শ্রীশ্রী লক্ষ্মী দেবী (বৈদিক পুরাণিক ইতিবৃত্ত)


লক্ষ্মী দেবীর কথা যেমন আছে আমাদের বেদ-উপনিষদে এবং নিন্ম অধিকারির বোঝার জন্য পুরাণ গ্রন্থে। আমাদের অত্র অঞ্চল ছাড়িয়েও ‘শ্রী লক্ষ্মী’ অন্য নামে পৃথিবীর নানা দেশে পুজিত।

10753_10153776970510375_1274116584_n
বৈদিক উষাই পৌরাণিক লক্ষ্মী। বেদে অনেক স্থলে উষা সুৰ্য্যপ্রিয়ারূপে বর্ণিত হয়েছেন। বৈদিক বিষ্ণু সূৰ্য্যের নামান্তর মাত্র। সুতরাং সূৰ্য্যপ্রিয়া বৈদিক উষা বিষ্ণুপ্রিয়া পৌরাণিক লক্ষ্মী হয়েছেন।
গ্ৰীক্ রোমীয় ঊষার ন্যায় বৈদিক উষারও রথ আছে। শ্ৰীসূক্তে শ্রীকে ‘অশ্বপুর্ব্বা’ ‘রথমধ্যা’ বলা হয়েছে। কিন্তু পৌরাণিক ঐ জলধিদুহিতা, মন্থনকালে সমুদ্র হতে উৎপন্না। গ্রীক্ উষা সমুদ্র হতে অশ্বযুক্ত শকটে আরোহণ করে প্রভাতগগন রঞ্জিত করে আসতেন। বেদে সমুদ্র বলতে অনেক স্থলে অন্তরীক্ষ বুঝাতো, সেই হিসাবে উষা সমুদ্রদুহিতা।
বৈদিক স্ত্রী-দেবত’গণের মধ্যে উষার আসন সৰ্ব্বাপেক্ষা উচ্চে, অথচ পৌরাণিক যুগে উষার উল্লেখ নাই, পুরাণে সে সুবর্ণকিরণ একেবারে নির্বাপিত। সেই উষা পুরাণে একেবারে লুপ্ত হোন নাই, তিনি লক্ষ্মীরূপে এখনও বিরাজ করছেন। উষাকে বেদে বাঞ্জিনীবতী বা অন্নবতী বলা হয়েছে। লক্ষ্মীও অন্নদাত্রী।
লক্ষ্মীর একটি নাম শ্ৰী। ঋগ্বেদে এবং তৈত্তিরীয় সংহিতায় রূপ ও ঐশ্বর্য্য অর্থে ‘শ্রী’ কথাটি পাওয়া যায়, কিন্তু তথায় ‘শ্ৰী’ বলে কোন দেবীর উল্লেখ নেই। এখন ‘শ্ৰী বা লক্ষ্মী’ দেবীর নিকট আমরা প্রচুর শস্য, অন্ন, বস্ত্র, ধন-সম্পদের জন্য প্রার্থনা করি। বৈদিকযুগে আর্য্যগণ প্রচুর শস্য ও পার্থিব সম্পদের জন্য পুরন্ধি ধিষণা প্রভৃতির নিকট প্রার্থনা করতেন, এরূপ বর্ণনা আছে। এখনকার আর্থিক অনটনের দিনে লোকে বহুপুত্র কামনা করতে সাহস করে না। কিন্তু আর্য্যগণের তখন লক্ষ্য ছিল, কিরূপে দলপুষ্টি হয়, অনাৰ্য্য শক্রগণের সাথে যুদ্ধে ও সাংসারিক কার্য্যে সহায়তার জন্য পুত্রের আবশ্যকতা তাঁহারা অনুভব করতেন এবং সেইজন্য তাঁহারা উপাস্য দেব- দেবীগণের নিকটে পুত্রলাভের প্রার্থনা জানাতেন। কুহু ও সিনীবালীর