শ্রীকৃষ্ণের ধর্ম ও কর্ম


Image result for sri krishna

ভাদ্র মাসের কৃষ্ণাষ্টমী শ্রীকৃষ্ণের জন্মতিথি। এদিন তিনি পৃথিবীর ভার মোচনের জন্য অবতাররূপে আবির্ভূত হয়েছিলেন। তিনি পূর্ণাবতার, স্বয়ং ভগবান— কৃষ্ণস্তু স্বয়ং ভগবান্। পৃথিবীকে ভারমুক্ত করার জন্য এর আগেও তিনি একাধিকবার এসেছিলেন। এ সম্পর্কে গীতায় তাঁর ‘যদা যদা হি … সম্ভবামি যুগে যুগে’ উক্তিটি সবারই জানা। কৃষ্ণরূপে জন্ম নিয়ে তিনি শিশু অবস্থায় শিশুঘাতিনী পূতনাকে বধ করেন। একে একে বকাসুর, অঘাসুর এবং আরো অনেক অসুরকে বধ করেন। কৈশোরে বধ করেন মথুরার অত্যাচারী রাজা, তাঁর মাতুল কংসকে, যে নিজের পিতা উগ্রসেনকে বন্দি করে সিংহাসন দখল করেছিল। যৌবনে তিনি মধ্যম পাণ্ডব ভীমকে দিয়ে বধ করান অত্যাচারী মগধরাজ জরাসন্ধকে। এর পর তিনি নিজে বধ করেন দুর্বৃত্ত চেদিরাজ শিশুপালকে, যে সম্পর্কে ছিল তাঁরই পিশতুত ভাই। এভাবে তিনি একে একে ভারমুক্ত করে পৃথিবীকে সজ্জনের বাসোপযোগী করে তুলছিলেন। কিন্তু এমন সময় সবচেয়ে বড় ভাররূপে আবির্ভূত হয় কুরুরাজ দুর্যোধন, তাঁরই আত্মীয়— পিশতুত ভাই যুধিষ্ঠির-ভীম-অর্জুনের জ্যাঠতুত ভাই। তিনি তাকে অনেক বুঝিয়েছেন, আত্মশুদ্ধির অনেক সুযোগ দিয়েছেন। কিন্তু ‘চোর না শোনে ধর্মের কাহিনী’, ‘অঙ্গারঃ শতধৌতেন মালিন্যং ন মুঞ্চতি’। তাই ভারতযুদ্ধ অনিবার্য হয়ে ওঠে। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধক্ষেত্রে কৌরব ও পাণ্ডবরা মুখোমুখি। অর্জুন সারথি শ্রীকৃষ্ণকে বললেন, রথটা উভয় সেনাদলের মাঝখানে নিয়ে যেতে। কারণ তিনি দেখতে চান অপরপক্ষে যুদ্ধের জন্য কারা উপস্থিত হয়েছেন। তিনি দেখলেন— ভীষ্ম, দ্রোণ প্রমুখ একান্ত আপনজনেরা উপস্থিত। যুদ্ধে জয়লাভ করতে হলে অর্জুনকে এঁদের হত্যা করতে হবে। তাঁর বুক কেঁপে উঠল। তিনি তীরধনু ফেলে রথের ওপর বসে পড়লেন। তিনি শ্রীকৃষ্ণকে বললেন যুদ্ধ করবেন না। স্বজনদের হত্যা করে রাজ্যলাভে তাঁর প্রয়োজন নেই। এর চেয়ে ভিক্ষা করে কিংবা বনের ফলমূল খেয়ে জীবন ধারণও অনেক ভালো। তখন ভগবান গর্জে উঠলেন, ‘ক্লৈব্যং মাস্ম গমঃ পার্থ নৈতৎ ত্বয্যুপপদ্যতে। ক্ষুদ্রং হূদয়দৌর্বল্যং ত্যক্ত্বোত্তিষ্ঠ পরন্তপ’— হে অর্জুন! এরূপ পৌরুষহীনতা তোমাতে শোভা পায় না; তুমি ক্ষত্রিয়, তাই হূদয়ের ক্ষুদ্র দুর্বলতা ত্যাগ করে উঠে দাঁড়াও, যুদ্ধ করো।

