ঋগ্বেদ সংহিতা-ভূমিকা- তৃতীয় পরিচ্ছেদ।(প্রথম ভাগ)


ওঁ

ঋগ্বেদ সংহিতা

ভূমিকা-তৃতীয় পরিচ্ছেদ।

(প্রথম ভাগ)

বেদ-পরিচয়।

[পল্লবগ্রাহিতার(ভাসা ভাসা জ্ঞান) কুফল;- বেদ অধ্যয়নে অশেষ জ্ঞান আবশ্যক; -ষড়বেদাঙ্গ;- শিক্ষা-এতে কি জ্ঞান লাভ করা যায়, তার মর্ম;- কল্প, ব্যাকরণ, নিরুক্ত, ছন্দ;-ঐ সকলের সারমর্ম; পদ, ক্রম, জটা, ঘন প্রভৃতি;- বেদে সাম্যভাব,-ঋগ্বেদের মন্ত্রে সাম্যভাবের বিকাশ; -বেদ বিষয়ে শাস্ত্রগ্রন্থের অভিমত- বিভিন্ন শাস্ত্রে বিভিন্ন মত পরিব্যক্ত;-বেদ বিভাগ,-সেবিষয়ে বিভিন্ন পদ্ধতি; -ঋগ্বেদ, সামবেদ, যজুর্ব্বেদ, অথর্ব্ববেদ;-কোন্‌ বেদে কি কি বিষয় আলোচিত হয়েছে; বেদপরিচয়ে বিবিধ বক্তব্য।]

পল্লবগ্রাহিতার(ভাসা ভাসা জ্ঞান) কুফল-

ভাসা ভাসা জ্ঞান মানুষের সাধারণ প্রবৃত্তি। বিষয়-বিশেষে গভীরভাবে মনযোগী হওয়া- সাধারণতঃ মানুষের রুচি-প্রকৃতি-বিরুদ্ধ। মানুষ সকল বিষয়ই ভাসাভাসা বা উপর-উপর বুঝতে চায়। এই যে বেদ-যে বেদ নিয়ে যুগ-যুগান্ত ধরে অনন্ত-কোটি মানুষের মস্তিষ্ক বিঘূর্ণিত হয়ে গেল, সেই বেদ-বিষয়েও মানুষের সেই পল্লবগ্রাহিতা(ভাসা ভাসা জ্ঞান)-প্রবৃত্তির অসদ্ভাব নেই। বেদ কি এবং বেদে যে কি আছে, সকলেই এক কথায় তার স্থূল-মর্ম জানতে চান। বেদ কি-এক কথায় উত্তর পেলে অনুসদ্ধিৎসু চিত্ত যেন শান্তি লাভ করে। তাই উত্তরও অনেক সময় যথেচ্ছভাবে দিয়ে থাকে। যার যতটুকু অভিজ্ঞতা, তিনি সেরূপ উত্তরই দিয়ে থাকেন। বিশাল মহাসাগরের গভীরতা নির্ণয় করার উদ্দেশ্যে অভিগমন করে যে জন অর্ধেক পথ হতে প্রত্যাবৃত্ত হয়েছে, মহাসাগর সম্বন্ধে সে একরকম উত্তর দিবে; যে সমুদ্রতীরে পৌঁছেছিল, সে অন্য আরেক রকম উত্তর দিবে; আবার যে মধ্য-সমুদ্রে অবগাহন করেছিল, সে এসে আর এক প্রকার উত্তর দিবে। এরকম বিভিন্ন জনের নিকট বিভিন্ন প্রকার উত্তরই পাওয়া যাবে। তারপর, সে উত্তর যদি এক কথায় পাবার আকাঙ্ক্ষা কর, তাতে যে স্বরূপ-তত্ত্ব কতটুকু প্রকাশ পাবে, তা সহজেই বোধগম্য হয়। এই সকল কারণেই, এক কথায় উত্তর দিতে গিয়ে, পৃথিবীর পরম-পূজ্য বেদকে কেউ বা ‘চাষার গান’ বলে ঘোষণা করে গেছেন। এতই দুর্ভাগ্য আমাদের।