নিকট তাঁহারা সন্তানের জন্য প্রার্থনা করছেন, এরূপ বর্ণনা আছে। অথৰ্ব্ববেদে আছে, তাঁহার সম্পদ ও বীরপুত্রের জন্য কুহূর নিকট প্রার্থনা করছেন। ঋগ্বেদে বিষ্ণুপত্নী বলে কারও উল্লেখ আছে বলে বোধ হয় না। ঋগ্বেদের শেষ অংশের একটি সূক্ত সুপ্রজননের জন্য বিষ্ণু ও সিনীবালীর নিকট প্রার্থনা বোধ হয় সেই জন্য অথৰ্ব্ববেদে সিনীবালীকে বিষ্ণুপত্নী বলা হয়েছে। পৌরাণিক যুগের বিষ্ণুপত্নী শ্ৰী বা লক্ষ্মীর নিকট সন্তান সুপ্রসবের জন্য বা বহু সন্তান লাভের জন্য প্রার্থনা কেহ করে না। বৌদ্ধযুগে যক্ষিণী হারিতী সে ভার লয়েছিলেন; আধুনিক যুগে জন্তলা রাক্ষসী, পাঁচুঠাকুর ও যষ্ঠীদেবী তা নিয়েছেন। তথাপি লোক আশীৰ্ব্বাদ করবার সময় ‘ধনে পুত্রে লক্ষ্মীলাভের কথা এখনও উল্লেখ করে। শ্ৰীসুক্তে দেখা যায়, প্রার্থনাকারী ধন ধান্য গো-হস্তি-রথ-অশ্ব ও আয়ু প্রার্থনা করবার সঙ্গে সঙ্গে পুত্র-পৌত্রের জন্যও কামনা জানাইতেছেন, কারণ পুত্রপৌত্রও ত সম্পৎ-সৌভাগ্যের চিহ্ন।
শাঙ্খ্যায়নগৃহ্যসূত্রে ও শতপথ-ব্রাহ্মণে শ্ৰী দেবী হয়েছেন। তৈত্তিরীয় উপনিষেদও বহুকেশবতী ‘শ্ৰী’র উল্লেখ আছে। শাঙ্খ্যায়নগৃহ্যসূত্রে ধিষ্ণু, অনুমতি, অদিতি প্রভৃতি দেবীগণের মধ্যে শ্রীর নাম পাওয়া যায়। শতপথ-ব্রাহ্মণেও শ্ৰী দেবীরূপে কল্পিত হয়েছেন- তথায় তাঁহার ধন-সম্পদ ঐশ্বৰ্য্য সবই আছে। শতপথ ব্রাহ্মণে শ্ৰী সম্বন্ধে যে কাহিনীটি বিবৃত হয়েছে, তাতে আছে প্রজাপতি প্ৰজা সৃজন করবার জন্য তপস্যা করছিলেন। তিনি তপ করতে করতে শ্রান্ত হলে শ্ৰী তাঁহার মধ্য হতে বাহির হয়ে আসলেন। (গ্ৰীক্‌ দেবেন্দ্র জিউসের মস্তক হতে এথেনা দেবীর উদ্ভব ইহার সাথে তুলনীয়।) শ্ৰী দীপ্তিমান অবয়বে সমস্ত জগৎ উদ্ভাসিত করে অবস্থান করলেন। সেই শোভাময়ী আলোর প্রতিমা দেখে দেবগণ তাঁহাকে ধ্যান করতে লাগলেন। তাঁদের ইচ্ছা হল, তাঁহাকে নিধন করে উহার শোভাসম্পদ কেড়ে নিবেন। প্রজাপতি দেবগণকে নিরস্ত করে বললেন, “শ্রী স্ত্রীলোক, লোকে স্ত্রী হত্যা করে না।” প্রজাপতি শ্রীকে প্রাণে না মারিয়া তাঁহার যথাসৰ্ব্বস্ব কড়িয়া নিবার পরামর্শ দিলেন। পরামর্শ কর্য্যে পরিণত হতে বিলম্ব হল না। অগ্নি তাহার অল্প নিলেন, সোম তাঁহার রাজ্য, বরুণ তাঁহার সাম্রাজ্য, মিত্র তাঁহার ক্ষত্র, ইন্দ্র উহার বল, বৃহস্পতি তাঁহার ব্ৰহ্মতেজ, সবিতৃ তাঁহার রাষ্ট্র, পুষা তাঁহার ঐশ্বৰ্য্য, সরস্বতী তাঁহার পুষ্টি এবং তুষ্টা উহার রূপ নিলেন। পরে শ্রী প্রজাপতির পরামর্শে যজ্ঞ করে ঐ-সকল দেবতাকে আহবান করলেন; এবং তাঁহারা যাহা যাহা নিয়েছিলেন, তুষ্ট হয়ে, সব শ্রীকে একে একে ফিরিয়ে দিলেন।
শ্ৰীসূক্ত শ্ৰী দেবীর উদ্দেশে রচিত। ঠিক বৈদিক যুগে ইহা রচিত নাও হতে পারে, কিন্তু সেইজন্য এর প্রাচীনত্ব সম্বন্ধে সন্দিহান হলে চলবে না, কারণ বৃহদ্দেবতাগ্রস্থে মন্ত্রদ্রষ্ট্রী বা সূত্ত-প্রণেত্রীগণের নামের মধ্যে শ্রীর নাম পাওয়া যায়। পৌরাণিকযুগে ও বৌদ্ধযুগে শ্রী প্রধান দেবীগণের মধ্যে পরিগণিতা। পৌরাণিক বৃত্তান্ত-অনুসারে সমুদ্রমন্থন হতে শ্রীর উৎপত্তি। (গ্রীক্‌দিগের প্রেম-সৌন্দর্য্যের দেবী এফ্রোডাইটিও Aphrodite সমুদ্রফেন হতে উৎপন্না) মহাভারতে আছে, মন্থনকালে শ্বেতপদ্মাসীনা লক্ষ্মী ও সুরাদেবী উদ্ভূত হলেন। রামায়ণে বারুণীর নাম আছে বটে, কিন্তু শ্রীর নাম নাই। বিষ্ণুপুরাণে আছে, শ্রী ভৃগু ও থ্যাতির কন্যা এবং ধর্মের পত্নী। তাহার পর যখন রুষ্ট দুৰ্ব্বাসার অভিশাপে ইন্দ্র শ্রীভ্রষ্ট হলেন, দেবগণ দানবহস্তে পরাজিত হতে লাগলেন, তখন বিষ্ণুর পরামর্শে সমুদ্রমন্থন করে দেবগণ পুনরায় শ্রীকে পেলেন।
শ্রীবিষ্ণুপুরাণ ও শ্রীমদ্ভাগবতে সাগর হতে লক্ষ্মীর উৎপত্তির যে বর্ণনা আছে, তা বাস্তবিকই কবিত্বময়। বিষ্ণুপুরাণে আছে, ধন্বন্তরির পর স্ফুরৎকান্তিমতী বিকসিত-কমলে-স্থিতা পঙ্কজহস্তা শ্রীদেবী সাগর হতে উত্থিত হলেন। মহর্ষিগণ শ্রীসূক্তে তাঁহার স্তব করলেন। বিশ্বাবসু আদি গন্ধৰ্ব্বগণ তাঁহার সম্মুখে গান করতে আরম্ভ করলেন। গঙ্গা আদি নদী তাহার স্নানার্থ জল লইয়া উপস্থিত হইলেন। দিগ্‌গজ-সকল হেমপাত্রস্থিত বিমল জল লইয়া সৰ্ব্বলোকমহেশ্বরী সেই দেবীকে স্নান করাতে লাগল। ক্ষীরোদ সাগর রূপ ধারণ করিয়া তাঁহাকে অম্লানপঙ্কজমালা প্রদান করিল। বিশ্বকর্ম্মা তাঁহাকে অলঙ্কারে বিভূষিত করলেন। দেবী স্নাতা, ভূষণভূষিতা ও দিব্যমালাম্বরধরা হয়ে সৰ্ব্বদেব-সমক্ষে হরির বক্ষঃস্থল আশ্রয় করলেন।

