পুণ্য জনক উপবাস, পুণ্য সাধনে উপবাস নিয়ম এর নাম ব্রত। যে সকল উপবাস কর্মানুষ্ঠান দ্বারা পুণ্য সঞ্চয় হয়, তাকে ব্রত বলে। সম্যক সঙ্কল্প জনিত অনুষ্ঠেয় ক্রিয়া বিশেষের নাম ব্রত। ব্রত প্রথমে দুই প্রকার, প্রবৃত্তিরূপ ও নিবৃত্তিরূপ, দ্রব্য বিশেষ ভোজন ও পূজাদি সাধ্য ব্রত কে প্রবৃত্তিরূপ এবং কেবল উপবাসাদি সাধ্য ব্রত কে নিবৃত্তি রূপ বলে। ব্রত আবার তিন প্রকার, নিত্য, নৈমিত্তিক ও কাম্য। না করলে প্রত্যব্যয়(অপরাধ বা পাপ)- সাধনের নাম নিত্য, যা না করলে প্রত্যব্যয় হয়, তাকে নিত্য বলে। একাদশী প্রভৃতি ব্রত নিত্য। কোন নিমিত্ত বশতঃ যে ব্রতের অনুষ্ঠান করা হয় তাকে নৈমিত্তিক বলে। পাপক্ষয় এর জন্য চান্দ্রায়ণাদি ব্রত নৈমিত্তিক। তিথি বিশেষে কামনা করে যে সকল ব্রত অনুষ্ঠান করা হয়, তাকে কাম্য বলে। যথা সাবিত্রী প্রভৃতি ব্রত। জ্যৈষ্ঠ মাসের কৃষ্ণ চতুর্দশী তিথিতে অবৈধব্য কামনায় সাবিত্রী ব্রত করতে হয়, সুতরাং এটা কাম্য। এভাবে কামনা করে যে ব্রত করা হয়, তাই কাম্য।
হেমাদ্রির ব্রত খণ্ডে লেখা আছে যে, অখণ্ডা তিথিতে ব্রত আরম্ভ করতে হয়, উদয় গামিনী তিথি যদি দিন মধ্য ভজনা না করে, অর্থাৎ যে তিথিতে সূর্য উদিত হন, সেই তিথি যদি দিনের মধ্য ভাগ পর্যন্ত প্রাপ্ত না হয়, তাহলে তাকে খণ্ড তিথি বলে, এই খণ্ড তিথি ব্রত আরম্ভে নিষিদ্ধ; অর্থাৎ এই তিথিতে ব্রত করতে নেই। এর বিপরীত অখণ্ড যে তিথি তাতেই ব্রত আরম্ভ প্রশস্ত। গুরু শুক্রের বাল্য বৃদ্ধান্ত জনিত অকাল এবং মলমাসে ও ব্রতারম্ভ করতে নেই।
যে তিথি ব্যাপী সূর্য দেব অবস্থান করেন, তাই অখণ্ডা তিথি, এই অখণ্ডা তিথিই ব্রত আরম্ভে প্রশস্ত। অস্ত গামিনী তিথি অপেক্ষা উদয় গামিনী তিথিই শ্রেষ্ঠ। অতএব উদয় গামিনী তিথিতেই ব্রতাদি কাজ করা বিধেয়।
ব্রতের কায়িক ও মানসিক দুই প্রকার ভেদ অবহিত হয়েছে, যথা- অহিংসা, সত্য, অস্তেয়, ব্রহ্মচৰ্য্য, অকল্মষ, এই গুলি মানস ব্রত এই সকলের অনুষ্ঠানে মানস ব্রতের ফল হয়। কায়িক ব্রত- উপবাস ও অযাচিত ভাবে অবস্থান প্রভৃতি অর্থাৎ সমস্ত দিন রাত উপবাস বা অশক্ত ব্যক্তির পক্ষে রাতে ভোজন এবং কারও নিকট কোন রকম যাচ্ঞা না করা, এটাই কায়িক ব্রত।
ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র এই চার বর্ণের মধ্যে স্ত্রী, পুরুষ সকলেরই ব্রতে অধিকার আছে, এরা সকলেই ব্রত অনুষ্ঠান দ্বারা পাপ মুক্ত হয়ে শ্রেষ্ঠ গতি লাভ করে থাকেন। যারা ব্রত অনুষ্ঠান করবেন, তাদের কর্মে অধিকার থাকা আবশ্যক, এই অধিকারের বিষয় এরকম লেখা আছে যে, যারা বর্ণ অনুসারে নিজ নিজ আশ্রম ধর্ম প্রতিপালন করেন, এবং বিশুদ্ধ চিত্ত, অলুব্ধ, সিত্যবাদী, সর্বভূতের হিতকারী, শ্রদ্ধা যুক্ত, মদ ও দম্ভ রহিত এবং পূর্বে শাস্ত্রার্থ নির্ণয় করে সে অনুসারে কার্যকারী এই সকল সদ্ গুণ বিশিষ্ট ব্যক্তিই ব্রতে অধিকারী; অর্থাৎ যিনি ধার্মিক তিনিই ব্রত অনুষ্ঠান করবেন, এমন ব্যক্তিই ব্রত করলে তার ফল পেয়ে থাকেন, অন্যথা নিষ্ফল হয়। অর্থাৎ তাদের ব্রতের ফল হয় না। ধার্মিক শব্দের অর্থ এইরকম লেখা আছে যে, পিতৃ গণের উদ্দেশে শ্রাদ্ধ, তপস্যা, সত্য, অক্রোধ, স্বদারে সন্তোষ, শৌচ, অনসূয়া, আত্মজ্ঞান, তিতিক্ষা, এই গুলি সাধারণ ধর্ম নামে অভিহিত, এই সকল সাধারণ ধর্ম অনুসারে যারা বিচরণ করেন, তারাই ধার্মিক। এইরকম ধার্মিক ব্যক্তিই ব্রতে অধিকারী।
চার বর্ণের স্ত্রী মাত্রেরই ব্রত অনুষ্ঠানে অধিকার আছে। কিন্তু তাদের সম্বন্ধে একটু বিশেষ বিধি এই যে, সধবা স্ত্রী স্বামীর অনুজ্ঞা নিয়ে ব্রত করবেন, অনুজ্ঞা ব্যতীত ব্রত করতে পারবেন না, কারণ শাস্ত্রে লেখা আছে যে তাঁদের পক্ষে পৃথক যজ্ঞ, ব্রত, উপবাস প্রভৃতি কিছুই নেই, একমাত্র পণ্ডিত শুশ্রুষাই তাদের ধর্ম, এর দ্বারাই তারা উৎকৃষ্ট লোক লাভ করে থাকে।
অবিবাহিত কন্যা পিতার আদেশে এবং সধবা পতির আজ্ঞায় ও বিধবা পুত্রের অনুজ্ঞা নিয়ে ব্রত আচরণ করবে।
কুমারী, সধবা ও বিধবা স্ত্রী মাত্রেরই পিতা, পতি ও পুত্রের আদেশে ব্রত ধারণ বিধেয়। অন্যথা তারা ব্রতের ফলভাগিনী হবে না।
ব্রত আচরণ করতে হলে তার পূর্ব দিন সংযত হয়ে থাকতে হয়। পরে ব্রত আরম্ভ দিনে সঙ্কল্প করে করতে হয়। ব্রতের পূর্ব দিন ব্রীহি(আউশধান), ষষ্টিক(ষেটে ধান), মুদ্গ(মুগডাল), কলায়, জল, দুগ্ধ, শ্যামাক(ধান বিশেষ), নীবার(উড়িধান, তৃণধান) ও গোধূম(আটা, ময়দা) এই সকল দ্রব্য ভোজন করতে পারে, কিন্তু কুষ্মাণ্ড(কুমড়া), অলাবু(লাউ), বার্ত্তাকু(বেগুণ), পালঙ্কী, জ্যোৎস্নিকা(ঝিঙে) এই সকল দ্রব্য ভোজন নিষিদ্ধ।
