্ষ অনুসারিণী বুদ্ধি চাই, আবার শিল্প-বিজ্ঞানাদিতে অভিজ্ঞ হওয়া চাই। কর্মক্ষেত্রে কর্মীর আদর্শ হতে হবে, আবার জ্ঞানক্ষেত্রে তত্ত্বজ্ঞান জন্মাবে। জ্ঞান- তারই নাম। জ্ঞানীর অবস্থা সর্বদিকে সকল ভাবের চরম স্ফূর্তির অবস্থা। দার্শনীকেরা জ্ঞানের কত প্রকার বিবৃতি-ব্যাখ্যা প্রকাশ করে গেছেন। সেই অনুসারে সকল দিকে সকল ভাবের চরম স্ফুর্তির অবস্থাই জ্ঞান। ন্যায়মতে জ্ঞানের পরিচয়; -যথাভাষা-পরিচ্ছেদে,-
‘অপ্রমা চ প্রমা চৈব জ্ঞানং দ্বিবিধমুচ্যতে। তৎশূন্যে তন্মতিৰ্য্যা স্যাদপ্রমা সা নিরূপিত॥
তৎপ্রপঞ্চো বিপর্য্যাসঃ সংশয়োহপি প্রকীর্ত্তিতঃ। আদ্যো দেহ আত্মবুদ্ধিঃ শঙ্খাদৌ পীতিমা মতিঃ॥
ভবেন্নিশ্চয়রূপা সা সংশয়োহথ প্রদর্শ্যতে। কিং স্বিন্নরো ভবেদ্‌যা ধীরেকত্রাভাবভাবয়োঃ।
তদ্ভাবাপ্রকারা ধীস্তৎপ্রকারা তু নির্ণয়ঃ॥ স সংশয়ো ভবেদ্‌যা ধীরেকত্রাভাবভাবয়োঃ।
সাধারণাদিধর্ম্মস্য জ্ঞানং সংশয়কারণম্‌॥ দোষোহপ্রমায়া জনকঃ প্রমায়াস্তু গুণো ভবেৎ।
পিত্তদূরত্বাদিরূপো দোষো নানাবিধো মতঃ॥ গুণঃ স্যাদ্‌ভ্রমভিন্নস্তু জ্ঞানমত্রোচ্যতে প্রমা।
অথবা তৎপ্রকারং যজ্‌জ্ঞানং তদ্বৎ বিশেষ্যকম্‌॥ জ্ঞানং যন্নির্ব্বিকল্পাখ্যং তদতীন্দ্রিয়মিষ্যতে।
তৎ প্রমাণাপ্রমাণাপি জ্ঞানং ষন্নির্ব্বিকল্পকম্‌॥ প্রকারত্বাদিশূন্যং হি সম্বন্ধানবগাহনাৎ।’
তৎ প্রমাণাপ্রমাণাপি জ্ঞানং যগ্নিৰ্বিকল্পকম ॥ প্রকারত্বাদিশূন্যং হি সম্বন্ধান বগাহনাৎ “

প্রমা ও অপ্রমা ভেদে জ্ঞান দুই প্রকার। যা সত্য, সেই জ্ঞান প্রমা জ্ঞান; যা মিথ্যা বা ভ্রান্তি, তা অপ্রমা জ্ঞান। অপ্রমা জ্ঞানে পণ্ডিতকে মূর্খ দেখে, দড়িকে সাপ বলে মনে করে। পিত্তরোগীর চোখে সাদা শঙ্খও হলুদ বর্ণ বলে প্রতীত হয়। অপ্রমা জ্ঞানে তেমনি মিথ্যাকে সত্য বলে মনে করে। যে জ্ঞান সত্যস্বরূপ, সেটাই প্রকৃত জ্ঞান। সেই জ্ঞানে যিনি জ্ঞানবান, তিনিই প্রকৃত জ্ঞানী। ন্যায়দর্শন সেই জ্ঞানেরই অন্বেষণ করে ফিরছেন। কেবল ন্যায়দর্শন বলেই নয়, সকল দর্শনই তত্ত্বজ্ঞানের সত্যজ্ঞানের অন্বেষণে চেষ্টারত। শ্ৰীকৃষ্ণ সে সকল জ্ঞানেরই গূঢ়তত্ত্ব অবগত ছিলেন। জ্ঞান কাকে বলে, জ্ঞানের স্বরূপ লক্ষণ কি, গীতায় তিনি যেভাবে তা ব্যক্ত করে গেছেন; অমানিত্ব অদাম্ভিত্ব প্রভৃতি জ্ঞানের তিনি যে লক্ষণসমূহ নিৰ্দ্ধারণ করেছেন, তাতেই তিনি যে সর্বজ্ঞানধার, তা হৃদয়ঙ্গম হয়। তিনি যে জ্ঞান-সমুদ্র সেই প্রসঙ্গে আমরা তা-ই সপ্রমাণ করেছি।(১) সাত্ত্বিক রাজসিক ও তামসিক ভেদে তিনি যে জ্ঞানের বিভাগ বিধান করে গেছেন, তার দ্বারাও তাঁর জ্ঞানের পরাকাষ্ঠা দেখতে পাই। শ্ৰীভগবান বলেছেন,-
“সৰ্ব্বভূতেষু যেনৈকং ভাবমব্যয়মীক্ষতে। অবিভক্তং বিভক্তেষু তজজ্ঞানং বিদ্ধি সাৰিকম্॥ পৃথকত্বেন তু যজজ্ঞানং নানাভাবান পৃথগবিধান। বেত্তি সৰ্ব্বেষু ভূতেষু তজজ্ঞানং বিদ্ধিরাজসম। যৎ তু কুংমবদেকস্মিন কার্য্যে সক্তমহৈতুকম। অতত্ত্বাৰ্থ বদল্লঞ্চ তৎ তামসমুদাহৃতম॥”
অর্থাৎ, ‘যে জ্ঞানের দ্বারা এই বিভিন্ন আকারে প্রতীয়মান নিখিল জগতের সর্বত্র, সেই একমাত্র অবিভক্ত অবিকার আত্মার ভাব পরিদৃষ্ট হয়, সেই জ্ঞান সাত্ত্বিক জ্ঞান। আর যে জ্ঞানে প্রতি দেহে বিভিন্ন গুণধর্ম বিশিষ্ট আত্মার পৃথক পৃথক অস্তিত্ব অনুভূত হয়, তাহাই রাজসিক জ্ঞান। আর যে জ্ঞান কেবলমাত্র বহুল দেহকেই লক্ষ্য করে; আত্মা ইন্দ্রিয় মন প্রভৃতি যা কিছু অদৃশ্য পদার্থ আছে, সে সমস্তকেই দেহ বা দেহীর বস্তু বলে দেখে; যে জ্ঞানের কোনও প্রকার যুক্তি বা হেতু নাই, যা তত্ত্বার্থ প্রকাশক নয়, যা অতীব ক্ষুদ্র অর্থাৎ কোনও বিষয়ের অভ্যন্তর প্রদেশ পর্য্যন্ত প্রকাশ করতে পারে না, কিন্তু কেবল বাইরের কিছু অংশ মাত্র প্রকাশ করে থাকে, তাকে তামস জ্ঞান বলে থাকে। জ্ঞানের এরকম ত্রিবিধ প্রকারভেদ বর্ণনা করে শ্রীকৃষ্ণ যখন কর্মের প্রকার-ভেদ করেছেন, তখনই বুঝতে পারা যায়,- শ্ৰীকৃষ্ণ কেমন জ্ঞানী ও কেমন কর্মী! গীতার সপ্তম অধ্যায়ে জ্ঞানযোগ-বৰ্ণন-প্রসঙ্গে ও তিনি জ্ঞানের তত্ত্ব নিরূপণ করে গেছেন। পরম জ্ঞানী ভিন্ন এমন করে জ্ঞান-তত্ত্ব প্রচারে কে সমর্থ হতে পারে ?

বদ্ধ মুক্তের লক্ষণে-
মনিষীরা জ্ঞানের ষে পরিভাষা নির্ধারণ করে গেছেন, সে অনুসারে আমরা বুঝতে পারি, সদসৎ সকল পদার্থের স্বরূপ-তত্ত্ব বিষয়ে যে অভিজ্ঞতা, তাহাই জ্ঞান; আবার, সকল কাজে পারদর্শিতাও জ্ঞান। তিনি জ্ঞানী, তিনি সকল তত্ত্ব অবগত আছেন এবং সকল কর্মে পারদর্শিতা লাভ করেছেন। বেদ-বেদাঙ্গ নিখিল শাস্ত্র গ্রন্থ সমূহ জ্ঞানীর অধিকৃত; অধিকন্তু জ্ঞানী যিনি, তিনি শিল্প-বিজ্ঞানে ও প্রতিষ্ঠাপন্ন। শ্রীকৃষ্ণের মধ্যে জ্ঞানের এই সকল অঙ্গই পরিপুষ্ট দেখি। বেদ-বেদাঙ্গ আদি নিখিল শাস্ত্র-গ্রন্থে শ্রীকৃষ্ণের যে অসাধারণ অভিজ্ঞতা ছিল, তাঁর প্রতি উক্তিতেই তা প্রতিপন্ন হয়। গীতার দার্শনিক গবেষণায় তিনি দর্শন-সমুদ্র মন্থন করে, উপনিষদের অন্তর্ভুক্ত যে সার রত্ন-সমূহ সমুদ্ধার করেছেন, শ্রীমদ্ভাগবতেও তাঁর উক্তি মধ্যে সেইরূপ সম্পদ দেখতে পাই। শ্রীমদ্ভাগবতে একাদশ স্কন্ধে সপ্তম হতে অষ্টাবিংশ পর্যন্ত অধ্যায়-দ্বাবিংশে উদ্ধবকে তিনি যে উপদেশ দিয়েছেন, তা গীতারই ন্যায় জ্ঞানের ভাণ্ডার। ঐ সকল অধ্যায়ে, অষ্ট-গুরুর প্রসঙ্গে, বন্ধন মুক্তির লক্ষণে, সাধুসঙ্গ-মহিমা কীর্তনে, কর্মানুষ্ঠান ও কর্ম ত্যাগ-বিধি বর্ণনে, সাধন সহ ধ্যানযোগ ব্যাখ্যাতে, অণিমাদি অষ্টসিদ্ধি কথনে, বর্ণাশ্রম ধর্ম, যতিধর্ম এবং ভক্তিযোগ, জ্ঞানযোগ ও ক্রিয়াযোগ নিরূপণে, দ্রব্য আদির দোষ গুণ ব্যাখ্যায় ও তত্ত্ব সম্বন্ধে নানা মতের বিরোধ-ভঞ্জনে, সাঙ্খ্য-যোগ কথনে ও সত্ত্ব আদি গুণের বৃত্তি প্রভৃতি নিরূপণে, ক্রিয়াযোগ ও পরমার্থ নির্ণয়ে, শ্রীকৃষ্ণ আপন জ্ঞানের পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করেছেন। শ্রীভগবান বদ্ধমুক্তি আদির লক্ষণ বিষয়ে, উদ্ধবকে যে উপদেশ দেন, তারই কিছু অংশ উদ্ধৃত করছি,-

“বদ্ধো মুক্ত ইতি ব্যাখ্যা গুণতো মে ন বস্তুতঃ। গুণস্য মায়ামূলত্বাৎ ন মে মোক্ষ ন বন্ধনম্‌॥
শোকমোহৌ সুখং দুঃখং দেহাপত্তিশ্চ মায়য়া। স্বপ্নো যথাত্মনঃ খ্যাতিঃ সংসৃতির্নতূবাস্তবী॥
বিদ্যাবিদ্যে মম তনূ বিদ্ধুদ্ধিব শরীরিনাম্‌। মোক্ষবন্ধকরী আদ্যো মায়য়া মে বিবির্ম্মিতে॥
একস্যৈব মমাংশস্য জীবস্যৈব মহামতে। বন্ধোহস্যাবিদ্যায়ানাদির্বিদ্যয়া চ তথেতরঃ॥
অথ বন্ধস্য মুক্তস্য বৈলক্ষণ্যং বদামি তে। বিরুদ্ধধর্ম্মিণোস্তাত স্থিতয়োরেকধর্ম্মিণি॥
সুপর্নাবেতৌ সদৃশৌ সখায়ৌ যদৃচ্ছয়ৈতৌ কৃতনীড়ৌ চ বৃক্ষে।
একস্তয়োঃ খাদতি পিপ্পলান্নমন্যো নিরন্নোহপি বলেন ভূয়ান॥
আত্মনমন্যঞ্চ স বেদ বিদ্বানপিপ্পলাদো ন তু পিপ্পলাদঃ।
যোহবিদ্যয়া যুক্‌ স তু নিত্যবদ্ধো বিদ্যাময়ো যঃ স তু নিত্যমুক্তঃ॥
দেহস্থোহপি ন দেহস্থো বিদ্বান স্বপ্নাদ্‌যথোত্থিতঃ। অদেহস্থোহপি দেহস্থঃ কুমতিঃ স্বপ্নদৃগ্‌যথা॥
ইংরিইয়ৈরিন্দ্রিইয়ার্থেষু গুণৈরপি গুণেষু চ। গৃহ্যমাণেষ্বহংকুর্য্যান্ন বিদ্বান্‌ যস্ত্ববিক্রিয়॥
দৈবাধীনে শরীরেহস্মিন্‌ গুণভাব্যেন কর্ম্মণা। বর্ত্তমানোহবুধস্তত্র কর্ত্তাস্মীতি নিবধ্যতে॥
এবং বিরক্তঃ শয়ন আসনাটনমজ্জনে। দর্শনস্পর্শনঘ্রাণ-ভোজনশ্রবনাদিষু॥
ন তথা বধ্যতে বিদ্বান্‌ তত্র তত্রাদয়ন্‌ গুণাৎ। প্রকৃতিস্থোহপ্যসংসক্তো যথা খং সবিতানিলঃ॥
বৈশারদ্যেক্ষরাসঙ্গশিতয়া চ্ছিন্নসংশয়ঃ। প্রতিবুদ্ধ ইব স্বপ্নান্নানাত্বাদ্‌বিনিবর্ত্ততে।
যস্য স্যুর্বীতসঙ্কল্পাঃ প্রাণেন্দ্রিয়মনোবিয়াম্‌। বৃত্তয়ঃ স বিনিম্মুক্তো দেহস্থোহপি হি তদ্‌গুণৈঃ॥”

অর্থাৎ, সত্ত্ব আদি গুণের আরোপে আত্মার বদ্ধ বা মুক্ত আখ্যা প্রদান করা হয়। কিন্তু বস্তুত পক্ষে আত্মা বদ্ধ বা মুক্ত নন। গুণ মায়মূলক; সুতরাং আত্মার বন্ধন ও নাই মোক্ষ ও নাই; মায়া দ্বারাই শোক মোহ সুখ দুঃখ ও দেহ উৎপত্তি ঘটে। স্বপনে যেমন মিথ্যাকে সত্য বলে প্রতীত হয়, সৃষ্টি ও তাই; উহা অবাস্তব। শরীরীদের মোক্ষ-বন্ধকারী যে বিদ্যা ও অবিদ্যা, তারা আমারই দুই আদ্যাশক্তি এবং আমার মায়ার দ্বারা বিনির্মিত। আমার অংশ-স্বরূপ এই অদ্বিতীয় অনাদি জীব অবিদ্যা দ্বারা বদ্ধ হয় এবং বিদ্যা দ্বারা মুক্তি লাভ করে। এক অবস্থায় অবস্থিত বিরুদ্ধ-ধর্মাক্রান্ত বদ্ধ ও মুক্ত জীবের বৈলক্ষণ্য সম্বন্ধে একটা দৃষ্টান্তের উল্লেখ করছি। সুন্দর পাখাবিশিষ্ট পরস্পর সমান সখ্যতা-সূত্রে আবদ্ধ দুইটি পাখি ইচ্ছা অনুসারে গাছের শাখায় নীড় নির্মাণ করে অবস্থিত আছে। এদের একজন পিপ্পলান্ন খায়, অন্যজন নিরাহার হলেও বলবান আছে। যে পিপ্পলান্ন খায় না, সেই বিদ্বান আত্মাকে ও আত্মাতীত বস্তু সমূহকে অবগত আছে। যে পিপ্পল খায়, সে সেরকম নয়। যে অবিদ্যার সাথে যুক্ত, সে নিত্যবদ্ধ, যে বিদ্যাময়, সে নিত্যমুক্ত। বিদ্বান জন, স্বপ্নোত্থিতের ন্যায়, দেহস্থ হয়েও দেহস্থ নন; কুমতি মূঢ় জন, স্বপ্ন অবস্থার ন্যায়, অ-দেহস্থ হয়েও দেহস্থ নন; কুমতি মূঢ় জন, সপ্ন অবস্থার ন্যায়, অদেহস্থ হয়েও দেহস্থ। ইন্দ্রিয় দ্বারা ইন্দ্রিয় গ্রহনীয় বিষয় এবং গুণ দ্বারা গুণগণ গ্রহণ করেও নির্বিকার বিদ্বান ব্যক্তি আমি গ্রহণ করছি এমন মনে করেন না। কিন্তু অপণ্ডিত অজ্ঞজন দৈব অধীনে শরীর পরিগ্রহ করে, গুণ-জনিত কর্ম দ্বারা কর্মে প্রবৃত্ত হয়ে, ‘আমি কর্তা’ ভেবে কর্মে আবদ্ধ হয়ে পড়ে। বিদ্বানগণ, শয়ন উপবেশন পর্যটন মর্জন দর্শন স্পর্শন ঘ্রাণ ভোজন শরণ প্রভৃতি বিষয় সকলে বিরক্তভাবে ইন্দ্রিয়গণকে ভোগ করলেও, তার দ্বারা বদ্ধ হন না। প্রকৃতিতে অবস্থিত হলেও আকাশ সূর্য অনিল যেমন অসংসক্ত, বিদ্বান-জন সেরকম বৈরাগ্য যোগ দ্বারা সংশয় ছিন্ন করেন এবং স্বপ্নোত্থিত ব্যক্তির ন্যায় দেহ আদি প্রপঞ্চ হতে নিবৃত্ত থাকেন। যার মন বুদ্ধি ইন্দ্রিয় প্রাণ আচরণ সকল সঙ্কল্প শূন্য, তিনি দেহস্থ হয়েও গুণগণ হতে মুক্ত। শ্রীভগবান বদ্ধ ও মুক্ত পুরুষের এই যে পরিচয় দিলেন, এই অল্প-কয়েকটি বাক্যের মধ্যে সকল জ্ঞানের সমাবেশ আছে। এখানেও সেই উপনিষদের অধ্যায় এখানেও সেই বেদান্তর ব্রহ্ম। ‘সুপণাবেতো সদৃশৌ সখায়ৌ’ ইত্যাদি শ্লোকে তিনি যে উপমার অবতারণা করেছেন ঐ উপমা উপনিষদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে আছে। যথা, মুণ্ডকোপনিষদে,-
দ্বা সুপর্ণা সষজা সখায়া সমানং বক্ষং পরিযস্বজাতে। তয়োবিনা পিপ্পলং সাদ্বত্ত্যনশ্নন্নন্যোহভিচাকশীতি সমান বৃক্ষে পুরুষো নিমগ্নোহনাশয়া শোচতি মুহ্যমানঃ জুষ্টং যদ্য পশ্য—
অর্থাৎ, পরস্পর সখ্যতা সূত্রে আবদ্ধ দুইটি সুন্দর পাখি একই বৃক্ষে অধিষ্ঠিত। তাদের একজন সুস্বাদু পিপ্পল ফল আহার করে, অপর জন ভক্ষণ করে না, কেবল দেখে। একই গাছে অবস্থান একজন অর্থাৎ জীব ঈশ্বরকে না দেখে মুহ্যমান হয়ে শোক প্রকাশ করে, কিন্তু আবার ঈশ্বরকে দেখতে পেলে, তাঁর মহিমা অনুভব করে বীতশোক অর্থাৎ শোকের অতীত অবস্থা প্রাপ্ত হয়।
উপনিষদের এই বাণীই ভাগবতে কৃষ্ণের উক্তিতে ধ্বনিত নয় কি ? যতক্ষণ আত্মজ্ঞান না হয়, মানুষ ততক্ষণ উদ্ভ্রান্ত হয়ে ফিরে। কিন্তু যেই আত্মদর্শন হয়, অমনি সকল বিক্ষোভ বিদূরিত হয়। বেদান্তেও এই ভাব পরিস্ফুট দেখি। অদ্বৈত মতে এই জীবই ব্রহ্মত্ব লাভ করে- যখন তার ভেদজ্ঞান দূর হয়। দ্বৈতমতে পরমেশ্বরই সে ভেদজ্ঞান দূর করে দেন। শ্রীকৃষ্ণ দ্বৈতাদ্বৈতের সকল দ্বন্দ্বের মীমাংসা করে গেছেন। নানা মতের বিরোধ ভঞ্জনে তিনি বলেছেন,-
প্রকৃতেরেবমাত্মানমবিবিচ্যাবুধঃ পুমান্‌।

অর্থাৎ, ‘অবিবেকী পুরুষ প্রকৃতি হতে আত্মাকে তত্ত্বতঃ পৃথক বিচার না করে, দেহাভিমান দ্বারা বিমূঢ় হয়ে সংসার প্রাপ্ত হয়। সত্ত্ব সংসর্গ হেতু ঋষি ও দেব, রজঃ সঙ্গে অসুর ও নর এবং তমঃ সঙ্গে ভূত ও পশু পক্ষী প্রভৃতি যোনিতে সে কর্ম দ্বারা ভ্রমণ করে বেড়ায়। যেমন মানুষ নৃত্যশিল্পী ও গায়কদের দেখে তাদের অনুকরণ করে; সেরকম অনীহ জীব, বুদ্ধির গুণ সকল দর্শন করে অনুকরণ করতে বাধ্য হন। যেমন জল কম্পন হলে তীরে অবস্থিত বৃক্ষ সকল যেন কম্পিত বলে বোধ হয়; যেমন নয়ন ঘূর্ণমান হলে, যেন পৃথিবীকে ভ্ৰমিত দেখায়; হে দাশাহঁ! যেমন কামনাসক্ত-চিত্ত ব্যক্তির বিষয় অনুভব এবং স্বপ্নে দেখা বিষয় অলীক; সেরকম আত্মার জন্ম মৃত্যু। এই পুরুষ বিষয়-নিকর চিন্তা করছে, এ জন্য বিষয়-সকল বর্তমান না থাকলেও, স্বপ্নে অর্থপ্রাপ্তির ন্যায়, এর পক্ষে সংসার বিরাম হয় না। অতএব উদ্ধব! প্রাপ্ত ইন্দ্রিয় নিকর দ্বার বিষয় সকল ভোগ করবে না; দেখ, বিকল্প সম্বন্ধীয় ভ্রম, আত্ম-অজ্ঞান বশতঃই অবভাসিত হচ্ছে। অসাধু জনগণের তিরস্কার, অবমানিত, অসূয়িত, তাড়িত, বন্ধন করে রক্ষিত, ভূতি সকল হতে ধ্বংসিত, কিম্বা অজ্ঞজন কর্তৃক নিষ্ঠীবন দ্বারা ব্যাপ্তীকৃত, অথবা মূত্র দ্বারা আদ্রীকৃত,- এরকম নানাবিধ কষ্টে পতিত হয়েও মঙ্গলাকাঙ্ক্ষী ব্যক্তি পরমেশ্বরে নিষ্ঠা সম্পন্ন হয়ে, আত্মা দ্বারা আত্মাকে উদ্ধার করবেন।’ এর অধিক আর জ্ঞানে পরিচয় হতে পারে না। ‘আত্মনাত্মানমুদ্ধরেৎ’; আত্মার দ্বারা আত্মাকে উদ্ধার করতে হবে; নিজের দ্বারা নিজের উপায় বিধান করতে হবে;-এ জ্ঞান যার হয়েছে, এ জ্ঞান অনুসারে যিনি কাজ করতে সমর্থ হয়েছেন, তাঁর আর ভাবনা কি ? জ্ঞানের এটাই পরাকাষ্ঠা। শ্রীকৃষ্ণ যে পরম জ্ঞানী, ‘আত্মনাত্মানমুদ্ধরেৎ’ এই একমাত্র বাক্যে তা প্রতীত হয়।

শ্রীকৃষ্ণ সকল জ্ঞানে জ্ঞানবান-
শব্দ কোষ-গ্রন্থ আদির অনুসরণে জ্ঞানের যে পরিভাষা দিয়েছে, তাতে বুঝেছি, তত্ত্বজ্ঞানের সঙ্গে সঙ্গে শিল্প-বিজ্ঞানের বিষয়েও অভিজ্ঞতা আবশ্যক। শ্রীকৃষ্ণে যে জ্ঞানের সকল অঙ্গই পরিপুষ্ট-লাভ করেছিল, তাঁর জীবন-বৃত্ত আলোচনায় সকল জ্ঞানে তা সম্যক উপলব্ধি হতে পারে। শ্রীকৃষ্ণ কোন কোন বিষয়ে শিক্ষা পেয়েছিলেন, আর কেমনভাবে সে শিক্ষা তার আয়ত্ত হয়েছিল, তাঁর কথা ও কাজে যেমন পরিচয় পাই, তাঁর বাল্য জীবনের ইতিহাসেও সে পরিচয় তেমনি পেতে পারি। তিনি যেখানে যেভাবে যে বিষয়ে শিক্ষা পেয়েছিলেন, শাস্ত্রে তার উল্লেখ আছে,- শ্রীমদ্ভাগবতে (১০ম স্কন্ধ, ৪৫শ অধ্যায়) যথা,-

উপনয়ন সংস্কারের পর দ্বিজত্ব লাভে রামকৃষ্ণ ভ্রাতৃদ্বয় ব্রহ্মচর্য ব্রত অবলম্বন করেন। ব্রহ্মচর্য অবলম্বনের পর তারা সান্দীপনি মুনির নিকট বিদ্যা শিক্ষার জন্য প্রেরিত হন। সেখানে রামকৃষ্ণ কি কি বিদ্যা শিখেছিলেন, উপরের শ্লোক-কয়েকটিতে তাঁরই পরিচয় আছে। গুরুগৃহে অবস্থানকালে অঙ্গ ও উপনিষদের সাথে তাঁরা নিখিল বেদ শিক্ষা করেন। বেদের অঙ্গ বলতে-শিক্ষা, কল্প, ব্যাকরণ, ছন্দ, নিরুক্ত, জ্যোতিষ প্রভৃতি বুঝিয়ে থাকে। বিভিন্ন বেদের বিভিন্ন উপনিষদের সংখ্যা-নির্ণয়-কল্পে দুই শতাধিক উপনিষদের পরিচয় পাওয় যায়। সুতরাং অঙ্গ ও উপনিষৎ এর সাথে অখিল বেদ অধ্যয়নে কেমন জ্ঞান-গবেষণার প্রয়োজন, সহজেই উপলব্ধি হয়। অঙ্গ ও উপনিষৎ সহ শ্রীকৃষ্ণ যে বেদ শাস্ত্রে অভিজ্ঞতা লাভ করেছিলেন, তাঁর উক্তিতে মহাভারতে ভাগবতে সর্বত্র প্রতিফলিত রয়েছে। তারপর, মন্ত্র ও দেবতা জ্ঞানের সাথে শ্রীকৃষ্ণ ধনুর্বেদ শিক্ষা লাভ করেন! সকল মন্ত্রের সকল দেবতার জ্ঞান-মানুষের সাধ্যায়ত্ত নয়। রামকৃষ্ণ মানুষের অতীত পরম পুরুষ ছিলেন; তাই তাঁরা সকল দেবতা সকল মন্ত্র অধিগত করতে সমর্থ হন। ধনুর্বেদ-যুদ্ধশাস্ত্র। এই ধনুর্বেদের মধ্যে যুদ্ধের উপযোগী সকল সকল অস্ত্রেরই প্রসঙ্গ আসতে পারে। বন্দুক, কামান প্রভৃতিও ধনুর্বেদের অন্তর্ভুক্ত। এই ধনুর্বিদ্যায় বা এই যুদ্ধবিদ্যায় শ্রীকৃষ্ণ যে পারদর্শিতা লাভ করেছিলেন, তাঁর জীবনে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সে নিদর্শন বিদ্যমান। বিবিধ ধর্ম, নীতি-মার্গ, আন্বাক্ষিকী বিদ্যা এবং ষড়বিধ রাজনীতি শিক্ষা প্রসঙ্গেও তাঁর জ্ঞান-গরিমার কি না নিদর্শন পাওয়া যায়! আন্বাক্ষিকী বিদ্যা বলতে- আগম শাস্ত্র প্রতিপাদিত বস্তু-তত্ত্ব জ্ঞানের পর যে তত্ত্বজ্ঞান উপস্থিত হয়, অর্থাৎ দর্শনশাস্ত্র জ্ঞান বলে বুঝতে পারি। গৌতমের ন্যায়-দর্শনকে আন্বাক্ষিকী বিদ্যা বলে কেউ কেউ উল্লেখ করে গেছেন। গীতায় বিশেষভাবে সাঙ্খ্য-দর্শনের মীমাংসা-দর্শনের ও বেদান্ত-দর্শনের বিষয় উল্লেখ হয়েছে দেখে যারা ন্যায়-দর্শনে শ্রীকৃষ্ণের অভিজ্ঞতা সম্বন্ধে সন্দিহান হন, এই আন্বাক্ষিকী বিদ্যার প্রসঙ্গে তাদের সে ভ্রম দূর হতে পারে। রাজনীতি বিষয়ে শ্রীকৃষ্ণের অভিজ্ঞতা যে কত দুর ছিল, বিচ্ছিন্ন রাজশক্তির একত্র করণে-সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠায় তা প্রতিপন্ন হয়। এই সকল বিদ্যা একবার শুনা মাত্র শ্রীকৃষ্ণ শিখে নিয়েছিলেন। সুতরাং তাঁর জ্ঞান কতদূর পরিস্ফুট ছিল, স্বতঃই অনুভূত হতে পারে। তিনি ৬৪ অহোরাত্রে ৬৪ কলাবিদ্যা শিখে নিয়েছিলেন। ৬৪ কলা-বিদ্যা যে কি, সে বিবরণ আমরা পূর্বেই লিপিবদ্ধ করেছি। গীত, বাদ্য, নৃত্য, নাট্য, আলেখ্য প্রভৃতি হতে আরম্ভ করে, আকর জ্ঞান,
ম-জ্ঞান, বাস্তু নির্মাণ জ্ঞান প্রভৃতি মানুষের যা কিছু জ্ঞানের প্রয়োজন আছে, সকলই এই ৬৪ কলার অন্তর্ভুক্ত। () যিনি ৬৪ কলায় নৈপুণ্য লাভ করতে পারেন, তিনিই সঙ্গীতজ্ঞ, তিনিই বাদ্য-বিশারদ, তিনিই নৃত্য-পরায়ণ, তিনিই চারু-চিত্রকর, তিনিই ঐন্দ্রজাল, তিনিই দেশভাষাভিজ্ঞ-তাঁর মানুষিক গুণের অবধি নেই। তিনি সকল গুণে গুণী, তিনি সকল জ্ঞানে জ্ঞানী। শ্রীকৃষ্ণ যে কলাবিদ্যা বিশারদ ছিলেন, তাঁর প্রাণোন্মাদিনী বেণুধ্বনিতে কানে কানে তার প্রতিধ্বনি জাগিয়ে রেখেছে। তিনি যে নটন নিপুণ ছিলেন, তাঁর সেই বামে হেলা ত্রিভঙ্গ-ভঙ্গিমা মূর্তিতে তা প্রকাশমান রয়েছে। কলাবিদ্যার লক্ষণান্তর যে দর্শনরসনাঙ্গরাগ, তাঁর তিলক-ভূষা পীতধড়া মোহন চূড়া প্রভৃতির মধ্যেই তা সমুজ্জ্বল দেখতে পাই। স্থাপত্যে, শিল্প কলায়-কোথায় শ্রীকৃষ্ণের জ্ঞান পরিস্ফুট নয়? তিনি যে বিজ্ঞান শাস্ত্রে বিশারদ ছিলেন, বিনা আগুনে রথ-দাহ্য-ব্যাপারে তা প্রতিপন্ন হয়। () সভাগৃহ নির্মাণে, দ্বারকায় নগর প্রতিষ্ঠায়,() শ্রীকৃষ্ণের কৃতিত্ব আজও জগৎ ঘোষণা করছে। ফলতঃ জ্ঞানের এমন কোনও অঙ্গই নেই, শ্রীকৃষ্ণ যে অঙ্গে অনভিজ্ঞ ছিলেন। তিনি সকল জ্ঞানের জ্ঞানী, তাই বলি-শ্রীকৃষ্ণ পরম জ্ঞানী।

তথ্যসূত্র-
ভারতবর্ষের ইতিহাস, বিশ্বকোষ, পৃথিবীর ইতিহাস(দুর্গাদাস লাহিড়ী)

সংকলনে- শ্রীকৃষ্ণকমল মিন্টু।

(৪) শ্রীকৃষ্ণ- পরম দার্শনিক


শ্রীকৃষ্ণ- পরম দার্শনিক; কেন-না, তিনি সাংখ্য পাতঞ্জল আদি সকল দর্শনের সার-সমন্বয় সাধন করেছেন।

বিভিন্ন দার্শনিক মতের সমন্বয় সাধনে;- শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার সাংখ্য-মত; -প্রকৃতি পুরুষ তত্ত্ব, সাংখ্য ও গীতার সাদৃশ্য; শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার যোগ দর্শন,-সাংখ্য ও পাতঞ্জলে সাদৃশ্য, যোগাঙ্গ সমাধি সাধনা প্রভৃতি, যোগের আদি স্তরের আভাস; মীমাংসা দর্শনের সার তথ্য, শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় যজ্ঞ-বিধির উপযোগিতা প্রসঙ্গ, যজ্ঞ কর্মে ফলাকাঙ্ক্ষা পরিশূন্যতা(ফল কামনা বিহীন); শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় বৈশেষিক দর্শনের ও ন্যায়দর্শনের সার সিদ্ধান্ত; শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় বেদান্ত দর্শন, গীতোক্ত ‘অহং’ ‘আমি’ তত্ত্ব, শ্রীমৎশঙ্করাচার্য্যের ব্যাখ্যায় সে মত পরিস্ফুট; গীতার সার সিদ্ধান্ত, সকলের অধিগম্য সুখ-তত্ত্ব, গীতার দার্শনিক মত সম্বন্ধে বিবিধ বক্তব্য।

শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় দার্শনিক মতের সমন্বয়-
শ্রীকৃষ্ণ- পরম দার্শনিক। দুর্বোধ্য দুরধিগম্য জটিল দর্শন-তত্ত্ব তিনি যেমন সুন্দর সরলভাবে বুঝিয়ে দিয়েছেন, বিভিন্ন দার্শনিক মতের বিবাদের মধ্যে তিনি যেমন সরল সুন্দর সমন্বয় সাধন করে গেছেন, তেমন আর দ্বিতীয় দেখা যায় না। সাংখ্য গণ জ্ঞানমার্গের অনুসরণে ধাবমান হয়েছেন; কিন্তু সামঞ্জস্য সাধন করেন নি। পাতঞ্জল সম্প্রদায়গণ যোগ সাধনেই জীবনের সারভূত বলে একবাক্যে নির্দেশ করলেন; কিন্তু সামঞ্জস্য বিধান করলেন না। এইরকম নৈয়ায়িকগণ, মীমাংসকগণ, বৈদান্তিকগণ, নিজ নিজ পথেই অগ্রসর হয়েছেন, কিন্তু কেউই দর্শন সমুদ্র মন্থনে সার-তত্ত্ব নিষ্কাশনে চেষ্টা করলেন না। দার্শনিকেরা প্রায়ই, কেউ কর্মকে উপেক্ষা করেছেন, কেউ ভক্তিকে উড়িয়ে দিয়েছেন, কেউ বা জ্ঞানকে হাস্যকর করে তুলেছেন। কিন্তু দর্শন শাস্ত্রের যে মুখ্য উদ্দেশ্য- দুঃখ-নিবৃত্তি ও পরমসুখ-লাভ সে পথে যে এ জন্ম-জরা-মরণশীল মানুষের পক্ষে জ্ঞান-ভক্তি-কর্ম তিনেরই প্রয়োজন, বোধ হয় শ্রীকৃষ্ণই জগৎকে তা প্রথম বোঝাতে প্রয়াস পেয়েছেন। যখন কর্ম-কাণ্ড দোষ-দুষ্ট হল, যখন ভক্তিমার্গে কণ্টক এসে পড়ল, যখন জ্ঞান-পথ অজ্ঞান আঁধারে ঘিরে ফেলল, শ্রীকৃষ্ণ সেই অবস্থায় পথ প্রদর্শন করলেন। পাপ আত্মা, ক্রান্ত, দুঃখ-দাবদগ্ধ সকল সন্তপ্ত জনকে তিনি অভয় দিয়ে বললেন,- ভয় নাই! যে যেমন অবস্থাতেই আছ, বিচলিত হয়ো না, উদ্ধার পাবে। গৃহী হও, সন্ন্যাসী হও, কর্মী হও, ভক্ত হও, জ্ঞানী হও- যে যেখানে যে অবস্থায় আছে, সেই অবস্থাতেই যে মুক্তিলাভের পথ আছে, তিনি তা গভীর কণ্ঠে ঘোষণা করলেন। ‘স্বধর্মে নিধং শ্রেয়ঃ’- এই অমৃত বানী কি শুভক্ষণেই শ্রীকৃষ্ণ প্রচার করেছিলেন! সে দুর্দিনে এ বাণী বিঘোষিত না হলে, একাকারের প্রবল বন্যায় সমাজ ভেসে যেত, ধর্ম প্লাবন হত, জাতীয় অস্তিত্ব চিরতরে লোপ পেত। দার্শনিক সম্প্রদায়ের দারুণ উচ্ছৃঙ্খলার মধ্যে সত্যের মহিমা বিস্তারে কি কৌশলেই শ্রীকৃষ্ণ হিন্দু-সমাজকে রক্ষা করেছেন!