শ্ৰীমদ্ভাগবতের বর্ণনা আরও কবিত্বময় এবং আরও বিস্তারিত। কান্তিপ্রভায় দিগমণ্ডল রঞ্জিত করে দেবী বিদ্যুন্‌মালার ন্যায় অবিভূর্তা হলেন। মহেন্দ্র তাঁহাকে অদ্ভুত আসন এনে দিলেন, শ্রেষ্ঠ নদীগণ মুর্ত্তিমতী হয়ে হেমকুম্ভে পবিত্র জল দিল। ভূমিদেবী অভিষেচন-উপযোগী ওষধি সকল, গোগণ পঞ্চগব্য এবং বসন্ত মধুমাসের উৎপন্ন উপহাররাজি প্রদান করলেন । গন্ধৰ্ব্ব কন্ঠোচ্চারিত মঙ্গলপাঠ, নটীগণের নৃত্যগীত, মেঘের তুমুলনিস্বনে বাদ্যযন্ত্র-বাদন, দিগ্‌গজগণ কর্তৃক পুর্ণকলস হতে জলবর্ষণ ও দ্বিজগণ কর্তৃক সূক্তবাক্য উচ্চারণ-
এই সকলের মধ্যে ঋষিগণ দেবীর অভিষেক-কাৰ্য্য সম্পাদন করলেন। তাহার পর দেবীর সজ্জা। সমুদ্ৰ পীত কৌশেয়বাস, বরুণ মধুমত্ত ভ্রমরগুঞ্জরিত কুহমদাম, বিশ্বকৰ্ম্মা বিচিত্ৰ ভূষণ, সরস্বতী হার, ব্রহ্মা পদ্ম এবং নাগগণ কুণ্ডল দিলেন। তাঁহার পর ভ্রমরগুঞ্জিত মালা লইয়া নুপুরশিঞ্জিত চরণে হেমলতার ন্যায় ভ্রমণ করতে করতে দেবী নারায়ণের গলে সেই মাল্য প্রদান করে অপূৰ্ব্ব ভঙ্গীতে লজ্জাবিভাসিত স্মিতবিস্ফারিত লোচনে তাঁহার বক্ষে অবস্থান করতে লাগলেন।
তাহার পর ব্রহ্মবৈবৰ্ত্ত-পুরাণে লক্ষ্মীচরিত্র যেমন অঙ্কিত হয়েছে, তাহা দেখলে মনে হয়, দেবী যেন কোন বঙ্গ গৃহস্থের কুলবধূ। তিনি নারায়ণের পত্নী—গঙ্গা ও সরস্বতী তাঁহার সপত্নী। পুরাণকার সপত্নীগণের কলহ ও তাঁহার মধ্যে লক্ষ্মীর অবিচল শান্তভাব বর্ণনা করেছেন; লক্ষ্মীচরিত্র আদর্শ বধুচরিত্র। কলহ-রতা দুই সপত্নীর মধ্যে দণ্ডায়মান হয়ে তাদের কলহ শান্তি করতে গিয়ে লক্ষ্মী বিনাদোষে সরস্বতী কর্ত্তৃক অভিশপ্ত হলেন। লক্ষ্মী কাহাকেও অভিশাপ দিলেন না, তাঁহার সপত্নীযুগল পরস্পরকে শাপ প্রদান করলেন। অভিশাপের কাণ্ড শেষ হলে নারায়ণ লক্ষ্মীর উপর সুবিচার করে গঙ্গাকে শিবের নিকট এবং সরস্বতীকে ব্ৰহ্মার নিকট প্রেরণ করতে চাইলেন। এখনও লক্ষ্মী, তিনি স্বামীকে সপত্নীদ্বয়ের উপর প্রসন্ন হবার জন্য অনুনয় করলেন। গুণমুগ্ধ স্বামী তাঁহার নিঃস্বার্থ প্রার্থনা রক্ষা করেছিলেন।