বেদ অধ্যয়নে অশেষ-জ্ঞান আবশ্যক-

বেদ বিষয়টি এতই জটিল, এতই গুরুতর যে, যতই সংক্ষেপে তার বিষয় আলোচনা করা যাক, যতই এক-কথায় তাকে বুঝার প্রয়াস পাওয়া যাক; বক্তব্য বিষয় স্বতঃই বিস্তৃত হয়ে পড়ে। আমরা প্রতিপন্ন করেছি, বেদ শব্দের অর্থ-জ্ঞান। বেদ কি-এক কথায় তার সংজ্ঞা প্রকাশ করতে গেলে, জ্ঞান ভিন্ন তাকে অন্য আর কি বলতে পারি? তবে সে জ্ঞান-কি জ্ঞান, কেমন জ্ঞান, সেটাই বিশেষ অনুধাবনের অনুভাবনার বিষয়। সে জ্ঞান লাভ করতে হলে-সে জ্ঞানে জ্ঞানী হবার আকাঙ্ক্ষা করলে বড় আয়াস- বড় প্রযন্ত প্রয়োজন। সে চেষ্টা- সে প্রযন্ত মানব-সাধারণের অধিগম্য নয়। তাই বেদ আলোচনায় বেদ অধ্যয়নে অশেষ প্রতিবন্ধক কল্পনা করা হয়েছে। বলা হয়েছে; -স্ত্রী-শুদ্র-অব্রাহ্মণ বেদপাঠে অনধিকার। জ্ঞানরাজ্যে প্রবেশ করবার অধিকার সকলের আছে; স্বয়ং বেদই সে সাম্যবাদ ঘোষণা করছেন। সেই অনুসারে স্ত্রী-শুদ্র-অব্রাহ্মণ কারও বেদপাঠে অনধিকার নেই সত্য। কিন্তু তথাপি কেন, বেদ অধ্যয়নের পক্ষে নানা প্রতিবন্ধকতার প্রশ্রয় দেওয়া হয়? কেন’ই বা অধিকারী অনধিকারীর প্রসঙ্গ নিয়ে মস্তিষ্ক আন্দোলিত হয়ে থাকে? তার কারণ যথেষ্ট আছে। পাহাড়ের উপর আরোহণ করতে হলে প্রথমে পাহাড়ের নীচের দিকে উপস্থিত হতে হয়; পরে মধ্যভাগে, পরিশেষে শীর্ষদেশে উঠবার প্রয়াস প্রয়োজন হয়। কেউই একেবারে তুঙ্গশৃঙ্গ স্পর্শ করতে সমর্থ হন না। বেদরূপ জ্ঞান লাভ করতে হলেও তেমনি স্তরে স্তরে অগ্রসর হওয়ার আবশ্যক হয়। হঠাৎ একটি সূক্ত বা ঋক্‌ কন্ঠস্থ করতে পারলেই এবং সেই অংশের একটা যথেচ্ছ অর্থ স্থির করতে পারলেই যে বেদ অধ্যয়ন সম্পন্ন হয়, তা নয়। বেদ অধ্যয়ন করতে হলে, সর্ব প্রথমে বেদাঙ্গে অভিজ্ঞতা-লাভ প্রয়োজন। বেদ যে অনাদি অনন্তকাল হতে অভ্রান্ত প্রমাণ মধ্যে পরিগণিত হয়ে আসছে, আর যে উহা অক্ষত অপরিবর্ত্তিত ভাবে বিদ্যমান রয়েছে, বেদাঙ্গে অভিজ্ঞ হতে পারলে’ই তা বোধগম্য হতে পারে। অক্ষয় বেদাঙ্গ-সূত্র, অক্ষয় মণি-মালার ন্যায়, বৈদিক সূক্ত-সমূহকে গেঁথে রেখেছে। সুতরাং বেদাঙ্গ-তত্ত্ব আগে অনুশীলন করতে না পারলে বেদ-মধ্যে প্রবেশ করবে-সাধ্য কি?

