শ্রীভগবান গীতায় বলেছেন ‘আমার চোখ কান আদি সর্বস্থানেই আছে,’ এর ভাব উপলব্ধি করতে পারছি না।


উত্তরঃ চোখ কান আদি ইন্দ্রিয়দের দ্বারা যে দেখা ও শুনার কাজ হয় প্রথমে তার মূল কি- তা হৃদয়ঙ্গম কর, মৃত্যুর পরে চোখ-কান অবয়ব বর্তমান থাকতেও যখন কেউ দেখতে বা শোনতে পায় না তখন এটা নিশ্চিত যে, কেবল চোখ-কান’ই দেখা-শোনার কর্তা নয়, এরা দ্বার স্বরূপ উপলক্ষ্য মাত্র। ঘরের ভিতরের মানুষ দ্বার খুলে বাইরের বস্তু দেখে বা শোনে, কিন্তু সেই মানুষ যখন ঘরের বাইরে যায়, তখন কেবল দ্বারের যেমন দেখা বা শোনার শক্তি থাকে না, তেমনি সেই সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম চৈতন্য বস্তু যা জীবদেহে অণূ রূপে বিরাজমান আছেন, যাঁর শক্তি মন বুদ্ধিতে প্রতিবিম্বিত হয়ে ইন্দ্রিয়দের পরিচালিত করছে, যিনি দেখা-শোনা সকল শক্তির কেন্দ্র স্বরূপ, যে অনোরণীয়ান্‌(ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জীবাত্মা-রূপে অণোরণীয়ান্‌) চৈতন্যের মহান্‌ জ্যোতিঃ প্রাণের চালক রূপে দেহভাণ্ডের মধ্যে ব্যাপ্ত, তিনিই জগৎ ব্রহ্মাণ্ডে মহতোমহীয়াণ(জগদাত্মারূপে মহতোমহীয়ান) রূপে পৃথিবী আদি পঞ্চভূতের প্রাণ স্বরূপে বিরাজমান আছেন জানবে। অতএব অণুতে যে শক্তি নিহিত আছে, অণূর সমষ্টি সরূপ বিরাটে তা অনন্ত ভাবে থাকবেই, সূক্ষ্ম জ্ঞান দৃষ্টির অভাবে যদিও আমরা সেই সর্বব্যাপী চৈতন্য সত্ত্বাকে প্রত্যক্ষ করতে পারি না, কিন্তু সময় বিশেষে সংসার সাগরের ঘুর্ণাবর্ত্তে পড়ে যখন মোহ জনিত অহঙ্কারের অসারতা বোধ হয়, চিন্তা শ্রোত যখন নশ্বর জগতের অতীত স্থানে চলে যায়, তখন কার্য দেখে কারণের ভাব উপলব্ধি হয় মাত্র, ফলত সাধনার দ্বারা জ্ঞানদৃষ্টির উন্মেষ না হলে পেচকের সূর্য্যালোক দেখার মত চৈতন্য জ্যোতি কে প্রত্যক্ষ করতে পারা যায় না, যুক্তির দ্বারা পরোক্ষ বোধ হয় বটে কিন্তু প্রত্যক্ষ করতে না পারলে তিনি যে সর্বদ্রষ্টা তার অপরোক্ষ বোধ হতে পারে না, পরোক্ষ বোধ আচ্ছন্ন হতে পারে কিন্তু অপরোক্ষ বোধে সে ভয় নেই।
শ্রবণের দ্বারা যে পরোক্ষ জ্ঞান অর্জন করেছ, সাধনের দ্বারা সেটাকে অস্থিমজ্জাগত করে যদি অপরোক্ষ জ্ঞান বা নিশ্চয়াত্মিকা বুদ্ধিতে পরিণত করতে পার, তবে চৈতন্য বিভূতির রসাস্বাদ করতে সক্ষম হবে ও ক্রমে এই রস পান করার লালসা যত বৃদ্ধি হবে, ভাব স্রোতে হৃদয় ততই পূর্ণ হতে থাকবে, পরে ভাবের পূর্ণতা হলে সেই রসের উৎস স্বরূপ শ্রীভগবানকে চাক্ষুষ প্রত্যক্ষ করতে সক্ষম হবে।

প্রশ্ন- শেষ কথাটি ভাল বুঝতে পারলাম না।

উত্তর- ভাই! লবনের সত্ত্বা সমুদ্র জলের সর্বস্থানে ব্যাপ্ত, যে কোন স্থান থেকে জল নিয়ে জিহবায় দিলে আস্বাদ পাওয়া যায় ও এই আস্বাদ পাওয়াকে অনুভব প্রত্যক্ষ বলে, কিন্তু সেই লবণকে চাক্ষুষ প্রত্যক্ষ করতে হলে যেমন তাপের আবশ্যক হয়, তেমনি পঞ্চভূতের প্রতি অণুতে যে চৈতন্য সত্ত্বা বিদ্যমান আছে, অপরোক্ষ জ্ঞানের দ্বারা তাঁর সেই সর্বব্যাপিত্ব ও সর্বশক্তি মত্ত্বার প্রত্যক্ষ্যানুভব হয়, সাধক এই সময়ে রসলোলুপ হয়ে ভাবাশ্রয় করলে ঐ ভাবের তাপে চিৎ পরমাণু সকল ঘণীভূত হয়ে সাধকের বাসনা অনুযায়ী আকার ধারণ পূর্বক চাক্ষুষ প্রত্যক্ষের বিষয়ীভূত হন।

ক্রমশঃ
শ্রীহরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়।

Leave a comment

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.