পৌরাণিক যুগের লক্ষ্মী চরিত্রের তুলনা নাই। পুরাণকারগণ দুঃসাহসী। লক্ষ্মীর স্বাভাবিক নম্রতার জন্য তাঁহাদের সাহস বেড়ে গিয়েছিল। ফলে, দেবীভাগবতের গ্লানিকর বৃত্তান্ত। লক্ষ্মীর ভ্রাতা উচ্চৈঃশ্রবার পৃষ্ঠে আরোহণ করে যখন সূৰ্য্যপুত্র রেবন্ত আসতেছিলেন, তখন অশ্ব ও অশ্বারোহীর প্রতি একাস্তে দৃষ্টিপাত করতে লক্ষ্মী নারায়ণ কর্তৃক অভিশপ্ত হলেন। লক্ষ্মীকে অশ্বীরূপ ধারণ করতে হল। তাহার পর অশ্বরূপী বিষ্ণুর ঔরসে তাহার পুত্র হয়। অশ্বরূপধারণের কাহিনীটি বৈদিক সূৰ্য্য-সরণ্যু বা পৌরাণিক সূৰ্য্যসংজ্ঞার কাহিনী অবলম্বনে লিখিত। বৈদিক সূৰ্য্য ও বৈদিক বিষ্ণু একই দেবতা। পুরাণের যুগেও বিষ্ণু ও সূর্য্য উভয়েই আদিত্য।।
সুতরাং দেবী-ভাগবতের কাহিনিটি রচনা করতে বিশেষ অসুবিধা হয় নাই। তাহার পর মহাদেব যে লক্ষ্মীর শাপমোচন করলেন, তার দ্বারা শিবের ক্ষমতা প্রমানের চেষ্টা হয়েছে। দেবীভাগবতকে একখানি শাক্ত ও সেই হিসাবে শৈব পুরাণ বলা যেতে পারে। শৈব পুরাণে শিবের মাহাত্ম্য দেখানোর চেষ্টা যে সমগ্র কাহিনীটি রচনার কারণ, ইহাও বলা যেতে পারে।
কোন কোন স্থলে মানব কি কি অনুষ্ঠান করলে শ্রী তাঁহার গৃহে অধিষ্ঠান করেন, তাহার বিবরণ মহাভারতের লক্ষ্মীবাসর-সংবাদে আছে। সিরি কালকন্নী জাতকে সিরি (শ্রী)ও প্রায় তাই বলতেছেন । বৌদ্ধযুগে সিবি বা সিরি-মা দেবতা একটি উপাস্য দেবী। সিরি-কালকন্নী জাতকে সিরি উত্তরদিক্‌পাল ধৃতরাষ্ট্রের দুহিতা; পশ্চিমদিক্‌পাল বিরুপাক্ষের দুহিতা কালকন্নী। কালকন্নীকে কথাবার্ত্তায় আমাদের অলক্ষ্মী বলিয়া মনে হয়। যেখানে লোভ, দ্বেষ, হিংসা, নিষ্ঠুরতা, যেখানে পরনিন্দা, মুর্খতা, ঘৃণা, সেইখানেই কালকন্নী বা অলক্ষ্মী। স্কন্দপুরাণের কাশীখণ্ডের এক স্থলে কালকন্নী ও অলক্ষ্মীর একত্রে উল্লেখ আছে। পদ্মপুরাণে স্বর্গখণ্ডে আছে, সমুদ্রমন্থনকালে অলক্ষ্মী জন্মগ্রহণ করেন; তাহার পর লক্ষ্মীর উদ্ভব হয়। অলক্ষ্মী বৈদিক নর্ঝতির পৌরাণিক রূপান্তর।Image result for kojagari lakshmi puja 2017