এর পর ভগবান অর্জুনকে আরো তীব্র আঘাত করলেন। তিনি বললেন, ‘স্বধর্মমপি চাবেক্ষ্য ন বিকম্পিতুমর্হসি। ধর্ম্যাদ্ধি যুদ্ধাচ্ছ্রেয়ো  ন্যৎ ক্ষত্রিয়স্য ন বিদ্যতে’— হে অর্জুন! তুমি যদি তোমার নিজের ধর্মের কথাও চিন্তা করো, তাহলেও তোমার কম্পিত হওয়া উচিত নয়, কারণ ধর্মযুদ্ধ ছাড়া ক্ষত্রিয়ের অন্য কোনো শ্রেষ্ঠ কাজ নেই।

লক্ষণীয় যে, ধর্ম বলতে আমরা যা বুঝি, ভগবান এখানে তা বোঝাননি। তিনি ধর্ম বলতে বুঝিয়েছেন যার যার পেশাকে। তাঁর মতে নিজ নিজ পেশাগত দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করাই ধর্ম। সে-মতে অধ্যাপকের ধর্ম অধ্যাপনা, ছাত্রের ধর্ম অধ্যয়ন, কৃষকের ধর্ম কৃষিকাজ ইত্যাদি। এই ধর্ম পালনে যে ব্যর্থ হয়, তার অস্তিত্ব বিপন্ন হয়। আগুনের ধর্ম উষ্ণতা। উষ্ণতা হারালে আগুন আর আগুন থাকে না। জলের ধর্ম তরলতা। তারল্য হারালে জল আর জল থাকে না। তেমনি ক্ষত্রিয়ের ক্ষাত্রধর্ম হারালে সে আর ক্ষত্রিয় থাকে না। অর্থাৎ, পেশাগত দায়িত্ব পালনে অবহেলা বিপর্যয় ডেকে আনে।

এ প্রসঙ্গে ভগবান আরেকটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন, ‘শ্রেয়ান্ স্বধর্মো বিগুণঃ পরধর্মাৎ স্বনুষ্ঠিতাৎ। স্বধর্মে নিধনং শ্রেয়ঃ পরধর্মো ভয়াবহঃ’— নিজের ধর্ম যেমনই হোক তা পরের ধর্মের চেয়ে শ্রেষ্ঠ; স্বধর্মে নিধনও ভালো, কিন্তু পরধর্ম ভয়াবহ। এর অর্থ— আমার যে পেশা, আমার বিজ্ঞতা সেখানেই; সেটা ছেড়ে অন্যের পেশায় হাত লাগালে দুটোই বিপর্যস্ত হবে। এটাই অধর্ম। শ্রীকৃষ্ণের এ উপদেশ কেবল অর্জুনের ক্ষেত্রেই নয়, সর্বকালের সবার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য— ধর্ম-বর্ণ-জাতি-শ্রেণী নির্বিশেষে। পারত্রিক জীবনের কথা বাদই দিলাম, জাগতিক জীবনেই এ উপদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালনীয়।

ভগবান অর্জুনকে আরো বলেছেন, এ যুদ্ধ তুমি কেবল তোমার জন্য করছ না, করছ বৃহতের জন্য। ক্ষুদ্রতা বা ব্যষ্টির স্বার্থপরতার স্পর্শ না থাকলে কোনো কাজ দুষ্ট হয় না। সমষ্টির স্বার্থে তখন তা মহত্ত্ব লাভ করে। এর জন্য ত্যাগ প্রয়োজন। ত্যাগই ভোগের দরজা খুলে দেয়। সে ভোগ আনন্দের, সকলের। একলার ভোগ পরিণামে কষ্টদায়ক। কাজেই তুমি ওঠো, জাগো, যুদ্ধ করো, এ পৃথিবীকে সুন্দর করো, আনন্দময় করে তোলো, ‘তস্মাদুত্তিষ্ঠ কৌন্তেয় যুদ্ধায় কৃতনিশ্চয়ঃ’।