জ্ঞান-ভক্তি-কর্ম তিনের দ্বন্ধ সমস্যা সমাধানে-
মীমাংসাই শ্রীকৃষ্ণ চরিত্রের প্রাণভূত। আমরা আগেও বলেছি, আবারও বলছি, সঙ্কট সমস্যার সমাধানই শ্রীকৃষ্ণ চরিত্রের প্রধান শিক্ষা। * জ্ঞান-ভক্তি-কর্ম তিনের প্রাধান্য-অপ্রাধান্য নিয়ে দ্বন্দ্ব কতকাল চলে আসছে এবং আরও কতকাল চলবে, তা কে বলতে পারে? কিন্তু শ্রীকৃষ্ণ দ্বন্দ্বের কেমন সুন্দর মীমাংসা করে দিয়েছেন। জ্ঞান-বাদীরা বলেন,- কর্মে মোক্ষ নাই; যেহেতু, কর্মের ফলে জন্ম আদি সুখ-দুঃখ ভোগ অনিবার্য হয়। এই মতে, যজ্ঞ আদি কর্ম মোক্ষ-হেতু নয়, কারণ, তার দ্বারা স্বর্গ আদি লাভ ঘটলেও তা চির-সুখপ্রদ হয় না; জ্ঞানই একমাত্র মুক্তির উপায়।
কিন্তু কর্মবাদীরা তার প্রতিবাদে বলেন,- কর্মই মূলাধার। জন্মেই কয় জন জ্ঞান-লোক লাভে সমর্থ হন ? শুকদেব বা শঙ্করাচার্য্য হয়ে কয় জন জন্মগ্রহণ করেন? শ্রীকৃষ্ণ সেই দ্বন্দ্বের সমাধান করে দিলেন। তিনি বোঝালেন,- মোক্ষ-মার্গে কর্ম-জ্ঞান-ভক্তি তিনেরই প্রয়োজন। তিনি বোঝালেন- সকল মানুষের শিক্ষা ধর্ম ও অবস্থা একরকম হতে পারে না; বিভিন্ন অবস্থায় মানুষকে মোক্ষ পথে পৌঁছে দেবার পথ তাই বিভিন্ন প্রকার। এই উপলক্ষে তিনি আরও বোঝালেন,- কেউ স্বধর্ম ত্যাগী হইও না; সকলেই আপন আপন ধর্মের মধ্য দিয়ে কর্মের সাহায্যে মোক্ষ লাভে সমর্থ হবে। কিভাবে শ্রীকৃষ্ণ এই তত্ত্ব প্রতিপাদন করেছেন, তা বুঝতে হলে, প্রথমে দর্শনকারদের অভিমত বোঝার প্রয়োজন হয়। তাহলে, সাংখ্যের নিঃশ্রেয়স বা পতঞ্জলির কৈবল্য বলতে কোন অবস্থা বুঝিয়ে থাকে এবং সে অবস্থা কিভাবে প্রাপ্ত হওয়া যায়, স্থূলভাবে তার একটু আলোচনা করা আবশ্যক হয়।
সাংখ্যমতে- ‘জ্ঞানই মুক্তি; প্রকৃতির ও পুরুষের ভেদ-জ্ঞানই সেই মুক্তির মূল। পুরুষ ও প্রকৃতি উভয়েই নিত্য অব্যয় ও অনাদি। তবে পুরুষের সঙ্গে প্রকৃতির সংযোগ হলে, প্রকৃতির যে বিকৃতি ঘটে, সেটাই সংসার- সেটাই সকল দুঃখের নিদান। পুরুষ প্রকৃতির প্রকৃত জ্ঞান লাভই-তত্ত্ব-জ্ঞান লাভ, সে অবস্থাই নিঃশ্রেয়স বা মুক্তি।’ পুরুষ ও প্রকৃতির সেই জ্ঞানলাভের জন্য সাংখ্য পঞ্চ-বিংশতি(২৫) তত্ত্বের জ্ঞানলাভ আবশ্যক বলে নির্দেশ করে গেছেন।(আট প্রকৃতি, ষোল বিকার এবং পুরুষ-এটাই পঞ্চ-বিংশতি তত্ত্ব বা পঞ্চ-বিংশ পদার্থ। তাদের’ই জ্ঞান-তত্ত্বজ্ঞান।) পতঞ্জলির ও প্রায় এই মত। তবে তিনি বলেন,- ‘পঞ্চ-বিংশতি তত্ত্বের অতীত এক পুরুষ বা ঈশ্বর আছেন; তাঁতেই জ্ঞানের পরাকাষ্ঠা, যোগবলে সেই জ্ঞান লাভ হয় এবং সেই জ্ঞানই কৈবল্য।’ ফলতঃ, কি সাংখ্য, কি পাতঞ্জলে উভয়ত্র জ্ঞান-লাভকে মোক্ষ বা কৈবল্য বলেই কীর্তন করা হয়েছে। বেদান্ত ও সেই জ্ঞান-তত্ত্ব উদ্ঘাটন করেছেন। ন্যায়-দর্শনের ও প্রতিপাদ্য- তত্ত্বজ্ঞান-লাভই মুক্তি। মীমাংসকরা যজ্ঞ আদি কর্মকে মোক্ষপদ বলে নির্দেশ করে গেছেন। সকলেই চান- মোক্ষ বা মুক্তি; সুতরাং প্রতিপাদ্য প্রায় সকলেরই অভিন্ন; কেবল পরিগৃহীত পন্থা স্বতন্ত্র। কিন্তু শ্রীকৃষ্ণ তারও সমাধান করে গেছেন। তিনি সকল পথের সকল কর্মের সকল জ্ঞানের গভীরতা নির্ণয়ে সর্ব সামঞ্জস্য সাধন করে দিয়েছেন।

গীতার সাংখ্য-মত।
সকল দেশের সকল দর্শন শাস্ত্রেরই মুখ্য লক্ষ্য এক। এই দুঃখ-তাপময় সংসারে, দুঃখনিবৃত্তি করে, চিরশান্তি-লাভ আশায় সকলেই উৎকন্ঠিত চিত্ত। নিজ নিজ বুদ্ধি যুক্তি ও অভিজ্ঞতা অনুসারে এক একজন এক এক পথ নির্দেশ করে গেছেন। দুঃখ-নিবৃত্তির-শান্তি লাভের জন্য নির্দিষ্ট পথ তাই অসংখ্য। সে পথ সম্বন্ধে প্রাচ্যের নির্দেশ এক রকম, পাশ্চাত্যের নির্দেশ আরেক রকম, ভক্তের নির্দেশ এক রকম, অভক্তের নির্দেশ আরও এক রকম। আমাদের দেশে এই পথ প্রদর্শন সম্বন্ধে ছয়টি প্রধান দার্শনিক মত প্রচলিত; তার শাখা উপশাখা যে কত’ই আছে, তার অন্ত নেই। সেই ষড়বিধ(ছয়টি) দার্শনিক মতের মধ্যে সাংখ্য মত প্রথম আলোচিত হয়ে থাকে। এই মতের মূল-তথ্য প্রকৃতি-পুরুষ তত্ত্ব নিরূপণে। প্রকৃতি পুরুষের মিলন-জনিত বিকৃতিই এই সংসার। সংসারেরই নামান্তর অবিদ্যা। শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় শ্রীকৃষ্ণ বোঝাচ্ছেন, অবিদ্যাই বা কি, আর প্রকৃতি পুরুষই বা কি এবং তাঁদের মিলন জনিত বিকৃতিই বা কি! ‘অবিদ্যা’ বলতে তিনি বোঝালেন, – আত্মীয়-স্বজন-পরিবৃত এই সংসার।+ পুরুষ প্রকৃতি ও তাঁদের সংযোগ ফল বোঝানোর জন্য তিনি (গীতা, ২য় অধ্যায়, ১৩শ-২২শ শ্লোকে) বললেন, –

দেহিনোহস্মিন্ যথা দেহে কৌমারং যৌবনং জরা। তথা দেহান্তরপ্রাপ্তির্ধীরস্তত্র ন মুহ্যতি॥১৩
মাত্রাস্পর্শাস্তু কৌন্তেয় শীতোষ্ণসুখদুঃখদাঃ। আগমাপায়িনোহনিত্যাস্তাংস্তিতিক্ষস্ব ভারত॥১৪
যং হি ন ব্যথয়ন্ত্যেতে পুরুষং পুরুষর্ষভ। সমদুঃখসুখং ধীরং সোহমৃতত্বায় কল্পতে॥১৫
নাসতো বিদ্যতে ভাবো নাভাবো বিদ্যতে সতঃ। উভয়োরপি দৃষ্টোহন্তস্ত্বনয়োস্তত্ত্বদর্শিভিঃ॥১৬
অবিনাশি তু তদ্বিদ্ধি যেন সর্বমিদং ততম্। বিনাশমব্যয়স্যাস্য ন কশ্চিৎ কর্তুমর্হতি॥১৭
অন্তবন্ত ইমে দেহা নিত্যস্যোক্তাঃ শরীরিণঃ। অনাশিনোহপ্রমেয়স্য তস্মাদ্ যুধ্যস্ব ভারত॥১৮
য এনং বেত্তি হন্তারং যশ্চৈনং মন্যতে হতম্। উভৌ তৌ ন বিজানীতো নায়ং হন্তি ন হন্যতে॥১৯॥
ন জায়তে ম্রিয়তে বা কদাচিন্ নায়ং ভূত্বা ভবিতা বা ন ভূয়ঃ।
অজো নিত্যঃ শাশ্বতোহয়ং পুরাণো ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে॥২০॥
বেদাবিনাশিনং নিত্যং য এনমজমব্যয়ম্। কথং স পুরুষঃ পার্থ কং ঘাতয়তি হন্তি কম্॥২১॥
বাসাংসি জীর্ণানি যথা বিহায় নবানি গৃহ্ণাতি নরোহপরাণি।
তথা শরীরাণি বিহায় জীর্ণান্য- ন্যানি সংযাতি নবানি দেহী॥২২॥
নৈনং ছিন্দন্তি শস্ত্রাণি নৈনং দহতি পাবকঃ। ন চৈনং ক্লেদয়ন্ত্যাপো ন শোষয়তি মারুতঃ॥২৩॥
অচ্ছেদ্যোহয়মদাহ্যোহয়মক্লেদ্যোহশোষ্য এব চ। নিত্যঃ সর্বগতঃ স্থাণুরচলোহয়ং সনাতনঃ॥২৪॥

অর্থাৎ, দেহীর দেহ যেভাবে কৌমার, যৌবন ও জরার মাধ্যমে তার রূপ পরিবর্তন করে চলে, মৃত্যুকালে তেমনই ঐ দেহী (আত্মা) এক দেহ থেকে অন্য কোন দেহে দেহান্তর হয়। স্থিতপ্রজ্ঞ পণ্ডিতেরা কখনও এই পরিবর্তনে মুহ্যমান হন না। হে কৌন্তেয়! ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে বিষয়ের সংযোগের ফলে অনিত্য সুখ ও দুঃখের অনুভব হয়। সেগুলি ঠিক যেন শীত এবং গ্রীষ্ম ঋতুর গমনাগমনের মতো। হে ভরতকুল-প্রদীপ! সেই ইন্দ্রিয়জাত অনুভূতির দ্বারা প্রভাবিত না হয়ে সেগুলি সহ্য করার চেষ্টা কর। হে পুরুষশ্রেষ্ঠ (অর্জুন)! যে জ্ঞানী ব্যক্তি সুখ ও দুঃখকে সমান জ্ঞান করেন এবং শীত ও উষ্ণ আদি দ্বন্দ্বে বিচলিত হন না, তিনিই মুক্তি লাভের প্রকৃত অধিকারী। যারা তত্ত্ব-দ্রষ্টা তাঁরা সিদ্ধান্ত করেছেন যে, অনিত্য জড় বস্তুর স্থায়িত্ব নেই এবং নিত্য বস্তু আত্মার কখনও বিনাশ হয় না। তাঁরা উভয় প্রকৃতির যথার্থ স্বরূপ উপলব্ধি করে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন। যা সমগ্র শরীরে পরিব্যাপ্ত হয়ে রয়েছে, তাকে তুমি অবিনাশী বলে জানবে। সেই অব্যয় আত্মাকে কেউ বিনাশ করতে সক্ষম নয়। অবিনাশী, অপরিমেয় ও শাশ্বত আত্মার জড় দেহ নিঃসন্দেহে বিনাশশীল। অতএব হে ভারত! তুমি শাস্ত্রবিহিত স্বধর্ম পরিত্যাগ না করে যুদ্ধ কর। যিনি জীবাত্মাকে হন্তা বলে মনে করেন কিংবা যিনি একে নিহত বলে ভাবেন, তাঁরা উভয়েই আত্মার প্রকৃত স্বরূপ জানেনা না। কারণ আত্মা কাউকে হত্যা করেন না এবং কারও দ্বারা নিহতও হন না। আত্মার কখনও জন্ম হয় না বা মৃত্যু হয় না, অথবা পুনঃ পুনঃ তাঁর উৎপত্তি বা বৃদ্ধি হয় না। তিনি জন্মরহিত শাশ্বত, নিত্য এবং পুরাতন হলেও চিরনবীন। শরীর নষ্ট হলেও আত্মা কখনও বিনষ্ট হয় না। হে পার্থ! যিনি এই আত্মাকে অবিনাশী, শাশ্বত, জন্মরহিত ও অক্ষয় বলে জানেন, তিনি কিভাবে কাউকে হত্যা করতে বা হত্যা করাতে পারেন ? মানুষ যেমন জীর্ণ বস্ত্র পরিত্যাগ করে নতুন বস্ত্র পরিধান করে, দেহী ও তেমনই জীর্ণ শরীর ত্যাগ করে নতুন দেহ ধারণ করেন। আত্মাকে অস্ত্রের দ্বারা কাটা যায় না, আগুনে পোড়ান যায় না, জলে ভেজানো যায় না, অথবা হাওয়াতে শুকানোও যায় না।

প্রকৃতি পুরুষ তত্ত্ব-
আত্মার ও দেহের ভেদ-জ্ঞান যার হৃদয়ে সম্যক উদয় হয়েছে, তিনিই তো প্রকৃত তত্ত্ব-জ্ঞান সম্পন্ন। তাঁর অবিদ্যা তিরোহিত হয়েছে। প্রকৃতি পুরুষের ভেদ-জ্ঞান তিনিই বুঝতে পেরেছেন। কর্ম-জনিত সংসার বন্ধন তাঁকে আর কখনও আবদ্ধ করে রাখতে পারে না। গীতা মাহাত্ম্যে যে লেখা আছে,-
‘সর্ব্বোপনিষদোগাবো দোগ্ধা গোপালনন্দনঃ। পার্থো বৎসঃ সুধী র্ভ্যোক্তা দুগ্ধং গীতামৃতং মহৎ॥
এই উক্তির সার্থকতা পূর্বে উদ্ধৃত কয়েক পংক্তির মধ্যেই যেন জীবন্ত পরিদৃশ্যমান্‌ রয়েছে! গীতা যে সর্ব উপনিষৎ-সার, উদ্ধৃত প্রত্যেক বাক্যেই তা উপলব্ধি হয়। উপনিষদের সার সিদ্ধান্ত,-
‘ন জায়তে ম্রিয়তে বা কদাচিন্ নায়ং ভূত্বা ভবিতা বা ন ভূয়ঃ। অজো নিত্যঃ শাশ্বতোহয়ং পুরাণো ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে॥ (কঠোপনিষৎ, ১২/২৮)।
স বা এষ্‌ মহানজ আত্মাহজরোহমরোহমৃতোহভয়ো ব্রহ্মাভয়ং বৈ ব্রহ্মাভয়ং হি বৈ ব্রহ্মা ভবতে ব এবং বেদ॥ (বৃহদারণ্যকোপনিষৎ, ৪ অঃ ৪২৫) ইত্যাদি।
গীতার ভগবদ বাক্যে কি ঐ বাণীই বিঘোষিত নয়? গীতার মধ্যে শ্লোক দশক সূত্রে (দ্বিতীয় অধ্যায়ের ১৩শ-২২শ শ্লোকে) শ্রীকৃষ্ণ যে সাংখ্য মতের সার-উদ্ধার করেছেন, নিম্নে উদ্ধৃত কয়েক পংক্তিতে তা বেশ বিশদ ভাবে দেখতে পাই। যথা, সপ্তম অধ্যায়ে প্রকৃতি বিভাগ ব্যাপী, কৃষ্ণের উক্তি (৪র্থ ও ৫ম শ্লোক),-
ভূমিরাপোহনলো বায়ুঃ খং মনো বুদ্ধিরেব চ। অহঙ্কার ইতীয়ং মে ভিন্না প্রকৃতিরষ্টধা॥৪॥
অপরেয়মিতস্ত্বন্যাং প্রকৃতিং বিদ্ধি মে পরাম্। জীবভূতাং মহাবাহো যয়েদং ধার্যতে জগৎ॥৫॥

অর্থাৎ- ভূমি, জল, বায়ু, অগ্নি, আকাশ, মন, বুদ্ধি ও অহঙ্কার- এই আট প্রকারে আমার ভিন্না জড়া প্রকৃতি বিভক্ত। হে মহাবাহো! এই নিকৃষ্টা প্রকৃতি ব্যতীত আমার আর একটি উৎকৃষ্টা প্রকৃতি রয়েছে। সেই প্রকৃতি চৈতন্য-স্বরূপা ও জীবভূতা; সেই শক্তি থেকে সমস্ত জীব নিঃসৃত হয়ে এই জড় জগৎকে ধারণ করে আছে। অন্যত্র, ত্রয়োদশ অধ্যায়ে (১ম ও ২য় এবং ১৯শ-২৩শ শ্লোক),-
ইদম শরিরম কৌন্তেয় ক্ষেত্রম ইতি অভিধিয়তে। এতত্ যঃ বেত্তি তম প্রাহুঃ ক্ষেত্রজ্ঞ ইতি তদ্ধিদঃ॥২॥
ইতি ক্ষেত্রম্‌ তথা জ্ঞানম জ্ঞেয়ম চ উত্তম্‌ সমাসতঃ। মত্ ভক্তঃ এতত্ বিজ্ঞায় মদ্ভাবায় উপপদ্যতে॥১৯॥
প্রকৃতিম্‌ পুরুষম্‌ চ এব বিদ্ধি অনাদী উভৌ অপি। বিকারান চ গুণান চ এব বিদ্ধি প্রকৃতি সম্ভবান॥২০॥
কার্য কারন কর্তৃত্বে হেতুঃ প্রকৃতি উচ্যতে। পুরুষ সুখ দুঃখানাম্‌ ভোক্তৃত্বেূ হেতুঃ উচ্যতে॥২১॥
পুরুষ প্রকৃতিস্থঃ হি ভুঙক্তে প্রকৃতিজান গুনান। কারনম্‌ গুনসঙ্গঁ অস্য সদসদ যোনি জন্মসু॥২২॥
উপদ্রস্টা অনুমন্তা চ ভর্তা ভোক্তা মহেশ্বর। পরমাত্মা ইতি চ অপি উক্ত দেহে অস্মিন পুরুষপর॥২৩॥

অর্থাৎ- শ্রীভগবান বললেন- হে কৌন্তেয়, এই দেহকে ক্ষেত্র বলা হয় এবং যিনি এই ক্ষেত্রকে জানেন (অর্থাৎ ‘আমি’ ‘আমার’ এরকম মনে করেন) তিনিই ক্ষেত্রজ্ঞ (জীবাত্মা); ক্ষেত্র-ক্ষেত্রজ্ঞবেত্তা পণ্ডিতগণ এইরকম বলে থাকেন। হে ভারত, সমুদয় ক্ষেত্রে আমাকেই ক্ষেত্রজ্ঞ বলে জানিও; ক্ষেত্র ও ক্ষেত্রজ্ঞের যে জ্ঞান তাহাই প্রকৃত জ্ঞান, এটাই আমার মত। অথবা ক্ষেত্র-ক্ষেত্রজ্ঞের যে জ্ঞান তাহাই আমার (পরমেশ্বরের) জ্ঞান, এটাই সর্বসম্মত। প্রকৃতি ও পুরুষ, উভয়কেই অনাদি বলে জানিও। দেহেন্দ্রিয় আদি বিকার সমূহ এবং সুখ, দুঃখ, মোহ আদি গুণসমূহ প্রকৃতি হতেই উৎপন্ন হয়েছে জানবে। শরীর ও ইন্দ্রিয়দের কর্তৃত্ব বিষয়ে প্রকৃতিই কারণ, এবং সুখ, দুঃখ ভোগ বিষয়ে পুরুষ’ই (ক্ষেত্রজ্ঞ) কারণ বলে উক্ত হন। পুরুষ প্রকৃতিতে অধিষ্ঠিত হয়ে প্রকৃতির গুণসমূহ ভোগ করেন এবং গুণসমূহের সংসর্গই পুরুষের সৎ ও অসৎ যোনিতে জন্মগ্রহণের কারণ হয়। এই দেহে যে পরম পুরুষ আছেন, তিনি উপদ্রষ্টা, অনুমন্তা, ভর্তা, ভোক্তা, মহেশ্বর ও পরমাত্মা বলে উক্ত হন। যিনি এই প্রকার পুরুষ-তত্ত্ব এবং বিকার আদি গুণের সাথে প্রকৃতি-তত্ত্ব অবগত হন, তিনি যে অবস্থায় থাকুন না কেন, পুনরায় জন্মলাভ করেন না অর্থাৎ মুক্ত হন।

সাংখ্য ও গীতার সাদৃশ্য-
ভগবদবাক্যে বেশ বুঝা যায়, প্রকৃতি কি, পুরুষ কি, আর উহার সংযোগে কি বিকৃতি ঘটে! ভগবদ্বাক্যে আরও বুঝা যায়, যিনি প্রকৃতি পুরুষের স্বরূপ-তত্ত্ব অবগত হয়েছেন, তিনিই মুক্তিলাভ করেন। সাংখ্য মতে দেখতে পাই, আট প্রকৃতি, ষোল বিকার। সেই মতে সেই আট প্রকৃতি- (১) অব্যক্ত মূলা প্রকৃতি অর্থাৎ অস্তঃকরণ বা মহত্তত্ত্ব, (২) বুদ্ধি, (৩) অহংকার, (৪-৮) পঞ্চ তন্মাত্র অর্থাৎ রূপ, রস, শব্দ, ও গন্ধ ও স্পর্শ। গীতার শ্লোকেও (ভূমিরাপোহনলোবায়ুখং’ ইত্যাদিতে) প্রকৃতিকে আট ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে; ক্ষিতি, অপ্‌, তেজ, মরুৎ, ব্যোম, মন, বুদ্ধি ও অহঙ্কার। সাংখ্যের সাথে এখানে কোনই বিভিন্ন ভাব দেখা গেল না। সাংখ্য-মতে, পঞ্চ-সূক্ষ্ম-ভূত বা পঞ্চ-তন্মাত্র হতে পঞ্চমহাভূত উৎপন্ন হয়। যে মহাভূত যে তন্মাত্র হতে উৎপন্ন, সেই তন্মাত্র সেই মহাভূতের গুণ বলেই অভিহিত। শব্দ-তন্মাত্র হতে আকাশ-মহাভূত সমুৎপন্ন; আকাশের গুণ শব্দ। এছাড়া, আর মহাভূত সমূহ যথাক্রমে পূর্ব পূর্ব মহাভূতের গুণ ও প্রাপ্ত হয়; যেমন স্পর্শ-তন্মাত্র হতে বায়ু মহাভূত উৎপন্ন হয়; কিন্তু বায়ুর গুণ-শব্দ ও স্পর্শ। রূপ-তন্মাত্র হতে তেজ মহাভূত সমুৎপন্ন; কিন্তু তেজের গুণ-শব্দ, স্পর্শ ও রূপ। রস তন্মাত্র হতে জল মহাভূত সমুৎপন্ন; কিন্তু জলের গুণ-শব্দ, স্পর্শ, রূপ ও রস। গন্ধ-তন্মাত্র হতে পৃথিবী মহাভূত সমুৎপন্ন; কিন্তু পৃথিবী মহাভূতের গুণ-শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস ও গন্ধ। এইভাবে তন্মাত্র-সন্মিলনে যে পঞ্চ-মহাভূত, এই চরাচর বিশ্ব, তারই সংযোগ বিয়োগে সমুৎপন্ন হয়েছে। স্বতরাং ‘ভূমিরাপোহনলোবায়ুথঃ’ এই পঞ্চ মহাভূতের উল্লেখে প্রকারান্তরে পঞ্চ তন্মাত্রেরই উল্লেখ হয়েছে, বুঝা যাচ্ছে। অতএব, ঐ কয়েকটি শ্লোকে শ্ৰীভগবান যে সাংখ্য-দর্শনের সার-তত্ত্ব উদ্ঘাটন করেছেন, তা বলাই বাহুল্য। ‘ক্ষেত্র’ ও ‘ক্ষেত্রজ্ঞ’ অ্ধ্যায়ে শ্রীভগবান পুরুষ ও প্রকৃতির যে পরিচয় দিলেন, তা ও সাংখ্য-মত থেকে অভিন্ন এবং শ্রুতি অনুসারী। শ্রুতি বলছেন, – ‘অনেন জীবেনাত্মানাসু প্রবিশ্য নামরূপে ব্যাকরবাণি।’ অর্থাৎ, ‘জীবাত্মারূপে অনুপ্রবিষ্ট হয়ে, নামরূপে পরিব্যক্ত হব’। সেই যে ক্ষেত্রজ্ঞ পরম পুরুষ, তিনিই প্রকৃতিতে অনুপ্রবিষ্ট হয়ে, বিকৃতি-প্রাপ্তিতে নামরূপ ধারণ করেন। ‘অপরেয়মিতিস্ত্বন্যাং’ ইত্যাদি বাক্যে সেটাই বুঝিয়ে থাকে। সাংখ্য-মতে ‘ব্যক্ত’, ‘অব্যক্ত’ ও ‘জ্ঞ’ শব্দ তিনটি যথাক্রমে দৃশ্যমান জড় জগৎকে, জগতের নিদানভূত মূলা প্রকৃতিকে এবং চৈতন্য-স্বরূপ (জড়াতীত)পুরুষকে বা আত্মাকে বুঝিয়ে থাকে। পুরুষ-অনাদি, অনন্ত, চেতন ও নিষ্ক্রিয়। প্রকৃতি- জড়-ধর্ম আক্রান্ত, গুণময়ী, অবিবেকী। পুরুষের সঙ্গে মিলিত হয়ে প্রকৃতি যে কাজ করে, সাংখ গণ সেই মিলন-কাজকে ‘সংঘাত’ বলেন। চৈতন্যের সঙ্গে মিলন-জনিত কাজই সংঘাত। সংসারে যে কোনও বস্তু আছে, ঐ সংঘাত-জনিতই তার সমস্তই সম উৎপন্ন। সংঘাতে উৎপন্ন সমস্ত পদার্থ একের প্রয়োজন-সাধক হয়। স্থূলদৃষ্টাস্তেব অবতারণায় বুঝতে পারি, এই ঘর বাড়ি- খাট-বিছানা পোষাক-পরিচ্ছদ-এমন fকি এই দেইটি পর্য্যন্ত, সকলই সংঘাতে উৎপন্ন, সকলই একের প্রয়োজন-সাধন উদ্দেশ্যে নিয়োজিত। এ হিসাবে, পুরুষ ভোক্তা, সংঘাত উৎপন্ন বস্তু-মাত্রই ভোগ্য, আর পুরুষের সংযোগেই প্রকৃতি ক্রিয়মাণ। এই বিষয় বুঝানোর জন্য, সাংখ্যকাররা দুইটি দৃষ্টান্তের অবতারণা করেন। প্রথম, মনে করুন-একটি পুষ্প। পুষ্পের উৎপত্তি-মূলেও পুরুষ, পুষ্পের সৌন্দর্য্য-সুগন্ধ অনুভবেও পুরুষ। পুষ্প কখনও নিজে নিজের সৌন্দর্য্য বা সুগন্ধ উপভোগ করে না। সুতরাং তার শোভা সৌন্দর্য্য সৌরভের ভোক্তা অন্য একজন আছেন। তিনিই পুরুষ বা আত্মা। একের সাথে অন্যের- পুরুষের সঙ্গে প্রকৃতির সংযোগ না হলে প্রকৃতির ক্রিয়মাণত্ব যে প্রকাশ পায় না, তার দৃষ্টান্ত স্বরূপ সাংখ্যকাররা পঙ্গু ও অন্ধের উদাহরণ দিয়ে থাকেন। পঙ্গু ও অন্ধ উভয়ে স্থানান্তরে যেতে ইচ্ছুক, কিন্তু অঙ্গহীনতার জন্য উভয়েই সেকাজে অসমর্থ। এক্ষেত্রে পঙ্গু ব্যক্তি যদি অন্ধের কাঁধে আরোহণ করে, তাহলে উভয়েই গন্তব্যে পৌঁছানো সম্ভব। প্রকৃতি জড় হলেও চেতন পুরুষের সাহায্যে কার্য্যকরী ক্ষমতা লাভ করে। ফলতঃ সৃষ্টি ব্যাপারে সাক্ষাৎ সম্বন্ধে পুরুষ কাজ করেন না বটে, কিন্তু পরোক্ষভাবে তিনিই সৃষ্টির কারণ স্বরূপ বলা হয়।
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় প্রকৃতির ‘পরা’ ও ‘অপরা’ দুই অবস্থা কীর্তিত হয়েছে। যে প্রকৃতি পুরষের সঙ্গে সম্বন্ধ যুক্ত অর্থাৎ চৈতন্য সান্নিধ্য প্রাপ্ত, সেটাই পরা বা শ্রেষ্ঠা প্রকৃতি, আর যা চৈতন্য সান্নিধ্য যুক্ত নয়, তা অপরা বা নিকৃষ্টা প্রকৃতি। এই প্রকৃতি পুরুষের তত্ত্ব আলোচনা করে, শ্রীকৃষ্ণ শেষ বুঝিয়েছেন, সকলের মূল-আমি। ‘মত্তঃ পরতরং নান্যৎ কিঞ্চিদস্তি ধনঞ্জয়। ময়ি সর্ব্বমিদং প্রোতং সূত্রে মণিগণা ইব।’ অর্থাৎ, এ জগতে আমার অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ আর কেউই নেই। সূত্রে যেমন মণি-মুক্তা গ্রথিত থাকে, তেমনি আমাতেই এই বিশ্ব গাঁথা রয়েছে। এই যে আমি, কারও ভাষায় পুরুষ বা আত্মা, কারও ভাষায় পরমব্রহ্ম পরমেশ্বর শ্রীভগবান, আবার কারও ভাষায় পরমপুরুষ শ্রীকৃষ্ণ।

সাংখ্য ও যোগ।
শ্ৰীভগবান যেমন সাংখ্য-মত বিবৃত করে মানুষকে নিঃশ্রেয়স-পথ প্রদর্শন করেছেন, তেমনই আবার তিনি যোগ-তত্ত্ব বিশদভাবে মানুষের কৈবল্য-প্রাপ্তির পথ সুগম করে দিয়েছেন। সাংখ্য-মতের সঙ্গে সঙ্গে পাতঞ্জল-মতের মালোচনায়, মূলে ঐ দুই মতের মধ্যে কি ঐক্য রয়েছে,- গীতায় তা বড় সুন্দরভাবেই বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। মূলে যে দুই মতই এক, বোধ হয় শ্রীকৃষ্ণের আগে আর কেউ এমনভাবে বুঝাতে সমর্থ হন নাই। সাংখ্য-গণ যে তত্ত্ব অনুসদ্ধানে নিয়োজিত, যোগমার্গ অবলম্বীদের ও সেই তত্ত্ব অনুসন্ধানে নিয়ত রয়েছেন। অথচ, আশ্চর্য্যের বিষয়, উহাদের পরস্পরের মধ্যে দ্বন্দ্বের অবধি নাই! মূল অনুসন্ধানের বিষয় উভয়েরই অভিন্ন; কেবল অনুসন্ধানের প্রকৃতি পদ্ধতি বিভিন্ন। এক পক্ষ জ্ঞানের দ্বারা জ্ঞানের অনুসন্ধান করতে চান, অপর পক্ষ জ্ঞানের সঞ্চয়ে জ্ঞান স্বরূপে লীন হবার আকাঙ্ক্ষা করেন। শ্রীকৃষ্ণ তাই বোঝাচ্ছেন, অজ্ঞেরাই পার্থক্য অনুধাবন করেন; নচেৎ, কি সাংখ্য, কি যোগ, উভয়ের একের অনুষ্ঠানেই মানুষ মোক্ষ লাভে সমর্থ হয়। মূলতঃ উভয়েই এক; যিনি সাংখ্যকে ও যোগকে এক দেখেন, তিনি সম্যক দর্শন শক্তি লাভ করেছেন। শ্রীকৃষ্ণ তারস্বরে এই কথা ঘোষণা করে গেছেন। যথা-
যৎ সাংখ্যৈঃ প্রাপ্ত্যতে স্থানং তদ্‌যোগৈরপি গম্যতে। একং সাংখ্যঞ্চ যোগঞ্চ যঃ পশ্যতি স পশ্যতি।
সাংখ্যের ও যোগের অঙ্গ, যোগের আসন, যোগের ফল প্রভৃতি বিষয় বিবৃত করে গেছেন। ‘যোগশ্চিত্তবৃত্তিনিরোধঃ’,-পাতঞ্জল সূত্রে যোগের এই প্রধান লক্ষণ পরিদৃষ্ট হয়। শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় শ্রীকৃষ্ণ সেই কথাই আরও একটু বিশদ ভাবে বুঝিয়ে বলছেন,-
যদা হি নেন্দ্রিয়ার্থেষু ন কর্মস্বনুষজতে। সর্বসঙ্কল্পসন্ন্যাসী যোগারদঢস্তদোচ্যতে॥
উদ্ধরেদাত্মনাত্মানং নাত্মানমবসাদয়েৎ। আত্মৈব হ্যাত্মনো বন্ধুরাত্মৈব রিপুরাত্মনঃ।
বন্ধুরাত্মাত্মনস্তস্য যেনাত্মৈবাত্মনা জিতঃ। অনাত্মনস্তু শত্রুত্বে বর্তেতাত্মৈব শত্রুবৎ॥
জিতাত্মনঃ প্রশান্তস্য পরমাত্মা সমাহিতঃ। শীতোষ্ণসুখদুঃখেষু তথা মানাপমানয়োঃ॥
জ্ঞানবিজ্ঞানতৃপ্তাত্মা কূটস্থো বিজিতেন্দ্রিয়ঃ। যুক্ত ইত্যুচ্যতে যোগী সমলোষ্টাশ্মকাঞ্চনঃ॥
সুহৃন্মিত্রার্যুদাসীনমধ্যস্থদ্বেষ্যবন্ধুষু। সাধুষ্বপি চ পাপেষু সমবুদ্ধির্বিশিষ্যতে॥
অর্থাৎ, যখন সাধক সর্বসঙ্কল্প ত্যাগ করায় রূপরসাদি ইন্দ্রিয় ভোগ্যবিষয়ে এবং কর্মে আসক্ত হন না, তখন তিনি যোগারূঢ় বলিয়া উক্ত হন। আত্মার দ্বারাই আত্মাকে বিষয়কূপ হইতে উদ্ধার করিবে, আত্মাকে অবসর করিবে না (নিম্নদিকে যাইতে দিবে না)। কেননা, আত্মাই আত্মার বন্ধু এবং আত্মাই আত্মার শত্রু। যে আত্মাদ্বারা আত্মা বশীভূত হয়েছে, সেই আত্মাই আত্মার বন্ধু। অজিতাত্মার আত্মা শত্রুবৎ অপকারে প্রবৃত্ত হয়। জিতেন্দ্রিয়, প্রশান্ত অর্থাৎ রাগদ্বেষাদিশূন্য ব্যক্তির পরমাত্মা শীত-গ্রীষ্ম, সুখ-দুঃখ, অথবা মান-অপমান প্রাপ্ত হলেও সমাহিত থাকে (অর্থাৎ অবিচলিতভাবে আপন সম-শান্ত-স্বরূপে অবস্থান করে)। যাঁর চিত্ত শাস্ত্র আদির উপদেশজাত জ্ঞান ও উপদিষ্ট তত্ত্বের প্রত্যক্ষ অনুভূতির দ্বারা পরিতৃপ্ত, যিনি বিষয়-সন্নিধানেও নির্বিকার ও জিতেন্দ্রিয়, মৃৎপিণ্ড পাষাণ ও সুবর্ণখণ্ডে যাঁরা সমদৃষ্ট, ঈদৃশ যোগীকে যুক্ত (যোগসিদ্ধ) বলে। সুহৃৎ, মিত্র, শত্রু, উদাসীন, মধ্যস্থ, দ্বেষ্য, বন্ধু, সাধু ও অসাধু-এই সকলের প্রতি যাঁর সমান বুদ্ধি, তিনিই প্রশংসনীয় অর্থাৎ তিনি সর্ববিষয়ে সকলের প্রতি রাগদ্বেষশূন্য, তিনিই শ্রেষ্ঠ।
যোগ সূত্রে যোগের যে অবস্থা বর্ণিত আছে, এখানেও সেই অবস্থাই বিবৃত হয়েছে। চিত্তবৃত্তি নিরোধ- এর অপেক্ষা কি হতে পারে! তারপর-যোগের অঙ্গ। পতঞ্জলি যোগ সূত্রে যম, নিয়ম, আসন, প্রাণায়াম, প্রত্যাহার, ধ্যান, ধারণা সমাধি- এই অষ্টবিধ যোগাঙ্গের নির্দেশ করেছেন। গীতায়ও দেখুন,- সেই অঙ্গ আদির বিষয় কি ভাবে বিবৃত হয়েছে।
যোগী যুঞ্জীত সততমাত্মানং রহসি স্থিতঃ। একাকী যতচিত্তাত্মা নিরাশীরপরিগ্রহঃ॥
শুচৌ দেশে প্রতিষ্ঠাপ্য স্থিরমাসনমাত্মনঃ। নাত্যুচ্ছ্রিতং নাতিনীচং চৈলাজিনকুশোত্তরম্॥
তত্রৈকাগ্রং মনঃ কৃত্বা যতচিত্তেন্দ্রিয়ক্রিয়ঃ। উপবিশ্যাসনে যুঞ্জ্যাদ্ যোগমাত্মবিশুদ্ধয়ে॥
সমং কায়শিরোগ্রীবং ধারয়ন্নচলং স্থিরঃ। সংপ্রেক্ষ্য নাসিকাগ্রং স্বং দিশশ্চানবলোকয়ন্॥
প্রশান্তাত্মা বিগতভীর্ব্রহ্মচারিব্রতে স্থিতঃ। মনঃ সংযম্য মচ্চিত্তো যুক্ত আসীত মৎপরঃ॥
যুঞ্জন্নেবং সদাত্মানং যোগী নিয়তমানসঃ। শান্তিং নির্বাণপরমাং মৎসংস্থামধিগচ্ছতি॥
নাত্যশ্নতস্তু যোগোহস্তি ন চৈকান্তমনশ্নতঃ। ন চাতিস্বপ্নশীলস্য জাগ্রতো নৈব চার্জুন॥
যুক্তাহারবিহারস্য যুক্তচেষ্টস্য কর্মসু। যুক্তস্বপ্নাববোধস্য যোগো ভবতি দুঃখহা॥
যদা বিনিয়তং চিত্তমাত্মন্যেবাবতিষ্ঠতে। নিস্পৃহঃ সর্বকামেভ্যো যুক্ত ইত্যুচ্যতে তদা॥
যথা দীপো নিবাতস্থো নেঙ্গতে সোপমা স্মৃতা। যোগিনো যতচিত্তস্য যুঞ্জতো যোগমাত্মনঃ॥
যত্রোপরমতে চিত্তং নিরুদ্ধং যোগসেবয়া। যত্র চৌবাত্মনাত্মানং পশ্যন্নাত্মনি তুষ্যতি॥
সুখমাত্যন্তিকং যত্তদ্‌বুদ্ধিগ্রাহ্যমতীন্দ্রিয়ম্। বেত্তি যত্র ন চৌবায়ং স্থিতশ্চলতি তত্ত্বতঃ॥
যং লব্ধ্বা চাপরং লাভং মন্যতে নাধিকং ততঃ। যস্মিন্ স্থিতো ন দুঃখেন গুরুণাপি বিচাল্যতে॥
তং বিদ্যাদ্দুঃখসংযোগবিয়োগং যোগসংজ্ঞিতম্। স নিশ্চয়েন যোক্তব্যো যোগোহনির্বিণ্নচেতসা॥
সংকল্পপ্রভবান্ কামাংস্ত্যক্ত্বা সর্বানশেষতঃ। মনসৈবেন্দ্রিয়গ্রামং বিনিয়ম্য সমন্ততঃ॥
শনৈঃ শনৈরুপরমেদ্ বুদ্ধ্যা ধৃতিগৃহীতয়া। আত্মসংস্থং মনঃ কৃত্বা ন কিঞ্চিদপি চিন্তয়েৎ॥
যতো যতো নিশ্চরতি মনশ্চঞ্চলমস্থিরম্। ততস্ততো নিয়ম্যৈতদাত্মন্যেব বশং নয়েৎ॥
প্রশান্তমনসং হ্যেনং যোগিনং সুখমুত্তমম্। উপৈতি শান্তরজসং ব্রহ্মভূতমকল্মষম্॥
যুঞ্জন্নেবং সদাত্মানং যোগী বিগতকল্মষঃ। সুখেন ব্রহ্মসংস্পর্শমত্যন্তং সুখমশ্নুতে॥
সর্বভূতস্থমাত্মানং সর্বভূতানি চাত্মনি। ঈক্ষতে যোগযুক্তাত্মা সর্বত্র সমদর্শনঃ॥
যো মাং পশ্যতি সর্বত্র সর্বং চ ময়ি পশ্যতি। তস্যাহং ন প্রণশ্যামি স চ মে ন প্রণশ্যতি॥
সর্বভূতস্থিতং যো মাং ভজত্যেকত্বমাস্থিতঃ। সর্বথা বর্তমানোহপি স যোগী ময়ি বর্ততে॥
অর্থাৎ, যোগী একাকী নির্জন স্থানে থেকে সংযতচিত্ত, সংযতদেহ, আকাঙ্ক্ষাশূন্য ও পরিগ্রহশূন্য হয়ে চিত্তকে সতত সমাধি অভ্যাস করাবেন। ১০
পবিত্র স্থানে নিজ আসন স্থাপন করবে; আসন যেন অতি উচ্চ অথবা অতি নিম্ন না হয়। কুশের উপরে ব্যাঘ্রাদির চর্ম এবং তার উপর বস্ত্র পেতে আসন প্রস্তুত করতে হয়; সেই আসনে উপবেশন করে চিত্ত ও ইন্দ্রিয়ের ক্রিয়া সংযম পূর্বক মনকে একাগ্র করে আত্মশুদ্ধির জন্য যোগ অভ্যাস করবে। ১১,১২
শরীর (মেরুদণ্ড), মস্তক ও গ্রীবা সরলভাবে ও নিশ্চলভাবে রেখে সুস্থির হয়ে আপনার নাসাগ্রবর্তী আকাশে দৃষ্টি রাখবে, এদিক্‌ ওদিক্‌ তাকাবে না; (এইভাবে উপবেশন করে) প্রশান্ত-চিত্ত, ভয়বর্জিত, ব্রহ্মচর্যশীল হয়ে মনঃসংযম পূর্বক মৎপরায়ণ মদ্গতচিত্ত হয়ে সমাধিস্থ হবে। ১৩-১৪
পূর্বোক্ত প্রকারে নিরন্তর মনঃসমাধান করতে করতে মন একাগ্র হয়ে নিশ্চল হয়। এমন স্থিরচিত্ত যোগী নির্বাণরূপ পরম শান্তি লাভ করেন। এই শান্তি আমাতেই স্থিতির ফল। ১৫
হে অর্জুন, কিন্তু যিনি অত্যধিক আহার করেন অথবা যিনি একান্ত অনাহারী, তাঁহার যোগ হয় না; অতিশয় নিদ্রালু বা অতিজাগরণশীলের যোগসমাধি হয় না। ১৬
যিনি পরিমিতরূপ আহার-বিহার করেন, পরিমিতরূপ কর্মচেষ্টা করেন, পরিমিতরূপে নিদ্রিত ও জাগ্রত থাকেন, তাঁহার যোগ দুঃখনিবর্তক হয়। ১৭
যখন চিত্ত বিশেষভাবে নিরুদ্ধ হয়ে আত্মাতেই অবস্থিতি করে, তখন যোগী সর্বকামনাশূন্য হয়। ঈদৃশ যোগী পুরুষই যোগসিদ্ধ বলে কথিত হন। ১৮
নির্বাত-প্রদেশে স্থিত দীপশিখা যেমন চঞ্চল হয় না, আত্মবিষয়ক যোগাভ্যাসকারী সংযতচিত্ত যোগীর অচঞ্চল চিত্তের উহাই দৃষ্টান্ত। ১৯
যে অবস্থায় যোগাভ্যাসদ্বারা নিরুদ্ধ চিত্ত উপরত (সর্ববৃত্তিশূন্য, নিষ্ক্রিয়) হয় এবং যে অবস্থায় আত্মাদ্বারা আত্মাতেই আত্মাকে দেখে পরিতোষ লাভ হয় (তাহাই যোগ শব্দ বাচ্য জানিও)। ২০
যে অবস্থায় ইন্দ্রিয়ের অগোচর, কেবল শুদ্ধ বুদ্ধিগ্রাহ্য যে নিরতিশয় সুখ (আত্মানন্দ) যোগী তাহাই অনুভব করেন এবং যে অবস্থায় স্থিতি লাভ করে আত্মস্বরূপ হতে বিচলিত হন না, তাহাই যোগশব্দবাচ্য জানবে। ২১
যে অবস্থা লাভ করলে যোগী অন্য কোন লাভ এর অপেক্ষা অধিক সুখ-কর বলে বোধ করেন না এবং যে অবস্থায় স্থিতি লাভ করলে মহাদুঃখেও বিচলিত হন না (তাহাই যোগশব্দবাচ্য জানবে)। ২২
এরকম অবস্থায় (চিত্তবৃত্তিনিরোধে) দুঃখসংযোগের বিয়োগ হয়, এই দুঃখ-বিয়োগই যোগশব্দবাচ্য। এই যোগ নির্বেদশূন্য চিত্তে অধ্যবসায় সহকারে অভ্যাস করা কর্তব্য। ২৩
সংকল্পজাত কামনাসমূহকে বিশেষরূপে ত্যাগ করে, মনের দ্বারা (চক্ষুরাদি) ইন্দ্রিয়সমূহকে বিষয় ব্যাপার হতে নিবৃত্ত করে, ধৈর্য্যযুক্ত বুদ্ধিদ্বারা মন ধীরে ধীরে নিরুদ্ধ করবে এবং এইরূপ নিরুদ্ধ মনকে আত্মাতে নিহিত করে (আত্মাকারবিশিষ্ট করে) কিছুই ভাবনা করবে না। ২৪-২৫
মন স্বভাবতঃ চঞ্চল, অতএব অস্থির হয়ে উহা যে যে বিষয়ে ধাবিত হয়, সেই সেই বিষয় হতে উহাকে প্রত্যাহার করে আত্মাতেই স্থির করে রাখবে। ২৬
এইরূপ যোগসিদ্ধ পুরুষ চিত্তবিক্ষেপক রজোগুণবিহীন এবং চিত্তলয়ের কারণ তমোগুণ বর্জিত হয়ে ব্রহ্মভাব লাভ করেন, ঈদৃশ প্রশান্তচিত্ত যোগীকে নির্মল সমাধি-সুখ আশ্রয় করে। ২৭
এই রূপে সদা মনকে সমাহিত করিয়া নিষ্পাপ হওয়ায় যোগী ব্রহ্মানুভবরূপ নিরতিশয় সুখ লাভ করেন। ২৮
এমন যোগযুক্ত পুরুষ সর্বত্র সমদর্শী হয়ে আত্মাকে সর্বভূতে এবং সর্বভূতকে আত্মাতে দর্শন করে থাকেন। ২৯
যিনি আমাকে সর্বভূতে অবস্থিত দেখেন এবং আমাতে সর্বভূত অবস্থিত দেখেন, আমি তাহার অদৃশ্য হই না, তিনিও আমার অদৃশ্য হন না। ৩০
যে যোগী সমত্ববুদ্ধি অবলম্বনপূর্বক সর্বভূতে ভেদজ্ঞান পরিত্যাগ করে সর্বভূতস্থিত আমাকে ভজনা করেন, তিনি যে অবস্থায়ই থাকুন না কেন, আমাতেই অবস্থান করেন। ৩১
হে অর্জুন, সুখই হোক, আর দুঃখই হোক, যে ব্যক্তি আত্মসাদৃশ্যে সর্বত্র সমদর্শী সেই যোগী সর্বশ্রেষ্ঠ এই আমার অভিমত। ৩২

