ঈশ্বর!
ঈশ্বর এক, অব্যয় ও অদ্বিতীয়। তিনি অনাদির আদি। এক হয়েও তিনি বহুদা বিভুতিতে প্রকাশ। যেমন তিনি একদিকে সৃষ্টি কর্তা ও স্হিতি কর্তা, অন্যদিকে দিকে তিনি প্রলয়েরও কর্তা। ঈশ্বর হল জাগতিক ক্ষমতার সর্বোচ্চ অবস্থানে অবস্থানকারী কোন অস্তিত্ব| আর্যদের স্মৃতি শাস্ত্রে মূলতঃ ঈশ্বর বিষয়ে এভাবেই ধারণ দেয়া আছে। এই মহাবিশ্বের জীব ও জড় সমস্তকিছুর সৃষ্টিকর্তা ও নিয়ন্ত্রক আছে মনে করা হয়। ঈশ্বরের ধারণা ধর্ম ও ভাষা ভেদে ভিন্ন। ভাষাভেদে একে ইংরেজি ভাষায় গড, আরবি ভাষায় আল্লাহ এবং বাংলা ও সংষ্কৃত ভাষায় ঈশ্বর ইত্যাদি শব্দ ব্যবহৃত হয়। পরম একেশ্বর ভগবানকে কখনো হরি, কখনো বিষ্ণু, কখনো নারায়ন, কখনো কৃষ্ণ আবার কখনো না রাম বলে সম্মোধন করা হয়।
ভগবান!!
“ভগ” ও “বান” – এদুটি শব্দের সন্ধির ফলে মূলতঃ ভগবান শব্দের উদ্ভব হয়েছে। “ভগ” শব্দটি গুনবাচক উপসর্গ এবং “বান” শব্দের অর্থ হলো অধিকারী কিংবা যার আছে অর্থে বুঝায়। “বান” শব্দের পূর্বে গুনবাচক উপসর্গ “ভগ” শব্দটি বসানোর পর একত্রে “ভগবান” শব্দটি এসেছে। বান শব্দের আগে ভগ শব্দ বসানো হয়েছে যেমনটা রূপবান, যার ধনবান শব্দটির সৃষ্টি হয়েছে ঠিক একভাবে। ‘ভগ’ অর্থ ঐশ্বর্য্য এবং ‘বান’ অর্থ অধিকারী, যার আছে। ঠিক যেভাবে যার সুন্দর রূপ আছে – আমরা তাকে বলি রূপবান, যার ধন আছে ধনবান, ঠিক তদ্রুপ যিনি ভগ অর্থাত্ ঐশ্বর্যের অধিকারী তাকে বলে ভগবান । পরাশর মুনি ভগবান শব্দের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছেন-
ঐশ্বর্য্যস্য সমগ্রস্য বীর্যস্য যশসঃ শ্রিয়ঃ ।
জ্ঞানবৈরাগ্যয়োশ্চৈব ষন্নত্ ভগ ইতিঙ্গনা ॥
যার মধ্যে সমস্ত ঐশ্বর্য্য, সমস্ত বীর্য্য, সমস্ত যশ, সমস্ত শ্রী, সমস্ত জ্ঞান এবং সমস্ত বৈরাগ্য এই ছয়টি গুন পূর্ণমাত্রায় বর্তমান, তিনি হচ্ছেন ভগবান। এই জগতে কেউ বড় ধনী হতে পারে, কিন্তু কেউ দাবী করতে পারেনা আমি সমস্ত ধনের মালিক। এই জগতে কেউ জ্ঞানী হতে পারে ,কিন্তু তিনি দাবী করতে পারে না সমস্ত জ্ঞানের অধিকারী। কিন্তু ভগবান সমস্ত ধন ,সমস্ত জ্ঞান ,সমস্ত সৌন্দর্য্য, সমস্ত যশ ,সমস্ত শক্তির অধিকারী, তাই তাকে বলা হয় ভগবান । সুতরাং কোন ব্যক্তির মধ্যে এছ’টি গুনের পূর্ণ বিকাশ (আংশিক নয়) দেখা গেলে তাকে ভগবান সম্মোধন করতে বাঁধা নেই। মূলতঃ একারনে সনাতন ধর্মে বহু মুনি, মহামুনি, ঋষি, মহাঋষিদের নামের আগে ভগবান শব্দটির ব্যবহার হতে দেখা যায়।
দেবতা!!!
দেবতা শব্দের অর্থ হলো যাদের মানে ও দানে আমরা পুষ্ট। প্রকৃতির যে সকল উপাদান বা পরমেশ্বর সৃষ্ট বিভুতি জীবের জীবনধারাকে সর্বদা মসৃন করে রাখে এবং তাদের দানে জীব তথা মানুষ পুষ্ট থাকে – এরাই মূলতঃ দেবতা। দেবতাদের মাতৃরুপ বা বিপরীত লিঙ্গের চিন্তনই হলো দেবী। এজন্য দেবতা কিংবা দেবীদের এক এক শক্তির উৎস এবং এক একটি শক্তির ধারণ রুপে পূজো করতে দেখা যায়। কথায় কথায় হিন্দুদের সংখ্যায় ৩৩কোটি দেব ও দেবীর কথা বলা হয়। আসলে ব্যাপাটা ঠিক নয়। মূলতঃ ৩৩ প্রকারের দেবতার কথা শ্রুতি ও স্মৃতি শাস্ত্রে আছে। যে গুলো মধ্যে-
(ক) ১২ প্রকার আদিত্য (ধাতা, মিত, আর্যমা, শুক্রা, বরুন, অংশ, প্রত্যুষ, ভাগ, বিবস্বান, পুষ, সবিতা, তবাস্হা)।
(খ) ০৮ প্রকার বসু (ধর, ধ্রুব, সোম, অহ, অনিল, অনল, প্রত্যুষ এবং প্রভাষ)।
(গ) ১১ প্রকার রুদ্ধ (হর, বহুরুপ, ত্রয়ম্বক, অপরাজিতা, বৃষাকাপি, শম্ভু, কপার্দী, রেবাত, মৃগব্যাধ, শর্বা এবং কাপালী) ও
(ঘ) ০২ প্রকারের ভ্রাতা (অশ্বিনী ও কুমার)
সুতরাং সর্বমোট (১২+০৮+১১+০২)= ৩৩ প্রকার বা শ্রেণীর দেবতা কিংবা দেবীর পুজো করা হয়, যারা প্রত্যেকেই কোন না কোন শক্তির স্বরুপ বা স্বরুপিনী এবং প্রকৃতিতে সেসব শক্তির কারণেই মানুষের জীবন মসৃন থাকে।
সুতরাং (১) পরমেশ্বর ভগবান, (২) ভগবান ও (৩) দেবতা/দেবী – এক নয়, যদিও ইংরেজীতে ঈশ্বর, ভগবান ও দেবতাকে একত্রে GOD বলা হয়।(অরুন চন্দ্র মজুমদার)