ভগবানের এসব উপদেশ হূদয়ঙ্গম করে অর্জুনের মোহ কেটে যায়। সব রকমের দৌর্বল্য পরিহার করে তিনি যুদ্ধে ব্রতী হন। দুর্যোধনাদি দুষ্কৃতিকারীরা বিনাশপ্রাপ্ত হয়। পৃথিবী ভারমুক্ত হয়। ব্যষ্টি নয়, সমষ্টি অখণ্ড আনন্দ লাভ করে। ভগবান কার্য সমাপনান্তে স্বস্থানে গমন করেন।

‘ভক্তের ভগবান’ বলে একটি কথা প্রচলিত আছে। এর একটি অর্থ হতে পারে— ভক্ত যেভাবে কামনা করে, ভগবান সেভাবেই তার কাছে ধরা দেন। ভগবান তখন ঘরের একজন হয়ে যান। ভক্তে আর ভগবানে কোনো অন্তর থাকে না। এরূপ ঘনিষ্ঠতায় ভালোবাসা জন্মে। ভালোবাসা পরস্পরকে প্রিয়তম করে। শ্রীকৃষ্ণ ভক্তদের কাছে তেমনই একজন। তাইতো মা যশোদার কাছে তিনি কানাই, গোপবালকদের কাছে তিনি গোপাল, গোপ-গোপীদের কাছে তিনি বল্লভ, সুদামার কাছে তিনি বয়স্য এবং অর্জুনের কাছে তিনি সখা। তিনি নিজেই বলেছেন, ‘যে যথা মাং প্রপদ্যন্তে তাংস্তথৈব ভজাম্যহম্’— যে আমাকে যেভাবে পেতে চায়, আমি সেভাবেই তার বাসনা পূরণ করি। এজন্যই তাঁর প্রতি সবার ভক্তির চেয়ে ভালোবাসা অধিক। তাই রাম সবার ভক্তির ধন, আর শ্রীকৃষ্ণ ভালোবাসার ধন।

শ্রীকৃষ্ণ কথা প্রসঙ্গে সমাজবিজ্ঞান বা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের একটি অত্যন্ত মূল্যবান ও বাস্তব কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, ‘চাতুর্বর্ণ্যং ময়া সৃষ্টং গুণকর্মবিভাগশঃ’— গুণ ও কর্মের বিভাগ অনুসারে আমি চারটি বর্ণ সৃষ্টি করেছি। বর্ণ চারটি হলো— ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র। ব্রাহ্মণের গুণ ও কর্ম অধ্যয়ন ও অধ্যাপনা করা, ক্ষত্রিয়ের দেশ রক্ষা করা, বৈশ্যের ব্যবসা-বাণিজ্য ও কৃষিকাজ করা এবং বাকি সব শূদ্রের কাজ। শ্রীকৃষ্ণের মতানুসারে এ গুণগুলোর যেটি যার মধ্যে থাকবে, সে সেই বর্ণের অন্তর্ভুক্ত হবে। অর্থাৎ, বর্ণ কর্ম অনুসারে, জন্ম অনুসারে নয়। আধুনিক সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থায়ও এরূপ পেশাগত শ্রেণীভেদ অনস্বীকার্য। একটি রাষ্ট্র বা সমাজ সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হতে হলে এরূপ বর্ণবিন্যাস একান্ত আবশ্যক। এর কোনো বিকল্প নেই।