ষড়বেদাঙ্গ-

বেদকে বুঝার জন্যই বেদাঙ্গের প্রবর্তনা। উহা ‘ষড়ঙ্গ’ নামে অবহিত হয়ে থাকে। শিক্ষা, কল্প, ব্যাকরণ, নিরুক্ত, ছন্দঃ ও জ্যোতিষ- এই ষড়ঙ্গের মধ্য দিয়েই নিগূঢ় বেদতত্ত্ব নিষ্কাষিত করতে হয়। এই ষড়ঙ্গ ভিন্ন বেদ-পাঠের সহায়তাকারী আরও কতগুলি পাঠ্য-গ্রন্থ আছে। পদ, ক্রম, জটা, ঘন প্রভৃতি বিষয়ক জ্ঞান সেই সকল গ্রন্থে লাভ করা যায়। তারপর আছে, ব্রাহ্মণ, আরণ্যক, উপনিষৎ, দর্শন, পুরাণ, উপপুরাণ। জ্ঞান-বুদ্ধির তারতম্য অনুসারে এদের এক একটির মধ্য দিয়ে বেদ-রূপ অনন্ত রন্তাকরের মধ্যে প্রবেশ করতে হয়। যাঁরা অল্প বুদ্ধি সম্পন্ন, যাঁরা সমুদ্রের তীরেও পৌঁছাতে পারে নি, তারা কি করে সে জ্ঞান-রত্নাকরের অভ্যন্তরে প্রবেশ করার আশা করতে পারে? বেদ অধ্যয়ন করতে হলে অভিজ্ঞ হতে হবে-ষড়ঙ্গে। ষড়ঙ্গের প্রথম অঙ্গ-শিক্ষা। শিক্ষা-শিখাবে বর্ণ; শিক্ষা-শিখাবে স্বর; শিক্ষা-শিখাবে মাত্রা; শিক্ষা-শিখাবে বল; শিক্ষা-শিখাবে সাম। বর্ণ, স্বর, মাত্রা, বল ও সাম-শিক্ষা এই বিষয়ে-পাঁচ প্রকার শিক্ষা দেয়। যদি অকার আদি বর্ণের জ্ঞান না থাকে; যদি উদাত্তা আদি ত্রিবিধ স্বর অনুধাবন করতে অনভিজ্ঞ হও; হ্রস্ব মাত্রা, দীর্ঘ-মাত্রা প্রভৃতির জ্ঞান যদি না জন্মে; উচ্চারণ-স্থান আদির এবং সাম্য-গুণ আদির অভ্যাস যদি তুমি না করে থাক; বৃথাই তোমার বেদ অধ্যয়ন হবে। অ আ ক খ ইত্যাদি স্বর ও ব্যঞ্জন ভেদে বর্ণ দ্বিবিধ। শিক্ষা-গ্রন্থ এই বর্ণজ্ঞানের শিক্ষা দেয়। উদাত্ত, অনুদাত্ত, স্বরিৎ- স্বর এই ত্রিবিধ। উদাত্ত-উচ্চ স্বর; অনুদাত্ত-নীচ স্বর; স্বরিৎ-উভয় স্বরের মধ্যবর্তী স্বর। এই ত্রিবিধ স্বরের জ্ঞান না থাকলে, বেদমন্ত্র উচ্চারণ করতে গেলে, স্বর-বিকৃতি দোষ ঘটে। সে দোষে শুভ কামনায় মন্ত্র উচ্চারণে অশুভ ফল সঙ্ঘটিত হতে পারে। শাস্ত্রে এ বিষয়ে প্রশস্ত দৃষ্টান্তের উল্লেখ আছে। “ইন্দ্র শত্রুর্বর্দ্ধস্ব”- পাঠ-বিপর্য্যয়-হেতু এই মন্ত্র বিপরীত ফল প্রদান করেছিল। আদ্যোদাত্ত পাঠে এই মন্ত্রে এক ফল; আর অন্তোদাত্ত পাঠে এই মন্ত্রে আর এক ফল। প্রথমোত্ত পাঠে তৎপুরুষ সমাস বিধায়, অর্থ হয়-ইন্দ্রের শত্রুবৃদ্ধি হোক। আর শেষোক্ত পাঠে, আদ্যোদাত্ত হেতু, বহুব্রীহি সমাস বিধায় অর্থ হয়- ইন্দ্রের শত্রু বিনষ্ট হোক। উচ্চারণের বিভিন্নতা-হেতু এমনই অর্থ-বিপর্য্যয় ঘটে থাকে। এই জন্যই ঋক্‌-সমুহের উচ্চারণের উপযোগী চিহ্ন-স্বরলিপি-সমূহ-ব্যবহৃত হতে দেখি। এখনকার স্বর-বিজ্ঞানে স-ঋ-গ-ম-প-ধ-নি অর্থাৎ ষড়ঙ্গ, ঋষভ, গান্ধার, মধ্যম, পঞ্চম, ধৈবত, নিষাদ-এই সপ্ত স্বর প্রচলিত। অধুনা-প্রচলিত এই সপ্ত স্বর সেই বৈদিক স্বরত্রয় হতেই উদ্ভূত হয়েছে, প্রতিপন্ন হয়। উদাত্ত হতে নিষাদ ও গান্ধার, অনুদাত্ত হতে ঋষভ ও বৈধত, স্বরিৎ হতে ষড়ঙ্গ মধ্যম ও পঞ্চম স্বরের উৎপত্তি পরিকল্পিত হয়। উদাত্ত, অনুদাত্ত, স্বরিৎ-এই তিন প্রকার উচ্চারণ-ভেদ বুঝানোর জন্য বৈদিক গ্রন্থ-সমূহে অনেক স্থানে শব্দান্তর্গত বর্ণের উপরে ও নিন্মে বিবিধ রেখা চিহ্ন ব্যবহৃত হয়। সঙ্গীতের স্বরলিপিতে যে সকল চিহ্ন আদি প্রচলিত আছে, তাহা ঐ বৈদিক উচ্চারণ-মূলক রেখা-চিহ্নের অনুসৃতি বলেই মনে হয়। নিন্মে উদাহরণ ছলে ঋগ্বেদের আগ্নেয়-সূক্ত অন্তর্গত প্রথম ঋক্‌টি রেখাচিহ্ন অঙ্কিতরূপে যথাযথ উদ্ধৃত করেছি।