এই সকল বিষয় বলার পর উপসংহারে শ্রীকৃষ্ণ বলিলেন,- ‘যোগিনামপি সর্বেষাং মদ্গতেনান্তরাত্মনা।
শ্রদ্ধাবান্ ভজতে যো মাং স মে যুক্ততমো মতঃ॥
অর্থাৎ, যিনি শ্রদ্ধাবান্‌ হয়ে মদ্গতচিত্তে আমার ভজনা করেন, সকল যোগীর মধ্যে তিনিই আমার সঙ্গে যোগে সর্বাপেক্ষা অধিক যুক্ত, এটাই আমার অভিমত অর্থাৎ ভগবানে ঐকান্তিক ভক্তিপরায়ণ যোগীই শ্রেষ্ঠ সাধক।
সকল মতের আলোচনার উপসংহারে শ্রীকৃষ্ণের যে উক্তি দেখতে পাই, যোগ তত্ত্বের ব্যাখ্যা বিশেষ করতে গিয়েও সেই কথারই প্রতিধ্বনি শুনি। সকল বাণীর সার বানী- এক মনে এক প্রাণে তাঁর-শ্রীভগবানের শরণাপন্ন হও। এখানেও সেই- ‘আমি’। যিনি যে অখণ্ড ঘন, সেই এটিএম, সেই পরম পুরুষ, সেই ‘আমি’। সাংখ্য পাতঞ্জলের যোগ সম্পদ সমৃদ্ধ আকারে শ্রীকৃষ্ণ সর্বত্রই দেখিয়েছেন-সেই আমি।

অভ্যাস যোগের প্রথম স্তর।
অভ্যাস’ই সকল যোগের মূল। চিত্ত বায়ুগতি বিচঞ্চল, অথচ চিত্তকে স্থির করতে না পারলে, কৈবল্য তো দূরের কথা, কোনও উদ্দেশ্যই সুসিদ্ধ হয় না। কি সাংখ্যে র জ্ঞান, কি পাতঞ্জলের যোগ,- চিত্ত স্থিরতার উপর কলহ নির্ভর করে। অভ্যাস- সেই চিত্ত স্থিরতার প্রথম সোপান। এবিষয় বিশেষভাবে উপলব্ধি করার জন্য শ্রীভগবান উপদেশ দিয়েছেন,- যদি তুমি মন স্থির করতে পার, একমাত্র আমাতেই তোমার চিত্ত নিবিষ্ট হয়, তাহলে আমাতেই অবস্থান করবে অর্থাৎ কৈবল্য লাভে সমর্থ হবে। কিন্তু যদি তাঁতে অসমর্থ হও, যদি তোমার চিত্ত স্থৈর্য্য না আসে, তুমি মদ্ভগচিত্ত হতে অভ্যাস কর, অর্থাৎ, চিত্তকে বার বার আমার প্রতি ন্যস্ত করার জন্য অভ্যস্ত হও। যদি অভ্যাসেও অসমর্থ হও, অর্থাৎ বিক্ষিপ্ত চিত্তকে ফিরিয়ে এনে আমার প্রতি—শরণাগত অপারগ হয়ে পড়, তবে আমার প্রীতি সাধনের উপযোগী কর্ম সকল অনুষ্ঠান করতে প্রবৃত্ত হবে। আমার প্রীতি সাধনের উপযোগী কর্মসমূহের দ্বারাও সিদ্ধিলাভ করতে পারবে। যদি সে কর্মেও তোমার সামর্থ্য না থাকে, একান্ত প্রাণে আমার শরণাপন্ন হও, আর সংযতচিত্ত হয়ে কর্মফল সমূহ পরিত্যাগ কর। অর্থাৎ, যে কাজই যখন কর না কেন, তাঁর কাজ তিনি করাচ্ছেন, এই মনে করে ফলের আশা পরিত্যাগ কর, তাহলেও তোমার উপায় হবে। অভ্যাস হতে জ্ঞান শ্রেষ্ঠ, জ্ঞান হতে ধ্যান শ্রেষ্ঠ, আবার ধ্যান হতে কর্ম-ফল-ত্যাগ শ্রেষ্ঠ, কর্মফল ত্যাগ অর্থাৎ আসক্তি নিবৃত্তি হতেই শান্তি অধিগত হয়।
এইরকম উপদেশ দিয়ে শ্রীকৃষ্ণ প্রকারান্তরে বুঝালেন যে, মানুষ বিভিন্ন অবস্থায় বিভিন্ন স্তরে অবস্থিত; সুতরাং বিভিন্ন জনের বিভিন্ন প্রকার পথ নির্দিষ্ট। ব্যাধি যেমন বিপরীত ধর্মাক্রান্ত; ভেষজেরও তেমনি অন্ত নেই। অভ্যাস- যোগাঙ্গের প্রথম স্তর। এই স্তরে ধীরে ধীরে চিত্তকে বিষয় নিরহ হতে প্রতিনিবৃত্ত করতে হয়; একবার অসমর্থ হলে দ্বিতীয় বাড়ে, দ্বিতীয় বার অসমর্থ হলে তৃতীয় বাড়ে, এভাবে বারবার চেষ্টার ফলে মানুষ চিত্তবৃত্তি-নিরোধে সমর্থ হয়। অভ্যাস-সেই চেষ্টা বিশেষ। অভ্যাস করতে করতে যদি অকৃতকার্য্য ও হওয়া যায়, চেষ্টার পর চেষ্টায়ও যদি সফল-কাম হতে না পারি, তাতেও নিরুৎসাহ হবার কারণ নাই। সে সম্বন্ধেও শ্রীভগবান অভয় দিয়ে বলছেন, ‘সৎকর্ম্মকারী এই জীবনে সিদ্ধি লাভ না করলেও পরজীবনে তার দুর্গতি হয় না। এ জীবনে যাঁরা যোগ-ভ্রষ্ট হন, পরজীবনে তাঁদের উচ্চগতি প্রাপ্তি ঘটে। তারদ্বারা উৎকর্ষের পর উৎকর্ষ লাভে তাঁরা পরমাগতি প্রাপ্ত হয়ে থাকেন! ফলতঃ, সৎকর্ম সাধনে চিত্ত নিবিষ্ট করার পক্ষে চেষ্টার ত্রুটি না হয়, এটাই ভগবানের উপদেশ। তারদ্বারা যোগ মার্গে উপস্থিত হওয়া যায়। যিনিই যোগী, তিনিই জ্ঞানী, আবার যিনিই জ্ঞানী, তিনিই জ্ঞানস্বরূপে আত্মলীন। জল-প্রবাহ যেমন মহাসাগরে মিশে যায়, প্রশ্বাস বায়ু যেমন আকাশে অনন্ত বায়ু তরঙ্গে বিলীন হয়, যোগ যুক্ত জীবন জল বুদ্‌বুদ্‌ তেমনি জ্ঞান সমুদ্রে ব্রহ্ম তরঙ্গে বিলীন হয়ে যায়।

জ্ঞান-সমুদ্র
জ্ঞান সমুদ্রই বা কি ? আর তাতে বিলীন হওয়াই বা কি? রূপকের আবরণ উন্মোচন করে, সরল সুন্দর সুবোধ্য ভাষায় শ্রীভগবান গীতায় তা বুঝিয়ে গেছেন। সাংখ্য গণ ও চান-জ্ঞান; যোগমার্গ অবলম্বীগণও অনুসন্ধান করেন-জ্ঞান। তাই ভগবান বুঝিয়ে দিচ্ছেন- জ্ঞান কি; আর সে জ্ঞান মানুষের অধিগত হয় কিভাবে? আমরা বারবার বলে আসছি্‌- সদ্‌গুণ সমষ্টিই জ্ঞান। যিনি সদ্‌গুণাধার, তিনিই জ্ঞানী। জ্ঞানের স্বরূপ তত্ত্ব আলোচনায় সেটাই উপলব্ধ হয়। জ্ঞানতত্ত্ব বর্ণনায় শ্রীভগবান গীতায় (১৩শ অধ্যায়ে) বলছেন,
অমানিত্বমদম্ভিত্বমহিংসা ক্ষান্তিরার্জবম্। আচার্য্যোপাসনং শৌচং স্থৈর্যমাত্মবিনিগ্রহঃ॥
ইন্দ্রিয়ার্থেষু বৈরাগ্যমনহঙ্কার এব চ। জন্মমৃতুজরাব্যাধিদুঃখদোষানুদর্শনম্॥
অসক্তিরনভিষ্বঙ্গঃ পুত্রদারগৃহাদিষু। নিত্যঞ্চ সমচিত্তত্বমিষ্টানিষ্টোপপত্তিষু॥
ময়ি চানন্যযোগেন ভক্তিরব্যভিচারিণী। বিবিক্তদেশসেবিত্বমরতির্জনসংসদি॥
অধ্যাত্মজ্ঞাননিত্যত্বং তত্ত্বজ্ঞানার্থদর্শনম্। এতজ্‌জ্ঞানমিতি প্রোক্তমজ্ঞানং যদতোহন্যথা॥
অর্থাৎ, শ্লাঘা(আত্ম প্রশংসা) শূন্যতা, দম্ভ পরিহার, অহিংসা, ক্ষমা, সরলতা, সদ্‌গুরুসেবা, বাহ্য এবং অভ্যন্তরের শৌচ, স্থির চিত্ততা, দেহ এবং ইন্দ্রিয় সমূহের সংযম, শব্দ-স্পর্শ আদি বিষয় ভোগে বিরত, অহঙ্কার ত্যাগ, জন্ম-মৃত্যু-জরা-ব্যাধি প্রভৃতি দুঃখের দোষ দর্শন, পুত্র কলত্র ভূবন আদির মায়া পরিবর্জন এবং তাতে অহংজ্ঞানের পরিত্যাগ, শুভাশুভ উভয়েই সতত সমবুদ্ধি, অনন্যা নিষ্ঠাদ্বারা আমাতে ঐকান্তিকী ভক্তি, নির্জন স্থানে বাস, সাধারণ জনসমাজে যাতায়াত না করা, পরমাত্মা বিষয়ক জ্ঞানে একনিষ্ঠা, তত্ত্বজ্ঞানের অর্থ অর্থাৎ মুক্তির আলোচনা এই সকল জ্ঞানের লক্ষণ, এবং এর বিপরীত লক্ষণই অজ্ঞান।
যে জ্ঞান লাভের জন্য মানুষ সারাজীবন ব্যাকুল হয়ে ছুটছে, অথচ যে জ্ঞানের স্বরূপ তত্ত্ব কিছুই উপলব্ধি করতে পারছে না, কয়টি সরল কথায় কেমন সুন্দর ভাবে তা বোধগম্য করানোর চেষ্টা করা হয়েছে। অজ্ঞানের ও জ্ঞানের পার্থক্য কি, এই কয়েক পংত্তির মধ্যে তাই বিশদীকৃত। কোনও একটি বস্তুকে বুঝতে হলে, দুই ধরণের লক্ষণের দ্বারা তা বুঝতে হয়। সেই দুই লক্ষণের নাম- (১) স্বরূপ-লক্ষণ, (২) তটস্থ লক্ষণ। স্বরূপ লক্ষণ দিয়ে বিশেষ কিছু ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ বুঝায় না, জিনিষটি যা, তারদ্বারা তাহাই শব্দান্তরে বুঝানোর চেষ্টা করা হয়, যেমন কলস ও কুম্ভ, শূন্য ও ফাঁকা; এখানে কলস বললেও যা বুঝ্য, কিম্ভ বললে তার অধিক কিছু বুঝা গেল না; শূন্য শব্দের প্রতিবাক্যে ফাঁক বললেও ঐ একই ভাব মনে আসে। এটাই হল-স্বরূপ লক্ষণ।
তটস্থ লক্ষণ বলতে অন্য বস্তুর সাহায্যে এক বস্তু বুঝানোর চেষ্টা, যেমন, শূন্য বলতে যদি বলি-এই প্রাচীরের পার্শ্ববর্তী স্থান শূন্য,-এটাই হল তটস্থ লক্ষণ। ঈশ্বর সম্বন্ধে ও দার্শনিক গণ দ্বিবিধ লক্ষণের অবতারণা করেন। তাঁর স্বরূপ লক্ষণ বর্ণনায় তারা বলে থাকেন- তিনি সৎ, তিনি চিৎ, তিনি আনন্দ ইত্যাদি। আর তাঁর তটস্থ লক্ষণ বিষয়ে তাঁরা বলেন- তিনি স্রষ্টা, তিনি কর্ত্তা, তিনি সংহার কর্তা। এভাবে স্বরূপ লক্ষণ ও তটস্থ লক্ষণের সমবায়ে ব্রহ্ম বা পরমেশ্বর ‘নির্গুণ নিষ্ক্রিয় নিরাকার’ এবং ‘কর্ত্তা হর্ত্তা বিধাতা’ প্রভৃতি বিপরীত বিশেষণ হয়ে থাকেন। গীতোক্ত জ্ঞানের বিশ্লেষণে বুঝা উচিত, একরকম বিশেষণে তাঁর স্বরূপ লক্ষণ নির্দেশ করা হয়েছে, আর অন্যরকম বিশেষণে তাঁর তটস্থ লক্ষণ বিবৃত আছে। বস্তুপক্ষে কোনও ভেদ নেই; বুঝানোর সুবিধার জন্যই ভেদভাবের অবতারণা করা হয়েছে। এ সম্বন্ধে কেউ কেউ বলেন- সৃষ্টৃত্ব, কর্তৃত্ব, পালনতত্ত্ব প্রভৃতি শক্তিগুলি ব্রহ্মের প্রকৃত গুণ বা লক্ষণ নয়, প্রকৃতির সাথে পুরুষের মিলন-জনিত বিকৃতির ফল মাত্র। সুতরাং ঐ সকল গুণের সাথে ঈশ্বরের কোনও সম্বন্ধ্য নেই। কিন্তু অন্য পক্ষের মত এই যে,- কি গুণ, কি ক্রিয়া, কি সাকার, কি নিরাকার, সকলই তিনি-সর্বরূপে তিনিই বিদ্যমান। এ বিতর্কের মীমাংসা গীতাতেই আছে- সে কেবল অধিকারি-ভেদ। যার যেমন বুদ্ধি, যেমন জ্ঞান, তার পক্ষে ব্রহ্ম তেমনই ভাবে বিকাশমান। তিনি গুণস্বরূপ, তিনি গুণাতীত, তিনি সকলই; সুতরাং সকল দিক দিয়েই তাঁকে অনুসন্ধান করা যায়। পরমব্রহ্মকে যখন জ্ঞান-স্বরূপ বলে শাস্ত্র নির্দেশ করেছেন, আর জ্ঞানের যখন লক্ষণ সমূহ শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় ভগবানের মুখে কীর্তি দেখলাম, তখন তাহাই অনুধাবন করার জন্য চেষ্টা করা কর্তব্য বলে মনে করি। শ্রীভগবানের মতে জ্ঞানের একটি অঙ্গ বা লক্ষণ-অমানিত্ব। মানীর ভাব মানিত্ব, তদ্ভাবের অভাবই অমানিত্ব। সে হিসাবে, অমানিত্ব শব্দের সাধারণ অর্থ- আত্মশ্লাঘারাহিত্য। মানুষ কতদূর জ্ঞান সম্পন্ন ও উন্নত অবস্থায় উপনীত হলে, তাঁর অমানিত্ব ভাব উপস্থিত হয়, বিবেচনা করে দেখুন দেখি! মান-আপমান, জয়-পরাজয়ের দ্বন্ধ নিয়েই সংসার অহর্নিশ কম্পমান। এ সংসারে কয় জন অমানিত্বের অধিকারী ? এইরকম গীতোক্ত এই এক একটি বিশেষণের বিষয় বিশেষভাবে অনুধাবন করে দেখুন, কোনটিই অল্প আয়াস সাধ্য নয়। অদাম্ভিত্ব শব্দেই বা কি বুঝায় ? কর্ম করে মানুষ আত্ম যশের কামনা করে; সেই আত্ম যশের ঘোষণাই দাম্ভিত্ব। পূজা-পার্বণ প্রভৃতিতেও এই দাম্ভিত্ব দেখতে পারি। সুতরাং জ্ঞান-স্বরূপ যে অদাম্ভিত্ব, তা কত উচ্চ স্তরের সম্পৎ,- বুঝা যায় না কি ? এইরকম অহিংসা, ক্ষান্তি, আর্জব প্রভৃতি বিংশত্যধিক স্বতন্ত্র যে গুণধর্ম বা লক্ষণ নির্ধারিত রয়েছে, তা সাংখ্যের সার-যোগেরও সার। ‘জন্মমৃত্যুজরাব্যাধিদঃখদোষানুদর্শনম’-এই একটি চরণের মধ্যে কত গভীর ভাবের অভিব্যক্তি আছে! যেন জন্ম না হয়, মৃত্যু না হয়, জরা ব্যাধির অধীন হতে না হয়; আর যেন, আধ্যাত্নিম, আধিদৈবিক ও আধিভৌতিক ত্রিবিধ দুঃখের কবল হতে নিষ্কৃতি লাভ করতে পারা যায়,- এই চিন্তা, এই অনুধ্যান, যাঁর জন্মেছে, তিনি জ্ঞানী নন তো জ্ঞানী আর কে ? সাংখ্যের যে আত্ম-জ্ঞান, সে কি এই অবস্থা নয় ? যোগের যে সমাধি, সেই বা এর অতীত কোন্‌ অবস্থা ? যোগযুক্ত ব্যক্তি যে অবস্থায় যে বিশুদ্ধ ক্ষেত্রে গিয়ে আশ্রয় গ্রহণ করবেন, তাঁর বিষয় ঐ বিংশতি লক্ষণ অন্তর্গত ‘বিবিক্তদেশসেবিত্বং’ বাক্যে স্পষ্ট করা হয়েছে। ফলতঃ, মানুষ ঐ সকল গুণ সম্পন্ন হতে পারলেই, মোক্ষ-লাভে সমর্থ হবে। গীতার এটাই স্থূল উপদেশ; এটাই সাংখ্যের জ্ঞান-যোগীর যোগসাধন। যোগের আদি-স্তর যাকে অভ্যাস বলে আমরা কীর্তন করেছি, এই জ্ঞান-গুণ-সম্পন্ন হতে হলে, সেই অভ্যাসই যে প্রথম ও প্রধান অবলম্বন হওয়া আবশ্যক, তা বলাই বাহুল্য।

গীতায় মীমাংসাদর্শন
এখন মীমাংসা দর্শনের সাথে গীতার কি সামঞ্জস্য আছে, আলোচনা করে দেখা যাক। মীমাংসা দর্শন বলতে প্রধানতঃ পূর্ব-মীমাংসাকেই বুঝিয়ে থাকে। কর্ম-কাণ্ড ও জ্ঞান-কাণ্ড বেদের দুই বিভাগ। সেই দুই বিভাগের অনুবর্তী দুই দার্শনিক মত প্রচলিত,- (১) পূর্ব-মীমাংসা, (২) উত্তর-মীমাংসা বা বেদান্ত। উত্তর মীমাংসা-বেদান্ত বলেই সাধারণতঃ পরিচিত। যাঁরা কর্মবাদী, তাঁরা প্রথমোক্ত সম্প্রদায়ভুক্ত। তাঁরাই মীমাংসক সম্প্রদায় নামে পরিচিত। আর যাঁরা জ্ঞান-বাদী, তাঁরা বৈদান্তিক নামে অভিহিত। মীমাংসকগণ কর্মকাণ্ডকেই প্রশস্ত বলে নির্দেশ করেন। তাঁদের মতে-যজ্ঞ আদিই শ্রেয়ঃসাধক। মীমাংসকদের উপদেশ-’যজ্ঞ অনুষ্ঠান কর; স্বর্গলাভ হবে।’ তাঁদের মতে, স্বর্গলাভই পরম সুখ। সেখানে অমৃত-পানে চিরসুখী হওয়া যায়।(১) মীমাংসকদের যে যজ্ঞের উপদেশ দিয়ে গেছেন, গীতাও সেই উপদেশ দিয়েছেন। সাংখ্যেরা কর্ম-পরিত্যাগ করতে বলেন, যেহেতু কর্মের দ্বারা বন্ধন আসে। কিন্তু, শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় যে বিষয়ে শ্রীকৃষ্ণ বলছেন,-
যজ্ঞার্থাৎ কর্মণোহন্যত্র লোকোহয়ং কর্মবন্ধনঃ। তদর্থং কর্ম কৌন্তেয় মুক্তসঙ্গঃ সমাচর॥
সহযজ্ঞাঃ প্রজাঃ সৃষ্ট্বা পুরোবাচ প্রজাপতিঃ। অনেন প্রসবিষ্যধ্বমেষ বোহস্ত্বিষ্টকামধুক্॥
দেবান্ ভাবয়তানেন তে দেবা ভাবয়ন্ত্ত বঃ। পরস্পরং ভাবয়ন্তঃ শ্রেয়ঃ পরমবাপ্স্যথ॥
ইষ্টান্ ভোগান্ হি বো দেবা দাস্যন্তে যজ্ঞভাবিতাঃ। তৈর্দত্তানপ্রদায়ৈভ্যো যো ভুঙক্তে স্তেন এব সঃ॥
যজ্ঞশিষ্টাশিনঃ সন্তো মুচ্যন্তে সর্বকিল্বিষৈঃ। ভুঞ্জতে তে ত্বঘং পাপা যে পচন্ত্যাত্মকারণাৎ॥
অন্নাদ্ ভবন্তি ভূতানি পর্জন্যাদন্নসম্ভবঃ। যজ্ঞাদ্ ভবতি পর্জন্যো যজ্ঞঃ কর্মসমুদ্ভবঃ॥
কর্ম ব্রহ্মোদ্ভবং বিদ্ধি ব্রহ্মাক্ষরসমুদ্ভবম্। তস্মাৎ সর্বগতং ব্রহ্ম নিত্যং যজ্ঞে প্রতিষ্ঠিতম্॥
এবং প্রবর্তিতং চক্রং নানুবর্তয়তীহ যঃ। অঘায়ুরিন্দ্রিয়ারামো মোঘং পার্থ স জীবতি॥

অর্থাৎ, ‘যজ্ঞার্থ কর্ম করে, যজ্ঞ বা পরমেশ্বরের আরাধনা ব্যতীত অন্য যে কোনও উদ্দেশ্যেই কর্ম অনুষ্ঠিত হোক না কেন, তা মানুষের সংসার-বন্ধনের হেতু ভূত হয়। অতএব হে পার্থ! তুমি কামনা বিহীন হয়ে, কেবল ঈশ্বর আরাধনার নিমিত্ত কর্মের অনুষ্ঠান করতে থাক। পুরাকালে প্রজাপতি ব্রহ্মা যজ্ঞের সাথে ব্রাহ্মণ আদি ত্রিবর্ণাত্মক প্রজা উৎপাদন করে বলেছিলেন যে, এই যজ্ঞের অনুসরণক্রমে তোমরা উত্তরোত্তর অতি-বৃদ্ধি লাভ কর; কেন না, এই যজ্ঞ ক্রিয়া তোমাদের জন্য কামধেনুর ন্যায় অভিলষিত ভোগপ্রদ। বিহিত যজ্ঞ অনুষ্ঠান দ্বারা তোমরা দেবতাদের সন্তুষ্ট ও সন্মানিত করলে, তাঁরাও তোমাদের হিতসাধন করে পরিতৃপ্ত করবেন। এভাবে পরস্পর সংবর্দ্ধিত করতে থাকলে, পরিণামে তোমরা মোক্ষরূপ পরমমঙ্গলের অধিকারী হবে। যজ্ঞদ্বারা সেবিত ও পরিপুষ্ট দেবগণ, তোমাদের বিবিধ বাসনারূপ ভোগ্য পদার্থ প্রদান করবেন। যে ব্যক্তি সেই দেবদত্ত ভোগাবস্তু সমূহ যজ্ঞ আদি দ্বারা দেব উদ্দেশে উৎসর্গীকৃত না করে স্বয়ং উপভোগ করে, সে তস্করতুল্য। যে সাধু পুরুষের দেবযজ্ঞ অবশিষ্ট অন্ন ভোজন করেন, তারা সর্ববিধ পাপ হতে মুক্ত হয়ে থাকেন। কিন্তু যে দুর্বৃত্তেরা কেবল আপন উদরপূরণার্থ ভোজন প্রস্তুত করে, তারা পাপই ভোজন করে। অন্ন রুপান্তরিত হয়ে প্রাণী সমূহের উদ্ভব করে। সেই অন্ন বৃষ্টি হতে সম উদ্ভুত, সেই বৃষ্টি যজ্ঞক্রিয়ার পরিণাম-স্বরূপ এবং সেই যজ্ঞ কর্ম হতে সমুৎপন্ন। ঋত্বিক ও যজমান সাধ্য কর্ম বেদ হতে সমুৎপন্ন, সেই বেদ পরব্রহ্ম হতে অমুদ্ভূত। সুতরাং সর্বপ্রকাশক অবিনাশী বেদরূপ ব্রহ্ম যজ্ঞ-কর্মে সতত বিরাজমান আছেন। যে ব্যক্তি ইহসংসারে ঈশ্বর প্রতিষ্ঠিত উল্লেখিত-রূপ জগত চক্রের অনুগামী না হয়, হে পার্থ! সে পাপজীবন ভোগাসক্ত বৃথা জীবন ধারণ করে। ভগবদ্‌ উক্তিতে এখানে বেশ বুঝতে পারা যায়, যজ্ঞই মোক্ষ-লাভের প্রকৃষ্ট প্রধান পথ।
যজ্ঞের স্বরূপ তত্ত্ব-
কিন্তু যজ্ঞ কি ? যজ্ঞ কত প্রকার ? শ্ৰীকৃষ্ণ সে বিষয়ে যখন পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবৃত করছেন, তখন সকল দিকের সকল সংশয় ছিন্ন হয়ে যায়। তখন বুঝতে পারি, কিবা জ্ঞান-কাণ্ডে, কিবা কর্ম-কাণ্ডে, কোথাও কোনও পার্থক্য নাই। সাংখ্যের নিঃশ্রেয়স বা পতঞ্জলির কৈবল্য বলতেও যা বুঝেছিলাম, যজ্ঞ বলতেও মূলত তাহাই বুঝতে পারি। সেই অহঙ্কার-বল-দর্প-কাম-ক্রোধ প্রভৃতিকে বশীভূত করণ, সেই সর্বভূতে চিৎ-স্বরূপের বিকাশ দর্শন, সেই ফলাকাঙ্ক্ষা-পরিশূন্যতা, মূলে সব একই গিয়ে দাঁড়িয়েছে। কেমন ভাবে কি যজ্ঞের অনুষ্ঠান করতে হবে, গীতায় শ্রীভগবানের উক্তিতে তারই পরিচয় দেখুন;-
চতুর্থ অধ্যায়ে-
গতসঙ্গস্য মুক্তস্য জ্ঞানাবস্থিতচেতসঃ। যজ্ঞায়াচরতঃ কর্ম সমগ্রং প্রবিলীয়তে॥
ব্রহ্মার্পণং ব্রহ্ম হবির্ব্রহ্মাগ্নৌ ব্রহ্মণা হুতম্। ব্রহ্মৈব তেন গন্তব্যং ব্রহ্মকর্মসমাধিনা॥
তদৈবমেবাপরে যজ্ঞং যোগিনঃ পর্যুপাসতে। ব্রহ্মাগ্নাবপরে যজ্ঞং যজ্ঞেনৈবোপজুহ্বতি॥
শ্রোত্রাদীনীন্দ্রিয়াণ্যন্যে সংযমাগ্নিষু জুহ্বতি। শব্দাদীন্ বিষয়ানন্য ইন্দ্রিয়াগ্নিষু জুহ্বতি॥
সর্বাণীন্দ্রিয়কর্মাণি প্রাণকর্মাণি চাপরে। আত্মসংযমযোগাগ্নৌ জুহ্বতি জ্ঞানদীপিতে॥
দ্রব্যযজ্ঞাস্তপোযজ্ঞা যোগযজ্ঞাস্তথাপরে। স্বাধ্যায়জ্ঞানযজ্ঞাশ্চ যতয়ঃ সংশিতব্রতাঃ॥
অপানে জুহ্বতি প্রাণং প্রাণেহপাণং তথাপরে। প্রাণপানগতী রুদ্ধ্বা প্রাণায়ামপরায়ণাঃ॥
অপরে নিয়তাহারাঃ প্রাণান্ প্রাণেষু জুহ্বতি। সর্বেহপ্যেতে যজ্ঞবিদো যজ্ঞক্ষপিতকল্মষাঃ॥
যজ্ঞশিষ্টামৃতভুজো যান্তি ব্রহ্ম সনাতনম্। নায়ং লোকোহ্স্ত্যযজ্ঞস্য কুতোহন্যঃ কুরুসত্তম॥

ষোড়শ অধ্যায়ে-
আত্মসম্ভাবিতাঃ স্তব্ধা ধনমানমদান্বিতাঃ। যজন্তে নামযজ্ঞৈস্তে দম্ভেনাবিধিপূর্বকম্॥
অহঙ্কারং বলং দর্পং কামং ক্রোধং চ সংশ্রিতাঃ। মামাত্মপরদেহেষু প্রদ্বিষন্তোহভ্যসূয়কাঃ॥

সপ্তদশ অধ্যায়ে-
অফলাকাঙ্ক্ষিভির্যজ্ঞো বিধিদিষ্টো য ইজ্যতে। যষ্টব্যমেবেতি মনঃ সমাধায় স সাত্ত্বিকঃ॥
অভিসন্ধ্যায় তু ফলং দম্ভার্থমপি চৈব যৎ। ইজ্যতে ভরতশ্রেষ্ঠ তং যজ্ঞং বিদ্ধি রাজসম্॥
বিধিহীনমসৃষ্টান্নং মন্ত্রহীনমদক্ষিণম্। শ্রদ্ধাবিরহিতং যজ্ঞং তামসং পরিচক্ষতে॥
অষ্টাদশ অধ্যায়ে-
যজ্ঞদানতপঃকর্ম্ম ন ত্যাজ্যং কার্য্যমেব তৎ। যজ্ঞো দানং তপশ্চৈব পাবনানি মনীষিণাম্॥
এতান্যপি তু কর্ম্মাণি সঙ্গং ত্যক্ত্বা ফলানি চ। কর্ত্তব্যানীতি মে পার্থ নিশ্চিতং মতমুত্তমম্॥

অর্থাৎ, যে কামনা বর্জিত, ধর্ম অধর্ম আদি বন্ধন বিনির্মুক্ত, আত্মা ও ব্রহ্মের অভেদ-জ্ঞান সম্পন্ন পুরুষ যজ্ঞ সংরক্ষণ উদ্দেশ্যে কর্মের অনুষ্ঠান করেন, তাঁর তত্ত্ববিৎ কর্ম, ফলের সাথে বিনষ্ট হয়ে যায়। স্রুব(হাতা) জুহব আদি যজ্ঞীয় পাত্রসমূহ যাঁর ব্রহ্ম-জ্ঞান, আহুতি প্রদানার্থ ঘৃত আদিতেও যাঁর ব্রহ্মবোধ, ব্রহ্মরূপ অগ্নিতে ব্রহ্মরূপ যজমান হোম অনুষ্ঠান করেন এটাই যার ধারণা, তেমন ব্রহ্মৈকচিত্ত পুরুষ ব্রহ্মই পেয়ে থাকেন। কোনও কোনও কর্মযোগী উল্লেখিত প্রণালীতে ইন্দ্র আদি দেব উদ্দেশ্যে যজ্ঞ সম্পন্ন করে থাকেন, আর কোনও কোনও জ্ঞানযোগী ব্রহ্মরুপ অগ্নিতে আত্মাহুতি প্রদান করে, আত্ম-যজ্ঞ সম্পাদন করেন। নিষ্ঠাচার সম্পন্ন যোগিরা ইন্দ্রিয় সংযম স্বরূপ অগ্নিতে ইন্দ্রিয়দের কে হবিরূপে প্রক্ষেপ করে জিতেন্দ্রিয় হন, আর অন্যেরা ইন্দ্রিয়রূপ অগ্নিতে ইন্দ্রিয়-গ্রাহ্য বিষয় সমূহ প্রক্ষেপ করেন, অর্থাৎ, স্পৃহাহীনতা হেতু বিষয় গ্রহণে বিরত হন। অন্য এক প্রকার যোগিপুরুষেরা ব্রহ্ম ও আত্মার অভেদ উপলব্ধিরূপ তত্ত্বজ্ঞান দ্বারা সমুজ্জ্বলিত আত্ম-সংযমরূপ যোগানলে ইন্দ্রিয় ও প্রাণের কর্ম সমূহ আহুতি প্রদান করেন। অনেকে দ্রব্য দান আদি রূপ দ্রব্য-যজ্ঞের অনুষ্ঠান করেন, অনেকে যজ্ঞ-জ্ঞানে চান্দ্রায়ণ আদি তপের দ্বারা তপোযজ্ঞ সাধন করেন, অনে যত্নশীল দৃঢ়-ব্রত ব্যক্তি ঋগ আদি বেদ আলোচনাকেই যজ্ঞ-বোধে তার দ্বারা স্বাধ্যায় যজ্ঞ সম্পাদন করেন এবং শাস্ত্রার্থ অবধারণরূপ জ্ঞানকেই যজ্ঞ মনে করে জ্ঞান-যজ্ঞ সম্পন্ন করেন। কোনও কোনও ব্যক্তি পুরক দ্বারা অপানে প্রাণকে, কেউ কেউ বা রেচক দ্বারা প্রাণে আপনকে আহুতি দিয়ে থাকেন, কেউ কেউ বা প্রাণ ও অপানের গতি নিরোধ করে প্রাণায়াম অনুষ্ঠান করে থাকেন। অপরে মিতাচারী হয়ে প্রাণ আদি পঞ্চ বায়ুতে ইন্দ্রিয় সকল সমর্পণ করেন। যে সকল ব্যক্তি পূর্বোক্ত রূপ যজ্ঞানুষ্ঠনে তৎপর, যজ্ঞ অনুষ্ঠান জনিত ক্ষয়িত-পাপ এবং অমৃত স্বরূপ যজ্ঞাবশেষ ভোজনরত তাঁরা নিত্য স্বরূপ ব্রহ্মকেই লাভ করেন। আর যাঁরা কোনও যজ্ঞেরই অনুষ্ঠান করেন না, তাঁরা যৎসামান্য সুখ বিধায়ক এই মনুষ্যলোক হতে পরিভ্রষ্ট, সুতরাং তাঁদের বহু সুখাত্মক পরলোক লাভের কোনই সম্ভাবনা নাই। সেই সকল আসুর ব্যক্তি আপনা-আপনি অহঙ্কৃত অনম এবং ধন মান ও মদ সমন্বিত হয়ে কেবল নামমাত্র প্রসিদ্ধির জন্য দম্ভ সহকারে বিধি বিবর্জিত ভাবে যজ্ঞানুষ্ঠান করেন। এই সকল ব্যক্তি অহঙ্কার, বল, দর্প, কাম এবং ক্রোধের বশীভূত হয়ে স্বদেহে এবং পরদেহে চিদংশরূপে স্থিত আমাকে দ্বেষ করে, সাধুদের গুণাবলীতে বিবিধ প্রতারণা আদি দোষের উদঘাটন করে থাকে। ফল কামনা বিরহিত পুরুষ নিষ্কাম যজ্ঞ অবশ্য অনুষ্ঠেয় এইরূপ স্থির করে শাস্ত্র নির্দিষ্ট যজ্ঞের অনুষ্ঠান করেন, তাহাই সাত্ত্বিক যজ্ঞ নামে অভিহিত হয়। স্বর্গ আদি ফলকামনা সহকারে অথবা কেবল নিজ মহত্ত্ব আদি প্রচারের জন্য যে যজ্ঞ সম্পাদন করা হয়, হে ভরত কুল প্রদীপ। তাকেই রাজস যজ্ঞ বলে জানবে। শাস্ত্রোক্ত বিধিশূন্য, অন্নদানহীন, শাস্ত্রোক্ত মন্ত্রহীন, দক্ষিণাহীন, শ্রদ্ধাশূন্য যজ্ঞকে তামস-যজ্ঞ বলে। যজ্ঞ, দান, তপস্যা প্রভৃতি কর্ম সমূহ কখনই পরিত্যাগ করা উচিত নয়, বরং তাঁদের অনুষ্ঠান করাই সর্বতোভাবে কর্তব্য। কারণ যজ্ঞ, দান, তপস্যা প্রভৃতি কর্ম নিয়ে ফলকামনা শূন্য বিবেকিদের চিত্তশুদ্ধি উৎপাদন করে থাকে। অতএব এর অনুষ্ঠান অতীব বিধেয়। হে পার্থ! বন্ধনের হেতুভূত হলেও আসক্তি এবং ফল কামনা পরিত্যাগ করে পূর্বোক্ত যজ্ঞ-দান আদি কর্ম সমূহকে অনুষ্ঠান করবে, এটাই আমার নিশ্চিত মত এবং উত্তম মত। এই প্রকার যজ্ঞ অনুষ্ঠানের উপদেশ দিয়ে শ্রীভগবান উপসংহারে বলছেন,-
ত্রৈবিদ্যা মাং সোমপাঃ পূতপাপা যজ্ঞৈরিষ্ট্বা স্বর্গতিং প্রার্থয়ন্তে।
তে পুণ্যমাসাদ্য সুরেন্দ্রলোকম্ অশ্নন্তি দিব্যান্ দিবি দেবভোগান্॥
তে তং ভুক্ত্বা স্বর্গলোকং বিশালং ক্ষীণে পুণ্যে মর্ত্যলোকং বিশন্তি।
এবং ত্রয়ীধর্মমনুপ্রপন্না গতাগতং কামকামা লভন্তে॥
যেহ্প্যন্যদেবতাভক্তা যজন্তে শ্রদ্ধয়ান্বিতাঃ। তেহপি মামেব কৌন্তেয় যজন্ত্যবিধিপূর্বকম্॥
যান্তি দেবব্রতা দেবান্ পিতৃন্ যান্তি পিতৃব্রতাঃ। ভূতানি যান্তি ভূতেজ্যা যান্তি মদ্ যাজিনোহপি মাম্॥

অর্থাৎ, ‘বেদত্রয়োক্ত কর্মনিষ্ঠগণ, বিবিধ যজ্ঞ অনুষ্ঠান দ্বারা আমার পূজা করে এবং যজ্ঞ অবশিষ্ট সোমরস পান জনিত পাপ পরিশূন্য হয়ে, স্বর্গ গমন প্রার্থনা করেন; তাঁরা পূণ্য-ফল স্বরূপ ইন্দ্রলোক প্রাপ্ত হই। স্বর্গপুরে দিব্য দেবভোগ সকল উপভোগ করে পূণ্যের ক্ষয় হলে পুনরায় বসুন্ধরায় জন্মগ্রহণ করেন এবং পূর্বোক্ত প্রণালী ক্রমে আবার কামনা পরতন্ত্র হয়ে বেদত্রয় বিহিত কর্ম মার্গের অনুসরণ ক্রমে বার বার যাতায়াত করতে থাকেন। হে অর্জুন! শ্রদ্ধা সহকারে ও ভক্তিভাবে যাঁরা অন্য দেবতার পূজা করে থাকেন, তাঁদের সে পূজা আমারই পূজা বটে, কিন্তু তা বিধি বিগর্হিত। যাঁরা দেবোপাসনা-পরায়ণ, তাঁরা দেবলোক প্রাপ্ত হন; যাঁরা শ্রদ্ধা আদি সহকারে পিতৃপূজা পরায়ণ, তাঁরা পিতৃলোক প্রাপ্ত হন; যাঁরা ভূতাদির পূজাপরায়ণ, তাঁরা ভূতলোক প্রাপ্ত হন, এবং যাঁরা আমার পূজা-পরায়ণ, তাঁরা আমাকেই প্রাপ্ত হয়ে থাকেন। এখানে দুইটি বিষয় বিবেচনা করে আছে। এক হিসাবে এটি সাংখ্য-মত; অন্য হিসাবে এটি যজ্ঞা অনুষ্ঠানের চরম ও পরম উপদেশ। যজ্ঞ দ্বারা কর্মফলে স্বর্গে ও মর্তে গতাগতির প্রসঙ্গ হেতু এটি সাংখ্য, আবার কিভাবে কেমন যজ্ঞ দ্বারা কি ফল লাভ হবে, তা বিশদভাবে বর্ণিত হওয়ায় যজ্ঞানুষ্ঠানের স্তর পর্যায় এতে প্রত্যক্ষ। অথচ, সেই- একই কথা ‘যান্তি…… মাম্‌’ -আমার ভজনাকারী যারা, তারা আমাকেই প্রাপ্ত হন। সেই ‘আমি’-সেই ‘অহং’-সেই ব্রহ্ম! সকলেরই শেষ সেই-আমি।

গীতায় বৈশেষিক ও ন্যায় দর্শনের সার-
বৈশেষিক দর্শন ও ন্যায় দর্শন উভ্যই তত্ত্বজ্ঞান লাভকে নিঃশ্রেয়স্‌ বা অপবর্গ লাভের উপায় বলে গণ্য করে গেছেন বটে, কিন্তু দুই সম্প্রদায় দুই দিক দিয়ে সে পথ নির্দ্ধারণের প্রয়াস পেয়েছেন। বৈশেষিক দর্শন মতে, সাতটি পদার্থের (দ্রব্য, গুণ, কর্ম, সামান্য, বিশেষ, সমবায় ও অভাব) সাধর্ম্য বা বৈধর্ম্যহেতুক তত্ত্বজ্ঞানই নিঃশ্রেয়স। ন্যায় দর্শন মতে, ১৬টি পদার্থের (প্রমাণ, প্রমেয়, সংশয়, প্রয়োজন, দৃষ্টান্ত, সিদ্ধান্ত, অবয়ব, তর্ক, নির্ণয়, বাদ, জল্প, বিতণ্ডা, হেত্বাভাস, ছল, জাতি, নিগ্রহস্থান।) তত্ত্বজ্ঞানই অপবর্গ লাভের কারণ। (১) বৈশেষিকের সাত পদার্থ এবং নৈয়ায়িকের ষোল পদার্থ আবার বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত আছে। সেই সকল বিভাগ বিষয়ে প্রকৃষ্ট জ্ঞান অর্জন করতে পারলে, তত্ত্বজ্ঞানের উদয়ে মোক্ষলাভ ঘটে। অনেকে বলেন,- বৈশেষিক দর্শনের ও ন্যায় দর্শনের নব পরিণতির পন্থার সাথে শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার প্রদর্শিত পন্থার কোনরকম ঐক্য নেই। সাধারণতঃ সেটাই মনে হয় বটে, কিন্তু একটু বিশেষভাবে দেখলে গীতার মধ্যেও ঐ দুই দর্শনের সার তথ্য সন্নিবিষ্ট দেখতে পাওয়া যায়। বৈধেষিক দর্শনের স্থূল সিদ্ধান্ত-পরমাণু, পরমাণু-সৎ, নিত্য কারণাতীত, পরমাণুর সমষ্টিই এই সৃষ্টি। গীতায় কি একথা-এ ভাব নেই? পরমাণু শব্দটি না থাকতে পারে; কিন্তু পরমাণু বলতে যা উপলব্ধি হয় তা নিশ্চয়ই আছে। যেমন, পরম সুখ লাভ বুঝানোর জন্য সেই অবস্থাকে কেউ মোক্ষ, কেউ নিঃশ্রেয়স্‌, কেউ অপবর্গ, কেউ মুক্তি, কেউ কৈবল্য সংজ্ঞা দিয়েছেন, এখানেও সেরকম সংজ্ঞান্তর মাত্র দেখতে পাই। গীতায় শ্রীভগবান বলেছেন,- ‘নাসতো বিদ্যতে ভাবো নাভাবো বিদ্যতে সতঃ।’ অর্থাৎ,- অনিত্য বস্তুর বিদ্যমানতা নেই, নিত্য বস্তুর নাশ নেই। বৈশেষিক দর্শনে কণাদের ও এই উক্তি,- ‘এতেন নিত্যেষু নিত্যত্বমুক্তম্‌’ এবং ‘অনিত্যেষনিত্যা দ্রব্যানিত্যত্বাৎ’ অর্থাৎ, নিত্য দ্রব্যের আশ্রয়ে নিত্যত্ব এবং অনিত্যের আশ্রয়ে অনিত্যত্ব। অন্যত্র- ‘অনিত্যহনিত্যম’, ‘নিত্য নিত্যম্‌’। যে দ্রব্যের উৎপত্তি বিনাশ নেই, সে দ্রব্য কি, আর যে দ্রব্য উৎপত্তি বিনাশাধীন, তাহাই বা কি; এতদ্দ্বারা বুঝা যাচ্ছে। এ হিসাবে, বৈশেষিকের যে পরমাণু, তাকেই পূর্বোক্ত বিশেষণভূত আত্মা বলে নির্দেশ করা যেতে পারে। আর একটি সূত্র,- ‘আত্ম কর্ম্মসু মোক্ষব্যাখ্যাতঃ’ এই বৈশেষিক সূত্র গীতোক্ত সকল সিদ্ধান্তেরই সার্থকতা দেখতে পাই। ঐ সূত্রের অর্থ- আত্মকর্ম থেকেই মোক্ষ হয়। কিন্তু আত্মকর্ম কি, আর কিভাবেই বা সেই আত্ম কর্ম সাধিত হয় ? সূত্রের ব্যাখ্যায় তা বিশদীকৃত দেখুন। আত্মকর্ম অর্থ- শ্রবণ, মনন, নিদিধ্যাসন প্রভৃতি। ‘শরণাগত আত্মা কি, তা শাস্ত্র থেকে অবগত হওয়ার নাম-শ্রবণ। বিচার দ্বারা শ্রুত বিষয়ের দৃঢ়তা সম্পাদন করতে হয়; এই বচারই অনুমানের উদ্ভাবক, এই তত্ত্বজ্ঞান হতে অনুমিতি হয়, দৃঢ় প্রমাণের জন্য অনুমিতি শ্রুতবিষয়ের দৃঢ়তা সম্পাদনে সক্ষম, এই দৃঢ়তা সম্পাদন হেতু অনুমিতিই মনন। তারপরে নিদিধ্যাসন অর্থাৎ সমাধি। এই পথে অগ্রসর হলে আত্মসাক্ষাৎকার হয়; তখন, দেহ আদির প্রতি অহংজ্ঞান থাকে না। তখন দেহে অহং জ্ঞানমূলক যে সুখাদির প্রতি ইচ্ছা ও দুঃখাদির প্রতি বিদ্বেষ, তা আর হয় না। সুতরাং ধর্মাধর্ম আর উৎপন্ন হয় না, পূর্ব সঞ্চিত ধর্মাধর্ম ও দেহের অহং জ্ঞানের অভাবের সঙ্গে —– ন্যায় বিফল হয়ে পড়ে সুতরাং নুতন ধর্মাধর্মের —- ও —- ধর্মাধর্মের অকর্ম্যণ্যতা হেতু জন্ম হয় না, জন্ম না হওয়ায় মন ও শরীর —অভাব, দুঃখ ও হয় না। এই চরম দুঃখ নিবৃত্তিই মুক্তি বা মোক্ষ। মনের উপযোগী বলে দ্রব্যাদি পদার্থ- জ্ঞান প্রথম প্রয়োজনীয়! (২) শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় এ ভাব কোথাও নেই? মোক্ষ লাভের জন্য যে যে বিধি গীতায় বিহিত দেখতে পাই, — মধ্যে তার সকল বিধিই বিদ্যমান। বৈশেষিক দর্শনে বেদের প্রামাণ্য স্বীকৃত হয়েছে (৩) সুতরাং বেদ রহিত কর্মকাণ্ড ও জ্ঞানকাণ্ড উভয়েরই সার্থকতা পরিদৃশ্যমান। বৈশেষিক দর্শনে —- বিশেষ তত্ত্ব বিশেষভাবে বিবৃত হয়েছে বলে অনেকে উহার মধ্যে ঈশ্বর তত্ত্ব অনুসন্ধান করে পান নি। কিন্তু বাস্তবপক্ষে বৈশেষিক দর্শনে যখন অদৃষ্ট তত্ত্ব ও কর্ম-তত্ত্ব, যাগ-যজ্ঞ ও বর্ণাশ্রম প্রভৃতির বিষয় বিষয় আলোচিত আছে; তখন উহাকে কোনও ক্রমেই নিরীশ্বর দর্শন বলা যেতে পারে না। আরও গীতায় যা আছে, তার সার কথা- ‘দৃষ্টানাং দৃষ্টপ্রয়োজনানাং দৃষ্টাভাবে প্রয়োগোহভ্যুদয়ায়’ এই বৈশেষিক সূত্রটির মধ্যেই গ্রথিত রয়েছে দেখতে পাই। যে সকল কর্ম শাস্ত্র-দৃষ্ট এবং যাঁদের প্রয়োজন শাস্ত্রে উপদিষ্ট আছে, তার দৃষ্টফল না থাকলে অভ্যুদয়ের জন্য অনুষ্ঠান হয়’- এতদর্থেই বা কি বুঝতে পারি ? ‘বেদ-প্রমাণ, বেদোক্ত কর্ম-কর্তব্য; সেই কর্মজনিত ধর্ম প্রভাবে স্বর্গ হয়, বিশেষ ধর্মপ্রভাবে দ্রব্যগুণাদি পদার্থের তত্ত্ব-জ্ঞান হয়, তারফলে মিথ্যা-জ্ঞান নিবৃত্তি হলে মুক্তি লাভ হয়।’ বৈশেষিক দর্শনের আলোচনায় পণ্ডিতগণ এইরকম সিদ্ধান্ত করে গেছেন। সুতরাং বৈশেষিক দর্শনের সাথে গীতার যে সম্বন্ধ সম্যক পরিদৃষ্ট হয়, তাতে কোনই সংশয় থাকতে পারে না। বৈশেষিক দর্শনের অঙ্গীভূত পরমাণূ বাদ গীতার দ্বিতীয় অধ্যায়োক্ত আত্মার বিশেষণেই বিশেষ ভাবে উপলব্ধ হয়। এ কথা পূর্বেই বলেছি। বৈশেষিক দর্শনে পরমাণুর যে পরিচয় দেওয়া হয়েছে, শ্রীমদ্ভগবদগীতায় বর্ণিত আত্মার বিশেষণ ও সেখানে সেরকম প্রযুক্ত দেখতে পারি। পরমাণু যেমন অবিভাজ্য নিত্য সনাতন, সেখানে আত্মাও তাহাই। শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় যথা,-
নৈনং ছিন্দন্তি

এই অংশ যে পরমাণু বাদের প্রসঙ্গ, শঙ্করাচার্য্য প্রভৃতির ভাষ্যে তা অনুভূত হয়। যা সৎ, যা অপরিবর্ত্তনীয়, যা অবিভাজ্য, আর যার সংযোগ সমষ্টিতে বা বিকারে এই পরিদৃশ্যমান অনিত্য সংসার সেই সদ্বস্তুর ও তার বিকারের বিষয় বোধগম্য করাবার জন্য ঘট পট অট্টালিকা ও তাঁদের উপাদানাদির দৃষ্টান্তের অবতারণা করা হয়। যে সামগ্রীর অস্তিত্ব অভাব ঘটে, তাহাই অসৎ, আর যা নিত্য-বিদ্যমান তাহাই সৎ। ঘট-অসৎ পদার্থ, যেহেতু মাটি দিয়ে উহা তৈরি এবং পরিণতিও মাটি। এইভাবে স্থূল দৃষ্টিতে মাটি সৎ ও ঘট অসৎ প্রতিপন্ন হয়। আর একটু সূক্ষ্মভাব দেখলে, মাটি ও অসৎ বলে প্রতিপন্ন হয়ে থাকে, সে হিসাবে মাটির উপাদান ভূত পরমাণুই সৎ। সূক্ষ্মাদপি সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে পরমাণুর যে পরমাণু-যা অবিভাজ্য অচ্ছেদ্য, তাহাই শেষ গিয়ে দাঁড়ায়। এখানে একটি বিবাদের কথা উঠে থাকে। পরমাণুর সে সংযোগবশতঃ এই পরিদৃশ্যমান্‌ জগত অবয়ব ভূত দ্রব্য আদি দৃষ্টিগোচর হয়, সে সংযোগ কিভাবে সাধিত হয়ে থাকে।’ আস্তিক্যদের মত এই যে- ‘তাঁদের সংযোগ কর্তা একজন আছেন, তিনিই ঈশ্বর বা পরমেশ্বর।’ বৈশেষিক দর্শনকে যাঁরা নাস্তিক্য দর্শন বলে ঘোষণা করেন, তাঁরা পরমাণু সংযোগ বিষয়ে প্রথমোক্ত মতেরই অনুসরণকারী। কিন্তু বলা বাহুল্য, সে মত বেদমার্গ অনুসারী বৈশেষিক দর্শনের মত নয়, সে মত ডেমক্রেটাস্‌ এপিকিউরাস, ডাল্টন প্রভৃতি পাশ্চাত্য পরমাণু-তত্ত্ববিৎ পণ্ডিতদের মতেরই প্রতিধ্বনি মাত্র। () শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় পরমব্রহ্মকে মূলাধাররূপে প্রতিপন্ন করার জন্যই দর্শন সমুদ্র মন্থন করা হয়েছে, আর তাই কেউ কেউ উহাতে বৈশেষিক দর্শনের তত্ত্ব কথার আভাষ পান নি। কিন্তু গীতায় পরমব্রহ্মের যে নামরূপ ও বিশেষণ আদির পরিচয় দেওয়া হয়েছে, সেবিষয় অনুধাবন করলে-পরমাণুতত্ত্বের প্রসঙ্গ ও যে তারমধ্যে নিহিত আছে, তা বুঝতে পারা যায়।()

(২) এই সাত পদার্থের বিভাগ ও তার সাধর্ম্য ও বেধর্মের পরিচয় এবং ন্যায়দর্শনের ষোল পদার্থের আলোচনা ‘পৃথিবীর ইতিহাস’ প্রথম খণ্ডে বৈশেষিক দর্শন প্রসঙ্গে দেখুন।
() ডেনক্রেটাস, এপিকুবাস, ডাল্টণ প্রভৃতি মতের আলোচনা ‘পৃথিবীর ইতিহাস, তৃতীয় খণ্ডে দ্রষ্টব্য।
() গীতোক্ত পরমব্রহ্মের নামরূপের ও বিশেষণের পরিচয় গীতায় ব্রহ্মতত্ত্ব সংক্রান্ত পরবর্তী আলোচনায় দেখুন।

গীতায় ন্যায় দর্শন।
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় ন্যায় দর্শনের আলোচনা কিভাবে আছে, দেখা যাক। ন্যায় দর্শনের ও প্রতিপাদ্য-তত্ত্বজ্ঞান। কিভাবে সে তত্ত্বজ্ঞান লাভ হতে পারে? প্রমাণ প্রমেয় আদি ১৬টি পদার্থের জ্ঞানেই সেই তত্ত্বজ্ঞান লাভ হয়ে থাকে। প্রত্যক্ষ, অনুমান, উপমান, শব্দ-ন্যায়-মতে প্রমাণ এই চার প্রকার। প্রমাণের যা বিষয়, তাহাই প্রমেয়। আত্মা, শরীর, ইন্দ্রিয়, অর্থ, বুদ্ধি, মন, প্রবৃত্তি, দোষ, প্রেত্যভাব, ফল, দুঃখ, অপবর্গ-এই ১২টি প্রমাণের বিষয়। ন্যায় দর্শন প্রমাণের দ্বারা বুঝতে চান- প্রে- ১২টি প্রমেয়ের স্বরূপ তত্ত্ব কি ? এজন্য, সংশয়, প্রয়োজন, দৃষ্টান্ত, সিদ্ধান্ত, অবয়ন, তর্ক, নির্ণয়, বাদ, জল্প, বিতণ্ডা, হেত্বাভাষ, ছল, জাতি, নিগ্রহস্থান প্রভৃতি কত জ্ঞানেরই আবশ্যক হয়। ন্যায়-দর্শনের মূল প্রতিপাদ্য- ‘আত্মা দেহাতিরিক্ত এবং দেহ হতে স্বতন্ত্র। এই তত্ত্বজ্ঞানই মোক্ষের হেতুভূত। সমাধি-বিশেষের অভ্যাসে তত্ত্বজ্ঞান এবং যম-নিয়মের দ্বারা সেই তত্ত্বজ্ঞানই লাভ হয়।’ নৈয়ায়িকেরা অদৃষ্ট বা পাপজন্ম কৃত কর্ম স্বীকার করেন। পুরুষের কর্মফল বা অদৃষ্ট যে ঈশ্বরাধীন, ‘ঈশ্বরঃ কারণং পুরুষকর্ম্মাফলাদর্শনাৎ’,- এটাই তাঁদের সিদ্ধান্ত। অতএব, গীতায় যে ন্যায় দর্শনের তত্ত্ব নিহিত নেই, তাহাই বা কিভাবে বলতে পারি? শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার ঈশ্বর তত্ত্ব আলোচনা করলে, নৈয়ায়িকদের ঈশ্বর এবং আত্মা প্রভৃতির সন্ধান নিশ্চয়ই পাওয়া যেতে পারে। এখানে একটি প্রশ্ন উঠে থাকে। সাংখ্যমত, পাতঞ্জলমত, মীমাংসামত এবং বেদান্তমত গীতায় যেমন বিশদভাবে আলোচিত হয়েছে, ন্যায়মত ও বৈশেষিক মত সেভাবে আলোচিত হয় নি; এমন কি, প্রথমোত্ত মত চতুষ্টয়ের তুলনায় শেষোক্ত মন্ত্রদ্বয়ের অস্তিত্বই গীতায় অনুসন্ধান করে পাওয়া যায় না, বলা যেতে পারে। এ সম্বন্ধে বক্তব্য এই যে, প্রমোক্ত মত-চতুষ্টয়ের সঙ্গে, শেষোক্ত মতদ্বয়ের উল্লেখ অতি সামান্য। এক হিসাবে এই দুই দর্শনই সাংখ্য দর্শনের অনুসারী সাংখ্য পঞ্চবিংশতি তত্ত্বের —লাভে নিঃশ্রেয়স্‌ আছে বলে নির্দেশ করেন। ন্যায় দর্শন ১৬টি পদার্থের জ্ঞানকে এবং বৈশিষিক-দর্শন সপ্ত পদার্থের সাধর্ম্য ও বৈধর্ম্য জনিত জ্ঞানকে তত্ত্বজ্ঞান লাভের — বলে ঘোষণা করে গেছেন। তিন মতের মধ্যেই প্রকারান্তরে সেই ক্ষিতি, অপ, তেজ, জল, বায়ু, আকাশ, শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস, গন্ধ প্রভৃতির আলোচনা আছে। সেই আত্মার, পরমাণুর, মনের বা বিশেষ পদার্থের অনুসরণে ত্রিবিধ দর্শনই প্রকারান্তরে বিনিযুক্ত রয়েছে। অনুসন্ধ্যেয় সামগ্রী প্রায় সর্বত্রই অভিন্ন, ক্বচিৎ কোথাও কিছু কমবেশী আছে। বৈশেষিকগণ একটি বিশেষ পদার্থের অনুসন্ধান করেন, নৈয়ায়িকগণ সে ক্ষেত্রে দেহাতিরিক্ত আত্মার অন্বেষণে ধাবমান আছেন। সাংখ্য সন্ধান করে থাকেন,-পুরুষ ও প্রকৃতি। বিদান-সংজ্ঞা বা নাম নিয়ে; বস্তুতপক্ষে পার্থক্য অতি সামান্যই দেখা যায়। নির্ঝরিণী বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন গিরি কন্দরে উৎপন্ন হয়; বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন জনপদ অতিক্রম করে বিভিন্ন মুখে ধাবমান হয়, কিন্তু সকলের সন্মিলন-স্থান-সেই মহাসাগর। দার্শিনিকরা ও যিনিই যে পথে অগ্রসর হয়েছেন; শ্রীকৃষ্ণ দেখিয়েছেন- সকলেরই মিলন-স্থান-সেই পরাৎপর পরম ব্রহ্ম।

শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় বেদান্ত দর্শন-
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় বেদান্ত দর্শন অনুসন্ধান করলে-গীতোক্ত ‘অহং’ ‘আমি’ তত্ত্ব অধিগত হলে-শ্রীকৃষ্ণ কেমনভাবে সর্ব দর্শনের সামঞ্জস্য সাধন করে গেছেন, তা সম্যকভাবে বোধগম্য হতে পারে। বেদান্ত দর্শন জ্ঞানের অনন্ত ভাণ্ডার। যিনি যে দিক দিয়েই অগ্রসর হবেন, বেদান্ত দর্শনের জ্ঞানালোকে সকল দিকের সকল পথই উদ্ভাসিত দেখতে পাবেন। দ্বৈতবাদ ও অদ্বৈতবাদ- পরস্পর বিরুদ্ধ দুই বাদের এবং তাদের শাখা উপশাখা প্রভৃতির উৎপত্তি-মূলে ও ঐক্য-স্থাপনে বেদান্ত দর্শনের প্রভাব অসাধারণ। বেদান্তের অনুসন্ধান-ব্রহ্ম। তত্ত্বজ্ঞানের উদয়ে সেই ব্রহ্মের সন্ধান পাওয়া যায়। ব্রহ্মের সন্ধান পেলেই, সংসার পারাবার হতে উদ্ধার লাভ হতে পারে। বেদান্ত বদ্য সেই যে ব্রহ্ম, কেমন তত্ত্ব-জ্ঞানের উদয়ে অধিগত হতে পারে, বেদান্ত সূত্রে তারই বিচার রয়েছে। সেই বিচারের যে মতান্তর, তাহাই অদ্বৈতবাদ এবং দ্বৈতবাদ অন্তর্গত বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ, শুদ্ধদ্বৈতবাদ প্রভৃতি। একই সূত্রের দ্বিবিধ অর্থের অবতারণায় অদ্বৈতবাদ ও বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ মতদ্বয়ের প্রতিষ্ঠা হয়ে থাকে। অদ্বৈতবাদিদের মত এই যে,- ‘সকলই ব্রহ্ম; ব্রহ্ম ভিন্ন অন্য কিছুরই সত্ত্বা নেই। জীবই ব্রহ্ম; ব্রহ্মাস্মি।’ এ মতে, ব্রহ্ম ভিন্ন — অন্য কিছু দেখ, সে মায়া, সে অবিদ্যা-সে তোমার ভ্রান্তি। এ মতে, ব্রহ্মের ও জীবের মধ্যে উপাস্য উপাসকের কোনও সম্বন্ধ নেই। কিন্তু দ্বৈতবাদিদের মত সম্পূর্ণ বিপরীত। তাঁদের মধ্যে প্রধান যে বিশিষ্টদ্বৈতবাদিরা, তাঁরা প্রমাণ করেন, জীব ও ব্রহ্ম বিভিন্ন, ব্রহ্ম উপাস্য জীব উপাসক। () শঙ্করাচার্য্য প্রমুখ ভাষ্যকারগণ অদ্বৈত মতের এবং রামানুজাচার্য্য প্রমুখ ভাষ্যকারগণ বিশিষ্ট দ্বৈতমতের প্রাধান্য প্রচার করে গেছেন। তাহার কোনও দিকের কোনও যুক্তিই উপেক্ষণীয় নয়। অনন্ত মহাসমুদ্রে অনন্ত অন্ধকারের মধ্যে বিভ্রান্ত তরণীকে দুই দিকের দুই আলোর রশ্মি পথ দেখাতে বিদ্যমান রয়েছে। কোন পথে অগ্রসর হলে, কতদূরে আশ্রয় স্থান মিলবে, সে আশ্রয় স্থানের অভিমুখে অগ্রসর হওয়ার জন্য কতটুকু শক্তি সামর্থ্য আছে, তা বুঝেই সেই বিভিন্ন মুখী আলোক রশ্মির একটিকে অনুসরণ কর, বেদান্ত সূত্রের বিভিন্ন ব্যাখ্যায় তারই যেন উপদেশ দিচ্ছেন। এ ভিন্ন, এমন জটিল সে বেদান্ত-তত্ত্ব যে, উহার একবিধ ব্যাখ্যাকে উপেক্ষা করে অন্যবিধ ব্যাখ্যার পেছনে অন্ধের মত অনুসরণ করলে বিভ্রান্ত ও বিপন্ন হতে হয়। তত্ত্বজ্ঞান লাভ হলেই বেদান্ত প্রতিপাদ্য পথ দৃষ্টিগোচর হয়। পথ কতদূর জটিল, কতদূর বিপরীত-গতিবিশিষ্ট, অদ্বৈতবাদিদের ও বিশিষ্টাদ্বৈতবাদিদের বিচার বিতর্ক অনুধাবন করলে, তা কতকটা উপলব্ধি হতে পারে। দুই বিপরীত দিক যে দুই আলোক রশ্মির বিষয় উল্লেখ করলাম, আর সেই দুই ভাব হতেই যে দুই বিভিন্ন মতের প্রবর্তনার বিষয় বুঝতে পারি, সে দুই দিকের দ্বিবিধ আলোকের বা দ্বিবিধ ভাবের প্রেরণা কোথা হতে আসল, একটু অনুসন্ধান করলেই সকল সংশয় দুরীভূত হয়। শ্রুতিতে ব্রহ্মের বা আত্মার দুইরূপ লক্ষণ- দুইরূপ ভাব দেখতে পাওয়া যায়। স্বরূপ-লক্ষণ ও তটস্থ লক্ষণ-প্রণিধান করানোর উদ্দেশ্যে লক্ষণ দুইটির পরিচয় পূর্বেই দিয়েছি; সে লক্ষণ দ্বারা কেউ তাঁকে সৎ চিৎ আনন্দ প্রভৃতি সংজ্ঞায় এবং কেউ তাঁকে হর্ত্তা কর্ত্তা বিধাতা ইত্যাদি অভিধায়ে অভিহিত করে গেছেন। সেখানে যেমন তিনি দুই বিপরীত বিশেষণে বিশেষিত ব্রহ্মের ভাব সম্বন্ধেও তেমনি দ্বিবিধ শ্রুতি দেখা যায়। একবিধ শ্রুতি-’নির্ব্বিশেষ নির্গুণ’ এবং অন্যবিধ শ্রুতি- ‘সবিশেষ সগুণ’। তাঁর বিশেষণে যেখানে বলা হয়েছে-তিনি অশব্দ অস্পর্শ অরূপ অরস অক্ষয়; যেখানে বলে হয়েছে- তিনি অদৃশ্য অগ্রাহ্য অগোত্র অবর্ণ; যেখানে বলা হয়েছে-তাঁর অন্তর নেই, বাহির নেই, চোখ নেই, কান নেই; সেই সেই স্থানে তাঁর নির্বিশেষ নির্গুণ লক্ষণ মাত্র বলা হয়েছে বুঝতে হবে। কিন্তু আবার যেখানে তাঁকে অণু হতে অণু, মহৎ হতে মহৎ, চেতনের চেতন, প্রভুর প্রভু, ঈশ্বরের ঈশ্বর, সর্বজ্ঞ, অন্তর্য্যামী প্রভৃতি বিশেষণে বিশেষিত করা হয়েছে, সেখানে তাঁর ‘সবিশেষ সগুণ ভাব’ বিবৃত রয়েছে। শ্রুতির একই উক্তির মধ্যে নির্বিশেষ নির্গুণ ভাবের ও সবিশেষ সগুণ ভাবের স্ফুর্তি দেখতে পাই। দুই একটি দৃষ্টান্ত; যথা-
অশব্দমস্পর্শমরূপমব্যয়ং তথাহরসং নিত্যগন্ধবচ্চ যৎ।
অনাদ্যন্তং মহতঃ পরং ধ্রবং নিচায্য তন্মৃত্যুমূখাৎ প্রমূচ্যতে॥ (কঠোপনিষদ ১।৩।১৫)
অশরীরং শরীরেষ্বনবস্থেষ্ববস্থিতম্।
মহান্তং বিভূমাম্তানং মত্বা ধীরো ন শোচতি॥ কঠোপনিষদ ১৷২৷২২
যথোর্ণনাভিঃ সৃজতে গৃহ্ণতে চ যথা পৃথিব্যামোষধযঃ সংভবন্তি৷
যথা সতঃ পুরূষাত্কেশলোমানি তথাক্ষরাত্সংভবতীহ বিশ্বম্॥ (মুণ্ডকোপনিষৎ ১/৬-৭)
নান্তঃপ্রজ্ঞং ন বহিষ্প্রজ্ঞং নোভয়তঃপ্রজ্ঞং ন প্রজ্ঞানঘনং ন প্রজ্ঞং নাপ্রজ্ঞম্।
অদৃষ্টমব্যবহার্যমগ্রাহ্যমলক্ষণমচিন্ত্যমব্যপদেশ্যমেকাত্মপ্রত্যয়সারং প্রপঞ্চোপশমং শান্তং শিবমদ্বৈতং চতুর্থং মন্যন্তে স আত্মা স বিজ্ঞেয়ঃ ॥
সোঽয়মাত্মাঽধ্যক্ষরমোংকারোঽধিমাত্রং পাদা মাত্রা মাত্রাশ্চ পাদা অকার উকারো মকার ইতি॥ (মাণ্ডুক্যোপনিষৎ, ৭/৮)
সর্ব্বতঃ পাণিপাদং ত সর্ব্বতোহক্ষিশিরোমুখম্। সর্ব্বতঃ শ্রুতিমল্লোকে সর্ব্বমাবৃত্য তিষ্ঠতি॥
অপাণিপাদো জবনো গ্রহীতা পশ্যত্যচক্ষুঃ স শৃণোত্যকর্ণঃ। স বেত্তি বেদ্যং ন চ তস্যান্তি বেত্তা তমাহুরগ্র্যং পুরুষং মহান্তম॥ (শ্বেতাশ্বতর ৩/১৯)

উপনিষদের প্রায় সর্বত্রই এই প্রকার সবিশেষ সগুণ ও নির্বিশেষ নির্গুণ ভাব ওতঃপ্রোত বিদ্যমান রয়েছে দেখা যায়। উপরে উদ্ধৃত শ্রুতি বাক্যের তাৎপর্য্য অনুধাবন করে দেখলে বুঝতে পারি,- ‘তিনি শব্দ স্পর্শ-রূপ-রস-গন্ধ-বিহীন, অনিত্য অথচ অব্যয়; অপিচ, অনাদি অনন্ত অহত অর্থাৎ নিত্য সত্য পর। আর যিনি তাঁকে জানতে পারেন, তিনিই মুক্তি লাভে সমর্থ হন।’ আবার, ‘তিনি অশরীর, অথচ সর্বব্যাপক। তিনি মহৎ, বিভু এবং তাঁকে মনন করলে, মানুষ মোক্ষ লাভ করে।’ আরও, ‘তিনি অদৃশ্য অর্থাৎ জ্ঞানেন্দ্রিয়ের অগম্য, তিনি কর্মেন্দ্রিয়ের বিষয়ীভূত নন, তাঁর গোত্র-সম্বন্ধ নেই। তিনি স্থূলত্ব ও সূক্ষ্মত্ব প্রভৃতি ধর্মবিরহিত, তিনি চোখ-কান-হাত-পা রহিত; অথচ, তিনি নিত্য, ব্রহ্মা আদি স্থাবরান্ত প্রাণিসমূহের অধিষ্ঠাতা, আকাশের ন্যায় সর্বব্যাপী, অতি সূক্ষ্ম পরিমাণ বিহীন, সর্বভূতের উৎপত্তিস্থান, এবং যিনি তাঁকে জানতে পারেন, তিনিই মুক্তিলাভে সমর্থ হন। উর্ণনাভ যেমন নিজ শরীর হতেই তন্তু-সমূহ বের করে বহির্দেশে বিস্তৃত করে এবং পুনঃরায় সে সমস্তকে নিজ শরীরে সংহৃত করে; পৃথিবী যেমন ওষধি প্রভৃতি উৎপন্ন করে তার সমস্ত পুনরায় রূপান্তরে আত্মসাৎ করে; পুরুষ হতে যেমন কেশলোম আদি-সমূহ সম্ভূত হয়, সেই প্রকার অক্ষর পরমব্রহ্ম হতে জগৎ উৎপন্ন হয়ে থাকে। এইরূপ তাঁর বিশেষণে আরও বলা হয়- ‘তাঁর প্রজ্ঞা বহির্মুখ অন্তর্মুখ বা উভয়মুখ নয়, তিনি প্রজ্ঞানঘন প্রজ্ঞ বা অপ্রজ্ঞ নন; তিনি দর্শনের ব্যবহারের গ্রহণের লক্ষণের চিন্তার নির্দেশের সকলেরই অতীত; অথচ আত্ম প্রত্যাশার প্রপঞ্চাতীত শান্ত শিব অদ্বৈত; এবং যে তাঁকে মনন করে, সেই তাঁকে প্রাপ্ত হয়। সেই আত্মা অকার উকার মকার ইতি সংযোগান্ত ওঙ্কার স্বরূপ।’ অধিক বিবৃতির আবশ্যক নেই। ফলতঃ ব্রহ্মের নির্বিশেষ নির্গুণ ও সবিশেষ সগুণ ভাবদ্বয় হতেই, যথাক্রমে অদ্বৈতবাদ ও বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ মতদ্বয়ের অভ্যুদয় ঘটেছে বলতে হয়। শ্রীমৎ শঙ্করাচার্য্য প্রথমোক্ত মতের পরিপোষক, আর শ্রীমৎ রামানুজাচার্য্য শেষোক্ত মতের পুষ্টিসাধক। এঁদের দুই মতে দুই দিক দিয়ে বেদান্ত সূত্রের ব্যাখ্যা চলেছে। অদ্বৈতবাদীর মতে- মুক্ত হন তিনি, যিনি ব্রহ্মকে জানেন-যিনি ব্রহ্মের সাথে সাম্যলাভে সমর্থ হয়েছেন। সোহহং ব্রহ্মাস্মি অর্থাৎ আমিই ব্রহ্ম এই জ্ঞানই, অদ্বৈত মতে তত্ত্বজ্ঞান; তাহাই মুক্তি। কিন্তু বিশিষ্টাদ্বৈত-বাদিগণের মুক্তি অন্যরকম। তাঁরা বলেন,- ‘ব্ৰহ্ম ও জীব স্বতন্ত্র; জীৰ উপাসনা-প্রভাবে ব্রহ্মের সমান গুণ প্রাপ্ত হন বটে; কিন্তু ব্ৰহ্মত্ব লাভ করেন না। জীব মুক্ত হলে, সর্ববিষয় দর্শনের এবং সর্বাকাঙ্ক্ষা পরিপূরণের ক্ষমতা প্রাপ্ত হন বটে; কিন্তু জগৎ ব্যাপারে তাঁর কোনই অধিকার থাকে না। বেদান্ত-সূত্রে আছে, জগদ্ব্যাপারবর্জ্জং প্রকরণাদসন্নিহিতত্বং।’ এই সূত্রের ব্যাখ্যায় বিশিষ্টাদ্বৈতবাদিগণ ঘোষণা করেন,- ‘শ্রুতি সকলের প্রকরণ ও অর্থের বিচার করলে এটাই বুঝা যায় যে, নিখিল-চিদচিৎ-সৃষ্টি-স্থিতি-নিয়মনরূপ জগদ্ব্যাপার কেবল ব্রহ্মেরই কাজ; ঐ কাজ ব্যতীত অন্যান্য সকল কাজেই মুক্ত জীবের সামর্থ্য আছে। যতো বা ইমানি ভূতানি,’- এই বাক্যের প্রকরণ দেখলে, উহা ব্ৰহ্ম পক্ষেই বুঝা যাবে। অনেক যত্ন করলেও ঐ সকল শ্রুতিকে কোনক্রমেই জীবপক্ষে সঙ্গত করা যায় না। কারণ, জীবসম্বন্ধীয় কোন ও কথাই উহার সন্নিধানে পাওয়া যায় না। অন্যথা- ‘জন্মাদস্যযতঃ’ ইত্যাদি ব্রহ্ম লক্ষণ বাক্য বলা হোত না। জীবের সৃষ্টি কর্তৃত্ব স্বীকার করতে হলে অনেকেশ্বরতারূপ অনিষ্টপাত অনিবার্য্য হয়ে পড়ে। অতএব মুক্তজীবে জগদ্ব্যাপারিত্ব অস্বীকার্য্য।’ মুক্তপুরুষগণ সর্ববিধ বিকারের অতীত হন বটে; কিন্তু ব্রহ্ম হতে পারেন না।