ভগবান স্বজনদের মৃত্যুতে ভীত না হওয়ার জন্য অর্জুনকে বলেছিলেন, জীবের মৃত্যু নেই। জীব অজর, অমর এবং শাশ্বত; শরীর বিনষ্ট হলেও এর বিনাশ নেই, ‘অজো নিত্যঃ শাশ্বতো  য়ং পুরাণো/ ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে’ এটি ঔপনিষদিক দর্শনের কথা। কিন্তু এরও একটি প্রায়োগিক দিক আছে। দর্শনের চেয়ে তার মূল্য কম নয়। সেটি হলো আত্মদর্শন বা আত্মচেতনা লাভ। ভগবানের এ কথার অর্থ হলো— আমরা যাকে জীব বলি, উপনিষদের ভাষায় তাকে বলা হয় জীবাত্মা। এই জীবাত্মা ও পরমাত্মা এক— সসীম আর অসীম। প্রত্যেকের মধ্যেই জীবাত্মা আছে, যা পরমাত্মার অংশ। এই চেতনা লাভ হলে সে আর নিজেকে কারো চেয়ে ছোট বা ক্ষুদ্র মনে করবে না। তার মধ্যে কোনো সংকোচ বা হীনম্মন্যতা থাকবে না। সে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে। দৃঢ়চিত্তে আপনার অধিকার ব্যক্ত করবে। আবার একই আত্মা সবার মধ্যে বিরাজমান— এ কথা চিন্তা করে সে কাউকে আঘাতও করবে না। স্বামী বিবেকানন্দ নিজ দেশে অবহেলিত আমেরিকা প্রবাসী এক আইরিশ যুবকের সঙ্গে পরিচিত হয়ে এই আত্মচেতনা লাভের কথাই বলেছিলেন। তিনি একেই বলেছিলেন ‘প্র্যাকটিকাল বেদান্ত’, যা মানুষকে ইহ জগতেই মোক্ষের সন্ধান দেয়।

ভগবান শ্রীগীতায় অর্জুনকে এসব কথা বলেছিলেন। তাই বিশাল মহাভারতের একটি অংশ হওয়া সত্ত্বেও গীতা স্বতন্ত্র দার্শনিক গ্রন্থের মর্যাদা পেয়েছে। এজন্য গীতার মাহাত্ম্যে বলা হয়েছে, ‘গীতা সুগীতা কর্তব্যা কিমন্যৈঃ শাস্ত্রবিস্তরৈঃ। যা স্বয়ং পদ্মনাভস্য মুখপদ্মাদ্বিনিঃসৃতা’

ড. দুলাল ভৌমিক

লেখক: অধ্যাপক, সংস্কৃত বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

নন্দোৎসব


 

শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা স্কুল's photo.
শ্রীকৃষ্ণের জন্মাষ্টমীর পরই হয় নন্দোৎসব। আনন্দময় ভূমা পুরুষ করুণায় মাখা মনুষ্য হইয়া ভূভারহরণ, ধর্মসংস্থাপন এবং রাগমার্গের ভজন প্রবর্তনের জন্য ভূমিতে অবতরণ করিলেন। প্রথমে দেবকী-বসুদেব-নন্দনরূপে কংস কারাগারে, পরে বসুদেব কর্তৃক বৃন্দাবনে নন্দরাজার গৃহে আনীত হইলেন যশোদানন্দন নামে।
শ্রীকৃষ্ণযামল ও হরিবংশ গ্রন্থে এক মধুর সংবাদ আছে- ভাদ্রের একই কৃষ্ণাষ্টমী তিথিতে অর্ধরাত্রে একই সময় মা দেবকী ও মা যশোদা উভয়েরই নিকট তিনি আবির্ভূত হইয়াছিলেন। যশোদার নিকট স্বয়ং ভগবান শ্রীকৃষ্ণরূপে এবং দেবকীর নিকট নিজেরই অন্য মূর্তি বাসুদেবরূপে তিনি আবির্ভূত হইলেন। আবার যশোদার নিকট তাঁহার আবির্ভাবের পরই যমজ একটি কন্যাও আবির্ভূত হইলেন। কন্যাটির নাম যোগমায়া দূর্গাদেবী। তাঁর আবির্ভাব অষ্টমী শেষে নবমী তিথির আরম্ভে। বসুদেব যশোদার শয্যায় বাসুদেবকে রাখিলে তিনি যশোদা-নন্দনের সহিত একীভূত হইলেন আর কারাগারে দেবকীর শয্যায় যোগমায়াকে রাখিলেন।
পুত্রজন্মে নন্দ মহারাজা, গোপ-গোপী সকলের আনন্দ হইল। কত দান, প্রসাধন, নৃত্যগীতাদি ও ভূরিভোজন হইল। নন্দ মহারাজ পুত্রজন্মের জন্য এই মহোৎসব স্মরণে ভারতবর্ষের হিন্দুগন ভগবানের জন্মতিথিকৃত্যের পরদিন আজও উৎসব করিয়া থাকেন। নন্দোৎ আনন্দোৎসব। কৃষ্ণজন্মাষ্টমী তিথির অপূর্ব তাৎপর্য ও অভিনব বার্তা। প্রতি বৎসর ভাদ্রের কৃষ্ণপক্ষের অষ্টমী তিথিতে ভক্তগণের স্মৃতিপথে উপস্থিত হয়। যিনি বাক্য ও মনের অগোচরে পরব্রহ্ম পুরুষ তিনি অনুগ্রহ করিয়া পৃথিবীতে অবতীর্ণ হইয়া মনুষ্য দেহে মনুষ্যের মত কত ক্রীড়া করিয়াছেন। যিনি ‘ভয়ং ভয়ানাং ভীষণং ভীষাণাণাং’,যিনি পাপী দুরাচার দুষ্টগণের শাস্তা, যিনি সর্বলোকমহেশ্বর, বিরাট পরমেশ্বর তিনিই আবার প্রভু, সখ্য, পুত্র ও প্রাণপতিরূপে প্রেম আস্বাদন করিয়া ভক্তকেও প্রেমাণর্বে নিমগ্ন করিয়াছেন। ক্ষুধা পিপাসা, ভয় ও দুঃখের অতীত হইয়াও ক্ষুধিত