।           । ।            ।

ওঁ অগ্নিমিলে পুরোহিতং যজ্ঞস্য দেবমৃত্বিজং।

।           ।

হোতারং রন্তধাতমং ॥১॥

উদ্ধৃত ঋকের বর্ণ-বিশেষের শীর্ষদেশে যে লম্বমান রেখা অঙ্কিত হয়েছে, তার দ্বারা সে সে বর্ণের উদাত্ত স্বরে উচ্চারণ জানানো হয়েছে। আর, বর্ণবিশেষের নিন্মভাগে যে শায়িত রেখা দৃষ্ট হচ্ছে, তার দ্বারা সে সে বর্ণের অনুদাত্ত স্বরে উচ্চারণ বুঝাচ্ছে, যে যে বর্ণের নিন্মে কোনরকম রেখা অঙ্কন হয় নি, সে সে বর্ণের উচ্চারণ স্বরিৎ বলে বুঝতে হবে। সাধারণতঃ উচ্চারণ-প্রণালী এভাবে নির্দ্দিষ্ট হয়ে থাকে। এতদ্ভিন্ন, মাত্রা আদি বুঝানোর জন্য আরও নানারকম চিহ্ন ব্যবহৃত হয়। মাত্রা ত্রিবিধ;- হ্রস্ব, দীর্ঘ ও প্লুত। ‘কি’ হ্রস্ব, ‘কী’ দীর্ঘ, ‘কি-ই’ প্লুত। রোদনে গানে প্লুত-স্বর বিহিত হয়। উহাকে অতি-দীর্ঘ স্বর বলা যেতে পারে। ‘বল’ বলতে প্রযন্ত ও উচ্চারণ-স্থান বুঝায়। উচ্চারণ স্থান অষ্টবিধ;- কন্ঠ, তালু, মূর্দ্ধা ইত্যাদি। মতান্তরে উচ্চারণ-স্থান আরও অধিক পরিকল্পিত হয়ে থাকে। কিন্তু সেগুলিকে যৌগিক উচ্চারণ-স্থান বলা যেতে পারে। যেমন, কন্ঠ ও তালু হতে উচ্চারিত বর্ণ-কণ্ঠতালব্য ইত্যাদি নামে অভিহিত হয়। প্রযন্ত বলতে ‘চেষ্টা’ বুঝিয়ে থাকে। অল্প, অস্পৃষ্ট ভেদে প্রযন্ত বিবিধ। সাম অর্থাৎ সাম্য বলতে উচ্চারণ-সাম্য বুঝায়। অতি-দ্রুত, অতিশয়-দ্রুত প্রভৃতি দোষ রহিত এবং মাধুর্য গুণ-যুক্ত উচ্চারণ’ই সাম্য। ফলতঃ, যাতে সুস্বরে সকল ভাব ব্যক্ত হয়, উচ্চারণে কোনও বৈষম্য না ঘটে, তাকেই সাম্য বলে। শিক্ষা-গ্রন্থ এই সকল শিক্ষা প্রদান করে।

