নাগপ্রিয়া পঞ্চমী, বা নাগপুজাঙ্গং পঞ্চমী।
আষাঢ়মাসের কৃষ্ণাপঞ্চমী। এই পঞ্চমী তিথিতে মনসা ও নাগপুজা করতে হয়, এজন্য এই পঞ্চমীর নাম নাগপঞ্চমী।
“সুপ্তে জনাৰ্দ্দনে কৃষ্ণে পঞ্চম্যাং ভবনাঙ্গনে।
পূজয়েন্মনসাদেবীং স্নুহীবিটপসংস্থিতাম্॥
পদ্মনাভে গতে শয্যাং দেবৈঃ সর্ব্বৈরনস্তরম্ ।
পঞ্চম্যামসিতে পক্ষে সমুত্তিষ্ঠতি পন্নগী॥” (তিথিতত্ত্ব)
বিষ্ণুর শয়নে কৃষ্ণাপঞ্চমী তিথিতে সিজবৃক্ষ স্থাপন করে মনসা ও নাগপূজা করতে হয়। মনসাদেবীকে পূজা ও নমস্কার করলে সাপের ভয় থাকে না। এই পূজাতে ঘী ও দুধ নৈবেদ্য দিতে হয়।
“দেবীং সম্পূজ্য নত্বা চ ন সর্পভয়মাপ্নুরাৎ।
পঞ্চম্যাং পূজয়েন্নাগাননন্তাদ্যান্ মহোরগান্॥
ক্ষীরং সর্পিন্তু নৈবেদ্যং দেয়ং সর্পবিষাপহম্॥” (তিথিতত্ত্ব)
এই দিনে নিজ ঘরে নিমপাতা স্থাপন করবে এবং ব্রাহ্মণ ও বন্ধুদের সাথে মিলে তা খেতে হয়।
“পিচুমর্দ্দন্ত পত্রাণি স্থাপয়েদ্ভবনোদরে।
স্বয়ঞ্চাপি তদশ্নীয়াৎ ব্রাহ্মণাংশ্চৈব ভোজয়েৎ॥” (তিথিতত্ত্ব)
বরাহপুরাণ থেকে জানা যায়, পঞ্চমী তিথিতে নাগেরা ব্রহ্মার শাপ ও শাপ থেকে মুক্ত হওয়ার উপায় লাভ করে, এ জন্য পঞ্চমী তিথি এদের অত্যন্ত প্রিয়। এই তিথিতে দুধ দিয়ে নাগদেরকে স্নান করালে আর সর্পভয় থাকে না। নাগপঞ্চমী দিনে অনন্ত, বাসুকি, পদ্ম, মহাপদ্ম, তক্ষক, কুলীর, কর্কোট ও শঙ্খ এই অষ্টনাগের পুজা করতে হয়, এই অষ্টনাগ ভিন্ন আরও কতগুলি নাগের নাম উল্লেখ তিথিতত্ত্বে দেখা যায়। যথা- শেষ, পদ্ম, মহাপদ্ম, কুলিক, শঙ্খপালক, বাসুকি, তক্ষক, কালিয়, মণিভদ্রক, ঐরাবত, ধৃতরাষ্ট্র, কর্কোটক, ধনঞ্জয়। (গরুড়পুরাণে) অনন্ত, বাসুকি, শঙ্খ, পদ্ম, কম্বল, কর্কোটক, ধৃতরাষ্ট্র, শঙ্খক, কালিয়, তক্ষক, পিঙ্গল ও মণিভদ্রক এ সকল নাগপূজা করলে সাপের দংশন থেকে মুক্ত অর্থাৎ প্রথমে দংশিত পরে মুক্ত হয়ে স্বর্গলাভ হয়।
“শেষঃ পদ্মো মহাপদ্মঃ কুলিকঃ শঙ্খপালকঃ।
বাসুকিন্তক্ষকশ্চৈব কালিয়ো মণিভদ্ৰকঃ॥
ঐরাবতো ধৃতরাষ্ট্রঃ কর্কোটকধনঞ্জয়ৌ।
গরুড়েঽপি –
অনন্তং বাসুকিং শঙ্খং পদ্মং কম্বলমেবচ।
তথা কর্কোটকং নাগং ধৃতরাষ্ট্রঞ্চ শঙ্খকম্॥
কালিয়ং তক্ষকঞ্চাপি পিঙ্গলং মণিভদ্রকম্।
যজেত্তানসিতান্নাগান্ দষ্টমুক্তোদিবং ব্রজেৎ॥” (তিথিতত্ত্ব )
ভারতের প্রায় সর্বত্র এই ব্রত আচরিত হয়। স্ত্রীলোকেই এই ব্রত করে থাকে। অন্যান্য স্ত্রী-ব্রতের মতো নাগপঞ্চমী ব্রতেরও স্ত্রী-সুলভ ব্ৰত কথা আছে। আশ্চর্যের বিষয় এই, বাংঙালী স্ত্রীরা যেমন কথা বলে থাকেন, বোম্বাইয়ে প্রভু-কায়স্থ রমণীরা নাগপঞ্চমীর ব্রতকথা প্রায় ঠিক তেমনটাই বলেন। এখানে প্রভু-কায়স্থ রমণীদের বলা উপাখ্যানটি সংক্ষেপে তুলে ধরা হল :-