আমাদের দেশে ভাদ্র, পৌষ ও চৈত্র মাসে লক্ষ্মীপূজা হয়। এতদ্ব্যতীত অশ্বিন মাসে পূর্ণিমায় কোজাগরী লক্ষ্মীপূজা হয়। শ্যামাপূজার দিন অমাবস্যায় কোন কোন স্থলে লক্ষ্মীপুজা হয়ে থাকে এবং ঐ দিন কোন কোন গৃহস্থের বাড়ী প্রথমে অলক্ষ্মীর পূজা হলে পরে অলক্ষ্মীকে বিদায় করে লক্ষ্মীপূজা হয়।
শারদীয়া পূর্ণিমাতে যে লক্ষ্মীপূজা হয়—যার প্রচলিত নাম কোজাগর-লক্ষ্মীপূজা-তা এখনও হিন্দুর নিকট একটি প্রধান পৰ্ব্ব। পূজনীয় স্মার্ত্ত-শিরোমণি রঘুনন্দন তাহার তিথিতত্ত্বে শাস্ত্রীয় বচন উদ্ধৃত করে এই তিথির করণীয় কাৰ্য্যের বিধান দিয়ে গেছেন। কোজাগর-পূর্ণিমাতে লক্ষ্মী ও ঐরাবতস্থিত ইন্দ্রের পুজা এবং সকলে সুগন্ধ ও সুবেশ ধারণ করে অক্ষক্রীড়া করে রাত্রি জাগরণ করবে; কারণ, নিশীখে বরদা লক্ষ্মী বলেন, “কে জাগরিত আছে ? যে জাগরিত থেকে অক্ষক্রীড়া করে, তাহাকে আমি বিত্ত প্রদান করি। নারিকেল ও চিপিটকের দ্বারা পিতৃগণ ও দেবগণের অর্চনা করবে এবং বন্ধুগণের সাথে উহা ভোজন করবে।” যে নারিকেলের জলপান করে অক্ষক্রীড়ায় নিশি অতিবাহিত করে, লক্ষ্মী তাহাকে ধন দান করে থাকেন।
আশ্বিন-পূর্ণিমায় এই কোজাগর লক্ষ্মীপূজা একটি বহু প্রাচীন উৎসবের সাথে জড়িত। বহুশতাব্দী পূৰ্ব্বে শরৎকালে শস্য কৰ্ত্তন হলে সীতা-যজ্ঞ হোত এবং তাতে সীতা এবং ইন্দ্র আহুত হতেন। পারস্কর-গৃহ্যসূত্রে এই স্থানে সীতাকে ইন্দ্রপত্নী বলা হয়েছে; কারণ, সীতা লাঙ্গলপদ্ধতিরূপিণী শস্য-উৎপাদয়িত্রী ভূমিদেবী; ইন্দ্র বৃষ্টি-জলপ্রদানকারী কৃষিকার্য্যের সুবিধাদাতা দেব। পূৰ্ব্বে সীতা-যজ্ঞে ইন্দ্র আহুত হতেন বলে তিথিতত্ত্বে কোজাগর-পূর্ণিমায় ইন্দ্রের পূজার বিধি আছে। লক্ষ্মী যে সীতার রূপান্তর, তা রামায়ণাদি গ্রন্থে বার বার বলা হয়েছে। তা ছাড়াও লক্ষ্মীর যে-মূৰ্ত্তি কল্পনা করা হয়েছে, তাঁতে দেখতে পাওয়া যায়, লক্ষ্মীর হস্তে ধান্যমঞ্জরী। তন্ত্রে মহালক্ষ্মীর একটি ধ্যানে লক্ষ্মীর হস্তে শালিধান্যের মঞ্জরী। এখনও লক্ষ্মীপূজার সময় কাঠায় ভরে নবীন ধান্য দেওয়া হয়ে থাকে।