কল্প, ব্যাকরণ প্রভৃতি।

শিক্ষার পর কল্প, ব্যাকরণ, নিরুক্ত ও ছন্দ প্রভৃতির প্রসঙ্গ উত্থাপন করা যাচ্ছে। আপস্তম্ব, বৌধায়ন, আশ্বলায়ন প্রভৃতি ঋষিগণের প্রণীত সূত্র-সমূহ কল্প-গ্রন্থ নামে অভিহিত হয়। এতে যাগ-প্রয়োগ-বিধি কল্পিত আছে। এজন্যে এর নাম-কল্প-গ্রন্থ। কিরকম প্রণালী-তে যজ্ঞ আরম্ভ হবে, কোন‌ মন্ত্র কখন উচ্চারণ করতে হবে, যজ্ঞের কোন‌ কার্য্য, ঋত্বিক হোতা বা পুরোহিত, কে কি ভাবে সম্পন্ন করবেন;- কল্পসূত্রে তারই উপদেশ দেওয়া হয়েছে। বেদ-রূপ দেহের হস্ত-স্থানীয় বলেই কল্প-সূত্রের মাহাত্ম্য পরিকীর্ত্তিত হয়। ব্যাকরণ কে বেদের মুখ স্বরূপ বলে ঘোষণা করা হয়েছে। ব্যাকরণ ভিন্ন বেদের অভ্যন্তরে প্রবেশ করবে, সাধ্য কি? ব্যাকরণ ভিন্ন অর্থ-নিষ্কাষণ সম্ভপর নয়। অর্থ-জ্ঞান না হলে, বেদ অধ্যয়ন বৃথা, ক্রিয়াকর্ম পণ্ড। বেদের স্বরূপ জানতে হলে, বেদ কি তা বুঝতে হলে, ব্যাকরণ-জ্ঞান প্রথম প্রয়োজন। সে ব্যাকরণ আবার যে-সে ব্যাকরণ নয়। অধুনা-প্রচলিত ব্যাকরণের মধ্যে পাণিনি, মুগ্ধবোধ, কলাপ প্রভৃতি প্রসিদ্ধ। কিন্তু বৈদিক-সাহিত্যের পরিচয়ের জন্য বিভিন্ন ব্যাকরণ প্রবর্তিত ছিল। ‘প্রতিশাখা’(প্রতিশাখ্য) তাঁদের আদিভূত। প্রত্যেক বেদের প্রত্যেক শাখার ভিন্ন ভিন্ন প্রতিশাখা ছিল। সে সকল এখন বিলুপ্ত প্রায়। এখন মাত্র তিন বেদের তিনটি প্রতিশাখা পাওয়া যায়। ঋগ্বেদের প্রতিশাখা-মহামুনি সনক কর্তৃক প্রবর্তিত হয়েছিল। শুক্ল-যজুর্ব্বেদের প্রতিশাখা কাত্যায়ন প্রণয়ন করেন। কৃষ্ণ-যজুর্ব্বেদের একটি শাখা-প্রবর্ত্তকের মধ্যে বাল্মীকি নাম দেখতে পাই। উচ্চারণ, ছন্দঃ প্রভৃতির প্রসঙ্গ প্রতিশাখায় উত্থাপিত। প্রতিশাখাই প্রকারান্তর বৈদিক ব্যাকরণ। প্রতিশাখা সমূহের অনুসরণে পাণিনি, কাত্যায়ন, বাড়ি, গালব, ভাগুড়ী, পাতঞ্জল, বর্ষ প্রভৃতি বৈয়াকরণ ব্যাকরণ-রচনায় প্রসিদ্ধতা সম্পন্ন হন। তবে তাঁদের ব্যাকরণ অনুসারে পরবর্ত্তি বৈয়াকরণ ব্যাকরণ-রচনায় প্রসিদ্ধ সম্পন্ন হন। তবে তাঁদের ব্যাকরণ অনুসারে পরবর্ত্তি কালে যে ভাষা প্রবর্ত্তিত হয়, সে ভাষা বেদের ভাষা হতে স্বতন্ত্র হয়ে পড়ে। পাণিনি প্রভৃতির পূর্বেও বহু বৈদিক বৈয়াকরণ বিদ্যমান ছিলেন। তাঁদের মধ্যে অপিশালী, কাশ্যপ, গার্গ্যেয়, গালব, শত্রুবর্ম্মণ, ভারদ্বাজ, সাকল্য, সেনাকাশ, স্ফোটায়ন প্রভৃতির নাম অনুসন্ধান করে পাওয়া যায়। বলা হয়, তখন সন্ধি, সুবন্ত, তদ্ধিত প্রভৃতি শিক্ষার জন্য ভিন্ন ভিন্ন  গ্রন্থ অনুসন্ধান করতে হত। পাণিনি সেই সমস্ত বিষয় একত্রে সূত্র আকারে নিবদ্ধ করেন। বেদাঙ্গের অপর গ্রন্থের নাম-নিরুক্ত। বৈদিক শব্দের ও বৈদিক-বাক্য সমূহের অর্থ নিরুক্ত গ্রন্থে বিশদীকৃত হয়েছে। অর্থ-বোধের জন্য নিরুক্তকারদের মধ্যে যাস্ক ঋষিই অধুনা প্রসিদ্ধি-সম্পন্ন। স্থৌলাষ্ঠীবী, ঔর্ণবাভ, শাকপূণি প্রভৃতি প্রণীত নিরুক্ত গ্রন্থেরও উল্লেখ দেখতে পাওয়া যায়। নিরুক্ত-গ্রন্থকে বেদের শ্রবণ ইন্দ্রিয় বলে পণ্ডিতগণ ঘোষণা করে থাকেন। নিরুক্তের পর ছন্দঃ গ্রন্থ। শিক্ষা বা স্বর-বিজ্ঞানের পর ছন্দঃ-জ্ঞানের উপযোগিতা অনুভূত হয়। ছন্দঃ- গ্রন্থের বীজ-বেদে, অঙ্কুরোদগম-আরণ্যকে, শাখা-প্রশাখা-উপনিষদে। ছন্দঃ-জ্ঞান ভিন্ন, রস-গুণ-দোষ উপলব্ধি হয় না; ছন্দঃ-জ্ঞান ভিন্ন উচ্চারিত শব্দ-সমূহ হৃদয়ে প্রবেশ করে না; তাই ছন্দের প্রাধান্য পরিকীর্ত্তিত হয়। বেদে প্রধানতঃ সাতটি ছন্দের উল্লেখ দেখতে পাই;- গায়ত্রী, উষ্ণিক, অনুষ্টুপ, বৃহতী, পংত্তি, ত্রিষ্টুভ, জগতী। সন্ধ্যাবন্দনায় ব্রাহ্মণ-মাত্রেই এই সকল ছন্দের পরিচয় পেয়ে থাকেন। চব্বিশ অক্ষরে(বা স্বরবর্ণে) তিন চরণে নিবদ্ধ যে ছন্দঃ, তাই গায়ত্রী। উষ্ণিক ছন্দে আটাশটি অক্ষর, অনুষ্টুপে