ব্রতের দিন প্রভুরমণীরা একটি কাঠের চৌকিতে চন্দন বা সিন্দুর দিয়ে ৯টা সাপের-চিত্র অংকন করে। এর মধ্যে দুইটি বড়, আর সাতটি ছোট। এদের পাদমূলে আর একটি লেজহীন ক্ষুদ্র সাপ আঁকে। তার কাছেই দীপহন্তা এক স্ত্রীমূর্তিও আঁকে। তার পাশেই একটি পাথরের টুকরা এবং একটা সাপের- বিবরও আঁকা হয়। বিবাহিতা রমণীরা প্রত্যেকে একে একে এই সর্গ-চিত্রের উপর ভাজা শসা, কলাই, কলার টুকরা, ফুটির টুকরা ও নারকেলের টুকরা দিয়ে থাকে। পাতার ঠোঙায় করে দুধ দেয়। তারপর ফুল চন্দন সিন্দুর দিয়ে পূজা করেন। পূজার পর সকলে মিলে সাপের কাছে পরিবারবর্গের মধ্যে কারও যেন সাপ থেকে অনিষ্ট না হয় এবং বাড়ীতে সাপের ভয় যেন না থাকে এই বর প্রার্থনা করে। তারপর গৃহিণী, কন্যা, বধূ প্রভৃতিকে একত্র করে ব্রতের কথা বলতে বসেন। ব্রতকথা এমন-
এক মণ্ডলের সাতজন পুত্রবধূ ছিল। ছোট বউটার বাপ মা ছিল না, সুতরাং বাড়ীর সমস্ত কাজ কর্ম সকলে তাকে দিয়েই করাত এবং পাঁচ জনের খাবারের অবশিষ্ট
খেতে দিত। এক দিন পুকুরঘাটে সাতটা বউ স্নান করতে গেল। বড় ছয় বউ পিতামাতাহীন সপ্তম বধূকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলতে লাগল, আমাদের বাপ ভাই আছে, তারা আমাদেরকে নিমন্ত্রণ করে নিয়ে যেতে এসেছে।
ছোট বউটা এই সকল শুনে মুখ ম্লান করে রইল। যেখানে তারা এ সকল কথা বলছিল, তার কাছেই এক সাপের গর্ত ছিল। এই গর্তবাসী সাপ ও সাপিনী তখন গর্তের মুখে থেকে তাদের সমস্ত কথা গুলি শুনল। সাপিনী তখন গর্ভিণী। সাপ বলল, তোমার এই অবস্থায় সেবার জন্য একজন লোকের আবশ্যক, এই পিতামাতাহীনা মনুষ্যকন্যাকে আমি নিয়ে আসি। আমি এর ভাই পরিচয় দিয়ে একে নিমন্ত্রণ করে আনব এবং তোমার প্রসবকাল পর্যন্ত এখানে রেখে পরে পাঠাবো। সাপিনী সম্মত হলে এক দিন অপরাহ্ণে ঐ ছোট বউটা গোরু চরাতে আসলে সাপ এক দিব্য যুবক মূৰ্ত্তি ধারণ করে এসে বলল, ভগ্নি! আমি তোমার ভাই, দূরদেশে ছিলাম, সুতরাং এত দিন তোমার খোঁজ খবর নিতে পারিনি। তুমি যখন শিশু ছিলে, তখন আমি বিদেশে গিয়েছিলাম, সুতরাং তুমি আমাকে কখন দেখনি। যাহোক এক দিন আমি তোমার শ্বশুর বাড়ী গিয়ে তোমাকে নিয়ে আসব। তুমি প্রস্তুত থেকো। একদিন বাড়ীর সবার খাওয়া হয়ে গেলে খাবারের অবশিষ্ট তুলে রেখে ছোট বউ বাসন মাজতে ও স্নান করতে গেল। ইতিমধ্যে সেই সাপ এসে সেই খাবার খেয়ে ফেলে। ছোট বউ স্নান করে এসে দেখে, তার খাওয়ার উচ্ছিষ্ট খাবার কয়টাও কে যেন খেয়ে ফেলেছে, তখন সে ভোক্তাকে গালি না দিয়ে বলল, আহারে কারো হয়তো ক্ষুধা পেয়েছিল, যেই বা খেয়েছে, তার ক্ষুধা শীতল হোক। সাপ এমন সহৃদয়তার কথা শুনে আনন্দিত হয়ে সেদিনই বউটাকে আনার জন্য স্বামীকে অনুরোধ করল। সাপ আগের মতো মানুষের আকার ধারণ করে মণ্ডলের বাড়ী গেল এবং নিজেকে মণ্ডলের কনিষ্ঠা বধূর ভাই পরিচয় দিয়ে তাকে নিয়ে যেতে চাইল। মণ্ডল অসম্মত হল না । ছোট বধূ এই নূতন ভাইয়ের সাথে নিঃসন্দেহ চলে গেল। পথে সাপ বধূকে নিজের প্রকৃত পরিচয় দিল এবং বলল, গর্তে প্রবেশের সময় সে