চরু(পায়েস), শক্তু(যব বা ছোলা পিষে তৈরী ছাতু), শাক, দধি, ঘৃত, মধু, তামাক, শালি(সুগন্ধি হৈমন্তিক ধান্য), নীবার(উড়িধান, তৃণধান্য), মূল এবং পত্রাদিও ভোজন করা যেতে পারে। মধু ও মাংস নিষিদ্ধ।
এই দিন ব্রহ্মচর্য অবলম্বন করে থাকতে হয়। ব্রহ্মচর্য শব্দে অষ্টাঙ্গ মৈথুন নিবৃত্তি বুঝতে হবে। ব্রতকারী, এই দিনে সকল ভূতের প্রতি দয়া, ক্ষান্তি, অনসূয়া, শৌচ প্রভৃতি পালন করে চলবেন।
ব্রত আরম্ভ কালে অশৌচাদি হলে ব্রত করতে নেই। কিন্তু ব্রত আরম্ভের পর যদি ব্রত দিনে অশৌচ হয়, তাহলে ব্রত করতে পারবে তাতে দোষ নেই। অর্থাৎ একটা ব্রত ৭ বৎসর ধরে করতে হয়, তার মধ্যে যে বারে প্রথম ব্রত আরম্ভ হবে, সেই বারে অশৌচাদি ঘটলে করতে পারবে না। কিন্তু পরের বৎসর যদি ব্রতের সম সময়ে অশৌচ বা স্ত্রী রজস্বলা হয়, তাহলে ব্রত বাঁধ হবে না, অন্যকে দিয়ে করানো যাবে, অর্থাৎ ব্রাহ্মণ ব্রত করবেন, উপবাসাদি নিজেই করবে, উপবাসে অসমর্থ হলে রাত্রে ভোজন করবে, অত্যন্ত অসমর্থ হলে পুত্রাদি প্রতিনিধি দ্বারা উপবাস করাবে। স্বামীর ব্রতে স্ত্রী এবং স্ত্রীর ব্রতে স্বামী প্রতিনিধি হতে পারে। তা না হলে পুত্র, ভ্রাতা বা বোন প্রতিনিধি হবে। এরা না হলে ব্ৰাহ্মণকে ও প্রতিনিধি করা যেতে পারে।
যথা বিধানে ব্রত গ্রহণ করলে সমাপন শেষে সেই ব্রতের প্রতিষ্ঠা করতে হয়। ব্রত বিশেষে ৫, ৭, ১৪ প্রভৃতি বৎসরে তার প্রতিষ্ঠা বিহিত হয়েছে। যদি কেউ ব্রত আরম্ভ করে ব্রতের সমাপ্তি কাল পর্যন্ত না বেঁচে থাকে, তাহলে ব্রতের অসমাপ্তি জন্য দোষ হবে না। ব্রতের ফলভাগী হবে। কিন্তু যদি কোন ব্যক্তি লোভ, মোহ, প্রমাদ বশতঃ ব্রত ভঙ্গ করে, তাহলে তার প্রায়শ্চিত্ত করতে হয়। প্রায়শ্চিত্ত অনুষ্ঠানের পর পুনর্বার ঐ ব্রত করতে হয়। প্রায়শ্চিত্ত বিষয়ে লেখা আছে যে, তিন দিন উপবাস এবং কেশ মুণ্ডন করবে। কেশ মুগুন যদি না করে, তার মূল প্রায়শ্চিত্তের দ্বিগুণ প্রায়শ্চিত্ত করতে হয়। উপবাস করতে না পারলে ২৪ পণ বরাটক দানরূপ প্রায়শ্চিত্ত করবে। কিন্তু সধবা স্ত্রীদের সম্বন্ধে