গীতায় ব্রহ্মতত্ত্ব-
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় শ্রীকৃষ্ণ বেদান্ত-মত সর্বতোভাবে আলোচনা করে গেছেন। উপসংহারে তিনি আপন সার সিদ্ধান্ত ব্যক্ত করেছেন। গীতায় কিভাবে বেদান্ত-দর্শনের আলোচনা হয়েছে, আর শ্রীকৃষ্ণ কেমন ভাবে কি সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন, তা বুঝতে হলে প্রথমে গীতোক্ত ব্রহ্মতত্ত্ব বুঝার প্রয়োজন হয়। তারপর, জীবতত্ত্ব, অবিদ্যা অসৎ বা মায়ার বিষয় হৃদয়ঙ্গম করার আবশ্যক হয়। সুতরাং গীতায় বেদান্ত দর্শন বুঝার পূর্বে আমরা প্রথমে ঐ সকল বিষয়ের সংক্ষিপ্ত আলোচনায় প্রবৃত্ত হচ্ছি।
প্রথম-ব্রহ্ম। সাধারণ দৃষ্টিতে গীতায় ব্রহ্মবাচক দশাধিক সংজ্ঞার প্রতি লক্ষ্য পড়ে,- (১) ব্রহ্ম, (২) পুরুষ, (৩) ক্ষেত্রজ্ঞ, বা ক্ষেত্রী, (৪) আত্মা, (৫) ওঁ, (৬) তৎ, (৭) সৎ, (৮) ঈশ্বর বা পরমেশ্বর (৯) কর্ত্তা, (১০) অহং।
স্থূল দৃষ্টিতে দেখতে গেলে, ঐ দশটি সংজ্ঞার মধ্যেও নানা বিরোধ দেখা যায়। কিন্তু জ্ঞানিগণ সে বিরোধ মীমাংসা করে সর্বত্র সমদর্শনে সমর্থ। কেমন বিরোধ, আর কেমনভাবে তার মীমাংসা হয়, তা বুঝার পূর্বে ব্রহ্মবাচক কি কি শব্দ কি কি অর্থে কেমন ভাবে ব্যবহৃত হয়েছে, দেখা যাক।
প্রথম- ‘ব্রহ্ম’ শব্দ। গীতায় আঠারটি অধ্যায়ের মধ্যে সাতটি অধ্যায়ে একুশটির বেশী শ্লোকে ‘ব্রহ্ম’ শব্দের প্রয়োগ আছে, তাতে ব্রহ্মের যে স্বরূপ নির্দিষ্ট হয়েছে, তারদ্বারা মনে কতই বিভিন্ন বিপরীত ভাবের উদয় হয়ে থাকে। ব্রহ্ম কিংস্বরূপ ? গীতায় শ্রীভগবান বলছেন,-
(১) জ্ঞেয়ং যত্তৎ প্রবক্ষ্যামি যজ্­জ্ঞাত্বামৃতশ্নুতে। অনাদি মৎপরং ব্রহ্ম ন সত্তন্নাসদুচ্যতে॥
সর্ব্বতঃ পাণিপাদন্তৎ সর্ব্বতোঽক্ষিশিরোমুখম্। সর্ব্বতঃ শ্রুতিমল্লোকে সর্ব্বমাবৃত্য তিষ্ঠতি॥
সর্ব্বেন্দ্রিয়গুণাভাসং সর্ব্বেন্দ্রিয়বিবর্জিতম্। অসক্তং সর্ব্বভৃচ্চৈব নির্গুণং গুণভোক্তৃ চ॥
বহিরন্তশ্চ ভূতানামচরং চরমেব চ। সূক্ষ্মত্বাত্তদবিজ্ঞেয়ং দূরস্থং চান্তিকে চ তৎ॥
অবিভক্তঞ্চ ভূতেষু বিভক্তমিব চ স্থিতম্। ভূতভর্ত্তৃ চ তজ্­জ্ঞেয়ং গ্রসিষ্ণু প্রভবিষ্ণু চ॥
জ্যোতিষামপি তজ্জ্যোতিস্তমসঃ পরমুচ্যতে। জ্ঞানং জ্ঞেয়ং জ্ঞানগম্যং হৃদি সর্ব্বস্য ধিষ্ঠিতম্॥ (১৩/১২-১৭)
অন্যত্র- (২)
ওঁ তৎ সদিতি নির্দ্দেশো ব্রহ্মণস্ত্রিবিধঃ স্মৃতঃ। ব্রাহ্মণাস্তেন বেদাশ্চ যজ্ঞাশ্চ বিহিতাঃ পুরা॥
তস্মাদোমিত্যুদাহৃত্য যজ্ঞদানতপঃক্রিয়াঃ। প্রবর্ত্তন্তে বিধানোক্তাঃ সততং ব্রহ্মবাদিনাম্॥
তদিত্যনভিসন্ধায় ফলং যজ্ঞতপঃক্রিয়াঃ। দানক্রিয়াশ্চ বিবিধাঃ ক্রিয়ন্তে মোক্ষকাঙ্ক্ষিভিঃ॥
সদ্ভাবে সাধুভাবে চ সদিত্যেতৎ প্রযুজ্যতে। প্রশন্তে কর্ম্মণি তথা সচ্ছব্দঃ পার্থ যুজ্যতে॥
যজ্ঞে তপসি দানে চ স্থিতিঃ সদিতি চোচ্যতে। কর্ম্ম চৈব তদর্থীয়ং সদিত্যেবাভিধীয়তে॥ (১৭/২৩-২৭)
আবার- (৩)
মম যোনির্মহদ্ব্রহ্ম তস্মিন্ গর্ব্ভং দধাম্যহম্। সম্ভবঃ সর্ব্বভূতানাং ততো ভবতি ভারত॥
সর্ব্বযোনিষু কৌন্তেয় মূর্ত্তয়ঃ সম্ভবন্তি যাঃ। তাসাং ব্রহ্ম মহদ্­যোনিরহং বীজপ্রদঃ পিতা॥ (১৪/৩-৪)
মাঞ্চ যোঽব্যভিচারণে ভক্তিযোগেন সেবতে। স গুণান্ সমতীত্যৈতান্ ব্রহ্মভূয়ায় কল্পতে॥
ব্রহ্মণো হি প্রতিষ্ঠাহমমৃতস্যাব্যয়স্য চ। শাশ্বতস্য চ ধর্ম্মস্য সুখস্যৈকান্তিকস্য চ॥ (১৪/২৬-২৭)
অন্যত্র- (৪)
ব্রক্ষার্পণং ব্রহ্ম হবির্ব্রহ্মাগ্নৌ ব্রহ্মণা হুতম্। ব্রহ্মৈব তেন গন্তব্যং ব্রহ্মকর্ম্মসমাধিনা॥
দৈবমেবাপরে যজ্ঞং যোগিনঃ পর্য্যুপাসতে। ব্রহ্মাগ্নাবপরে যজ্ঞং যজ্ঞেনৈবোপজুহ্বতি॥ (৪/২৪-২৫)
আরও- (৫)
ইহৈব তৈর্জিতঃ সর্গো যেষাং সাম্যে স্থিতং মনঃ।
নির্দ্দোষং হি সমং ব্রহ্ম তস্মাদ্­ব্রহ্মণি তে স্থিতাঃ॥
ন প্রহৃষ্যেৎ প্রিয়ং প্রাপ্য নোদ্বিজেৎ প্রাপ্য চাপ্রিয়ম্।
স্থিরবুদ্ধিরসংমূঢ়ো ব্রহ্মবিদ্­ধ্রহ্মণি স্থিতঃ॥
বাহ্যস্পর্শেষ্বসক্তাত্মা বিন্দত্যাত্মনি যৎ সুখম্।
স ব্রহ্মযোগযুক্তাত্মা সুখমক্ষয়মশ্নুতে॥ (৫/১৯-২১)
যোঽন্তঃ সুখোঽন্তরারামস্তথান্তর্জ্যোতিরেব যঃ। স যোগী ব্রহ্মনির্ব্বাণং ব্রহ্মভূতোঽধিগচ্ছতি॥
লভন্তে ব্রহ্মনির্ব্বাণমৃষয়ঃ ক্ষীণকল্মষাঃ। ছিন্নদ্বৈধা যতাত্মানঃ সর্ব্বভূতহিতে রতাঃ॥
কামক্রোধবিমুক্তানাং যতীনাং যতচেতসাম্। অভিতো ব্রহ্মনির্ব্বাণং বর্ত্ততে বিদিতাত্মনাম্॥ (৫/২৪-২৬)
আরও- (৬)
সিদ্ধিং প্রাপ্তো যথা ব্রহ্ম তথাপ্নোতি নিবোধ মে। সমাসেনৈব কৌন্তেয় নিষ্ঠা জ্ঞানস্য যা পরা॥
বুদ্ধ্যা বিশুদ্ধয়া যুক্তো ধৃত্যাত্মানং নিয়ম্য চ। শব্দাদীন্ বিষয়াংস্ত্যক্ত্বা রাগদ্বেষৌ ব্যুদস্য চ॥
বিবিক্তসেবী লঘ্বাশী যতবাক্কায়মানসঃ। ধ্যানযোগপরো নিত্যং বৈরাগ্যং সমুপাশ্রিতঃ॥
অহঙ্কারং বলং দর্পং কামং ক্রোধং পরিগ্রহম্। বিমুচ্য নির্ম্মমঃ শান্তো ব্রহ্মভূয়ায় কল্পতে॥
ব্রহ্মভূতঃ প্রসন্নাত্মা ন শোচতি ন কাঙ্ক্ষতি। সমঃ সর্ব্বেষু ভূতেষু মদ্ভক্তিং লভতে পরাম্॥ (১৮/৫০-৫৪)
অন্যত্র- (৭)
পশ্যামি দেবাংস্তব দেব দেহে সর্ব্বাংস্তথা ভূতবিশেষসঙ্ঘান্।
ব্রহ্মাণমীশং কমলাসনস্থম্ ঋষীংশ্চ সর্ব্বানুরগাংশ্চ দিব্যান্॥(১১/১৫)
গীতার যে সাতটি অধ্যায়ে ব্রহ্ম শব্দের প্রয়োগ দেখলাম, সাধারণ দৃষ্টিতে উহা বিপরীত ভাবদ্যোতক বলে মনে হয়। প্রথম বলা হয়েছে, ‘সেই পরমব্রহ্ম সৎ ও নন, অসৎ ও নন, অথচ, সেই পরম ব্রহ্মের হাত-পা সর্বত্র প্রসারিত, সর্বত্র তাঁর মুখ চোখ মাথা বিদ্যমান; তাঁর শ্রবণ সকল স্থানে শ্রুতি-শক্তি-সম্পন্ন এবং তিনি বিশ্বের সমস্ত পদার্থে ব্যাপ্ত হয়ে অবস্থিত রয়েছেন।’ ঐ সূত্রে আরও বলা হয়েছে- ‘সেই পরমাত্মা ইন্দ্রিয়সমূহের গুণের অবভাসক অথচ তিনি সর্বেন্দ্রিয়বিহীন; তিনি নির্লিপ্ত অথচ সকলের আধার-স্বরূপ; তিনি নির্গুণ, অথচ জীবরূপে গুণোভোক্তা।’ আরও বলা হয়েছে- ‘তিনি ভূতগণের বাইরে এবং অন্তরে অবস্থিত, আবার তিনি স্থাবর জঙ্গম-রূপ ভূতপুঞ্জ; তিনি অতি সূক্ষ্ম অর্থাৎ রূপ আদি বিহীন হেতু জ্ঞানের অগোচর; এছাড়াও তিনি দূরবর্তী অথচ নিকটে অবস্থিত।’ আরও,- ‘তিনি স্থাবর জন্মমাত্মক ভূতপুঞ্জে অবিভক্ত হয়েও ভিন্নরূপে প্রতীয়মান; তিনি স্থিতিকালে ভূতবর্গের পালক, প্রলয় কালে সংহারক, এবং সৃষ্টিকালে উৎপাদক বলে জানবে। সেই ব্রহ্ম সূর্য্য আদিরও প্রকাশক এবং অজ্ঞান দ্বারা অসংস্পৃষ্ট; তিনি জ্ঞানরূপী, জ্ঞেয় বস্তু, জ্ঞানের দ্বারা প্রাপ্য এবং সকলের হৃদয়ে নিয়ন্তারূপে অবস্থিত।’ একই অধ্যায়ে একই প্রসঙ্গে শ্রীভগবান ব্রহ্মের কি স্বরূপ নির্দেশ করলেন, বুঝে দেখুন! সেই যে বলেছি,- স্বরূপ লক্ষণ ও তটস্থ লক্ষণ- ব্রহ্মের দুই লক্ষণ; সেই যে বুঝেছি,-নির্বিশেষ নির্গুণ ও সবিশেষ সগুণ-ব্রহ্মের এই দুই ভাব; গীতায় ভগবদ্‌ উক্তিতেও সেই নির্দেশ। অদ্বৈতবাদী যে চোখে ব্রহ্মকে দেখতে চান, তিনি সেই চোখেই তাঁকে দেখতে পাবেন; আবার দ্বৈতবাদী বা বিশিষ্টাদ্বৈতবাদী ব্রহ্মের যে স্বরূপ নির্ণয় করেন, তা ও এখানে পরিস্ফুটীকৃত। ব্রহ্মের পর্য্যায়- ওঁ সৎ সৎ। শ্রীকৃষ্ণ বলছেন- ‘ব্রহ্মের ঐ ত্রিবিধ নাম (ওঁ তৎ সৎ) শিষ্টগণ কর্তৃক নির্ণীত হয়েছে। এই নামত্রয় দ্বারাই ব্রাহ্মণ, বেদ এবং যজ্ঞ সমূহ পূর্বে সৃষ্টি হয়েছিল। এই জন্যই ব্রহ্মজ্ঞ ব্যক্তিগণ এই বাক্য উচ্চারণ করে শাস্ত্রক্ত যজ্ঞ, দান তপস্যা প্রভৃতি বৈদিক কর্ম সমূহ সম্পাদঙ্করে থাকেন। মোক্ষ অভিলাষী ব্যক্তিগণ ‘তৎ’ এই বাক্য উচ্চারণ পূর্বক ফলকামনা পরিহার করে, বিবিধ যজ্ঞ, তপস্যা এবং দানক্রিয়ার অনুষ্ঠান করে থাকেন। হে পার্থ! সৎ শব্দ সদ্ভাবে অর্থাৎ অস্তিত্ব বিষয়ে এবং সাধু ভাবে প্রযুক্ত হয়ে থাকে। মাঙ্গলিক কাজে ‘সৎ’ শব্দ উচ্চারিত হয়। যজ্ঞে তপস্যায় এবং দান কার্য্যে যে একান্ত নিষ্ঠা, তা সৎরূপে নির্দিষ্ট এবং ব্রহ্ম জ্ঞানানুকূল যে সকল কর্ম অনুষ্ঠিত হয়, তাও সৎ নামে অভিহিত হয়ে থাকে।’ আরও বলা হচ্ছে যে, ‘ব্রহ্ম আমার যোনি বা গর্ভাধান-স্থান, উহাতে আমি গর্ভ অর্থাৎ জগৎ বিস্তারের কারণ-স্বরূপ চিদাভাস নিক্ষেপ করি, আর তা হতেই নিখিল, ভূতগণ উৎপত্তি হয়। যোনিসকলে যে মূর্তি(অর্থাৎ মনুষ্যাদি জগদ্ব্যাপার) উদ্ভূত হয়, মহৎ ব্রহ্ম তার মাতৃস্থানীয়া এবং আমি তার গর্ভাধানকারী পিতা।’ এখানে মহৎব্রহ্ম বা ব্রহ্ম প্রকৃতি-স্থানীয়া এবং আমি-পুরুষ বা কর্ত্তা-স্থানীয়, এরকম বুঝা যায়। এরপর আবার বলা হয়েছে,- ‘যে জন আমার ঐকান্তিক ভক্তিমান ও সেবাপরায়ণ, সে ব্যক্তি সকল গুণ অতিক্রম করে ব্রহ্ম ভাব অর্থাৎ মুক্তি প্রাপ্ত হন। অধিকতর আমি ব্রহ্মের প্রতিমা, অর্থাৎ ঘনীভূত ব্রহ্ম, আমি নিত্য অমৃতের, সনাতন ধর্মের এবং পরম সুখের প্রতিমা অর্থাৎ আশ্রয়স্থান।’ তবেই বুঝুন,- কি ব্রহ্ম, কিভাবে উপনীত। এই ব্রহ্মের আর এক পরিচয়-’অর্পণ ব্রহ্ম, হবি ব্রহ্ম, অগ্নি ব্রহ্ম, হোম ব্রহ্ম। এইরকম কর্মাত্মক ব্রহ্মে ন্যস্তচিত্ত জনও ব্রহ্ম।’ এখানে একেবারে ‘সোহহং’ ভাব। ফলাকাঙ্ক্ষা বর্জিত যজ্ঞকারীর এই অবস্থা। ব্রহ্মপ্রাপ্ত হন- আর কোন জন ? যে জন কর্মযোগযুক্ত, তিনি ব্রহ্মকে প্রাপ্ত হন। যাঁরা কর্মযোগী, কর্মফলে আসক্তি-ত্যাগ-হেতু, তাঁদের কর্ম বন্ধন বিচ্ছিন্ন হয়েই আছে; যেমন, জলমধ্যে থেকেও পদ্মপাতা জল দ্বারা লিপ্ত হয় না, কর্মযোগীগণ কর্মফল ব্রহ্মে অর্পণ হেতু তেমনি নির্লিপ্ত ভাবাপন্ন। আর, ‘যাঁদের চিত্ত সাম্যে স্থিত, তাঁরা ইহলোকে থেকেও স্বর্গজয়ী, ব্রহ্ম নির্দোষ ও সর্বত্র সমভাবাপন্ন, সুতরাং যাঁরা নির্দোষ সাম্যভাবাপন্ন, তাঁরাও ব্রহ্মত্ব প্রাপ্ত।’ ব্রহ্মভাবাপন্ন বা ব্রহ্মত্ব প্রাপ্ত জন কেমন ?- না, তাঁরা স্থিরবুদ্ধি মোহ-হীন, প্রিয় বা অপ্রিয় কোনও অবস্থায় হৃষ্ট বা বিষন্ন নন, বাহ্যেইন্দ্রিয়ের আকৃষ্যমাণ বিষয়সমূহে তারা অনাসক্তচিত্ত, তাঁদের অন্তঃকরণ পরম শান্তি পূর্ণ, সমাধি দ্বারা পরমাত্মার সাথে মিলন জনিত তাঁরা অক্ষয় সুখপ্রাপ্ত। তাঁরাই যোগী, তাঁরাই ব্রহ্ম, তাঁরাই আত্মদৃষ্টসম্পন্ন, তাঁরাই ব্রহ্মত্ব প্রাপ্ত।’ উপসংহারে(আঠার অধ্যায়ে) ব্রহ্মত্ব প্রাপ্তির চরম পন্থা নির্দিষ্ট হয়েছে, ব্রহ্মের স্বভাব এবং তদ্ভাব-প্রাপ্তিই ব্রহ্মত্ব —রয়েছে। সে পথ- সে স্বভাব প্রাপ্তি কি ? সাত্ত্বিকী বুদ্ধি, সাত্ত্বিকী ধৃতি, তদ্দ্বারা চিত্ত বৃত্তির স্থৈর্য্য সম্পাদন, রাগ দ্বেষ পরিহার, পবিত্র স্থানে বাস ও পরিমিত আহার, দেহ– মনের সংযম সাধন, অহঙ্কার বল দর্প কাম ক্রোধ পরিগ্রহ পরিহার, ব্রহ্ম ধ্যান পরায়ণ, সর্ব বিষয়ে মমত্ব-শূন্য, আর ‘আমিই ব্রহ্ম’ এরকম দৃঢ় প্রত্যয়,-এটিই হল ব্রহ্মত্ব লাভের লক্ষণ। যে লক্ষণে শোক নেই, আকাঙ্ক্ষা নেই, নিরানন্দ নেই; সর্বভূতে সমদর্শিতা আছে, আর ভগবানে অচঞ্চলা ভক্তি আছে। যাঁর এই ভাব হয়েছে, তিনিই ব্রহ্মত্ব লাভ করেছেন। তিনিই দেখছেন- ‘সেই ব্রহ্মেই এই বিশ্ব ওতঃপ্রোত বিদ্যমান রয়েছে; দেবগণ, প্রাণিগণ, দিব্য ঋষিগণ, বিশ্ব-সংসার সকলই তাঁতে অবস্থিত আছে।’ ব্রহ্মের ও ব্রহ্মবিদের এটাই চরম ও পরম অবস্থা।

পুরুষ, ক্ষেত্রজ্ঞ, ঈশ্বর, আত্মা।
‘ব্রহ্ম’ শব্দ গীতায় যে যে অর্থে ব্যবহার হয়েছে; পুরুষ, ক্ষেত্রজ্ঞ, আত্মা, ঈশ্বর প্রভৃতি শব্দ প্রায় সেই ভাবই প্রকাশ করছে। গীতার যে কয়েক স্থানে পুরুষ শব্দ ব্রহ্মভাবদ্যোতক, তার মধ্যে অষ্টম অধ্যায়ে, ত্রয়োদশ অধ্যায়ে, ষোড়শ অধ্যায়ে যে পুরুষ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে, তা লক্ষ্য করার বিষয় বলে মনে করি। অষ্টম অধ্যায়ে ‘পুরুষশ্চাধিদৈবতং’- পুরুষকে ‘অধিদৈবত’ বলা হয়েছে। অধিদৈবত শব্দের অর্থ-সূর্য্য-অগ্নি-জল-বায়ু-আকাশ আদির আশ্রয়-স্বরূপ অধিষ্ঠানভূত চৈতন্যাংশ, ইন্দ্রিয় আদি দেবগণের অধিপতি। শঙ্করাচার্য্য এই ‘অধিদৈবত’ পুরুষকে, ‘আদিত্যান্তর্গত হিরণ্যগর্ভ সর্ব্বপ্রাণীকরণানামনুগ্রাহক’ বলে বিশেষিত করে গেছেন। এই অধ্যায়ে এই পুরুষের আর পরিচয় আছে,- ‘অভ্যাসযোগ দ্বারা একাগ্রচিত্তে সেই জ্যোতিম্ময় পরমপুরুষকে চিন্তা করলে, তাঁকেই লাভ করা যায়। তিনি সর্বজ্ঞ, অনাদি, নিখিল ব্রহ্মাণ্ডের নিয়ন্তা, সূক্ষ্ম হতে সূক্ষ্মতম, ব্রহ্মাণ্ডের পালনকর্তা, মলিন মনোবুদ্ধির অগোচর, প্রকৃতির পর বর্তমান সূর্য্যের ন্যায় স্বপর প্রকাশক।’(গীতার অষ্টম অধ্যায়ের ৮-১০ এবং ২১-২২ শ্লোক দেখুন) আরও, ‘সেই পুরুষে ভূতগণ অবস্থিত আছে; তিনি এই সমুদায় জগৎ ব্যাপিয়া আছেন; তিনি কারণ স্বরূপ ও শ্রেষ্ঠ, মাত্র অনন্যা-ভক্তি দ্বারাই তাঁকে প্রাপ্ত হওয়া যায়।’(গীতায় ত্রয়োদশ অধ্যায়ের ১৯-২৪ শ্লোক ও তার অর্থ অনুধাবন করুন) পুরুষকে প্রায় সকল স্থানেই ‘অহং’ বা ‘আমি’ হতে অভিন্ন বলে প্রতিপন্ন করা হয়েছে দেখতে পাই। ত্রয়োদশ অধ্যায়ে পুরুষ অনাদি (প্রকৃতিং পুরুষঞ্চৈব বিদ্ধ্যানাদী উভাবপি), পুরুষ সুখদুঃখের ভোক্তৃত্ব-হেতু (পুরুষঃ সুখদুঃখানাং ভোক্তৃত্বে হেতুরুচতে) অর্থাৎ, ‘সুখদুঃখভোগের কারণরূপে উক্ত। সেখানে পুরুষ প্রকৃতিগত হয়ে, প্রকৃতিসম্ভূত সুখদুঃখ আদি গুণ-সমূহকে উপভোগ করেন; সেখানে পুরুষ এই দেহে অবস্থিত হয়েও দেহ হতে ভিন্ন এবং এর সাক্ষী, অনুমোদক, ভর্ত্তা, ভোক্তা, ও সর্বস্বামী পরমাত্মা প্রভৃতি রূপে পরিচিত।’ অধিকতর, যিনি এই পুরুষকে আর বিকারযুক্ত প্রকৃতিকে পরিজ্ঞাত হতে পারেন, তিনি মুক্তি লাভ করেন।(ত্রয়োদশ অধ্যায়ে ২৬ এবং ৩৩-৩৪ শ্লোকে ক্ষেত্র ক্ষেত্রজ্ঞ ক্ষেত্রী প্রভৃতির পরিচয় দেখুন) পঞ্চদশ অধ্যায়ে পুরুষের ত্রিবিধ মূর্তি দেখতে পাই। এক প্রকার পুরুষ ‘ক্ষর’, এক প্রকার ‘অক্ষর’ এবং তৃতীয় প্রকার পুরুষ ‘উত্তম’। সেই উত্তম পুরুষকে সেখানে পরমাত্মা ঈশ্বর নির্বিকার ও লোকরক্ষক বলে ঘোষণা করা হয়েছে। সেই পুরুষ বা পুরুষোত্তম যে অহং তাহাই উক্ত আছে। ক্ষেত্রজ্ঞ ঈশ্বর কর্তা প্রভৃতি শব্দের ও প্রায় ঐ একই রকম সংজ্ঞা নির্দিষ্ট। ত্রয়োদশ অধ্যায়ের কয়েকটি শ্লোকে পূর্বে যাকে প্রকৃতি ও পুরুষ বলা হয়েছে, তাকেই আবার ক্ষেত্র ও ক্ষেত্রজ্ঞ বলা হচ্ছে; যথা,- ‘যাবৎ সংজায়তে কিঞ্চিৎ সত্ত্বং স্থাবরজঙ্গমম। ক্ষেত্রক্ষেত্রজ্ঞ সংযোগাৎ তদ্বিদ্ধি ভরতর্ষভঃ।’ পড়ে আবার ক্ষেত্রজ্ঞকে ক্ষেত্রী নামে অভিহিত দেখি। ক্ষেত্র ক্ষেত্রজ্ঞের জ্ঞান লাভে যে পরমপদপ্রাপ্তি হয়, তাহাই সিদ্ধান্ত। ঈশ্বর শব্দ যেখানে প্রযুক্ত হয়েছে, সেখানে প্রায় সর্বত্রই ‘অহং’ ভাবদ্যোতক (ঈশ্বরোহহমহং ইত্যাদি)। একস্থানে ঈশ্বরের একটু পরিচয় আছে; যথা,- ‘ঈশ্বরঃ সর্বভূতানাং হৃদ্দেশেহর্জ্জুন তিষ্ঠতি। ভ্রাময়ন সর্ব্বভূতানি যন্ত্রারূঢ়ানি মায়য়া॥’ অর্থাৎ, অন্তর্য্যামী ঈশ্বর স্বকীয় মায়া-প্রভাবে যন্ত্রারূঢ় ভূতগণকে পরিভ্রমণ করিয়ে তাদের হৃদয়ে অবস্থিতি করছেন। সর্বতোভাবে এই ঈশ্বরের শরণাপন্ন হলে, মুক্তি অধিগত হয়। ‘ওঁ তৎ সৎ’ শব্দত্রয় যে ব্রহ্মবাচক, তা পূর্বেই বলা হয়েছে। সুতরাং সে বিষয়ে অধিক আলোচনা নিষ্প্রয়োজন।
অতঃপর- কর্তা। গীতায় কর্তার ত্রিবিধ প্রকারভেদ উল্লেখ আছে। কর্তা- সাত্ত্বিক, কর্তা-রাজস, কর্তা-তামস। ‘মুক্তসঙ্গোহনহংবাদী ধৃত্যুৎসাহসমন্বিতঃ। সিদ্ধ্যসিদ্ধ্যোর্নির্বিকারঃ কর্তা সাত্ত্বিক উচ্যতে॥
রাগী কর্মফলপ্রেপ্সুর্লুব্ধো হিংসাত্মকোহশুচিঃ। হর্ষশোকান্বিতঃ কর্তা রাজসঃ পরিকীর্তিতঃ॥
অযুক্তঃ প্রাকৃতঃ স্তব্ধঃ শঠো নৈষ্কৃতিকোহলসঃ। বিষাদী দীর্ঘসূত্রী চ কর্তা তামস উচ্যতে॥’ এই ত্রিবিধ কর্তার মধ্যে সাত্ত্বিক কর্তাই শ্রেষ্ঠ। তিনি মুক্তসঙ্গ, অর্থাৎ ফলকামনা পরিবর্জিত। তিনি নিরহঙ্কার, তিনি ধৈর্য্য ও উৎসাহশীল, অর্থাৎ নিশ্চয়াত্মিকা জ্ঞান-সম্পন্ন। কাজের সিদ্ধিতে বা অসিদ্ধিতে তাঁর হর্ষ-বিষাদ নেই। যিনি রাজস কর্তা- তিনি কাম আদি রাগযুক্ত, কর্মপ্রার্থী, হিংসাপরায়ণ, অশুচি, লাভালাভে হর্ষ-শোকযুক্ত। আর যিনি তামস কর্তা-তিনি অসংযত অবিবেকী অনম প্রবঞ্চক অলস শোকস্বভাব ইত্যাদি। মানুষ যেমন সত্ত্ব আদি ত্রিবিধ গুণান্বিত, তার কর্তাও তদনুরূপ। যে কর্তা সাত্ত্বিক, সেই কর্তাই বিমুক্ত। গীতার যে বিভিন্ন দার্শনিক মতের সামঞ্জস্য-সাধন হয়েছে, তার মূল তথ্য প্রকৃতি-পুরুষ ক্ষেত্র-ক্ষেত্রজ্ঞ, জীব ব্রহ্ম, কর্তা করণ, ওঁতৎসৎ, অহং প্রভৃতি নাম-সংজ্ঞার মধ্যেই যেন দেদীপ্যমান রয়েছে। এই নাম সংজ্ঞার পরিণতিই অহং, গীতোক্ত ‘অহং’-তত্ত্বের আলোচনায় তাহাই উপলব্ধি হয়।

গীতার সার ‘অহং’ -’আমি’-
গীতার সার- ‘অহং’ ‘আমি’ তত্ত্ব। ব্রহ্ম, ঈশ্বর, পুরুষ, কর্তা, আত্মা, ক্ষেত্রজ্ঞ, ওঁতৎসৎ আদি যে কিছু তত্ত্ব গীতায় আলোচিত হয়েছে, তাদের সারভূত- অহং বা আমি। গীতার সেই ‘অহং আমি’ উলব্ধি করতে পারলেই গীতাপাঠ সার্থক হয়,- শ্রীকৃষ্ণের দার্শনিক গবেষণার সামঞ্জস্য সমাধানও সম্যক অধিগত হতে পারে। শ্রীকৃষ্ণ যখনই যে উপদেশ দিয়েছেন, সেই উপদেশেরই শেষ মীমাংসায় অহং-তত্ত্ব দৃঢ় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তিনি প্রথমে বলছেন- ‘ইন্দ্রিয়গণকে বশীভূত করে মৎপরায়ণ হও (তানি সর্ব্বাণি সংযম্য যুক্ত আসীতমৎপরঃ); মধ্যেও বলেছেন,- সর্ব কর্ম আমাতে অর্পণ কর; শেষেও বলছেন-
মন্মনা ভব মদ্ভক্ত মদ্‌যাজী মাং নমস্কুরু। মামেবৈষ্যসি সত্যং তে প্রতিজানে প্রিয়োহসি মে॥
সর্ব্বধর্ম্মান্‌ পরিত্যজ্য মামেকং শরণং ব্রজ। অহং ত্বাং সর্ব্বপাপেভ্যো মোক্ষয়িষ্যামি মা শুচঃ॥
অর্থাৎ, আমার প্রতি চিত্ত ন্যস্ত কর, আমার ভক্ত ও আমার উপাসক হও, একমাত্র আমাকেই নমস্কার কর, তাহলেই আমাকে পাবে; হে প্রিয়, এ কথা সত্য-ধ্রুব সত্য। সর্ব ধর্ম (সর্ব কাজ) পরিত্যাগ করে, একমাত্র আমার শরণ লও; আমিই তোমায় সর্ববিধ পাপ হতে মুক্ত করব; অনুশোচনার কোনও প্রয়োজন নেই। এক স্থানে নয়; দ্বিতীয় অধ্যায়ে- যেখানে তাঁর উপদেশ আরম্ভ হয়েছে, সেখানেও ঐ কথা; আবার আঠারো অধ্যায়ে-যেখানে উপদেশ শেষ হয়েছে, সেখানেও ঐ কথা। তৃতীয় অধ্যায়েও সেই; চতুর্থ অধ্যায়েও সেই; পর পর সকল অধ্যায়েই সেই কথা।
তৃতীয় অধ্যায়ে, যথা,-
‘ময়ি সর্ব্বাণি কর্ম্মাণি সংন্যস্যাধ্যাত্ম চেতসা।’
চতুর্থ অধ্যায়ে, যথা- ‘যে যথা মাং প্রপদ্যন্তে তাংস্তথৈব ভজাম্যমম্‌।’
পঞ্চম অধ্যায়ে, যথা- ‘ভোক্তারং যজ্ঞতপসাং সর্ব্বলোক মহেশ্বরম।
সুহৃদং সর্ব্বভূতানাং জ্ঞাত্বা মাং শান্তিমৃচ্ছতি।’
ষষ্ঠ অধ্যায়ে, যথা- ‘যো মাং পশ্যতি সর্ব্বত্র সর্ব্বঞ্চ ময়ি পশ্যতি।
তস্যাহং ন প্রণশ্যমি স চ মে ন প্রণশ্যতি॥
সর্ব্বভূতস্থিতং যো মাং ভজত্যেকত্বমাস্থিতঃ।
সর্ব্বথা বর্ত্তমানোঽপি স যোগী ময়ি বর্ত্ততে॥
সপ্তম অধ্যায়ে, যথা- ময্যাসক্তমনাঃ পার্থ যোগং যুঞ্জন্মদাশ্রয়ঃ।
অসংশয়ং সমগ্রং মাং যথা জ্ঞাস্যসি তচ্ছৃণু॥১
সাধিভূতাধিদৈবং মাং সাধিযজ্ঞঞ্চ যে বিদুঃ।
প্রয়াণকালেঽপি চ মাং তে বিদুর্যুক্তচেতসঃ॥৩০
অষ্টম অধ্যায়ে, যথা- অন্তকালে চ মামেব স্মরন্ মুক্ত্বা কলেবরম্।
যঃ প্রয়াতি স মদ্ভাবং যাতি নাস্ত্যত্র সংশয়ঃ॥৫
মামুপেত্য পুনর্জন্মদুঃখালয়মশাশ্বতম্।
নাপ্নুবন্তি মহাত্মানঃ সংসিদ্ধিং পরমাং গতাঃ॥১৫
আব্রহ্মভুবনাল্লোকাঃ পুনরাবর্ত্তিনোঽর্জ্জুন।
মামুপেত্য তু কৌন্তেয় পুনর্জন্ম ন বিদ্যতে॥১৬
নবম অধ্যায়ে, যথা-
যৎ করোষি যদশ্নাসি যজ্জুহোষি দদাসি যৎ।
যত্তপস্যসি কৌন্তেয় তৎ কুরুষ্ব মদর্পণম্॥২৭
মন্মনা ভব মদ্ভক্তো মদ্­যাজী মাং নমস্কুরু।
মামেবৈষ্যসি যুক্ত্বৈবমাত্মানং মৎপরায়ণঃ॥৩৪
দশম অধ্যায়ে, যথা- মচ্চিত্তা মদ্গতপ্রাণা বোধয়ন্তঃ পরস্পরম্।
কথয়ন্তশ্চ মাং নিত্যং তুষ্যন্তি চ রমন্তি চ॥৯
একাদশ অধ্যায়ে, যথা-
মৎকর্ম্মকৃন্মৎপরমো মদ্­ভক্তঃ সঙ্গবর্জ্জিতঃ।
নির্ব্বৈরঃ সর্ব্বভূতেষু যঃ স মামেতি পাণ্ডব॥৫৫
দ্বাদশ অধ্যায়ে, যথা-
ময্যাবেশ্য মনো যে মাং নিত্যযুক্তা উপাসতে।
শ্রদ্ধয়া পরয়োপেতাস্তে মে যুক্ততমা মতাঃ॥২
যে তু সর্ব্বাণি কর্ম্মাণি ময়ি সংন্যস্য মৎপরাঃ।
অনন্যেনৈব যোগেন মাং ধ্যায়ন্ত উপাসতে॥৬
তেষামহং সমুদ্ধর্ত্তা মৃত্যুসংসারসাগরাৎ।
ভবামি ন চিরাৎ পার্থ ময্যাবেশিতচেতসাম্॥৭
ময্যেব মন আধৎস্ব ময়ি বুদ্ধিং নিবেশয়।
নিবসিষ্যসি ময্যেব অত ঊর্দ্ধ্বং ন সংশয়ঃ॥৮
ত্রয়োদশ অধ্যায়ে, যথা- মদ্ভক্ত এতদ্বিজ্ঞায় মদ্ভাবায়োপপদ্যতে॥১৯
চতুর্দ্দশ অধ্যায়ে, যথা- মাঞ্চ যোঽব্যভিচারণে ভক্তিযোগেন সেবতে।
স গুণান্ সমতীত্যৈতান্ ব্রহ্মভূয়ায় কল্পতে॥২৬
পঞ্চদশ অধ্যায়ে, যথা-
যো মামেবমসংমূঢ়ো জানাতি পুরুষোত্তমম্।
স সর্ব্ববিদ্ভজতি মাং সর্ব্বভাবেন ভারত॥১৯
ষোড়শ অধ্যায়ে, যথা-
তানহং দ্বিষতঃ ক্রূরান্ সংসারেষু নরাধমান্।
ক্ষিপাম্যজস্রমশুভানাসুরীষ্বেব যোনিষু॥১৯
সপ্তদশ অধ্যায়ে যথা-
কর্শয়ন্তঃ শরীরস্থং ভূতগ্রামমচেতসঃ।
মাঞ্চৈবান্তঃশরীরস্থং তাং বিদ্ধ্যাসুরনিশ্চয়ান্॥৬
এই রকম দেখা যায়, গীতার সর্বত্রই তিনি বলেছেন,- সমুদায় কর্ম আমাতে সমর্পণ কর; যে আমাকে যে ভাবে ভজনা করে, আমি তাকে সেই ভাবেই অনুগ্রহ করি; যে জন আমাকে সকল যজ্ঞের, সকল তপস্যার নিলয়-স্থান সর্বলোকমহেশ্বর ও সর্বভূতের সুহৃৎ বলে জানতে পারে, সেই মোক্ষ লাভের অধিকারী হয়; যিনি আমাকে সর্বভূতে দেখতে পান এবং আমাতে সর্বভূতের আশ্রয় বলে জানেন, আমি তাঁর অদৃশ্য নই, তিনিও আমার দৃষ্টি-বহির্ভূত নন, যিনি সর্বভূতে আমাকে অভিন্ন-ভাবে অবস্থিত দেখে আমার ভজনা করেন, তিনি যে ভাবেই অবস্থিত হোন না কেন, তিনি আমাতেই অবস্থিত হন, হে পার্থ! তুমি একমাত্র আমাতে নিবিষ্ট-চিত্ত ও একমাত্র আমার শরণাপন্ন হয়ে যোগরত হও, তাহলে তুমি সম্যকভাবে আমাকেই প্রাপ্ত হবে, যাঁরা আমাকে অধিভূত অধিদৈব ও অধিযজ্ঞের সাথে জানেন, আমাতে আসক্ত চিত্ত হন, অন্তকালে তারা আমাকেই প্রাপ্ত হয়ে থাকেন, মৃত্যুকালে আমাকে স্মরণ করে, যেজন কলেবর পরিত্যাগ করে, সেজন আমারই ভাব প্রাপ্ত হয়, এই বিষয়ে কোনই সংশয় নেই, এমন মদ্ভক্তগণ দুঃখের আলয় স্বরূপ অনিত্য জন্ম হতে মুক্তি লাভ করেন এবং পরমাসিদ্ধি (মোক্ষ) প্রাপ্ত হয়ে থাকেন, ব্রহ্ম লোক হতেও জীবেরা পুনরায় ভুলোকে জন্মগ্রহণ করে থাকেন; কিন্তু যে জন আমাকে প্রাপ্ত হয়, তার আর পূণ জন্ম হয় না, হে কৌন্তেয়! তুমি যে কাজই কর, আহারই কর, হোমই কর, দানই কর, ব্রত তপস্যাই কর, সমস্ত যেন আমাতে সমর্পিত হয়-এমন ভাবে করবে, মৎচ্চিত্ত, মৎসেবক ও মদুপাসক হয়ে আমাকেই নমস্কার কর, মৎপরায়ণ হয়ে আমাতে একাগ্রচিত্ত হতে পারলে, আমাকেই প্রাপ্ত হবে, আমার প্রতি যাঁদের চিত্ত ন্যস্ত, যারা মদ্গত প্রাণ, তারা আমার কথা শুনিয়ে- আমার মাহাত্ম্য জনসমাজকে বুঝিয়ে দিয়ে, পরমানন্দ প্রম শান্তি প্রাপ্ত হয়, হে পাণ্ডব! আমার প্রীতির জন্য যিনি ধর্মানুষ্ঠান করেন, আমি যার পরম পুরুষার্থ, যিনি আমার পরম ভক্ত, যিনি পুত্র-কলত্র আদিতে আসক্তিশূন্য অথচ সর্বজনে নির্বৈর ভাব, তিনিই আমাকে প্রাপ্ত হন, আমাতে চিত্ত নিবিষ্ট করে, মৎপরায়ণ হয়ে, পরম শ্রদ্ধা সহকারে, যারা আমার উপাসনা করে, তাহারাই আমার প্রকৃষ্ট উপাসক, যারা সর্ব কর্ম আমাতে সমর্পণ করে, মৎপরায়ণ হয়ে, অনন্যভক্তিসহকারে ধ্যান নিরত যোগযুক্ত হয়ে, আমার উপাসনা করে, হে পার্থ। মদ্গতচিত্ত সেই সকল মহাত্মাদের আমি মৃত্যুরূপ সংসার সাগর হতে উদ্ধার করি, অতএব আমাতেই মন ন্যস্ত কর, আমাতেই বুদ্ধি স্থির রাখ, তাহলে দেহান্তে আমাতেই অবস্থান করতে সমর্থ হবে, সে বিষয়ে কোনই সংশয় নেই, যেজন আমার ভক্ত, সেজন সকল জ্ঞান লাভ করে, আমার ভাব অর্থাৎ ব্রহ্মত্ব প্রাপ্ত হয়, আমাকে যে জন অবিচলিত ভক্তি দ্বারা উপাসনা করে, সে গুণাতীত হয়ে ব্রহ্ম ভাব (মুক্তি) প্রাপ্ত হয়; অবিচলিত চিত্তে যেজন আমাকে পুরুষোত্তম বলে জানতে পারে এবং সেইরূপ জেনে আমাকে ভজনায় সর্বতোভাবে প্রবৃত্ত হয়, সে জন সর্বজ্ঞত্ব লাভ করে; আর যে ক্রূরকর্মা নরাধম পাপিষ্ঠ আমার বিদ্বেষী হয়, তাকে আমি নিরন্তর আসুরী যোনিতে নিক্ষেপ করি, যে অবিবেকী(জন অশাস্ত্রীয় যজ্ঞ তপাদির দ্বারা) অন্তরস্থিত আমাকে এবং বহিঃস্থিত ভূতবর্গকে কষ্ট প্রদান করে, তারা আসুর-স্বভাব অর্থাৎ তারা চিরকষ্টভাগী হয়।’
অহং, আমি বা আমার মাহাত্ম্য সম্বন্ধে গীতায় এমনই পরিচয় দেওয়া হয়েছে। উহাতে ঐ ‘অহং’ আমি বা আমার স্বরূপ কিছুই ব্যক্ত করা হয়নি, কিন্তু ঐ ‘অহং’ আমি বা আমার মধ্যে কর্মকাণ্ড আছে, জ্ঞান কাণ্ড আছে, সুতরাং বেদের সার, উপনিষদের সার, দর্শনের সার-সর্ব-সারভূত মোক্ষ-তত্ত্ব সর্বতোভাবে বিবৃত রয়েছে।