তৃষ্ণার্ত, ভীত কম্পিত ও ক্রন্দনরত হইয়া অপূর্ব অভূতপূর্ব প্রেমলীলা দেখাইয়াছেন। তাঁহার এই সকল লীলামৃত আস্বাদন করিয়া কলিহত জীব মায়ার কবল হইতে মুক্ত হইয়া তাঁহাকে লাভ করিতে সমর্থ হইবে। এই জন্যই তাঁহার এই ভূবন পাবনী লীলার প্রকাশ। বৃদ্ধ নন্দ মহারাজ আত্মজ লাভ করিয়া আহ্লাদিত চিত্তে উৎসব করিয়াছিলেন বলিয়া আনন্দবিগ্রহ নন্দনন্দেরএই জন্মোৎসবটি ‘নন্দোৎসব” নামে বিখ্যাত। এই শব্দটির অন্য অর্থ আছে। শ্রীকৃষ্ণের জন্ম হইতে প্রায় প্রতিটি লীলার মধ্যে যে শক্তির খেলার পরিচয় আছে, সর্বশক্তিমান ভগবানের উৎসবের তাঁহার সেই উন্মুখমোহিনী অঘটনঘটন পটীয়সী যোগমায়া শক্তির উৎসবও এই নন্দোৎসবের দিন অনুষ্ঠেয়। নন্দার উৎসব এই অর্থেও নন্দোৎসব শব্দ নিষ্পন্ন হয়। শ্রীশ্রীভগবতী যোগমায়া দূর্গাদেবীর আর এক নাম নন্দা। মার্কেন্ডেয় পুরাণে দেবীর মূর্তির রহস্যের মধ্যে এই নাম উল্লিখিত হইয়াছে। “নন্দা ভগবতী নাম যা ভবিষ্যতি নন্দজ”। এই নন্দতনয়া নন্দাদেবী চণ্ডীতে “নন্দগোপাগৃহে জাত যশোদাগর্ভস্মভবা” বলিয়া উক্ত হইয়াছেন। ইনি কৃষ্ণানুজা এবং কংস তাঁহাকে
শিলাপৃষ্ঠে নিক্ষেপ করিলে তাঁহার হস্তচুত্য হইয়া মস্তকে পদাঘাত করিয়া আকাশে
‘সায়ূধাষ্ট মহাভূজা’ রূপে দর্শন দিয়াছিলেন তৎপর এই মহাদেবী দূর্গা, কামাখ্যা ও
বিন্ধ্যবাসিনী নামে পূজিতা হইয়া আসিতেছেন। ভগবান আবির্ভূত হইবার পূর্বে তাঁহার এই মহাশক্তিকে ব্রজধামে আসিয়া লীলারআসর প্রস্তুত্ত করিতে আদেশ দিয়াছিলেন। গচ্ছ দেবী ব্রজং ভদ্রে। ভাগবতে ভবিষ্যপুরাণে শ্রীকৃষ্ণ জন্মাষ্টমী ব্রতকথার মধ্যে আদেশ আছে- তাঁহার জন্মোৎসবের ন্যায় ভগবতীর জন্মোৎসব করিতে হইবে। ভগবান ও ভগবতী উভয়েরই মহোৎসব নন্দোৎসব দিবসে অবশ্য করণীয়। হরে কৃষ্ণ।
পন্ডিতপ্রবর জ্যোতির্ময় নন্দের রচনা থেকে- কৃষ্ণ কৃপাপ্রার্থী।
হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে।
হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে।।
(৭/৯/২০১৫ ইংরেজী, দোহা-কাতার)