বিশেষ এই যে, তাদের কেশমুণ্ডন করতে নেই। তাদের কেশের অগ্রভাগ হতে দুই অঙ্গুল পরিমাণ কেশ ছেদন করলেই হবে। এইভাবে প্রায়শ্চিত্ত কুরে পরে আবার ব্রত করবে। যদি কেউ সঙ্কল্প করে ব্রত গ্রহণপুর্বক সেই ব্রত না করে, তাহলে জীবিত অবস্থায় চণ্ডালত্ব এবং মরণের পর কুকুর যোনী প্রাপ্ত হয়।
ব্রত গ্রহণ বিষয়ে পূর্ব্বাহ্ণ কালে সঙ্কল্প করতে হয়। পুর্ব দিনে সংযত চিত্ত হয়ে ব্রত দিন প্রাতঃকালে দান সন্ধ্যাদি করে আচমন, সুর্য অর্ঘ্য, গণেশ, শিবাদি পঞ্চ দেবতা, আদিত্যাদি নবগ্রহ ও ইন্দ্রাদি দশদিকপাল প্রভৃতির পূজা, সূর্য, সোম ইত্যাদি স্বস্তিবাচন করে পরে সঙ্কল্প করবে। ইত্যাদি রূপে পূজাদি করে ব্রতাচরণ করবে।
ব্রত যে কয় বৎসর সাধ্য হবে, সেই কয় বৎসর একই নিয়মে ব্রতানুষ্ঠান করে নিয়মিত বৎসর পূর্ণ হলে বিধি অনুসারে সেই ব্রত প্রতিষ্ঠা করবে। প্রতিষ্ঠা কালে যদি জন্ম বা মরণাশৌচ হয়, তাহলেও পুর্ব সঙ্কল্প অনুসারে প্রতিষ্ঠা কাজ সিদ্ধ হবে, তাতে কোনরকম দোষ হবে না। কিন্তু যার ব্রত, তিনি উপবাসাদি ভিন্ন আর কিছুই করতে পারবেন না।
যদি কোন দৈবগতিকে প্রতিষ্ঠা বৎসরে প্রতিষ্ঠা না হয়, তাহলে অশৌচে হবে না। যদি ঐ বৎসর গুরু শুক্রের বাল্য, অস্ত ও বৃদ্ধ জনিত অকাল ও মলমাসাদি হয়, তাহলেও প্রতিষ্ঠা হবে না। যে বৎসর অকাল, মলমাস প্রভৃতি না হয়, এবং অশৌচাদি না থাকে, সেই বৎসরেই প্রতিষ্ঠা হবে, কিন্তু প্রতিষ্ঠা-বৎসরে প্রতিষ্ঠা না করায় অবশ্য পাপভোগী হতে হবে।
ব্রতকারী ব্রতানুষ্ঠানের পর ব্রতকথা শ্রবণ করবেন। ব্রত প্রতিষ্ঠা হয়ে গেলে আর কথা শুনতে হয় না। কিন্তু কোন কোন ব্রতে বিশেষ আছে যে, প্রতিষ্ঠার পরও কথা শ্রবণ ও ভোজ্য উৎসর্গ করতে হয়, যেমন কুক্কুটি সপ্তমী ব্রতে প্রতিষ্ঠার পরও যাবজ্জীবন ব্রত কথা শ্রবণ ও ডোর ধারণ করতে হয়।
প্রত্যেক ব্রতের বিশেষ বিবরণ সেই সেই শব্দে লেখা হয়েছে, এই জন্য এখানে আর লেখা হল না। অকারাদি ক্রমে কতকগুলি ব্রতের নাম নির্দিষ্ট হল। ভবিষ্য পুরাণ, মৎস্য পুরাণ, পদ্ম পুরাণ প্রভৃতি পুরাণ সমূহে এই সকল ব্রতের বিধান নির্দিষ্ট হয়েছে।
শেয়ার করে অন্যদের জানতে সহায়তা করুন-
You must be logged in to post a comment.