সেই ‘অহং’-আমি তত্ত্ব-
সে ‘আমি’- কে আমি ? তিনি যেখানে বললেন- ‘তানি সর্বাণি সংযম্য আসীত মৎপরঃ’; সেখানে ‘মৎপরঃ’ বলতে কার অনুসরণ বুঝাচ্ছে ? এর পূর্বে গীতার আর কোথাও ‘অহং’-জ্ঞাপক শব্দ প্রয়োগ হয়নি। অপিচ, এখানেও এই ‘মৎ’ শব্দের কোনও ব্যাখ্যা দেওয়া হয়নি। সুতরাং সহজ দৃষ্টিতে এখানে এই ‘মৎ’ শব্দের নানা অর্থ নিষ্কাষণ করতে পারেন। পূর্বে জীব বা আত্মার বিষয় বলা হয়েছে। যদিও সেখানে জীব বা ‘আত্মা’ শব্দ ব্যবহৃত হয়নি, কিন্তু যে বিশেষণে যাঁকে বুঝানো হয়েছে, তাতে তাঁকে জীব বা আত্মা বলেই ব্যাখ্যা করা হয়। আত্মাই বল, আর অন্য যে সংজ্ঞাই প্রদান কর, সেখানে তিনি-অবিনাশী, নিত্য, সৎ, অব্যয়, অচ্ছেদ্য, অদাহ্য প্রভৃতি বিশেষণে বিশেষিত আছেন। () সাংখ্য গণ বলেন, ঐ ‘মৎ’ শব্দে সেই ‘আত্মাকে’ বা পুরুষকে নির্দেশ করা হয়েছে। সে ক্ষেত্রে ‘মৎপর’ শব্দে ‘আত্মপর’ বা আত্মজ্ঞান-সম্পন্ন অর্থ সূচিত হচ্ছে। বৈদান্তিকদের ব্যাখ্যা অন্যরকম। যাঁরা অদ্বৈতবাদী, তাঁদের ব্যাখ্যায় ঐ বিশেষণ গুলি জীব সম্বন্ধে প্রয়োগ হয়েছে। জীবের ‘সোহহং’ (আমিই ব্রহ্ম) এমন জ্ঞানে অবস্থিত ভাব ‘মৎপরঃ’ শব্দে বুঝিয়ে থাকে। বিশিষ্টাদ্বৈতবাদীদের ব্যাখ্যায় সর্বাত্মা বাসুদেবের প্রতি একাগ্রচিত্ততা প্রতিপন্ন হয়। () দ্বৈতবাদিরা অধিকতর পরিষ্কার ভাবে বলে থাকেন যে, বাসুদেব শ্রীকৃষ্ণই সকলের আত্মারূপে অবস্থিত; তার প্রতি একান্ত ভক্তিপরায়ণ হলে সংসারের সকল বিপদ বিদূরিত হয়। দৃষ্টান্ত স্বরূপ তারা বলেন, শাস্ত্রে আছে- যাঁরা বাসুদেবের ভক্ত, তাঁদের কখনও অমঙ্গল হয় না। প্রবল বলশালী নৃপতির আশ্রয়ে গ্রহণে লোক যেমন দস্যুদের দমন করতে সমর্থ হয়, আর রাজ আশ্রিত জন জেনে দস্যুরা যেমন ভয়ে বশীভূত থাকে, তেমনি ভগবদ আশ্রয় লাভ করতে পারলে দুর্দ্ধর্ষ ইন্দ্রিয়গণ নিজ্ঞ্রিহীত ও বশতাপন্ন হয়। বাসুদেব শ্রীকৃষ্ণের অর্চনা উপাসনা দ্বারাই যে ইন্দ্রিয়গণকে দমিত ও বশীভূত করা যায়, এ পক্ষ তাহাই সিদ্ধান্ত করেন। ফলতঃ এক সম্প্রদায় ‘মৎপরঃ’ শব্দে তত্ত্বজ্ঞানসম্পন্ন, এক সম্প্রদায় ‘অহং’ ভাবাপন্ন, অন্য সম্প্রদায় আত্ম-সমাধিযুক্ত এবং অন্যান্য সম্প্রদায় কৃষ্ণভক্ত অর্থ নিষ্পন্ন করেন। বাসুদেব শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং যখন বক্তা, তখন শেষোক্ত অর্থই যে অধিকাংশের অনুমোদিত, তা বলাই বাহুল্য। যা হোক, অন্যান্য অধ্যায়ে তিনি সেই ‘আমার’ কি পরিচয় দিয়েছেন এবং তার সাথে এই মৎপরতার কি সম্বন্ধ আছে, দেখা যাক। তৃতীয় অধ্যায়ে, (২২-২৪ শ্লোকে) যথা- ‘ন মে পার্থান্তি কর্ত্তব্যং ত্রিষু লোকেষু কিঞ্চন। নানাবাপ্তমবাপ্তব্যং বর্ত্ত এব চ কর্ম্মণি। যদি হ্যহং ন বর্ত্তেয়ং জাতু কর্ম্মণ্যতন্দ্রিতঃ। মম বর্ত্মানুবর্ত্তন্তে মনুষ্যাঃ পার্থ সর্ব্বশঃ। উৎসীদেয়রিমে লোকা ন কুর্য্যাং কর্ম্ম চেদহম। সঙ্করস্য চ কর্ত্তা স্যামুপহন্যামিমাঃ প্রজাঃ।’ অর্থাৎ, হে পার্থ! এই ত্রিলোকের মধ্যে আমার কিছুই কর্তব্য ও নেই; প্রাপ্তব্য বা অপ্রাপ্তব্যও নেই; তথাপি আমি কর্মে নিয়োজিত আছি। হে পার্থ! আমি যদি অনলস হয়ে কর্মের অনুষ্ঠান না করি, তবে মানুষেরা সর্বতোভাবে আমারই অনুসরণ করবে। আমি কর্ম না করলে, আমার অনুসরণে কর্ম না করে, ধর্মলোপবশতঃ তারা বিনষ্ট হবে। আর তাহলে, আমিই বর্ণসঙ্করের কর্তা হব এবং আমা হতেই লোকসকল ধ্বংস প্রাপ্ত হবে।’
এখানে ‘আমার’ একটু পরিচয় পাওয়া গেল। সে ‘আমি’ কেমন ? না, নিয়ত কর্মানুরত। কর্তব্য বলে নয়; প্রাপ্তব্য বা অপ্রাপ্তব্য বলেও নয়; তথাপি কর্ম আমায় করতেই হবে। এ প্রসঙ্গে একটি নিগূঢ় উপদেশ পাওয়া যায়। সে উপদেশ, আমি কর্ম করি, আমার জন্য নয়-জীবের জন্য; জীব তেমনি নিজের জন্য কর্ম না করে সর্ব কর্ম আমাতে সমর্পণ করুক (মন্নি সর্ব্বাণি সংন্যস্যাধ্যাত্মচেতসা)। তাঁতেই তার মোক্ষ। গীতার চতুর্থ অধ্যায়ে এই ‘আমির’ যে পরিচয় পাওয়া যায়, তা এই, –
‘বহুনি মে ব্যতীতানি জন্মানি তব চার্জ্জুন। তান্যহং বেদ সর্ব্বাণি ন ত্বং বেত্থ পরন্তপ।
অজোহপি সন্নব্যয়াত্মা ভূতানামীশ্বরোহপি সন্‌। প্রকৃতিং স্বামধিষ্ঠায় সম্ভবাম্যাত্মমায়য়া।’
এখানে বলা হল, অর্জুনের অনেক জন্ম; কিন্তু অর্জুন তা জানেন না (কারণ অবিদ্যার দ্বারা তিনি আচ্ছন্ন আছেন)। আমারও অনেক জন্ম, অথচ আমি তা অবগত আছি (কারণ আমি অবিদ্যাচ্ছন্ন নই)। আমি অজ অর্থাৎ আমার জন্ম নেই; আমি অব্যয় অর্থাৎ আমার বিনাশ নেই; আমি ভূতগণের ঈশ্বর অর্থাৎ আমার কর্ম নেই; কিন্তু শুদ্ধ সত্ত্ব প্রকৃতিতে অধিষ্ঠান করে, আমি আবার মায়াবশতঃ জন্মগ্রহণ করি।’ এর পরেই আবার বলে হয়ছে, যে জন আসক্তি ভয় ও ক্রোধ শূন্য হয়ে মদ্গতচিত্ত্ব আমাকে আশ্রয় করে, সে জন আত্মজ্ঞান লাভে স্বধর্মাচরণে প্রবৃত্ত হয়ে মাৎসাযুজ্য প্রাপ্ত হয়। এরপর পঞ্চম অধ্যায়ে যজ্ঞ ও তপস্যার কথায় ‘আমাকে’ যজ্ঞভোক্তা সর্বলোক মহেশ্বর ও সর্বজীবের উপকারক বলে নির্দেশ করা হয়েছে। ষষ্ঠ অধ্যায়ে, সর্বভূতে আমার অবস্থান এবং যে আমাকে সর্বভূতে দেখতে পায়, সেই মুক্তি লাভ করে,- এভাবে ‘আমার’ পরিচয় দেওয়া হয়েছে। সপ্তম অধ্যায়ে, ‘আমার’ যে পরিচয় আছে তাতে বলা হয়েছে,- ‘ক্ষিত্যপতেজঃমরুৎব্যোম মনোবুদ্ধি অহঙ্কার আমার এই অষ্টবিধা প্রকৃতি; ঐ প্রকৃতি অপরা অর্থাৎ নিকৃষ্টা, উহা ব্যতীত আমার এক শ্রেষ্ঠ প্রকৃতি আছে, তা জীবভূতা অর্থাৎ চৈতন্যময়ী। সেই চৈতন্যময়ী প্রকৃতিই জগৎকে ধারণ করে আছেন। ঐ দুই প্রকৃতি হতে ভূতগণ উৎপন্ন; ঐ প্রকৃতির সহিত আমি জগতের উৎপত্তির এবং লয়ের নিদান।’ এই কথা বলে শ্রীকৃষ্ণ আর এক গূঢ় তত্ত্ব ব্যক্ত করেছেন। প্রকৃতি সংযুক্ত সুতরাং বিকৃতি মধ্যস্থিত এই ‘আমির’ ঊপরেও যে আর এক ‘আমি আছে, যেন তাহাই তাঁর লক্ষ্য। এই উপলক্ষেই তিনি বলছেন,-
‘মত্তঃ পরতরং নান্যৎ কিঞ্চিদস্তি ধনঞ্জয়।
ময়ি সর্ব্বমিদং প্রোতং সূত্রে মণিগণা ইব॥
রসোঽহমপ্সু কৌন্তেয় প্রভাস্মি শশিসূর্য্যয়োঃ।
প্রণবঃ সর্ব্ববেদেষু শব্দঃ খে পৌরুষং নৃষু॥
পুণ্যো গন্ধঃ পৃথিব্যাঞ্চ তেজশ্চাস্মি বিভাবসৌ।
জীবনং সর্ব্বভূতেষু তপশ্চাস্মি তপস্বিষু॥
বীজং মাং সর্ব্বভূতানাং বিদ্ধি পার্থ সনাতনম্।
বুদ্ধির্বুদ্ধিমতামস্মি তেজস্তেজস্বিনামহম্॥
বলং বলবতাং চাহং কামরাগবিবর্জ্জিতম্।
ধর্ম্মাবিরুদ্ধো ভূতেষু কামোঽস্মি ভরতর্ষভ॥ (৭/৭-১১)
অর্থাৎ, ‘আমি ভিন্ন সৃষ্টি সংহারের আর কোনও কারণ নেই; সূত্রে মণিগণের ন্যায় জগৎ আমাতে গ্রথিত রয়েছে। আমি জলে রস, চন্দ্র-সূর্য্যে প্রভা, সর্ব্ববেদে প্রণব, আকাশে শব্দ, নরগণের মধ্যে পৌরুষ, পৃথিবীতে পবিত্র গন্ধ, অগ্নিতে তেজ, সর্বভূতে জীবন এবং তপস্বিদের তপ; আমাকে সনাতন ও সর্বভূতের বীজ বলে জানবে; আমি বুদ্ধিমানদের বুদ্ধি ও তেজস্বীদের তেজ। আমি বলবানদের কাম-রাগ-বিবর্জিত বল এবং ভূতগণের মধ্যে ধর্মের অবিরোধী যে কামনা আছে, তা ও আমি।’ আরও ‘যে কোনও প্রকার সাত্ত্বিক, রাজসিক ও তামসিক ভাব আছে, তার সমস্তই আমা হতে বিকশিত; অথচ, আমি তাদের অধীন নই, কিন্তু তার সমস্তই আমা অধীন। সমগ্র জগৎ ত্রিবিধ গুণময় ভাবে মোহিত থাক্য, মূলতত্ত্ব বুঝতে পারে না, এবং আমি যে সমস্ত পদার্থের অতীত, উৎপত্তি-বিনাশ আদি-রহিত, তাহাও জানতে পারে না। আমার সত্ত্বাদি ত্রিগুণময়ী দৈবী মায়া অতিশয় দুস্তরা। যারা আমাকে প্রাপ্ত হয় বা ভজনা করে, তারাই এই মায়া হতে উত্তীর্ণ হতে পারে।’ এই বলে ‘আমার’ পরিচয় দিয়ে, কোন প্রকার লোক কিভাবে মায়া পারাবার হতে উত্তীর্ণ হয়ে ‘আমাকে’ লাভ করতে সমর্থ হয়, তার বিবরণ বিবৃত আছে। পরিশেষে উপসংহারে বলা হয়েছে,- ‘বহুনাং জন্মনামন্তে জ্ঞানবান মাং প্রপদ্যতে। বাসুদেবঃ সর্ব্বমিতি স মহাত্মা সুদুর্ল্লভঃ।’ অর্থাৎ, ‘(কর্মের পর কর্মের দ্বারা) অনেক জন্মের শেষে, জ্ঞানবান হয়ে, এই ব্রহ্মাণ্ডই বাসুদেব এই প্রকার সর্বত্র আত্ম দৃষ্টিতে আমাকে প্রাপ্ত হয়।’ সপ্তম অধ্যায়ে এই যে ‘আমার’ বিবরণ বিবৃত হয়েছে, এখানে ভগবানের স্বরূপ-তত্ত্ব উপলব্ধি উপলক্ষে নানা বিতর্ক-বিবাদ উপস্থিত হয়। এখানে সাংখ্য মত, কি মীমাংসকদের মত, কি বেদান্তমত আলোচিত হয়েছে,-বিতর্ক সেই বিষয়েই উঠে থাকে। ভাষ্যকারদের মধ্যে যিনি যে সম্প্রদায়ভুক্ত, তিনি সেই সম্প্রদায়ের উপযোগী ব্যাখ্যাই করে গেছেন। এই অধ্যায়ে শ্রীভগবান যখন নিজের অষ্ট প্রকৃতির পরিচয় দিলেন, তখন সাংখ্যমত ব্যক্ত হল বলে বুঝা গেল। এক প্রকৃতি অপরা অর্থাৎ জড়, এবং অন্য প্রকৃতি পরা অর্থাৎ চৈতন্যময়ী; আর তাদের মধ্যে ‘অহং’ বা ‘পুরুষ’-উৎপত্তি সংহার কর্তা। () আমি ভিন্ন সৃষ্টি সংহারের কারণান্তর নেই; সূত্রে মণিগণের ন্যায় জগৎ-সংসার আমাতেই গাঁথা রয়েছে। এটি সাংখ্যে উক্ত প্রকৃতি-পুরুষ ভাবদ্যোতক বটে; তবে এখানে একটা বড় সূক্ষ্ম ভাব মনে আসে। প্রকৃতি-পুরুষের উপর মিলনকর্তা যে আর একজন আছেন, এই উপমায় আমরা তা বেশ বুঝতে পারি। প্রকৃতি ও পুরুষ উভয়েই নিষ্ক্রিয়; কিন্তু উভয়ের মিলন জনিত সৃষ্টি বা সংসার। অনুধাবন করে দেখুন দেখি, মিলন হয় কিভাবে ? যারা নিষ্ক্রিয় সুতরাং নিশ্চল, একজন তাদের মিলন-কর্তা না থাকলে, তাদের মিলন হয় কিভাবে ? সুতরাং স্বীকার করতে হয়, পুরুষের উপর পুরুষোত্তম আর একজন আছেন। এই ‘সূত্রেমণিগণাইব’ উপমায় তার ইঙ্গিত পাই। গীতার ব্যাখ্যা বিশ্লেষণে তার চরম স্ফুর্ত্তি পরিদৃষ্ট হয়। গীতায় ভিন্ন ভিন্ন স্থানে এই ‘আমার’ একটু অনুসন্ধান করে দেখা যাক।
(১) শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার নবম অধ্যায়ে (৪র্থ-৫ম শ্লোকে), যথা-
ময়া ততমিদং সর্বং জগদব্যক্তমূর্তিনা। মৎস্থানি সর্বভূতানি ন চাহং তেষ্ববস্থিতঃ॥
ন চ মৎস্থানি ভূতানি পশ্য মে যোগমৈশ্বরম্। ভূতভৃন্ন চ ভূতস্থো মমাত্মা ভূতভাবনঃ॥

(২) দশম অধ্যায়ে (২০-৪২ শ্লোক), যথা-
অহমাত্মা গুড়াকেশ সর্বভূতাশয়স্থিতঃ। অহমাদিশ্চ মধ্যং চ ভূতানামন্ত এব চ॥২০
আদিত্যানামহং বিষ্ণুর্জ্যোতিষাং রবিংশুমান্। মরীচির্মরুতামস্মি নক্ষত্রাণামহং শশী॥২১
বেদানাং সামবেদোহস্মি দেবানামস্মি বাসবঃ। ইন্দ্রিয়াণাং মনশ্চাস্মি ভূতানামস্মি চেতনা॥২২
রুদ্রাণাং শঙ্করশ্চাস্মি বিত্তেশো যক্ষরক্ষসাম্। বসূনাং পাবকশ্চাস্মি মেরুঃ শিখরিণামহম্॥২৩
পুরোধসাং চ মুখ্যং মাং বিদ্ধি পার্থ বৃহস্পতিম্। সেনানীনামহং স্কন্দঃ সরসামস্মি সাগরঃ॥২৪
মহর্ষীণাং ভৃগুরহং গিরামস্ম্যেকমক্ষরম্। যজ্ঞানাং জপযজ্ঞোহস্মি স্থাবরাণাং হিমালয়ঃ॥২৫
অশ্বথঃ সর্ববৃক্ষাণাং দেবর্ষীণাং চ নারদঃ। গন্ধর্বাণাং চিত্ররথঃ সিদ্ধানাং কপিলো মুনিঃ॥২৬
উচ্চৈঃশ্রবসমশ্বানাং বিদ্ধি মামমৃতোদ্ ভবম্। ঐরাবতং গজেন্দ্রাণাং নরাণাং চ নরাধিপম্॥২৭
আয়ুধানামহং বজ্রং ধেনূনামস্মি কামধুক্। প্রজনশ্চাস্মি কন্দর্পঃ সর্পাণামস্মি বাসুকীঃ॥২৮
অনন্তশ্চাস্মি নাগানাং বরুণো যাদসামহম্। পিতৃণামর্যমা চাস্মি যমঃ সংযমতামহম্॥২৯
প্রহ্লাদশ্চাস্মি দৈত্যানাং কালঃ কলয়তামহম্। মৃগাণাং চ মৃগেন্দ্রোহহং বৈনতেয়শ্চ পক্ষিণাম্॥৩০
পবনঃ পবতামস্মি রামঃ শস্ত্রভৃতামহম্। ঝষাণাং মকরশ্চাস্মি স্রোতসামস্মি জাহ্নবী॥৩১
সর্গাণামাদিরন্তশ্চ মধ্যং চৈবাহমর্জুন। আধ্যাত্মবিদ্যা বিদ্যানাং বাদঃ প্রবদতামহম্॥৩২
অক্ষরাণামকারোহস্মি দ্বন্দ্বঃ সামাসিকস্য চ। অহমেবাক্ষয়ঃ কালো ধাতাহং বিশ্বতোমুখঃ॥৩৩
মৃত্যুঃ সর্বহরশ্চাহমুদ্ভবশ্চ ভবিষ্যতাম্। কীর্তিঃ শ্রীর্বাক্ চ নারীণাং স্মৃতির্মেধা ধৃতিঃ ক্ষমা॥৩৪
বৃহৎসাম তথা সাম্নাং গায়ত্রী ছন্দসামহম্। মাসানাং মার্গশীর্ষোহহ্ মৃতূনাং কুসুমাকরঃ॥৩৫
দ্যুতং ছলয়তামস্মি তেজস্তেজস্বিনামহম্। জয়োহস্মি ব্যবসায়োহস্মি সত্ত্বং সত্ত্ববতামহম্॥৩৬
বৃঞ্চীনাং বাসুদেবোহস্মি পাণ্ডবানাং ধনঞ্জয়ঃ। মুনীনামপ্যহং ব্যাসঃ কবীনামুশনাঃ কবিঃ॥৩৭
দণ্ডো দময়তামস্মি নীতিরস্মি জিগীষতাম্। মৌনং চৈবাস্মি গুহ্যানাং জ্ঞানং জ্ঞানবতামহম্॥৩৮
যচ্চাপি সর্বভূতানাং বীজং তদহমর্জুন। ন তদস্তি বিনা যৎ স্যান্ময়া ভূতং চরাচরম্॥৩৯
নান্তোহস্তি মম দিব্যানাং ,বিভূতীনাং পরন্তপ। এষ তূদ্দেশতঃ প্রোক্তো বিভূতের্বিস্তরো ময়া॥৪০
যদ্ যদ্বিভূতীমৎ সত্ত্বং শ্রীমদূর্জিতমেব বা। তত্তদেবাবগচ্ছ ত্বং মম তেজোহংশসম্ভবম্॥৪১
অথবা বহুনৈতেন কিং জ্ঞাতেন তবার্জুন। বিষ্টভ্যাহমিদং কৃৎস্নমেকাংশেন স্থিতো জগৎ॥৪২

রূপকের আবরণে আবৃত থাকায়, পূর্বোক্ত শ্লোক সমূহের সেই অহং-তত্ত্ব সম্যক হৃদগম্য না হলেও, মানুষ এই ‘অহং’ অর্থের অনুশীলনে বড় একটা উচ্চ শিক্ষা পেতে পারে, বড় একটা উচ্চ আদর্শ দেখতে পায়। সকলের শ্রেষ্ঠ স্থান অধিকার করতে হবে, আর সেই শ্রেষ্ঠ স্থানই আমি। এখানে সেই পরিচয়ই শ্রীহরি প্রদান করেছেন। পঞ্চদশ অধ্যায়ে এ ভাব বিশদভাবে দেখতে পাই। সেখানে ‘আমার’ পরিচয় এরকম-
যদাদিত্যগতং তেজো জগদ্ ভাসয়েতেহখিলম্। যচ্চন্দ্রমসি যচ্চাগ্নৌ তত্তেজো বিদ্ধি মামকম্॥১২
গামাবিশ্য চ ভূতানি ধারয়াম্যহমোজসা। পুষ্ণামি চৌষধীঃ সর্বাঃ সোমো ভূত্বা রসাত্মকঃ॥১৩
অহং বৈশ্বানরো ভূত্বা প্রাণিনাং দেহমাশ্রিতঃ। প্রাণাপানসমাযুক্তঃ পচাম্যন্নং চতুর্বিধম্॥১৪
সর্বস্য চাহং হৃদি সন্নিবিষ্টো মত্তঃ স্মৃতির্জ্ঞানমপোহনং চ।
বেদৈশ্চ সর্বৈরহমেব বেদ্যো বেদান্তকৃদ্ বেদবিদেব চাহম্॥১৫
দ্বাবিমৌ পুরুষৌ লোকে ক্ষরশ্চাক্ষর এব চ। ক্ষরঃ সর্বাণি ভূতানি কুটস্থোহক্ষর উচ্যতে॥১৬
উত্তমঃ পুরুষস্ত্বন্যঃ পরমাত্মেত্যুদাহৃত। যো লোকত্রয়মাবিশ্য বিভর্ত্যব্যয় ঈশ্বরঃ॥১৭
যস্মাৎ ক্ষরমতীতোহহমক্ষরাদপি চোত্তমঃ। অতোহস্মি লোকে বেদে চ প্রথিতঃ পুরুষোত্তমঃ॥১৮

পূর্বে বলা হয়েছিল, প্রকৃতি দ্বিবিধা- পরা ও অপরা। এখানে বলা হল- পুরুষ ও দ্বিবিধ;-ক্ষর ও অক্ষর। অধিকন্তু বলা হল, সকলের উপর আর এক পুরুষ আছেন, তিনি ‘উত্তম পুরুষ’। তিনি চৈতন্যস্বরূপ, তিনি নিত্যশুদ্ধবুদ্ধমুক্তস্বভাব পরমাত্মা নামে অভিহিত। সুতরাং, বুঝে দেখুন সূত্রে গ্রথিত মণিদের ন্যায় এই জগৎ যে অবস্থিত, তার লক্ষ্য কোথায়- কত দূরে- কোন ‘আমার’ প্রতি ? ‘সূত্রে মণিগণাইব’ উপমায় পণ্ডিতেরা সাধারণতঃ সাংখ্যমতের অনুসরণে পুরুষ-সংযোগে প্রকৃতির বিকৃতি এবং অদ্বৈতবাদিদের মায়োপহিত ব্রহ্মকে লক্ষ্য করে থাকেন। কিন্তু সূক্ষ্ম ভাবে বিচার করলে এখানে মিলনের উপর মিলন কর্তার ভাবই মনে আসে। এ উদাহরণ- বিকৃতির উদাহরণ নয়। যদি উপমায় বলতেন- গাছে যেমন পাতা ফুল ফল, তাহলে প্রোক্ত অর্থ সূচিত হলেও হতে পারত। কিন্তু সূত্র ও মণির মিলনকর্তা অর্থাৎ পুরুষের কথাই বলে হয়েছে বুঝতে হয়। সূত্র স্বতন্ত্র, মণি স্বতন্ত্র, উভয়ই নিষ্ক্রিয়। আমি যদি তাদের মিলন করে না দেই, মিলন হবে কি প্রকারে ? সুতরাং ঐ উপমার প্রভাবে সূখমদর্শীর লক্ষ্য-সকলের অতীত বিশেষণ-বিরহিত সেই ‘আমার’ প্রতি আকর্ষণ করেছে। গীতার মূলে সেই ‘আমিই’ পরিদৃশ্যমান। যখন জ্ঞানীর মধ্যে কোন জ্ঞানী শ্রেষ্ঠ, তার মীমাংসার আবশ্যক হল, যখন ভক্তের মধ্যে কোন ভক্ত শ্রেষ্ঠ, তা নির্দেশ করার প্রয়োজন আসল, তখন শ্রীভগবান কি বললেন,- ‘বহুনাং জন্মনামন্তে জ্ঞানবান্‌ মাং প্রপদ্যতে। বাসুদেবঃ সর্ব্বমিতি স মহাত্মা সুদুর্ল্লভঃ॥’
বলেছি তো, এই শ্লোকের অর্থ নিয়ে কতই বিবাদ চলেছে! বৈষ্ণব বলছেন-সেই নন্দনন্দন বাসুদেব শ্রীকৃষ্ণের প্রসঙ্গই এখানে উত্থাপিত, সেই পীতধড়া মোহনচূরা বনমালী বংশীধারী, পটে হোক প্রতিমায় হোক, তাঁর উপাসনার বিষয় এখানে উপদিষ্ট। দ্বৈতবাদিদের (বিশিষ্টদ্বৈতবাদিদের) সেই ব্যাখ্যারই অনুসরণে শ্রীকৃষ্ণ মুর্তির ধান ধারণায় নিবিষ্ট চিত্ত। কিন্তু অদ্বৈতবাদিদের বাসুদেব শব্দ সত্ত্বেও অন্যরকম ব্যাখ্যায় অন্যরকম অর্থ নির্দেশ করছেন। তাঁদের পক্ষের প্রমাণ- ‘অব্যক্তং ব্যক্তিমাপন্নং মন্যন্তে মামবুদ্ধয়ঃ। পরং ভাবমজানন্তো মমাব্যয়মনুত্তমম্‌॥ অর্থাৎ, কেমন ভক্ত আমাকে প্রাপ্ত হয়,- এই উপদেশ দান কালে শ্রীভগবান যখন বললেন, ‘অল্পবুদ্ধি লোকেরা আমার অব্যয়, সর্বোত্তম স্বরূপ তত্ত্ব জানতে না পেরে ময়াতীত আমাকে ব্যক্তিভাবে (মনুষ্যাদিরূপে) ভজনা করে থাকে, তখন অদ্বৈতবাদিগণ, বিগ্রহ মুর্তি ত্যাগ করে, প্রতীকোপাসনার বিষয় বিস্মৃত হয়ে, জ্ঞান-স্বরূপ অহং এর সন্ধানে প্রবৃত্ত হলেন। ফলতঃ বেদান্তের সর্ববিধ ব্যাখ্যাই যে গীতায় ভগবদ্বাক্যের অন্তর্ভূত হয়ে আছে, ঐ একটি শ্লোকের ব্যাখ্যায়ই তা প্রতিপন্ন হয়। সুতরাং গীতার ভগবদুক্তি-সমূহ যিনি যে চোখে দেখবেন, তার মধ্যে তিনি সেই ভাবই লাভ করবেন। তাই শঙ্করাচার্য্যাদির ভাষ্য একরকম অর্থ নির্ণয় করেছে; রামানুজাচার্য্যাদির ভাষ্যে অন্যরকম অর্থ নির্দিষ্ট হচ্ছে।

অহং-কর্তা।
ব্রহ্মের নাম বিশেষণের সম্বন্ধ সম্পর্ক বিভিন্ন দার্শনিক সম্প্রদায়ের সাথে গীতার সম্বন্ধ সম্পর্ক সূচিত হয়। ‘ব্রহ্ম’বাচক শব্দ সমূহের গীতায় যে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ দেখতে পাওয়া যায়, অনুসন্ধিৎসু গণ তাঁতেই সকল দর্শনের সার সম্পদ দেখতে পান। ব্রহ্ম, পুরুষ, ক্ষেত্রজ্ঞ, অহং প্রভৃতির প্রসঙ্গে সে পরিচয় আমরা সংক্ষেপে সামান্যমাত্র তুলে ধরেছি। এখানে আর একটি নাম বিশেষণের আলোচনায় ঐ প্রসঙ্গের উপসংহারের চেষ্টা পেয়েছি। সে নাম-কর্তা। সাত্ত্বিক, রাজস ও তামস ভেদে সে কর্তা যে কেমন কর্তা, তা আংশিক বুঝতে পেরেছি।* এখন সেই কর্তাকে একটু বিশেষভাবে বুঝার চেষ্টা করা যাক। বেদান্ত মতে পাঁচটি কারণ দিয়ে কর্ম ফল উৎপন্ন হয়। সেই পাঁচটি কারণ- (১) অধিষ্ঠান অর্থাৎ শরীর, (২) কর্তা অর্থাৎ উপাধি-লক্ষণ-ভোক্তা- দেহ-মন-ইন্দ্রিয় আদির সাথে অভিন্ন ভাবাপন্ন আত্মা, (৩) করণ অর্থাৎ চোখ-কান আদি ইন্দ্রিয় গণ ও মনো-বুদ্ধি প্রভৃতি, (৪) বিভিন্ন রকম চেষ্টা, (৫) দৈব অর্থাৎ পূর্ব-জন্মের অর্জিত কর্ম-অদৃষ্ট-অনুগ্রাহক দেবতা-জাত শরীর, বাক্য ও মন দিয়ে মানুষ যে কোনও ধর্ম বা অধর্ম কর্ম করে, সে সকল কর্মেরই এই পাঁচটি কারণ নির্দিষ্ট হয়। গীতায় শ্রীভগবান বলছেন, – ‘এই কারণ পঞ্চক দ্বারা নিষ্পাদ্য-মান কাজে যে ব্যক্তি অবিবেক বশতঃ নিত্য-শুদ্ধ-বুদ্ধ-মুক্ত স্বভাব ক্রিয়া-গুণ-বিরহিত চিৎ-স্বরূপ আত্মাকে কর্তা বলে মনে করে, সে দুর্মতি সম্যক দর্শনের অক্ষমতা হেতু কর্ম ফল ভোগে বাধ্য হয়। কিন্তু ‘আমি এই কর্ম করলাম’- এ ভাব যার নেই, যার বুদ্ধি কর্মে লিপ্ত নয়, সে ব্যক্তি কখনই কর্ম-ফল জনিত বন্ধনে (হনন করেও প্রত্যবায়ভাগী) বদ্ধ হন না।’ গীতার এই ব্যাখ্যায় ‘কর্তার’ উপরে এক অচিন্ত্য অব্যক্ত চিৎস্বরূপকে লক্ষ্য করা হয়েছে। পূর্বে যেমন দেখিয়েছি, পুরুষ-পর, অপর, উত্তম, পূর্বে যেমন মনে জেগেছে, সূত্রে ‘মণিগণাইব’ দৃষ্টান্ত, পুরুষ প্রকৃতি ও তাঁদের মিলন কর্তার অব্যক্ত স্মৃতি; এখানেও সেই ভাব- সেই দ্যোতনা। অদ্বৈতবাদী এখানে জীবে ও ব্রহ্মে একত্ব দেখতে পান; দ্বৈতবাদী এখানে সেই একত্বের মধ্যে একটু বিশেষত্ব নির্দেশ করেন। অদ্বৈতবাদীর ব্রহ্ম-সাফরে কর্তা কর্ম করণ অধিষ্ঠান দৈব সব এক হয়ে মিশে গেছে, তাঁদের সকল’ই ব্রহ্মাস্মি; কিন্তু দ্বৈতবাদী গণ দেখছেন-সেই মহা-মিলনের মহোদধি-কোলে ওঁকার-রূপী নারায়ণ অনন্ত শয্যায় শায়িত রয়েছেন; তাঁদের কর্তা ব্রহ্মাংশ বটে; কিন্তু ব্রহ্ম নন। বেদান্ত-বেদ্য ব্রহ্মের বিভূতি যে ঐ ‘কর্তার’ অঙ্গে দ্যুতিমান, গীতা পাঠক বা গীতার ব্যাখ্যাকারী সাধারণ্যের দৃষ্টি তার প্রতি কখনো পড়েছে, দেখতে পাই। প্রধানতঃ অনেকেই ঐ কর্তার সাথে যে সেই বিশ্বপাতা বিশ্বেশ্বরের সম্বন্ধ সূচিত হতে পারে, তা মনেই স্থান দেন না। তাঁদের মতে উহা সাধারণ ভাবে মানুষের কর্ম সম্বন্ধে প্রযুক্ত হয়েছে, এটাই সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু একটু অভিনিবেশ সহকারে আলোচনা করলে বুজতে পারি,- জ্ঞান জ্ঞেয় পরিজ্ঞাতা ও যা, করণ কর্ম কর্তা ও তাহাই;- ‘জ্ঞানং জ্ঞেয়ং পরিজ্ঞাতা ত্রিবিধা কর্মচোদনা। করণং কর্ম কর্ত্তেতি ত্রিবিধঃ কর্ম্মসংগ্রহঃ।’ এই শ্লোকের অন্তর্গত ‘কর্ম্মচোদনা’ ও ‘কর্ম্মসংগ্রহ’ শব্দ দুইটির অর্থ নিয়ে তর্ক চলছে, আর তার জন্যই অর্থ উৎপত্তির পক্ষে মতান্তর ঘটে আসছে। কিন্তু মূলতঃ ঐ দুই শব্দের অর্থ অভিন্ন; ‘চোদনাসংগ্রহ শব্দয়োরৈক্যার্থঃ।’ তাতে বুঝতে পারি, যা করণ, তাই জ্ঞান; যা কর্ম, তাই জ্ঞেয়, যিনি কর্তা, তিনিই জ্ঞাতা। করণ-সাধনভূত দ্রব্য আদি, কর্ম-যাগ আদি, কর্তা-অনুষ্ঠাতা; ‘করণং সাধনভূতং দ্রব্যাদিকং কর্ম্মযাগাদি কর্ত্তানুষ্ঠাতেতি।’ এখানে মীমাংসক গণের যজ্ঞানুষ্ঠান ও তা থেকে উত্পন্ন অপবর্গ প্রাপ্তির ভাব মনে আসতে পারে। তার পর, এই কর্তার সাথে বেদান্ত-বেদ্য জীব বা ব্রহ্মের কেমন সম্বন্ধ কিভাবে প্রতিষ্ঠিত আছে, অনুসন্ধান করে দেখা যাক। কর্তা শব্দ অহংকার ভাব জ্ঞাপক; শুদ্ধ-সত্ত্ব-চিৎ স্বরূপ ব্রহ্মে কর্তৃত্ব বা অহংকার থাকতে পারে না। এই হেতু-বাদ, এই কর্তার সাথে বেদান্ত-বেদ্য ব্রহ্মের যে কোনও সম্বন্ধ নেই, এটাই সাধারণতঃ সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু কর্তাও যা, জীবও তাহাই নয় কি ? পরম পুরুষের পরিচয়ে শ্রুতি (প্রশ্নোপনিষৎ, ৪র্থ ৯) বলেছেন, ‘এষ হি দ্রষ্টা স্প্রষ্টা শ্রোতা ঘ্রাতা রসয়ীতা মন্তা বোদ্ধা কর্তা বিজ্ঞানাত্মা পুরুষঃ। স পরেহক্ষরে আত্মনি সম্প্রতিষ্ঠতে।’ পরমব্রহ্ম যে কর্তা দ্রষ্টা বোদ্ধা শ্রোতা স্প্রষ্টা, তা বেশ উপলব্ধি হল। এই যে বলেছি, ব্রহ্মের দুই ভাব; এ ভাব তার অন্তর্গত সবিশেষ বা সগুণ ভাব। অতএব বুঝা গেল, কর্তাই জীব, জীবই ব্রহ্ম, এখানে এ ভাব আসতে পারে। ‘জ্ঞোহত এব’ বেদান্ত সূত্রেও, জ্ঞানস্বরূপ হয়েও জীব যে জ্ঞাতৃস্বরূপ হন, এই সিদ্ধান্ত হয়ে থাকে, ‘জ্ঞ এবাত্মা জ্ঞানস্বরূপত্বে সতি জ্ঞাতৃস্বরূপ এব।’ বাদরায়ণ সূত্রান্তরে জীবও কর্তার অভিন্নত্ব স্বীকার করে গেছেন; যথা- ‘কর্তা শাস্ত্রার্থবত্ত্বাৎ।’ অর্থাৎ, ‘শাস্ত্রার্থবত্ত্ব-প্রযুক্ত জীবকে কর্তা বলাই যুক্ত হয়েছে।’ জীবের কর্তৃত্ব সম্বন্ধে এইরকম বহুল প্রমাণ প্রয়োগ করা যেতে পারে। এখানে বেদান্ত একটি বিতর্ক উপস্থিত করেছেন। সে বিতর্ক- “জীবের ঐ কর্তৃত্ব স্বায়ত্ত কি পরায়ত্ত ? এইরকম সংশয়ে- ‘স্বৰ্গকামনায় যজ্ঞ করবে’, ‘ব্রাহ্মণ সুরাপান করবে না’, ইত্যাদি বিধি-নিষেধ শাস্ত্র হতে তাঁর কর্তৃত্ব স্বায়ত্ত বলেই বোধ হয়। যিনি নিজ ইচ্ছানুসারে কাজে প্রবৃত্ত ও তা হতে নিবৃত্ত হতে পারেন, তাকেই কর্মে নিয়োগ করতে দেখা যায়। এই প্রকার পূর্বপক্ষ স্থির হয়। তার উত্তরে বেদান্ত বলছেন,- ‘পরাৎ তু তচ্ছ্রতেঃ,’ অর্থাৎ, ‘শ্রুতি-প্রমাণ-সদ্ভাব হেতু জীবের কর্তৃত্ব পরায়ত্তই জানতে হবে।’ তু শব্দ শঙ্কাচ্ছেদের নিমিত্ত। জীবের কর্তৃত্ব পরমেশ্বর আয়ত্ত। কারণ, পরমেশ্বরই জীবগণের অন্তরে প্রবিষ্ট হয়ে, তাদেরকে কর্মে নিযুক্ত করেন;–ইত্যাদি শ্রুতিবাক্য সকল ওইরকম নির্দেশ করে থাকেন। পুনর্বার আশঙ্কা করছেন যে, জীবের কর্তৃত্ব যদি পরমেশ্বরের আয়ত্তাধীন হয়, তাহলে বিধি নিষেধ শাস্ত্র ব্যর্থ হয়ে পড়ে। কারণ, নিজ ইচ্ছা অনুসারে প্রবৃত্তি নিবৃত্তি সমর্থ ব্যক্তির পক্ষেই শাস্ত্রের শাসন লক্ষ্য করা যায়। এইরকম আশঙ্কার নিরাসার্থে বলছেন,- ‘কৃতপ্রযত্নাপেক্ষস্তু বিহিতপ্রতিষিদ্ধা বৈয়র্থ্যাদিভ্যঃ।’ অর্থাৎ, জীবের কর্তৃত্ব স্বাধীন না হলেও পরমেশ্বরের অধীনেই জীবের কর্তৃত্ব স্বীকার করতে হয়। তু শব্দ শঙ্কার নিরাসার্থ। জীব কৃত ধর্মাধর্ম-লক্ষণ প্রযন্ত অপেক্ষা করেই পরমেশ্বর তাদেরকে কর্মে প্রবৃত্ত করে থাকেন। অতএব উক্ত দোষের অবতারণা হচ্ছে না। পরমেশ্বর মেঘের ন্যায় নিমিত্ত মাত্র হয়ে, জীব গণকে ধর্মাধর্ম-সমুত্থ বৈষম্যবশতঃ বিষম ফল প্রদান করেন। মেঘ যেমন অসাধারণ স্বীয় বীজ হতে উৎপন্ন তরুলতা আদির কারণ হয়, মেঘ না থাকলে উহাদের রস পুষ্পাদির বৈষম্য সম্ভব হয় না এবং বীজ না থাকলেও উহারা উৎপন্ন হতে পারে না -তেমনি পরমেশ্বর ও জীব কৃত কর্ম অনুসারেই নিমিত্ত স্বরূপে তাদেরকে ফল প্রদান করে থাকেন। জীবরূপ কর্তাও পরমেশ্বর-প্রেরিত হয়ে কাজ করছেন বলেই, তাহার কর্তৃত্ব নিবারিত হল না| এরকম ঘটনা কেন হয় ? –বিধিনিষেধের অবৈয়র্থ্যাদি বশতই এইরকম হয়ে থাকে। এতে বিধি-শাস্ত্র বা নিষেধ-শাস্ত্র ব্যর্থ হচ্ছে না। পরমেশ্বর যদি বিধিতে বা নিষেধে কাঠ-পাথর আদির ন্যায় জীবকে নিযুক্ত করেন, তাহলে ঐ সকল শাস্ত্রের প্রামাণ্যের হানি হয়; নিয়োজ্য কর্তারও কৃতিত্ব থাকা চাই। উন্নতির জন্য সৎকর্মে প্রবর্তনের নাম অনুগ্রহ এবং অবনতির নিমিত্ত অসৎকর্মে প্রবর্তনের নাম নিগ্রহ। পরমেশ্বরের নিমিত্ত-কর্তৃত্বে উহা সম্ভব হয়; অন্যথা উহা সম্ভব হয় না এবং বৈষম্য আদি দোষেরও পরিহার হয় না। অতএব জীব প্রযোজ্য-কর্তা এবং পরমেশ্বর হেতু-কর্তা ও প্রযোজক-কর্তা। পরমেশ্বরের অনুমোদন ব্যতিরেকে জীবের কর্তৃত্ব সম্ভব হয় না।”
এমন বিচারের উপসংহারে প্রতিপন্ন হয়, ‘অংশুমানের অংশুর ন্যায় জীব পরমেশ্বরেরও অংশ। জীব ব্রহ্ম হতে ভিন্ন হয়েও তৎসম্বন্ধাপেক্ষী।’ এই ব্রহ্মের স্বরূপ তত্ত্ব উপনিষৎ যেমন কীর্তন করছেন, তার দৃষ্টান্ত; (শ্বেতাশ্বতর উপনিষৎ ১ম ১৫) যথা,-
তিলেষু তৈলং দধনীব সর্পি-রাপঃ স্রোতঃস্বর্ণীষু চাগ্নিঃ।
এবমাত্মনি গৃহ্যতেহসৌ সত্যেনৈনং তপসা যোহনুপশ্যতি॥’
পুঙ্খানুপুঙ্খ আলোচনায় গীতারও মূল বাণী এই দেখতে পাই। পুরুষ আছেন, ক্ষেত্রজ্ঞ আছেন, ব্রহ্ম আছেন, কর্তা আছেন,- সকলের উপর আছেন- ‘অহং’। সাত্ত্বিক, রাজস ও তামস ভেদে গীতায় যে ত্রিবিধ কর্তার বিষয় উত্থাপিত, সে কর্তা-ত্রয়ের সাত্ত্বিক কর্তাই ‘পর’ পুরুষ বা পরা প্রকৃতি; এবং উহার অপর দুই কর্তা অপরা বা বিকৃতি। গীতায় ত্রিবিধ কর্তার উল্লেখে ‘সাত্ত্বিক’, রাজস, ‘তামস’-এই তিন স্তর বা অবস্থা প্রতীত হয়। সাত্ত্বিক অবস্থার স্তরে যিনি উপনীত, তিনি ব্রহ্ম-সাক্ষাৎকার সম্পন্ন অথবা ব্ৰহ্মভূত। তিনিই বুঝেছেন,- গীতায় কিন্তু সকল জ্ঞানের- সকল শিক্ষার সারভূত শিক্ষা প্রদত্ত হয়েছে- ‘সৰ্ব্বধৰ্ম্মান পরিত্যজ্য মামেকং শরণং ব্রজ।’ কর্তা কর্তৃত্ব সকলই এখানে কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়েছে।