সাপের রূপ ধারণ করবে এবং বউটা যেন তার লেজ ধরে থাকে যাতে করে অনায়াসে সাপের গর্তে প্রবেশ করতে পারবে। এবং সেটাই হল। বউটা গর্তে প্রবেশ করে দেখল, সুবর্ণময় প্রাসাদে রত্ন-খচিত দোলায় গর্ভিণী সাপিনী শুয়ে আছে। বউটা আসামাত্রই সাপিনীর সাতটা সন্তান ভূমিষ্ঠ হল। বউটা একটি দীপ হাতে যেমনি সেগুলিকে দেখতে গেল, অমনি একটা সদ্যজাত শিশু সাপ লাফিয়ে তার গায়ে উঠল। বউটা ভয়ে চমকে উঠল, হাতের দীপ পড়ে গেল এবং তার আঘাতে একটা শিশুর লেজ কেটে গেল। এই শিশুগুলি বড় হলে পূর্ণ দেহ ছয়টা সাপ লেজহীন সাপটাকে উপহাস করতে লাগিল। সে তখন জাতক্রোধ হয়ে সেই বধূকে দংশন করবে এমটা স্থির করল এবং একদিন সেই উদ্দেশে মণ্ডলের বাড়ীটে প্রবেশ করল। সেদিন ছিল নাগপঞ্চমী। যখন নিজ ঘরে বসে ছোট বউ নাগপঞ্চমীর ব্রত করে সাপেদের উদ্দেশে দুধ কলা উৎসর্গ করছে, এমন সময় জাতক্রোধ শিশু সাপ সেখানে উপস্থিত হল, কিন্তু মানবীকে সাপের পূজা করতে দেখে তার ক্রোধ দূর হল, তারপরে তার দেওয়া খাবার খেয়ে চলে গেল। সে পিতামাতাকে সমস্ত বিবরণ বলিল। সাপ ও সাপিনী শুনে পরম উল্লাসিত হয়ে বধূকে বিস্তর ধন রত্ন দান করল এবং বহু পুত্রবতী হওয়ার বর দিল।
এই পুণ্যকথা শুনে প্রভুরমণীরা সকলে চাউলের লাড্ডু ভোজন করে। পুণা প্রভৃতি স্থানে ঐ দিন সর্পনর্তকেরা গৃহস্থের বাড়ি বাড়ি গিয়ে নিজেদের সাপের পূজা করায়। গৃহস্থকামিনীরাও এ সকল জীবিত সাপদেরকে দুধ, কলা, ভাজা শস্য কলাই ইত্যাদি খেতে দেয় ও প্রত্যেকে একটা করে পয়সা দেয়। ঐ দিন প্রভুরমণীরা পাতার ঠোঙায় গৃহকোণে সাপেদের উদ্দেশে দুধ রেখে দেয় এবং পাছে সাপের কোন ক্ষতি না হয়, সে দিন জাঁতা পেসা, রান্না, শস্য ভাঁজা ইত্যাদি কাজ করে না।
বাংলা দেশের নাগপঞ্চমী ব্রতকথার একটু ভেদ আছে।
সাতারা অঞ্চলেও নাগপঞ্চমীর খুব ধুমধাম হয়। এই প্রদেশে অনেকগুলি গ্রামে সাপের-মন্দির আছে। যেখানে সাপের মন্দির আছে, সেখানে স্ত্রীলোকেরা মাটির সাপ বা কাঠের আসনে চন্দন ও সিন্দুরে অঙ্কিত সাপের-চিত্র ও পূজার দ্রব্য নিয়ে ঐ মন্দিরে উপস্থিত হয়। এই সকল স্ত্রীরা সাপের গর্ত দেখলে পরস্পর হাত ধরে সেখানে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করে এবং সেই গর্ভে দুধ কলা দেয়। বত্তিশা-সিরালেন নামের নগরে নাগকুলি নামে এক জাতীয় সাপ আছে, তাদের বিষ তত অনিষ্টকর নয়। সেখানকার লোকে নাগপঞ্চমীর আগের দিন এই সাপ ধরে হাঁড়িতে রাখে। পূজার দিন তাকে খেতে দেয় এবং পর দিন আবার বনে ছেড়ে দেয়।
দাক্ষিণাত্যে অনেক স্থানে নাগ মন্দির আছে। মাদ্রাজ শহরেই সর্বাপেক্ষা বেশী। মাদ্রাজের উপকণ্ঠে বসরাপাড় গ্রামে এক বৃহৎ নাগমন্দির আছে। সেখানে প্রতি রবিবার সকালে ব্রাহ্মণ-রমণীরা পূজা দিতে যায়। এখানকার পূজক বন্যয়েনড়ি জাতীয়।
নিবেদনে- কৃষ্ণকমল
You must be logged in to post a comment.