বত্রিশটি, বৃহতীতে ছত্রিশটি, পংক্তিতে চল্লিশটি ছন্দঃ, ত্রিষ্টুভে চুয়াল্লিশটি এবং জগতীতে আটচল্লিশটি অক্ষর আছে। বেদ-ব্যবহৃত এই সাতটি ছন্দঃ ‘দৈবিক ছন্দঃ’ নামে অভিহিত। মহর্ষি কাত্যায়ন তাঁর ‘সর্ব্বানুক্রমনিকা’ গ্রন্থে এই সাতটি দৈবিক ছন্দের উল্লেখ করে গেছেন। পিঙ্গলাচার্য্য প্রভৃতি বিরচিত ছন্দঃ গ্রন্থ এককালে প্রসিদ্ধ সম্পন্ন ছিল। পিঙ্গলাচার্য্যের ছন্দঃ-গ্রন্থ-ছন্দঃ-মঞ্জরী-প্রাচীন ও প্রসিদ্ধ। পণ্ডিতগণ ঐ গ্রন্থকে বেদের পদস্বরূপ বলে কীর্ত্তন করেছেন। বেদ-ব্যবহৃত ছন্দের নাম-দৈবিক ছন্দঃ; আর বেদের পরবর্ত্তিকালে যে সকল ছন্দঃ বিরচিত হ্য়েছে, তার নাম-লৌকিক ছন্দঃ। মহর্ষি বাল্মীকি লৌকিক ছন্দের প্রবর্ত্তক বলে কথিত হন। ‘মা নিষাদ’ ইত্যাদি লৌকিক ছন্দের আদিভূত। তার পরে সংস্কৃত-সাহিত্যে অধুনা দুই শতাধিক ছন্দঃ প্রচলিত হয়েছে। তন্মধেও পঞ্চাশ প্রকার ছন্দঃ সাধারণতঃ ব্যবহৃত হয়ে থাকে। যাহোক, বেদ অধ্যয়নে ছন্দঃ প্রভৃতির জ্ঞান যে একান্ত আবশ্যক, তা বলাই বাহুল্য। ষষ্ঠ বেদাঙ্গ-জ্যোতিষ। যার দ্বারা সূর্য্য আদি গ্রহের অবস্থান বিষয়ে জ্ঞানলাভ হয়,-গ্রহ আদির গতি-স্থিতি প্রভৃতি বিষয়ে অভিজ্ঞতা জন্মে, তারই নাম-জ্যোতিষ শাস্ত্র। বেদবিহিত যজ্ঞ-কর্ম সম্পন্ন করতে হলে, জ্যোতিষ-শাস্ত্রের জ্ঞানলাভ বিশেষ প্রয়োজন। কোন সময়ে কোন কর্ম আরম্ভ করতে হবে, কোন্‌ সময়ে কোন্‌ কর্ম সমাপন করার আবশ্যক, জ্যোতিষ শাস্ত্র সেই জ্ঞান শিক্ষা দেয়। যথা নির্দিষ্ট সময়ে কর্ম আরম্ভ না হলে এবং যথা নির্দিষ্ট সময়ে কর্ম সমাপ্ত না হলে কর্ম পণ্ড হয়ে যায়। তাই জ্যোতিষের এত প্রয়োজন। পরাশর প্রভৃতি ঋষিগণ যজ্ঞের কালাকাল নির্ণয়ের জন্য জ্যোতিষের সূত্র রচনা করে গেছেন। পণ্ডিতগণ জ্যোতিষ শাস্ত্রকে বেদের চক্ষু-স্থানীয় বলে কীর্ত্তন করে থাকেন।  