গীতায় সুখ-তত্ত্ব উপলক্ষে-
সর্ববিধ দার্শনিক মতের আলোচনায়, গীতায় শ্রীভগবান সকলের অধিগম্য সুখ-তত্ত্ব বিবৃত করেছেন। তাহাই গীতার সার-সিদ্ধান্ত, তাহাই গীতার অস্থি-মজ্জা-মেরুদণ্ড, তাহাই গীতার প্রাণ-ভূত। জীব মাত্রই দুঃখ-পঙ্ক-নিমগ্ন; গীতার লক্ষ্য- তাদের সকলকেই উদ্ধার করতে হবে। যিনি অজ্ঞানের অগাধ গহ্বরে নিমজ্জিত আছেন, তাকেও উদ্ধার করতে হবে; যিনি জ্ঞান-অজ্ঞানের মধ্য-সীমায় সমতল ক্ষেত্রে দণ্ডায়মান আছেন, তাকেও পথ দেখাতে হবে; যিনি জ্ঞান-গিরিবরের উচ্চ-শিখরে আরোহণ করেছেন, তাকেও উচ্চতম সোপানে অধিষ্ঠিত করাতে হবে। অন্যান্য দার্শনিক সম্প্রদায়গণ বিশেষ বিশেষ অবস্থায় জনগণকে পথ দেখানোর প্রয়াস পেয়েছেন; কিন্তু গীতা জ্ঞানী অজ্ঞানী উচ্চ নীচ সকলেরই মুক্তির পথ সুগম করে দিয়েছেন। গীতার সেইটুকুই বিশেষত্ব। শ্রীভগবান যে সর্ব-জীবে সমান দয়াবান, গীতায় তাহাই উপলব্ধি হয়। তিনি জীবকে সম্বোধন করে বললেন,-
শ্রেয়ান্ স্বধর্মো বিগুণঃ পরধর্মাৎ স্বনুষ্ঠিতাৎ।
স্বভাবনিয়তং কর্ম কুর্বন্নাপ্নোতি কিল্বিষম্॥
সহজং কর্ম কৌন্তেয় সদোষমপি ন ত্যজেৎ।
সর্বারম্ভা হি দোষেণ ধুমেনাগ্নিরিবাবৃতাঃ॥”
অর্থাৎ, ‘স্বধর্মানুসরণই শ্রেয়, সে স্বধর্ম বিগুণ হলেও তার সার্থকতা আছে। কিন্তু উত্তমরূপে অনুষ্ঠিত হলেও পর-ধর্ম কখনই গ্রহণীয় নয়। সহজ অর্থাৎ প্রকৃতিগত কর্ম করে মানুষ কখনই পাপ-ভাগী হয় না।’ এখানে সাংখ্যমত অবলম্বীগণ আপত্তি তুলতে পারেন যে, কর্মমাত্রই মোক্ষের অন্তরায়-জন্ম-বন্ধনের হেতু-ভূত; সুতরাং যার যে ধর্ম যে কর্ম স্বভাবতঃ নির্দিষ্ট আছে, সে ধর্মে সে কর্মে তার জন্ম-বন্ধন দৃঢ় হয়ে আসে। কিন্তু তারও উত্তর শ্রীভগবান প্রদান করে বোঝালেন,- সে হিসাবে পরকীয় অ-স্বভাবজ ধর্ম-কর্মে ও দোষ আছে; যেমন আগুনেও ধুম থাকে। এ কথা বলার উদ্দেশ্য এই যে, ধূম-দোষ পরিহার করে মানুষ যেমন অগ্নির ব্যবহার করে, সেইরকম কর্মের দোষাংশ পরিত্যাগ করে গুণাংশ গ্রহণ করুক, তাতে তার স্বধর্মই শ্রেয়ঃ-সাধক হবে। ফল কথা, যে জন যে ধর্মে যে অবস্থায় আছে, সেই ধর্মে সে অবস্থায় থেকেই আত্ম উৎকর্ষ সাধনের চেষ্টা করুক,- এটাই শ্রীভগবানের প্রধান উপদেশ। পরম সুখ স্বরূপ মোক্ষলাভের জন্য উদ্বিগ্ন হয়ে একেবারে সীমালঙ্ঘনের চেষ্টা কখনই শ্ৰেয়ঃসাধক নয়; তোমার গণ্ডীর মধ্যেই তোমার মুক্তি আছে,-এটাই গীতার এক প্রধান উপদেশ। অবস্থা অনেকের অনেক রকম থাকতে পারে; সুতরাং বিভিন্ন অবস্থায় সুখের বিভিন্ন স্তরেও, মানুষের উপনীত হওয়া অসম্ভব নয়। গীতার লক্ষ্য- সকল স্তরের সকল জীবকে মোক্ষ-ক্ষেত্রে পৌঁছে দেওয়া।

সকলের অধিগত মোক্ষ-পথ প্রসঙ্গে।-
কিন্তু সকলের আয়ত্ত অধীন সে মোক্ষ-পথ কি প্রকার ? গীতার ব্যাখ্যা-বিবৃতি উপলক্ষে বিভিন্ন জন বিভিন্ন পথ নির্দেশ করে গেছেন। জ্ঞান-বাদী গণ, জ্ঞান ভিন্ন মোক্ষ-লাভ হবে না বলে, অন্যের উদ্ধারের পক্ষে হতাশ্বাস হয়েছে। ভক্তি-বাদী গণ গীতার মধ্যে ভক্তিই সার সম্পদ বলে নির্দেশ করে গেছেন। কর্ম-বাদী গণ মুক্তির পথে কর্মেরই প্রাধান্য দেখিয়েছেন।
শঙ্করাচার্য্যের মতে, গীতা শাস্ত্রের প্রধান প্রয়োজন, সহেতুক (অর্থাৎ কারণের সাথে বিদ্যমান) সংসার হতে উপরম-লক্ষণ (অর্থাৎ বৈরাগ্য -লক্ষণ) বা মুক্তি। * শঙ্কর ভাষ্যের সূচনায় প্রকাশ,- ‘প্রবৃত্তি-লক্ষণ ও নিবৃত্তি-লক্ষণ ভেদে বেদোক্ত ধর্ম দ্বিবিধ। প্রবৃত্তি লক্ষণ আক্রান্ত ধর্ম- বিষয় ভোগ অভিলাষ প্রবর্তক যাগ-যজ্ঞ আদি ক্রিয়া কর্ম, তার দ্বারা সৃষ্টি-রক্ষা ও প্রাণীদের মঙ্গল সাধন হয়। নিবৃত্তি-লক্ষণ আক্রান্ত ধর্ম-বিষয় ভোগ অভিলাষ নিবর্তক-জ্ঞানমূলক।
যাগ-যজ্ঞ আদি কর্মের অনুষ্ঠানে ভোগ অভিলাষ বৃদ্ধিতে জ্ঞান লোপ প্রাপ্ত হয়ে আসলে, শ্রীভগবান জ্ঞানতত্ত্ব-প্রচারে মোক্ষ-পথ সুগম করে দেন। গীতা সেই জ্ঞান-তত্ত্ব প্রচারের হেতু-ভূত।’
শ্রীমন্মধুসূদন সরস্বতীর টিকা তাৎপর্য আলোচনায় এই ভাব আরও একটু বিশদীকৃত। কর্ম-কাণ্ড, উপাসনা-কাণ্ড, জ্ঞান-কাণ্ড- বেদ যে ত্রিবিধ কাণ্ডে বিভক্ত, গীতার ষটক তিনটিতে তারই অবভাস। ঐ ষটক তিনটি ‘তত্ত্বমসি’ মহাবাক্য প্রতিফলিত। প্রথম ষটকে- কর্ম-ত্যাগ-প্রসঙ্গে জীবাত্মা (‘তৎ’) নির্ধারিত। তৃতীয় ষটকে- জ্ঞান প্রসঙ্গে ‘তৎ’ ও ‘ত্বং’ পদার্থের অভিন্নত্ব প্রতিপাদনে ‘ওসি’ (হও-মিলন হয়) বাক্য প্রযুক্ত। (১) ফলতঃ, এ হিসাবে জীবের ও ব্রহ্মের একত্ব জ্ঞানই গীতার লক্ষ্য। রামানুজাচার্য্য এবং বিশ্বনাথ প্রমুখ ভাষ্যকার টীকাকার গণ ভক্তিকেই গীতার সার সম্পদ বলে ঘোষণা করে গেছেন। ভক্তি ভিন্ন কর্ম-জ্ঞান সমস্তই মিথ্যা; ভক্তিই কর্ম-জ্ঞানের মূলীভূত; আর সেই জন্যই ভক্তি যোগ প্রকরণ গীতার মধ্যস্থানে সন্নিবিষ্ট আছে। বিশ্বনাথ প্রভৃতির টীকা তাৎপর্য এমন ভাবই প্রকাশ পেয়েছে। (২) এই মতে কেবলীভূতা ও প্রধানীভূতাঃ ভেদে ভক্তি দ্বিবিধা। কেবলীভক্তি কর্ম ও জ্ঞানের অপেক্ষা রাখে না; উহা স্বতঃ-বিকশিত ও বিশুদ্ধ। উহার নামান্তর-অনন্যা বা অকিঞ্চন ভক্তি। কর্ম ও জ্ঞান প্রভাবে যে ভক্তি উৎপন্ন হয়, তা কর্ম প্রধান বা জ্ঞান প্রধান ভক্তি নামে অভিহিত হয়ে থাকে। যাহোক, জ্ঞান ও ভক্তির প্রভাব ভাষ্য ও টীকাকার গণ যেমন প্রত্যক্ষ করেছেন, কর্মের প্রাধান্য বিষয়ে তারা যে তেমনি কোনও গবেষণায় প্রবৃত্ত হয়েছেন, তা মনে হয় না। এক পক্ষ বলেন-ভক্তি চাই, অন্য পক্ষ বলেন-জ্ঞান চাই, তবেই মুক্তি পাবে। কর্মকে প্রায়ই কেউ মুখ্য-ভাবে মোক্ষের পথ বলে নির্ধারণ করেন নি। জ্ঞান ও ভক্তির মুক্তি সামর্থ্য বিষয়ক বিবাদই প্রধান বিবাদ। কর্মের পক্ষে প্রায় সকলেরই মত এই যে, গীতার উপদেশ নিষ্কাম কর্মই শ্রেয়ঃসাধক; সেই কর্মই জ্ঞান, সেই কর্মই ভক্তি। এই সকল মতের সার নিষ্কাসনে উপলব্ধি হয়, কর্ম না থাকলেও চলে, জ্ঞান আর ভক্তি প্রভাবেই মুক্তি অধিগত হয়ে আসে।

(১) গীতা শাস্ত্রস্য সংক্ষেপত প্রয়োজনং পরং নিঃশ্রেয়সং সহেতুকস্য সংসারস্য অত্যন্তোপরমলক্ষণম্।
(২) তত্র তু প্রথমে কাণ্ডে কর্ম্ম তত্ত্যাগবর্ত্মনা। ত্বংপদার্থবিশুদ্ধাত্মা স্যেপপত্তির্নিরূপ্যতে। দ্বিতীয়ে ভগবদ্ভক্তিনিষ্ঠাবর্ণনবর্ত্মনা। ভগবৎ পরমানন্দস্তৎপদার্থোহবধার্য্যতে। তৃতীয়ে তু তয়োরৈক্য বাক্যার্থো বর্ণ্যতে স্ফুটম। এবমপ্যত্র কাণ্ডানাং সম্বন্ধোহস্তি পরস্পরম।

গীতায় দার্শনিক মত

বড়ই সমস্যার কথা-কর্ম কি জ্ঞান কি ভক্তি-মুক্তি কোন পথে কিভাবে অধিগত হয়! কর্মই জন্ম, কর্মই সংসার, কর্মই সর্বথা পরিদৃশ্যমান। জীব-মাত্রই কর্মের অধীন। জ্ঞানীর বা ভক্তের কর্ম শেষ হতে পারে; কিন্তু অবশিষ্ট সকলেই তো কর্মের অধীন! সংখ্যার অনুপাত করার প্রয়াস পেলেই বা কি বুঝতে পারি ? তারপর, পূর্বেই বলেছি তো, জন্মেই কতজন জ্ঞানী বা ভক্ত হতে পারেন। শুকদেব শঙ্করাচার্য্য-সংসারে বিরল নয় কি ? সুতরাং বুঝতে পারি, বিশাল ব্রহ্মাণ্ডের তুলনায় অণু-পরমাণুর-স্বরূপ প্রাণী-জগতের দৃষ্টির অগোচর ক্ষুদ্র অংশ মাত্র জ্ঞানী বা ভক্ত হয়ে মুক্তি লাভ করলেও, বিশাল বিরাট অংশ কর্ম-ডোরে বাঁধা পড়ে থাকে। করুণা নিদান শ্রীভগবান সেই অসংখ্য অগণ্য কর্মানুবন্ধ জীবের মুক্তি-বিধান করছেন। গীতার তাহাই দার্শনিক তত্ত্ব। অন্যান্য দার্শনিক সম্প্রদায়ের প্রতিপাদ্য বিষয় হতে গীতার প্রতিপাদ্য বিষয় যে অভিনব পস্থানুসারী, এই তত্ত্ব আলোচনায়ই তা উপলব্ধি হয়ে থাকে। নিখিল দার্শনিক সম্প্রদায়ের মধ্যে শ্রীকৃষ্ণই বোধ হয় প্রথম ঘোষণা করে গেছেন,-কর্ম ভিন্ন জীবের মোক্ষলাভের উপায়ান্তর নেই।
‘ন কৰ্ম্মণোমনারম্ভান্নৈষ্কৰ্ম্ম্যং পুরুষোহশ্নুতে।
ন চ সন্ন্যসনাদেব সিদ্ধিং সমধিগচ্ছতি॥
অর্থাৎ, কর্মানুষ্ঠান ভিন্ন পুরুষ নৈষ্কর্ম্য (তত্ত্বজ্ঞানী) হতে পারে না। কর্ম ভিন্ন কেবলমাত্র সন্ন্যাসেও সিদ্ধি-লাভ হয় না। শ্লোক দুইটির ব্যাখ্যায় নানা জন নানা গবেষণা প্রকাশ করতে পারেন। কিন্তু যতই যা নূতন কথা যিনি বলুন, কর্মই যে জ্ঞানের মূল, এই শ্লোকে সেই কথাই বলা হয়েছে; তা সকলকেই স্বীকার করতে হবে। এই উক্তিরই প্রতিধ্বনি স্বরূপ শ্রীভগবান পুনরায় বলেছেন (৩য় অধ্যায়, ৮ম শ্লোক),-
‘নিয়তং কুরু কৰ্ম্ম ত্বং কৰ্ম্ম জ্যায়োহ্যকৰ্ম্মণঃ।
শরীরযাত্রাপি চ তে ন প্রসিধ্যেদকৰ্ম্মণঃ॥
অর্থাৎ, ‘কর্ম না করা অপেক্ষা কর্ম করাই শ্রেয়স্কর; তুমি নিয়ত কর্মপর হও। সর্বকর্ম-পরিশূন্য হলে তোমার দেহযাত্রাই নির্বাহ হবে না। কর্ম ভিন্ন মানুষের অস্তিত্বই যে অসম্ভব, এখানে তাহাই বলা হল। অতএব ভগবদ্বাক্যে বেশ প্রতীত হচ্ছে,- কর্মই মানুষের প্রথম প্রয়োজন। কর্মপর মানুষ কর্মানুরত না হলে, জ্ঞান তো দূরের কথা, তার অস্তিত্ব অভাবই ঘটবে; অর্থাৎ,-জীবন্মৃত হয়ে থাকতে হবে। বুঝা গেল-সকলকে কর্ম করতেই হবে; বুঝা গেল-কর্মের উপরেই অস্তিত্ব। এইবার বুঝা আবশ্যক -কর্ম কি ? তোমায় করতে হবে-কোন কর্ম! সৎ ও অসৎ ভেদে প্রধানতঃ কর্মকে দুই ভাগে বিভক্ত করা যেতে পারে। দৈব ও আসুর ভেদেও কর্মকে দুই ভাগে বিভক্ত করা যেতে পারে। কিন্তু এ বিভাগ মানুষ সহজে বুঝতে পারে না। শ্রীকৃষ্ণ তাই বলেছেন, কর্ম ও অকর্ম-কর্মের এই যে দুই বিভাগ, বিবেকীগণও তা বুঝতে পারেন না; কিং কৰ্ম্ম কিমকৰ্ম্মেতি কবয়োহপ্যত্র মোহিতাঃ।’ ফলতঃ, কর্মই বা কি, আর অকর্মই বা কি, তা অনুধাবন করা বিশেষ প্রয়োজন। তারপর, আর ও বুঝা প্রয়োজন- বিকর্ম। শ্রীভগবান বলছেন ( গীতা, ৪র্থ অধ্যায়, ১৭শ শ্লোক),-
‘কর্ম্মণোহ্যপি বোদ্ধব্যং বোদ্ধব্যঞ্চ বিকর্ম্মণঃ।
অকর্ম্মণশ্চ বোদ্ধব্য গহণা কর্ম্মণো গতিঃ॥
কর্মের গতি বড় দুর্জ্ঞেয়; সুতরাং কর্ম, অকর্ম ও বিকর্ম তিনই বুঝা আবশ্যক। এ বোধ বড়ই কঠিন। এ বোধ বড়ই কঠিন। সে কাঠিন্য-সে দুর্জ্ঞেয়ত্ব-শ্রীকৃষ্ণের একটি উক্তিতেই প্রতিপন্ন হয়; যথা,-
‘কৰ্ম্মণ্যকৰ্ম্ম যঃ পশ্যেদকৰ্ম্মণি চ কৰ্ম্ম যঃ।
স বুদ্ধিমান মনুষ্যেষু স যুক্তঃ কৃৎস্নকৰ্ম্মকৃৎ॥’
পূর্বে কর্মের ত্রিবিধ বিভাগ (কর্ম, অকর্ম, বিকর্ম) নিদিষ্ট হল। তারপরই শ্রীভগবান বললেন,–‘যিনি কর্মকে অকর্ম এবং অকর্মকে কর্ম বলে বুঝতে পারেন, সেই বুদ্ধিমান ব্যক্তি কৃৎস্নকর্ম্মকৃৎ (সর্ব কৰ্ম্মানুষ্ঠাতা) ও যুক্ত (নির্লিপ্ত যোগী পুরুষ)। এ বড় বিষম প্রহেলিকার কথা। কর্ম, অকর্ম ও বিকর্ম-কর্মের যখন তিনটি ভাগ করলেন, তখন কর্ম বলতে শাস্ত্র-সিদ্ধ কর্ম, বিকর্ম বলতে শাস্ত্র-নিষিদ্ধ কর্ম এবং অকর্ম বলতে কর্ম-সন্ন্যাসই (নৈষ্কর্ম্য) অর্থ নিষ্পন্ন হয়ে থাকে। শঙ্করাচার্য্য-প্রমুখ ভাষ্য-টীকাকার গণ ঐরূপ অর্থই নিষ্পন্ন করে গেছেন। তাহলে এখন কর্মে অকর্ম এবং অকর্মে কর্ম কিভাবে দেখা সম্ভবপর হয় ? কর্ম ও অকর্মের স্থূল অর্থে বুঝতে পারি,- যা কর্ম, তা ফলপ্রসূ; যা অকর্ম, তাহ নিষ্ফল। সুতরাং একে অন্যের আরোপ হয় কি প্রকারে ? কর্ম্মণি ও অকৰ্ম্মণি-সপ্তম্যস্ত পদ। বিষয়ে বা অধিকরণে দুই কারণে সপ্তমী বিভক্তি হয়। কিন্তু কর্মে অকর্ম, অকর্মে কর্ম,-এমন বাক্যে ঐ দুই কারণের কোনও কারণই সঙ্গত হয় না। সমান বিষয়ে সমান জ্ঞানই, বিষয়ে সপ্তমীর লক্ষণ, অর্থাৎ- ঘটে ঘট জ্ঞান, পটে পট-জ্ঞান ইত্যাদি। বিপরীত জ্ঞান অর্থাৎ ঘট ও পট রূপ দুই ভিন্ন পদার্থের একত্ব-জ্ঞান কদাচ সিদ্ধ হয় না। এইরকম, অধিকরণে সপ্তমী সিদ্ধান্ত করতে গেলে, তাতেও বিঘ্ন ঘটে। আধার ও আধেয় কখনও বিপরীত-ধর্ম আক্রান্ত হয়ে টিকতে পারে না। পাত্রে জল থাকতে পারে; কিন্তু জলে অনল, আধার আধেয় ভাবে কখনও থাকতে পারে কি ? কর্মে অকর্মে এবং অকর্মে কর্ম এমন বাক্যে সাধারণতঃ পূৰ্ব্বোক্তরূপ অসম্ভবতার প্রশ্নই মনে জেগে থাকে। কিন্তু এও বিবেচনা করা উচিত নয় কি যে, শ্রীভগবানের মুখকমল হতে অসম্ভব অযৌক্তিক উপদেশ কখনই নির্গত হতে পারে না! তবে বস্তুতপক্ষে কথাটা কি ? ভগবানের বাক্য কখনও মিথ্যা বা প্রমোদপূর্ণ নয়। সুতরাং বুঝতে হবে, ঐ বাক্যের মধ্যে নিশ্চয়ই সত্য নিহিত আছে। অনুসন্ধানের পর অনুসন্ধান করে, ভাষ্যকার গণ নির্ঘণ্ট করলেন,- কর্মে অকর্ম এবং অকর্মে কর্ম দর্শন এ দৃষ্টান্তের তো অপ্রাচুর্য নেই! রেল, ষ্টীমারে বা নৌকায় গতাগতি কালে, মানুষ সচরাচর দেখতে পায়-পারিপার্শ্বিক বৃক্ষ লতা-গুল্ম-সমূহ, এমন কি পর্বত-মাটির স্তূপ ভূমিখণ্ড পর্যন্ত, বিপরীত দিকে চলেছে! তারা গতি-ক্রিয়াহীন; অথচ সাধারণ দৃষ্টিতে মনে হয়, তারা প্রতিলোম গতিবিশিষ্ট। অচলে চলচ্ছক্তি দর্শন-অকর্মে কর্ম-দর্শন নয় কি ? এমন দৃষ্টান্ত আরও বহুল পরিদৃশ্যমান! মনে করুন, কোনও যোগী প্রকৃত যোগ-যুক্ত না হয়ে দেহান্দ্রিয় আদি ব্যাপার প্রতিরোধ করে বসে আছেন। তার সেই প্রতিরোধ ক্রিয়া- তুষ্ণীম্ভাবাবলম্বন, দৃশ্যতঃ অকর্ম বলে প্রতিপন্ন হলেও উহা যে কর্ম-সাপেক্ষ, তা উপলব্ধি হয়। অকর্মে কর্মের দৃষ্টান্ত এইরকম আরও আছে। মানুষের নিত্য-নৈমিত্তিক কর্ম (যা ফলপ্রসূ নয়), সে কর্মের আকরণজনিত প্রত্যব্যয় ঘটে। সুতরাং সে অকরণ বা অকর্ম-কর্মবাচ্য। অতএব বুঝা গেল, অকর্মে কর্ম অসিদ্ধ নয়। এইরূপ, কর্মেও অকর্মের দৃষ্টান্ত বিরল নয়। কোনও মানুষ বা যান আদি অতি দুরে গতিবিশিষ্ট; দূরত্ব নিবন্ধন তাদের গতি-ক্রিয়া অনুভূত না হওয়ায় তাদেরকে নিশ্চল বলে মনে হচ্ছে। সে যেমন ভ্রম, সৌরজগতে গ্রহ আদির গতিবিধি সংক্রান্ত সেইরূপ ভ্রম কত জনের মনে বদ্ধমূল আছে; অজ্ঞজন গতিবিশিষ্ট গ্রন্থাদিকে স্বতঃই নিশ্চল বলে মনে করে। সুতরাং বিবিধ দৃষ্টান্তে কর্মে অকর্ম উপলব্ধি হয়। তারপর নিত্যকর্মের বিষয়। এক হিসাবে নিত্যকর্ম (সন্ধ্যাদি) কর্ম নয়; কারণ, উহার অকরণে দোষ আছে, কিন্তু করণে কোনও ফল নেই। সুতরাং বিবিধ দৃষ্টান্তে বেশ উপলব্ধি হয় যে, কর্মে অকর্ম বা অকর্মে কর্ম বাক্য শ্রীহরির মুখ হতে অনর্থক নির্গত হয় নি। তা যদি না হয়ে থাকে, তবে এইবার “কৰ্ম্মণ্যকৰ্ম্ম যঃ পশ্যেদ কৰ্ম্মণি চ কৰ্ম্ম যঃ” বাক্যের প্রকৃত অর্থ নিষ্কাসন কিভাবে হতে পারে, দেখা যাক। পূর্বে ভগবান বলেছেন, কর্ম কি আর অকর্ম কি, তা বুঝতে পণ্ডিত গণও মুহ্যমান হন। কিন্তু এখন বললেন-যারা কর্মে অকর্মে এবং অকর্মে কর্ম দেখেছেন, তারাই বুদ্ধিমান যোগী ও কৃৎস্নকর্মকৃৎ। এই দুই উক্তির সামঞ্জস্য রক্ষায় বুঝতে পারা যায়, শেষোক্ত স্থলে যারা কর্মাকর্মের ভেদ উপলব্ধি করতে পেরেছেন, সেই জ্ঞানী ব্যক্তিদের প্রসঙ্গই এখানে উত্থাপিত হয়েছে। যারা জ্ঞানী, তারাই তো কর্মে অকর্ম দেখতে সমর্থ হন! যারা অজ্ঞানী, তাঁদের নিকট সে ভ্রম তো রয়েই গেছে! সুতরাং এখানে কর্মাকর্ম জ্ঞান বিশিষ্ট ব্যক্তির প্রসঙ্গই উখাপিত বলে স্বীকৃত হয়। এ অর্থ সমীচীন বটে; কিন্তু এর ও উপরে আরও যে এক নিগূঢ় ভাব আছে, তাহাই শ্রীভগবানের লক্ষীভূত বলে বিশ্বাস করি। সে ভাব-কোন ভাব, তুমি যে কর্ম করবে, সে কর্ম যেন তোমার অকর্ম (নৈষ্কর্ম্য) মধ্যে গণ্য হয়; আর সেই অকর্মেই (নৈষ্কর্ম্যেই) যেন তুমি কর্ম দেখ। অর্থাৎ, কর্ম করতেই হবে; কিন্তু সে কর্ম এমন হওয়া চাই, যার দ্বারা নৈষ্কর্ম্য বা মোক্ষ অধিগত হতে পারে। কর্ম-প্রসঙ্গে যখন উপদেশ দেওয়া হচ্ছে, তখন কেমন কর্ম করতে হবে-সেই উপদেশই প্রদত্ত হয়েছে, বুঝা আবশ্যক। যিনি এই বুঝে কর্ম করতে পারবেন, তিনিই বুদ্ধিমান যোগী ও কৃৎস্নকৰ্ম্মকৃৎ। ফলতঃ, কর্ম চাই, কর্ম করতেই হবে। গীতার এটাই প্রধান উপদেশ। গীতা যেমন বলেছেন-
‘কৰ্ম্মণ্যকৰ্ম্ম যঃ পশ্যেদকর্ম্মণি চ কর্ম্ম যঃ’; সেইরকম গীতায় (৫অধ্যায় ৫ শ্লোকে) আরও বলা হয়েছে,-
যৎ সাংখ্যৈঃ প্রাপ্যতে স্থানং তদ্‌যোগৈরপি গম্যতে। একং সাংখ্যঞ্চ যোগঞ্চ যঃ পশ্যতি স পশ্যতি॥
অর্থাৎ, ‘জ্ঞানী গণ যে স্থান বা মোক্ষ লাভ করেন, কর্মযোগি গণ ও সেই স্থান’ই প্রাপ্ত হন। সাংখ্য ও যোগ কে যিনি অভিন্ন-ভাবে দর্শন করতে সমর্থ হয়েছেন, তিনিই সম্যক দর্শন-শক্তি লাভ করেছেন।’ বুঝা গেল, কর্মই আবশ্যক।

কর্মেই নৈষ্কর্ম্য।
বুঝা গেল, কর্মের মধ্যে আবার সেই কর্ম আবশ্যক- যে কর্মে বন্ধন নেই, যে কর্ম কর্ম হয়েও নৈষ্কর্ম্ম্য অৰ্থাৎ মুক্তিফলপ্রদ। কিন্তু সে কর্ম-কোন কর্ম ? গীতায়ই তার উপদেশ আছে। এক স্থানে নয়। এক কথায় নয়; বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন ভাবে বিভিন্ন যুক্তির সাহায্যে গীতায় শ্ৰীভগবান সেই কথাই বুঝিয়ে গেছেন। স্থির ধীর চিত্তে সেই সকল উপদেশ পড়ে দেখুন; পড়ে সার-সিদ্ধান্ত অনুধাবন করুন। গীতায়, যথা,-

(১) যজ্ঞার্থাৎ কর্ম্মণোহন্যত্র লোকাহয়ং কর্ম্মবন্ধনঃ। তদর্থং কর্ম্ম কৌন্তেয় মুক্তসঙ্গঃ সমাচর॥ ৩/৯
(২) কাম এষ ক্রোধ এষ রজোগুণসমুদ্ভবঃ। মহাশনো মহাপাপ্মা বিদ্ধ্যেনমিহ বৈরিণম্॥৩/৩৭
ধূমেনাব্রিয়তে বহ্নির্যথাদর্শো মলেন চ। যথোল্বেনাবৃতো গর্ভস্তথা তেনেদমাবৃতম্॥৩/৩৮
আবৃতং জ্ঞানমেতেন জ্ঞানিনো নিত্যবৈরিণা। কামরূপেণ কৌন্তেয় দুষ্পূরেণানলেন চ॥৩/৩৯
ইন্দ্রিয়াণি মনো বুদ্ধিরস্যাধিষ্ঠানমুচ্যতে। এতৈর্বিমোহয়ত্যেষ জ্ঞানমাবৃত্য দেহিনম্॥৩/৪০
তস্মাত্ত্বমিন্দ্রিয়াণ্যাদৌ নিয়ম্য ভরতর্ষভ। পাপ্মানং প্রজহি হ্যেনং জ্ঞানবিজ্ঞাননাশনম্॥৩/৪১
ইন্দ্রিয়াণি পরাণ্যাহুরিন্দ্রিয়েভ্যঃ পরং মনঃ। মনসস্তু পরা বুদ্ধির্যো বুদ্ধেঃ পরতস্ত্ত সঃ॥৩/৪২
এবং বুদ্ধেঃ পরং বুদ্ধা সংস্তভ্যাত্মানমাত্মনা। জহি শত্রুং মহাবাহো কামরূপংদুরাসদম্॥৩/৪৩
(৩) যস্য সর্বে সমারম্ভাঃ কামসংকল্পবর্জিতাঃ। জ্ঞানাগ্নিদগ্ধকর্মাণাং তমাহুঃ পণ্ডিতং বুধাঃ॥৪/১৯
ত্যক্ত্বা কর্মফলাসঙ্গং নিত্যতৃপ্তো নিরাশ্রয়ঃ। কর্মণ্যভিপ্রবৃত্তোহপি নৈব কিঞ্চিৎ করোতি সঃ॥৪/২০
নিরাশীর্যতচিত্তাত্মা ত্যক্তসর্বপরিগ্রহঃ। শারীরং কেবলং কর্ম কুর্বন্নাপ্নোতি কিল্বিষম্॥৪/২১
যদৃচ্ছালাভসন্তুষ্টো দ্বন্দ্বাতীতঃ বিমৎসরঃ। সম সিদ্ধাবসিদ্ধৌ চ কৃত্বাপি ন নিবধ্যতে॥৪/২২
গতসঙ্গস্য মুক্তস্য জ্ঞানাবস্থিতচেতসঃ। যজ্ঞায়াচরতঃ কর্ম সমগ্রং প্রবিলীয়তে॥৪/২৩
(৪) শ্রেয়ো হি জ্ঞানমভ্যাস্যাজ্ জ্ঞানাদ্ধ্যানং বিশিষ্যতে। ধ্যানাৎ কর্মফলত্যাগস্ত্যাগাচ্ছান্তিরনন্তরম্॥ ১২/১২
অদ্ধেষ্টা সর্বভূতানাং মৈত্রঃ করুণ এব চ। নির্মমো নিরহঙ্কারঃ সমদুঃখসুখঃ ক্ষমী॥ ১২/১৩
সন্তুষ্টঃ সততং যোগী যতাত্মা দৃঢ়নিশ্চয়ঃ। ময্যর্পিতমনোবুদ্ধির্যো মদ্ভক্তঃ স মে প্রিয়ঃ॥ ১২/১৪
যস্মান্নোদ্বিজতে লোকো লোকান্নোদ্বিজতে চ যঃ। হর্ষামর্ষভয়োদ্বেগৈর্মুক্ত যঃ স চ মে প্রিয়ঃ॥ ১২/১৫
অনপেক্ষঃ শুচির্দক্ষ উদাসীনো গতব্যথঃ। সর্বারম্ভপরিত্যাগী যো মদ্ভক্তঃ স মে প্রিয়ঃ॥ ১২/১৬
যো ন হৃষ্যতি ন দ্বেষ্টি ন শোচতি ন কাঙ্ক্ষতি। শুভাশুভপরিত্যাগী ভক্তিমান্ যঃ স মে প্রিয়ঃ ॥ ১২/১৭
সমঃ শত্রৌ চ মিত্রে চ তথা মানাপমানয়োঃ। শীতোষ্ণসুখদুঃখেষু সমঃ সঙ্গবিবর্জিতঃ॥ ১২/১৮
তুল্যনিন্দাস্তুতির্মৌনী সন্তুষ্টো যেন কেনচিৎ। অনিকেতঃ স্থিরমতির্ভক্তিমান্মে প্রিয়ো নরঃ॥ ১২/১৯
যে তু ধর্মামৃতমিদং যথোক্তং পর্যুপাসতে। শ্রদ্দধানা মৎপরমা ভক্তাস্তেহতীব মে প্রিয়াঃ॥ ১২/২০
(৫) কাম্যানাং কর্মণাং ন্যাসং সন্ন্যাসং কবয়ো বিদুঃ। সর্বকর্মফলত্যাগং প্রাহুস্ত্যাগং বিচক্ষণাঃ॥ ১৮/২
ত্যাজ্যং দোষবদিত্যেকে কর্ম প্রাহুর্মনীষিণঃ। যজ্ঞদানতপঃকর্ম ন ত্যাজ্যমিতি চাপরে॥ ১৮/৩
নিশ্চয়ং শৃণু মে তত্র ত্যাগে ভরতসত্তম। ত্যাগো হি পুরুষব্যাঘ্র ত্রিবিধঃ সংপ্রকীর্তিতঃ॥ ১৮/৪
যজ্ঞদানতপঃকর্ম ন ত্যাজং কার্যমেব তৎ। যজ্ঞো দানং তপশ্চৈব পাবনানি মনীষিণাম্॥ ১৮/৫
এতান্যপি তু কর্মাণি সঙ্গং ত্যক্ত্বা ফলানি চ। কর্তব্যানীতি মে পার্থ নিশ্চিতং মতমুত্তমম্॥ ১৮/৬