শ্রীসূক্তে লক্ষ্মী হিরণ্যবর্ণা, আবার পদ্মবর্ণা বলে বর্ণিতা। তন্ত্রে মহালক্ষ্মীর ধ্যানে দেবী বালাৰ্কদ্যুতি, সিন্দূরারুণকান্তি, সৌদামিনী সন্নিভা। তিনি নানালঙ্কারভূষিতা। তিথিতত্ত্বে আদিত্যপুরাণ হতে লক্ষ্মীর যে ধ্যান উদ্ধৃত হয়েছে, তাতে তিনি গৌরবর্ণা। তাঁহার হস্তসংখ্যা এবং হস্তে তিনি কি কি ধারণ করে থাকবেন, এই দুইটি বিষয়ে অনেক বিভিন্নতা দৃষ্ট হয়। দেবী কোথাও দ্বিহস্ত, কোথাও বা চতুর্হস্তা, কোথাও বা তিনি ষড়ভূজা বা অষ্টভুজা। আবার এক স্থানে মহালক্ষ্মী অষ্টাদশভূজারূপে কল্পিত হয়েছেন। এই মহালক্ষ্মী মহাকালীমুর্ত্তির অন্যরূপ বিকাশ। কোন কোন স্থলে লক্ষ্মীপূজায় যে বলিদানের বিধি আছে, তাহ বোধ হয় এই মহালক্ষ্মীর পুজা।
তিথিতত্ত্বে উদ্ধৃত আদিত্যপুরাণ অনুসারে লক্ষ্মীর হস্তে পাশ, অক্ষমালা, পদ্ম ও অঙ্কুশ। লক্ষ্মীর প্রত্যেক মুর্ত্তিকল্পনাতেই হন্তে পদ্ম থাকে। কোন কোন মূৰ্ত্তিতে হস্ত বসুপাত্র (রত্নপূর্ণ পাত্র) স্বর্ণপদ্ম ও মাতুলুঙ্গ (লেবু) থাকে। কমলার হস্তধৃত লেবুই কমলালেবু নামে অভিহিত হইয়াছে কি না, তা বলা যায় না। অষ্টাদশভূজা মহালক্ষ্মীর হস্তে যথাক্রমে অক্ষ, স্ৰক্‌, পরশু, গদা, কুলিশ, পদ্ম, ধনু, কুণ্ডিকা (কমণ্ডলু,) দণ্ড, শক্তি, অসি, চৰ্ম্ম, জলজ, ঘণ্টা, সুরাপাত্র, শূল, পাণ ও সুদর্শন (চক্র)। শুক্রনীতিসার অনুসারে লক্ষ্মীর এক হস্তে বীণা, দুইটি হস্তে বর এবং অভয়মুদ্রা থাকবে। তথায় আর-একটি হস্তে লুঙ্গফলেরও উল্লেখ আছে। লুঙ্গফল সস্তবতঃ মাতুলুঙ্গ। মূৰ্ত্তিবিশেষে দেবীর এক হস্তে শ্ৰীফল থাকবে, এইরূপ উল্লেখ পাওয়া যায়। শ্ৰীফল সম্বন্ধে একটি পৌরাণিক কাহিনী আছে যে, একদা শিব-পুজাকালে একটি পদ্মের অভাব ঘটায় লক্ষ্মী মুকুলিত পদ্মসদৃশ আপনার একটি স্তন কৰ্ত্তন করে দিয়েছিলেন। মহাদেবের বরে তাঁহাই বিল্ব বা শ্রীফল হয়। মৎস্যপুরাণে বর্ণিত লক্ষ্মীমূৰ্ত্তির হস্তে পদ্ম ও শ্ৰীফল। এই গজলক্ষ্মীমূৰ্ত্তি। দেবী পদ্মাসনে উপবিষ্টা, দুইটি হস্তী দেবীর উপর জলবর্ধণ করিতেছে।