পদ, ক্রম, জটা, ঘন প্রভৃতি।

পদ, ক্রম, জটা, ঘন প্রভৃতি আরও বহু জ্ঞাতব্য বিষয়ে বেদ অধ্যায়ীর অভিজ্ঞতা-লাভ আবশ্যক। মন্ত্রে সন্ধি-সূত্রে বহু পদ পরস্পর গ্রথিত আছে। সন্ধিসূত্র বিচ্ছিন্ন করে সেই সকল পদকে স্বতন্ত্র ভাবে বিন্যস্ত করাকে পদ, পদপাঠ বা পদবিশ্লেষণ বলে। পদবিশ্লেষণ ভিন্ন, কোন্‌ শব্দ কিভাবে অবস্থিত আছে,- সে জ্ঞান লাভ ব্যতীত, কেমন করে বেদের মধ্যে প্রবেশ করতে সমর্থ হবে? আগ্নেয়-সূক্তের যে প্রথম ঋক্‌, তারই প্রসঙ্গ উত্থাপন করছি। স্বর-প্রসঙ্গ ঋক্‌টি উদ্ধৃত করছি। পদ-বিশ্লেষণ করলে, তা নিম্নরূপে বিন্যস্ত করা যেতে পারে। যথা,-

।           ।         ।

ওঁ অগ্নি। ঈলে। পুরঃহহিতং। যজ্ঞস্য। দেবং। ঋত্বিজং।

।               ।

হোতারং। রত্নহধাতমং ॥১॥

সন্ধি-বিচ্ছেদের পর কোন পদ কেমন ভাবে অবস্থিত ও উচ্চারিত হয়, উক্ত দৃষ্টান্তে তা বোধগম্য হবে। ক্রম, জটা ও ঘন বিষয়ে প্রসিদ্ধ বেদ-ব্যাখ্যাতা রমানাথ সরস্বতী কৃত ঋগ্বেদ গ্রন্থের  অনুক্রমণিকা অংশ সংক্ষপে যা লিখেছেন, নিন্মে সেই অংশ উদ্ধৃত করা গেল। যথা-

ক্রম। -কোন্‌ পদের পর কোন পদ উচ্চারণ করতে হবে এবং কোন্‌ মন্ত্রের কোন্‌ পদ শেষ হলে কোন্‌ মন্ত্রের কোন্‌ পদ উচ্চারিত হবে, তা ক্রম-গ্রন্থে নিরুপন হয়েছে। ক্রম-পাঠ বহুবিধ;-পদক্রম, বর্ণক্রম প্রভৃতি। যথা, ঋগ্বেদের প্রথম মন্ত্র- ‘অগ্নিমীলে পুরোহিতং যজ্ঞস্য যজ্ঞস্য দেবং দেবং ঋত্বিজং’ ক্রম অনুসারে পাঠ করতে হলে ‘অগ্নি ঈলে ঈলে পুরোহিতং পুরোহিতং যজ্ঞস্য যজ্ঞস্য দেবং দেবং ঋত্বিজং’ ইত্যাদি পদক্রম এবং ‘অগ্নি গ্নিমী মীলে লেপু পুরো রোহি’ ইত্যাদি বর্ণক্রম।

জটা।-জটাপাঠ ক্রমপাঠ অপেক্ষাও কৃত্রিম এবং যত্নে রচিত। যথা,- পূর্বে উদ্ধৃত ঋগ্বেদের প্রথম মন্ত্র ‘অগ্নিং ঈলে ঈলে অগ্নিং অগ্নিং ঈলে ঈলে পুরোহিতং পুরোহিতং ঈলে ঈলে পুরোহিতং ঈলে ঈলে পুরোহিতং পুরোহিতং যজ্ঞস্য যজ্ঞস্য পুরোহিতং পুরোহিতং যজ্ঞস্য ইত্যাদি।’ প্রত্যেক পদদ্বয়ের তিন বার আবৃত্তি করতে হবে এবং দ্বিতীয় বার আবৃত্তির সময় দ্বিতীয় পদটি প্রথমে ও প্রথম পদটি তার পরে পাঠ করতে হবে।

ঘন। পূর্ব্বোক্ত অনুরূপ আর এক প্রকার বৈদিক মন্ত্রের পাঠ আছে, তাকে ঘনপাঠ বলে। ‘অগ্নিং ঈলে, ঈলে অগ্নিং, অগ্নিং ঈলে পুরোহিতং পুরোহিতং ঈলে অগ্নিং অগ্নিং ঈলে পুরোহিতং। ১) ঈলে পুরোহিতং, পুরোহিতং ঈলে, ঈলে পুরোহিতং যজ্ঞস্য পুরোহিতং ঈলে, ঈলে পুরোহিতং যজ্ঞস্য। ২) পুরোহিতং যজ্ঞস্য, ইত্যাদি প্রত্যেক পদ হতে এক একটি ঘনপাঠ হয়। এতদ্ভিন্ন অন্য নানা প্রকার পাঠের নিয়ম থাকতে পারে। ইত্যাদি কারণ বশতঃ বেদের পাঠভেদ দূরে থাকুক, অক্ষর-মাত্রেরও ব্যতিক্রম ঘটার সম্ভাবনা নেই।

Leave a comment

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.