♥♡♥ জন্মাষ্টমীর শিক্ষা ♥♡♥


জন্মাষ্টমীর শিক্ষা~~~~~~~~~~~~~~~~
☆★☆★☆★☆★☆★☆★☆★☆★☆★☆★
শুভ কৃষ্ণ জন্মাষ্টমী ।

শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা স্কুল's photo.
এই অষ্ঠমীতে তাঁর জন্ম। কার জন্ম ? যাঁর জন্ম কর্ম্ম নেই, তাঁর জন্ম। মানুষ জন্মে কর্মফলে। যিনি কর্মের অতীতে যাঁর কর্ম নেই কর্মফল নেই তাঁর জন্মেরও সম্ভাবনা নেই। যা সম্ভব নয় তা অসম্ভব । এই দিনে অসম্ভব সম্ভব হয়েছিল । জগতের আদরের ধন আসছেন ভাদ্রের বাদলঘন বর্ষায় । শ্রীভগবান মানুষের মধ্যে মানুষ হয়ে আসেন, যিনি বড় তিনি আসছেন ছোটদের মধ্যে ছোট্ট শিশু হয়ে।
তাঁর জন্মকালে আলো জ্বলে নি। গৃহউজ্জ্বল ছিল শুধু তাঁর অঙ্গপ্রভায়। উলুধ্বনি শঙ্খধ্বনি হয় নি। চারিদিকে ছিল নিপীড়িত আর্তধ্বনি । কোন উৎসবের ঘটা হয় নি, আকাশ ছিল ঘনঘটা। আর ছিল আকাশে বিজলীর খেলা। সঙ্গে ছিল নিদারুণ বৃষ্টি । ঘুমিয়ে ছিল কুবুদ্ধি দাতা মন্ত্রীরা, মথুরা রাজ্য আর ভোগান্ধ রাজা কংস।
জন্মেছিলেন তিনি রাজার রাজপ্রাসাদে নয়, ভিখারীর পর্ণকুটিরেও নয়। জন্ম তাঁর কংসের কারাগারে, অন্য সকলের অলক্ষ্যে বন্দিনী দেবকীর বেদনা ভরা বক্ষে ।
কংসের ঘরেই জন্মেছিল ভগবদ লালসা তার ভগ্নীরূপে। কেমন তারা যার ঘরে আসবে ভগবান?
দেবী দেবকী ভক্তির মূর্তি ।বসুদেব শুদ্ধ জ্ঞানময় সত্তা। তাদের হল বিবাহ। জ্ঞানের সঙ্গে শুদ্ধ ভক্তির মিলন হল। তক্ষুণি বেজে উঠল ভোগবাদী কংসের মৃত্যুর ঘন্টা । দৈববাণীতে শুনলো মৃত্যুর আওয়াজ । শুনল সে, আসছে তার মৃত্যুদানকারী। তার ভোগের শেষ হবে শুনে হৃদকম্প হল কংসের। সে কারাগারের রুদ্ধ করে রাখল জ্ঞানভক্তিকে। বসুদেব হল জ্ঞান, দেবকী হল ভক্তি। কংসের হীন কাজে বাধা দিল বিবেকবুদ্ধি রূপী উগ্রসেন। তাকে বন্দি করল কংস। দেবকীর ছয় সন্তান পঞ্চ ইন্দ্রিয় আর মনকে কংস বধ করল। সপ্তম গর্ভে আসল অসীমের আলো অনন্ত। যোগমায়ার প্রভাবে তিনি এলেন ব্রজের রোহিণীর গর্ভে। দেবকী ভক্তি আর রোহিনী হলেন কর্ম।
অষ্টমে এলেন শ্রীহরি। অনন্তানন্তময়। দেবকীর গর্ভস্তুতি জন্য এলেন দেবদেবী জাগল মনে প্রসন্নতা, এল উল্লাস।
সত্যব্রতং সত্যপরং ত্রিসত্যং
সত্যস্য যোনিং নিহিতঞ্চ সত্যে
সত্যস্য সত্যমৃত সত্য নেত্রং
সত্যাত্মকং ত্বাং শরণং প্রপন্নাঃ।
দেবতারা সেই সত্যের বন্দনা করতে আসে। সত্য মানে আনন্দ।সত্য মানে কংসের মনে সন্ত্রাস ।
বিশ্বপ্রকৃতির কী সাজ! আকাশে নির্মলতা, জলাশয় পদ্মময়, তারকায় উজ্জ্বলতা, মধুলোভা ভ্রমরের হর্ষ, যজ্ঞের অগ্নি জ্বলে উঠলো। বাতাসে পবিত্র গন্ধ । যেন বাতাস বলছে তাঁর শুভ আগমনের কথা। যাঁর অপেক্ষায় সবাই।
তিনি এলেন আসেন যিনি যুগে যুগে আসেন । আজ এলেন তিনি মাটির ধূলায় কারাগারে । পীতবসন জলধরবরণ পদ্মপলাশলোচন চতুর্ভুজ শঙ্খ চক্রগদাপদ্মধারী মুরারি।
বসুদেব দেখলেন তাকে জ্ঞাননয়নে, দেবকী দেখলেন ভক্তিনয়নে। যখন চলে গেলেন ব্রজবনে , তারা দেখলেন প্রেমনয়নে। জ্ঞানী ভক্ত প্রেমিক দেখে তাঁকে অমৃতময়। ভোগীর দৃষ্টিতে তিনি মৃত্যুময় । জন্মদিনে গেলেন তিনি ভোগীর চোখ এড়িয়ে চলে এলেন নন্দবাবার ঘরে গোকুলে। একটি কালো রূপ ভক্তের অমৃতদাতা, আর একটি হল কালরূপ কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ ক্ষেত্রে অর্জুন দেখেছিল সেই মহাকালকে।
কংস দেখল না, জানল না, তারই কারাগারের গুপ্ত কক্ষে এসেছেন অমৃত ধন।
তিনি এসেছিলেন ধূলায় নেমে মানুষকে ভালবাসতে, ভালবাসা শিখাতে। শুদ্ধ ভালবাসায় তাঁকে আপন করা যায় এই কথা জানতে, দেখাতে। কত শত জ্ঞানী, ধনীরা ছিল তিনি তাদের কাছে গেলেন না। জন্মিয়া গেলেন ঘোষ পল্লীতে গোয়াল পাড়ায়। গোপ গোপী ভালবাসার তরঙ্গে। গোপপল্লীর ব্রজবাসীদের ধন ছিল না, বিদ্যা ছিল না, ছিল ভালবাসা। হৃদয়পাত্র ভরা কৃষ্ণ তৃষ্ণা। শুধু প্রীতির রাজ্যে কৃষ্ণ বাধা। এই অষ্ঠমীতে কৃষ্ণের কাছে শুদ্ধ কৃষ্ণপ্রীতি কামনা করি সবার জন্য ।
শুভময় আনন্দময় কৃষ্ণ জন্মাষ্টমী ।