বিষ্ণুমূৰ্ত্তিসহ যে লক্ষ্মীমূৰ্ত্তি দেখা যায়, তা দ্বিহস্তবিশিষ্ট। শ্ৰীযুক্ত বিনোদবিহারী কাব্যতীর্থ বিদ্যাবিনোদ মহাশয়ের ‘বিষ্ণুমূৰ্ত্তি পরিচয়’ নামক পুস্তক হতে জানা যায় যে, বাসুদেব, ত্ৰৈলোক্যমোহন, নারায়ণ প্রভৃতি বিষ্ণুমূৰ্ত্তিতে লক্ষ্মীমুৰ্ত্তিও আছেন। লক্ষ্মীনারায়ণমূৰ্ত্তিতে দেবী নারায়ণের বাম অঙ্কের উপর উপবিষ্ট এবং কোন কোন স্থলে তাঁহার হস্ত দ্বারা পরস্পরকে আলিঙ্গন করে রয়েছেন। অগ্নিপুরাণ হতে জানা যায়, লক্ষ্মী বরাহরূপধারী বিষ্ণুর পদতলে উপবিষ্ট থাকেন। অনন্তশায়িনী বিষ্ণুমূর্তিতে বিষ্ণু নাগের উপর শয়ান এবং লক্ষ্মী তাঁহার পদসেব করছেন। অগ্নিপুরাণের হরিশঙ্কর মূৰ্ত্তিতে নারায়ণ জলশায়ী অবস্থায় বামপাশ্বে শয়ান। ইহাঁর শরীরের এক অংশ রুদ্র (মহাদেব)-মূৰ্ত্তি এবং অপর অংশ কেশব (বিষ্ণু)-মুর্ত্তির লক্ষণযুক্ত এবং মূৰ্ত্তিটি গৌরী ও লক্ষ্মীমুর্ত্তিসমন্বিত। ভারতবর্ষে শৈব বৈষ্ণব প্রভৃতি ধৰ্ম্ম প্রচলিত থাকলেও তাহাদের উপাস্য দেবদেবীগণের মধ্যে ঐক্য-সম্পাদনের চেষ্টা ছিল। সেই সেই চেষ্টার ফলে হরিশঙ্কর মূৰ্ত্তি ও মহালক্ষ্মী মহাকালী মহাসরস্বতীমূৰ্ত্তি।
চিত্রে লক্ষ্মীর বাহন পেচক দেখা যায় । ইহার কারণ ঠিক বলা যায় না। মার্কণ্ডেয়পুরাণের অন্তর্গত চণ্ডী অনুসারে দেবগণের যে বাহন, তাঁহাদের শক্তিরূপিণী দেবীগণেরও সেই বাহন। সুতরাং বৈষ্ণবীর বাহন গরুড়; সেই হিসাবে লক্ষ্মীর বাহন গরুড় হওয়া উচিত ছিল। পেচককে গরুড়ের স্ত্রী-সংস্করণ বলিয়াই বোধ হয়। এথেন্সের পুর্বলক্ষ্মী বা রক্ষয়িত্রী এথেন দেবীর প্রিয় পক্ষীও পেচক।
দেবী-ভাগবতে আছে যে, লক্ষ্মী নানা মূৰ্ত্তিতে নানা স্থানে অবস্থান করছেন। স্বৰ্গধামে তিনি স্বৰ্গলক্ষ্মী, এই লক্ষ্মীর অভাবে ইন্দ্র শ্ৰী-ভ্রষ্ট হয়েছিল। রাজভবনে তিনি রাজলক্ষ্মী, এইজন্যই পরমভাগবত। গুপ্তরাজগণ মুদ্রায় লক্ষ্মীচিহ্ন অঙ্কিত করেছিলেন। আর মর্ত্ত্যলোকে তিনি গৃহলক্ষ্মী- এই মূৰ্ত্তিতে তিনি এখনও হিন্দুগৃহে বিরাজ করছেন।

(মাসিক বসুমতী, অগ্রহায়ণ) শ্ৰী ক্ষেত্ৰগোপাল মুখোপাধ্যায় এর লক্ষ্মী বিষয় ইতিবৃত্ত থেকে সংকলিত- #কৃষ্ণকমল

Leave a comment

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.