অর্থাৎ, (১) ‘যজ্ঞার্থ কর্ম ভিন্ন অন্য কর্ম বন্ধনের কারণ। সুতরাং যজ্ঞার্থ (ভগবানের প্রীতি-সাধনের জন্য) নিষ্কামভাবে কর্ম করবে; অর্থাৎ-সে কর্মে বন্ধন নেই। (২) ‘কাম রজঃগুণজাত অতৃপ্ত অতিশয় উগ্র; ক্রোধ কামেরই পরিণাম। সুতরাং কামকে মোক্ষ পথের বৈরী বলে জানবে। ধূম যেমন আগুনকে আবৃত করে রাখে, মলিনতা যেমন দর্পণকে আচ্ছন্ন করে রাখে, জরাযু যেমন গর্ভকে আবৃত করে রাখে, কাম তেমনই জ্ঞানকে আচ্ছন্ন করে রাখে। জ্ঞানের চিরশক্ৰ কামরূপ দুষ্পূরণীয় অনল দ্বারা জ্ঞান আবৃত থাকে। ইন্দ্রিয় মন বুদ্ধি প্রভৃতি কামে অধিষ্ঠান বলে অভিহিত হয়; যেহেতু, ইন্দ্রিয় আদি দ্বারাই জ্ঞানকে আবৃত করে, কাম দেইকে মুগ্ধ করে। অতএব ইন্দ্রিয় গণকে সংযত করে জ্ঞান-বিজ্ঞান-নাশন কামকে বিনাশ কর। দেহ আদি হতে ইন্দ্রিয় গণ শ্রেষ্ঠ বটে; কিন্তু ইন্দ্রিয় গণ অপেক্ষা মন শ্রেষ্ঠ; মন অপেক্ষা বুদ্ধি শ্রেষ্ঠ; বুদ্ধি অপেক্ষা আত্মা শ্রেষ্ঠ। এটি বুঝে আত্মার দ্বারা আত্মাকে স্থির করে কামরূপ দুর্নিবার শক্রকে জয় করবে।” (৩) যার সকল কর্ম কাম-সঙ্কল্প-বর্জিত, তিনিই পণ্ডিত; তারই জ্ঞানরূপ অগ্নিতে কর্ম সকল দগ্ধ প্রাপ্ত হয়। কর্ম-ফলে আসক্তি ত্যাগী ব্যক্তি নিত্য তৃপ্ত নিরবলম্ব; কর্মে প্রবৃত্ত থাকলেও নিরাকাঙ্ক্ষ-নিবন্ধন তার কর্ম নৈষ্কর্ম্য মধ্যে গণ্য হয়। নিষ্কাম সংযতচিত্ত-দেহ সর্ববিষয়-সঙ্গ-পরিত্যাগকারী ব্যক্তি দেহযাত্রা-নির্বাহের জন্য যে কর্ম করেন, সে কর্ম কখনই বন্ধনের হেতু হয় না। যদৃচ্ছা-লাভে সন্তুষ্ট, ক্ষুধা-তৃষ্ণা-শীতোষ্ণ আদি-সহনশীল নির্বৈর, সিদ্ধিতে বা অসিদ্ধিতে সমজ্ঞান ব্যক্তিরও কর্ম বন্ধন-হেতু নয়। যারা নিষ্কাম, রাগ আদি বিরহিত, জ্ঞানে অবস্থিত-চিত্ত এবং ভগবদ উদ্দেশে যজ্ঞ আদি কর্মে প্রবৃত্ত, তাদের কর্ম আপনিই লয় প্রাপ্ত হয়। (৪) অভ্যাস অপেক্ষা জ্ঞান, জ্ঞান অপেক্ষা ধ্যান, ধ্যান অপেক্ষা কর্ম-ফল-ত্যাগ শ্রেষ্ঠ; তাতেই শান্তিলাভ হয়। যে জন সর্বভূতে দ্বেষশূন্য, মৈত্র্য ও কারুণ্য-সম্পন্ন, অথচ মমতাহীন, অহঙ্কার-শূন্য, শোক-দুঃখে সমদৰ্শী, ক্ষমাশীল, সতত সন্তুষ্টচিত্ত, যোগী, সংযতচিত্ত, অধ্যবসায়-সম্পন্ন ও ভগবানে মন-বুদ্ধি সমর্পণকারী হন, তিনিই ভগবানের প্রিয়; অর্থাৎ মোক্ষের অধিকারী। যিনি লোক সকলের উদ্বেগের কারণ নন, লোকসমূহ হতে ও যিনি উদ্বেগ-প্রাপ্ত হন না, হর্ষামর্ষ-ভয়-উদ্বেগ মুক্ত সেই ব্যক্তিই ভগবানের প্রিয়। স্বয়মাগত অর্থেও যিনি স্পৃহাশূন্য, শৌচ-সম্পন্ন, অনলস, অপক্ষপাত, চিত্তক্লেশ-শূন্য ও সর্বাকাঙ্ক্ষা-পরিত্যাগী, তিনিই ভগবানের প্রিয়। আনন্দ (প্রিয়বস্তলাভে) নাই, বিদ্বেষ (অপ্রিয় বস্তুতে) নাই, দুঃখিত (ইষ্ট-নাশে) নন, আকাঙ্ক্ষা (পদগৌরব, অর্থের) করেন না, শুভাশুভ-পরিত্যাগকারী ভগবানে ভক্তিমান যে ব্যক্তি, সেই তার প্রিয় হয়। শত্রু মিত্রে ও মান অপমানে সমদৰ্শী, শীতোষ্ণ-সুখদুঃখে সমজ্ঞান, আসক্তিশূন্য, নিন্দা, প্রশংসায় অবিচলিত-চিত্ত, সংযত বাক, সদাসন্তুষ্ট, আশ্রয় রহিত অথচ স্থিরচিত্ত, এরকম ভক্তিমান যে জন, তিনিই ভগবানের প্রিয়পাত্র। (৫) পণ্ডিতেরা কাম কর্মের ত্যাগকে সন্ন্যাস বলে জানেন; কিন্তু বিচক্ষণ জন সর্ব-কর্ম-ফল-ত্যাগকেই ত্যাগ বলে কীৰ্ত্তন করে গেছেন। মনীষিগণ (সাংখ্য গণ) কর্ম মাত্রকেই দোষ-হেতু বলে ত্যাগের উপদেশ দিয়েছেন। অন্য পণ্ডিতগণ (মীমাংসকগণ) যজ্ঞ-দান-তপঃ কর্মকে অত্যাজ্য বলে ঘোষণা করে গেছেন। কিন্তু আমার (ভগবানের) মত এই যে, ত্যাগ ত্রিবিধ। যজ্ঞ দান-তপঃ-কর্ম কখনও ত্যাজ্য নয়; পরন্তু তাই কৰ্ত্তব্য কাজ। যেহেতু, যজ্ঞ দান-তপস্যা দ্বারাই মনীষি গণের চিত্ত পরিশুদ্ধ হয়। অতএব আসক্তি ও ফল-কামনা পরিত্যাগ করে, ঐ সকল কর্মের অনুষ্টান করা একান্ত আবশ্যক। এটিই আমার নিশ্চিত উত্তম মত জানবে। অধিক বলার বা বুঝানোর আবশ্যক নেই। যে কর্ম যে ভাবে অনুষ্ঠান করা আবশ্যক, ভগবান পুনঃপুনঃ সেই উপদেশ প্রদান করেছেন। যখন বলেছেন,- ‘আমাকে ভজনা কর’, তখনও যে ভাবে ভজনা করতে বলেছেন; যখন বলছেন- ‘কর্ম কর’, তখনও সেই ভাবেই কর্ম করতে বলছেন। ভজনায়ও যা-কর্মেও তাহাই। কর্ম করতে হবে; কিন্তু ফলকামনা ত্যাগ করিয়। আমাকে ভজনা করতে হবে, কিন্তু সর্বভূতে সমদৰ্শন করে। কর্ম করতে হবে; কিন্তু অহঙ্কার বল দৰ্প কাম ক্রোধ-পরিগ্রহ পরিত্যাগ করে; ব্রহ্মত্ব পেতে পারবে, যদি বুঝে থাক- সৰ্ব্বভূতে সৰ্ব্বজীবে ব্রহ্ম বিরাজমান। সে বোধ, সে জ্ঞান, সকলই কর্মের অধীন। সে কর্ম অকর্মরূপ কর্ম; সে কর্ম কর্মফল ত্যাগরূপ কর্ম; সে কর্ম-সর্বত্রে ব্রহ্ম অধিষ্ঠান দর্শন এবং সৰ্ব্বজীবে সমদর্শনরূপ কর্ম। রাগ দ্বেষ অহঙ্কার প্রভৃতি ত্যাগ করে, অমানিত্ব-অদাম্ভিত্ব প্রভৃতি গুণসম্পন্ন হতে হতে নিগুৰ্ণত্ব-লাভ হয়। কর্মেই অকর্ম, গুণেই নির্গুণত্ব, অগ্নিতেই নিৰ্ব্বাণত্ব। কর্ম হয়েও, নৈষ্ক্ররম্যের (মোক্ষের) হেতুভূত, দেখুন সে কি কর্ম;-
“অভয়ং সত্ত্বসংশুদ্ধির্জ্ঞানযোগব্যবস্থিতিঃ। দানং দমশ্চ যজ্ঞশ্চ স্বাধ্যায়স্তপ আর্জবম্॥ ১৬/১
অহিংসা সত্যমক্রোধস্ত্যাগঃ শান্তিরপৈশুনম্। দয়া ভূতেষ্বলোলুপ্তং মার্দবং হ্রীরচাপলম্॥ ১৬/২
তেজঃ ক্ষমা ধৃতিঃ শৌচমদ্রোহো নাতিমানিতা। ভবন্তি সম্পদং দৈবীমভিজাতস্য ভারত॥ ১৬/৩”
অর্থাৎ, নির্ভীকতা, চিত্তের প্রসন্নতা, জ্ঞান-যোগ-নিষ্ঠা, দান, ইন্দ্রিয়-সংযম, যজ্ঞ, বেদ আদি পাঠ, তপস্যা, সরলতা, অহিংসা, সত্য, অক্রোধ, সন্ন্যাস, চিত্তের উপরতি, পরনিন্দা ত্যাগ, জীবে দয়া, লোভহীনতা, মৃদুতা, লজ্জা, অচাপল্য, তেজ, ক্ষমা, ধৈর্য্য, বাহ্য অভ্যন্তরশৌচ, জিঘাংসারাহিত্য ও অভিমান-শুন্যতা,-এই ষড়বিংশতি প্রকার বৃত্তি শুদ্ধ-সাত্ত্বিকী সম্পদকে লক্ষ্য করিয়া জাত ব্যক্তিরই জন্মিয় থাকে।” এই ষোড়শ দৈবী সম্পদের বিষয় বলে শ্রীভগবান ঘোষণা করলেন, “দৈবীসম্পদ বিমোক্ষায় নিবন্ধায়াসুরী মতা।” অর্থাৎ, দৈবী সম্পদে মোক্ষ; আর দম্ভদর্প অভিমান আদি আসুরী সম্পৎ বন্ধনের হেতুভূত। যথা-
“দম্ভো দৰ্পোহভিমানশ্চ ক্রোধঃ পারুষ্যমেব চ। অজ্ঞানং চাভিজাতস্য পার্থসম্পদমাক্ষরীম্।
দৈবীসম্পদবিমোক্ষায় নিবন্ধয়াসুরী মতা। মা শুচঃ সম্পদং দৈবীমাভিজাতোহসি পাণ্ডব।”
দৈবী সম্পদের অধিকারী হলে তার আর মোক্ষের ভাবনা নেই। এমন করে ‘চোখে আঙুল দিয়ে, যিনি এমন সরল-সুগম মোক্ষের পথ দেখিয়ে দিলেন, তিনি কি পরম দার্শনিক নন ? তাই বলছিলাম,-শ্ৰীকৃষ্ণ পরম দার্শনিক, কেন-না, তিনি সকল দর্শনের সার-সমন্বয় সাধন করে এক সরল সুগম সুখের পন্থা জনসমাজকে প্রদর্শন করে গেছেন।

মোক্ষের অধিকারী-
শ্রীভগবান গীতা শাস্ত্রের যেখানেই যখন মোক্ষের পথ প্রদর্শন করেছেন, সেখানেই তখন কর্মের উপর মোক্ষের ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত দেখতে পেয়েছি। ক্বচিৎ কোথাও অর্থ নিষ্পত্তি পক্ষে অস্তুরায় উপস্থিত হলেও, পুৰ্ব্বাপর সঙ্গতি রক্ষায় অর্থোৎপত্তির প্রয়াস পেলে, সর্বথা সেই একই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়ে কর্মই মূল, কর্ম ভিন্ন গত্যন্তর নেই , এটিই গীতার মুখ্য উপদেশ। তবে কর্মের প্রকারভেদ আছে, আর সে প্রভেদ উপলব্ধি করে কর্ম-ক্ষেত্রে অগ্রসর হও, এটাই শ্ৰীভগবানের প্রদত্ত সুশিক্ষা।
গীতায় দেখানো হয়েছে,-মোক্ষের অধিকারী কোন জন ? প্রাক্তন বা কর্ম অনুসারে মানুষ বিভিন্ন অবস্থায় অবস্থিত। গীতায় সেই বিভিন্ন অবস্থার মানুষেরই মুক্তির পথ নির্দিষ্ট আছে। তুমি জ্ঞানী জ্ঞানমার্গানুসারী, শুনবে- তোমার মুক্তি হবে কি প্রকারে ? মুক্তি-জ্ঞানের দ্বারাই হবে বটে; সত্বাদি গুণত্রয়ের নিবৃত্তিতেই তুমি কৃতকৃতাৰ্থ হবে সত্য; কিন্তু তুমি যখন দেহী, তখন দেহের দ্বারাই কর্মের দ্বারাই–আচারের দ্বারাই-তোমার সেই সত্ত্ব আদি গুণের নিবৃত্তি আবশ্যক। তোমায় সুখ-দুঃখে অবিচলিতচিত্ত হতে হবে, ইট-পাথর-স্বর্ণে সমান জ্ঞান করতে হবে, প্রিয় অপ্রিয় বিষয়ে সমভাবাপন্ন এবং নিন্দা-প্রশংসায় অনুদ্বিগ্ন থাকতে হবে। মান-অপমানে সমভাব, শক্ৰ-মিত্রে সমদৰ্শী, দৃষ্টাদৃষ্ট লাভালাভ বিষয়ে নিরপেক্ষচিত্ত-এমনটি হতে পারলে তবে তো তুমি গুণাতীত সুতরাং মুক্ত হতে পারবে! (১) তবেই বুঝুন, জীবে কর্ম প্রয়োজন কি না! যে দিক দিয়ে যে ভাবেই দৃষ্টিপাত করুন, সৎকর্ম সদনুষ্ঠান ভিন্ন মামুষের গত্যন্তর নেই। অসৎকর্ম অসৎ-পথ পরিত্যাগ এবং সৎকর্ম সৎচিন্তায় মনোনিবেশ,-এটাই হল মোক্ষের প্রথম স্তর। এই স্তরে উপনীত হলেই গীতার প্রধান লক্ষ্যভূত কর্মফল ত্যাগ আপনা-আপনি অধিগত হয়। গীতার কোথায় না এ আভাষ- এ উপদেশ দেখতে পাই ? দৃষ্টান্ত কত উল্লেখ করব ? দেখুন-মুক্তির অধিকারী- স্থিতপ্রজ্ঞ। দেখুন-মুক্ত জীবের-ব্রহ্মনিৰ্ব্বাণ। দেখুন-মানুষের পরম মুখময় পর গতি। সর্বত্রই এক ভাব-এক চিন্তা-এক শিক্ষা। স্থিতপ্রজ্ঞের লক্ষণ; যথা,-
“প্রজহাতি যদা কামান্ সর্বান্ পার্থ মনোগতান্। আত্মন্যেবাত্মনা তুষ্টঃ স্থিতপ্রজ্ঞস্তদোচ্যতে॥৫৫
দুঃখেষ্বনুদ্বিগ্নমনাঃ সুখেষু বিগতস্পৃহঃ। বীতরাগভয়ক্রোধঃ স্থিতধীর্মুনিরুচ্যতে॥৫৬
যঃ সর্বত্রানভিস্নেহস্তত্তৎ প্রাপ্য শুভাশুভম্। নাভিনন্দতি ন দ্বেষ্টি তস্য প্রজ্ঞা প্রতিষ্ঠিতা॥৫৭
যদা সংহরতে চায়ং কূর্মোহঙ্গানীব সর্বশঃ। ইন্দ্রিয়াণীন্দ্রিয়ার্থেভ্যস্তস্য প্রজ্ঞা প্রতিষ্ঠিতা॥৫৮
বিষয়া বিনিবর্তন্তে নিরাহারস্য দেহিনঃ। রসবর্জং রসোহপ্যস্য পরং দৃষ্ট্বা নিবর্ততে॥৫৯
যততো হ্যপি কৌন্তেয় পুরুষস্য বিপশ্চিতঃ। ইন্দ্রিয়াণি প্রমাথীনি হরন্তি প্রসভং মনঃ॥ ৬০
তানি সর্বাণি সংযম্য যুক্ত আসীত মৎপরঃ। বশে হি যস্যেন্দ্রিয়াণি তস্য প্রজ্ঞা প্রতিষ্ঠিতা॥৬১
ধ্যায়তো বিষয়ান্ পুংসঃ সঙ্গস্তেষূপজায়তে। সঙ্গাৎ সঞ্জায়তে কামঃ কামাৎ ক্রোধোহভিজায়তে॥৬২
ক্রোধাদ্ ভবতি সম্মোহঃ সম্মোহাৎ স্মৃতিবিভ্রমঃ। স্মৃতিভ্রংশাদ্ বুদ্ধিনাশো বুদ্ধিনাশাৎ প্রণশ্যতি॥৬৩
রাগদ্বেষবিমুক্তৈস্তু বিষয়ানিন্দ্রিয়ৈশ্চরন্। আত্মবশ্যৈর্বিধেয়াত্মা প্রসাদমধিগচ্ছতি॥৬৪
প্রসাদে সর্বদুঃখানাং হানিরস্যোপজায়তে। প্রসন্নচেতসো হ্যাশু বুদ্ধিঃ পর্যবতিষ্ঠতে॥৬৫
নাস্তি বুদ্ধিরযুক্তস্য ন চাযুক্তস্য ভাবনা। ন চাভাবয়তঃ শান্তিরশান্তস্য কুতঃ সুখম্॥৬৬
ইন্দ্রিয়াণাং হি চরতাং যন্মনোহনুবিধীয়তে। তদস্য হরতি প্রজ্ঞাং বায়ুর্নাবমিবাম্ভসি॥৬৭
তস্মাদ্ যস্য মহাবাহো নিগৃহীতানি সর্বশঃ। ইন্দ্রিয়াণীন্দ্রিয়ার্থেভ্যস্তস্য প্রজ্ঞা প্রতিষ্ঠিতা॥৬৮
যা নিশা সর্বভূতানাং তস্যাং জাগর্তি সংযমী। যস্যাং জাগ্রতি ভূতানি সা নিশা পশ্যতো মুনেঃ॥৬৯
আপূর্যমাণমচলপ্রতিষ্ঠং সমুদ্রমাপঃ প্রবিশন্তি যদ্বৎ।
তদ্বৎ কামা যং প্রবিশন্তি সর্বে সঃ শান্তিমাপ্নোতি ন কামকামী ॥৭০
বিহায় কামান্‌ যঃ সর্ব্বান্‌ পুমাংশ্চরতি নিস্পৃহঃ। নির্ম্মমো নিরহঙ্কারঃ ন কামকামী ॥৭১

অর্থাৎ, হে পার্থ! যোগী ব্যক্তি, অন্তঃকরণের মধ্যে যত প্রকার আশা তৃষ্ণা বা অভিলাষ আছে, সে সমস্তই যখন এককালে পরিত্যাগ করেন, কোনও বিষয়েই কোনও প্রকার তৃষ্ণা বা কামনা অল্পমাত্রও থাকে না, কেবলমাত্র পরমার্থ-তত্ত্ব-স্বরূপ আত্মাতেই সন্তুষ্ট থাকেন, সেই অবস্থায় তাঁকে স্থিতপ্রজ্ঞ বা ব্রহ্মজ্ঞানী বলে। যখন দুঃখেতে কোন প্রকার উদ্বেগ বোধ না হয়, সুখেতে ও কোনপ্রকার স্পৃহা থাকে না, আর যিনি আসক্তি, ভয় ও ক্রোধ আদি প্রবৃত্তিকে সমূলে পরিত্যাগ করেছেন, তাঁকে স্থিতধী বা ব্রহ্মজ্ঞানী মুনি বলা যায়। যিনি ধন, ঐশ্বৰ্য্য ও পুত্র-কলত্র-দেহ আদিতে এককালে নিঃস্নেহ, যিনি শুভ বা অশুভ ঘটনা হলে কোনপ্রকার আনন্দ বা বিদ্বেষ অনুভব না করেন, তাঁরই ব্ৰহ্মজ্ঞান হয়েছে বলা যায়। কুৰ্ম্ম যেমন হস্তপদ আদি অঙ্গগুলিকে বাহির হতে গুটিয়ে নিয়ে দেহের মধ্যে সন্নিবেশিত করে, সেই প্রকার আপন ইন্দ্ৰিয় গণকে রূপ-রসাদি বিষয়-সমূহ হতে প্রত্যাকর্ষণ পূৰ্ব্বক যিনি আত্মাতে বিলীন করতে পারেন, তিনিই ব্ৰহ্মজ্ঞান প্রাপ্ত হন। যে ব্যক্তি পীড়া আদি নিবন্ধন অথবা আহার্য্য-দ্রব্যের অভাবে নিরাহার হয়, তারও সমস্ত ইন্দ্রিয় গুলি শিথিল হয়ে বিলীন প্রায় হয় বটে; কিন্তু তাতে বিষয় অনুরাগের কিছুমাত্র ক্ষয় হতে পারে না। আর যারা আত্মাকে দেখতে পান, তাঁদের অনুরাগের সাথেই ইন্দ্রিয় আদির প্রতিসংহার হয়ে যায় অর্থাৎ অনুরাগও বিনষ্ট হয়ে যায়, ইন্দ্রিয়গণও প্রতিসংহৃত হয়। অতএব পীড়া আদি জনিত ইন্দ্রিয়-শৈথিল্য কোনই কাজের নয়; অনুরাগ সহিত যে ইন্দ্রেয়র লয় হয়, তাহাই উন্নতির চিহ্ন। কিন্তু হে কৌন্তেয়! পূৰ্ব্বোক্ত প্রজ্ঞাস্থৈৰ্য্য লাভ করতে হলে প্রথমতঃ ইন্দ্রিয়গণকে বশীভূত করা আবশ্যক; কারণ, ইন্দ্রিয় গণ যাদের বশীভূত হয়নি, সেই বিদ্বান পুরুষগণ প্রজ্ঞাস্থৈৰ্য্যের নিমিত্ত অতিশয় প্রযত্ন করলেও প্রমার্থী ইন্দ্রিয় গণ, বলাৎকার পূর্বক তাদের মনকে বিষয় অভিমুখে নিয়ে যায়। অতএব, প্রথম সেই ইন্দ্রিয়গণকে বশীভূত করে সমাধির অনুষ্ঠান করতঃ ‘সোহহং’ (আমিই ব্রহ্ম) এই রকম জ্ঞানে অবস্থিতি করবে; কারণ, ইন্দ্রিয়গণ যার বশীভূত তারই

প্রজ্ঞা স্থিরতা লাভ করতে পারে। ইন্দ্রিয়গণকে বশীভূত করতে হলে, প্রথমতঃ বিষয়ের চিন্তা পরিত্যাগ করা আবশ্যক; কারণ, বিষয়ের চিন্তা হতেই ক্রমে সৰ্ব্বনাশ উপস্থিত হয়, সৰ্ব্বদা নানা প্রকার ভোগ্য বিষয়ের চিন্তা করতে করতে ক্রমে তাতে আসক্তি জন্মে। আসক্তি হলেই তা প্রাপ্তির জন্য অত্যন্ত অভিলাষ হয় এবং তখন যদি সেই তীব্র অভিলাষ কোন প্রকারে ব্যাঘাত পায় (পেয়েই থাকে), তাহলেই ক্রোধ এসে পড়ে; ক্রোধ হলেই লোকের হিতাহিত বিষয়ে মোহ হয়ে থাকে। তখন সদুপদেশ সকল বিস্মৃত হয়ে যায়, সুতরাং তখন বুদ্ধির বিবেকশক্তি বিনষ্ট হয়; কার্য্যা কার্য্যের বিবেক শক্তি বিনষ্ট হলেই পুরুষ এককালে অধঃপতিত হল। আর যারা অনুরাগের এবং বিদ্বেষের সাথে অসংশ্লিষ্ট হয়ে নিজ বশীকৃত ইন্দ্রিয় গণের দ্বারা বিষয় রাজ্যে বিচরণ করেন, সেই বিজিতমনাঃ মহাত্মাই প্রকৃত প্রসন্নতা লাভ করে থাকেন। প্রসন্নতা শক্তির বিকাশ হলে, তার সমস্ত দুঃখের অভাব হয়ে যায়। প্রসন্নমনা ব্যক্তিরই অবিলম্বে প্রজ্ঞা প্রতিষ্ঠিত বা ব্রহ্ম সংস্থিতি হয়ে থাকে। চিত্তপ্রসাদ না থাকলে আত্মা বা ব্রহ্ম বিষয়ে জ্ঞান হতে পারে না; এবং প্রসাদ শূন্য ব্যক্তির আত্মজ্ঞানে অভিনিবেশ ও হতে পারে না। অভিনিবেশ না হলে শান্তি আসতে পারে না। ইন্দ্রিয়ের ও অন্তঃকরণের শান্তি বা বিরাম না হলে আর সুখ হবে কেন? অর্থাৎ, বিষয় তৃষ্ণা আদি স্বরূপ দুঃখই থাকবে। ইন্দ্রিয় গণের বিষয় বিচরণকালে যদি মনও তার অনকূলেই চলে, তাহলে, বায়ু যেমন নৌকাকে জল মধ্যে নিমগ্ন করে, মনও সেই রকম সংযমীর বিবেক বুদ্ধিকে হরণ করে ফেলে। অতএব হে মহাবাহো! যার সমস্ত ইন্দ্রিয় এবং অন্তঃকরণ বিষয় হতে নিগৃহীত হয়েছে, তারই ব্রহ্ম সংস্থিতি হতে পারে। হে ধনঞ্জয়! অবিবেকী মনুষ্য আদি প্রাণিগণের যা রাত্রি অর্থাৎ অন্ধকার ময়, সেখানে সংযমী ব্যক্তি গণ সর্বদা জাগ্রত থাকেন, আর অবিবেকী গণ যেখানে জাগ্রত থাকেন, সেখানে আত্মদর্শী মহাত্মার নিশা। অতএব সংসার রাজ্যে আসক্তি থাকলে আত্ম সংস্থিতি হওয়া অসম্ভব। আবার আত্ম সংস্থিতি হয়ে গেলেও কর্মের অনুষ্ঠান করা নিতান্ত আবশ্যক। পর্বত আদি হতে নানা ভাবে নিঃস্যন্দিত নদ-নদী সমূহ যেমন অচলভাবে অবস্থিত জলরাশি-পরিপূর্ণ সমদ্রে প্রবেশ করে, তেমনি অবিদ্যা-বিজৃম্ভিত সমস্ত কামনা বা বাসনা যার সেই সমুদ্রস্থানীয় অনন্ত আত্মাতে প্রত্যাহারের দ্বারা বিলীন হয়ে যায়, তিনিই মোক্ষ পেতে পারেন; খিনি বিষয় বাসনা-পরবশ, তিনি কখনই মুক্তি পেতে পারেন না। অধিক কি বলিব, যিনি সমস্ত প্রকার বাসনা নিঃশেষরূপে পরিত্যাগ পূর্বক অবশেষে জীবনের উপরেও নিষ্পৃহ হয়ে অহংমদীয়ত্বভাব বিসর্জন পূর্বক বিচরণ করেন, তিনিই নিৰ্ব্বাণ নামক মুক্তি পেতে পারেন। যেমন স্থিতপ্রজ্ঞ দেখলেন, তেমনি ব্রহ্ম নির্ব্বাণ প্রাপ্তির লক্ষণ আদি এবং পরাগতি প্রাপ্তির লক্ষণ আদি অনুধাবন করে দেখুন। (গীতার পঞ্চম অধ্যায়ের ২৫-২৬ শ্লোক, নবম অধ্যায়ের ৩২ শ্লোক এবং অষ্টাদশ অধ্যায়ের ৫৪ প্রভৃতি শ্লোক আলোচনায় এই সকল তত্ত্ব বিশদ ভাবে জানা যায়)

জগদীশ্বরের অধিষ্ঠান প্রত্যক্ষীকরণ—কত সদ্‌গুণের সমবায়ে সঞ্জাত হয়, যার সামষ্টি বিবেচনা-শক্তি আছে, তিনিই তা বুঝতে পারেন। গীতার প্রথম লক্ষ্য-কর্ম-সৎকৰ্ম্ম, চরম লক্ষ্য-সৰ্ব্বভূতে সমদৰ্শন-ব্রহ্মদর্শন। সৎকর্মের ফল – কর্মফলত্যাগ; সেই কর্ম-ফলত্যাগেই সৰ্ব্বভুতে আত্মদর্শন; তাহাই মোক্ষ। ফলতঃ, সৰ্ব্বজীবে সমদর্শী হও, সকলকে আত্ম-রূপে নিজের বলে জ্ঞান করা; শান্তি অধিগত হবে, মোক্ষ লাভ করবে।

শান্তি লাভে রাজভক্তি-
শ্ৰীকৃষ্ণের দার্শনিক মত পর্য্যালোচনা করলে, এরকম বেশ উপলব্ধি হয় যে, তিনি লকল সম্প্রদায়ের সকলের সুখ-শান্তি-বিধানের জণ্যই চেষ্টা করে গেছেন। শান্তি রাজ্য-ধর্ম রাজ্য-সংস্থাপন করাই তাহার কাজে ও উপদেশে সৰ্ব্বত্র অভিব্যক্ত। আমরা প্রতিপন্ন করেছি, শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাবের পূর্বে সমাজ-বিপ্লব, নীতি-বিপ্লব ও রাষ্ট্র-বিপ্লবের সূচনা হয়েছিল; সেই বিপ্লবে শান্তি স্থাপনের জন্য শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাব হয়। সেই শান্তি স্থাপনে তিনি যে চেষ্টা পেয়েছিলেন, সে আভাষ পূর্বেই দেওয়া হয়েছে। গীতায় দার্শনিক-তত্ত্ব প্রচারেও তার তেমনি চেষ্টারই পরিচয় পাওয়া যায়। গীতার এক গুঢ় লক্ষ্য-শাস্তিস্থাপন;-সমাজে শান্তি-স্থাপন, রাজ্যে প্রজাদের মধ্যে শান্তি স্থাপন, বিভিন্ন ধর্ম-সম্প্রদায়ের দ্বন্ধ কোলাহলে শান্তি স্থাপন। শ্রীকৃষ্ণের দার্শনিক গবেষণার বিষয় আলোচনা করলে তিনি ধর্মে ও সমাজে কিভাবে শান্তি -স্থাপনে প্রয়াস পেয়েছেন, উপলব্ধি হতে পারে। রাষ্ট্র-বিপ্লবই প্রধানতঃ সমাজ-বিপ্লবের ও নীতি বিপ্লবের মূল। সুতরাং রাষ্ট্র বিপ্লবে শান্তি স্থাপনের লক্ষ্যে গীতোক্ত বাক্যে কি উপদেশ পেতে পারি, প্রথমে অনুসন্ধান করে দেখা যাক।
গীতার কুব্যাখ্যার ফলে ভারতবর্ষে রাষ্ট্র-বিপ্লবকারী দলের উদ্ভব হয়েছে বলে অনেকেই সিদ্ধান্ত করে থাকেন। কিছুকাল হতে গীতার প্রতি তাই এক শ্রেণীর রাজ পুরুষের খরদৃষ্টি নিপতিত আছে। কদর্থকারিরা গীতার যেমন কদর্থেরই সূচনা করুক, গীতার মধ্যে রাষ্ট্র বিপ্লবের ভাব উদ্রেক-মূলক প্সঙ্গ আদৌ উত্থাপিত নেই; পরন্তু রাষ্ট্র বিপ্লব নিবারক শান্তি প্রতিষ্ঠাপক সন্দর্ভই গীতার অস্থি মজ্জা মরুদণ্ডে অন্তর্বাহী শোণিত তরঙ্গে সঞ্চালিত রয়েছে। গীতার শ্লোকে আছে- ‘আত্মার বা জীবের বিনাশ নেই; যুদ্ধই ক্ষত্রিয়ের স্বধর্ম; অতএব তুমি সুখ-দুঃখ লাভালাভ ও জয়পরাজয়কে সমান জ্ঞান করে যুদ্ধে প্রবৃত্ত হও; তাতে তোমার পাপ হবে না। (সুখ দুঃখ সমে কৃত্বা লাভালাভৌ জয়াজয়ো। ততো যুদ্ধায় যুজ্যস্ব নৈবং পাপমবাপ্স্যসি।) সাধারণ দৃষ্টিতে যে অর্থ প্রতিপন্ন হয়, সেই অর্থই মেনে নিলাম। শ্রীকৃষ্ণ কর্তৃক অর্জুনকে যুদ্ধে উৎসাহদানের অভ্যন্তরে যে এক নিগূঢ় শিক্ষা আছে, তা বুঝানোর আবশ্যক এ প্রসঙ্গ দেখি না। তবে গীতার যে অর্থ ধরে উচ্ছৃঙ্খলতার বা রাষ্ট্র বিপ্লব উত্তেজনার আদর্শ প্ততিষ্ঠার প্রয়াস হয়, সেই অর্থের অনুসরণেই আমরা বুঝতে পারি, এ অংশে রাষ্ট্র-বিপ্লব উত্তজনার প্রসঙ্গ কিছুই নেই; বরং রাষ্ট্র-বিপ্লবে শান্তি স্থাপনের প্রয়াসই পরিফুট। এখানে অশান্তির ও শান্তির কারণ কি, বোঝার প্রয়োজন। রাজা যুধিষ্ঠির; রাজ্যে তার ন্যায্য অধিকার; দুর্য্যোধন অধর্মাচরণে তাকে বঞ্চিত করতে চান; যুদ্ধ সেই উপলক্ষে-অশান্তি সেই কারণে। সে অশান্তি দূর হতে পারে কি প্রকার ? যিনি রাজা, যার ন্যায় সঙ্গত অধিকার, তিনি যদি নিজ রাজ্য-নিজ অধিকার প্রাপ্ত হন; তাহলেই অশান্তি দূর হয়। এক দিকে ন্যায্য অধিকার-দান-সচ্চরিত্র সাধু নৃপতির সুপ্রতিষ্ঠা-সাধন; অন্য দিকে কুচরিত্র কদাচারীর অন্যায় কাজে সহায়তা (অর্জুন যদি যুদ্ধ না করে তূষ্ণীম্ভাবাবলম্বনে অবস্থিত থাকেন, তাতেও পরোক্ষভাবে অন্যায় কাকাজে সহায়তা করা হয়) বিবেচনা করে দেখুন, অর্জুনের পক্ষে কোন পথ অবলম্বনীয় ? যুদ্ধে প্রবৃত্ত হওয়াই সর্বতোভাবে তাঁর পক্ষে কর্তব্য; আর সে কর্তব্যপালনে শান্তিই সূচিত হয়। এইবার বুঝা প্রয়োজন, অর্জুন কোন পক্ষে যুদ্ধে প্রবৃত্ত হচ্ছেন। তিনি যুদ্ধে প্রবৃত্ত হচ্ছেন-রাজার পক্ষে; যার ন্যায় সঙ্গত অধিকার-সেই রাজার পক্ষে। তিনি বিপ্লবকারীর দলে মিশে রাষ্ট্র-বিপ্লবে যোগ দিতে প্রবৃত্ত নন; তূষ্ণীম্ভাব অবলম্বনে রাষ্ট্র-বিপ্লবের প্রশ্রয় দিতে ও প্রস্তুত নন। তিনি দেশপতি রাজার পক্ষাবলম্বনে দেশে শান্তি-স্থাপনে বদ্ধপরিকর। রাজার হিতসাধনে চেষ্টা-রাষ্ট্র-বিপ্লব-দমনে প্রয়াস- মোক্ষা অভিলাষী ধার্মিকেরই কৰ্ত্তব্য কর্ম; কেন-না, “নরাণাঞ্চ নরাধিপম্‌” অর্থাৎ শ্ৰীভগবান নরগণের মধ্যে নৃপতিরূপেই অবস্থিত আছেন। * যিনি বলেছেন,- ‘নরগণের মধ্যে নৃপতি-রূপে আমি (ভগবান ) অবস্থিত আছি’; আরও যিনি উপদেশ দিয়েছেন,-“যদি মোক্ষ চাও, আমার (ভগবানের) ভক্ত হও’; এমন উক্তিতে রাজ-দ্রোহিতার ভাব পরিহার করে মানুষ রাজভক্তি পরায়ণ হোক, এই শিক্ষাই প্রাপ্ত হওয়া যায়। অথচ, কি পরিতাপের বিষয়, এমন রাজভক্তি মূলক গীতাশাস্ত্রকে লোকে বিদ্রোহিতা আচরণমূলক বলে মনে করছে! কি ভ্রান্তি! ফলতঃ সকল দিকে সকল প্রকার শান্তি স্থাপনেই শ্রীকৃষ্ণ প্রযন্তপর। বহিরঙ্গের সঙ্গে সঙ্গে অন্তরঙ্গের শান্তি-স্থাপনেই তার দার্শনিক গবেষণা। জ্ঞানমার্গ অনুসারী বিভিন্ন দার্শনিক সম্প্রদায়ের মতের সাথে তার গবেষণার সামঞ্জস্য সাধনের সঙ্গে সঙ্গে তাই আমরা সংক্ষেপে সমাজের বহিরঙ্গে তার শান্তি-স্থাপনের প্রয়াসের বিষয় উল্লেখ করলাম। যে দিক দিয়েই দেখা যাক, শ্রীকৃষ্ণ শান্তি স্থাপনেরই-ঐহিক শান্তি হতে পারলৌকিক পরম শান্তি প্রতিষ্ঠা কল্পেই-প্রযন্তপর ছিলেন। সর্ব বিষয়ে শান্তি-স্থাপনের প্রয়াস ভিন্ন উচ্ছৃঙ্খলতার উত্তেজনায় তিনি কখনও সহায়তা করেন নি।

*গীতার দশম অধ্যায়ে ২৭শ শ্লোকে ‘নরাণাঞ্চ নরাধিপম’ এই যে উক্তি দেখতে পাই (দশম অধ্যায়ের ঐ শ্লোক এবং শ্রী কৃষ্ণ যে ভাবে আত্ম পরিচয় দিতেছেন, সেই সকল শ্লোক, এই খণ্ডের ১৯৫ম পৃষ্ঠার উদ্ধৃত হয়েছে), শ্রীমদ্ভাগবতে ও এই উক্তির প্রতিধ্বনি আছে। শ্রীমদ্ভাগবতের একাদশ স্কন্ধে ১৭শ শ্লোক শ্রীভগবান বলছেন,- ‘তপতাং দ্যুমতাং সূর্য্যাং মনুষ্যানাঞ্চ ভূপতিং’। অর্থা, প্রতাপশালী ও দীপ্তিশালীদের মধ্যে আমি সূর্য্য এবং মানুষের মধ্যে আমি নৃপতি। কেবল শ্রীকৃষ্ণের উক্তিতে নয়; হিন্দু শাস্ত্রে সর্বত্রই রাজার মাহাত্ম্য এইরূপ পরিকীর্ত্তিত আছে। (পৃথিবীর ইতিহাস, প্রথম খণ্ড, ২৯শ পরিচ্ছেদে এ বিষয়ের বিশদ আলোচনা দ্রষ্টব্য)। যে রাজা ঈশ্বরের শ্রেষ্ঠ বিভূতি মধ্যে পরিগণিত, তাঁহার বিরুদ্ধাচরণ-পাপ ও অধর্ম তো বটেই; অধিকন্তু উপহার সহায়তার পক্ষে সচেষ্ট না হয়ে তূষ্ণীম্ভাব অবলম্বনও পাপমূলক। গীতার দশম অধ্যায়ের ২০শ হতে ৪২শ শ্লোকে শ্রীভগবান আপনার বিভূতির যে পরিচয় দিয়েছেন, শ্রীমদ্ভাগবতের ১১শ স্কন্ধে ১৬শ অধ্যায় ৯ম থেকে ৮১শ শ্লোকে সেই পরিচয় দেদীপ্যমান। দুই গ্রন্থ মিলিয়ে পাঠ করলে সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যাবে।

তথ্যসূত্র-
ভারতবর্ষের ইতিহাস, বিশ্বকোষ, পৃথিবীর ইতিহাস(দুর্গাদাস লাহিড়ী)

সংকলনে- শ্রীকৃষ্ণকমল মিন্টু।