তথ্যসুত্রঃ- বৈষ্ণবীয় ভজন কীর্ত্তন

শ্রীকৃষ্ণের জন্মতারিখ নির্ধারিত হয়েছে কিভাবে?ব্যাপারগুলো খুব মজার এবং চমকপ্রদ।


 শ্রীকৃষ্ণের জন্মতারিখ নির্ধারিত হয়েছে কিভাবে?ব্যাপারগুলো খুব মজার এবং চমকপ্রদ।
1779149_624489757599962_1326701387_n
 আমাদের মহাভারত,রামায়নের যুগে বর্তমানের মত তারিখ পদ্ধতির প্রচলন ছিলনা।কিন্তু এই গ্রন্থদ্বয়ের লেখক এমন দুইজন বিখ্যাত জ্ঞানী ব্যাক্তি ছিলেন যাদের ছিল জ্যোতির্বিদ্যা নিয়ে অগাধ জ্ঞান ও দক্ষতা।তাই তাঁরা গ্রন্থদুটিতে প্রত্যেকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা কোনদিন ঘটেছিল তা লিপিবদ্ধ করেছেন ওইদিন বিশেষ গ্রহ এবং নক্ষত্র সমূহ মহাশুন্যে ঠিক কোন অবস্থানে ছিল তা উল্লেখের মাধ্যমে।মহাভারতের যুদ্ধ শুরুর ঘটনা উল্লেখিত হয়েছে উদ্যেগ এবং ভীষ্মপর্বে উল্লেখ করা আছে এভাবে-

১)শনি গ্রহ ছিল রোহিণী নক্ষত্রে
২)মঙ্গল ছিল জ্যেষ্ঠ তে
সঙ্গে কার্তিকে চন্দ্রগ্রহন এবং জ্যেষ্ঠতে সূর্যগ্রহন।
শনি গ্রহ রোহিণী নক্ষত্রে থাকে প্রতি ৭০০০ বছরে একবার আর জ্যেষ্ঠ তে সূর্যগ্রহন হয় প্রতি ৩৪০ বছরে একবার।

এই তথ্যসমূহ থেকে প্ল্যানেটারিয়াম প্রযুক্তির মাধ্যমে মহাভারত যুদ্ধের তারিখ জানা যায় খ্রিষ্টপূর্ব ৩০৬৭ সালের ২২ শে নভেম্বর থেকে এ যুদ্ধ শুরু হয়েছিল।

Dr Narhari Achar (a professor of physics at the University of Memphis, Tennessee, in the US) গবেষণার উপর ভিত্তি করে পণ্ডিত মনিষ পাণ্ডে শ্রীকৃষ্ণের জন্মতিথি নির্ধারণ করেন খ্রিষ্টপূর্ব ৩১১২ সাল,যদিও বর্তমানে Dr Arun K Banshalকর্তৃক নির্ধারিত জন্মতিথি খ্রিষ্টপূর্ব ৩২২৮ সালের ১৮ই জুলাই ই সমধিক প্রচলিত ও গৃহীত।
একইভাবে জানা যায় খ্রিষ্টপূর্ব ৩০৬৭ সালের ২৬ শে সেপ্টেম্বর শ্রীকৃষ্ণ দ্বারকা থেকে হস্তিনাপুরের উদ্যেশ্যে যাত্রা করেছিলেন যুদ্ধ বন্ধ করতে ধৃতরাষ্ট্রকে অনুরোধ করার জন্য এবং ২৮ শে সেপ্টেম্বর সেখানে পৌঁছেন।

যদিও এ নির্ধারিত তারিখটি একদম ভুলের ঊর্ধ্বে নয় এবং একদম সর্বজনস্বীকৃত তাও নয়,তবে এই তারিখটি ই বহুল ব্যাবহৃত।

ধন্যবাদ সকলকে

 VEDA, The infallible word of GOD